যেখানে_দিগন্ত_হারায় পর্ব-১৪

0
207

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন বিকেলে অনাড়ম্বরভাবেই বিয়ে হল আরমান,মাশিয়ার। বাবা-মা’র আদরের মেয়ের বিয়েতে বাজলনা কোন সানাই। দেশের বিখ্যাত পার্লারে বউ সাজতে গেলোনা সে। অতিথীদের পদচারনায় মুখরিখ হলোনা মোর্তাজা মহল। আসলনা কোন ভিআইপি অতিথী। থাকলনা কোনও মিডিয়া। মোর্তাজা মহলের ড্রয়িংরুমে সাদামাটাভাবে বিয়ে হল দুজনের। বধূবেশে পালকিতে চড়লনা মাশিয়া। তার বদলে একটা সাধারন মাইক্রোতে চড়ে ওরা রওনা দিল গ্রামের পথে।

আরমানের বড় মামা-মামী , ওর কাজিন, দুই বোন আর তিনজন বন্ধুকে নিয়ে মোর্তাজা মহলে গিয়েছিল। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তারা যে যার বাসায় ফিরে যায়। তবে আরমানের এক বন্ধু যাবার আগে আরমান তাকে একটা দ্বায়িত্ব দেয়। ওর বাসায় সে কয়টা ফার্নিচার আছে সেগুলো ওর বাসার কাজের খালাকে দিতে বলে। আরমান কাজের খালা এবং বাড়িওয়ালাকে বলে রেখেছে। আর বাসার চাবিও ওর বন্ধুকে দিয়েছে। ওর বন্ধু জানিয়েছে, সে তার ওপর অর্পিত দ্বায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করবে।

সব গোছগাছ করে আরমানরা রাত সাড়ে দশটার পর বিদায় নেয় মোর্তাজা পরিবারের কাছ থেকে।
কল্পনা মোর্তাজা অঝোরে কেঁদেই চলছেন। তিনি মাশিয়াকে আদর করতে গেলেই মাশিয়া তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সব বুঝেও কল্পনা মোর্তাজা আজ মেয়ের ওপর একটুও রাগ করলেননা। তিনি বারবার আরমানকে অনুরোধ করলেন, তার মেয়ের খেয়াল রাখতে। মিরাজ মোর্তাজারও একই অবস্থা। তার আদরের মেয়ে চিরতরে তার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে ভেবেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আরমানের হাতে মেয়েকে তুলে দিলেন। আজ মাশিয়া এক ফোঁটাও অশ্রু বিসর্জন করলনা। কিংবা বাবা-মা’ র কান্না দেখেও তার মন একটুও খারাপ হলোনা। ও স্থির বসে রইল।

সকাল ছয়টার কিছু পরেই মাইক্রো এসে দাঁড়ায় দোতলা মাটির বাড়ির সামনে। এত সকালে মাইক্রো দাঁড়াতে দেখে গ্রামের লোকজন উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।
প্রথমে আরমান গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর শশী, সুধা, আয়েশা খানম বেরিয়ে আসলেও মাশিয়া ঠাঁয় বসে রইল।

” মাগো, তুমি ইকটু বস, আমি এখনই আসতাছি। ” আয়েশা খানম মাশিয়াকে বসতে বলে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি সুধাকে ইশারা করে নিজের সাথে যেতে বললেন।

কিছুক্ষণ পর তিনি একটা পিরিচে মিষ্টি নিয়ে আসলেন।

” তোমারে কোন আয়োজন ছাড়াই বাড়িতে আনলাম। তাই তোমারে বরনও করা হইলনা। রাগ হইওনা, মা। কয়দিন পরেই বড় অনুষ্ঠান কইরা, সবার সাথে তোমার পরিচয় করামু। নেও এই মিষ্টি খাইয়া, গাড়ি থাইকা নামো। ” আয়েশা খানম বাড়ি দেখভালের দায়িত্ব তার এক দেবরকে দিয়ে ঢাকা গিয়েছিলেন। আরমানের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই তিনি তার দেবরকে ফোন করে মিষ্টি কিনে রাখতে বলেছিলেন। তবে তিনি কাউকে জানাননি আরমানের বিয়ের কথা। সেই মিষ্টি দিয়েই তিনি পুত্রবধূর মিষ্টিমুখ করালেন। মাশিয়া অল্প একটু মিষ্টি খায়। এরপর আয়েশা খানম সুধার হাত থেকে একটা ছোট বক্স নিলেন। বক্স খুলে তিনি একজোড়া বালা বের করে পরিয়ে দিলেন মাশিয়ার হাতে। এত কিছুর পরও মাশিয়া কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না। সে নিরবে সবার নির্দেশ পালন করতে থাকে।

আরমান গাড়ি থেকে ব্যাগ বের করে একে একে সেগুলো বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। আয়েশা খানম এতক্ষণ কি করলেন সেদিকে ওর নজর নেই।

গাড়ি থেকে নামতেই মাশিয়ার নজর যায় ফুলে ফুলে সাজানো এক দরজার দিকে। দরজার ডানপাশে কামিনী গাছে থোকায় থোকায় কামিনী ফুটে রয়েছে। গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। কামিনীর পাশেই গন্ধরাজ গাছ ফুলের ভারে নুয়ে পরছে। তারপাশে শিউলি গাছ বাকি দুই ফুলের সুবাসে উতলা হচ্ছে বোধহয়। দরজার বামদিকে বেলি, রাই বেলি আর লন্ঠন জবা নিজেদের সৌন্দর্য্য উজার করে দিচ্ছে। হুট করেই মাশিয়ার মনে হল, ফুলে ভরা কোন বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। নানানরকম ফুল মাটির দোতলা বাড়িটিকে অন্যরূপে সাজিয়েছে।

” আসো মা, তোমার বাড়িতে ডান পা দিয়ে প্রবেশ কর। ”

আগে কখনো শাড়ি না পরায় হাঁটতে একটু অসুবিধাই হচ্ছিল মাশিয়ার। কোনরকম পা টিপে টিপে হাঁটছে।

বাড়ির ভেতর ঢুকে আরেকপ্রস্ত অবাক হয় মাশিয়া। উত্তর, দক্ষিণ আর পশ্চিম তিন দিকেই বড় বড় মাটির দোতলা ঘর। সাথে লাগোয়া বারান্দা। পরিপাটি করে রাখা বাড়ির উত্তরের ঘরের সামনে বড় একটা আমগাছ। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা বরই গাছ। চারপাশের বারান্দা ঘেঁষে লাগানো আছে কয়েকরকম ফুলের গাছ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মাশিয়ার আঁখিদ্বয় পুরো বাড়ি অবলোকন করল। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এখন থেকে এই বাড়িতেই জীবন কাটাতে হবে ভেবেই বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল।

” তোমার রুমে চল, ভাবি। রাতে ঘুমাওনি। এখন ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও। ” আধাঘন্টা আগেও যে বাড়ির সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিলনা, আজ সেই বাড়িতে নাকি নিজের একটা রুমও আছে! হুট করেই মাশিয়ার ভিষণ কান্না পায়। পাপা সবকিছু না দেখেই কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল? এই প্রশ্নটা চিৎকার করে জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু জানবে কার কাছ থেকে! ও বাবা যে এখানে নেই!

উত্তরের ঘরের ভেতরে মাশিয়াকে পৌঁছে দিয়ে শশী বেরিয়ে যায়। বেশ বড়সড় একটা ঘর। আসবাব বলতে কেবল, খাট একটা আলনা, একটা ড্রেসিং টেবিল আর একটা রিডিং টেবিল ও তিনটা চেয়ার আছে ঘরটাতে। মাশিয়া গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় ড্রেসিংটেবিলের দিকে। খুলনায় ওর দাদুর বাড়িতে এরকম একটা ড্রেসিংটেবিল ছিল। ওর খুব পছন্দের ছিল সেটা। ছোটবেলায় ও কারনে-অকারনে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াত। ঘুরে ঘুরে দেখত নিজেকে। দাদুকে বলত, ড্রেসিংটেবিলটা ওকে দিয়ে দিতে। দাদু হেসে বলত, তোমার যখন মনে চাইবে, তুমি নিয়ে যেও। কিন্তু কখনোই সেই ড্রেসিংটেবিল ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। দাদুর মৃ’ত্যু’র পর সেটা কোথায় গেছে মাশিয়া জানেনা। আজ অনেকদিন পর দাদুর কথা মনে পরল, মনে পরল সেই অতি প্রিয় ড্রেসিংটেবিলের কথা। মাশিয়া পরম আবেগে ছুঁয়ে দেয় ড্রেসিংটেবিলের একপাশ। গতকাল থেকে জমিয়ে রাখা অশ্রুকনারা হুট করেই ঝরতে শুরু করল। যেন তারা প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কার আগে কে ঝরবে। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সেটা বলতে পারেনা মাশিয়া। সুধার ডাকে হুশ আসলে চোখমুখ মুছে নেয়।

” ভাবি, কলপাড়ে চল। চাচি রান্না করে এনেছে। গোসল করে এসে খেয়ে নিবে। এরপর ঘুমাবে। সারারাত মনে হও ঘুমাওনি? আমি যখনই তোমার দিকে তাকিয়েছি, তখনই তোমাকে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। ”

” গাড়িতে উঠলে ঘুমাতে পারিনা। ” কথার মাঝেই ন্যাপসাক খুলে থ্রিপিস বের করল। এ বাড়ি থেকে গতকাল দশটা শাড়ি নিয়ে গেছিলো। কিন্তু ওর সব সময়ই শাড়িতে অনিহা। তাই আলাদা ন্যাপসাক ভর্তি করে পোশাক এনেছে।

গোসল করে ঘরে ঢুকতেই আয়েশা খানম খাবার নিয়ে আসলেন। তিনি মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে ওকে থ্রিপিস পরা অবস্থায় দেখে একটু হাসলেন।

” ইকটু খাইয়া নেও, মা। এরপর ঘুমাও। তোমার চাচি শ্বাশুড়ি বেশি কিছু রান্দবার পারেনি। শুধু পুঁটি মাছের ঝোল আর করলা ভাজছে। এইগুলাই এখন কষ্ট কইরা খাও। দুপুরে আমি তোমার পছন্দের খাবার রাইন্দা দিমু। ”

সেদিন বিকেলের পর মাশিয়া আর কিছুই খায়নি। তাই ক্ষুধাও লেগেছে প্রচুর। মিরাজ মোর্তাজা সেদিন ওর সামনে থেকে খাবারের প্লেট সরিয়ে নেয়ার পর পণ করেছিল না খেয়েই ম’রে যাবে। কিন্তু পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা থাকায় সেসব পণ দিব্যি ভুলে গেল।

” আমি মাছের কাঁ’টা বাছতে পারিনা, আন্টি। মম সব সময়ই কাঁ’টা বেছে দিত। ”

মাশিয়ার কথায় হাসলেন আয়েশা খানম।

” শ্বাশুড়িরে বুঝি কেউ আন্টি ডাকে? তুমি আমার কাছে আমার সুধা, শশীর থাইকা কোন অংশেই কম নও। তুমিও আমার আরেক মেয়ে। ওগোর মতন তুমিও আমারে আম্মা ডাইকো, কেমন? তোমার মা’য় আগে কাঁ’টা বাইছা দিত। এখন থাইকা আমিও দিমু। তয় শুধু বাইছাই দিমুনা। খাওয়াইয়াও দিমু। এখনো আমি মাঝেমধ্যে সুধা, শশীরে খাওয়ায় দিই। আইজ থাইকা তোমারেও দিমু। ”

আয়েশা খানম পরম যত্নে মাশিয়াকে খাইয়ে দিলেন। এরপর তিনি মাশিয়াকে ঘুমাতে বলে বাহির থেকে দরজা ভেজিয়ে দিলেন।

মাশিয়া সময় নষ্ট না করে বিছানায় যায়। গত তিনরাত ধরে ঘুমায়না ও।

বাড়িতে আজ সাজ সাজ রব। আয়েশা খানম কয়েকজন প্রতিবেশিকে ডেকে পিঠা বানাতে লাগিয়ে দিলেন। শশীকে পাশের বাড়ি থেকে হাঁস কিনে আনতে পাঠালেন। প্রতিবেশিরা আরমানের বিয়ের কথা জানতে পেরে দলে দলে বউ দেখতে আসছে। আয়েশা খানম সবাইকে জানান, বউ ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠলেই দেখতে পাবে।

বাড়িতে ঢুকেই আরমান মা’য়ের ঘরে ঘুমিয়েছে। প্রায় তিনঘণ্টা পর ওর ঘুম ভাঙ্গে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল বাড়ি ভর্তি মানুষজন। সবাই আরমানকে দেখে বিয়েতে না জানানোর অভিযোগ করলে, আরমান চুপচাপ শুনে যায়। এরপর সবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের ঘরে ঢোকে।

বিছানায় ঘুমন্ত মাশিয়াকে দেখে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়না আরমান। ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

চলবে…