যেখানে_দিগন্ত_হারায় পর্ব-৪১+৪২

0
254

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৪১
জাওয়াদ জামী জামী

আজ সুধার জীবনের সবথেকে খুশির দিন। ও মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। তা-ও আবার ঢাকা মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে। ওর এতদিনের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে। স্বপ্ন পূরণের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেল মেয়েটা। ওদের সব আত্মীয়স্বজনরা ভিষণ খুশি সুধার এই অর্জনে খুব খুশি হয়েছে। এত আনন্দের মাঝেও সুধা কান্নাকাটি করছে। আম্মা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হত। ওর এই অর্জন আম্মা দেখতে পেলোনা। এই আফসোস ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে আজীবন।

আরমান দুইদিনের ছুটি নিয়ে ঢাকা এসেছে। সুধা কান্নাকাটি করছিল, বিধায় ওকে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আসতে হয়েছে।

” দোস্ত, তুই একবার স্যারের কাছে ফোন দিয়ে দেখ। তাকে খুশির খবরটা দে। দেখবি সে ছুটে আসবে তোর কাছে। ” তৃষা ক্লাস শেষ করেই মাশিয়ার কাছে আসে। ওর সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে বাসায় ফিরে যায়। মাশিয়ার শরীর দিনদিন খারাপ হচ্ছে। তাই ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধুদের কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করে বাসাতেই পড়াশোনা করছে।

” জানিস তৃষা, আমার জন্য সে কতটা কষ্ট পেয়েছে? তাকে আমি কুকুর বলেছি। কেন জানিস? আমি তার সংসার বেরিয়ে আসতে গেলে, সে হাতজোড় করেছে, কেঁদেছে। কিন্তু তার চোখের পানি আমার মন গলাতে পারেনি। উল্টো আমি বিরক্ত হয়েছি। তাই তাকে কুকুরের সাথে তুলনা করেছি। তাকে আঘাত দিয়েছি। তোর কি মনে হয়, এতকিছুর পরও সে আমাকে মেনে নিবে? ” মাশিয়া নির্বিকার চিত্তে বলল।

” তোকে যদি স্যার ভালোবেসে থাকে তবে নির্দিধায় মেনে নিবে। শুধু তুই একবার তার কাছে নত হ। সব ভুলে ফিরে যা তার কাছে। ”

” তার কাছে নত হতে আমার কোনও আপত্তি নেই, নেই কোন লজ্জাও। আমি শুধু নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাচ্ছি। যেদিন বুঝব আমার প্রায়শ্চিত্তের আর প্রয়োজন নেই তখনই তার কাছে ফিরে যাব। আর এরমধ্যে নিজেকে তার যোগ্য করে তুলব। ”

” কিন্তু স্যার যদি ততদিন তোর অপেক্ষায় না থেকে নতুনভাবে জীবন শুরু করে? কি করবি তখন? সইতে পাইবি সেই যাতনা? আমার কথা শোন, ফিরে যা দেরি হওয়ার আগেই। ”

” সে আমাকে ভিষণ ভালোবাসে। তার চোখে আমার জন্য এক আকাশ ভালোবাসা দেখেছিলাম। তার সেই ভালোবাসাকেই পুঁজি করে আমি তার বিশ্বাস ভেঙ্গেছি। নিজের অহংবোধ বজায় রাখতে সেই ভালোবাসা পায়ে মাড়িয়েছি। চরম আঘাত দিয়েছি তাকে। তারপরও আমি জানি, তার ভালোবাসা শুধু আমার জন্যই। অন্য কাউকে সে নিজের সাথে কখনোই জড়াবেনা। ”

তৃষা আর কিছুই বললনা। ও বুঝতে পারছে মাশিয়া ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। শুধু ধরতে পারছেনা, মাশিয়ার ভয়টা কিসে।

মাশিয়া মলিন মুখে তাকিয়ে আছে তৃষার দিকে। ও কাউকেই বলতে পারেনা হৃদয়ের গহীনে জমাট বেঁধে থাকা ভয়ের কারন। কখনোই কাউকে বলতে পারবেনা, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আরমানের সাথে নোংরা খেলায় মেতেছিল। আরমানের ভালোবাসাকে হাতিয়ার করে আরমানকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেছে। সেই রাতে ও নিজ থেকেই ধরা দিয়েছিল আরমানের বাহুডোরে। কাউকে কখনোই বলতে পারবেনা এই গোপন কথাগুলো। ও জানে, ওর এমন ছলচাতুরীর ক্ষমা নেই আরমানের অভিধানে। তাই আরমানের মুখোমুখি হওয়ার সাহস হয়না কিছুতেই।

পেরিয়ে গেছে দেড়মাস । সুধার ক্লাস শুরু হয়েছে পুরোদমে। ও নিয়মিত ক্লাস করছে। গত কয়েকদিন ধরে সুধা লক্ষ্য করছে, একটা ছেলে ওকে ফলো করছে। ছেলেটা সব সময় সুধার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। তাকে দেখে সিনিয়র বলেই মনে হয়। তবুও সুধার ভয় কাটেনা। সদ্য মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে ও। তাই আশেপাশের সবাই ওর অচেনা। সেই ছেলেটিও তাই।

ক্লাস শেষ করে কেবলই রুম থেকে বের হয়েছে মেয়েটা। এমন সময় সেই অচেনা ছেলে এসে সুধার পথরোধ করে। তাকে দেখে সুধা ভিষণ চমকায়। ছেলেটির গায়ে এ্যাপ্রোন হাতে ট্রেথোস্কোপ। লম্বা আর হালকাপাতলা গড়নের উজ্জ্বল শ্যামবর্নের ছেলেটির মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। ছেলেটিকে দেখামাত্রই সুধা মাথা নিচু করল।

” হ্যালো, আমি অনিক। আপনি বোধহয় নতুন ভর্তি হয়েছেন ? গত একমাস ধরে আপনাকে দেখছি। আপনার নামটা জানতে পারি? ”

সুধা আঁড়চোখে এদিকওদিক তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজছে। কিন্তু সেই সুযোগ ওর হচ্ছেনা। এদিকে ছেলেটা ওর উত্তরের আশায় সুধার দিকে তাকিয়ে আছে।

” আ..আমি সুধা। আমাকে যেতে দিন। ”

সুধার কথা ঠিক বোধগম্য হয়না অনিক নামক ছেলেটির। সে মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করল,

” আমি কি আপনার পথ আটকে রেখেছি? আর আপনার নাম কি শুধুই সুধা? আগেপিছে কিছুই নেই! ”

” আমি বাসায় যাব। পথ ছাড়ুন। ” এবার সুধা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল।

” এই কি করছেন! কাঁদবেননা প্লিজ। আশেপাশের সবাই যদি আপনাকে কাঁদতে দেখে, তবে তারা ভাববে, আমি আপনাকে খারাপ কিছু বলেছি। মেডিকেলে আমার একটা রেপুটেশন আছে। ” ছেলেটা বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়েছে। সে এদিকওদিক তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। এই সুযোগে সুধা ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। কিছুদূর গিয়ে মেয়েটা দৌড় দেয়।

” যাহ্ এভাবে চলে গেল কেন! আমিতো শুধু তার নাম জিজ্ঞেস করেছি! আজব! ”

” কি হে, আইনস্টাইন? এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন, বাবা? কোথাও কি কারেন্টর শক খেয়েছ? ” পেছন থেকে আরেকটা ছেলে এসে অনিক নামক ছেলেটার কাঁধে হাত রাখল।

” আর বলিসনা, বন্ধু। তোকে একটা মেয়ের কথা বলেছিলামনা? তাকে আজ নাম জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো। আমিতো ভয়ই পেয়েছিলাম। নাম জিজ্ঞেস করলে যে কেউ কাঁদে এটা আজ প্রথম দেখলাম। ”

” হুররর ব্যাটা। তোর নাম জিজ্ঞেস করায় মেয়েটা কাঁদেনি। কেঁদেছে তোর চেহারা দেখে। তোর এই ফিলিপসের মত বডি দেখে মেয়েটা নিশ্চয়ই ভয় খেয়েছে। আগেই বলেছি বেশি বেশি হরলিক্স খেয়ে বডি তৈরী কর। আমার কথা শুনলে আজ কোন মেয়ে তোকে দেখে কাঁদতনা। ”

” ইয়ার্কি করছিস, বন্ধু? আমি মরছি প্রেমের অনলে। কিন্তু আমাকে সাহায্য না করে অনলে ঘৃত ছিটিয়ে দিচ্ছিস! ”

” অবশেষে আমাদের নিউটন মোহাম্মদ টমাস আলভা এডিসন হোসেন আইনস্টাইন প্রেমে পড়েছে ভাবা যায়! তোর এই প্রেমে শুধু আমি কেন পুরো মেডিকেলের স্টাফ তোকে সাথে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে তোকে সাহায্য করতে আমরা মর্গ থেকে ডেড বডি আনব। ডেড বডির মিছলে ভরিয়ে ফেলব রাজপথ। ”

বন্ধুর এরূপ কথা শুনে অনিক চোখ সরু করে তার দিকে তাকায়। ও বুঝতে পারছেনা, ওকে সাহায্য করতে ডেড বডির মিছিল করতে হবে কেন?

বাসায় এসে সুধা অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। ছেলেটাকে সে মেডিকেলে ভর্তি হবার পর থেকেই দেখছে। ছেলেটা বেশিরভাগ সময়ই ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। সুধা আর পাঁচটা মেয়ের মত নয়। ও সব সময়ই ছেলেদের এড়িয়ে চলেছে। ছেলেদের সাথে কথা বলতে ওর অস্বস্তি লাগে। এক ধরনের ভয় কাজ করে। শশীর মত ও সাহসী নয়। চট করে কারো মুখের ওপর কথা বলতে পারেনা, কারো সাথে সহজে মিশতে পারেনা। আর ছেলেদের সাথে কথা বলাকে ও ঝামেলা মনে করে। আর সেই ঝামেলার মাঝেই ও ফেঁসেছে।

” আপু, কি হয়েছে তোমার? খরগোশের মত লাফাচ্ছ কেন! ” সুধাকে পায়চারী করতে দেখে শশী বলল।

” আমি লাফাচ্ছি! এই তোর খেয়েদেয়ে কাজ নেই? পড়াশোনা নেই? আমার হাঁটাকে তোর খরগোশের মত লাফানো মনে হচ্ছে? ফাজিল মেয়ে। পড়াশোনার বেলায় কোন খবর নেই। দিনদিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে। ”

” লও ঠ্যালা। সামান্য একটা কথার রিয়্যাকশন কেউ এভাবে দেয়, সেটা তোমাকে না দেখলে বুঝতামনা। তোমার এভাবে কথা বলার কারণ বুঝতে একটু একটু পারছি। নিশ্চয়ই কোন ছেলে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছিল? ছেলেদের দেখলেই তো তুমি গুটিয়ে যাও। তারা কথা বলতে চাইলে অস্থির হয়ে যাও। তুমি একটা ব্যাকডেটেড রমনী সেটা কি তুমি জানো? আরে বাবা, পুরুষ হলো প্রেমিকের জাত। তারা নারীদের দেখলে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতেই চাইবে। তাদের কথায় মধু ঝরবে এটাই স্বাভাবিক। এতে অস্থির হওয়ার কি আছে! দুনিয়ার সব প্রেমিক পুরুষ কি তোমাকেই দেখে? আমি কি সুন্দরী নই! আমার সাথে কেউ কথা বলতে চাইলে আমি অন্তত তাকে হতাশ করবনা। ” শশী ঢং করে বলল।

” বেয়াদব মেয়ে, আজকেই যদি ভাইয়াকে এসব কথা বলেছি, তবে আমার নাম সুধা নয়। ও পড়াশোনা বাদ দিয়ে পুরুষ নিয়ে গবেষণা করছে! আসছে পুরুষ বিশেষজ্ঞ। যা ভাগ। রুমে গিয়ে বই নিয়ে বস। ” সুধার ধমক খেয়ে শশী অপ্রসন্ন বদনে রুমে গিয়ে বই হাতে নেয়।

আটমাসের প্রেগেন্সিতেই মাশিয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওর পুরো শরীর ফুলে গেছে। সেই।সাথে দেখা দিয়েছে রক্তশূন্যতা। সেই সাথে দেখা দিয়েছে, ইন্টারনাল কিছু প্রবলেম। চার দিন ধরে ও হসপিটালে এডমিট। ডক্টর জানিয়েছে, দুই-একদিনের মধ্যেই কয়েক ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যেই সি সেকশনে নিতে হবে।

হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে মাশিয়া। সার্বক্ষনিক ওর পাশে কেউ না কেউ থাকছে। তৃষা, মিতুল, জয় ওরা প্রতিদিনই আসছে। ওর সাথে দুই-চার ঘন্টা কাটাচ্ছে। ওকে সাহস দিচ্ছে সবাই।

সাতদিন না পেরোতেই মাশিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। বাধ্য হয়ে ওকে সি সেকশনে নিতে হয়। কল্পনা মোর্তাজা আল্লাহকে ডাকছেন। তার বড় বোন, ছোট বোন সবাই এসেছে। মিরাজ মোর্তাজা ডক্টরের সাথে আছেন। তিনি মেয়েকে সুস্থ দেখতে চান। তাই দেশের নামকরা চিকিৎসক এনেছেন নিজের ক্লিনিকে। মাহিনও বাবার সাথেই আছে। তবে দোলন আসেনি ক্লিনিকে।

যথাসময়ে মাশিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। বাহিরে সবাই আল্লাহকে ডাকছেন। ডক্টর জানিয়েছে, মাশিয়ার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। যখন-তখন খারাপ কিছু ঘটতে পারে। প্রায় আধাঘন্টা পর দু’জন সিস্টার কোলে করে দুইটা বেবি এনে দাঁড়ায় কল্পনা মোর্তাজার সামনে।

“ম্যাম, আপনার নাতনী। ”

অবাক হয়ে কল্পনা মোর্তাজা তাকালেন ফুটফুটে দুইটা পরীর দিকে। কাঁপাকাঁপা হাতে একজনকে কোলে নিলেন। আরেকজনকে নিলেন মিরাজ মোর্তাজা। কিন্তু কল্পনা মোর্তাজা তখনো ঘোর থেকে বেরোতে পারেননি। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন স্বামীর দিকে। তার মনোভাব বুঝতে পারলেন মিরাজ মোর্তাজা। তিনি হাসলেন।

” আমি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু তোমাদের বলিনি। এমনিতেই মাশিয়ার শরীর খারাপ ছিল। তার উপর টুইন বেবির কথা শুনলে তোমরা চিন্তা করতে। এছাড়া ডক্টরও জানিয়েছিল, মাশিয়ার কিছু কমপ্লিকেশন আছে। টুইন বেবি ধারন ক্ষমতা ওর নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমি এটা গোপন করে গেছি। ডক্টরও তোমাদের জানায়নি। তারা চিকিৎসা করে গেছে। ”

কল্পনা মোর্তাজা খুশিতে কেঁদে ফেললেন। তিনি সিস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন,

” আমার মেয়ে কেমন আছে? ”

” খুব ভালো নেই। ব্লিডিং কন্ট্রোল হচ্ছেনা। তবে ডক্টররা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। আপনারা আল্লাহকে ডাকুন। ”

দুইবোন এসে কল্পনা মোর্তাজাকে ধরলেন। মাশিয়ার খবর শুনে তার মাথা ঘুরে উঠেছে। মাশিয়ার ছোট খালা মিরাজ মোর্তাজার কাছ থেকে বেবিকে নেয়। আরেকজন কল্পনা মোর্তাজার কাছ থেকে নিজের কোলে নেন। এরপর তারা কল্পনা মোর্তাজাকে নিয়ে কেবিনে যান।

গত কয়েকদিন থেকেই আরমানের খুব অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর গলা টিপে ধরে রেখেছে। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতে পারছেনা। কয়েক রাত ওর নির্ঘুম কাটিয়েছে। আজ সকাল থেকেই ওর বেশি খারাপ লাগবে। একটা অজানা অনুভূতি ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। আজ সে কলেজেও যায়নি। সকাল থেকে কিচ্ছুটি মুখে দেয়নি। চিন্তায় শুধু ঘরবার করছে। যখন ধৈর্য্যে আর কুলালোনা তখন ফোন দেয় মিরাজ মোর্তাজার নম্বরে। কিন্তু ওকে হতাশ করে দিয়ে ফোন বন্ধ দেখায়। পরপর কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
এরপর ফোন দেয় কল্পনা মোর্তাজার নম্বরে। কিন্তু কল্পনা মোর্তাজার ফোন বেজেই চলল কেউ রিসিভ করলনা।

মিরাজ মোর্তাজার ব্যাটারিতে চার্য নেই তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। তিনি ব্যস্ত মাশিয়াকে নিয়ে। কল্পনা মোর্তাজার ফোনও পার্সের ভেতর। তিনি ব্যাগ কেবিনে রেখে এসেছেন। আরমান জানতেও পারলনা তার অংশ দুনিয়ায় আসার আয়োজন করছে। অবশেষে তারা এসেই গেছে। দুনিয়ায় এসে যারা দেখতে পেলোনা বাবার মুখ। পেলোনা বাবার কোল।

চলবে…

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_৪২
জাওয়াদ জামী জামী

মাশিয়ার অবস্থা অবনতির দিকে যাওয়ায় ডেলিভারির আধাঘন্টা পরই ওকে আইসিইউতে শিফট করা হয়। চিন্তায় জর্জরিত কল্পনা মোর্তাজা মেয়ের এই কথা শোনার পরই সেন্সলেস হয়ে যান। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। তাকে অক্সিজেন দিয়ে হসপিটালেই এডমিট করা হয়।

কিছুক্ষণ পর কল্পনা মোর্তাজার জ্ঞান ফিরতেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’র কান্না শুনে তার পাশে গিয়ে বসলেন। শান্তনার হাত রাখলেন স্ত্রী’র মাথায়।

” শান্ত হও, কল্পনা। আমাদের এভাবে ভেঙ্গে পরলে চলবেনা। তুমি এমন অস্থির হলে বাচ্চাদের কে সামলাবে? আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আরমানকে ফোন দিয়ে ওর সন্তানের কথা জানাতে চাই। এতে যদি মাশিয়া রাগ করে করুক। সন্তান আগমনের সুসংবাদ জানার অধিকার আরমানের আছে। আমি আরও আগেই ফোন দিতাম। কিন্তু তুমি হুট করেই সেন্সলেস হয়ে গেলে, তাই আর পারলামনা। ”

সিস্টার এসে কল্পনা মোর্তাজার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিতেই তিনি কথা বললেন,

” আমিও ভেবেছিলাম আরমানকে ফোন দিয়ে ওর সন্তানের কথা জানাব। কিন্তু সেটা আর হলো কই। তুমিই বরং ওকে ফোন দিয়ে জানাও। ”

মিরাজ মোর্তাজা পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলেন ব্যাটারিতে চার্য নেই। তিনি হতাশ চোখে স্ত্রী’ র দিকে তাকালেন।

” আংকেল, ডক্টর আপনার খোঁজ করছে। আপনি গিয়ে তার সাথে দেখা করুন। ”

তৃষা এসে মিরাজ মোর্তাজাকে ডাকল। মিরাজ মোর্তাজা তারাহুরো করে বেরিয়ে গেলেন। তৃষা কল্পনা মোর্তাজার কাছে গিয়ে বসল।

” আন্টি, এখন আপনার কেমন লাগছে? আপনি আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। ”

” আমার মেয়েটা কেমন আছে, তৃষা? ও সুস্থ হয়ে আবারও আমার বুকে ফিরবেতো? আবারও কেঁদে উঠলেন কল্পনা মোর্তাজা। ”

” ওকে ফিরতেই হবে, আন্টি। ও এখনো সন্তানদের মুখ দেখেনি। সন্তানদের জন্য হলেও ওকে ফিরতে হবে। একটা কথা বলব, আন্টি? কিছু মনে করবেননাতো? ”

” কি বলবে বল? ” চোখ মুছে বললেন কল্পনা মোর্তাজা।

” স্যারকে বোধহয় এখনো জানানো হয়নি। আংকেল আপনাকে আর মাশিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। ”

” তুমি একবার আরমানকে ফোন দিয়ে আমাকে দাওতো। তোমার আংকেলের ফোন সুইচড অফ। তাই সে আরমানকে জানাতে পারলনা। আমার পার্সও বাচ্চাদের কেবিনে রাখা আছে। পার্সেই ফোন আছে। সকাল থেকে ফোনের খোঁজ রাখছিনা। ”

” আপনি শুয়ে থাকুন। আমি আমার ফোন নিয়ে আসছি। একদমই নড়াচড়া করবেননা। স্যালাইন এখনো শেষ হয়নি। ”

তৃষার কথা শেষ না হতেই একজন সিস্টার এসে কল্পনার মোর্তাজার স্যালাইনে কি একটা ইনজেকশন দিল। তৃষা বেরিয়ে গেল ফোন আনতে।

তৃষা ফোন নিয়ে কল্পনা মোর্তাজার কেবিনে এসে দেখল তিনি ঘুমিয়ে পরেছেন। এদিকে মিরাজ মোর্তাজাও ডক্টরের সাথে কোথাও গেছেন। তাই বাধ্য হয়ে তৃষা ফোন করল আরমানকে।

আরমান বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। তবুও ওর অস্থিরতা কমছেনা। কল্পনা মোর্তাজাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে, কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। যতক্ষণ না মাশিয়ার কোন খবর পাচ্ছে ততক্ষণ ও শান্তি পাবেনা। সকাল থেকেই অস্থির লাগায় ও সুধা আর শশীর খবর নিয়েছে। ওরা ভালো আছে জেনে স্বস্তি পেলেও অস্থিরতা কিছুতেই কাটছেনা। ওর মন বলছে মাশিয়ার কিছু হয়েছে। মাশিয়া ভালো নেই। চিন্তার মাঝেই আরমানের ফোন বেজে উঠল। ফোনের আওয়াজ পেতেই ও ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল অপরিচিত নম্বর। কোন কিছু না ভেবেই ও ফোন রিসিভ করল।

” হ্যালো। ”

” আসসালামু আলাইকুম, স্যার। আমি তৃষা, ঢাকা থেকে। চিনেছেন আমাকে? ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। তুমি আমার এক্স স্টুডেন্ট তৃষা? ” আরমান অবাক হয়ে জানতে চাইল।

” জ্বি, স্যার। আমি সে-ই। ”

” হঠাৎ কি মনে করে ফোন দিয়েছ? সব ঠিক আছে তো? ” আরমানের বুক দুরুদুরু করছে।

” আপনি একবার ঢাকায় আসতে পারবেন, স্যার? মাশিয়া ভিষণ অসুস্থ। ও আইসিইউতে আছে। ”

তৃষার কথা শুনে আরমানের হাত থেকে ফোন বিছানায় পরে যায়। ও স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, শরীরে কাঁপন টের পাচ্ছে। অপর পাশ থেকে তৃষা আরমানকে ডেকেই চলেছে। খানিকক্ষণ পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আরমান আবারও ফোন হাতে নেয়।

” কি হয়েছে ওর? কোন হসপিটালে আছে? ”

” আপনি আগে আসুন। তারপর সব জেনে নিবেন। ” তৃষা আর কথা বাড়ালনা। হসপিটালের এ্যাড্রেস জানিয়ে দিল আরমানকে।

আরমান বিছানা থেকে নেমে সুধাকে তৈরী হতে হতে সুধাকে ফোন দিয়ে হসপিটালের এ্যাড্রেস দিয়ে সেখানে যেতে বলল। আর তৃষার নম্বরও ওকে এসএমএস করে দিল। সুধা কোন প্রশ্ন না করে ওর কথায় রাজি হয়।

আরমানের ফোন পেয়ে সুধা একটুও দেরি করলনা। ও মেডিকেল থেকে বেরিয়ে পরল। শশীকে ফোন দিয়ে তৈরী থাকতে বলল। আধাঘন্টা পর সুধা শশীকে নিয়ে হসপিটালের সামনে এসে ফোন দেয় তৃষাকে। তৃষা ফোন রিসিভ করলে সুধা ওর পরিচয় দেয়। এরপর তৃষা সুধাকে কেবিন নম্বর জানিয়ে দিলে সুধা সরাসরি তিন তলায় উঠে যায়।

আরমান বেরিয়ে পরেছে। ওর ঢাকায় পৌঁছাতে কম করে ৯ ঘন্টা লাগবে। টেনশনে আরমানের পাগল পাগল লাগছে।

সুধা আর শশী তৃষার বলা কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আলতোভাবে দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা খোলাই ছিল। ওর ধাক্কায় পুরোটা খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে সুধা কাউকেই চিনতে পারলনা। দু’জন মাঝবয়েসী মহিলা দুটো বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে। আর দু’জন মেয়ে বাচ্চাদের জন্য দুধ বানাচ্ছে। ওদের দেখে সকলে একযোগে তাকায়। একটা মেয়ে হাতের ফিডিং বোতল রেখে উঠে আসল ওদের কাছে।

” তোমরা সুধা, শশী?”

সুধা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।

” আমি তৃষা। এদিকে এস। ” তৃষা সুধার হাত ধরে নিয়ে যায় বাচ্চাদের কাছে।

সুধা আর শশী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল একবারে ছোট দুইটা বাচ্চার দিকে। আরমান কেন ওদের এখানে আসতে বলেছে, সেটা ওদের বোধগম্য হচ্ছেনা।

” কিছু মনে করবেননা, আসলে আপনাদের আমরা চিনতে পারছিনা। ভাইয়া ফোনে শুধু বলেছে এখানে আসতে। আর সেই সাথে আপনার নম্বর দিয়েছে। এই বাচ্চারা কারা? আর আপনারাই বা কারা? ” সুধা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” আমি মাশিয়ার বন্ধু, আর ইনারা মাশিয়ার খালামনি। আর এই যে পুতুলদের দেখছ, এরা মাশিয়ার মেয়ে। তোমার ভাইয়ার মেয়ে। ”

তৃষার কথা শেষ হতে না হতেই সুধা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বেডের একপাশে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। আর শশী ধপ করে বেডে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওদেরকে শান্ত করতে তৃষা হিমশিম খেয়ে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওরা নিজেদের ধাতস্থ করে বাচ্চাদের কোলে নেয়। আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে ছোট্ট পুতুলদের।

” ভাবি কোথায়, আপু? আর খালাম্মাই বা কোথায়? ” বেশ খানিকক্ষণ পর সুধা তৃষাকে জিজ্ঞেস করল।

” মাশিয়া আইসিইউতে আছে। ওর অবস্থা ভালো নয়। আর আন্টি পাশের কেবিনে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি মাশিয়ার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে গেছেন। ”

তৃষার কথা শুনে ওরা দুই বোন চমকে উঠল। তৃষাকে অনুরোধ করল মাশিয়ার কাছে নিয়ে যেতে। তৃষা ওদের মাশিয়ার কাছে নিয়ে গেলে ওরা কাঁচের দরজা দিয়ে মাশিয়াকে দেখল। ওকে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে দু’জনেরই মনটা খারাপ হয়ে গেছে। কত যন্ত্রপাতি মেয়েটার শরীরে লাগানো আছে। মাশিয়াকে এই অবস্থায় দেখে ওরা দু বোনই অতীতে ফিরে গেছে। কত খুনসুটি, কত-শত মজা করেছে ওরা। একসাথে কত রাত জেগে গল্প করেছে। বেশিক্ষন ওরা আইসিইউ-র সামনে থাকতে পারলনা।

সুধা আর শশীকে দেখে কল্পনা মোর্তাজার মুখে হাসি ফুটল। তিনি চোখ খুলেই ওদেরকে দেখলেন।

” তোমরা এসেছ, মা! তোমার আংকেল আরমানকে ফোন করতে গিয়ে দেখল তার ফোনের ব্যাটারি ডাউন। আর আমার ফোন ঐ কেবিনে রেখেছি। তাই তোমাদের জানাতে পারিনি। আমার মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলে? কেমন আছে ও? তোমার দুই মা কেমন আছে? ” দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলেন কল্পনা মোর্তাজা।

” ভাবি আর বাবুরা ওরা সবাই ভালো আছে। আপনি চিন্তা করবেননা। বাবুরা ঘুমাচ্ছে। ভাইয়াও আসছে। আপনি তারাতারি সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আমাদের ভালো লাগছেনা। ” সুধা কল্পনা মোর্তাজার কাছে গিয়ে বসল। ও কল্পনা মোর্তাজার একটা হাত ধরে রেখেছে। ঢাকায় থাকার সুবাদে কল্পনা মোর্তাজার সাথে ওর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

” সত্যিই আরমান আসছে? কতক্ষণ লাগবে আসতে? তোমার আম্মাকে আসতে বলোনি? তিনি আসবেননা? ”

কল্পনা মোর্তাজার শেষ প্রশ্নে মাথা নিচু করল ওরা দুই বোন। দু’জনেরই গাল বেয়ে নেমেছে অশ্রুধারা। ওদের কাঁদতে দেখে ভয় পেলেন কল্পনা মোর্তাজা। তিনি মনে মনে বললেন, তবে কি বেয়ান মাশিয়াকে ক্ষমা করবেননা?

” আম্মা আর কোনদিনও আসবেননা, খালাম্মা। তিনি কখনো জানতেই পারবেননা তার দুইটা নাতনী হয়েছে। আর বাচ্চারাও কখনোই তাদের দাদীমার আদর পাবেনা। ” শশী কান্না থামিয়ে বলল। সুধা কেঁদেই চলেছে।

শশীর কথার মানে বুঝতে পারলেননা কল্পনা মোর্তাজা। তিনি ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকলেন শশীর দিকে।

” আম্মা আর নেই। ভাবি চলে আসার দুই মাস পরই আম্মা আমাদের একা করে চিরতরে চলে গেছে। আম্মা তার নাতনীদের কখনোই দেখতে পাবেনা। ” এবার সুধা জোড়ে কেঁদে উঠল।

সুধার কথা শুনে কল্পনা মোর্তাজা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি কি বলবেন, সুধাকে কিভাবে শান্তনা দেবেন বুঝতে পারছেননা। তিনি অনেকক্ষণ পর মুখ খুললেন,

” মাশিয়ার দুর্ভাগ্য তোমার আম্মার মত একজন শ্বাশুড়িকে অকালে হারালো। তার কাছে নিজের ভুলের ক্ষমা চাইতেও পারলনা। অমন একজন মানুষের ছত্রছায়ায় নিজেকে পরিশুদ্ধ নারী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলনা। একটা সম্পর্ক ঠিকঠাক গড়ে উঠার আগেই মাশিয়া সেটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বেয়ানের সাথে করা অন্যায়ের ক্ষমা কোনদিনই পাবেনা মাশিয়া। কিন্তু তোমরা ওর ভুলগুলো ক্ষমা করে দিও, মা। আমার মেয়েটা যে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে নিজের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করছে। তোমরা ওকে ক্ষমা করে দিও। এত কিছু হয়ে গেছে তোমরা আমাদের জানাওনি কেন? তাকে অন্তত শেষ দেখা দেখতে পেতাম। ” দুঃখে কেঁদে উঠলেন কল্পনা মোর্তাজা। আয়েশা খানমের মৃত্যু তিনি কিছুতেই মানতে পারছেননা।

” সেই মুহূর্তে আমরা কাউকে জানানোর পরিস্থিতিতে ছিলামনা। তাছাড়া ভাইয়াও ভাবির ওপর মনঃক্ষুণ্ন ছিল। ভাবি বলেছিল, আমাদের সাথে কোন সম্পর্ক সে রাখতে চায়না। এসব কারনেই আপনাদের জানানো হয়নি। আর আমরা ভাবিকে অনেক আগেই ক্ষমা করেছি। আম্মা কখনোই ভাবির ওপর রেগে ছিলনা। সে ভাবিকে ফিরে পেতে চেয়েছে। মৃ’ত্যু’র আগেও ভাইয়াকে অনুরোধ করেছে ভাবিকে ফিরিয়ে নিতে। এসব কথা এখন থাক, খালাম্মা। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন। ভাবি ফিরে আসুক আমাদের মাঝে। এটাই আমরা চাই। ” সুধা একসাথে কথাগুলো বলল।

কল্পনা মোর্তাজা শান্ত, স্নিগ্ধ এই মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মধ্যে বড্ড বেশি মায়া। তিনি প্রথম থেকেই সুধাকে ভিষণ পছন্দ করেন। তিনি অনেকবার ভেবেছিলেন, তার আর একটা ছেলে থাকলে তিনি সুধাকে সেই ছেলের বউ করতেন।

মিরাজ মোর্তাজা সুধা, শশীকে দেখে ভিষণ খুশি হয়েছেন। তিনিও আয়েশা খানমের মৃ’ত্যু’র খবর শুনে কল্পনা মোর্তাজার মত স্তব্ধ হয়ে গেছেন। ওদের দু বোনকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আফসোস করলেন নিজের মেয়ের কৃতকর্মের জন্য।

আরমান হসপিটালের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাঁচতলা এই প্রাইভেট হসপিটালের সুনাম আছে চিকিৎসা সেবার জন্য। ও বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়।

সুধা আর শশী দুই পুতুলকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ওরা এই মুহূর্তে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। সারাদিন পর এই প্রথমবার চোখ খুলল। ওরা দুই বোন ছোট্ট পুতুলদের দু-চোখ ভরে দেখছে।

তৃতীয় তলায় এসে আরমান এদিকওদিক তাকিয়ে ওর কাঙ্ক্ষিত কেবিনের খোঁজ করছে। কয়েক সেকেন্ড পরই ওর চোখ যায় তিন নম্বর কেবিনের দরজায়। দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে পৌঁছে ডাক দেয় সুধাকে।

” সুধা, ভেতরে আছিস? ”

আরমানের গলা শুনে সুধা উঠে দাঁড়ায়। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। একহাতে খুলে দেয় দরজা।

বোনের কোলে সদ্যজাত শিশুকে দেখে কপাল কুঁচকে তাকায় আরমান। ও এখানে মাশিয়াকে দেখতে এসেছে। বোনদেরও পাঠিয়েছিল মাশিয়ার আশেপাশে থাকতে, ওর খোঁজ আরমানকে জানাতে। কিন্তু সেটা না করে সুধা কার বাচ্চাকে নিয়ে মেতে আছে? প্রশ্নটা উঁকি দেয় আরমানের মনে।

” ভেতরে এস, ভাইয়া। ” একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আরমানকে ভেতরে ঢুকতে বলল সুধা।

আরমান ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে গেছে। শশীর কোলেও একটা বাচ্চা। এসব কি হচ্ছে! বাচ্চাদুটো পিটপিটিয়ে তাকাচ্ছে। কল্পনা মোর্তাজা একটা বেডে হেলান দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। আরমানকে দেখে তিনি সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেননা। আরমান একবার সুধার দিকে তাকায় তো আরেকবার শশীর দিকে তাকায়। আরমানকে ভ্যাবাচেকা খেতে দেখে রুমে উপস্থিত সবাই হাসল। তৃষা ফিডিং বোতল সুধার কাছে দিয়ে আরেকটা বোতলে দুধ প্রস্তুত করছে। কাজের ফাঁকেই সে কথা বলল আরমানের সাথে।

” বলুনতো স্যার, পুতুলগুলো কে? আপনি বলতে পারলে ধরে নিব আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। ” তৃষার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি।

তৃষার মুখে এমন আশ্চর্যজনক কথা শুনে এবার আরমানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। ও কোন কিছু না বলে সুধার দিকে তাকায় উত্তরের আশায়। সুধা বুঝতে পারছে ওর ভাইয়ার মনে কি চলছে।

” আমাদের প্রিন্সেস। এতদিন যেটা আমরা জানতে পারিনি আজ হুট করেই সেই সুসংবাদ ভাবি আমাদের দিয়েছে। এতদিন আম্মার জন্য কষ্ট পেতাম, কাঁদতাম। আম্মার অভাব সর্বদা বিরাজ করত আমাদের মাঝে। আজ প্রিন্সেসরা আমাদের সেই অভাব দূর করেছে। এক আম্মাকে হারিয়ে আমরা দুইটা আম্মা পেয়েছি। শান্তি লাগছেনা, ভাইয়া? ”

সুধার কথা শুনে পা দুটো টলে উঠল। এ কি শুনছে ও! এটাও সম্ভব! এতদিনের বিরহ, দুঃখ-যাতনা, মান-অভিমানের এভাবেই সমাপ্তি হতে চলেছে তবে! সেই একটা রাতের ভালোবাসা এভাবেই পূর্ণতা পেয়েছে! টালমাটাল পায়ে আরমান এগিয়ে যায় সুধার কাছে। ডান হাতে স্পর্শ করল ওর প্রিন্সেসের গাল। ওর চোখে পানি। বাচ্চাটাও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

” এখানেও তোমার আরেকটা আম্মা আছে, ভাইয়া। আমাদের অবহেলা করোনা। আমরাও একটু ভালোবাসা ডিজার্ভ করি। ” শশী দুষ্টুমি করছে আরমানের সাথে।

আরমান কাঁপাকাঁপা হাতে সুধার কাছ থেকে কোলে নেয় ওর প্রিন্সেসকে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ওর কান্না দেখে সবার চোখে পানি এসে গেছে। শশী আরমানের কাছে এসে দাঁড়ায়। আরমান ওর কাছ থেকেও আরেকটা প্রিন্সেসকে কোলে নেয়। দু’হাতে দুই মেয়েকে আগলে নেয় ও।

” মাশিয়া কোথায়? কেমন আছে সে? ” কান্নাজড়ানো গলায় প্রশ্ন করল সুধাকে।

চলবে…