#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat
২৩.
রুহার হাত দেখে মুরসালীন মৃদু হাসি টানল ঠোঁটে।রুহার ডান হাত চোখের সামনে ধরে বলল,
“আমার নাম হাতে লিখেছিস ভালো কথা,তাই বলে বানান ভুল?”
রুহা লজ্জায় চোখের দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
“ভালোবাসায় সব ঠিক।বানান ভুল হলে কিছু হয় না মুরসালীন ভাই।ভালোবাসি এটাই বড়ো কথা।”
হেসে ফেলল মুরসালীন।রুহার নাক টেনে দিয়ে বলল,
“সাবধানে চলা-ফেরা করবি রুহা।”
রুহা গাল ফুলিয়ে তাকাল মুরসালীনের দিকে।মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“চলব না,কী করবেন আপনি?”
মুরসালীন মৃদু হেসে রুহার নাকে নাক ঘষে বলল,
“ঝাঁপটে জড়িয়ে রাখব তোকে।কথা কেন শুনিস না?”
রুহা হেসে ফেলল।মুরসালীনের বুকে মাথা রেখে বলল,
“আমার সব কিছু কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।কয়েক বছর আগেও আমি কত পাগল ছিলাম আপনার সাথে প্রেম করবো বলে।আর আজ আমি আপনার বাচ্চার মা হতে চলেছি।”
“আল্লাহ চেয়েছেন বলে এক হয়েছি।শুকরিয়া আদায় কর পাগল।”
রুহার চোখে জল জমে উঠতেই মৃদু হেসে ফেলল। মুরসালীন তার কপালে আলতো চুমু এঁকে দিল। চারপাশ নিস্তব্ধ,শুধু দুজন মানুষের শ্বাসের শব্দে ভরে উঠেছে মুহূর্তটা।
রুহা বলল,
“আমি চাই না এই সুখ থেকে কোনোদিন আলাদা হতে।আপনি সবসময় আমার পাশে থাকবেন,তাই তো?”
মুরসালীন দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল,
“মৃত্যু পর্যন্ত তোকে আঁকড়ে রাখব,বউ।এমনকি যদি আসমান-জমিন ভেঙেও পড়ে,তবু তোকে ছাড়ব না।”
রুহা চোখ মুছে মৃদু হেসে বলল,
“আপনি না থাকলে আমি থাকতেও পারব না।আমার মন,আমার স্বপ্ন,আমার দুনিয়া সবই তো আপনি।”
মুরসালীন হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।দুজনের নীরবতা যেন কথা বলে উঠল।আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে দুজনেই চোখ বুজে রইল।
ভোরের আলো ধীরে ধীরে জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে।নতুন দিনের সূচনা যেন তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনাও বয়ে আনল
যেখানে কোনো ভয় নেই,নেই কোনো আড়াল,শুধু আছে দুটো হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসা।
দিন যাচ্ছে,রুহার অসুস্থতাও বাড়ছে।পেট উঁচু হয়েছে।বাড়ির প্রত্যেকে ভীষণ যত্ন নেয় তার।
ইলমা বেগম সারাদিন রুহার খোঁজখবর রাখেন, যেন কোনো কষ্ট না হয়।নাসরিন বেগমও এ সময়ে তার প্রতি অদ্ভুত নরম হয়ে উঠেছেন।আফনান তো একেবারে পাহারাদার,রুহার পাশে না থাকলে সে শান্তি পায় না।
মুরসালীন প্রতিদিন কলেজ থেকে ফিরেই সোজা চলে আসে স্ত্রীর কাছে।আজও তাই হলো।দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে,রুহা কোলবালিশে হ্যালান দিয়ে বসে আছে।মুখে ক্লান্তি,কিন্তু চোখে মিষ্টি এক ঝলক সুখ।
মুরসালীন এগিয়ে এসে ধীরে বসে বলে,
“আজ কেমন লাগছে?”
রুহা ঠোঁট বাঁকিয়ে মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়,
“যেন বুকের ভেতর দুটো হৃদপিণ্ড একসাথে ধুকপুক করছে।আমারও,আমাদের সন্তানেরও।”
কথাটা শুনে মুরসালীন হেসে ফেলল।সে হাত বাড়িয়ে রুহার পেটে রাখে।নিঃশব্দে দোয়া করে,
“হে আল্লাহ,আমার স্ত্রী আর সন্তানকে হেফাজত করো।”
ফ্রেশ হয়ে এসে বউয়ের পাশে বসে।রুহা পিটপিট করো মুরসালীনের দিকে তাকায়।হঠাৎ কপাল কুঁচকে বলে,
“খবরদার বাইরে মেয়েদের সাথে টাংকি মারবেন না।আপনি অলরেডি এক বাচ্চার বাপ।”
মুরসালীন হতভম্ব হয়ে তাকায়।রুহা হঠাৎ পাগলের মতো এমন কথা বলছে কেন?সে আশ্চর্য হয়ে বলল,
“কী বলছিস এসব?”
“আপনি দিন দিন অনেক সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন।মেয়েরা লাইন মারার চেষ্টা করলে তো সমসা।”
“আমি বাইরে কারো দিকে তাকাই? চোখ তো শুধু আমার বউয়ের জন্য।”
রুহা গাল ফুলিয়ে রাগী গলায় বলল,
“না,আমি আগে থেকে বলে দিচ্ছি।অন্য কেউ আপনাকে দেখে লাইন মারতে আসলে আমি কিন্তু সহ্য করব না।খবরদার,তাকাবেন না।”
মুরসালীন দুষ্টু ভঙ্গিতে কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল,
“তুই যদি এমন হিংসুটে হস,তাহলে তোকে গায়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সারাদিন ঘুরতে হবে।সবাই দেখবে আমি কার।”
রুহা প্রথমে মুখ গম্ভীর করে থাকল,তারপর হেসে ফেলল।
“সত্যি বলেন তো,কেন এত ভালোবাসেন আমায়?”
মুরসালীন তার হাত নিজের হাতে নিয়ে চোখের দিকে তাকাল।
“তুই আমার প্রাণ।তোর ভেতরে এখন আমার রক্ত মাংসেরই অংশ বেড়ে উঠছে।এই ভালোবাসার চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কী চাই?”
রুহার চোখ ভিজে এলো।সে আলতো করে মুরসালীনের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
“তাহলে আমি আপনাকে কষ্ট দিয়ে ঝগড়া করব না।তবে মাঝে মাঝে একটু ঈর্ষা করব,বুঝলেন?”
মুরসালীন হেসে কপালে চুমু খেল।
“ঈর্ষা কর,তবে মনে রাখিস তুই-ই আমার সব।”
ঘরের ভেতর দুজনের হাসি আর দুষ্টুমি ভরে উঠল। বাইরের আকাশে সূর্য ঢলে পড়ছে, ভেতরে এক দম্পতির ভালোবাসার আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে।
____
কয়েকদিন ধরে রিফা বেশ রেগে আছে নাবিলের উপর।কেন রেগে আছে সেটা বেচারা জানে না।আজ সুযোগ বুঝে বলেই ফেলল,
“কী সমস্যা তোমার?কদিন ধরে দেখছি তোমার মুড খারাপ হয়েই চলেছে।”
রিফা রেগে তাকাল।হাতের তোয়ালে নাবিলের মুখের উপর ছুড়ে মেরে বলল,
“একদম কথা বলবে না।যাও সামনে থেকে।”
নাবিল অবাক হলো।বলল,
“মার খেতে ইচ্ছে হয়েছে তোমার?বলবে রেগে কেন আছো?”
রিফা বিরক্ত হয়ে ছলছল চোখে তাকাল।বলল,
“রুহার ৬মাস চলছে।আমি ওর বড়ো ভাবি হয়েও পিছিয়ে গেলাম।আমার কী ইচ্ছে করে না মা হওয়ার?তুমি এমন কেন?একবারও বলো না চলো বাচ্চার প্ল্যান করি।”
নাবিল হতভম্ব হয়ে বউয়ের দিকে তাকাল।এই কারণে বউ রেগে ছিল এতদিন?সে আরও ভেবেছে রিফার হয়তো একটু সময় দরকার।বিয়ে হয়েছে আড়াই বছর হয়ে গেছে।তারও বেশ বয়স হয়েছে।বউয়ের জন্য বাচ্চার কথাটা কখনো বলা হয়নি।হঠাৎ সে শব্দ করে হেসে উঠল।রিফা কপাল কুঁচকে বলল,
“নাবিল,তুমি কিন্তু আমার হাতে মার খাবে এখন।হাসছো কেন?”
নাবিল রিফাকে টেনে নিজের সামনে বসালো।কপালে টোকা মেরে বলল,
“এবার বুঝলাম তোমার রাগের কারণ।আমি ভেবেছি তুমি হয়তো আর একটু সময় চাইছো তাই এই ব্যাপার নিয়ে আর আগাইনি।”
“আর কত সময় নিব?আমার বয়স জানো কত?”
“আচ্ছা হয়েছে।আমাদেরও বাচ্চা হবে।”
রিফা নাবিলের বুকে সিটিয়ে এলো।ধীর কণ্ঠে বলল,
“মা আজকে বলছিল বাচ্চা কাচ্চা তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে।অনেক তো হলো।”
“আল্লাহ চাইলে সব হবে।”
_____
দিন গিয়ে মাস পেরোলো কয়েকটা।এখন রাত প্রায় ১২টা ছুঁইছুঁই।আজ সকালে রুহার কোল আলো করে একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে।গোল মুখ,উজ্জল শ্যামলা গয়ের রঙ,কুটুরকুটুর চোখ।এ যেন পুরো মুরসালীন।বাচ্চাটাকে খাওয়াচ্ছে রুহা।সারাদিন ঘুমিয়ে খানিকক্ষণ আগে জেগেছে।হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে দুই মা ছেলে।ইলমা বেগম বাচ্চাটাকে ধরে রেখেছেন।মুরসালীন ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।হওয়ার পর থেকে যে মায়ের কোলে গেছে,আর আসার নাম নেই।বাপের কোলে এসেছিল মায়ের পেট থেকে বেরোনোর পর।বউয়ের কাছে এখনো ভালো ভাবে যেতে পারেনি সে।
মুরসালীন নাক ছিঁটকাল।শেষে কিনা ছেলেটাও হয়েছে মায়ের মতো বজ্জাত।একটা মেয়ে হলে বোধহয় তার মতো শান্ত,ভদ্র হত।ইলমা বেগম আড়চোখে মুরসালীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“অমন করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?”
রুহা ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর দিকে তাকাল।মুরসালীন রুহার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিছু হয়নি।ওকে বাইরে নিয়ে যাবে কখন?”
“কাকে বাইরে নিব?”
“বাবুকে।”
“খাচ্ছে দেখছিস না?খাওয়া শেষ হোক আগে।”
“তাড়াতাড়ি শেষ করো।”
ইলমা বেগম ঠোঁট চেপে হাসলেন।বাচ্চাকে খাইয়ে কিছুক্ষণ শুইয়ে রেখে কোলে তুলে নিলেন তিনি।মুরসালীনের সামনে এসে বাচ্চাকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“নে,একটু আদর করে দে।”
মুরসালীন ছেলেকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।বাচ্চাটা গোল গোল চোখে বাবার বদন দেখে ঠোঁট নাড়াচ্ছে।মুরসালীন মুচকি হাসল।আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল ছেলের কপালে।নাকে নাক ঘষে বলল,
“আব্বা আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকেন কেন?”
ইলমা বেগম বললেন,
“সে ভাবছে আমার বাবা আমার মতোই দেখতে।”
মুরসালীন হাসল।কিছুক্ষণ বাবুকে আদর করে ইলমা বেগমের কাছে দিয়ে বউয়ের কাছে এগিয়ে গেলো।ইলমা বেগম দরজা আঁটকে বাইরে গেলেন।রুহা ক্লান্ত চোখে তাকাল।মুরসালীন রুহার হাত মুঠোয় এনে বলল,
“খারাপ লাগছে বউ?”
রুহা মুচকি হেসে বলল,
“একটুও না।”
মুরসালীন রুহার পাশে বসল।মাথায় হাত বুলিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
“তোকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব?আমার এই রঙহীন জীবনটাকে রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিস তুই।”
রুহা মুচকি হাসল।হাত শক্ত করে ধরে বুকের সাথে চেপে ধরলো।
“রঙ আমি দিয়েছি আর রাঙিয়েন আপনি।এই ভালোবাসাটুকু শুধু রুহানির জন্য বুকের মাঝে যত্ন করে রেখে দিন।”
#চলবে…?