#যেখানে_মন_হারায়
#হামিদা_আক্তার_ইভা_Hayat
২৪.[শেষ পর্ব]
কিছু মাস কেটেছে।রুহা আর মুরসালীনের ছোটো সংসার বেশ ভালো যাচ্ছে।দুই মা ছেলে মিলে ভালোই জ্বালায়।আজ শনিবার।সন্ধ্যার সময় মুরসালীন বাইরে থেকে রুহা আর আফনানের জন্য কিছু বাইরের খাবার নিয়ে এলো।রুহা বিছানায় বসে ছিল ছেলেকে নিয়ে।বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।আর রুহা বকবক করছে তার সাথে।মুরসালীন দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।রুহা তাকাল সেদিকে।
মুরসালীন নিকটে এগিয়ে এসে পাশে বসল।ছেলেকে বউয়ের কোল থেকে নিয়ে তার বলিষ্ঠ একহাতেই পেঁচিয়ে ধরল।নাকে নাক ঘষে বলল,
“আপনি আমার বউয়ের দিকে অমন করে তাকায় থাকেন কেন আব্বা?”
রুহা ঠোঁট টিপে হাসল।বাচ্চাটা বাবার কথা শুনে হেসে উঠল।মুরসালীন ছেলের হাসি দেখে শব্দ করে হাসল।রুহাকে বলল,
“রাফাত তোর মতোই বিচ্ছু হয়েছে রুহা।”
রুহা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“দেখতে হবে না ছেলেটা কার?”
“একটু শান্ত শিষ্ট রাখার চেষ্টা কর।তোকে পালতে গিয়েই আমি বুড়ো হয়ে গেছি,এখন একে সামলাতে গেলে আল্লাহ জানে কী হবে।”
রুহা হেসে উঠল।রাফাতকে কোলে নিতেই মুরসালীন ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।তারপর রাফাতকে কোলে নিয়ে বলল,
“নিচে তোর আর আফনানের জন্য কিছু খাবার এনেছি।যা,গিয়ে দেখ।”
রুহা ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বলল,
“পরে খাব এখন না।আপনি আমার পাশে বসুন।”
মুরসালীন পাশে গিয়ে বসতেই রুহা ঝাঁপটে ধরল তাকে।টুস করে গালে চুমু এঁকে বলল,
“দিন দিন এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন কেন?আমাকে তো বুড়িদের মতো লাগে এখনই।”
মুরসালীন রুহার কপালে টোকা মারল।
“ফাজিল মার খাবি তুই?”
“খেতেই পারি।অবশ্য আপনি কখনো আমাকে মারেননি।আজ মারতে গেলে কষ্ট পাবেন তাই মারার দরকার নেই।”
“আল্লাহ,ছেলেটা তোর মতো বাঁদর না হলেই হলো।তুই তো যৌবন জ্বালিয়ে খেলি,ছেলেটা এখন জীবন জ্বালিয়ে খাবে।”
“আপনি বেশি কথা বলেন।”
তখন রাত হয়েছে বেশ।খাওয়া দাওয়ার পর রিফা কাঁচুমাঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল ডাইনিং টেবিলের এক কোনায়।সবাই একে একে উঠে যাচ্ছে।নাবিল গলা পরিষ্কার করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সবার এত তাড়া কীসের?বসো,আমার কথা আছে।”
সবাই বসলো চেয়ারে।রুহা ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।ভ্রু কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।কামরুল শেখ বললেন,
“কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো।”
নাবিল শুকনো ঢোক গিলে এক গ্লাস পানি খেয়ে রিফাকে চোখের ইশারায় কিছু বলতে বলল।রিফা চোখ রাঙিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।নাবিল ব্যর্থ হয়ে খুঁকখুঁক করে কেশে বলল,
“না মানে,একটা কথা বলার ছিল।”
“কী বলবে?”
নাবিল জড়তা ভুলে নরম কণ্ঠে বলল,
“রিফা প্রেগন্যান্ট।আপনি দাদা হবেন।”
এক মুহূর্ত যেন সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল।কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।রুহা হাঁ করে তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে।তারপর দু’চোখ চকচক করে উঠল আনন্দে।বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল,
“আলহামদুলিল্লাহ! আমি ফুপি হবো!”
আফনান হাততালি দিয়ে হেসে উঠল।
“হুররে! আমি চাচা হবো!ছেলে হলে কিন্তু আমি নাম রাখব,বুঝলে রুহা আপু?”
রুহা চোখ কুঁচকে বলল,
“দেখা যাবে।নাম আমি রাখব।”
মুরসালীন পাশে বসে মুচকি হাসল।ভাইয়ের খুশি তার চোখেও ভাসল।কামরুল শেখ মুখ গম্ভীর করেও বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না।অজান্তে ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।নাসরিন বেগমও প্রথমে ভ্রু কুঁচকালেও পরে চোখ আনন্দে ভরে উঠল।
ইলমা বেগম চোখ মুছলেন চুপিচুপি।তার বুক ভরে উঠল।ছেলের ঘরে নতুন প্রাণ আসছে এর চেয়ে বড়ো সুখ আর কী হতে পারে?
নাবিল চুপচাপ দাঁড়াল।কেউ কিছু না বললেও সে রিফার হাত শক্ত করে ধরে হেসে বলল,
“ঘরে নতুন অতিথি আসছে।সবাই দোয়া করবেন।”
রুহা গিয়ে রিফাকে জড়িয়ে ধরল।রিফা লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলল।হাসি, খুনসুটি আর আনন্দে ভরে উঠল চারপাশ।বাড়ির প্রতিটি মানুষ যেন নতুন আশার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল।
নরুল শেখ আর কামরুল শেখ মিলে বাজারে গিয়ে মিষ্টি কিনে নিয়ে এলেন।দিন দিন যেন শেখ বাড়ির সুখ বেড়েই চলেছে।বাড়ির দুই বড়ো ছেলের সংসারে রহমত এসেছে।সব কিছুই আল্লাহর দান।
খুব বেশি রাত নয়।রুহা বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে পাশে মুরসালীনের বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিল।দুজনেই চুপচাপ।নীরবে ঘরটা ভীষণ শান্ত হয়ে আছে।মুরসালীন বউয়ের মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে।হঠাৎ রুহা শুধোয়,
“শুনছেন?”
মুরসালীন ছোটো করে জবাব দিল,
“শুনছি!”
“সবাই আজ কত খুশি দেখেছেন?অথচ একটা সময় আমাদের এই বাড়ি থেকেই বেড় করে দেয়া হয়েছিল।”
“সব অতীত।এসব কেন মনে হচ্ছে আজ?”
রুহা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।মুরসালীনের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
“আজ মনটা ভীষণ ভালো।আপনাকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য।মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব সুখ আমার হয়েছে।”
মুরসালীন মুচকি হাসল।আড়চোখে ছেলের ঘুমন্ত বদন দেখে বলল,
“সব সুখ তোর হোক।আজীবন এমন করেই ভালোবেসে যাস।তুই ছাড়া নিঃস্ব এই মুরসালীন শেখ আবেশ।তুই আমার,শুধু আমার,শুধুই আমার।”
মুরসালীনের কণ্ঠে গভীর দৃঢ়তা আর ভালোবাসা ঝরে পড়ল।রুহার বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল।এতদিন ধরে ঝগড়া,খুনসুটি, অভিমান সবকিছুই যেন মিলেমিশে এক গভীর প্রেমে রূপ নিল এই কথাগুলোয়।রুহা তার বুকের ভেতর ধকধক করা হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিল।ধীরে মাথা তুলে মুরসালীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কখনোই মুখে স্বীকার করেন না ভালোবাসার কথা,অথচ আজ আপনার কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে,পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মেয়ে আমি।”
মুরসালীন ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে রুহার চিবুক ধরে চোখের গভীরে তাকাল।ঠোঁটে গাঢ় চুমু এঁকে ধীর গলায় ফিসফিস করে বলল,
“ভালোবাসা মুখে বলার জিনিস নয়,সেটা তো চোখে বোঝা যায়,আচরণে বোঝা যায়।আমি সারাজীবন তোকে না বলে ভালোবেসেছি আর আমৃত্যু এভাবেই ভালোবাসব।”
ভালোবাসা লেখা হয় না কাগজে,
থাকে শুধু চোখের ভাষায়।
অভিমান, খুনসুটি, ঝগড়ার ভেতরেও
লুকিয়ে থাকে আসল আশায়।
রুহা আর মুরসালীন
দুই প্রাণ এক হৃদয়ের গান,
তাদের সংসার হোক আলোয় ভরা
আল্লাহর রহমতে হোক সুখের সমাহার।
~সমাপ্ত।
-হায়াত বুড়ি🦋