যেখানে মন হারায় পর্ব-২০+২১

0
13

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat
২০.

নাবিলের বিয়ে শেষ হলো ঝামেলা ছাড়াই।রিফাকে বউ বানিয়ে ঘরে নিয়ে এলো নাবিল।বাড়ি ভর্তি মানুষ।নতুন বউ দেখার জন্য হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছে।নাবিলের ঘরে রিফাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।সেখানেই সব মহিলারা জ্যাম বাজিয়েছে।রুহা ভাবির জন্য একগ্লাস নরমাল পানি নিয়ে হাজির হলো সেখানে।ভাইয়ের কাছ থেকে গেট ধরার টাকা আগেই ছিনিয়ে নিয়েছে সে।
সে ভিড় ঠেলে বলল,

“বাবাগো,কত রাত হয়েছে দেখেছ?আমার ভাইকে বাসর করতে দিবে না তোমরা?সবাই বের হও ঘর থেকে।”

রুহার কথা শুনে সবাই হতবাক।এই পাগল মেয়ে বলে কী?নিজের ভাইকে নিয়ে এসব কেও বলে?রাইমা বোনের কান টেনে ধরে বললো,
“এক থাপ্পড় মারব ফাজিল।বেশি ফটোরফটোর শিখেছিস।”

রুহা জিভ কাটল।রিফাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আপু,তোমার কী খারাপ লাগছে?”

রিফা মাথা নাড়িয়ে না করল।একে একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছু ভাবিরা মিলে রিফার কানে কানে কী যেন ফুঁসুরফুঁসুর করল।রুহা ভ্রু কুঁচকে সে দৃশ্য দেখে বলল,

“তোমরা কানে কানে কী বলো?”

রুহার খালাতো ভাইয়ের বউ ঠোঁট টিপে বলল,

“কী বলি বুঝো না?বাসর কী তোমার হয়নি?বিয়ের এতদিন পরেও এমন প্রশ্ন?”

রুহা মুখ কুঁচকে ফেলল।বলল,
“কী আজব কথা।আমার বাসর রাতে আমি কাউকে পাইনি তাহলে জানব কী করে কী বলছো?”

ভাবি কপাল চাপড়ে এবার সত্যি গলা ছেড়ে বলতে শুরু করল।রুহার চোখ কপালে।নাক ছিঁটকে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুখ চেপে বলল,
“ছিঃ, ভাবি কী বলো এসব?”

“কী বলি মানে?তুমি কী সাধু?এখনো কিছু হয়নি?”

রুহা কথা খুঁজে না পেয়ে তাড়াহুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।ঘরের ভেতর থেকে চাপা হাসির গুঞ্জন শোনা গেলো।
মুরসালীন ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ঠান্ডা পানি খাচ্ছিল।সারাদিন এত কাজ করে শরীর ব্যথা করছে তার।রুহা সামনে এগিয়ে আসতেই মুরসালীন বাউয়ের লজ্জা রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে পিটপিট করে পলক ফেলল।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

“লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”

রুহা ধুম করে মুরসালীনের পাশে বসে পড়ল।ছেলেটা চমকায়।হকচকিয়ে রুহার দিকে তাকাতেই রুহা বলে,
“বউদের সব সময় জামাইদের সামনে লজ্জা পেতে হয়।”

“এই কথা কে বলল?”

“মতিন ভাইয়ের বউ বলেছে।”

“তোকে লজ্জা দেয়ার জন্য আমার চোখই যথেষ্ট।”

রুহা মুখ বাঁকাল।মুরসালীনের শার্টের হাতা টেনে বলল,

“এখন তো কোনো কাজ নেই।চলুন না একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি আমরা।”

“আমার শরীর ব্যথা করছে বউ।পরে একদিন যাব কেমন?”

রুহা মন খারাপ করে মাথা নাড়লো।মুরসালীন বউয়ের অভিমানী মুখ দেখে মিষ্টি হাসল।বউয়ের হাত ধরে বাড়ির বাইরে হাঁটা ধরল।রুহা চমকে ওঠে বলল,

“কী হলো?কোথায় যাচ্ছেন?”

“চল একটু লুকিয়ে প্রেম করি আসি আমরা।”

রুহা হেসে ফেলল।স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটা ধরল।ফাঁকা নয়,মানুষ আছে তবে খুবই কম।এখন ভীষণ রাত হয়েছে।মুরসালীন ঘাড় বাঁকিয়ে বউয়ের জ্বলজ্বলে মুখ খানা দেখে বলল,

“দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছিস কেন?দেখলেই মন কেমন কেমন করে।”

রুহা অবুঝ চোখে তাকাল।বলল,
“কেমন করে?”

মুরসালীন ঠোঁট কামড়ে হাসল।বোকা মেয়ে কিছু বুঝে না।সে মাথা ঝাকিয়ে বলল,
“কথায় নয় কাজে করে দেখাব।”

রুহা আর ঘাটলো না।দুই চড়ুই হাতে হাত রেখে অনেকটা পথ হাঁটল।হাঁটতে হাঁটতে সময় গড়াল বেশ।মুরসালীন রুহার কাঁধ জড়িয়ে ধরে হাঁটছে।অনেকটা পথ নীরবতা চলল দুজনের মাঝে।হঠাৎ মুরসালীন নীরবতা ভেঙে বলল,

“একটা সুন্দর সাধারণ জীবন কাটানোর শখ আমার।তোকে নিয়ে এই গোটা জীবনটা পাড় করতে চাই।আমাদের ঘরে ছোটো ছোটো চড়ুই পাখি হবে।তাদের সাথে তুই সারাদিন ব্যস্ত থাকবি,আর আমি কাজ শেষে বাড়ি ফিরে তোদের দেখে মুচকি হাসবো।তোর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে আমার চড়ুই পাখিদের নিয়ে সারারাত কাটাব।বুকের একপাশে তুই থাকবি,আরেক পাশে ওরা।আমাদের চাওয়া পাওয়া হবে আমরাই।তোর আগমন আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত।এভাবেই পাশে থেকে ভালোবেসে যাস।মৃত্যুর আগ অব্দি আমার চোখে শুধু তোর নাম থাকবে।”

রুহা লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে।এত সুন্দর সুন্দর কথা মুরসালীন বিয়ের আগে কখনো বলেনি।কয়েকদিন আগেও না।এইতো কিছুদিন ধরে এসব কথা বলছে।তার ভীষণ লজ্জা লাগে মুরসালীন যখন বাচ্চা কাচ্চার কথা বলে।সে বুঝতে পারছে না মুরসালীন হঠাৎ এসব কথা কেন বলছে।

মুরসালীন খোলা মাঠ পেরিয়ে উল্টো পথে ঘুরল।বাড়ি ফিরে রুহা রাইমার ঘরে গেলো।বাড়িতে জায়গা নেই তাই এই অবস্থা।রাইমার ঘরে তার কাজিনরাই ছিল।সবাই ঘুমে কাদা।রাইমা বাহারকে ঘুম পাড়িয়ে জামা কাপড় পাল্টে এলো।রুহা বাহারের পাশে শুয়ে ছিলো।রাইমা আসতেই রুহা বলে,

“একটা কথা বলি আপু?”

রাইমা রুহার পাশে শুয়ে বলল,
“বল।”

রুহা বোনের শরীর ঘেঁষে শুলো।কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“মুরসালীন ভাই আজ কাল কেমন যেন অদ্ভুত কথা বলে।”

রাইমা কপাল কুঁচকাল।
“কী বলে?”

“কেমন যেন অদ্ভুত কথা।মানে সব কথায় বাচ্চা টেনে নিয়ে আসেন।”

রাইমা ঠোঁট টিপে হাসল।বোনের নরম গাল টেনে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তোর আদুরে জামাই আব্বা ডাক শুনতে চাইছে।”

রুহা চোখ গোল করে তাকালো রাইমার দিকে।
“আব্বা ডাক মানে?”

“মানে জামাই চায় তুই মা হ, বুঝলি? তোর মতো একটা মিষ্টি বউকে বুকে নিয়ে সংসার করলেই তো হলো না,এবার ছোট্ট একটা পুঁচকে সোনাও চাই তার।তাই সব কথায় বাচ্চার টপিক টেনে আনে।”

রুহা অবাক হয়ে মুখ হাঁ করে তাকাল।গলা নামিয়ে বলল,
“আমাকে তো কখনো বলেনি উনার বাচ্চা চাই।তা ছাড়া এখন মা হব কিভাবে?”

“সব কথা মুখে বলতে হয় পাগল?জামাইয়ের ইচ্ছে সম্পর্কে জানতে হবে না?।যতটা পারিস ওর কাছে কাছে থাকিস।স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যতটা বোঝাপড়া আর ভালোবাসা থাকবে,সংসার ততটাই মধুর হবে।”

রুহা ফিসফিস করে বলল,
“কাছে থাকি তো,তবুও মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে।”

“অদ্ভুত নয় রে পাগলি,ঐ অদ্ভুতটাই হলো ভালোবাসা।যে ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়। তোর মুরসালীন ভাই গম্ভীর মানুষ,কিন্তু তোর জন্যই সে এত মিষ্টি কথা বলে।এটা তুই বুঝবি কিছুদিন পর।”

রুহা বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইল।বুকের ভেতর কেমন অজানা শিহরণ জেগে উঠছে।মনে হচ্ছে সত্যিই,জামাই তাকে শুধু বউ নয়,তার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষ ভেবেই সব স্বপ্নের কথা বলে।

চোখ বুজতে বুজতে নিজের অজান্তেই ঠোঁটে একটুখানি হাসি খেলে গেল।
“আদুরে জামাই?”

#চলবে..?

#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat
২১.

কেটেছে বেশ কয়েকদিন।রুহা আর মুরসালীন এখন নিজেদের বাড়িতেই থাকে।ভাড়া বাসাটা তারা ছেড়ে দিয়েছে।
আজ শনিবার।মুরসালীনের অফ ডে থাকায় সে আজ বাড়িতেই আছে।সে ফ্রেশ হয়ে মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে।হঠাৎ নিচ থেকে হট্টগোলের শব্দ কানে আসতেই সে চিন্তিত হয়ে ঘর থেকে বের হলো।সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল বাশার এসেছে বাড়িতে।কামরুল শেখ রাগারাগি করছেন তার সাথেই।রাইমা বাহারকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরেছে।বাচ্চাটা বাবার কোলে যাওয়ার জন্য চিৎকার করে কাঁদছে।মুরসালীন তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো।রুহার পাশে এসে দাঁড়াল।

নাবিল রাগে রিফার সাথে চিল্লা চিল্লি করছে বাঁধা দেয়ায়।মুরসালীন শান্ত হয়ে লম্বা শ্বাস টেনে কাছে এগিয়ে গেল।বাশারকে বসতে বলল।কামরুল শেখ এবং মুরসালীন পাশাপাশি বসলেন।বাশার চুপচাপ তাদের সামনে বসে।বাহার মায়ের কোল থেকে দাঁপিয়ে নেমে দৌঁড়ে বাবার বুকে ঝেঁপে পড়ল।বাশার ছেলেকে ধরেই মুখে এলোমেলো চুমু খেলো।রাইমার চোখে পানি।বুক ফে টে যাচ্ছে তার।

নাবিল চোয়াল শক্ত করে বলল,
“ও আবার এই বাড়িতে এসেছে কেন?”

বাশার আড়চোখে রাইমার দিকে তাকিয়ে কামরুল শেখকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“বাবা আমাকে হয়তো ক্ষমা করা যায় না।কারণ আমি ক্ষমার যোগ্যই নই।একটা সময় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেশাপানি করেছি দিন রাত।ঘরের বউ বাচ্চা রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে ঘুরেছি।কিন্তু বাবা আপনি বিশ্বাস করুন?আমার মেয়েলি কোনো সমস্যা ছিল না কখনো।আপনার মেয়েকে জিজ্ঞেস করুন?আমি হয়তো অমানুষের মতো তার গায়ে দিনের পর দিন হাত তুলেছি,অবহেলা করেছি,অত্যাচার করেছি কিন্তু কখনো পর-নারীতে জড়িত হইনি।”

বাশার হঠাৎ হাত জোড় করে ধরা গলায় বলল,
“আমি পাপ করেছি বাবা,অন্যায় করেছি।আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দিন।”

“ক্ষমা?কোন মুখে এই কথা বলছ বাশার?আমার এই ফুটফুটে মেয়ের গায়ে হাত তুলেছ,পশুর মতো নির্যাতন করেছ।এত কিছুর পরও তোমায় ক্ষমা করা যায়?”

বাশার মাথা নিচু করল।আজ নিজেকে ভীষণ ব্যর্থ মনে হচ্ছে।কিভাবে কী করবে নিজেও বুঝতে পারছে না।সে বলল,
“আমি বাহারের মায়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

নাবিল গলা চওড়া করে বলল,
“কোনো কথা হবে না।তুমি বের হও বাড়ি থেকে।”

মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আপনারা একটু শান্ত হন।”

তারপর রাইমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাইমা,তুমি কী বাশার ভাইয়ের সাথে আলাদা করে কথা বলবে?”

রাইমা ভীতু চোখে বাবা আর ভাইয়ের দিকে তাকাল।মুরসালীন সেই দৃষ্টি বুঝে বলল,
“বাবা আর ভাইয়ার কথা বাদ দাও।তুমি বলো,কথা বলবে?”

রাইমা মাথা নাড়ায়।মুরসালীন ওদের উপরে পাঠিয়ে দেয়।বাহার বাবু মুরসালীনের কোলে গিয়ে উঠে।রুহা রেগে তাকায় মুরসালীনের দিকে।ও চায়নি আপু ঐ লোকটার সাথে আলাদা করে কথা বলুক।মুরসালীন বউয়ের রাগান্বিত আঁখি দেখেও কিছু বলল না।কামরুল শেখ রাগারাগি করলেন মুরসালীনের সাথে।মুরসালীন শান্ত গলায় বলল,

“মানুষকে লাস্ট একটা সুযোগ দিতে সমস্যা কী চাচা?আপনারা আপনাদের মতামত দিয়ে যাচ্ছেন অথচ রাইমা কী চায় সেটা একবারও ভাবছেন না?আমি বাশার ভাইকে আসতে বলেছিলাম আজকে বিকালে কিন্তু উনি যে সকালেই এসে হাজির হবেন আমি জানতাম না।কয়েকদিন আগে উনার সাথে আমার দেখা হয়েছি ঢলীপাড়া।নিজের ভুল স্বীকার করেছিল।লজ্জায় রাইমার সামনে আসতে পারেনি।সেদিন আমি উনার চোখে দুঃখের,হাহাকারের পানি দেখেছিলাম।

চাচা,আজ অতীত ভুলে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সব নতুন করে শুরু করতে চাইছে,তাহলে আমরা কেন তাকে একটা সুযোগ দিতে পারব না?আমি মানছি সে একটা সময় সত্যি’ই খুব খারাপ করেছে কিন্তু এখন সেই ভুলটা বুঝতে পেরেছে।তাদের একটা সন্তানও আছে।তার তো একটা ভবিষ্যত আছে চাচা।”

“আমার মেয়ে ঐ সংসারে যেতে চাইলে আমি বাঁধা দিব না কিন্তু..কিন্তু বাশার যে আবার এমন করবে না এটার কী গ্যারেন্টি আছে?আমি চাই না আমার মেয়ে আবার নরক যন্ত্রণা সহ্য করুক।”

“আপনি বিশ্বাস রাখেন,এবার আর কিছুই হবে না।”

কামরুল শেখ একটু শান্ত হলেন।রুহা ক্ষিপ্ত হয়ে সেখান থেকে সরে গেলো।
রাইমার ঘরে এই মুহূর্তে বাশার বসে আছে রাইমার পায়ের কাছে।কোলে মাথা রেখে পা জড়িয়ে ধরেছে।চোখে পানি।রাইমা হুহু করে কাঁদছে।যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে।এই মানুষটাকে সে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে।একটা সময় এই লোকটাই তাকে পায়ের কাছে ঠেলে দিয়েছিল।রাইমা লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নিলো।পা ঝাঁকিয়ে বলল,

“পা ছাড়ুন আমার।”

বাশার ছাড়ল না।শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমায় ক্ষমা করা যায় না রাই?আমি ভুল করেছি,আমি বুঝতে পেরেছি সব।আমাকে প্লিজ শেষ একটা সুযোগ দাও।”

“কেন সুযোগ চাইছেন?আপনি তো চাইতেন মুক্তি পেতে,শান্তি পেতে।আমি তো সব দাবি ছেড়ে দিয়েছি।আপনাকে মুক্ত করে দিয়েছি,তাহলে এখন কেন আবার ফিরে এসেছেন?”

রাইমার বুকের ভেতরটা দপদপ করছে।চোখের পানি থামাতে পারছে না।বাশার তার পা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে,যেন এই আঁকড়ে ধরা থেকে সে মুক্তি দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে।
বাশারের গলা ভাঙা,চোখ লাল হয়ে গেছে কান্নায়।

“আমি জানি আমি মানুষ না রাই।আমি জানি তোমার চোখে আমি নোংরা এক অত্যাচারী।কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি সেই বাশার নই আর।তুমি যদি আবার আমায় ফিরিয়ে নাও,আমি তোমার প্রতিটা অশ্রুর দাগ নিজের বুকের ভেতর যত্ন করে রাখব।আমি আর ভুল করব না।আমি কসম করছি আল্লাহর নামে।শেষ একটাবার সুযোগ দাও।”

রাইমা পা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল,বুক ফে টে যাচ্ছে তার যন্ত্রণায়।
কিন্তু বাশার ছাড়ল না,বরং আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মাথা ঝুঁকিয়ে কান্নায় ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর পা।
রাইমা হঠাৎ ভেঙে পড়ল,গলা রুদ্ধ হয়ে বলল,
“আপনি কেন এমন করলেন বাশার?আমি তো আপনাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম।সেই ভালোবাসারই কী কোনো দাম ছিল না আপনার কাছে?”

বাশার কাঁপা গলায় বলল,
“দাম ছিল রাই,আজ আমি বুঝি কতটা দাম ছিল।কিন্তু তখন আমি অন্ধ ছিলাম।আজ আমি শুধু তোমায় চাই, তোমার ক্ষমা চাই, আর চাই আমাদের বাহারকে নিয়ে আবার নতুন করে বাঁচতে।”

রাইমা আবার ছাড়িয়ে নিতে চাইলে বাশার আচমকাই ভিজে আসা ঠোঁটটা তার ঠোঁটে রাখল।
অপ্রস্তুত রাইমা আঁতকে উঠল,বুক ধড়ফড় করে উঠল,চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল।কিন্তু বাশার একটুও ছাড়ল না।
তার চোখের ভেতর কান্নার লোনাজল,অপরাধবোধ আর একরাশ আকুলতার ছোঁয়া।
কয়েক মুহূর্ত পর রাইমা কেঁপে উঠে পা ঝাঁকিয়ে সরে গেল।
শ্বাস নেয়া দায় হয়ে আসছে তার।বাশার ভাঙা গলায় শুধু বলল,
“শেষবারের মতো একটা সুযোগ রাই,প্লিজ?”

রাইমা চোখ মুছে এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।মাথার ভেতর ঢেউ খেলছে অতীতের দুঃসহ স্মৃতি আর বর্তমানের আকুল কান্না।
সে বাশারের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আপনাকে বিশ্বাস করা বড়ো কঠিন বাশার!”

“শেষবার।”

রাইমা লম্বা শ্বাস টানল।বাশার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে রাইমাকে।আজ রাইমা প্রথম বাশারকে এত কান্নাকাটি করতে দেখল।তাও আবার তার জন্য।
____

“আপনি বেশি বুঝেন।ঐ লোকটাকে বাড়িতে কেন ডেকেছেন?”

“রুহা গলা নামিয়ে কথা বল।”

“বলব না আপনি কী করবেন?ঐ লোকের মতো আমার গায়ে হাত তুলবেন?আপনার কাজ দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।যে মানুষটা আমার বোনের জীবনটা পুরো নষ্ট করে দিয়েছে আপনি সেই মানুষটার সাপোর্ট কাটছেন?”

মুরসালীনের মেজাজ খারাপ হচ্ছে রুহার চিৎকারে।উচ্চগলায় কথা বলা তার পছন্দ নয়।আর যদি ঘরের বউ হয় তাহলে তো প্রশ্নই ওঠে না।সে চোখ বুজে শ্বাস টানল।শেষ বার শান্ত গলায় বলল,

“রুহা,আস্তে কথা বল।”

“বলব না আস্তে কথা।”

মুরসালীন এবার ধমকে উঠল।
“বললাম না চুপ করতে?কথা কানে যায় না তোর?গলা উঁচু করে কার সাথে কথা বলিস?বুঝিস কী সম্পর্কের?আমি চুপ থাকতে বলেছি মানে চুপ থাকবি।”

রুহা ভয়ে চমকে উঠল।চোখে টলমলে পানি চিকচিক করছে।মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে গেলেও রাগটা একটুও কমলো না।অভিমানী গলায় বলল,
“আচ্ছা! আপনিও বোধহয় ঐ লোকটার মতো একদিন আমায় এভাবে ধমক দিবেন,গায়ে হাতও তুলবেন? শুধু আমার বোনের জীবনটাই শেষ হলো কেন? আমারটাও শেষ করুণ।”

মুরসালীনের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল।চোখ নামিয়ে ধীর গলায় বলল,
“রুহা,তুই কীসব বলছিস?”

“আমি কিছু ভুল বলিনি।আপনি আজ যেটা করেছেন,সেটা দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমার দুঃখ,আমার বোনের কষ্ট একটুও বুঝেন না।আপনার কাছে যদি বোনের যন্ত্রণা দাম না পায়, তাহলে আমার যন্ত্রণারও কোনো দাম পাবেনা।”

মুরসালীনের গলাটা ভারী হয়ে এলো।চোখ বুজে শ্বাস টেনে কাছে এগিয়ে গেলো।রাগ যেন তিরতিরবি করে বাড়ছে।ঠাটিয়ে রুহার গালের মধ্যে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে তার।তবুও নিজেকে সালমে নিলো।

“ আমি তোকে আঘাত করার কথা ভাবতেও পারি না।”

রুহা ঠোঁট কামড়ে পেছনে সরে গেলো।
“ভালোবাসা মানে কী শুধু সুন্দর সুন্দর কথা বলা? কাজের মধ্যে যদি তার ছাপ না থাকে তবে সেই ভালোবাসা দিয়ে কী হবে? আজ আমার বোনটা যখন কষ্টে আছে,তখন আপনি ওর পাশে দাঁড়ানোর বদলে,যে মানুষটা ওর জীবনটা নষ্ট করেছে তাকেই সুযোগ দিচ্ছেন।এটাই আপনার ন্যায়বিচার?”

মুরসালীনের কপাল ভাঁজ হয়ে গেল।রাগটা গিলে ফেলে শান্ত থাকার চেষ্টা করছে।বুকে হাত রেখে বলল,
“তুই বিশ্বাস কর, আমি কখনো অন্যায়ের পক্ষে নেই।আমি শুধু চাইছিলাম রাইমা নিজে সিদ্ধান্ত নিক।এটা ওর পুরো জীবনের ব্যাপার।আমাদের সিদ্ধান্তকে আমরা ওর উপর চাপিয়ে দিতে পারি না।বুঝতে কেন পারছিস না?”

“না,আমি বুঝব না।আমি চাই না আমার বোনটা আবার কষ্ট পাক।”

মুরসালীন ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে রুহার হাতটা ধরতে চাইলো।রুহা হাত টেনে নিলো।চোখে অশ্রু চিকচিক করছে।
“আমায় ছুঁবেন না।”

মুরসালীন স্থির চোখে তাকাল।গলাটা আরও নরম হলো,
“ছুঁবো না,যদি তুই না চাস।একটা সাধারণ ব্যাপার নিয়ে তুই আজ অনেক সাহস দেখিয়ে ফেলেছিস।একে তো বলদের মতো কথা বলছিস তার উপর আমার সাথেই কাহিনি করছিস।”

রুহা এবার আর ধরে রাখতে পারল না।কান্নায় বুক ভেঙে যাচ্ছে।
“আমি চাই না একটুও আমার বোন আবার ঐলোকটার সংসারে ফিরে যাক।”

মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।বউয়ের রাগ,অভিমান আর কষ্টে ভরা কান্না,সবকিছু ওর বুকের ভেতর তীরের মতো বিঁধছে।
“আচ্ছা, তুই যা বলিস তাই হবে।কিন্তু তুই চুপ কর, কান্না থামা।আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

রুহা মুখ ফিরিয়ে কান্না চেপে ধরলো।মুরসালীন এবার কাছে গিয়ে আস্তে করে ওর ওড়না দিয়ে চোখ মুছে দিল।রুহা হাত টেনে নিতে চাইল, কিন্তু মুরসালীন ছাড়লো না।

“বললাম তো যা বলবি তাই হবে।”

#চলবে…?