যেখানে_দিগন্ত_হারায় পর্ব-৪৯+৫০

0
331

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৪৯
জাওয়াদ জামী জামী

মাশিয়া ঘরে এসে দেখল আরমান শরীর মুছছে। বোধহয় সে এখনই গোসল করেছে। আদ্র চোখে মাশিয়া কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল আরমানের দিকে। মানুষটা বাড়িতে আসা অব্দি ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। এই মুহূর্তে আরমানের বুকে ছুটে যেতে ভিষণ ইচ্ছে করছে মাশিয়ার। হয়তো সে এখনই ঝাঁপিয়ে পরত তার আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের বুকে। কিন্তু পাশে শশী থাকায় সেটা আর করা হয় উঠলনা। এক বুক আফসোস নিয়ে ওর রাতটা কাটাতে হবে।

মেয়েদের দেখে আরমান হাসিমুখে এগিয়ে আসল। মাশিয়ার কাছ থেকে বড় মেয়েকে কোলে নিয়ে, শশীর দিকে হাত বাড়ায়।

” কখন খাবে, ভাইয়া? ”

” সবাই খেয়েছে? ”

” হুম। শুধু আমরা চারজন বাকি আছি। ”

” আচ্ছা। আধাঘন্টা পর খাচ্ছি। আর শোন, ব্যাগে তোদের জন্য নতুন কাপড় রাখা আছে। বের করে দেখ পছন্দ হয় কিনা। ” আরমান ইশারায় ওর ব্যাগ দেখিয়ে দেয় শশীকে।

শশী ব্যাগ থেকে তিনটা প্যাকেট বের করল। দুইটা প্যাকেটের ওপরে ওর আর সুধার নাম লিখা আছে। বাকিটাতে কিছুই লিখা নেই। তাই একটু অবাক হয়ো শশী জিজ্ঞেস করল,

” এটাতে কি আছে, ভাইয়া? এই প্যাকেটে কারও নাম নেই তো! ”

” এটা ইনার জন্য। দে ইনাকে। খুলে দেখতে বল। পছন্দ না হলে আমাকে বলতে বলিস। প্রয়োজনে চেঞ্জ করে এনে দেব। ভিআইপিদের পোশাক কিনতে গেলে গলদঘর্ম হতে হয়। ”

আরমানের এমন খোঁচা দেয়া কথা শুনেও আজ মাশিয়ার মোটেও রাগ হলোনা। ওর কথা আরমান চিন্তা করেছে, ওর জন্য পোশাক এনেছে ভাবতেই ওর মন ভালো লাগায় ছেয়ে যায়।

শশী অসহায় চোখে তাকায় মাশিয়ার দিকে। ওর মাশিয়ার জন্য চিন্তা হচ্ছে। ও নিশ্চিত ভাইয়ার এমন কথা শুনে ওর ভাবির মন খারাপ হবেই হবে। কিন্তু মাশিয়ার দিকে তাকিয়েই ও বিস্মিত হয়ে গেলো। মাশিয়ার চোখমুখে মন খারাপের কোনই ছাপ নেই। বরং তার ঠোঁটের কোন প্রসারিত হয়ে আছে। মাশিয়ার হাসিমুখ দেখে হাঁফ ছাড়ল শশী। সেই সাথে বুক থেকে উবে গেল চিন্তার মেঘ। ও আবারও উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,

” পুতুলদের জন্য কি কিনেছ , ভাইয়া? ”

” পাশের ব্যাগে দেখ। ” আরমানের কথা শেষ হতেই শশী দ্রুত হাতে ব্যাগ খুলতে শুরু করল।

পুরো ব্যাগ ভর্তি বাচ্চাদের কাপড়। পোশাকগুলো দেখে শশীর মুখে কথা যোগায়না। ওর বারবার মনে হচ্ছে, এখনই ও ছোট হয়ে গেলে এইগুলো পরতে পারবে। এতক্ষণ কেন ছোট হচ্ছেনা!

” চন্দ্র, কালকে কুরিয়ার অফিসে যাবি। সেখানে পার্সেল এসেছে। তুই গিয়ে রিসিভ করবি। দশটার মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি। ”

” কিসের পার্সেল, ভাইয়া? ”

” সুধার হলুদ সন্ধ্যার জন্য ড্রেস কোড ঠিক করেছিলাম। সেগুলোই এসেছে। ”

” সবার জন্য! আমার জন্যও? ”

” হুম, সবার জন্য। ফুফু-ফুপা ,চাচা-চাচি, মামি, ভাই-ভাবি, বোন, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সবার জন্যই। তুই কাউকে সাথে নিয়ে যাস। একা একা নিয়ে আসতে পারবিনা। ”

” তুমি কত্ত ভালো সেটা কি তুমি জানো? ”

” নতুন পোশাক কিনে দিলেই আমি ভালো। যা ভাগ। আমাকে আমার আম্মাদের সাথে গল্প করতে দে। ”

শশী বেরিয়ে গেলে আরমান মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়।

মাশিয়া এতক্ষণ ওর কাপড়ের প্যাকেট বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিল। শশী বেরিয়ে যেতেই ও প্যাকেট খুলল। গাঢ় নীল রংয়ের জামদানী ওকে অভিভূত করল। শাড়ির সাথে ম্যাচিং গহনাও আছে! আবেগে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল ওর চোখের কোন বেয়ে।

” এই যে নন ভিআইপি, আপনাকেই বলছি? শাড়ীটা আমার ভিষণই পছন্দ হয়েছে। আপনাকে কষ্ট করে এটা চেঞ্জ করতে হবেনা। ” শাড়ীতে পরপর কয়েকটা চুমু খায় মাশিয়া।

আরমান আঁড়চোখে মাশিয়ার কর্মকাণ্ড দেখে মনে মনে হাসছে আর ভাবছে, মেয়েটার ছেলেমানুষী এখনও আছেই।

বাচ্চাদের ঘুমিয়ে দিয়ে আরমান ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। মাশিয়াও ওর পিছুপিছু গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসে।

ভাই-ভাবীকে দেখে সুধা খাবার বাড়তে শুরু করল। অতিথিরা খাওয়া শেষ করেছে অনেক আগেই। তারা এখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আরমানের প্লেটে মাছের একটা টুকরা দেখে মাশিয়ার কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে।

” সুধাময়ী, নন ভিআইপি পার্সনকে মাছের একটা টুকরো দিয়ে ইনসাল্ট করছ কেন! তারা অন্তত মাছের মাথা ডিজার্ভ করে। আর তাছাড়া সেই সাথে লেজও। আবার তুমি চাইলে মাছের কিডনি, ফুসফুস, নাড়িভুড়ি দিয়েও তাকে আপ্যায়ন করতে পার। প্রয়োজনে নিজের ভাগের মাছটুকুও দিতে পার। শশী তোমারটাও দাও তাকে। দেখলেনা সারাদিন কত পরিশ্রম করল। ”

” আমরা দিলে তোমার প্লেটের মাছের টুকরাও ভাইয়াকে দিতে হবে। ইনফ্যাক্ট এই দ্বায়িত্ব পালন করতে হয় একজন স্ত্রী কেই। তারপরও তুমি যখন বললে, তখন ভাইয়ার খাতিরে আমরা নিজেদের ভাগের খাবার ভাইয়াকে দিতেই পারি। ” শশীও কম যায়না।

” সরি চন্দ্রাবতী, আমি তাকে কাঁটার একটা অংশও দিতে পারবনা। তবে প্রয়োজনে তার থেকে খাবার ছিনিয়ে নিতে পারব এবং সেই সাহসও আমার আছে। দেখবে নাকি? ”

ওদের দুজনের কথপোকথন শুনে আরমান খাওয়া ভুলে তাকিয়ে আছে। ও বুঝতে চাইছে মাশিয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু সেটা কিছুতেই পারছেনা। তাই চুপচাপ থেকে দেখে যেতে চায় শেষ পর্যন্ত কি হয়।

সুধা বোধহয় মাশিয়ার কথা শুনেই আরমানের প্লেটে আরেক টুকরা মাছ দিল। আরমান নিতে চাইছিলনা তবুও ওর জোড়াজুড়িতে নিতে হল।

” সুধাময়ী, ভাত আরও দু চামচ বেশি দিও উনাকে। আহারে বেচারা, সারাদিনের খাটুনিতে কেমন শুকিয়ে গেছে। শোন, আমি ডিম খাবনা। আমার ভাগের ডিমটাও তাকেই দিও। মাছ, ডিম এখনই শেষ করে ফেল। সকালে খিচুড়ি, ডিম ভাজা, বেগুন ভাজা হবে। এগুলো কিন্তু সকালে কেউই খাবেনা। ” মাশিয়া মজা করে খাচ্ছে আর বলছে।

এইবার আরমান চুপ থাকতে পারলনা। খেঁকিয়ে উঠল মাশিয়ার ওপর। তবে ওর রাগ গিয়ে পরল সুধার ওপর।

” দে যে কয়টা মাছ, ডিম আছে আমাকেই দে। আমিতো রাক্ষস মনে হয় তার। আমার পেটকে বোধহয় ডাষ্টবিনও মনে করে আরেকজন। দে যা আছে দে। ”

আরমানকে রাগতে দেখে সুধা ঝিমিয়ে যায়। ও আঁড়চোখে মাশিয়ার দিকে তাকায়। কিন্তু মাশিয়া সেসব পরোয়া করার মত মেয়েই নয়। ও সুধার কাছ থেকে ডিম ভুনার বাটি নিয়ে আরমানের প্লেটে দুইটা ডিম তুলে দেয়। সেই সাথে আরেক টুকরা মাছও দেয়।

আরমান প্লেটে খাবারের গাদা নিয়ে বসে আছে। চার টুকরা মাছ, দুইটা ডিম এই মুহূর্তে ওর কাছে বোঝা মনে হচ্ছে। যদিওবা সারাদিনের খাটুনিতে প্রচণ্ড ক্ষুধাও লেগেছে। কিন্তু তাই বলে চার টুকরা মাছ, দুইটা ডিম খাবে!

” সুধা, এবার তাকে শুরু করতে বল। এভাবে ধ্যানমগ্ন সাধুর মত বসে থাকলে খাবার প্লেটেই পঁচবে। একটুকু খেলে কেউ রাক্ষস হয়ে যায়না। এই রিজিকই অনেকের ভাগ্যে জোটেনা। ” মাশিয়ার গলায় এমন কিছু ছিল, আরমান আর কথা বাড়ালোনা। চুপচাপ খেতে শুরু করল।

আরমানের দিকে তাকিয়ে মাশিয়া মৃদু হাসল। কতদিন পর মানুষটা বাড়িতে এসেছে। যেখানে থাকে সেখানে হয়তো খেতে পারেনা ঠিকমত। অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। মানুষটাকে খাওয়াতেই ওর এত কিছু। মাশিয়া ভালো করেই জানে, সুধা যদি তার প্লেটে এক টুকরার বেশি মাছ দিত, তবে সে ধমক দিত সুধাকে। আর সেই মাছ খেতওনা। তাই তাকে রাগিয়ে দিয়েই কাজ সেরেছে মাশিয়া।

আরমান দ্রুত খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে যায়। মেয়েরা ঘরে একা আছে।

মাশিয়াদের খাওয়া শেষ হলে ওরা সব গোছগাছ করে যে যার ঘরে যায়। কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। অনেক কাজ করতে হবে ওদের।

মাশিয়া ঘরে এসে দেখল আরমান ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। ও একটু উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল, আরমান এত মনযোগ দিয়ে কি দেখছে। কিন্তু ওকে নিরাশ হতে হল। অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পেলোনা কিছুই। কিন্তু ও আরমানকে না বিরক্ত করে শান্তি পাচ্ছেনা। তাকে একটু না খোঁচালে রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারবেনা। একটু ভাবতেই একটা বুদ্ধি আসল মাথায়। ও ঠোঁট কামড়ে হেসে নিজের ফোন হাতে নিল। ফেসবুকে লগ-ইন করে চ্যাটিং শুরু করল সাথে।

আরমানের কানে অনেকক্ষণ থেকেই ম্যাসেঞ্জারের টুংটাং শব্দ আসছিল। ও বিরক্ত হয়ে মাশিয়ার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল, মাশিয়া হাসিহাসি মুখে কারও সাথে চ্যাটিং করছে। মাশিয়ার এমন অ-বিবেচক কাজ দেখে আরমান রেগে গেল। ওর চিন্তা মেয়েদের নিয়ে। ফোনের শব্দে যদি মেয়েরা জেগে যায়! কিন্তু মাশিয়ার ভেতর মেয়েদের জন্য চিন্তার কোন লক্ষ্মণই দেখা গেলনা। ও হাসিমুখে গল্প করতে ব্যস্ত। এদিকে একের পর এক ম্যাসেজ আসছে।

মাশিয়া চোখের কোনা দিয়ে আরমানের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছে। আরমানকে রাগতে দেখে ওর ভিষণই শান্তি লাগছে। অবশেষে তাকে রাগাতে পেরেছে।

ফোন হাতছাড়া হতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল মাশিয়া। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আরমানের দিকে।

” বাচ্চারা যে ঘুমিয়ে আছে সেই চিন্তা এই বেয়াদব মেয়ের নেই! রাত সাড়ে এগারোটায় চ্যাট করতে ব্যস্ত সে! কালকেই এই ফোন যদি আমি পুকুরে না ফেলেছি তবে আমার নাম আরমান নয়। ”

” কি নাম রাখবেন বলে ঠিক করেছেন, স্যার? না মানে আগে থেকে জানা থাকলে সুবিধা হত। নিজ দ্বায়িত্বে সবাইকে আপনার নতুন নাম জানিয়ে দিতাম। ” মাশিয়াকে হাসতে দেখে আরমানের রাগ আরও বেড়ে যায়।

” সাহস কত তার! অন্যায় করে আবার হাসছে! রাত-বিরেতে চ্যাট করছে, আবার গলাবাজিও করছে! ”

” আমি কোন অন্যায়ই করিনি। আমিতো নিজের সাথেই চ্যাট করছিলাম। বিশ্বাস না হলে চেইক করুন। দুইটা আইডিতে লগ-ইন করা আছে। এক আইডি দিয়ে আরেক আইডিতে কথা বলছি। আমারতো কথা বলার মত কেউ নেই, তাই নিজের সাথে নিজেকেই কথা বলতে হয় । ” মাশিয়া অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে কথাগুলো বলল।

মাশিয়ার কথা শুনে হতভম্ব আরমান ফোন চেইক করে দেখল মাশিয়া সত্যি কথাই বলছে। ও বোকা বনে গেল। আরমানের বোকা বোকা মুখ দেখে মাশিয়া আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে মেয়েটা। ওর হাসি দেখে আরমান রাগে ফোন মাশিয়ার কাছে ছুঁড়ে মারল।

চলবে…

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৫০
জাওয়াদ জামী জামী

সুধা, শশী, মাশিয়াসহ বাড়ির প্রত্যেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে রাখা নতুন কাপড়গুলোর দিকে। প্রায় ২০০+ শাড়ী আর পাঞ্জাবীর স্তুপ ওকে সত্যিই হতবাক করেছে। সাদা আর গোলাপির সংমিশ্রণে হ্যান্ডলুম সুতির শাড়ী সত্যিই নজরকাড়া লাগছে। এরইমধ্যে আরমান একটা লিষ্ট এনে মাশিয়ার কাছে দিয়েছে। সেখানে লিখা আছে শাড়ী, পাঞ্জাবীগুলো কারা কারা পাবে।

দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রত্যেককেই তাদের শাড়ী, পাঞ্জাবী দিতে গিয়ে মাশিয়া লক্ষ্য করল সবার জন্য শপিং করলেও আরমান নিজের জন্য কিছুই কিনেনি। কষ্টে ওর কান্না পাচ্ছে। ও নিজের শাড়ী নিয়ে ঘরে এসে শাড়ীটার একটা ছবি তুলে তৃষার হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দেয়। সেই সাথে প্যাকেটে থাকা ঠিকানাও জানিয়ে দেয়। যেখান থেকে আরমান অর্ডার দিয়ে এসব তৈরী করে নিয়েছে। আগামীকাল সুধার গায়ে হলুদ। তৃষারাও আগামীকালই গ্রামে আসবে। আর আরমান ঢাকা থেকেই এসব পোশাক আনিয়েছে। তৃষাকে ডিটেইলস বলে দেয় ওর কি করতে হবে।

প্রত্যেক আত্নীয়-স্বজনরা আরমানের কাছ থেকে পোশাক পেয়ে ভিষণই খুশি হয়েছে। কয়েকজন প্রতিবেশির জন্যও শাড়ী, পাঞ্জাবী অর্ডার করেছিল আরমান। তারা খুশিতে কেঁদে ফেলেছে। আজ পর্যন্ত তাদের সাথে এমনটা ঘটেনি।

” আপনার পাঞ্জাবী কোথায়? আর বিয়ের দিনই বা কি পরবেন? ” আরমান ঘরে ঢুকলেই মাশিয়াও কোথায় থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।

” আমার এসব ভালো লাগেনা। আর তাছাড়া বিয়ের দিন আমার নতুন পোশাক পরিধানের সময় কোথায়। সারাদিন কাজেই ব্যস্ত থাকতে হবে। ” মাশিয়া এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হয়, এই ত্যাড়া লোক নিজের জন্য কিছুই কিনেনি। ওর এবার ভিষণ রাগ হচ্ছে।

” আসছে মহামানব। সবার দিকে তার নজর, কিন্তু নিজের বেলায় ঠনঠনাঠন। অসহ্য লোক একটা। ” আরমানকে আরও কয়েকটা গালি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মাশিয়া।

আরমান ভ্রু কঁচকে তাকিয়ে থাকল গমনোদ্যত মাশিয়ার দিকে। এই মেয়েটাকে সে এখন পর্যন্ত পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি।

মাটির বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হতে আর দেরি নেই। ছেলেমেয়েরা যেন একেকটা রঙ্গিন প্রজাপতি। তারা মনের আনন্দে এখানে সেখানে উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ওর বোনেরা আর মাশিয়া এখনও তৈরী হয়নি। আরমান কাঁজের ফাঁকেই লক্ষ্য করল বড়দের সাথে তাল মিলিয়ে মাশিয়াও সমান তালে কাজ করছে।

দুপুর গড়াতেই মাশিয়াকে ওর মামি শ্বাশুড়ি তৈরী হতে বলল। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই বরের বাড়ি থেকে হলুদের তত্ব নিয়ে আসবে। যেহেতু তারা ঢাকা থেকে আসবে তাই একটু তারাতারিই আসছে। এখান থেকে তারা সন্ধ্যার আগেই ফিরে যাবে। মাশিয়া কিছুক্ষণ গাঁইগুঁই করে নিজের ঘরে যায়। এক ঘন্টারও বেশি হয়েছে ও মেয়েদের দেখেনি। মেয়েদের জন্য ওর মন কেমন করছে। তাই আবারও ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। এখানে-সেখানে খুঁজে বাচ্চাদের না পেয়ে ও যায় বাহিরের উঠানে। সেখানে বাচ্চাদের দেখতে পায়। আরমান আর মিরাজ মোর্তাজার কোলে আছে ওরা। সেখানে আরও কয়েকজন বসে আছে। মাশিয়া হাসিমুখে এগিয়ে যায়।

” প্রিন্সেসকে ভাইয়ার কাছে দিয়ে আপনি একটু ভেতরে আসেন। ” মাশিয়া ইশারায় আরমানের চাচাতো ভাইয়ের কাছে দিতে বলল ওর ছোট মেয়েকে। এখানে অনেকেই আছে তাই আরমান নিরবে মাশিয়ার কথা শুনল। ও প্রিন্সেসকে ওর চাচাতো ভাইয়ের কাছে দিয়ে মাশিয়ার সাথে বাড়িতে ঢুকল।

” তোমার কি লজ্জা শরম নেই! উঠান ভর্তি মানুষের সামনে থেকে তুমি আমাকে ডেকে নিয়ে আসলে! দিনদিন বয়স বাড়ছে না কমছে? ”

” এটা আবার জিজ্ঞেস করার মত সাবজেক্ট হলো নাকি! আপনিতো ভালো করেই জানেন আমি নির্লজ্জ, বেহায়া, বেয়াদব সবকিছুই। এককথায় একজন খারাপ মানুষের যা যা গুণাবলী থাকা দরকায় তার সবই আমার মধ্যে আছে। তারপরও কেন অবুঝের মত কথা বলেন! আসলে আপনার মত ভালো মানুষদের নিয়ে এই এক সমস্যা। তারা সবাইকে নিজের মত ভালো ভাবতে পছন্দ করে। ”

মাশিয়ার কথা শুনে রাগ উঠলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল আরমান। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

” অভিনয় না করে বল কি হয়েছে? কেন ডাকলে আমাকে? ”

মাশিয়া আলমারি থেকে একটা প্যাকেট বের করে আরমানকে দেয়।

” এটা পরে নিন। ”

” কি আছে এতে? ”

” খুলেই দেখুন। ”

আরমান প্যাকেট খুলে পাঞ্জাবী দেখে অবাক হয়ে গেছে। ও তো নিজের জন্য অর্ডার করেনি। তবে?

” কোথায় থেকে পেয়েছ এটা? ”

” আপনি যেখান থেকে সবার জন্য এনেছেন। কথা না বাড়িয়ে তৈরী হয়ে নিন। আধাঘন্টার মধ্যেই বরপক্ষ তত্ব নিয়ে এসে যাবে। ”

” টাকা কোথায় পেয়েছ? ” আরমান কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল।

” আপনি প্রতিমাসে বাচ্চাদের জন্য টাকা দিতেন, সব টাকা লাগতনা। সেই টাকা থেকেই আনিয়েছি তৃষাকে দিয়ে। সবাই নতুন পোশাক পরবে কিন্তু আপনি পরবেননা এটা মানতে পারিনি কিছুতেই। ”

মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করলনা আরমানের। মেয়েটার মন ভাঙতে ইচ্ছে করছেনা মোটেও। পাঞ্জাবী বিছানায় রেখে বাহিরে যাওয়ার উপক্রম করতেই মাশিয়া চিৎকার করে উঠল।

” আপনি এটা পরবেননা? তাহলে আমিও আজকে এভাবেই থাকব। এবং কালকেও নতুন শাড়ীটা পরবনা। ”

মাশিয়ার চিৎকারে আরমান বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরে তাকায়।

” আরে গাধী, আমি কলপাড়ে যাচ্ছি। ফ্রেশ না হয়েই পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে সঙ সেজে ঘুরব! ”

মাশিয়া নিজের বোকামির জন্য একটুও অপ্রভিত হয়না। সে-ও আরমানের পিছুপিছু কলপাড়ে যায়। উদ্দেশ্য সে নিজেও ফ্রেশ হবে আরমানকে বিরক্ত করবে।

” তুমি এখানে আসলে কেন! এতক্ষণ ঘরে আমার মাথা খেয়েও শান্তি পাওনি? আবার এখানে চলে এসেছ? ” মাশিয়াকে পিছু পিছু আসতে দেখে আরমান বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল। ও খেয়াল করল উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশিরা ওদের দেখে মিটিমিটি হাসছে।

” আপনার মাথা যে কত টেস্টি সেটা যদি জানতেন তবে এই কথা বলতে পারতেননা। আপনার মাথা খাওয়ার মধ্যে আলাদা মজা আছে, বুঝলেন? ”

” ধুত্তেরি, তুমিই যাও। ” আরমান দাঁড়িয়ে যায়।

” আরে মহাপণ্ডিত, আমিও ফ্রেশ হতেই যাচ্ছি। আপনার মত ত্যাঁদোড় লোকের মাথায় যে উপাদেয় কিছুই নেই সেটা আমি ভালো করেই জানি। ” মাশিয়া আরমানকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাঁটা ধরল কলপাড়ের দিকে।

মাশিয়াকে এমন রূপে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল আরমান। ওর চুলগুলো হাঁটু ছুঁয়েছে। অথচ আগে ওর কোমড় সমান চুল ছিল। আরমান গত কয়েকমাসে একবারের জন্যও লক্ষ্য করেনি মাশিয়ার এই পরিবর্তন। কানে প্লাটিনামের ঝুমকা পরেছে। যেগুলো আরমান মালয়েশিয়া থেকে ওর জন্য এনেছিল। আর দু হাতে দু গাছি রেশমি চুড়ি, ব্যাস এতেই ওকে অপরূপা লাগছে। মুখে সাজের কোন বালাই নেই। শুধু ঠোঁটে লিপ গ্লজ দিয়েছে। মেয়েটা আগের থেকে অনেক পরিনত হয়েছে। স্বাস্থ্যও বেড়েছে কিছুটা। মাতৃত্বের সব লক্ষ্মণই ওর মধ্যে বিরাজমান। আরমানকে দেখে ওর দিকে এগিয়ে যায় মাশিয়া। আরমানের হাতে চিমটি কেটে স্নিগ্ধ হেসে বলল,

” আয়হায় মে তো মারগায়ি। মাশা-আল্লাহ, আমার জামাইকে কত সুন্দর লাগছে। কারও নজর না লাগুক। খবরদার কোন মেয়ের দিকে তাকাবেননা। অপরিচিত কোন মেয়ের সাথে কথা বলবেননা। যেকোন একটা মেয়েকে কোলে রাখবেন যতক্ষণ মেহমান বাড়িতে থাকবে। যাতে করে সবাই বুঝতে পারে আপনি অন্য কারও সম্পত্তি। একদম রেজিস্ট্রি করা সম্পত্তি। ”

” কিহ! তুমি কি পা’গ’ল? আমি কি করব না করব সেটা তোমার থেকে শুনে করব নাকি! দেশে পুরোনো পা’গ’লে’র ভাত নেই, আর তুমি নতুন পা’গ’ল আমদানি হলে কোথায় থেকে? ”

” যতই বাহানা করেননা কেন, আপনাকে আমার কথা শুনতেই হবে। যদি আমার কথার এদিক-সেদিক করেন, তবে আপনার বড় মামার কাছে বিচার দেব এটা নিশ্চিত থাকেন। ” দেখি সরতো। আমাকে যেতে দাও। বাহিরে অনেক কাজ আছে। আসছে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। মাশিয়াকে ধাক্কা দিয়ে আরমান ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

আরমানের এমন কাজে রাগে কপাল কুঁচকে তাকায় মাশিয়া। রাগে দাঁতে দাঁত পিষছে। নেহাৎ বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন তাই ও চুপ থাকল।

আরমান উঠানে গিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। মাশিয়া আনমনা হয়ে কিছু একটা বলছে। রাগে মেয়েটার মুখ লাল হয়ে গেছে। আজকে বোধহয় মেয়েটাকে একটু বেশিই স্নিগ্ধ লাগছে।

মাশিয়ার দম ফেলার সময় নেই। মেহমানদের আপ্যায়ন করতে গিয়ে ওর অবস্থা কাহিল। সুধার শ্বশুর বাড়ি থেকে হলুদের তত্ব নিয়ে এসেছে। শশী ওদের নিয়ে ব্যস্ত। মাশিয়াকে বাধ্য হয়ে বড়দের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। শ্বাশুড়ি না থাকায় সব দ্বায়িত্ব ওর কাঁধে এসেছে।

মাশিয়া অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছে, একটা মেয়ে আরমানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সুযোগ পেলেই আরমানের সাথে গল্প জুড়ে দিচ্ছে। আরমানও হেসে হেসে সেই মেয়েটার সাথে কথা বলছে। অনিকের বোনের কাছ থেকে মাশিয়া জানতে পেরেছে মেয়েটা অনিকের কাজিন। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।

” হেই ভাইয়া, আসেন সেলফি তুলি। আমাকে আপনার গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবেন চলুন। আপনার মত আপনার গ্রামও বেশ সুন্দর। ” অনিকের কাজিন পিহু আরমানের বাহু জড়িয়ে ধরল।

মাশিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটাই শুনল। ওর নজর আরমানের দিকে। আরমান হাসছে। আরমানের ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি দেখে মাশিয়ার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আঁখি দ্বয় লোনাজলে টইটুম্বুর। এদিকে মেয়েটা একের পর এক সেলফি তুলেই যাচ্ছে। দুর্বল পায়ে নিজের ঘরে চলে যায় মেয়েটা।

” চলুননা বাহিরে যাই। ” পিহু নামের মেয়েটা অনুনয় করল।

” ওযেট করুন, আমি আমার ফ্রেন্ডদের ডাকছি। ” আরমান পিহুর হাত ছাড়িয়ে বলল।

” আপনার কোন বন্ধু থাকবেনা আমাদের সাথে। শুধু আমি আর আপনি থাকব। চলুনতো, এমন করছেন কেন! আমি শুনেছি আপনিও ঢাবি’র স্টুডেন্ট ছিলেন। তবে এত আনইজি ফিল করছেন কেন! বি ইজি, হ্যান্ডসাম।”

” আমার হাত ধরে এভাবে টানাটানি করবেননা। আমার বউ দেখলে দুজনেরই খবর আছে। ওকে আমার বন্ধুদের সাথে যেতে চাননা ঠিক আছে, আমার মেয়েদের সাথে নেই। ”

” আমি জানতাম আপনার বউ আধুনিক মেয়ে। সে আবার এসবের কেয়ার করে নাকি! আমিতো আপনার সাথে প্রেম করছিনা, বেড়াতেই যেতে চাচ্ছি শুধু। আর প্রেম করলেও দোষের কিছু দেখছিনা। এসব একটুআধটু হয়েই থাকে। একজন নারীর বিপরীতে যদি আপনার মত সুপুরুষ থাকে, তবে সেই নারী একবারও দেখবেনা সুপুরুষটি বিবাহিত না অবিবাহিত। নারীর কামনায় সেই সুপুরুষটিই থাকবে। যেমনটা আমার কামনায় আপনি আছেন। আপনাকে পেতে নিজের জীবন বাজী ধরতে এক সেকেন্ডও দ্বিধা করবনা আমি।”

মেয়েটার কথা শুনে আরমান ঘামছে। ও বুঝতে পারছে মেয়েটার থেকে ওকে দূরে থাকতে হবে। চিন্তার মাঝে আরমান খেয়ালও করলনা ওর পেছনে মাশিয়া এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরে ফিরে যাবার পর মাশিয়া বুঝতে পেরেছে ও ভেতরে এসে ভুল করেছে। তাই আরেকবার আরমানের কাছে যায় ওকে ডাকতে।

আরমান আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। এই মেয়েটার হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইছে কায়মনে। মেয়েটার ওপর রাগও হচ্ছে প্রচুর। শুধু বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারছেনা ও। আজ যদি এটা বিয়ে বাড়ি না হতো, তবে মেয়েটাকে থাপড়িয়ে ওর ভিমরতী ছুটিয়ে দিত।পেছনে তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে যায় আরমান। মাশিয়া উদভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে টুপটাপ ঝরছে অশ্রুধারা।

চলবে…