যেখানে_দিগন্ত_হারায় পর্ব-২৯+৩০

0
209

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী জামী

খসখস আওয়াজে চমকে উঠে বসল মাশিয়া। চার্যারের আলোতে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত একটা বিশ। এদিকে খসখস আওয়াজ বেড়েই চলেছে। আবার থেকে থেকে ফিসফাস কথাও শোনাও যাচ্ছে। মাশিয়া ভালো করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। ঘরের পেছনে কেউ রয়েছে। এবার মাশিয়ার ভয় হচ্ছে। ও বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। আয়েশা খানম, সুধা দুজনের ঘরের দরজাই বন্ধ। লাইব্রেরীর দিকে চোখ পরতেই দেখল দরজা খোলা আছে, আর আলোও জ্ব’ল’ছে। তার মানে আরমান জেগে আছে। মাশিয়া আর দেরি না করে দৌড়ে চলে যায় সেখানে।

আরমান চেয়ারে বসে পড়ছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় ও দরজা-জানালা খুলেই রেখেছে। মাশিয়া হঠাৎই এসে ঝাঁপিয়ে পরল ওর বুকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল আরমান। ও চেয়ার সুদ্ধ উল্টে যেতে গেলেই টেবিলের পায়া ধরে সামাল দেয়। কিন্তু মাশিয়ার সেদিকে কোন নজর নেই।

” রাত-বিরেতে এসব কি শুরু করলে! মাঝেমধ্যে তোমার হয় কি বলতো? হুটহাট এমন কলিজার ওপর আক্রমণ কর কেন? আমার কলিজা কি সরকারি সম্পত্তি? ” আরমান বাম হাতে জড়িয়ে রেখেছে মাশিয়াকে। ও কথাগুলো বলল ঠিকই কিন্তু মাশিয়াকে ছাড়লনা।

” ঘরের পেছনে কেউ আছে। সেখান থেকে কথার আওয়াজ আসছে। মনে হচ্ছে কয়েকজন আছে সেখানে। আমার ভিষণ ভয় লাগছে। ” মাশিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। ও সত্যিই ভিষণ ভয় পেয়েছে।

” যে আছে থাকুকনা। সে-তো তোমার কোন ক্ষতি করছেনা। তুমি তোমার মত ঘুমাও। ” আরমানের দৃষ্টি মাশিয়ার দিকে।

” উঁহু, আমি ঘরে একা থাকতে পারবনা। আপনিও চলুন। ওরা যদি ভেতরে ঢুকে যায়?”

” চিন্তা করছ কেন? জানালা বন্ধ আছে। কিছুই হবেনা। ” আরমান মাশিয়াকে অভয় দিচ্ছে।

” তবুও আপনি চলুন। আর নয়তো আমাকে এখানে থাকতে দিন। ”

” এই ছোট চৌকিতে দু’জনের জায়গা হবেনা। আচ্ছা ঘরে চল, আমি দেখছি। ”

মাশিয়া আরমানকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আরমান বই হাতে নিয়ে চার্যার অফ করে বাহিরে আসল। মাশিয়াও আরমানের গা ঘেঁষে হাঁটছে। ও ডান হাতে আরমানের একটা হাত ধরে রেখেছে।
আরমান ঘরে এসে দক্ষিণের একটা জানালা খুলে দেয়। অন্ধকারেই আশপাশ দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হয়। সে-ও ফিসফাস আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।

” কে ঐখানে? কে কথা বলছে? ” একটু জোড়েই বলল আরমান। কিছুক্ষণ নিরবতার পর পেছন থেকে কেউ কথা বলল,

” ভাই, আমি রাকিব। ”

” এতরাতে এখানে কি করছ? জানোনা বাড়িতে মেয়েরা থাকে? ওরা শব্দ শুনে ভয় পেতে পারে? ” আরমান ছেলেটাকে চিনতে পেরে ধমকে উঠল।

” ভাই, রাগ কইরেননা। আমরা যাইতাছি। ”

” ঠিক আছে যাও। আর কখনো এখানে এসে বসবেনা। ”

আরমান জানালা বন্ধ করে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়। মাশিয়া সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আরমান কাছে আসতেই মাশিয়া টুপ করে আরমানের গালে চুমু দেয়।

” থ্যাংকিউ, অসভ্য মাস্টার। সত্যিই আপনার সাহস আছে। ”

আরমান গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। মাশিয়া কি সত্যিই ওকে চুমু দিয়েছে! আরমানকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাশিয়া ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়। সেই সাথে একটু আগে করা নিজের কাজের জন্য লজ্জা পায়। তাই লজ্জা ঢাকতে আরমানের ঘাড়েই দোষ চাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

” এভাবে খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? শুয়ে পরুন। এত ভাবাভাবির কিছুই নেই। চুমুটা আপনাকেই দিয়েছি। ছেলেগুলো এখান থেকে চলে যাবে সেই আনন্দেই দিয়েছি। ওরা যাচ্ছে জন্য ওদেরকে ডেকে তো চুমু দিতে পারিনা তাই-না? যদিও সব ক্রেডিটই ওদের। কিন্তু চুমু আপনাকেই দিতে হল। হোয়াট স্যুড আই ডু ইফ দেয়ার লাক ইজ ব্যাড? ”

এই প্রথম মাশিয়ার এমন কথায় আরমানের হাসি পায়। মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। তাই ওকে আরেকটু লজ্জা দেয়ার লোভ সামলাতে পারলনা।

” ওরা বোধহয় বেশিদূর যায়নি। আশেপাশেই কোথাও আছে। এক কাজ করি, ওদেরকে ডেকে নিয়ে আসি? তখন তুমি ইচ্ছেমত ওদের চুমু দিও? একটামাত্র বউয়ের ইচ্ছেই যদি পূরণ করতে না পারি তবে কেমন স্বামী হলাম আমি! ”

কিন্তু আরমানের কথা শুনে মাশিয়া লজ্জা পাওয়ার বদলে রেগে গেল।

” অসভ্য মাস্টার, আপনাকে আমি খু’ণ করব। এখন আমার ইচ্ছেটা পূরণ করবেন, হুম? একমাত্র জামাই হিসেবে স্ত্রী’র ইচ্ছে পূরণ করা আপনার জন্য ফরজ কাজ। করবেন আমার ইচ্ছে পূরণ? ” মাশিয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

” আমি কি ইচ্ছেপরী নাকি? তুমি যখন যেটা বলবে সেই ইচ্ছেই পূরণ করব! যাও ঘুমায়। রাত-বিরেতে আবোলতাবোল কিসব বলছ! ”

” আপনি ইচ্ছেপরী হবেন কেন! আপনিতো ইচ্ছে কি বলে ঐটাকে? কি বলে? কি বলে? ও হ্যাঁ, মনে পরেছে। আপনিতো ইচ্ছেজ্বিন। আমার সব ইচ্ছে পূরণ করবেন। ” মাশিয়া পারলে আরমানকে খু’ণ করে।

” তুমি কি ঘুমাবে? নাকি আমি লাইব্রেরীতে চলে যাব? ”

আরমানের হুমকি কাজে দেয়। মাশিয়া সুড়সুড় করে বিছানায় যায়। আরমানও চেয়ারে বসে বই হাতে নেয়।

” আপনি পড়বেন? কি এত পড়ছেন? ”

” বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছি, আরও একঘন্টা পড়ব। তুমি ঘুমাও। ও ভালো কথা। তোমার রেজাল্ট আর কিছুদিন পর দেবে সেটা কি জানো? ”

” নাহ্। ” ছোট্ট করে উত্তর দিল।

” দরকার নেই জানার। রেজাল্ট হাতে পেলেই জানতে পারবে, আগে থেকে প্যারা নেয়ার দরকার নেই। ”

মাশিয়া বুঝল আরমান ওকে খোঁ’চা দিল। তবুও ও চুপ মে’রে যায়। কারন ওর নিজের পড়াশোনা কিংবা পরীক্ষার ওপর নিজেরই ভরসা নেই। তাই রেজাল্টও যে ভালো হবেনা সেটা ও মোটামুটি নিশ্চিত। তাই আরমানের সাথে পড়াশোনার বিষয় নিয়ে লাগতে যাওয়ার মত বোকা মেয়ে মাশিয়া নয়।

সকাল থেকেই আয়েশা খানম গোছগাছ শুরু করছেন। আজ রাতের গাড়িতে আরমান সুধাকে নিয়ে ঢাকা যাবে। আরমান ঘরে এসে নিজের ব্যাগ গোছাচ্ছে। মাশিয়া বসে বসে আরমানের কাজ দেখছে।

” কতদিনের জন্য দেশান্তরী হচ্ছেন? ”

” দেশান্তরী বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছ? তুমি কি চাওনা আমি আবার বাড়িতে আসি? ” মাশিয়ার কথা শুনে আরমান জানতে চায়।

” আমার চাওয়া কিংবা না চাওয়াতে যে আপনার যায় আসেনা এটা আমি ভালোই বুঝি। আপনার কুসুম কিংবা স্নিগ্ধার কথা হলে আলাদা ছিল। তাদের কথা আপনি আবার ফেলতে পারেননা কিনা। আমি শুনেছি আপনি নাকি টপ স্টুডেন্ট ছিলেন। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার রোড সাইড রোমিও বৈ আর কিছুই মনে হয়না। সারাদিন নারী দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকেও কিভাবে মানুষ ভালো রেজাল্ট করে! ” খাটে বসে পা দোলাচ্ছে মাশিয়া। সেই সাথে মিটিমিটি হাসছে।

” আমাকে তোমার রোড সাইড রোমিও বলে মনে হয়! এক মিনিট, নারী দ্বারা পরিবেষ্টিত বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছ? এই প্রশ্নের উত্তর আগে দাও, তারপর তোমার ব্যবস্থা আমি করছি। ”

আরমানের হুমকিতে মাশিয়া আজ একটুও ভয় পেলোনা। ও দ্বিগুণ উৎসাহে কথা বলল।

” নারী দ্বারা পরিবেষ্টিত মানে হচ্ছে আপনি মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করতেন। আর বিয়ের পরও সেই স্বভাব যায়নি। বোঝাতে পেরেছি লুচু মাস্টার? আর আপনি আমার কি ব্যবস্থা করবেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে যে আপনার চরিত্রের অধঃপতন হয়েছে সেটা যদি আম্মা জানতে পারে তখন কি হবে ভেবে দেখেছেন? ”

” ভয় দেখাচ্ছ! হাহ্ দুর্বল পয়েন্ট। তোমার কথা আম্মা কোনদিনই বিশ্বাস করবেনা। তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম, আমি মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করতাম। এতে তোমার কি? জ্ব’ল’ছে নাকি? জ্ব’লে-পু’ড়ে ছাই হবার আগেই ঠান্ডা পানিতে নিজেকে ভিজিয়ে নাও। নয়তো আজীবন এভাবে জ্ব’ল’তে’ই থাকবে। আগে না হয় নারী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতাম। কিন্তু এখন পেত্নী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতে হচ্ছে! কত দূর্ভাগ্য হলে একজন মানুষের ভাগ্যের এমন অধঃপতন হয়, ভাবলেই আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে। ”

মাশিয়া আরমানের শেষের কথা শুনে রেগে আ’গু’ন হয়ে গেছে। কিন্তু সাথে সাথে নিজেকে সামলে নেয়। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দেয়, ” কুল মাশিয়া, কুল। নিজেকে শান্ত রাখ। এই খ’চ্চ’রে’র সাথে লাগতে যাসনা। শেষে দেখবি এই অসভ্য মাস্টার তোকেই নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। ”

” তো নারীদের হিরো, কতদিনের জন্য দেশান্তরী হচ্ছেন সেটাতো বলুন? অতীতের নারীদের সাথে সাক্ষাৎ হবে জন্য এখন থেকেই হাওয়ায় উড়ছেন। তা কি কি প্ল্যান করে রেখেছেন? ”

মাশিয়ার কথা শুনে আরমানের হাসি পাচ্ছে। আরমান কাপড় গোছানো বাদ দিয়ে মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

” প্ল্যান তো করেছি অনেক। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। তুমি কি যাবে নাকি আমার সাথে? নিজের চোখেই দেখতে সব। ”

মাশিয়া খাট থেকে নেমে আরমানের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

” আমার মোটেও ইচ্ছে করছেনা আপনার অতীতের নারীদের দেখতে। আমি কি ওদের থেকে কম নাকি! আমি চাইলেও আপনার মত লুচুদের আঙ্গুলে নাচাতে পারি। ” আরমানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর চোখেমুখে ফুঁ দেয়।

মাশিয়ার এমন কাজে আরমান ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। মাশিয়ার এমন আচরণ ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। ও বোঝার চেষ্টা করছে মাশিয়া কি চাইছে।

” কি আর করব বল, বর্তমানে যদি কপালে পেত্নী থাকে, তবে অতীতের নারীদের দিয়েই তো কলিজা ঠান্ডা করতে হবে। কিন্তু তুমি শেষে কি বললে? তুমিও কাউকে আঙ্গুলে নাচাতে পার! মাই গড! তুমি ছিলে ভার্সিটির আতংক। সবাই পারলে তোমার থেকে দশ হাত দূরে থাকত। সেই তোমার মুখে এসব কি শুনছি! ”

” অপমান করবেননা বলে দিলাম। আবারও এমন কথা বললে কলিজা টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলব। ঢাকা যাবে জন্য খুশিতে বাক-বাকুম করছে! বদ লোক একটা। আমি সুধার কাছ থেকে সব শুনব। বাড়িতে যখন আসবেন, তখন আপনাকে মজা দেখাব। ” মাশিয়া আরমানের চুল মুঠোর মধ্যে নিয়ে ইচ্ছেমত ঝাঁকিয়ে দেয়।

মাশিয়ার হাত থেকে ছাড়া পেতেই আরমান মাশিয়ার কোমড় ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

” তুমিতো শুধু মজাই দেখাতে পারো। ঐ কাজে তুমি এক্সপার্ট। তবে সেটা আমি দেখতে চাইনা। অবশ্য অন্য কিছু দেখাতে চাইলে না করবনা। দেখাবে নাকি? ”

আরমানের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে মাশিয়ার শরীর শিরশির করতে থাকে। হার্টবিটেরা ছন্দ হীন তালে দ্রীমদ্রীম করে দামামা বাজিয়ে চলছে অনবরত। ইচ্ছে করছে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু ওর পদযুগল যেন গেঁথে রয়েছে মেঝের সাথে। মাশিয়া আর নিজেকে সামলাতে পারেনা মাথা রাখে আরমানের বুকে।

নিজের বুকে মাশিয়াকে আবিষ্কার করতেই সুখে আরমানের শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। তাহলে কি অবশেষে সিংহী ভালোবাসার বাঁধনে আটকা পরলো? আরমানের এই মুহুর্তে কিছুই বলতে ইচ্ছে করলনা। এ ক্ষন শুধু দু’জন দু’জনকে অনুভবের।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে কেউ বলতে পারেনা। নিরবতা ভাঙে মাশিয়ার ডাকে।

” এই যে অসভ্য মাস্টার? ”

” হুম। ”

” কবে আসবেন? ”

” আট থেকে দশদিন পর। তুমি যাবে আমাদের সাথে? ”

” উঁহু। আপনিই যান। কিন্তু খবরদার মেয়েদের আশেপাশে যাবেননা। তাদের থেকে দূরে থাকবেন। ”

” যদি না থাকি? ”

” অসভ্য মাস্টার তোকে তো আমি খু’ণ’ই করে ফেলব। ” মাশিয়া রেগে আরমানের বুকে খামচি দেয়।

” তুই তোকারি করছ কেন? ঘরে পেত্নী বউ থাকলে, মানুষ সুন্দরীদের খোঁজে এদিকসেদিক ঘুরবে এটাইতো স্বাভাবিক। ”

” আমি সুন্দরী নই? আমি সুন্দরী না হলে আপনিও একটা ঢেঁড়শ। হিরো আলমও আপনার থেকে হ্যান্ডসাম। ”

” যাবে নাকি তোমার হিরো আলমের কাছে? তাহলে চল দিয়ে আসি। ”

” আমি এখানেই থাকব। কোথাও যাবোনা। ” মাশিয়া আরমানের ওপর নিজের শরীর এলিয়ে দিল। আরমানও পরম ভালোবাসায় আগলে রাখল ওর আকাঙ্ক্ষিত নারীকে।

চলবে…

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী জামী

” এই টাকাগুলো রাখ। আমি না আসা পর্যন্ত আম্মার সাথে ঘুমাবে। কোন সমস্যা কিংবা কোনকিছু প্রয়োজন হলে আম্মাকে বলবে। ” আরমান মাশিয়াকে কিছু টাকা দিয়ে কথাগুলো বলল।

মাশিয়া ওর হাতে থাকা টাকাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর ও একটু হেসে বলল,

” মেয়েদের থেকে দূরে থাকবেন। প্রয়োজন হলেও কোন মেয়ের সাথে কথা বলবেননা বলে দিলাম। আমি কিন্তু সুধার কাছ থেকে সবকিছু শুনব। যদি তেমন কিছু শুনি, তখন আপনার খবর আছে। ”

মাশিয়ার কথা শুনে আরমান হাসল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আর সময় বেশি নেই, এখনই বেরোতে হবে। তবুও সে মাশিয়াকে টেনে নিজের কাছে নেয়। মাশিয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,

” বলললামনা আমার সাথে চল? তাহলে নিজের চোখেই সব দেখতে পেতে, আমি কি করছি না করছি। সুধার কাছ থেকে কিছুই শোনার প্রয়োজন হতোনা। এখনও সময় আছে, চল যাই। ”

মাশিয়া আরমানের শার্টের বোতাম খুলে আবারও লাগিয়ে দিল। এরপর আরমানের ঘাড়ে হাত রাখল।

” উঁহু, এখন কোথাও যাবনা। কিন্তু আমি যাচ্ছিনা বলে নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ মনে করে যত্রতত্র উড়বেননা বলে দিচ্ছি। যদি এমন কিছু শুনি তখন আপনার ঠ্যাং ভেঙে দেব। ” মাশিয়ার গলায় শাসনের সুর।

” পারবে ভাঙতে? কষ্ট হবেনা? কিন্তু হঠাৎ করেই সিংহীর বিড়ালে রুপান্তরীত হওয়ার কাহিনী এখনও বুঝলামনা। ”

” এতদিন আপনার সাথে বাস করে কি শিখলাম তাহলে! আপনার অস্ত্র দিয়ে আপনাকেই ঘায়েল করব। বুঝেছেন, অসভ্য মাস্টার? আশার করছি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন? ” মাশিয়া আরমানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দেয়।

” সত্যিই তোমার কথার মানে বুঝিনি। একটু বুঝিয়ে দেবে? ” আরমান মাশিয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারলনা। তাই ও মাশিয়ার কাছে জানতে চাইল।

” যাওয়ার সময় এসব শুনতে নেই। এই আপনার দেরি হচ্ছেনা? ”

” হচ্ছে তো। কিন্তু তুমি আমাকে ধরে রেখেছ। আর এই মূহুর্তে তোমার বাঁধন থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে করছেনা। ”

আরমানের কথা শোনামাত্রই মাশিয়া ঝট করে আরমানের ঘাড় থেকে হাত নামায়।

” এবার না গেলে বাস মিস করবেন। আমি কি কি বলেছি সব মনে রাখবেন কিন্তু। ”

” মনে থাকবে। ” আরমান হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

তিনদিন হচ্ছে আরমান ঢাকা গেছে। মাশিয়া মনে আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও আর শশী বেশিরভাগ সময়ই বাগানে বসে আড্ডা দেয়। যেহেতু খরমান নেই তাই ওদের আপাতত পড়ার জন্য কোন ধমকও খেতে হচ্ছেনা। আয়েশা খানমও ছেলের বউকে কিছুই বলেননা। তাই মাশিয়া নিজের মতই চলছে।

মাশিয়া আর শশী বারান্দায় বসে আমড়া মাখা খাচ্ছে। আয়েশা খানম গেছেন পুকুরে। ঘরে আয়েশা খানমের ফোন বাজছে। কি মনে করে মাশিয়াই যায় ফোনের কাছে। মাশিয়া ফোন হাতে নিয়ে দেখল আরমানের নাম। ও ফোন রিসিভ করে চুপ থাকল।

” কেমন আছো, আম্মা? ”

” আমি আম্মার ছেলের বউ বলছিলাম। আম্মা পুকুরে গেছে। তাকে ডাকব? ”

” ওহ, তাহলে আমি আম্মার ছেলে বলছি। আপাতত আম্মার ছেলের বউ কথা বললেই চলবে। তার কি এখন সময় হবে কথা বলার? ”

” আমার কাছে অফুরন্ত সময় আছে। চাইলে আপনাকেও ধার দিতে পারি। কি করছেন আপনি? ”

” সুধাকে নিয়ে কোচিং-এ এসেছি। এবার বল তোমরা কেমন আছো? শশী কোথায়? ”

” আরে রাখেন আপনার প্রশ্ন। আপনি এখনই শশীর ফোনে ভিডিও কল দিবেন। আমি ফোন রাখছি। আপনি শশীর ফোনে ফোন দিন জলদি। ” মাশিয়া ফোন কেটে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় শশীর কাছে।

” শশী তোমার ফোন কোথায়? ডাটা অন আছে ফোনে? না থাকলে জলদি অন করো। হারি আপ। ওঠ ফোন কোথায় দেখ। ”

মাশিয়া শশীকে প্রায় টেনে তোলে। হতবাক শশী মাশিয়ার কথামত কাজ করে।

কয়েক মিনিট পরই শশীর ফোন বেজে উঠল। শশী ফোনে আরমানের নাম দেখেই মাশিয়ার দিকে এগিয়ে দেয়।

” হ্যাল্লো, লুচু মাস্টার। ”

মাশিয়ার কথার প্রত্তুত্যরে কোন কথা না বলে তাকিয়ে থাকল আরমান। আরমানকে চুপ থাকতে দেখে মাশিয়া আবারও কথা বলল।

” কি দেখছেন এভাবে? দেখি ফোনের ক্যামেরা আপনার দুইপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে আসেনতো। এরপর সামনে পেছনেও নিয়ে যাবেন। ” মাশিয়া যেন কিছু একটা দেখতে চাইছে।

মাশিয়ার কথা শুনে এবার আর আরমান চুপ থাকতে পারলনা।

” হোয়াট! ক্যামেরা সামনে-পেছনে ডানে-বামে ঘোরাবো মানে? কি বলতে চাইছো তুমি? ” আরমান অবাক হয়ে জানতে চায়।

” দেখবো আপনার সামনে-পেছনে, ডানে-বামে কোন রমনী আছে নাকি। ও হ্যাঁ, নিচের দিকেও ক্যামেরা ধরবেন। বলাতো যায়না, নিচে হয়তো কাউকে লুকিয়ে রাখলেন। তারাতারি করুন। ” মাশিয়া ফোনেই এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে।

” এবার বুঝেছি কেন তুমি ভিডিও কলে আসতে বললে। আমিও পা গ ল তোমার কথা শুনে কি না কি ভাবলাম। ”

” বেশি কথা বলে টপিক পাল্টানোর চেষ্টা করবেননা। তারাতারি করুন। বেশি দেরি হলে রমনীরা আবার লুকিয়ে যেতে পারে। ”

মাশিয়ার এমন উদ্ভট কথায় আরমান রেগে গেলেও আশেপাশে লোকজন আছে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। ও দাঁতে দাঁত চেপে ফোন চারপাশে ঘুরিয়ে মাশিয়াকে দেখিয়ে দেয়।

” এবার কি আকাশও দেখাব? বলাতো যায়না সেখানেও কেউ হাওয়ায় ভেসে থাকতে পারে। ” আরমান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

” ভালো কথা মনে করেছেন। দেখান দেখি আকাশে কেউ আছে নাকি। আশেপাশের সব টেরেসে ক্যামেরা নিয়ে যাবেন। ”

মাশিয়ার কথা শুনে আরমান কপাল চাপড়ায়। রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

” বাড়িতে একবার আসতে দাও। তোমার সন্দেহের ভূত যদি ঘাড় থেকে না নামাই তবে আমার নাম আরমান নয়। ”

” বকবকানি বাদ দিয়ে চুল এলোমেলো করুন। চুল এত পরিপাটি করে রেখেছেন কেন? চুল এলোমেলো করে, টি-শার্টের কলারের বোতাম লাগান। ” আরমানের রাগকে মোটেও পাত্তা দিলনা মাশিয়া।

” আমি ফোন রাখছি। ”

” এই খবরদার ফোন রাখবেননা। আপনি ফোন রাখার সাথে সাথেই আমি এমন এক চিল্লানী দেব, পাড়ার লোকজন জড়ো হবে কিন্তু। তারা জিজ্ঞেস করলে বলল, আপনি ঢাকায় গিয়ে অন্য এক মেয়ের সাথে প্রেম করছেন। পুরুষ মানুষ থাকবে অগোছালো হয়ে। সেই রুলস না মেনেই তিনি ফুলবাবু সেজে ঢাকার অলিগলিতে ঘুরছেন। আর এদিকে আমি চিন্তায় ম র ছি। যচ করতে বলেছি করুন। ” মাশিয়া আজ আরমানকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা।

আরমান মুখ কালো করে নিজের চুল এলোমেলো করল। এরপর কলারের বোতাম লাগালো।

” হয়েছে? এবার খুশি তুমি? ” আরও কিছু করতে হবে? ” রাগে আরমানের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।

” না। আজকের মত এটাই ঠিক আছে। এরপর থেকে বাহিরে গেলে বেশি সাজুগুজু করার দরকার নেই। মনে রাখবেন আপনার একটা বউ আছে। তাই অন্য মেয়েদের কাছে নিজেকে কুরবানির গরু হিসেবে প্রকাশ করার কোন মানেই হয়না। ” মাশিয়া নিজেকে জ্ঞানী প্রমান করতে চাইল।

” আর কিছু? ”

” উঁহু। এবার রাখতে পারেন। ” মাশিয়া আরমানের উদ্দেশ্য ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল। সেই সাথে চোখও মারল। আর নিমেষেই আরমানের রাগও হাওয়ায় মিশে গেল। ও হেসে ফোনের লাইন কেটে দিল।

মাশিয়া বারান্দায় বসেই কথা বলছিল। এতক্ষণ শশী উঠানে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর হাতে আমড়া মাখার বাটি। কিন্তু বেচারী খাওয়া ভুলে মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বিশ্বাসই হচ্ছেনা ভাইয়াকে ভাবী এভাবে নাকানিচুবানি খাওয়ালো। মাশিয়া ফোন চৌকিতে রেখে শশীর দিকে তাকায়।

” কি দেখছো এভাবে ভাইয়ের চন্দ্র? ”

” ভাইয়া আমার। তুমি ভাই বলছ কেন? ”

” তোমার ভাই-ই বলেছি। তাকে ভাই বলতে যাব কোন দুঃখে! সে-তো আমার অসভ্য মাস্টার। ”

” তুমি আমার ভাইয়াকে এভাবে নাকানিচুবানি খাওয়ালে, ভাবি? এটা তুমি করতে পারলে! ভাইয়া না তোমার একমাত্র জামাই? ” শশী ভিষণই অবাক হয়েছে।

” একমাত্র জামাই জন্যই তো তার পেছনে লাগতে পারি। এতে যে কি মজা সেটা যদি তুমি জানতে। অবশ্য বিয়ের আগে এসব বোঝার কোন ওয়ে তোমার নেই। তাই বিয়ের আগ পর্যন্ত আমার নওটানকি দেখেই চোখকে স্বার্থক কর। ”

” মাফ চাই, ভাবী। ভাইয়াকে পরাস্ত দেখতে অভ্যস্ত নই আমরা। আমার কষ্ট হচ্ছে ভাইয়ার জন্য। পাগলের বেশে ভাইয়াকে দেখে না জানি মানুষজন কত হাসছে। ” শশী পারলে আরমানের জন্য কাঁদে।

শশীর মুখের দিকে তাকিয়ে মাশিয়া হো হো করে হেসে উঠল। ভাইবোনের মধ্যে এত মিল আর ভালোবাসা ও আগে কাউকেই দেখেনি।

দশদিন পর আরমান গ্রামে এসেছে। ও সুধাকে মোটামুটি ফ্ল্যাট থেকে কোচিং-এর রাস্তা চিনিয়ে দিয়েছে। ওরা ঢাকায় যাওয়ার পর মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে নিয়ে ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন। কল্পনা মোর্তাজা প্রতিদিন একবার করে এসে সুধাকে দেখে যান। তিনি সুধাকে রান্না করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি প্রতিদিন তিনবেলা খাবার পাঠান। একটা গাড়ী তিনি পাঠাচ্ছেন সুধাকে কোচিং-এ নিয়ে যেতে আসতে। মোটকথা, সুধাকে পড়াশোনা আর ফ্ল্যাট পরিষ্কার ছাড়া কিছুই করতে হয়না। কল্পনা মোর্তাজা চেয়েছিলেন সুধা তাদের বাসাতেই থাকুক। কিন্তু আরমান রাজি হয়নি। আরমান চলে আসার পর কল্পনা মোর্তাজা তার বাসার একজন মেইডকে পাঠিয়েছেন সুধার কাছে। গ্রাম থেকে কেউ না যাওয়া পর্যন্ত মেইড সুধার কাছেই থাকবে। আরমানও নিশ্চিত থাকতে পারছে কল্পনা মোর্তাজার এমন সহযোগিতার জন্য। আয়েশা খানম কিছু জিনিসপত্র পাঠিয়েছিলেন কল্পনা মোর্তাজার জন্য। সেগুলো প্রথম দিনই সুধা তাকে দিয়েছে। তিনি ভিষণ খুশি এমন একটা পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারায়।

আরমান বাড়িতে আসলে মাশিয়া ওর থেকে দূরে দূরে থাকছে। এই দশদিন ও আরমানকে খুব বিরক্ত করেছে। আরমান রেগেও আছে মাশিয়ার ওপর। ও সুযোগ পেলেই মাশিয়াকে শায়েস্তা করবে। মাশিয়া তাই আয়েশা খানমের আশেপাশেই থাকছে বেশিরভাগ সময়।

আরমান খুব ভোরে বাড়িতে এসেছে। এখন বিকেল। এত সময়ের মধ্যে মাশিয়া ওর কাছে একবারও আসেনি। এই মুহূর্তে মাশিয়া আয়েশা খানমের কাছে বসে আছে। আরমানও ওর মা’য়ের কাছেই বসে গল্প করছে। ঠিক তখনই বাহিরে থেকে কেউ আরমানের নাম ধরে ডাক দিল। ডাক শুনে আরমান বাহিরে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ও যখন ভেতরে আসল তখন ওর হাতে একটা খাম দেখতে পায় সবাই। আরমাস বারান্দায় এসে খাম খুলে কয়েকটা কাগজ দেখতে পায়। এরমধ্যে সে একটা চিঠিও পায়। তাই আগে চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

” কিয়ের চিঠি আইছে, বাপ? ” আয়েশা খানম চিন্তিত বদনে জানতে চাইলেন।

আরমান সময় নিয়ে চিঠি পড়ে হাসিমুখে তাকায় আয়েশা খানমের দিকে।

” একটা কোর্সের জন্য মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটিতে এ্যাপ্লাই করেছিলাম, আম্মা। সেখান থেকেই উত্তর এসেছে। তারা ধাপে ধাপে পঞ্চাশজনকে নিচ্ছে। চারমাসের কোর্স। আমাকে চতুর্থ ধাপের জন্য সিলেক্ট করেছে অথরিটি। আগামী পনের দিনের মধ্যেই মালয়েশিয়া যেতে হবে আমাকে। ”

আরমানের এমন সুযোগ আসায় সবাই খুশি। আয়েশা খানমতো খুশিতে কেঁদেই ফেললেন। শশীও খুশিতে লাফাতে শুরু করেছে।

” আমাকে আবারও ঢাকা যেতে হবে, আম্মা। ডিপার্টমেন্ট থেকে কয়েকটা পেপার সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়া পাসপোর্টও রিনিউ করাতে হবে। আরও কিছু কাজ আছে। ”

” কবে যাইবা, বাপ? আজকেই কেবল আসলা। ” কালকেই যাব, আম্মা। পনের দিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করতে হবে। ”

আরমান ব্যস্ত হয়ে যায় কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে।

চলবে…