যেখানে_দিগন্ত_হারায় পর্ব-৪৫+৪৬

0
324

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৪৫
জাওয়াদ জামী জামী

স্বম্বিৎ ফিরে পেতেই রিশাদ তেড়ে আসল আরমানের দিকে। আরমানের এক ঘুষিতেই ও কিছুক্ষণ মেঝেতে লুটোপুটি খায়। নাক বেয়ে গলগল করে নামছে র’ক্তে’র ধারা। ওকে তেড়ে আসতে দেখেও আরমান মোটেও বিচলিত হলোনা। ও অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল। যেন কোন কিছুতেই ওর কোনও তাড়া নেই।

রিশাদ আরমানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ও রাগে ফুঁসছে।

” ইউ ব্লাডি ফুল। তোমার সাহস হয় কি করে আমার গায়ে হাত তোলার? আগেরবার তোমাকে কিছু বলিনি বলে আজও যে তোমাকে ছেড়ে দেব, এটা ভেবোনা। আজ আমার হাত থেকে তোমাকে কোন বাপের ব্যাটাই বাঁচাতে পারবেনা। ”

কথা বলেই রিশাদ আরমানকে মারার জন্য হাত উঠায়। ওর হাত মাঝপথে থাকতেই আরমানের হাতের দশাসই থাপ্পড় খেয়ে ও দুই হাত দূরে ছিটকে যায়। সেখানে উপস্থিত সবাই থাপ্পড়ের বিকট শব্দে চমকে উঠল। কিন্তু কেউই আরমানের সামনে আসার সাহস পেলোনা। এখানের সবাই জানে আরমানের সম্পর্কে। আরমান এগিয়ে যায় রিশাদের কাছে।

” রাস্কেল, সেদিনও তোর কিছু করার ক্ষমতা ছিলনা, আর আজও নেই। আমি তোকে এখানেই মে রে পুঁতে রেখে দিলেও তুই কিছুই করতে পারবিনা। এতদিন অনেক বিরক্ত করেছিস মাশিয়াকে। নেহাৎই বাঘিনী বিড়াল হয়েছিল তাই তোর চাপার জোড় এখনো আছে। নয়তো ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নয় মাশিয়া। আমাকে কি করবি কর। দেখি তোর হিম্মত। ” আরমান কথা বলছে আর রিশাদকে এলোপাথাড়ি মা’র’ছে।

রিশাদ এতক্ষণ গলার জোড় দেখালেও আরমানের মা র সহ্য করতে পারছেনা কিংবা নিজেকে রক্ষা করতেও পারছেনা।

আরমান এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। এক কোনায় একটা রড দেখে দ্রুত পায়ে সেখানে গিয়ে রড হাতে নেয়।

” আমার সন্তানদের নিয়ে তুই কি বলেছিলি মনে আছে? ওরা তোর সন্তান? পৃথিবীতে আসার আগেই আমার সন্তানদের কলুষিত করতে চেয়েছিলি তুই। আমি মনে মনে তোকেই খুঁজেছি কয়েকটা দিন। কিন্তু তোকে পাইনি। আজ দেখ, তোর দুর্ভাগ্য তোকে আমার কাছে টেনে এনেছে। ” আরমান রড দিয়ে মারছে রিশাদকে। রিশাদের চিৎকারে হসপিটালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

আরমানের এমন আগ্রাসী রূপ দেখে রিসিপশন থেকে একজন মিরাজ মোর্তাজাকে ফোন দেয়।

মিতুল হসপিটালে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়। আরমান রিশাদকে বেদম প্রহার করছে। আরমানের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে ভয় ঢুকে যায়। তবে ও এটা ঠিকই বুঝতে পারছে, এই মুহূর্তে আরমানকে না থামালে আজ রিশাদ বাঁচবেনা। ও এগিয়ে গেল লিফ্টের দিকে।

” সুধা, শশী তোমরা নিচে গিয়ে স্যারকে আটকাও। স্যার আজ রিশাদকে মে রে ই ফেলবে। তারাতারি যাও। ” মিতুল প্রায় ঠেলে ওদের দু বোনকে রুম থেকে বের করে দেয়।

মাশিয়া মিতুলের কথা শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। ওর বুঝে আসছেনা আরমান কেন রিশাদকে মা র ছে? চিন্তায় ওর মাথা খারাপ হবার জোগাড়।

সুধা লিফ্ট থেকে বেরিয়েই দেখল প্রায় অচেতন রিশাদকে মে রে ই যাচ্ছে আরমান
রিশাদের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা নেই। ও জড়বস্তুর ন্যায় মেঝেতে লুটাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর পুরো শরীর। সুধা দৌড়ে যায় আরমানের কাছে।

” ভাইয়া, কি করছ! ছেড়ে দাও। লোকটা ম রে যাবে তো। ” ওরা দু বোন জোড় করে আরমানের কাছ থেকে রড কেড়ে নেয়।

শশী আরমানকে জড়িয়ে ধরে আছে। আরমান রাগে কাঁপছে।

” ভাইয়া, তুমি কি পাগল হয়েছ! এভাবে কেউ কাউকে মা রে? তুমি নিজেকে এই লোকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছ নাকি! এটা নাহয় বেয়াদব। কিন্তু তুমি তো নও? ” শশী আরমানকে ঠেলে লিফ্টের কাছে।

” ও এভাবে একঘন্টা এখানে থাকবে। এক ঘন্টা পর ওর চিকিৎসা করবেন আপনারা। এর আগে যদি কেউ ওকে টাচ করে, তবে তারও এর মতই অবস্থা হবে। ” লিফ্টে ওঠার আগে হসপিটালের কর্মীদের হুমকি দিল আরমান।

কেবিনে এসে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে মেয়েদের কাছে যায়। মেয়েরা ঘুমাচ্ছে। তাই ওদের কোলে নিতে পারলনা। মাশিয়া অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে। কিন্তু আরমান একটাবারও ওর দিকে ফিরে তাকায়না।

মিরাজ মোর্তাজা একঘন্টা পর এসে জানালেন রিশাদের দুই হাত আর এক পা ভেঙে গেছে। বুকের দুইটা হাড়ও ভেঙেছে। মাথায় সেলাই পড়েছে সাতটা। এছাড়াও ওর পুরো শরীর থেঁতলে গেছে। তিনি আরমানের দিকে তাকালেন। কিন্তু আরমানের ভেতরে কোনও হেলদোল দেখলেননা।

মাশিয়া অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। ওকে বাসায় নিতে হবে। কল্পনা মোর্তাজা চাইলেন মাশিয়াকে তাদের বাসায় নিতে। কিন্তু আরমান চায়না মাশিয়া সেখানে যাক। ও মাশিয়াকে সুধার ফ্ল্যাটে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আরমানের সিদ্ধান্তে কল্পনা মোর্তাজা মোটেও অখুশি হননি। অবশেষে তার মেয়ে নিজের সংসারে ফিরবে, এটাই তার জন্য স্বস্তির।

সুধা বাচ্চাদের তৈরী করছে। শশী ওদের কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। গোছগাছ শেষ হলেই ওরা নিজেদের ফ্ল্যাটে যাবে। মাশিয়াকে ওরা কিছুই করতে দিচ্ছেনা। ও ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আরমান কোথাও গেছে। তাই মেয়েটা বিছানায় শুয়ে হাত-পা নাড়াচ্ছে।

” সুধা, তোদের গোছগাছ হয়েছে? গাড়ি এসে গেছে। তারাতারি কর। ” আরমান কেবিনে প্রবেশ করে সুধাকে বলল।

” হুম। তুমি ব্যাগগুলো নিচে নিয়ে যাও। গাড়িতে রেখে এস। ভাবিকে ধরে নিতে হবে। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে আমরা ভাবিকে নিতে পারবনা। খালাম্মাতো এখনও আসলোনা। তিনি সকালেই আসতে চেয়েছিলেন। ”

আরমান কিছু না বলে একজনকে সাথে নিয়ে ব্যাগগুলো গাড়িতে রেখে আসল।

ওরা বেরোনোর আগ মুহূর্তে কল্পনা মোর্তাজা কেবিনে ঢুকলেন।

” আমার দেরি হয়ে গেল, মা। হঠাৎই প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। একটু আরামবোধ করতেই চলে আসলাম। ” কল্পনা মোর্তাজা তার বড় নাতনিকে কোলে নিলেন।

” শুধু আম্মুই আসেনি, আমিও এসেছি। মাশিয়াকে আর বাচ্চাদের আমাদের বাসায় নিয়ে যাব। তই দেখি, বাচ্চাদের আমার কাছে দাও। ” দোলন কেবিনে ঢুকে হাসিমুখে বলল।

দোলনকে দেখে সবাই একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

” সরি, আপনার চাওয়া পূরণ করতে পারছিনা। বাচ্চাদেরও আপনার কোলে দেয়া যাবেনা। আর আমার মেয়েরা আমাদের বাসাতেই যাবে। তা হুট করে আজকে কি মনে করে উদয় হলেন? এই কয়দিন আপনার টিকিটির দেখাও পাইনি। আমার স্ত্রী যখন আইসিউতে মৃ’ত্যু’র প্রহর গুনছিল, তখন কোথায় ছিলেন? আজ হঠাৎ করেই কেনইবা এত দ্বায়িত্ব দেখাতে এসেছেন? কয়েকটা মাস যখন ওর পাশে আমি ছিলামনা, তখন কোথায় ছিল আপনার দ্বায়িত্ববোধ? আপনি যেতে পারেন। আপনাকে দেখেই আমার রাগ উঠছে। যখন দেখলেন একটা মেয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছে, তখন তাকে না বুঝিয়ে তার পাশে না থেকে, তার বাড়ি ছাড়ার কারণ হয়েছেন। ভেবেছিলেন আমার স্ত্রী তার বাবার বাসায় থাকলে আপনার কর্তৃত্ব থাকবেনা। তাইতো? তাই ওর সাথে দুর্ব্যবহার করলেন। ওকে আঘাত দিলেন। কিন্তু আজ যখন দেখলেন, আমার স্ত্রী ওর সংসার, স্বামী ফিরে পেয়েছে, তখনই চলে আসলেন তাঁবেদারি করতে? ভালোমানুষি দেখাতে? তার প্রয়োজন নেই। আমার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আমি একাই যথেষ্ট। ”

আরমানের কথায় দোলন চরম অপমানিত হয়। ও ভাবতেই পারেনি আরমান ওকে এভাবে অপমান করতে পারে। তবে ও আরও আশ্চর্য হয়েছে আরমান কিভাবে ওর দুরভিসন্ধি ধরে ফেলেছে! ও হাসার চেষ্টা করল।

” সংসারে থাকলে এমন অনেক কিছুই হয়। আবার সব ঠিকও হয়ে যায়। সবকিছু মনে রাখলে চলেনা। ”

” সবকিছু আপনি ভুলে যেতে পারেন, অন্যেরা ভুলতে পারে, কিন্তু আমি ভুলতে পারিনা। বিশেষ করে সবকিছু যখন আমার আপনজনদের ঘিরেই ঘটে। একটা মেয়েকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় আপনি বাসা ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন, এটাতো কোনদিনই ভুলবনা। আর আপনি আমার আপন কেউই নন যে আপনাকে তোষামোদ করে চলতে হবে আমাকে। আপনি আসতে পারেন। আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ”

আরমানের করা তীব্র অপমানে দোলনের মুখ কালো হয়ে গেছে। ও সুড়সুড় করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

মাশিয়া মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে আরমানের দিকে। যে মানুষটাকে ও একদিন আঘাত দিয়েছে, কাঁদিয়েছে, সেই মানুষটাই আজ ওর অপমানের উচিত জবাব দিল! রিশাদকে সেদিন আঘাত করেছে ওরই জন্য। আজ আপন পরের ফারাক মাশিয়া বুঝতে পারছে। সেইসাথে বুঝতে পারছে, হাজারবার জন্ম নিলেও মাশিয়া আরমানের হয়েই জন্মাতে চায়। এই মানুষটাই ওর সুখ-দুঃখের সাথী। এই মানুষটার বুকেই ওর সুখ।

চলবে…

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৪৬
জাওয়াদ জামী জামী

দোলন কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই কল্পনা মোর্তাজা মলিন হেসে আরমানের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

” আমাকে মাফ করে দিও, আরমান। সন্তানদের শুধু আদরই দিয়ে গেছি, কখনো শাসন করিনি। যদি আগেই শাসন করতাম তবে মাশিয়ার এত ভোগান্তি পোহাতে হতোনা। আর মাহিনও নিজের বোনের প্রতি যত্নশীল হতো। তোমাদের জীবনটা এলোমেলো হতোনা। ”

শ্বাশুড়ির কথা শুনে আরমান অপ্রস্তুতবোধ করছে। ও চাইলেই অনেক কিছু বলতে পারত , তবে সে এখন কথা বাড়াতে চায়না।

” অতীত নিয়ে এখন কোন কথা বলাই বোধহয় ভালো হবে। প্রত্যেক বাবা-মা’র-ই সন্তানের প্রতি সফ্ট কর্নার থাকে। সন্তানের প্রতি অসীম ভালোবাসা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর সে জন্যই শাসনটা অনেকেই করে উঠতে পারেনা। আর শাসন না পেলে সন্তানরা লাগামছাড়া হবে এটাও স্বাভাবিক। তবে একটা সময় সবাই নিজের ভুল বুঝতে পারে। ” আরমানের কথা শেষ না হতেই মিরাজ মোর্তাজা কেবিনে ঢুকলেন। তার সাথে আছে ডক্টর জহুরুল হক।

মিরাজ মোর্তাজা নাতনীদের আদর করছেন। তার চোখে পানি। ডক্টর জহুরুল হক এগিয়ে গেলেন মাশিয়ার দিকে।

” মামনি, নিজের যত্ন নিও। নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করো। কতবড় বিপদ থেকে তুমি রক্ষা পেয়েছ, সেটা চিন্তা করে হলেও নিজের খেয়াল রেখ। মনে রেখ, তুমি এখন আর একা নও। তোমার সাথে জড়িয়ে আছে তোমার দুই মেয়ের ভালোমন্দ। ”

” জ্বি আংকেল, আপনার কথা মনে থাকবে। ”

” ডক্টর আংকেল, আপনি এই কয়দিনে ভাবির যথেষ্ট টেক কেয়ার করেছেন। এজন্য অনেকগুলো থাংকু আপনাকে। আপনি নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। কিন্তু আপনার ছেলে আপনাকে এত ভয় পায় কেন, এই চিন্তায় আমি ঘুমাতে পারিনা। সন্তানরা বদরাগী বাবাকে ভয় পায় এটা জানি। কিন্তু আপনার মত ফ্রেন্ডলি বাবাকেও কেউ ভয় পায়! হোয়াই আংকেল, হোয়াই? ”

শশীর কথায় যেন কেবিনের মধ্যে বাজ পড়ল। সুধার মুখ হা হয়ে গেছে। ডক্টর জহুরুল হকও অবাক। তিনি শশীর কথার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করছেন। বাকি সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে শশীর দিকে।

” তুমি কার কথা বলছ, মা? আমারতো দুইটা ছেলে। তুমি কি ওদের চেনো? ”

” আমি শুধু অনিক ভাইয়াকে চিনি। তার মুখেই শুনেছি আপনি ভাইয়ার বাবা। বেচারা বিয়ে করতে চায়, কিন্তু ভয়ে আপনাকে বলতে পারছেনা। কত নিষ্পাপ একটা ছেলে আপনার ভাবা যায়! ”

শশীর এহেন কথায় আরমানের রাগ তরতর করে বাড়তে থাকে। মেয়েটা দিনদিন লাগামহীন কথাবার্তা বলছে, সেটা আরমান অনেকবারই অবলোকন করেছে। আজকে গুরুজনের সামনেও শশী চরম বেয়াদবি করেছে। বাসায় গিয়ে ওকে দুইটা থাপ্পড় মা রা র সিদ্ধান্ত নেয় আরমান।

কথা শেষ হতেই আরমানের দিকে চোখ যায় শশীর। সাথে সাথে ওর কলিজা শুকিয়ে গেছে। আরমান ওর দিকে চিলচক্ষুতে তাকিয়ে আছে। ভয়ে ঢোক গিলল শশী। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে।

সুধা, কল্পনা মোর্তাজার কোলে দুই বাচ্চা। শশীর হাতে ছোট একটা ব্যাগ। আরমান মাশিয়াকে ধরে রেখেছে। কল্পনা মোর্তাজা ওদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে তবেই নিজের বাসায় ফিরবেন।

অনেকগুলো মাস পর আরমানের ছোঁয়া পেয়ে মাশিয়ার শরীর শিরশির করে উঠল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ও আরমানের বুকে গড়িয়ে পরল। সেভাবেই পরে রইল আরমানের বুকে। বিড়ালছানার মত গুটিসুটি মে’রে বসে থাকে। সেই অতি চেনা পুরুষালী গন্ধে মাতোয়ারা মাশিয়ার মন। কতদিন পর গন্ধটা নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে। বুক ভরে শ্বাস টানল সে। বুকের প্রতিটি কোনে মেখে নিল পুরুষালী গন্ধের প্রতিটি বিন্দু। আরমানের হৃৎস্পন্দনেরা ছন্দময় তালে বেজেই চলেছে অনবরত। আজ এই শব্দগুলোও মাশিয়ার কানে ঝংকার তুলেছে। নিজের অজান্তেই আরমানকে একহাতে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েটা। বাসায় পৌঁছাতে আধাঘন্টার মত লেগে যাবে, এতটুকু সময় ও আরমানের বুকেই থাকতে চায়। ওর শরীরের গন্ধ মাখতে চায় নিজের শরীরে। ওর হৃৎস্পন্দনের সাথে সন্ধি করতে চায়।

আরমান লক্ষ্য করল মাশিয়া ওর বুকে মাথা রেখেছে। নড়ার কোন লক্ষ্মণই নেই ওর মধ্যে। হয়তো মেয়েটার খারাপ লাগছে, তাই এভাবে নেতিয়ে আছে ভেবে আরমান ওকে সরানোর চেষ্টা করলনা।

গত দুইদিন থেকে শশী আরমানের থেকে দূরে দূরে থাকছে। সব সময়ই কোননা কোন কাজের অযুহাতে রান্নাঘরেই থাকছে। ও বুঝতে পারছে সুযোগ পেলেই আরমান ওকে নির্ঘাত থাপড়াবে। এই বয়সে মা র খেতে চায়না ও।

বিকেলে বাচ্চারাদের নিয়ে আরমান ঘুমিয়ে আছে। মাশিয়াও বিছানার একপাশে শুয়ে তাকিয়ে আছে স্বামী-সন্তানদের দিকে। ও আরমানকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। মানুষটা রাতের অধিকাংশ সময়ই জেগে থাকে। মেয়েদের সামান্য কান্নাও সে সইতে পারেনা। একটু কান্না করলেই সে দুই হাতে দুই মেয়েকে নিয়ে ঘরময় পায়চারী করে। দিনেও তাই। এতটুকুও অবসর তার নেই।

গত বিশ দিনে আরমান একবারও মাশিয়ার সাথে কথা বলেনি। এই কষ্ট মাশিয়াকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ও ছটফট করছে আরমানের সাথে কথা বলার জন্য। ও উতলা হয়ে আছে আরমানের ছোঁয়া পেতে। কিন্তু আরমান ওর দিকে ফিরেও তাকায়না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মাশিয়া। আপনমনেই বিড়বিড় করছে,

” কি হয় আমার সাথে একটু কথা বললে। আমাকে একটাবার বুকে জড়িয়ে নিলে। জানি আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি। তার ফলও ভোগ করেছি দিনের পর দিন। এত নিষ্ঠুর কেন আপনি? একটা সময় যখন অভিনয় করেছি, তখন কাছে টেনেছেন। কিন্তু এখন যখন সত্যিই আপনার হতে চাই, তখন আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। আরও শাস্তি দিতে চান আমাকে? তবে দিন। আপনার নিষ্ঠুরতার আ গু নে পু ড়ে ই নাহয় নিজেকে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব। আপনার যোগ্য স্ত্রী হয়ে উঠব। ”

মাশিয়ার কান্নার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠল। কলিংবেলের শব্দ শুনে মেয়েটা ওড়নায় চোখ মুছল। রুম থেকেই শুনতে পেল সুধা দরজা খুলে দিয়েছে। একটু পরেই সুধা ওকে রুমের দরজার সামনে থেকে ডাকল। সুধার ডাক শুনে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল মাশিয়া। মৃদু গলায় সুধাকে ভেতরে ডাকল।

সুধা ভেতরে এসে জানাল মিরাজ মোর্তাজা আর ডক্টর জহুরুল হক এসেছেন। ওদের কথপোকথনে আরমানের ঘুম ভেঙে যায়। তখন সুধা ওকে জানায় বাসায় মেহমান এসেছে।

ডক্টর জহুরুল হকের কথা শুনে ড্রয়িংরুমে সবাই অবাক হয়ে গেছে । শশী আঁড়চোখে আরমানের দিকে তাকাচ্ছে। ঘোর কাটলে মাশিয়া হেসে উঠল।

” আপনি সত্যি বলছেন, আংকেল! সত্যিই সুধাকে আপনার ছোট ছেলের বউ করতে চান? ”

” সত্যিই বলেছি, মামনি। সেদিন শশী মামনির কথা শুনে আমি বাসায় গিয়ে অনিককে জিজ্ঞেস করলাম ও কি সত্যিই বিয়ে করতে চায়? আর সেই কথা শশীই বা কিভাবে জানল? ওকে চেপে ধরতেই গড়গড় করে সব উগড়ে দিল। সে নাকি সুধাকে পছন্দ করে, বিয়ে করতে চায়। এরপর মিরাজ ভাইয়ের সাথে আলোচনা করলাম, আমার বড় ছেলে, বউমার সাথে কথা বললাম। এরপর আসলাম তোমাদের কাছে, সুধা মা’কে আমার বাসায় নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইতে। জামাইবাবা, দেবে তোমার বোনকে আমার ছেলের কাছে? ”

ডক্টর জহুরুল হকের কথা শুনে আরমান কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। ও কিছু একটা ভাবছে।

” আমি আগে সুধার সাথে কথা বলতে চাই। আপনি হয়তো জানেন, আমাদের আব্বা-আম্মা কেউ বেঁচে নেই। তাদের অবর্তমানে ওদের সব দ্বায়িত্ব আমার। তাই যা করব ভেবেচিন্তেই করতে চাই। আমি চাইনা আমার কোন একটা ভুল সিদ্ধান্তে ওদের জীবনে ঝড় উঠুক। ”

” ওকে ইয়াংম্যান, তুমি সুধা মামনির সাথে কথা বল। আমার পরিবার, আমার ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নাও। এরপর সামনে এগোও। আমি তোমাদের জোর করবনা। তোমরা যেটা ভালো মনে করবে সেটাই মেনে নিব আমি। ”

আরও একঘন্টা মেয়ের বাসায় কাটিয়ে মিরাজ মোর্তাজা ও ডক্টর জহুরুল হক বিদায় নিলেন৷

আরমান সে রাতেই সুধার সাথে কথা বলল। আরমানও চাইছে সুধার বিয়ে দিতে। কয়েকটা বিয়ের সম্মন্ধও এসেছে। আরমান মনে মনে সবগুলো পাত্রের ব্যাপারে খোঁজও নিয়েছে। তবে কেউই ওর মনমত হয়নি। সুধাকে সবকিছু খুলে বলতেই আঁইগুই শুরু করল ও। ওর একটাই কথা এখন বিয়ে করতে চায়না।

” ভাইয়া, তুমি বরং শশীর বিয়ে দাও। ও বিয়ের জন্য উতলা হয়ে গেছে। আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করি। তারপর বিয়ের কথা ভাবব।”

” বড় বোনকে রেখে ছোট বোনের বিয়ে দেয়ার মত বোকা ভাই আমি নই। তুই মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিস, কেউ না চাইলেও তোকে পড়াশোনা কমপ্লিট করতে হবে। আর এই যে বলছিস, পড়াশোনা শেষ করেই তবে বিয়ে করবি, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর তাছাড়া আমিও তোদের সাথে থাকিনা। তোদের একা এখানে রেখে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারিনা। সব সময়ই তোদের জন্য চিন্তা হয়। বিয়ের পরেও মেয়েরা মেডিকেলে পড়াশোনা করেছে এমন অনেক রেকর্ড আছে। আসলে ইচ্ছাশক্তিই সব। তোর চেষ্টা আর ইচ্ছা থাকলে কেউই তোর পথ আগলে রাখতে পারবেনা। জয়ী তুই হবিই। আর যদি তোর কোন পছন্দ থাকে আমাকে বল। ডক্টর জহুরুল হকের ছেলের সাথেই বিয়ে হতে হবে এমন কোন কথা নেই। ”

আরমান আরও নানাভাবে বোঝাতে থাকে সুধাকে।

” ঠিক আছে, ভাইয়া। তুমি যেটা ভালো বোঝ সেটাই কর। আর পার্সোনালি আমার পছন্দেরও তেমন কেউ নেই। তবে একটা বিষয় আগে থেকেই ক্লিয়ার করে নিও, সেটা হল আমার পড়াশোনা। ”

সুধার কথা শুনে স্বস্তি পায় আরমান। কিছুক্ষণ পর ওর কয়েকটা বন্ধুকে ফোন দিয়ে ডক্টর জহুরুল হক ও তার পরিবারের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলে।

চলবে…