যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব-২৯+৩০

0
792

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________
‘মুখে যা আসে তা-ই বলে দাও তাই না? বেশরম যেন কোথাকার!’ কিছুটা ধমকেরসুরে বলল আহনাফ। সে যে কী করে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বের হবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

অর্ষার চোখে-মুখে অন্ধকার নেমে আসে। চুপসে যাওয়া মুখ করে বলে,’আমায় কেন বেশরম বলছেন? বেশরম তো আপনি। আপনি তো জানেন, আমিও এখন এখানে থাকি। তাও কেন আপনি নেং’টু প্যান্ট পরেছেন?’

আহনাফ দাঁতমুখ খিঁচে বলল,’চুপ একদম চুপ! কোনদিক থেকে এটাকে তোমার নেং’টু প্যান্ট মনে হচ্ছে হ্যাঁ? আন্ডারওয়্যার আর শর্টসের মধ্যে এখনো পার্থক্য বোঝো না। গাধী!’

অর্ষাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ক্যাথি ও অ্যানিকে নিচে নামিয়ে সে রুমে চলে গেল। অর্ষা তার যাওয়ার পথে চুপ করে তাকিয়ে ভাবতে লাগল। আহনাফ কী বলে গেল তাকে? গাধী? তার মতো ব্রিলিয়ান্ট একটা স্টুডেন্টকে সে কিনা শেষমেশ গাধী উপাধি দিয়ে গেল!

ক্যাথি এসে অর্ষার পায়ে গাল বুলায়। ওর স্পর্শে ভাবনা-চিন্তা ছুটে যায় অর্ষার। সময়-কাল বিলম্ব না করে চেঁচিয়ে একছুটে চলে যায় রুমের ভেতর।

আহনাফ আলমারি থেকে ফুলপ্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিল, ঝড়ের গতিতে ছুটে আসা অর্ষার সাথে লেগে যায় ধাক্কা। কিছুক্ষণ সে রাগী লুক নিয়ে তাকিয়ে থাকে। অর্ষা অপরাধীর মতো মাথা নত করে রেখেছে।

আহনাফ আর কী-ই বা বলবে একে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’দু’দণ্ড স্থির থাকতে পারো না? এত ছটফট করো কেন?’

‘আমি অনেক শান্তশিষ্ট সেটা আপনিও জানেন। এখানে আসার পর থেকেই আপনার বিড়ালের উৎপাতে আমার আর শান্ত থাকা হচ্ছে না।’

আহনাফ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। শুধু ওয়াশরুমে যাওয়ার পূর্বে বিড়বিড় করে বলে গেল,’কিছু বলাটাই অযথা। বৃথা!’

অর্ষা ক্যাথিওনকে রুমে আসতে দেখে, দ্রুত ফোনটা নিয়ে দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে যায়। দরজা লক করে বিড়বিড় করে বলে,

‘শেষমেশ কিনা একটা বিড়াল আমাকে উত্যক্ত করছে! হায় আল্লাহ্!’

বিছানায় বসে হোয়াটসএপে যায় সে। আমেনা বেগম ও লামিয়া বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। লামিয়া অবশ্য কয়েকটা ম্যাসেজও পাঠিয়েছে। যেগুলোর ধরণ কিছুটা এমন,

‘কিরে কোথায় মরছি’স?’ ‘এত তাড়াতাড়ি ম’রে গেলি?’ ‘ফোন ধর বেদ্দপ মাইয়া!’ ইত্যাদি আরো অনেক ম্যাসেজ।

অর্ষা ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়। ফোনে না পেয়ে ভেবে নিল, সে ম’রে গেছে? একেই বলে বন্ধুত্ব। ফাজিলের হাড্ডি একেকটা!

সে প্রথমে আমেনা বেগমকে ফোন করে মিনিট বিশেক কথা বলে। এরপর কল করে লামিয়াকে। লামিয়া অনলাইনেই ছিল। ফোন রিসিভ করে গম্ভীরকণ্ঠে বলে,

‘কে? কাকে চাই? কী চাই? কেন চাই?’

অর্ষা হাসতে থাকে। হাসি শুনে এক কাঠি বেশি রেগে যায় লামিয়া। খ্যাঁক করে বলে ওঠে,’হাসবি না অ’সভ্য মেয়ে! কতগুলা ফোন দিছি কাল? ধরিস নাই ক্যান?’

অর্ষা অপরাধীর মতো করে বলল,’স্যরি রে। ঘুমিয়ে গেছিলাম।’

‘ঘুমাইছিলি নাকি ভাইয়ার সাথে লটরপটর করছিলি সত্যি করে বল। তোদের রোমান্স তাহলে বেশ ভালোই চলছে বল?’

‘ছিহ্! কীভাবে কথা বলিস? এসব কিছুই না।’

‘ছি ছি করস ক্যান? তুই আমার ফ্রেন্ড। তোর সামনে এত ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে পারব না।’

এটুকু বলে একটুখানি থামে। ফের উৎসাহিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’এই বল না, ভাইয়ার সাথে তোর কিছু হয়েছে কিনা?’

‘হ্যাঁ, হয়েছে।’

লামিয়া আরো উৎসাহিত হয়ে জানতে চায়,’কী কী হয়েছে?’

‘ঝগড়া।’

‘অ্যা?’

‘হ্যাঁ। ঝগড়া হয়েছে আমাদের। নিয়ম করে প্রায় প্রতিদিন-ই হয়।’

‘এমা কেন?’

‘কী জানি! কীভাবে কীভাবে যেন হয়ে যায়।’

‘এছাড়া আর কিচ্ছু হয়নি?’

‘কী হবে?’

‘যা হয় সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। বাই দ্য ওয়ে, তোরা কি আলাদা থাকিস?’

‘আলাদাও থাকি, একসাথেও থাকি। কাজের আন্টি আসার পর একসাথে থাকা হয়।’

‘তাও তোদের মধ্যে কিছুই হয়নি? তোরা এত আনরোমান্টিক কেন? তোর বাচ্চাকাচ্চা দেখে কি আমরা মরতে পারব?’

অর্ষা লজ্জা পেয়ে যায় লামিয়ার কথা শুনে। দুজনের মাঝে একেবারেই যে কিছু হয়নি, সেটা বললেও তো ভুল বলা হয়। অবশ্য যতটুকু কাছে আসা হয়েছিল সেটা সম্পূর্ণ ছিল আহনাফের জ্বরের প্রভাব। এই কাছে আসার কোনো মানেই হয় না। তাই সে বিষয়টা লামিয়ার কাছে গোপন রাখল আপাতত। কখনো বলার মতো হলে সে নিজেই জানাবে।

‘কিরে? কোথায় গেলি?’ অর্ষাকে নিশ্চুপ পেয়ে প্রশ্ন করল লামিয়া।

অর্ষা ক্ষীণস্বরে বলল,’আছি। বল।’

‘চুপ করে আছিস কেন?’

‘তোর এসব কথার উত্তর হয় নাকি?’

‘দেখা যাবে। আমি শুধু আসি একবার। তোকে রোমান্টিক হওয়ার টিপস দেবো।’

‘আমার কোনো টিপস লাগবে না ভাই। তার আগে তুই বল, তুই আসবি মানে? কোথায় আসবি?’

লামিয়া একটু ভাব নিয়ে বলল,’সুইজারল্যান্ড আসব ডিয়ার।’

অর্ষা অবাক হয়ে বলে,’কী! মজা নিচ্ছিস?’

‘আরে না! সত্যিই। রেজাল্টের পর-ই আসব ট্যুরিস্ট ভিসায়। হানিমুনে বুঝছিস।’

‘তুই কি সত্যি বলছিস? আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না।’ খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলল অর্ষা।

‘বিশ্বাস কর মেরি জান। খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে ইন-শা-আল্লাহ্।’

‘ইন-শা-আল্লাহ্! খুশিতে এই কয়েকদিন তো আমার ঘুম-ই আসবে না। কবে যে রেজাল্ট দেবে আর কবে যে দেখা হবে!’

‘নিহাল এখন থেকেই সবকিছুর ব্যবস্থা করে রাখবে। ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করবে। যাতে করে রেজাল্ট দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই যেতে পারি।’

‘আমি যে কত খুশি হয়েছি তোকে বলে বোঝাতে পারব না। বাকিরা এই খবর জানে?’

‘এখনো জানে না। জানার পর আশিক তো সবার আগে আমাকে বলবে ওর জন্য কম্বল নিয়ে যেতে।’

অর্ষা শব্দ করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,’তোদের বাংলাদেশের সময়ে সন্ধ্যায় সবাইকে অনলাইনে থাকতে বলিস। ভিডিয়ো কলে কথা বলব।’

‘ঠিক আছে জান। এখন তাহলে রাখছি। শাশুড়ির থেকে রান্না শিখতেছি বুঝছিস। সুইজারল্যান্ড গিয়ে তোকে রান্না করে খাওয়াব।’

অর্ষা হেসে বলল,’বাব্বাহ্! এত সকালে রান্নাবান্না? যা হোক, অপেক্ষায় রইলাম। সাবধানে রান্না করিস। হাত পুড়িস না আবার।’

‘আচ্ছা। সকালের নাস্তা তো তাই এত সকালে। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে।’

‘খুব ভালো। রাখছি তাহলে। আল্লাহ্ হাফেজ।’

‘আল্লাহ্ হাফেজ।’
__________
সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রাস্তার মোড়ে এসে সবাই একত্রিত হয়। এখান থেকে আগে সবাই মিলে প্রাইভেট পড়তে যাবে। তারপর স্কুলে। সকাল এবং ওর বান্ধবীরা ক্লাস টেনে পড়ে। সবাই আসার পর গল্প করতে করতে যাচ্ছে।

নিতু সকালের উদ্দেশ্যে বলল,’তুই যে ডেয়ার জিতে যাবি ভাবতেও পারিনি।’

সকাল তার লম্বা বিনুনি ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বলল,’সকালের কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় বুঝলি?’

‘বুঝলাম। আগে বুঝলে আমার টাকাগুলো বাঁচত।’ মুখ গোমড়া করে বলল বিথী।

সকাল হাসতে হাসতে বলে,’এখন মুখটা কার্টুনের মতো রেখেছিস কেন? আমাকে ডেয়ার দেওয়ার আগে তোদের ভাবা উচিত ছিল।’

বিথী মুখ গোমড়া করেই বলল,’শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। আর জীবনেও তোকে ডেয়ার দেবো না, বাজিও ধরব না।’

সকাল হাসে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলে,’তবে যাই বলিস, ছেলেটা কিন্তু সত্যিই অনেক হ্যান্ডসাম।’

নিতু অবাক হয়ে বলে,’তুই আবার প্রেমেট্রেমে পড়ে যাসনি তো?’

‘তা জানিনা। পড়লেই বা কী সমস্যা?’

‘অনেক সমস্যা। ছেলেটার সম্পর্কে তুই, আমি, আমরা কেউই কিছু জানি না। কেমন সে তাও জানি না। তারচেয়েও বড়ো কথা, যদি গার্লফ্রেন্ড থাকে?’

‘থাকলে থাকবে। ব্রেকাপ করিয়ে দেবো।’

‘হুহ! মামার বাড়ির আবদার।’ মুখ ভেংচি দিয়ে বলল বিথী।

স্যারের বাসায় পৌঁছে যাওয়ায় কথোপকথন আর বেশিদূর এগোল না এই বিষয়ে। তবে সুযোগ মিললেই তিন বান্ধবীর কথার প্রসঙ্গ হিসেবে বারংবার উঠে আসছিল আহিল।
.
প্রাইভেট পড়ে স্কুলে যাওয়ার পথে আহিলকে দেখতে পায় তিন বান্ধবী। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হচ্ছিল। সাথে এক মেয়ে। আহিলকে দেখে সকাল যতটা না খুশি হয়েছিল তারচেয়েও বেশি রাগ আর কষ্ট হচ্ছে সাথে থাকা মেয়েটিকে দেখে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?

এক মনে ভাবল সে আহিলকে এড়িয়ে চলে যাবে। কিন্তু তার দুর্বোধ্য মন সেই বাধা মানতে নারাজ।

নিতু তো সকালকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলেই ফেলল,’কিরে তোর দিওয়ানা দেখি অন্য মেয়ের সাথে।’

উত্তরে বিথী বলল,’তো সে কি সকালকে নিয়ে ঘুরবে নাকি? কত সুন্দর ছেলে! পাশের মেয়েটাও যথেষ্ট সুন্দরী আছে তাই না রে?’

দুই বান্ধবীর কথা শুনে রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ে সকাল। তার আরো বেশি খারাপ লাগছে নিজের বান্ধবীর মুখে অন্য মেয়ের প্রশংসা শুনে। তার অবাধ্য মন এবার আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল আহিলের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

সে ব্যস্ত রাস্তা পার হওয়ার জন্য রাস্তার দু’পাশে তাকাচ্ছে। নিতু ব্যস্ত হয়ে বলে,’আরে করছিস কী? রাস্তা কেন পার হচ্ছিস? আমাদের স্কুল তো এইদিকে।’

সকাল কোনো কথাই শুনল না। এমনকি কোনো প্রশ্নের উত্তরও দিলো না। তবে সে রাস্তা পার হতে হতে আহিলের সাথে থাকা মেয়েটি রিকশায় উঠে পড়েছে।

আহিল বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দেবে সেই মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে সকাল সামনে দাঁড়ায়। একটু দৌঁড়াতে হয়েছে বলে এখন কিছুটা হাঁপাচ্ছে।

সকাল কোমরে হাত রেখে নাক ফুলিয়ে বলল,’আপনি এখানে কেন? ঐ মেয়েটা কে ছিল সাথে?’

আহিল ভ্রুকুটি করে জানতে চায়,’আপনি কে?’

সকালের মুখটা হা হয়ে যায়। অপমানে চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলে ওঠে। কাল দেখা হলো, বাইকে করে পৌঁছেও দিল; আর আজ-ই কিনা চিনতে পারছে না!

সে রাগে গমগম করে বলে উঠল,’আপনি আমায় চিনতে পারছেন না?’

‘জি না।’

‘সত্যিই চিনতে পারছেন না?’

‘বললাম তো না! তাও বারবার এক প্রশ্ন কেন করছেন? আপনার কিছু বলার থাকলে ঝটপট বলে ফেলুন। আমার কাজ আছে।’

রাগে শরীর রিরি করে ওঠে সকালে। সব ব্যস্ততা যেন উনার একার-ই! আর সকালের যে ক্লাসে লেট হয়ে যাচ্ছে তার বেলায় কিছু না!

সে রাগ প্রকাশ না করেই বলল,’আরে আমি সকাল! কাল যে বৃষ্টির মধ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন? মনে পড়েছে?’

‘ওহ হ্যাঁ। সেই অ’ভদ্র, বেয়া’দব মেয়েটা!’

সকাল মলিনমুখে বলল,’বকছেন কেন?’

‘কাল যাওয়ার সময় কী বলে গেছিলেন? আমি আগুন? পিচ্চি একটা মেয়ে আর কথার কী ছিঁড়ি! এই মেয়ে এই, স্কুলে কি এসব শিক্ষা দেয় তোমাদের?’ ধমকে কথাগুলো বলল আহিল।

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে যায় সকালের। কাঁদোকাঁদো দৃষ্টিতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। আহিল বাইক স্টার্ট দেওয়ার পূর্বে শাসিয়ে বলল,

‘শোনো মেয়ে, তোমার বয়স এখনো অনেক কম। এসব পাগলামি-ছাগলামি বাদ দিয়ে স্টাডিতে ফোকাস করো।’

এরপর সে চোখের পলকেই বাইক নিয়ে সকালের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সকালের ফরসা গাল বেয়ে।
________
দুপুরে হুট করে অর্ষার রুমে প্রবেশ করে আহনাফ। অর্ষা তখন ঘুমিয়ে ছিল।

আহনাফ বিড়বিড় করে বলে,’সময় নেই, অসময় নেই, খালি ঘুম!’

এরপর জোরে জোরে ডাকতে ডাকতে বলল,’অর্ষা? এই অর্ষা?’

অর্ষার কোনো সাড়াশব্দ নেই। বেশ কয়েকবার ডেকে বিরক্ত হয়ে গেল আহনাফ। শেষমেশ আর না পেরে দুই বাহু চেপে ধরে উঠিয়ে বসাল। এবার ঘুম ভাঙে অর্ষার।

নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে,’কী হয়েছে?’

‘কিছু হয়নি। ফুপি ফোন করেছিল। যেতে বলেছে। তৈরি হয়ে নাও তুমি।’

‘এখন আমি কোথাও যাব না।’ বলে শুয়ে পড়ল অর্ষা।

আহনাফ বেজায় বিরক্ত হলো। কাঠকাঠ গলায় বলল,’তুমি কি ভালো ভালোই উঠবে? নাকি আমি ক্যাথি আর অ্যানিকে এখানে নিয়ে আসব?’

লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল অর্ষা। অস্থিরতার সাথে বলল,’না, না। একদম না। আমি উঠে গেছি। দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে যাব। সত্যি।’

আহনাফ গম্ভীর হয়ে বলল,’ঠিক দশ মিনিট ওকে? এর এক সেকেন্ডও যেন বেশি না হয়। আমি ক্যাথি আর অ্যানিকে হানির কাছে দিয়ে আসছি।’

‘ওকে, ওকে। দশ মিনিটেই হয়ে যাবে।’

আহনাফ গম্ভীর মুখে ঘর থেকে বের হয়। বাইরে যাওয়ার পরে মিটিমিটি হাসে, অর্ষার আড়ালে। স্বগতোক্তি করে বলে,’ভীতু একটা!’

এদিকে অর্ষা বিরক্ত হয়ে বলে,’মানুষের দুর্বলতা নিয়ে কীভাবে ছিনিমিনি খেলে! বদমাই’শ লোক একটা!’

দশ মিনিট তো চোখের পলকেই চলে যাবে। তাই সে দ্রুত আহনাফের রুমে গেল। কোন ড্রেস পরবে এত চিন্তা-ভাবনা করার সময় নেই। তাই ব্ল্যাক ডেনিম জিন্স আর লেমন কালার জর্জেট লং গাউন নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কোনো রকম শাওয়ার সেড়ে ঘরে ফিরে আসে। জামা-কাপড় শুকাতে দিয়ে ভেজা চুলগুলো আচড়ে নেয়। সাজুগুজু করার আগেই আহনাফ ফিরে আসে।

ঘরে প্রবেশ করে বলে,’হয়েছে?’

অর্ষা তড়িঘড়ি করে বলল,’হ্যাঁ, আমি রেডি।’

আহনাফ ভালো করে অর্ষাকে পরখ করল। অর্ষা ওর দৃষ্টি দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,’কী দেখছেন?’

‘তোমাকে। ভেজা চুল থেকে পানি পড়ছে।’

‘তা তো পড়বেই। চুল তো ভেজা।’

আহনাফ কিছু না বলে ওয়ারড্রবের লক খুলে হেয়ার ড্রায়ার বের করে বলল,’এটা দিয়ে চুল শুকিয়ে নাও।’

অর্ষা করুণস্বরে বলল,’আমি এটা দিয়ে চুল শুকাতে পারি না। কখনো ব্যবহার করিনি।’

‘ইট’স ওকে। তুমি আয়নার সামনে বসো।’

অর্ষা চুপচাপ বসল। আহনাফ ওর পিছে দাঁড়িয়ে নিজে চুল শুকিয়ে দিচ্ছে। অর্ষা যেমন অবাক হচ্ছে, তেমন আবার ভালোও লাগছে। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি বোধ হয় একেই বলে। আয়নায় সে বিবশ হয়ে আহনাফকে দেখছিল।

অর্ষার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,’আপনি অনেক সুন্দর।’

‘কী?’

‘না মানে, বলছিলাম হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে কি আপনি চুল শুকাতেন?’

‘না। আফরিনের জন্য কিনেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশে যাওয়ার সময় নেওয়ার কথা মনে ছিল না।’

‘ওহ।’

চুল শুকানো শেষ হলে আহনাফ বলল,’এত সাদামাটা ভাবে যাবে নাকি? সাজো।’

‘কিন্তু দশ মিনিট তো শেষ।’

অর্ষার বাচ্চাদের মতো কথা শুনে আহনাফের হাসি চলে আসে। কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে,’সমস্যা নেই। আরো দশ মিনিট সময় দিলাম।’

অর্ষার সাজগোজ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। ঠিকমতো মেকাপও সে করতে পারে না। সাজ বলতে সে যা বুঝে এবং পারে তা হচ্ছে, মুখে হালকা ফেসপাউডার, চোখে আইলানার, মাশকারা আর কাজল। ঠোঁটে ম্যাট লিপস্টিক। এখনো সে এইটুকুই সাজল।

সাজ শেষ হলে সে ওড়নাটি গলায় পেঁচিয়ে এনে ওড়নার দুই সাইড বুকের ওপর রাখল। কিছু চুল সামনে এসে পড়েছিল। সেগুলো হাত দিয়ে ঠেলে পেছনে দিয়ে বলল,

‘আমি রেডি, চলুন।’

আহনাফ একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল,’সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

অর্ষা লজ্জা পেলেও মুচকি হেসে বলল,’থ্যাঙ্কিউ।’

আহনাফ আলমারি থেকে লেডিস ব্ল্যাক লেদারের জ্যাকেট অর্ষার হাতে তুলে দিয়ে বলল,’রাতে ঠান্ডা লাগবে। এটা সাথে নাও।’

‘আচ্ছা।’

দুজনে একসাথে বেরিয়ে পড়ে। সুইজারল্যান্ড আসার পর আজ প্রথম অর্ষা দূরে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। পাশের সিটে তার প্রিয় মানুষ, পছন্দের মানুষ। এমনকি মানুষটা তার স্বামীও। এরচেয়ে আনন্দের, খুশির অনুভূতি আর কী-ই বা হতে পারে।

অর্ষা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানতে চায়,’ফুপির বাসা কোথায়?’

‘জেনেভা শহরে।’

জুরিখ শহর পার হওয়ার সময় বিশাল একটা নদী পড়ে। যেটা জুরিখ শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আহনাফ অর্ষাকে নদীটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,

‘এই নদীর নাম লিম্মাত।’

‘অনেক সুন্দর।’

যাওয়ার পথে দূর থেকে একটা লেখা দেখতে পেল অর্ষা। সম্ভবত ল্যাটিন ভাষায় লেখা,‘‘Unus pro omnibus, omnes, pro uno.’’

আহনাফ অর্ষার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকিয়ে বলল,’ল্যাটিন ভাষা বোঝো?’

অর্ষা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’উঁহু। ঐখানে যে কী লেখা ছিল পড়লাম ঠিক, কিন্তু বুঝলাম না।’

আহনাফ হেসে বলল,’ল্যাটিন ভাষায় লেখা তাই বোঝোনি। কথাটির বাংলা অর্থা হলো, ‘একের জন্য সব, সবের জন্য এক।’ এটা সুইজারল্যান্ডের নীতিবাক্য।’

‘আপনি তো দেখি অনেক কিছু জানেন।’

‘অদ্ভুত! আমি এই দেশের বাসিন্দা, তো জানব না?’

‘হু।’
.
ফুপির বাসায় পৌঁছে দেখল হুলস্থুল কাণ্ড। ফুপি ভীষণ ব্যস্ত। অর্ষা আর আহনাফকে দেখে ব্যস্ততা রেখে এগিয়ে আসেন। অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,

‘ভালো আছো মা?’

অর্ষা সালাম দিয়ে বলল,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো ফুপি। আপনি কেমন আছেন?’

‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো আছি। সেই কবে এসেছ সুইজারল্যান্ড। আর আজ আসলে ফুপির বাসায়?’

অর্ষা অপ্রস্তুতভাবে হাসল। ফুপি আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললেন,’দোষ তো তোর। অর্ষার না। তুই নিয়ে আসিসনি কেন?’

‘ওমনি সব দোষ আমার হয়ে গেল না?’ বলল আহনাফ।

‘অবশ্যই তোর।’

তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে ফুপির ছেলে নিহিত আর মেয়ে নেহা। নিহিত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর নেহা পড়ে ক্লাস টেনে। দু’ভাই-বোন-ই যথেষ্ট স্মার্ট আর সুন্দর।

নিহিত এগিয়ে এসে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে বলে,’কী অবস্থা ব্রো? অনেকদিন বাদে আসলে।’

আহনাফও জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বলল,’তুইও তো যাস না।’

নেহা আগে গেল অর্ষার কাছে। আপ্লুত হয়ে বলল,’তুমিই তো আমাদের ভাবি?’

অর্ষা মৃদু হেসে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। নেহা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’তোমায় তো আমি চিনি। কিন্তু তুমি আমায় চেনো না। পরীক্ষা থাকায় আমি আর ভাইয়া তোমাদের বিয়েতে যেতে পারিনি। বাই দ্য ওয়ে, আমি নেহা।’

অর্ষা হাত মিলিয়ে হেসে বলল,’মুখ চিনি না। কিন্তু তোমাদের কথা আন্টির কাছে শুনেছিলাম।’

‘কোন আন্টি?’ প্রশ্ন করে নেহা।

অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’ইয়ে মানে, মায়ের কথা বলছিলাম। উনার মা আরকি!’ আহনাফকে দেখিয়ে বলল।

নেহা অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’নার্ভাস হচ্ছ কেন? ননোদের সামনে এত নার্ভাস হতে নেই।’

নিহিতও কথার মাঝে ঢুকে বলল,’আমার কথা বলেনি?’

অর্ষা হেসে বলল,’বলেছে।’

ফুপি তখন বলল,’বাকি কথা খাওয়ার টেবিলে হবে। নেহা ওদের রুমটা দেখিয়ে দে। ফ্রেশ হয়ে আসুক।’

নেহা অর্ষার হাত ধরে বলল,’আমার সাথে আসো সুইটহার্ট।’
ওদের পেছন পেছন আহনাফ আর নিহিতও গেল।

রুমে গিয়ে অর্ষার নার্ভাসনেস কিছুটা কমে। আহনাফ জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’

‘কিছু হয়নি। ফুপির পরিবারের সকলে বেশ মিশুক।’

আহনাফ বিছানায় শুয়ে বলল,’অনেক! আমাদের বংশের সবাই অনেক ভালো। কারও মধ্যেই কোনো অহংকার খুঁজে পাবে না।’

‘সত্যি বলছি, আপনাদেরকে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। দুনিয়ায় এখন এমন পরিবার পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। সবাই তো এখন টাকা-পয়সাকেই সবকিছু মনে করে।’

‘এরমাঝে ভিন্ন মন-মানসিকতার মানুষও রয়েছে।’

‘হুম। যেমন আপনারা। আচ্ছা ফুপা কোথায়? তাকে তো দেখলাম না।’

‘ফুপা অফিসে। তার সাথে রাতে দেখা হবে।’

‘আমরা বাড়ি ফিরব কবে?’

‘কাল সকালে।’

দুজনে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। ফুপি তখন খাবারের আয়োজন করা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। টেবিলে হরেক রকমের খাবার। এত খাবার কে খাবে কে জানে! ফুপি জোর করে অর্ষাকে অনেককিছু খাইয়েছে। পেট নিয়ে চলাই এখন মুশকিল হয়ে পড়েছে তার।

কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর নেহা আবদার করে বসে,’ঘুরতে যাবে।’

অর্ষা ক্লান্তস্বরে বলল,’আমি কোথাও যেতে পারব না সোনা। তোমার ভাইয়াকে নিয়ে যাও।’

নেহা সোফায় অর্ষার পাশে বসল। হাত ধরে বলল,’এমন বোলো না সুইটহার্ট! আমি তো তোমাকে নিয়ে ঘুরতে চাই। আবার কবে দেখা হবে তা তো জানিনা। প্লিজ চলো যাই! ওখানে গেলে তোমার অনেক ভালো লাগবে। লেকের মাঝে জাহাজ। ঠান্ডা বাতাসে রাতের লেক দেখবে। মন পুরো ফুরফুরা হয়ে যাবে।’

‘কোথায় যেতে যাচ্ছিস?’ প্রশ্ন করল নিহিত।

‘লেক জেনেভায় যাব ভাইয়া। আমার স্কুলের ফ্রেন্ডরা মিলে জাহাজে পার্টির ব্যবস্থা করেছে।’

‘ওয়াও! তাহলে আমার ফ্রেন্ডসদেরও ইনভাইট করি?’

‘শিওর।’

দুই ভাই-বোন নিজেদের মতো প্ল্যানিং করে ফেলেছে। অর্ষা আর না করতে পারল না। এখান থেকে চারজনে মিলে সোজা চলে গেল লেক জেনেভায়। সত্যি বলতে যতটা অনিচ্ছা নিয়ে অর্ষা বাড়ি থেকে বের হয়েছিল, তারচেয়েও অধিক বেশি মনটা ভালো হয়ে গেছে। লেকের পাশে নানান রকমের ফুল। যাদের নামও অর্ষা হয়তো ঠিকমতো জানে না। চাঁদের আলোতে লেকের পানি ঝিকমিক করছে। থৈথৈ করছে লেকের নীলাভ পানি।

সবাই মিলে জাহাজে ওঠে। জাহাজ শুনে অর্ষা ভেবেছিল বিশাল বড়ো জাহাজ বোধ হয় হবে। এসে দেখল তেমন না। মাঝারি সাইজ বলা যায় বড় জোড়। নেহা ওর সব বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে অর্ষা আর আহনাফের পরিচয় করিয়ে দিলো। নিহিতের বন্ধু-বান্ধব সবাই এসে পৌঁছালে জাহাজ ছাড়া হয়।

অর্ষা দাঁড়িয়ে আছে বাইরের দিকে খোলা আকাশের নিচে। জাহাজ ছুটে চলেছে, সেই সাথে শাঁইশাঁই করে ধেঁয়ে আসা বাতাসে অর্ষার ওড়না উড়ছে। আহনাফ মৃদুমন্দ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’খারাপ লাগছে?’

অর্ষা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,’উঁহু! অনেক অনেক অনেক বেশি ভালো লাগছে। এতগুলা ভালো লাগছে।’

শেষ কথাটা দু’হাত প্রসারিত করে বলল। বোঝাতে চাইল ভালো লাগার পরিমাণ আহনাফ ফিক করে হাসে।

ভেতরে সবাই হৈ-হুল্লোড় করছে। কয়েকজন ইংলিশ গানের তালে তালে নাচছে। নেহা বাইরে এসে দুজনকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। দু’গ্লাস জুস ধরিয়ে দেয় হাতে।

অর্ষা আতঙ্গিত হয়ে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ ওর চোখের দৃষ্টি বুঝতে পেরে নেহাকে জিজ্ঞেস করল,’এল’কোহল মেশানো নাকি? ও কিন্তু এসব খায় না।’

জুসের সাথে সবগুলো বোতলে হুইস্কি মেশানো। অর্ষা খাবে না শুনে নেহা মিথ্যে বলল,’আরে না! এগুলো শুধু জুস। এই দেখো আমরাও খাচ্ছি।’

অভয় পেয়ে অর্ষা গ্লাসে চুমুক দেয়। টেস্ট ভালো বিধায় আরো তিন গ্লাস জুস খেয়ে ফেলে। নেহা অর্ষার হাত ধরে নাচতে নাচতে বলে,’টেস্ট কেমন ভাবি?’

‘দারুণ! কী জুস এটা? নাম কী?’

নেহা মশকরা করে বলল,’লাভ জুস।’

এরপর আহনাফকে টেনে এনে বলল,’এরকম দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? বউয়ের সাথে ডান্স করো।’

অগত্যা আহনাফ অর্ষার হাত ধরল। ততক্ষণে নেশা নেশা ভাব এসে গেছে অর্ষার মাঝে। বাতাসে অর্ষার চুলগুলো ওড়ার সময় অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল দেখতে। নজর সরানো দায়। আহনাফ তৎক্ষণাৎ অর্ষাকে ছেড়ে দেয়। অর্ষাও এগিয়ে আসে। চোখ-মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করে,্

‘এভাবে চলে এলেন কেন?’

‘খেতে।’ জুসের গ্লাস দেখিয়ে বলল আহনাফ

‘ওহ আচ্ছা তাই? ওকে দেখি কে কত জুস খেতে পারে।’ বলে গ্লাসটা নিয়ে নিল অর্ষা। গ্লাসের বদলে বোতল নিল।

আহনাফ বাধা দিয়ে বলল,’তোমার খাওয়া লাগবে না।’

‘কেন না? একশো বার খাব। হাজার বার খাব। আপনি খাবেন না।’!

‘আজিব! আমি কেন খাব না? আমিও একশো বার খাব, হাজার বার খাব।’ এই বলে সেও ঢকঢক করে বোতল থেকে জুস পান করতে থাকে।

এবার আহনাফেরও নেশা হয়ে গেছে প্রায়। অর্ষা বোতল নিয়ে আবার বাইরে গেছে। বসে পড়েছে সে। ওকে ফলো করে আহনাফও আসে। যদি বেখেয়ালে আবার পানিতে পড়ে যায় তখন! অর্ষা একবার বোতলে চুমুক দিচ্ছিল আরেকবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বোতলে চুমুক দেয়। আহনাফ গিয়ে ওর পাশে বসে। বোতলটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে,

‘অনেক খেয়েছ। আর খাওয়া লাগবে না।’

অর্ষার তখন চোখে-মুখে পুরো নেশা। মাথা ভনভন করছিল। ঝিম মেরে কিছুক্ষণ আহনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে বুকের ওপর ঢলে পড়ে। বুকে মৃদু আঘাত করতে করতে বলে,’আপনি অনেক খারাপ। অনেক!’

নেহা ফের এসেছিল ওদের ডাকতে। দুজনকে একসাথে দেখে মুচকি হেসে আবার চলে যায়। আহনাফ অর্ষার দু’বাহু ধরে সোজা করে বসিয়ে বলল,’আমি খারাপ?’

‘হু! ভীষণ।’

‘আমি সত্যিই খারাপ?’

‘১০০% খারাপ। একটুও ভালো নেই।’

অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে আহনাফের যেন আরো নেশা হয়ে গেল। সে অর্ষাকে আরো কাছে টেনে আনলো। এক হাত চলে গেল অর্ষার জ্যাকেট ভেদ করে কোমরে, আর অন্য হাত অর্ষার চুলের মাঝে। কোনো কিছু চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশ পেল না কেউ-ই। অর্ষার পেলব ওষ্ঠে ডুবিয়ে দিলো নিজের ওষ্ঠদ্বয়।

কিছুক্ষণ পর ঠোঁট ছেড়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,’গার্ল লাইক ইউ ইজ হার্ডলি সীন। ইউ আর মাই কুইন।’
এরপর সে গাঢ় চুম্বন দিলো অর্ষার দু’গালে।

অর্ষা ফের ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,’আই সেইড, ইউ আর ব্যাড, ব্যাড, ব্যাড। ভেরি ব্যাড!’

‘ইয়াহ্! আই এম! এন্ড অনলি ফর ইউ।’ বলে সে আবারও অর্ষার ঠোঁটে গভীর চুমু দিলো।

চলবে…

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
শীতল সমীরণ মন না করে শীতল। মন যে খারাপ হয় কারণে অকারণ। প্রথম ভালোলাগা হোক কিংবা অল্প বয়সের ভালোলাগা; খুব সন্তর্পণে তা মনের ভেতর গেঁথে থাকে। অল্প একটু ভালো মুহূর্ত মনে যে রকম আনন্দের সৃষ্টি করে তেমন-ই, অল্প একটু খারাপ মুহূর্তও পুরো মনটাকে বিষিয়ে তোলে। সকালের পরিস্থিতি ঠিক সে রকম।

বই-খাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিছানায় বসে রয়েছে সে। কিছুক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে পড়ার চেষ্টা করছে তো; কিছুক্ষণ বিছানায়। কোথাও তার পড়া হচ্ছে না। অথচ একগাদা পড়া পেন্ডিং রয়েছে। ক্লাসের পড়া, কোচিং এর পড়া, প্রাইভেটের পড়া সব! আর এদিকে উচাটন মন নিয়ে সে অস্থিরতায় ভুগছে। সমস্যা তো পড়ার স্থান নয় বরঞ্চ তার মন। সে কিছুতেই আহিলের করা অপমানগুলো ভুলতে পারছে না।

সকালের মা সেলিনা বেগম মেয়ের রুমে এসে পুরোদস্তুর অবাক হয়ে যান। সকাল হাত-পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে ছিল। তিনি হরলক্সিের গ্লাস টেবিলের ওপর রেখে বললেন,

‘একি অবস্থা তোর?’

সকাল করুণস্বরে বলে,’কী?’

‘বইখাতা সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিস কেন?’

‘দেখছ না পড়তেছি?’

‘এই তোর পড়ার নমুনা? এভাবে কেউ পড়ে?’

‘ভালো লাগছে না মা।’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘কিছু হয়নি।’

‘কিছু না হলে ভালো লাগবে না কেন? শরীর খারাপ?’

‘না।’

তিনি কয়েক সেকেন্ড মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,’তোর যে কখন কী হয় বুঝি না আমি! হরলিক্স খেয়ে চুপচাপ সুন্দরমতো পড়তে বোস।’

আহিলের কথা মনে পড়ে যায় সকালের। সকালে তো আহিল তাকে ছোটো বলেই অমন বড়ো বড়ো কথা বলে গেছিল। হরলিক্সের কথা শুনে বেপরোয়া মনটা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠল।

সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সেলিনা বেগমকে পিছু ডাকল,’মা।’

তিনি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’কী?’

‘এখন থেকে আমি আর হরলিক্স খাব না। নিয়ে যাও।’

‘কেন? হরলিক্স আবার তোকে কী করল?’

‘কিছু করেনি। আমি কি ছোটো আছি নাকি যে এখনো হরলিক্স খাব?’

সেলিনা বেগম চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছেন। ধমক দিয়ে বলেন,’খুব বড়ো হয়ে গেছিস তাই না? এক থা’প্পড় দেবো সব কয়টা দাঁত পড়ে যাবে। চুপচাপ খেয়ে নে।’

মা চলে যাওয়ার পর রাগে ফেটে পড়ে সকাল। সবাই কেন তাকে শুধু ছোটো-ই বলে! সে কি খুব বেশি ছোটো? হরলিক্স খেল না সে। ওয়াশরুমে ফেলে দিয়ে গ্লাস খালি করে আবার টেবিলের ওপর রেখে দিলো।

সেই সময়ে নিতুর কল আসে। মনে মনে খুশিই হয় সকাল। যাক, ওর সাথে কথা বললে মনটা তো হালকা হবে।

ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিতু বলল,’দোস্ত ম্যাথ হোমওয়ার্ক করছিস? হোয়াটসএপে ছবি পাঠিয়ে দে না।’

মুহূর্তেই আবার রাগ উঠে গেল মাথায়। সকাল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এজন্য ফোন করেছিস? রাখ, ফোন রাখ বলছি।’

‘আরে রাগ করছিস কেন? কী হয়েছে?’

‘ঘোড়ার ডিম হয়েছে।’

‘বলবি তো! না বললে বুঝব কী করে।’

‘কী হবে আবার? সকাল থেকে তো কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। ঐ ছেলের কথাগুলো কানে বাজতেছে শুধু।’

নিতু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’ও এই ব্যাপার? আরে বাদ দে না! কত মানুষ তো কত কথা-ই বলে। সব কি মনে রাখতে হয় নাকি?’

‘বাদ দেবো মানে? পারছি না আমি। একই তো অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখেছি, তার ওপর আবার উলটো আমাকেই অপমান করে গেল।’

‘তুই যেভাবে বলছিস, মনে হচ্ছে সে তোর বয়ফ্রেন্ড? এত হাইপার কেন হচ্ছিস তুই?’

একটুখানি থেমে ফের বলল,’বাই এনি চান্স, তুই তার প্রেমে পড়ে যাসনি তো?’

সকাল চুপ করে থাকে। নিতু বলে,’কীরে? চুপ কেন?’

‘জানিনা।’

‘মনে তো হচ্ছে তুই হাবুডুবু খাচ্ছিস।’

‘খেলেই বা কী?’

‘ট্রিট দিবি।’

‘রাখ তোর ট্রিট! সে তো আমাকে দেখতেই পারে না। কেমন দূর দূর করে দেখিসনি?’

‘হু, তাতে কী? সে রিজেক্ট করতেই পারে। তাই বলে কি তুই হাল ছেড়ে দিবি?’

‘তাহলে কী করব?’

‘আঠার মতো লেগে থাকবি। কয়দিন ইগনোর করবে সে? দেখবি একদিন ঠিক পটে যাবে।’

‘সত্যি বলছিস?’

‘অবশ্যই। তুই কি তার চেয়ে কম সুন্দর নাকি? হাল ছাড়িস না।’

সকাল খুশি হয়ে যায়। নিতু বলে,’মন ভালো হয়েছে? এবার তো হোমওয়ার্কের ছবি দে!’

‘আমি তো পড়তেই পারিনি। হোমওয়ার্কও করিনি। বাট ডোন্ট ওয়্যারি, আমি এখনই হোমওয়ার্ক করে তোকে ছবি পাঠাচ্ছি।’
_______
‘বন্ধু তিনদিন তোর বাড়ি গেলাম
দেখা পাইলাম না,
বন্ধু তিনদিন।’

আশিক তার রুক্ষকণ্ঠে গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। আহিল, দিদার, লামিয়া, জুঁই আর রেশমি গালে হাত দিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সকলের চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ।

আর সইতে না পেরে রেশমি জোরে একটা ধমক দিয়ে বলল,’এই থামা তোর গান! আমার এলাকার কুত্তাগুলা নইলে এখনই বাসায় আইসা পড়বে।’

আশিক গান থামিয়ে মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি আহত। লামিয়া করুণস্বরে বলল,’আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকায় কয়টা কুত্তা আছে। অলরেডি ওরা ঘেউঘেউ করা শুরু করছে।’

‘সেম রে! হেডফোন নিই নাই তো, তাই ওরা মনে হয় গান শুনে এমন করতেছে।’ বলল জুঁই।

আশিক খুব কষ্ট নিয়ে আহিল এবং দিদারের উদ্দেশ্যে বলল,’ওরা আমাকে অপমান করতেছে। তোরা কিছু বলবি না?’

দিদার বলল,’তোর কি মান আছে যে অপমান করবে?’

আহিল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আমি তো এটাই বুঝতেছি না, আজ এমন কোন পাপ করেছি যে তোর গান শুনতে হচ্ছে!’

আশিক কান্না করার ঢং করে বলল,’তোরা সবাই আমাকে অপমান করলি তো? কর! বোকারানী যদি কলে থাকত তাহলে ও ঠিক-ই আমার পক্ষ নিতো।’

জুঁই বলল,’ভালো কথা! কীরে লামিয়া তুই যে বললি, অর্ষা কলে আসতে বলছে। কোথায় ও?’

লামিয়া ঠোঁট উলটে বলল,’কী জানি! লাইনেও তো নাই।’

‘দেখ মনে হয় ভুলে গেছে।’ বলল দিদার।

রেশমি হতাশ হয়ে বলল,’এটা কোনো কথা!’

‘হয়তো ব্যস্ত আছে। আমরা কথা বলতে থাকি। দেখি আসে কিনা।’ বলল আহিল।

লামিয়া পা গুটিয়ে আরাম করে বসে বলল,’তাহলে একটা গল্প শোনা।’

‘এখন গল্প শুনাব? তোর হাজবেন্ড কোথায়?’

‘অফিসে। আসতে রাত হবে। তুই গল্প বল।’

আশিক মনমরা হয়ে বলল,’আমার গান তো ভালো লাগল না তোদের। নে আহিল তুই একটা গল্প-ই শোনা। আমরাও শুনি।’

আহিল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আর গল্প! নিজেই তো কোনো গল্পে আটকে গেছি মনে হচ্ছে।’

‘কেন? কী হয়েছে?’ প্রশ্ন করল রেশমি।

‘আরে আজ যে তুই আর আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম না সকালে? তখন একটা মেয়ে এসেছিল।’

সকলে অবাক হয়ে সমস্বরে বলল,’মেয়ে!’

রেশমি বলল,’মেয়ে কোত্থেকে এলো? কোন মেয়ে? আমি তো দেখলাম না।’

‘আগে কথা শেষ করতে দে আমায়।’

‘আচ্ছা বল।’

এরপর সে সকালের সাথে ঘটে যাওয়া সকল কথা বন্ধুদের বলল। সবার তো হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ।

দিদার হাসতে হাসতেই বলল,’তুই আগুন? একটা পিচ্চি মেয়ে তোকে আগুন বলে গেল? হায় আল্লাহ্!’

আহিল মুখ গম্ভীর করে বলল,’হাসছিস কেন তোরা? হাসবি না।’

রেশমি বলল,’শুধুশুধু আমিও জড়িয়ে গেলাম। ঐ মেয়ে নিশ্চয়ই ভেবেছে আমি তোর গার্লফ্রেন্ড?’

‘কী জানি! কথার ধরণে তো মনে হচ্ছিল জেলাস। ভাই রে ভাই, এইটুকুন মেয়ের কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবি তোরা।’

‘তাইলে তো মেয়েটারে একবার দেখা দরকার।’ বলল আশিক।

‘কোনো দরকার নাই! এছাড়া মেয়েটা মনে হয় আর সামনে আসবে না। যেই ধমক দিয়েছি, এবার থেকে দেখলে দশ হাত দূরে দূরে থাকবে।’
_________
লেকের থৈ থৈ করা পানির স্রোতের সাথে ভেসে চলছে মাঝারি সাইজের সাদা জাহাজটি। লেকের নীলাভ স্বচ্ছ পানিতে আকাশের বুকে থাকা অর্ধখণ্ড চাঁদটির প্রতিচ্ছবি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। চাঁদের সঙ্গে রয়েছে ঝলমল করা দূরাকাশের তারা। যাদের দেখতে যতটা সুন্দর লাগে, গগনা করা এরচেয়েও কঠিন। শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব বটে।

এই মুহূর্তে চাঁদের সঙ্গে অর্ষাকে তুলনা করা যায়। নিঃসন্দেহে আহনাফের বুককে বলা যায় বিশাল আকাশ। চাঁদ যেমন আকাশের বুকে থেকে পৃথিবীতে কিরণ ছড়াচ্ছে, ঠিক তেমন-ই আহনাফের বুকে থেকে অর্ষা মুহূর্তটাকে আরো বেশি সুন্দর করে তুলেছে। এক হাতে আহনাফ তাকে আগলে রেখেছে বুকের মাঝে। খুব যত্নসহকারে। হোক না বিষয়টা অ-জ্ঞানে, তাতেই বা কী আসে যায়! এই মুহূর্তটা অনন্ত হোক। এর শেষ যেন কোথাও না হয়।

অনেকক্ষণ বাদে নেহা আবার আসে বাইরের দিকটায়। বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। তাড়াতাড়ি সকলকে বাড়িতে ফিরতে বলা হয়েছে। নেহা বাইরে এসে অবাক হয়। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে দুষ্টু হাসি।

দু’হাত গালে রেখে নিজে নিজেই হেসে বলে,’আরে বাহ্! আমার ভাই-ভাবি দেখি খুব রোমান্টিক। দুজনে কী সুন্দর খোলা আকাশের নিচে শুয়ে রয়েছে!’

নেহা এগিয়ে এসে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। অর্ষার হাতে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলে,’ভাবি? এই ভাবি?’

অর্ষার কোনো হুশ-ই নেই। সে তো নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। অন্যদিকে আহনাফেরও একই অবস্থা। কারও-ই কোনো সাড়াশব্দ নেই। নেশাটা দুজনের বড্ড বেশি-ই হয়ে গেছে। বাড়িতে গিয়ে তো মায়ের হাতে উত্তম-মধ্যম তাকেই খেতে হবে মনে হচ্ছে। এত সুন্দর করে দুজনে ঘুমিয়ে আছে যে, নেহার ডাকতেও মায়া লাগছে। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। তাড়াতাড়ি না ফিরলে পানিশমেন্টও তার-ই হবে। তবে এত সুন্দর দৃশ্য তো ক্যামেরাবন্দী করাই যায়।

নেহা উঠে দাঁড়াল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনের ক্যামেরায় দুজনের যুগলবন্দী ছবি ফোনে ক্যাপচার করে নিল। ছবিটা দেখলে মনে হবে রাজকুমারের বুকে রাজকুমারী ঘুমিয়ে রয়েছে। সেই সাথে ছবিতে রয়েছে আকাশের সাথে নীলাভ লেকের পানি। আহা! ছবিটা পুরো বাঁধিয়ে রাখার মতো।

ফোন পকেটে রেখে সে নিহিতকে ডাকতে গেল। তার একার পক্ষে দুজনকে ডেকে তোলা সম্ভব নয়। জাহাজ ঘাটে ফেরার পর নেহা, নিহিত এবং আরো কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে আহনাফ এবং অর্ষাকে গাড়িতে উঠিয়ে বসাল।

ড্রাইভিং সিটে বসেছে নিহিত আর পাশের সিটে নেহা। নেহা পেছনের সিটে আহনাফ এবং অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ভাইয়া! দুজনের তো ভালোই নেশা হয়ে গেছে। মা বকবে না?’

‘বকবেই তো। তুই কেন ওদের ঐ জুস খাওয়াতে গেলি?’

‘আরে আমি কি জানতাম নাকি ওরা এত পরিমাণ খাবে!’

‘এবার বোঝ মজা।’

‘প্লিজ ভাইয়া, মাকে একটু ম্যানেজ করে নিও প্লিজ!’

নিহিত গম্ভীর হওয়ার অভিনয় করছিল। এবার হেসে বলল,’তুই চিন্তা করিস না তো।’

বাড়ি ফিরে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিলেন ফুপি নিজেই। নেহা ও নিহিত মিলে অর্ষা এবং আহনাফকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে ওরা দুজন নেশা করে আবোল-তাবোল বলছে বিড়বিড় করে।

ফুপি চমকে প্রশ্ন করেন,’এই অবস্থা কেন?’

নেহা ভয়ে ঢোক গিলে বলে,’আগে ভাইয়া আর ভাবিকে ঘরে নিতে হবে মামনী। এভাবে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না।’

ফুপি একবার ভেতরের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বললেন,’তোদের বাবা এখন ঘরে। তাড়াতাড়ি ওদেরকে ওদের ঘরে নিয়ে যা।’

নেহা এবং নিহিত তাই করল। ফুপিও পিছু পিছু গেলেন সেই রুমে। ছেলে-মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,’ওরা যে এত ড্রিঙ্কস করেছে, তোরা কোথায় ছিলি তখন?’

নিহিত বুদ্ধি করে বলল,’ওদেরকে আলাদা স্পেস দিয়েছিলাম মামনী। কিন্তু বুঝতে পারিনি ওরা সময় না কাটিয়ে এত ড্রিঙ্কস করবে।’

‘না, তা কেন বুঝবে? এত পাকনামি কেন করতে গেছ? এখন তোমাদের বাবাকে কী বলব আমি? তিনি তো অর্ষা আর আহনাফের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।’

নেহা ফট করে বলল,’উমম! বলে দাও যে, ভাবি খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। তাই সকালে দেখা করবে।’

‘আহারে! বুদ্ধির কী বাহার! দেখি কীভাবে পরিস্থিতি সামলানো যায় এখন। তোদের দুটোর বিচার আমি সকালে করব। এখন বের হ ঘর থেকে।’

দু’জন বের হওয়ার পর ফুপিও ঘরের লাইট অফ করে দরজা চাপিয়ে চলে গেলেন।
.
.
চোখে-মুখে কিছু সুড়সুড় করছে বলে মনে হচ্ছে আহনাফের। সে বারবার মুখে হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে। শেষমেশ ঘুম-ই ভেঙে যায় তার। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে জিনিসটা কী! কিন্তু চোখ মেলে রাখাটাই তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে পড়ছে। সে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলে। বুকের মাঝে থাকা অর্ষাকে কোলবালিশ ভেবে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নেশা কাটেনি তার পুরোপুরি। নেশার ঘোরে অর্ষার গালে চুমু খায়। ঘুমের মধ্যেই বিরক্ত হয়ে ‘চ’ সূচক শব্দ করে অর্ষা। যেই গালে চুমু দিয়েছে সেই গালে হাত রেখে চুমু মোছার চেষ্টা করে। ফের আবার চুমু খায় আহনাফ। অর্ষা এবার বিরক্ত হয়েই মৃদু আঘাত করে আহনাফের বাহুতে।

এবার যেন আহনাফের হুঁশ ফিরল। সে ফট করে চোখ মেলে তাকায়। এতক্ষণ মুখে যা সুড়সুড় করছিল তা ছিল অর্ষার চুল। আর যাকে কোলবালিশ ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সে কোলবালিশ নয় বরং অর্ষা!

অর্ষা ঘুম জড়ানো কণ্ঠেই বিড়বিড় করে বলছে,’আমি বলেছিলাম আপনি খারাপ। আপনি সত্যিই অনেক খারাপ। বারবার কেন চুমু খাচ্ছেন? কেন, কেন?’

আহনাফ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে কিয়ৎক্ষণ। এরপর অর্ষাকে সরিয়ে লাফিয়ে উঠে বসে। বুকে ফুঁ দিয়ে বলে,’লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ!’

সে উঠে যাওয়ার আগে অর্ষা তার হাত টেনে ধরে। আহনাফ উঠতে গিয়েও থেমে যায় অর্ষার মুখের দিকে তাকিয়ে। নেশার রেশ হয়ে গেছে তার। সে মুখটা ধীরে ধীরে এগিয়ে নেয় অজান্তেই। অর্ষা চোখ দুটো পিটপিট করে তাকায়। আহনাফের মুখের ওপর হাত রেখে মিষ্টি করে হেসে বলে,’নো!’

প্রত্যাখানে আবারও হুঁশ ফিরে আসে আহনাফের। একছুটে চলে যায় ওয়াশরুমে। চোখে-মুখে পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকায় আহনাফ। মুখের ওপর হাত রেখে বলে,

‘হায় আল্লাহ্! কী যে হয়ে গেল। অর্ষা দেখেছে আমি চুমু খেতে যাচ্ছিলাম? দেখেছেই তো! না দেখলে বারণ করল কীভাবে? কী হলো হঠাৎ আমার! আমি ও’কে মুখ দেখাব কীভাবে? ওর সামনে যাব কীভাবে? ছি আহনাফ! ছি! কী করে তুই এটা করতে গেলি?’

সে লজ্জায় অস্বস্তিতে গাট হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। রুমে গিয়ে অর্ষার মুখোমুখি যে কীভাবে হবে সেই ভাবনাতেই এখন সে বিবশ হয়ে গেছে।

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]