যেখানে_দিগন্ত_হারায় পর্ব-৩৭+৩৮

0
226

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী জামী

” দোস্ত, একটা কথা বলি কিছু মনে করবিনা বল? ” ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে এসে বসেছে চার বন্ধু। নানান গল্পের মধ্যে হঠাৎ করেই তৃষা কিছু একটা বলার অনুমতি চাইল মাশিয়ার কাছে। মেয়েটা এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল ওদের আশেপাশে ভীড় কতটা।

” কি বলবি বল? এত অনুমতি নেয়ার কি আছে? ”

” দোস্ত, আমরা তোর ভালো চাই। তাই তোকে এমন মনমরা দেখতে ভালো লাগেনা। তুই কি লক্ষ্য করেছিস, গত দুইমাসে তোর কত পরিবর্তন হয়েছে? তুই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিস। আগেরমত হাসিসনা। আমাদের সাথে আড্ডা দিসনা আগেরমত। আমরা বুঝতে পারি তুই স্যারকে মিস করিস। স্যারের অনুপস্থিতি তোকে বদলে দিয়েছে। তুই বদলে গেছিস। ওপরে ওপরে যতই দেখাস তুই স্যারকে চাসনা। কিন্তু ভেতরে ঠিক উল্টো। তুই হয়তো নিজেও জানিসনা, তুই স্যারকে কতটা ভালোবাসিস। মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখিসনা, দোস্ত। ফিরে যা স্যারের কাছে। ” তৃষা কথাগুলো বলছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ও পাচ্ছে। যদি মাশিয়া রেগে যায়!

তৃষার কথায় মাশিয়া চুপচাপ বসে থাকল। যেন কিছু একটা ভাবছে। অনেকক্ষন পর ও মুখ খুলল,

” তোর ধারনা ভুল। আমি কাউকে ভালোবাসিনা। আর ঐ অসভ্য মাস্টারকে তো নয়ই। তার জন্য আমি অনেক অপমানিত হয়েছি। দিনের পর দিন সে আমাকে দিয়ে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করিয়ে নিয়েছে। তার জন্যই আমাকে এক বছরের বেশি সময় ঐ অজপাড়াগাঁয়ে কাটাতে হয়েছে। যে আমার দুর্দশার জন্য দায়ী, তাকে আমি কিভাবে ভালোবাসতে পারি! ” মাশিয়া কথাগুলো মুখে বললো ঠিকই কিন্তু ওর চোখ অন্য কিছু বলছে।

” বেইব, তুমি স্যারের সাথে গ্রামে গিয়ে ভুল কিছুই করোনি। সেখানে স্যারের সাথে থেকেছ জন্যই স্যার তোমাকে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। তার ফলশ্রুতিতেই তোমার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। হয়তো স্যার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তোমাকে জোর করেছে। কিন্তু আখেরে তোমার ভালোই হয়েছে। তুমি কত পাল্টে গেছ, সেই ধারনা তোমার আছে? তুমি আর আগের মত ভার্সিটিতে র্যাগ দিচ্ছনা, ছোট-বড় সকলের সঙ্গে ভালো ব্যাবহার করছ। আগের থেকে অনেক শান্ত হয়েছ, বুঝদার হয়েছ। পড়াশোনায় মনযোগী হয়েছ। এসবকিছু সম্ভব হয়েছে শুধু স্যারের জন্যই। ” মিতুলও মাশিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

” ওরা ঠিক বলেছে, দোস্ত। আগের মাশিয়ার সাথে এখনকার মাশিয়ার আকাশপাতাল তফাৎ। তুই যে স্যারকে ভালোবাসিস, এটা স্বীকার করছিনা ঠিকই কিন্তু বিষয়টা মিথ্যা নয়। তুই নিজের মনকে জিজ্ঞেস করে দেখিস। দেখবি সে-ও একটাই উত্তর দেবে। তুই তাকে ভালোবাসিস। তোর মনে রাগ আর জিদের প্রলেপ পরেছে। তাই তোর ভালোবাসা এখনো দেখতে পাচ্ছিসনা। একবার তোর মন থেকে রাগ, জিদ সব একপাশে সরিয়ে রেখে দেখ। দেখবি সেখানে শুধু স্যারই আছে। ” জয়ও আজ চুপ করে থাকলনা।

” জয় ঠিক বলেছে, মাশিয়া। যে তুই এসি ছাড়া থাকতে পারতিসনা এক মুহূর্তের জন্যও, কিন্তু সেই তুই গত দুইমাস যাবৎ এসি ছাড়া থাকছিস, যে তুই মাছের কাঁটার ভয়ে মাছ খেতিসনা, সেই তুই দিব্যি মাছের কাঁটা বেছে ভাত খাস, যে তুই দামী দামী পোশাকে অভ্যস্ত ছিলি কিন্তু এখন সেই তুই-ই সাধারন শাড়িতেই দিন পার করছিস। জিনস-টপস না পরতে চাইলে সালোয়ার-স্যুট পরতিস কিন্তু তুই সেসব না পরে শাড়ী পরছিস। কেন? আগে যেখানে তুই শাড়ীর নাম শুনতে পারিসনি। নিশ্চয়ই স্যার শাড়ী পছন্দ করেন। আর সেজন্যই তুই শাড়ী পরতে শুরু করেছিস। ”
তৃষা সবদিক দিয়েই মাশিয়াকে চেপে ধরল।

বন্ধুদের এহেন যুক্তিতে দিশেহারা মাশিয়া কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না। ওদের অকাট্য যুক্তির বিপক্ষে কোন শক্ত অযুহাত ওর নেই। তাই মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণের বৃথা চেষ্টা করল। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

” আমি তো বললাম, তাকে আমি ভালোবাসিনা। তবুও তোরা কেন নাছোড়বান্দার ন্যায় আমার পেছনে পরে আছিস? আমি ঐ অসভ্য মাস্টারকে ভালোবাসতেই পারিনা। আমি তাকে ভালোবাসিনা। ” একছুটে মাশিয়া ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায়। ও কাঁদছে। গাড়ির কাছে যাওয়ার আগেই কারও সাথে ধাক্কা খেয়ে ওকে থামতে হলো। ঝাপসা চোখে ও দেখল সামনে রিশাদ দাঁড়িয়ে আছে।

” কুল বেইবি, কুল। এত ছুটোছুটি করছ কেন? অবশ্য তোমাকে ছুটোছুটি করলেই বেশি হ’ট লাগে। চলোনা বেইবি, আজ আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি। ”

” সাট আপ, ইউ ফুল। তোমাকে সেদিন বলেছিনা, আমার সামনে না আসতে? তবুও সেইমলেসের মত আমার সামনে এসেছ! পথ ছাড়, আমাকে যেতে দাও। তোমাকে দেখেই আমার রাগ হচ্ছে। ” মাশিয়া রিশাদকে পাশ কাটিয়ে যেতেই রিশাদ ওর হাত ধরে ফেলল।

” এত অহংকার কেন করছ? তুমি কি মনে কর আমার থেকে দূরে থাকতে চাইলেই তুমি সেটা করতে পারবে? হাজার চেষ্টা করলেও দূরে যেতে পারবেনা তুমি। আমার কাছেই তোমাকে আসতে হবে। আমার কতদিনের স্বপ্ন তোমাকে বিছানায় নিব। সেই স্বপ্ন পূরণ না করেই তোমাকে ছেড়ে দেব ভাবছ! এতদিন তোমাকে চোখে চোখে রেখেছি দূরে যাব বলে? ”

রিশাদের কথা শুনে রাগে, ঘৃণায় মাশিয়ার শরীর রি রি করছে। ওর ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে, এই ছেলেটাকে সে নিজের বন্ধু মনে করত! মাশিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে আসল তৃষা, মিতুল, জয়।

” কি ব্যাপার রিশাদ, তুমি মাশিয়ার হাত ধরে রেখেছ কেন? অন্য কারও স্ত্রী ‘ র হাত ধরতে তোমার লজ্জা করছেনা? পারলে কোন মেয়েকে পটিয়ে তার হাত ধর। ” জয় এগিয়ে গিয়ে রিশাদের থেকে মাশিয়ার হাত ছাড়িয়ে নেয়।

” কি রে মেয়েদের চ্যালা, খুব বেড়েছিস দেখছি? তিনজন মেয়ের মাঝে থেকে নিজেকে মেয়ে মেয়ে মনে হয়না তোর? সামলাতে পারিসতো তিনজনকে? ” রিশাদ জয়কে রাগিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু জয় ওর ফাঁদে পা দিলনা। ও শান্ত গলায় বলল,

” সবাইতো তোমার মত নয়। মেয়েদের সম্মান করতে জানি আর সেই সাথে নিজের ওপর যথেষ্ট কন্ট্রোলও আছে৷ আমার কথা চিন্তা না করে নিজেরটা ভাব। ভবিষ্যতে মাশিয়ার আশেপাশে তোমাকে দেখলে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব। ”

” বাব্বাহ্, আমার বেইবির জন্য তোর চিন্তা আমাকে ভাবাচ্ছে। একসাথে দু’জনকেই পেতে চাইছিস নাকি? মিতুল কি তোর ইচ্ছে পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? তাই আবার আমার বেইবির দিকে নজর দিচ্ছিস? ব্যাড ভেরি ব্যাড। আমি.. ”

রিশাদ পরের বাক্য শেষ করতে পারলনা। মিতুল এগিয়ে এসে ওকে কষিয়ে থাপ্পড় মেরেছে। তৃষাও রিশাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

” ইউ সান অব বিচ। তোর এত সাহস হয় কি করে আমাদের নামে বাজে কথা বলার? জুতিয়ে তোর মুখের মানচিত্র পাল্টে দেব হা’রা’মি। এতদিন মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে তোকে কিছু বলিনি। কিন্তু আজ তুই মাশিয়ার সাথে খারাপ আচরণ করেছিস। তুই কি মনে করেছিস, তোকে জুতোপেটা করতে পারবনা? তোর মত নর্দমার কীটকে জুতোপেটা করলে আমার কিচ্ছু হবেনা। তোর বাপের হাত এত লম্বা নয়। আমার টিকিটি ছুঁতে পারবিনা তুই। ” তৃষা রাগে গজগজ করছে।

” তোকে যদি আর একদিন ভার্সিটি চত্বরে দেখেছি, তবে সেদিন তোর মুখে একটাও দাঁত থাকবেনা। যা কু’ত্তা বেরিয়ে যা ভার্সিটি থেকে। মাশিয়ার বাবার ভার্সিটিতে এসে ওর সাথেই মিসবিহেভ করছিস? যা বেরিয়ে যা। ” মিতুল রিশাদের কলার ধরে ওকে ভার্সিটি থেকে বের করে দেয়।

মাশিয়া তখন থেকেই কেঁদে চলেছে। তৃষা, মিতুল মিলে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এরপর ওকে নিয়ে বাসায় যায়।

আরমান বাড়িতে এসেছে। সুধাও কয়েকদিনের ছুটিতে এসেছে। ও চিটাগং যাবে মা-বোনের সাথে। সেখানে দুই-একদিন কাটিয়ে ঢাকা ফিরবে। আয়েশা খানম সব গোছগাছ করে নিয়েছেন। আরমান সব জমিজমা বর্গা চাষীকে দিয়েছে।

গভীর রাত। পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমে মগ্ন। শুধু ঘুম নেই আয়েশা খানমের চোখে। দুইমাস আগেও তার বাড়ি কোলাহলপূর্ণ ছিল। ছেলেমেয়েরা একে-অপরের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকত। সুখে পরিপূর্ণ ছিল তার সংসার৷ কিন্তু একটা মেয়েই তাদের সব সুখ, হাসি, আনন্দ চুরি করে পালিয়েছে। তার ছেলেমেয়েরা আজ হাসতে ভুলে গেছে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত আয়েশা খানম। আরমান গত দুইমাসে নিজেকে বেশ গুটিয়ে নিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে চায়না। খাওয়াদাওয়ায় করছে অনিয়ম। শুকিয়েছে বেশ খানিকটা। ওর সুদর্শন চেহারায় পরেছে বিষন্নতার ছাপ। আয়েশা খানম ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারেননা। বারবার নিজেকে দোষী ভাবছেন তিনি। তার জন্যই আরমান মাশিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু মাশিয়া শেষ পর্যন্ত আরমানকে নিঃস্ব করে চলে গেছে।

আয়েশা খানম ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তায় চোখের পাতা এক করতে পারেননা। রাতের পর রাত তিনি নির্ঘুম কাটিয়ে দেন। কান্না তার নিত্যসঙ্গী। আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। তিনি নিরবে কাঁদছেন।

গত কয়েকদিন থেকেই আয়েশা খানমের বুকের ব্যথা বেড়েছে। থেকে থেকে বুকে ব্যথা করছে৷ তিনি ঠিকমত ঔষধ খাচ্ছেননা। খাওয়াদাওয়ারও অনিয়ম করছেন। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসলেন। বুকের ব্যথাটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ঘামছেন তিনি। তার পাশেই সুধা, শশী ঘুমাচ্ছে। তিনি হাত দিয়ে কোনরকমে সুধাকে ঝাঁকুনি দিলেন।

ঝাঁকুনিতে সুধার ঘুম ভেঙে যায়। ও উঠে বসল। পাশেই আম্মার দিকে চোখ পরতে ওর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। ওর আম্মা একপাশে কাত হয়ে আছে। তার নাকমুখ দিয়ে গ্যাজলা বের হচ্ছে।

সুধা আম্মার এরূপ অবস্থা দেখে চিৎকার করে শশীকে ডাকল।

আরমান আয়েশা খানমের মাথা নিজের কোলের ওপর রেখেছে। ও অ্যাম্বুলেন্স ডেকে অনেকক্ষণ আগেই। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আধাঘন্টার মত সময় লাগবে। এদিকে আয়েশা খানমের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হয়ে চলেছে। তিনি টেনে শ্বাস নিচ্ছেন।

” বাপ, তোমার বইনদের দেইখা রাইখ। ভালো পোলা দেইখা ওদের বিয়া দিও। বউমাকে ফিরায় আইনো। হেয় রাগী, জেদি কিন্তু হের মন ছোট মানুষের লাহান। তুমি তার সামনে গিয়া দাঁড়াইলেই হেয় তোমার সাথে আইয়া পরব দেইখা নিও। নিজের জীবনডা এলোমেলো কইরোনা, বাপ। সুধা, শশী, তোমরা ভাইয়ের দিকে খেয়াল রাইখো। ভাইরে কষ্ট পাইতে দিওনা। তিন ভাইবোন মিল্লা-মিশ্যা থাইকো। ভাইয়ের সব কথা শুইনা চইলো। ” শ্বাস আটকে আসায় থামলেন আয়েশা খানম।

” আম্মা, আরেকটু ধৈয্য ধর। অ্যাম্বুলেন্স এসে পরবে। ” আরমান কাঁদছে। কাঁদছে সুধা, শশীও।

আয়েশা খানম ছেলের কথার উত্তর দিতে পারলেননা। একটু হেসে কালিমা পড়তে শুরু করলেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস আরমানের কোলেই ছাড়লেন তিনি।

চলবে…

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী জামী

কিছুতেই ঘুম আসছেনা মাশিয়ার। ওর মন কু গাইছে। বারবার মনে হচ্ছে কোন বিপদ আসছে। না চাইতেও আরমানের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তবে কি আরমানের কিছু হয়েছে? কিছু ভাবতে পারছেনা মাশিয়া। চিন্তায় ওর শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। ফোন হাতে নিয়ে আরমানের নম্বরে ফোন দিতে গিয়েও দিলনা। কম্পমান পায়ে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকলো। অযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পরল সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়। একসময় আরমানের রাগারাগিতে নামাজ আদায় করলেও এখন সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় না করলে ওর এখন আর ভালো লাগেনা।

দুই রাকাআত দুই রাকাআত করে চার রাকাআত নফল নামাজ আদায় করে সৃষ্টিকর্তার নিকট হাত উঠিয়ে আরমান ও তার পরিবারের জন্য দোয়া করল। ওরা যেন ভালো থাকে, নিরাপদে থাকে সে-ই দোয়া করতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসালো। নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইল সৃষ্টিকর্তার কাছে। ও যখন মোনাজাত শেষ তখন রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। শরীর ক্লান্ত লাগছে হঠাৎ করেই। তাই জায়নামাজেই শরীর এলিয়ে দিল।

শশী পা’গ’লে’র মত কাঁদছে। ওকে ধরে রাখতে পারছেনা কেউই। সুধাও কাঁদছে, ওর ও আম্মার জন্য কষ্ট হচ্ছে। তবে ও বেশি চিন্তা করছে আরমানের জন্য। রাত থেকেই আরমান ঠাঁয় বসে আছে ওর আম্মার পাশে। সারারাত আম্মার মাথা নিজের কোলেই রেখেছিল। কেউই ওকে অনেক বলেও আম্মার কাছ থেকে এক ইঞ্চিও সরাতে পারেনি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর আম্মার দিকে। আব্বার মৃ’ত্যু’র পর যে মানুষটি ওদের শত বিপদের মাঝেও আগলে রেখেছিল, আজ সেই মানুষটা ওদের অকূলপাথারে ফেলে রেখে চলে গেল। আরমানের বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে। ও কাঁদতে পারছেনা। কান্নারা দলা বেঁধে ওর কণ্ঠা অবরোধ করে রেখেছে। সুধা ভাইয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরপর ভাইয়ের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, কষ্ট পেওনা ভাইয়া, যেকোন পরিস্থিতিতে আমরা তোমার পাশেই থাকব। সুধা ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে গেলেও আরমান আর শশীকে বুঝতে দিচ্ছেনা। এমনকি আম্মাকে চিরতরে নিয়ে যাওয়ার সময়ও সুধা এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেললনা। আম্মার বিয়োগব্যথায় বুকের পাঁজর ভেঙে চুরমার হলেও, সুধা শশীকে বুকে টেনে নিয়ে ওকে শান্তনা দিতে ব্যস্ত থাকল।

ফজরের নামাজ আদায় করে মাশিয়া সেই যে ঘুমিয়েছে, সকাল দশটা বাজলেও ওর ঘুম ভাঙ্গলোনা। মিরাজ মোর্তাজা, মাহিন অফিসে গেছেন অনেক আগেই। মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দশটা পেরোতেই কল্পনা মোর্তাজা মাশিয়ার রুমে আসলেন।

মাশিয়া জায়নামাজে একটা বালিশ রেখে ঘুমাচ্ছে। মাশিয়াকে এই অবস্থায় দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন কল্পনা মোর্তাজা। এই বাসায় আসার পর থেকে মাশিয়া বেশিরভাগ রাতেই মেঝেতে ঘুমায়। এসি বন্ধ করে জানালাগুলো খুলে রাখে।
কল্পনা মোর্তাজা পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মেয়েটা এই দুইমাসে অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। ঠিকমত খাওয়াদাওয়াও করেনা। আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। এখন আবার চোখমুখ ফোলাফোলাও লাগছে।

মাথায় কারও স্পর্শ পেয়ে ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠল মাশিয়া।

” মাশিয়া, বেলা দশটা বাজে। উঠে পর। আজ ভার্সিটিতে যাবেনা? ”

” আরেকটু ঘুমাইনা, আম্মা। আরও আধাঘন্টা পর ডাকবেন। এতক্ষণ আপনার অসভ্য ছেলেকে দেখে রাখুন। সে যেন আমার ঘুম না ভাঙ্গায়। ” ঘুম জড়ানো গলায় বলল মাশিয়া। এরপরই ও পাশ ফিরে শুলো।

মেয়ের মুখে আম্মা ডাক শুনে হাসলেন কল্পনা মোর্তাজা। তার মেয়ে যে ঐ বাড়ির সবাইকে বড্ড মিস করছে তিনি বুঝতে পারছেন। মাশিয়ার সমস্ত সত্তা জুড়ে আরমান আর ওর পরিবার বিরাজ করছে এটা ভেবেই তার শান্তি লাগলো। কিন্তু তার মেয়ে মুখে কিছুতেই সেটা স্বীকার করছেনা। কেন করছেনা সেটা বুঝতে পারছেননা তিনি। মাশিয়াকে আবার ঘুমাতে দেখে তিনি আবারও ডাকলেন।

” মাশিয়া, ওঠ। বাসার সবার খাওয়া শেষ। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমি। ” এবার একটু জোড়েই ডাকলেন তিনি।

মা’য়ের গলা পেয়ে মাশিয়া চোখ খুলল। চোখ খুলেই মা’য়ের উদ্বিগ্ন মুখ চোখে পরল মাশিয়ার। ও কথা না বলে উঠে বসতে গেল। আর তাতেই বাঁধল বিপত্তি। মাথা ঘুরে যাওয়ায় শরীরের ব্যালান্স রাখতে পারলনা। মুখ থুবড়ে পরল মেঝেতে। মাথা গিয়ে সরাসরি পরেছে মেঝেতে। চোখের পলকেই ঘটে গেল অঘটন। কল্পনা মোর্তাজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্ঞান হারায় মাশিয়া।

মেয়েকে নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠলেন কল্পনা মোর্তাজা। তার চিৎকারে কয়েকজন মেইড ছুটে আসল। দোলনও শ্বাশুড়ির চিৎকার শুনতে পেয়ে মাশিয়ার রুমে আসল। কল্পনা মোর্তাজা দিশেহারা হয়ে কাঁদছেন। মেইডরা মাশিয়ার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টায় রত। অবস্থা বেগতিক দেখে দোলন অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠায়।

হসপিটালের বেডে ঘুমিয়ে আছে মাশিয়া। ওর হাত ধরে পাশে বসে আছেন কল্পনা মোর্তাজা। মিরাজ মোর্তাজা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন। দোলনের ফোন পেয়ে তিনি আর মাহিন ছুটে এসেছেন। অবশ্য আধাঘন্টা পর মাহিন আর দোলন ফিরেও গেছে।

রিপোর্ট আসতে আরও আধাঘন্টা লাগবে। ভয়ে কল্পনা মোর্তাজার বুক দুরুদুরু করছে। তিনি থেকে থেকেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন। মিরাজ মোর্তাজা ব্যথিত চোখে চেয়ে আছেন মেয়ের দিকে। মেয়ের এমন দূর্দশা তিনি দেখতে পারছেননা। আরমানের নিষেধ উপেক্ষা করেই তিনি ফোন দিয়েছিলেন আরমানকে। তিনি এই দুইমাসে বুঝে গেছেন, মাশিয়া আরমানের বিরহে কষ্ট পাচ্ছে। তিনি মেয়েকে সুখী দেখতে চান। তিনি চান মাশিয়া ফিরে যাক তার আপন ঠিকানায়। আর তিনি ভালো করেই জানেন, আরমান মাশিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালে দুনিয়ার কোন শক্তিই ওর কাছে মাশিয়ার যাওয়া আটকাতে পারবেনা। পরপর তিনবার ফোন দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আরমান একবারও রিসিভ করেনি। এতে তার মন একটু খারাপ হয়েছে। কিন্তু তিনি জানতে পারলেননা মা’কে হারিয়ে পাগলপ্রায় আরমান। ফোন কোথায় আছে সেটা সে জানেইনা।

জোহরের নামাজ আদায় করে এসে আয়েশা খানমের বিছানায় শুয়ে আছে আরমান। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রয়েছে কড়িকাঠের দিকে। ওর আম্মা আর নেই, এটা ভাবলেই বিষাদের ছাপ পরছে দু-চোখে। ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি।

সুধা নামাজ শেষ করে আম্মার ঘরে এসে দেখল আরমান বিছানায় শুয়ে আছে। ও ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ভাইয়ের কাছে। কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু আরমানের কাছে যেতেই কান্নারা তীব্র গতিতে বেড়িয়ে আসল বুকের অন্তঃপুর থেকে। আরমানের পাশে বসেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে সুধা। আরমান সুধাকে থামানোর চেষ্টা করলনা একটুও। মাথাটা একটু কাত করে চোখের পানি মুছল সংগোপনে। সুধার কান্না শুনে শশীও ছুটে এসেছে। ও এক ছুটে সুধার কাছে যায়। ছুটে এসেছে আরমানের দুই ফুপু আর চাচী। তারা সুধাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুধার মধ্যে থামার কোন লক্ষ্মণই নেই।

অনেকক্ষণ পর আরমান উঠে বসল। চোখমুখ মুছে দু হাতে জড়িয়ে ধরল দুই বোনকে। আজ শান্তনা দেয়ার ভাষা ওর নেই। ওর নিরবতাকেই শান্তনা ভেবে চুপ হয়ে গেল সুধা আর শশী। তিন ভাইবোনের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন নিরবতা বিরাজ করছে। ওরা নিরবতার মাঝেই নিজেদের কষ্ট প্রকাশ করছে যেন।

রিপোর্ট হাতে ডক্টর কেবিনে প্রবেশ করলেন। প্রাইভেট এই হসপিটালের মালিক মিরাজ মোর্তাজা। নিজের হসপিটাল হওয়ায় অনেক সুবিধা থাকে। প্রয়োজনে-অপ্রোয়জনে ডক্টর নিজেই এসে খোঁজ নেন। তেমনি রিপোর্টও ডক্টর নিজেই নিয়ে এসেছেন। ডক্টরকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন মিরাজ মোর্তাজা। কল্পনা মোর্তাজাও স্বামীর দেখাদেখি উঠে দাঁড়ালেন। মাশিয়া এখনো ঘুমাচ্ছে। ডক্টর বলেছেন, আরও দুই থেকে তিন ঘন্টা পর ওর ঘুম ভাঙ্গবে। মিরাজ মোর্তাজা ডক্টরকে সোফায় বসতে ইশারা করলে তিনি বসলেন। কল্পনা মোর্তাজাও স্বামীর পাশে এসে বসলেন। তাদের চোখেমুখে উদ্বেগ।

” এভ্রিথিং ইজ ওকে, ডক্টর? আমার মেয়ে ঠিক আছে তো? ওর রিপোর্টে খারাপ কিছু নেইতো? ” একসাথে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন মিরাজ মোর্তাজা।

ঘুমন্ত মাশিয়ার দিকে তাকিয়ে ডক্টর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

” মামনির র’ক্তে হিমোগ্লোবিন খুবই কম পাওয়া গেছে। এভাবে চলতে থাকলে বিষয়টা খারাপের দিকে যাবে। এছাড়া মাথায় আঘাত লাগার কারনে ওর ব্রেইনে এর ইফেক্ট পরেছে। এটা সারতে সময় লাগবে। এছাড়াও মামনির প্রেশারের অবস্থাও খারাপ। সে বোধহয় ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছেনা? ”

ডক্টরের কথা শুনে কল্পনা মোর্তাজা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। অশ্রুসজল চোখে তাকালেন ঘুমন্ত মেয়ের দিকে।

” ডক্টর, আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবেতো? আপনি ওকে প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দিন। আমরা ওকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাব। ” কল্পনা মোর্তাজা ব্যাকুল হয়ে বললেন।

” চিন্তা করবেননা, ম্যাম। মামনি আমাদের ট্রিটমেন্টেই সুস্থ হবে। আপনারা শুধু ওর খেয়াল রাখবেন। এই রে, আপনাদের শুধু দুঃখের গল্পই শুনিয়ে যাচ্ছি। এবার সুখের খবর শুনুন। আপনারা নানা-নানি হচ্ছেন। এবার ফাইনালি আপনাদের শাসন করার জন্য কেউ আসছে। ”

ডক্টরের শেষের কথাগুলো শুনে দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো মিরাজ মোর্তাজা, কল্পনা মোর্তাজার। এ কি শুনলেন তারা! আনন্দে তারা দুজনেই কেঁদে ফেললেন।

অনেকক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে মিরাজ মোর্তাজা আবারও ফোন দিলেন আরমানকে। কিন্তু এবারও তাকে নিরাশ হতে হয়।

ঘুম ভাঙ্গলে মাশিয়া নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল। হাত নাড়াতে গিয়ে টের পেল স্যালাইন দেয়া হয়েছে। ও ফ্যাসফেসে গলায় কল্পনা মোর্তাজাকে ডাক দেয়। কল্পনা মোর্তাজা সিস্টারের কাছ থেকে ঔষধ খাওয়ানোর নিয়মকানুন জেনে নিচ্ছেন। মেয়ের আওয়াজ পেয়ে তিনি হাসিমুখে গেলেন মেয়ের কাছে। প্রথমেই চুমু খেলেন মাশিয়ার চোখেমুখে। মা’য়ের এমন কাণ্ডে হতবিহ্বল মাশিয়া ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকল।

” আমরা আজ কত খুশি, সেটা কি তুমি জানো? ” কল্পনা মোর্তাজা উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

” মেয়ে অসুস্থ হলে বাবা-মা খুশি হয় এটা আগে কখনোই শুনিনি। ” মাশিয়া মুখ ভার করে বলল।

” পাগলি মেয়ে, কে বলেছে তোমার অসুস্থতায় আমরা খুশি হয়েছি! আমরা খুশি হয়েছি এটা জেনে, যে আমরা জীবন্ত পুতুলের মালিক হব আর কয়েকমাস পরই। ”

” জীবন্ত পুতুল! ” মাশিয়া বিস্মিত হয়ে গেছে।

” হুম। তুমি আমাদের পুতুলটা উপহার দিচ্ছ। ”

” হেয়ালি না করে বল কি হয়েছে? আমার শরীর খারাপ লাগছে। তোমার এত হেয়ালি নিতে পারছিনা, মম। ”

কল্পনা মোর্তাজা মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,

” তুমি মা হতে চলেছ। তুমি আমাদের সেই ছোট মেয়েটি নেই। তোমার মাঝে এখন আরেক প্রাণের অস্তিত্ব। যার মধ্যেই তুমি দেখবে তোমার জীবনচক্র। যে তোমার আয়না হয়ে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ”

মা’য়ের কথা শুনে নিজের অজান্তেই মাশিয়ার বাম হাত ওর পেট ছোঁয়। বুকের ভেতর হৃৎস্পন্দনেরা দামামা বাজিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চক্কর দিয়ে উঠল মাশিয়ার মাথা। অসার হয়ে আসছে পুরো শরীর। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। আর প্রায় সাথে সাথেই কল্পনা মোর্তাজা জড়িয়ে ধরলেন তার মেয়েকে।

” মম, আমি যে তাকে চরম আঘাত দিয়েছি। অপমানে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছি। ঘৃণায় তার থেকে দূরে চলে এসেছি। এখন তারই অস্তিত্ব নিজের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছি আমি! তাকে তো আমি ভুলতে চেয়েছিলাম। তবে কেন সে আমার পিছু ছাড়ছেনা? তার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেই, সে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে। তবে কি সে আর তার স্মৃতি আমার পিছু ছাড়বেনা? এ কোন বাঁধনে আমাকে বেঁধে রেখেছে সে! ”

” তুমি তাকে দিতে পার, অপমান করতে পার। কিন্তু তাকে ঘৃণা করা তোমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি আরমানকে কতটা ভালোবাস সেটা তুমি নিজেও জানোনা। আর সেজন্যই তার স্মৃতি তোমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এতদিন তার কাছে থেকে যেটা তুমি অনুধাবন করতে পারোনি, সেটা তুমি এখন অনুধাবন করছ। দুরত্বই তোমার ভালোবাসাকে জানতে শিখিয়েছে, বুঝতে শিখিয়েছে। ”

মা’য়ের কথা শুনে মাশিয়া নিরবে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। ওর বাম হাত তখনো ছুঁয়ে আছে ওর পেট।

চলবে…