#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
অবুঝ মনে গম্ভীর প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসে রয়েছে অর্ষা। আহনাফের রাগ করার মতো সে এমন কী-ই বা করেছিল? এতগুলো দিন ঠিকমতো কথা বলল না, আজ যা একটু বলল তাও ধমকের ওপর রাখল। মিথ্যা অপবাদ দিলো। আবার যাওয়ার আগে বলে গেল, রাগও নাকি ভাঙাতে জানে না। আরে বাবা! রাগ ভাঙানোর মতো সুযোগটা তো আগে দেওয়া লাগবে!
লিলিয়া অর্ষার রুমে একবার উঁকি দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ঘরের দরজা চাপিয়ে ফোন করল আমেনা বেগমকে। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে আমেনা বেগম কল রিসিভ করলেন। যেন এতক্ষণ সে এই সময়ের প্রতিক্ষাতেই ছিলেন।
তিনি উৎসাহিত কণ্ঠে লিলিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,’কাজ হয়েছে?’
লিলিয়া দ্বিধান্বিত হয়ে বলল,’আপনি যা বলেছিলেন তাই করেছি। স্মিথকে দিয়ে ওর শার্টের বোতাম ছিঁড়িয়েছি। তবে কাজ মনে হয় হয়নি। আহনাফকে দেখলাম রেগে গেল। বাংলায় কথা বলেছে বলে কিছু বুঝিনি।’
আমেনা বেগমের উৎসাহে ভাঁটা পড়ল। তিনি যেমনটা ভেবেছিলেন, তেমনটা মনে হয় হয়নি। লিলিয়া আহনাফের পুরনো মেইড বলে আমেনা বেগমের সাথেও তার খুব ভালো একটা সম্পর্ক রয়েছে। প্রায়ই তিনি আগে ফোন করে আহনাফের ভালোমন্দ খোঁজ-খবর নিতেন। এখনো সে প্রায় ফোন করে আহনাফ এবং অর্ষার খোঁজ-খবর নেন। দুজনের মান-অভিমানের কথাও তিনি লিলিয়ার কাছেই শুনেছিলেন। তাই তো দূরত্ব ঘুচিয়ে দুজনকে কাছাকাছি আনার জন্য দূর্দান্ত একটা প্ল্যান এঁটেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে কোন ছাই হলো? আহনাফ নাকি সেই রাগারাগিই করেছে! হায় মাবুদ!
তিনি প্রলম্বিত একটা শ্বাস নিয়ে লিলিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,’অর্ষার সাথে খুব বেশি রাগ করেছে নাকি?’
লিলিয়া জানাল,’না। খুব বেশি নয়।’
‘এই দুটোকে এক করি কী করে বলো তো? দুজনই তো দেখছি দুই মেরুর। একজন আগালে, আরেকজন পেছায়।’
লিলিয়া অসহায়ের মতো বলল,’আমিও বুঝতে পারছি না।’
‘আচ্ছা তুমি আমায় খোঁজ-খবর সব জানিও। আমি দেখি, আর কোনো প্ল্যান পাই কিনা।’
‘ঠিক আছে।’
‘অর্ষা কোথায় এখন?’
‘ঘরেই। মন খারাপ বোধ হয়। একা একা বসে আছে।’
‘আচ্ছা আমি ও’কে ফোন দিয়ে কথা বলছি।’
‘আচ্ছা ম্যাম।’
আমেনা বেগম কল কেটে অর্ষাকে কল করলেন।
.
বারান্দায় সাদা টাইলসের ওপর পা মুড়িয়ে বসে আছে অর্ষা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই টাইলসগুলোকে দেখছে। তার হাতের নখ দ্বারা পিচ্ছিল প্রায় টাইলসগুলোর ওপর অযথা আঁকিবুঁকি করছিল। যদিও তার ধ্যান কিংবা জ্ঞান কোনোটিই আঁকিবুঁকি ভেতর ছিল না। তার সম্পূর্ণ চিন্তার ভাণ্ডার-ই ছিল আহনাফকে ঘিরে। তার কথাগুলো যেন বারংবার কর্ণকুহরে আ’ঘা’ত হানছিল। কিছু একটা বোঝাতে চাচ্ছিল। কিন্তু মনও যে এবার বড্ড জেদী হয়ে গেছে। কিছুতেই কিছু বুঝতে চাইছে না। তারও রাগ হয়। অভিমান হয়। কই মানুষটা তো তখন তার রাগ-অভিমানগুলো বোঝে না। তখন তো সে মানুষটাকে বলে না,’আপনি রাগ ভাঙাতে পারেন না।’
রুমের ভেতর থাকা ফোনটি বেজে ওঠে। চিন্তার ঘোর কাটে অর্ষার। কপালে চিকন ভাঁজ পড়ে। এই সময়ে কে ফোন করতে পারে? আহনাফ! মনটা হঠাৎ-ই তার প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। তড়িঘড়ি করে উঠে দৌঁড়ে যায় রুমের ভেতর। ব্যস্ত হাতে বিছানার ওপর থেকে তুলে নেয় ফোনটি। হাসির ঝিলিক কমে আসে। মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ফোন আসেনি। হোয়াটসএপে ফোন করেছেন আমেনা বেগম। পরক্ষণেই ফের আবার অর্ষার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির ফোন না এলেও, মানুষটির জননী তো ফোন করেছে। যাকে সে নিজেও তার মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসে না। সব বিষন্নতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সে ফোন রিসিভ করে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে আমেনা বেগমের মায়াময়ী মুখটি।
‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছেন?’ ফোন নিয়ে বারান্দায় যেতে যেতে প্রশ্ন করল অর্ষা।
আমেনা বেগম কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন,’ওয়া আলাইকুমুস-সালাম। আলহামদুলিল্লাহ্ মা, ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো?’
‘জি, আমিও আলহামদুলিল্লাহ্।’
‘তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে মন খারাপ।’
‘কই? না তো! আমি একদম ঠিক আছি।’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘আমি সত্যি বলছি আন্টি।’
‘আন্টি? আমি কি এখনো তোমার আন্টি হই?’
অর্ষা কিছুটা লজ্জা পেল। তবে মুখে কিছুই বলল না। আমেনা বেগম বললেন,
‘আমায় মা বলে ডাকবে কবে?’
অর্ষার কাছে উত্তর নেই। সে সলজ্জিতভাবে হেসে মাথা নত করে রাখে। আমেনা বেগম ফের নিজ থেকেই বললেন,
‘তোমার যে মন খারাপ না তার প্রমাণ দাও।’
অর্ষা হেসে ফেলে। জানতে চায়,’কীভাবে?’
‘আমায় মা বলে ডাকো।’
এবারও অর্ষা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,’মাঝে মাঝে আপনি একদম বাচ্চা হয়ে যান আন্টি।’
‘বাচ্চাকাচ্চা মা বলে না ডাকলে কী করব বলো তো?’
‘আপনি কি আসবেন না মা?’
কথাটা বলেই লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে অর্ষা। আমেনা বেগমও এবার হেসে ফেলেন।
হাসতে হাসতে বলেন,’তুমি এত লাজুক!’
হাসি থামিয়ে ফের বললেন,’দেখি যাব। আহনাফের সাথে সব ঠিকঠাক আছে তো?’
অর্ষা কোনো কিছু না ভেবেই বলল,’হ্যাঁ।’
আমেনা বেগম চুপ করে অর্ষার দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রসঙ্গ বদলাতে অর্ষা জিজ্ঞেস করল,’আহিল কোথায়?’
‘অফিসে গেছে।’
‘বাবা, রেণু আপা সবাই ভালো আছে তো?’
জহির চৌধুরীকে প্রথমবারের মতো বাবা বলে সম্বোধন করেছে বলে মনে মনে হাসলেন আমেনা বেগম। একটু নিশ্চিন্ত হলেন যে, হয়তো দুজনের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।
তিনি অর্ষাকে বুঝতে না দিয়ে বললেন,’হ্যাঁ, সবাই ভালো আছে। কী করছিলে তুমি?’
‘এমনিই বসে ছিলাম।’
দুজনের কথোপকথন হয় ঘণ্টাখানেক। এরমাঝে জেনেভা শহরে ঘুরে আসার গল্পও অর্ষা আমেনা বেগমকে শুনিয়েছে। একটা কথা অস্বীকার করার জো নেই; তার মনে এখন আর একটুখানিও বিষন্নতা নেই। মায়েরা বোধ হয় এমনই হয়। একেকজন মা ম্যাজিশিয়ান। সে নিজের মা হোক বা শাশুড়ি মা! সব বউ-শাশুড়ির সম্পর্কগুলো যদি এমন সুন্দর হতো তাহলে সংসারগুলোও কত-ই না সুন্দর হতো!
________
সেলিনা বেগমের সাথে মুদির দোকানে এসেছে সকাল। আজকাল সকালের বাবা আর ভাইয়ের সময়ই হয় না যে বাজার করবে। মাসকাবারির বাজার মাস শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। দেখা যায় তেল একটু আছে তো, ডাল নেই। মশলা নাই। কিছু না কিছুর অভাব তো দেখা দেবেই। কাজেই সেলিনা বেগমকেই টুকটাক জিনিস কিনে নিতে হয়। সংসার তো চালাতে হবে। মাঝে মাঝে রাগ হয়ে তিনি স্বামীকে অনেক কথা শুনিয়েও দেন! আবার স্বামীর ব্যস্ততাও বোঝার চেষ্টা করেন।
মায়ের হাত ধরে সকাল হাঁটছিল। হোমওয়ার্ক করা শেষে মনে হলো মায়ের সাথে একটু সময় কাটানো যাক। মা-ও তো তখন মহাব্যস্ত! তাকে মুদি দোকানে যেতে হবে। অগত্যা সকালও বায়না ধরল, সেও সাথে আসবে। সেলিনা বেগম না করেননি। স্বামী, ছেলের তো আর সময় হয় না; না হয় তিনি মেয়েকে সাথে নিয়েই বাজার করলেন। মা-বেটি একাই এক হাজার হুহ!
রাস্তা পার হওয়ার সময় সেলিনা বেগম সকালের হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন,’তোর হরলিক্সও তো মনে হয় শেষ তাই না?’
সকালের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। কেননা সে তো এখন আর হরলিক্স খেতে চায় না।
সকালকে নিরব দেখে তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন,’কিরে? কী জিজ্ঞেস করি?’
সকাল মুখটা গম্ভীর করে বলল,’জানিনা।’
সেই সময়ে সামনে একটা গাড়ি আসায় সেলিনা বেগম আর কিছু বললেন না। রাস্তা পার হয়ে সোজা গেলেন মুদি দোকানে।
দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সকালকে বললেন,’একবার মাছের বাজারে যাই চল। দেখি ভালো কোনো মাছ পাই কিনা।’
‘এত রাতে তুমি ভালো মাছ পাবে? যাওয়ার দরকার নেই।’
‘আরে পেতেও তো পারি। চল যাই।’ বলতে বলতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
সকাল পেছন থেকে মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলছে,’না, মা! প্লিজ! তুমি যা নিতে এসেছ তাই নাও। এখন আর মাছ নিতে হবে না।’
‘আরে এমন করছিস কেন? ভালো মাছ না পেলে নেব না। দেখতে সমস্যা কী?’
সকাল একইভাবে শাড়ির আঁচল ধরে আকুতি করছিল মাছের বাজারে না যাওয়ার জন্য। মাছের আঁশটে গন্ধ তার একদম সহ্য হয় না। ব’মি চলে আসে। হুট করে সকাল থমকে যায়। শাড়ির আঁচলে তখন টান লাগায় সেলিনা বেগমও থেমে যান। কোমরে হাত রেখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘তোর য’ন্ত্র’ণা’য় আর শান্তি পাব না। চল যাব না মাছের বাজারে। শান্তি?’
সকাল কিছু বলল না। শুধু আড়ষ্ট হয়ে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নত করে নিল। সেলিনা বেগম ওর হাত ধরে মুদি দোকানে নিয়ে গেলেন। সকাল তখনো আড়চোখে ডানদিকে তাকাচ্ছিল। মানুষটা মুখটিপে হাসছে!
পাশাপাশি দোকানে আছে সকাল আর আহিল। দুজনে দাঁড়িয়েও আছে নিকটে। সে এরকম হাসছে কেন?
সেলিনা বেগম একে একে যা প্রয়োজন সব নিয়ে নিলেন। শেষে এসে সকালের উদ্দেশ্যে বললেন,’তোর জন্য হরলিক্সও এখনই নিয়ে যাই। কী বলিস?’
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে পাশের দোকানে হাসির ধুম পড়ে যায়। আহিলের সাথে আরো কয়েকজন ছেলে ছিল। ওরা-ও হাসছে। এরা নিশ্চয়ই আহিলের বন্ধু। লজ্জায় সকালের এখন ইচ্ছে করছে মায়ের শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে পড়তে। ওরা কি হরলিক্সের কথা শুনেই হাসল? আর একটু আগে যে হাসল, তখন কেন হেসেছিল? সকালের কাণ্ড দেখে?
সকালের মনের থাকা প্রশ্নের ঝুড়ি শেষ হওয়ার আগেই সেলিনা বেগমের কেনাকাটা শেষ হয়ে যায়। তিনি সকালকে নিয়ে হাঁটা শুরু করেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। সকালের খুব করে ইচ্ছে করছিল একটাবার পিছু ফিরে তাকাতে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একটাবার ঐ মুখটি মন ভরে দেখতে। সে কি খারাপ ভাববে? আবারও রাগ করবে? রাগ করার তো কোনো কারণ-ই নেই। সে তো ইচ্ছে করে সামনে আসেনি। দেখাটা কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে। এখানে তো আর তার কোনো দোষ নেই। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। এখন এজন্য কি একটিবার পিছু ফিরে তাকে দেখা যাবে? অন্যায় হয়ে যাবে হয়তো! মানুষটা তো আর তার নয়। সে অন্য কারো ভালোবাসা। থাক, সব ইচ্ছের পূর্ণতা পেতে নেই।
রাতের অন্ধকারে এক সময় সকাল হারিয়ে যায়। আইসক্রিম খাচ্ছিল আহিল, আশিক আর দিদার। ওরা এতক্ষণ বেশ হাসাহাসি-ই করছিল।
আশিক হাসতে হাসতে বলে,’মাইয়াটা কিন্তু কিউট আছে। কী সুন্দর বাচ্চা বাচ্চা টাইপ! রিলেশন করলেই পারতি।’
আহিল আইসক্রিমটুকু শেষ করে মানিব্যাগ বের করতে করতে বলল,’বাচ্চা বাচ্চা টাইপ না। বাচ্চাই। দেখিস না এখনো হরলিক্স খায়।’
দিদার হেসে বলল,’আবার মায়ের আঁচল ধরেও হাঁটে দেখেছিস? দৃশ্যটা সুন্দর ছিল।’
আহিল মুচকি হাসল। আইসক্রিমের টাকা মিটিয়ে দিয়ে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। তখন দিদার বলল,
‘একবার ভেবে দেখতে পারতি মেয়েটার কথা।’
আহিল বাইকে উঠে বসার পর আশিক আর দিদারও উঠল। বাইক স্টার্ট দিয়ে আহিল বলল,’কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এসব নিয়ে ভাবছি না আপাতত।’
আশিক আহত হওয়ার ভান ধরে বলল,’তুই বড্ড নি’ষ্ঠু’র!’
__________
বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বাসায় বিদ্যুৎ নেই। দুপুর পর্যন্ত আবহাওয়া তো ভালোই ছিল। কড়া রোদ ছিল তখন। হঠাৎ করেই আকাশ মেঘলা হওয়া শুরু করে। দমকা বাতাসে জানালার কপাট একটা আরেকটার সাথে বারি খায়, পর্দা উড়িয়ে জানান দেয় ঝড়ের পূর্বাভাস। কিছুক্ষণ বাদেই ঝুমঝুমিয়ে নামা শুরু করে বৃষ্টি।
লিলিয়া, অর্ষা আর স্মিথ ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে। মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ক্যাথি আর অ্যানি। ঠান্ডা পেয়ে দুটোতে মিলে আরামসে ঘুমাচ্ছে। ঘরে শুইয়ে দিয়ে আসলেই উঠে যায়। যেমনটা ছোটো বাচ্চাদের সাথে হয়। তাই আর বৃথা চেষ্টাটি লিলিয়া করেনি।
তিনজনে মিলে সন্ধ্যার নাস্তা করছিল আর গল্প করছিল। লিলিয়াকে স্মিথ আর অর্ষা বারবার অনুরোধ করে বলেছে একটা ভূতের গল্প শোনাতে। লিলিয়াও দুজনের আবদার রাখতে তার মায়ের মুখে শোনা ভূতের গল্প শোনাচ্ছিল দুজনকে। পুরো বাড়িটিতে এখন শুধু মোমবাতির টিমটিমে আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। চার্জার লাইট নিভিয়ে দিয়েছে অর্ষা। টিমটিমে আলোতেই ভূতের গল্প শুনে মজা আছে। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি আর বাড়ির ভেতর একসাথে বসে ভূতের গল্প শোনা। কী রোমাঞ্চকর মুহূর্ত!
স্মিথ ও অর্ষা পাশাপাশি জড়োসড়ো হয়ে বসে গল্প শুনছিল। হুট করে বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠে। ভয়ে আঁৎকে ওঠে দুজনে।
লিলিয়া হেসে বলে,’ভয় পাও আবার তোমরা ভূতের গল্পও শুনতে চাও। বসো আমি দেখি, কে এসেছে।’
স্মিথ লিলিয়ার হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,’নো মম!’
তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’ভয় পেও না। বাস্তবে ভূত বলতে কিছু নেই।’
লিলিয়া চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিল। বৃষ্টিতে ভিজেপুড়ে এসেছে আহনাফ। চুপচাপ বাড়ির ভেতর ঢুকে ড্রয়িংরুমে জড়োসড়ো হয়ে একসাথে বসে থাকা অর্ষা এবং স্মিথের দিকে একবার তাকাল। তারপর পূর্বের ন্যায় নিরবেই নিজের রুমে চলে গেল। সাথে সাথে বিদ্যুৎও চলে আসে তখন।
লিলিয়া অর্ষার উদ্দেশ্যে বলল,’ঘরে যাও এখন। বাকি গল্প পরে শোনাব।’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। রুমে গিয়ে দেখে ভেজা শার্টের বোতাম খুলছে আহনাফ।
অর্ষা কয়েক সেকেন্ড নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে,’বৃষ্টিতে ভিজে এসেছেন কেন?’
‘ভিজে আসিনি। বাড়িতে এসে লনে দাঁড়িয়ে ভিজেছি।’ অর্ষার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো আহনাফ।
‘কেন?’
‘ইচ্ছে হয়েছিল তাই।’
‘ঝড়-বাদলের মধ্যে ভেজার কি খুব বেশি দরকার ছিল?’
‘জানিনা। ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিয়েছি শুধু, ব্যস।’
অর্ষা আর কিছু বলল না। শুধু চেয়ে থেকে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল।
আহনাফ ওয়াশরুমে যাওয়ার পর অর্ষা খাটের ওপর চুপচাপ বসে রইল। মানুষটা যে কেন হঠাৎ করে আবার গম্ভীর হয়ে গেল কে জানে!
শাওয়ার নিয়ে শুধু তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমে আসে আহনাফ। দরজা খোলার শব্দ শুনে অর্ষা একবার তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে রান্নাঘরে চলে যায় কফি আনতে।
কফি এনে দেখে আহনাফ ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরে নিয়েছে। বিছানায় শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অর্ষা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,’বৃষ্টিতে যে ভিজলেন, যদি জ্বর আসে?’
আহনাফ শুয়ে পড়ে বলল,’কফি খাব না। জ্বর আসলে আসতেও পারে। ভালো লাগছে না। ঘুমাব।’
‘এখনই ঘুমাবেন? রাতে ডিনার করবেন না?’
‘মনে হয় না। তুমি খেয়ে নিও।’
‘কফি খান। ভালো লাগবে।’
‘আমি এখন কিচ্ছু খাব না।’
কথা শেষ করে কম্বলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ে আহনাফ। অর্ষা এখন কী করবে? আহনাফের জন্য আনা কফি নিজেই খেয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। ইউটিউবে ঘোরে। কিছুই ভালো লাগছে না। বন্ধুরাও কেউ অনলাইনে নেই এখন। বোর হয়ে লিলিয়ার রুমে চলে যায়। ঐ রুমেই ডিনারের আগ পর্যন্ত গল্পগুজব করে।
ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১০টা বাজে। লিলিয়া বলল,’আহনাফকে ঘুম থেকে তোলো। আমি খাবার গরম করছি।’
অর্ষা চলে গেল আহনাফকে ডাকতে। রুমের লাইট জ্বালিয়ে কিছুক্ষণ ডাকল। সাড়াশব্দ নেই। এবার শরীরে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘শুনছেন? খেয়ে তারপর ঘুমান।’
আহনাফ জড়ানো কণ্ঠে বলল,’যাও এখান থেকে।’
অর্ষা হাল না ছেড়ে ডাকতে থাকে। কম্বল সরিয়ে হাতে হাত রেখে অবাক হয়। এর মধ্যেই তার জ্বর চলে এসেছে। বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসে, এটা জানার পরও বৃষ্টিতে ভেজার কোনো মানে হয়? আহনাফকে এখন ঘুম থেকে উঠানো মুশকিল। লিলিয়া খাবার গরম করে ডাকতে আসে।
অর্ষা করুণস্বরে বলে,’উনার আবার জ্বর এসেছে!’
লিলিয়া এসে আহনাফের কপালে হাত রাখে। চিন্তিত হয়ে বলে,’এখন হয়তো আর উঠবে না। আমি খাবার ঘরে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি ও’কে খাইয়ে দাও।’
‘ঘুমন্ত মানুষকে খাওয়ায় কীভাবে?’
‘বাচ্চাদের যেভাবে খাওয়ায় সেভাবে। বসো তুমি। আমি খাবার নিয়ে আসি।’
লিলিয়া খাবার এনে টি-টেবিলের ওপর রাখে। অর্ষা এবং সে মিলে আহনাফকে ধরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসায়। আহনাফ বিরক্ত হয়। জ্বরের ঘোরে রাগারাগি করে। অর্ষা অবশ্য এসব গায়ে মাখল না। লিলিয়ার কথামতোই অল্প একটু খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো। আহনাফকে আবার শুইয়ে দিয়ে সেও লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে পাশে। এখন আর তার খেতে ইচ্ছে করছে না। অর্ষার একটু ভয় ভয়ও লাগছে। ভয়টা অদ্ভুত রকমের অনুভূতির সঞ্চার করছে মনের ভেতর। এর আগেরবার আহনাফের যখন জ্বর এসেছিল, তখন সে অর্ষাকে যেভাবে কাছে টেনে নিয়েছিল আজও কি তা-ই করবে?
আহনাফের গোঙানোর শব্দ হয় তখন। ব্যথায় গোঙাচ্ছিল সে। অর্ষা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’
‘মাথা ব্যথা করছে।’
অর্ষা উঠে বসে। দু’হাতে সুন্দর করে ম্যাসাজ করতে থাকে। ভালো লাগছে এখন। সে মৃদুস্বরে অর্ষাকে বলেও,’ভালো লাগে।’
মৃদু হাসে অর্ষা। আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,’গল্প শোনাও।’
অর্ষা হতবিহ্বল হয়ে যায়। সে আর গল্প! সে আহনাফের মতোই আহ্লাদী হয়ে বলল,’আমি তো গল্প বলতে পারি না।’
‘উঁহু! আমি জানিনা কিছু। আমি গল্প শুনব।’
অর্ষা কোন গল্প তাকে শোনাবে? সে নিজেই একটা গল্প বানিয়ে আহনাফকে বলতে শুরু করে,
‘এক রাজ্যে ছিল রাজা, আর এক ছিল রানী। তখন তাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। একদিকে রাজ্য আর অন্যদিকে রানী। রাজা তো মহাব্যস্ত।
রানী আর রাজ্য নিয়ে রাজার অনেক ভালো সময় কাটছিল। প্রজারাও রাজা, রানীর ব্যবহারে সন্তুষ্ট ছিল।
একদিন অন্য রাজ্যের সাথে এই রাজ্যের তুমুল দা’ঙ্গা লাগে। অনেক হাতি-ঘোড়ার সাথে সাথে প্রজাদের ফসলাদি; এমনকি প্রজারাও আ’হ’ত ও নি’হ’ত হয়। এরপর রাজা নিজেই যায় যু’দ্ধ করতে। এই সুযোগে দ’স্যু’রা প্রাসাদে এসে রানীকে মেরে ফেলে। রাজা যু’দ্ধ জয় করে রাজ্যে ফিরে দেখে তার অনেক প্রজাদের এবং রানীকেও মে’রে ফেলেছে।
রানীর মৃ’ত্যু রাজা সহ্য করতে পারে না। কারণ সে রানীকে অনেক ভালোবাসতো। রানীর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত তার মনে পড়তে থাকে। রানীকে ছাড়া থাকতে হবে ভেবে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তারও বেঁচে থাকার ইচ্ছে মা’রা যায়। এরপর রাজা নিজের তলোয়ার নিজের পেটে ঢুকিয়ে সেখানেই জীবন উৎসর্গ করে। শেষ সময়ে শুধু রানীর হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেয়েছিল।
এভাবেই রানীর শোকে রাজার মৃত্যুর মাধ্যমে গল্পটি শেষ হয়ে যায়।’
গল্প শুনে জ্বরের ঘোরে আহনাফ অর্ষার হাত চেপে ধরে বলে,’তুমি আমায় কখনো ছেড়ে যাবে না তো?’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৩৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
আকাশের বজ্রপাতে হঠাৎ করেই অন্ধকার রুমটা মাঝে মাঝে আলোকিত হয়ে উঠছে। জানালার পর্দা লাগানো হয়নি। জানালার কাচ গলেই মূলত বজ্রপাতের আলোতে ঘর ঝলমল করে ওঠে। সেই হঠাৎ ধেয়ে আসা আলোতে অর্ষা নিবিড় দৃষ্টিতে আহনাফের মুখটি দেখে। কত মায়া, কত স্নেহ সেই মুখটিতে!
অর্ষার পৃথিবীটা খুব ছোট্ট ছিল। তার যাওয়ার স্থানও পরিমাপ করা ছিল। বাড়ি থেকে স্কুল, কলেজ। মাঝেমাঝে বন্ধুদের সাথে আশেপাশের কোনো রেস্টুরেন্ট কিংবা লেকের পাড় এই পর্যন্তই। তার পৃথিবী জুড়ে ছিল তার বন্ধুরা। বাবা-মাকে সে খুব কম সময়ের জন্যই পেয়েছে বলা যায়। জীবনের পথটা হয়তো এখনো অনেক দীর্ঘ। এমনও হতে পারে মৃ’ত্যু খুব সন্নিকটে। মায়ের অনুপস্থিতিতে তার বুকে যন্ত্রণা হতো। কষ্ট হতো। বন্ধুরা তখন ব্যথার উপশম হিসেবে কাজ করত। সে ভাবেইনি এভাবেও যে ভালোবাসা হয়। ভালোবাসা! হ্যাঁ, ভালোবাসাই তো! নতুবা আহনাফের প্রতি কেনই বা তার এত টান? এত মায়া? এর নাম কি ভালোবাসা নয়?
আহনাফের কণ্ঠ থেকে তখন মৃদুস্বরে ভেসে আসে,’বলো না, বলো না!’
অর্ষার বক্ষজুড়ে তখন দীর্ঘশ্বাসের বসবাস। কবে সে মানুষটিকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারবে? তার সাহস কম। চিৎকার করে ভালোবাসার কথা সে কখনোই বলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে পারবে, ভালোবাসি। আচ্ছা ভালোবাসলে কি মুখে প্রকাশ করতেই হয়? না বললে কি বোঝা যায় না?
প্রশ্নগুলো নিয়ে আর মাথা ঘামাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যা হয়, হোক। যা হবে নিশ্চয়ই সেটা ভালো হবে। সে আহনাফের চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলল,
‘ঘুমান।’
আহনাফ সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে আর তার ঘুম ভাঙেনি। জ্বরের প্রভাবে কোনো পাগলামিও করেনি। সকালে যখন ঘুম ভাঙে, শরীরে তখন জ্বর ছিল না। তবে মাথাটা বেশ ভার হয়ে ছিল। অর্ষাকে পাশে না পেয়ে সে একটু জোরেই নাম ধরে ডাকল,
‘অর্ষা?’
বারান্দা থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে অর্ষা। আহনাফ এক পলক তাকিয়ে থেকে বলে,’বারান্দায় কেন এত সকালে?’
জামায় ভিজে যাওয়া হাত মুছে অর্ষা বলল,’বৃষ্টির পানি তো বারান্দায়। তাই মুছে দিচ্ছিলাম।’
‘সকাল সকাল এসব করার কি খুব দরকার?’
‘সমস্যা নেই তো! আপনার জ্বর কমেছে?’
‘জ্বর এসেছিল?’
অর্ষার খুব হাসি পাচ্ছিল তখন। মিটিমিটি করে হাসলেও আহনাফের নজরে পড়েনি। ভাগ্যিস পড়েনি! না হলে সকাল সকাল একটা তুলকালাম কাণ্ড সত্যিই বেঁধে যেত।
অর্ষা হাসি আটকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,’হ্যাঁ।’
‘ওহ। মাথাটা ভার হয়ে আছে। কড়া করে কফি বানিয়ে দিতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, শিওর। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ততক্ষণে।’
অর্ষা কফি আনার জন্য চলে যাওয়ার পর আহনাফও ফ্রেশ হয়ে নেয়। কফির সাথে সাথে সকালের নাস্তাও নিয়ে আসে অর্ষা।
কফি সম্পূর্ণ শেষ করার পর অনেকটাই ভালো লাগছিল আহনাফের। সে ব্রেডে কামড় দিয়ে বলল,
‘তুমি তখন হাসছিলে কেন?’
‘কখন?’ অর্ষার চোখে-মুখে বিস্মিত ভাব।
‘যখন জিজ্ঞেস করলাম আমার জ্বর এসেছিল কিনা।’
‘আমি সত্যিই হাসিনি।’
‘মিথ্যে বলো কেন?’
‘না, সত্যি।’
আহনাফ একবার তাকিয়ে আর কিছু বলল না। অন্যদিকে অর্ষা তো এটাই ভেবে পাচ্ছে না, এই লোকটা সামান্য জিনিসও কীভাবে খেয়াল করে? তখন কিছুই বলল না। আর এখন যখন শরীরটা একটু চাঙ্গা হলো, ওমনিই একদম তেড়ে এসেছে!
অর্ষা চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,’অফিসে যাবেন আজ?’
‘অবশ্যই।’
‘কখন আসবেন?’
‘জানিনা। কিছু লাগবে তোমার?’
‘উঁহু।’
‘কিছু লাগলে বলতে পারো।’
আহনাফ উঠে গেল আলমারির কাছে। অর্ষা ইতস্তত করে বলল,’একটা কথা বলতাম।’
‘বলে ফেলো।’
‘রাগ করবেন না প্লিজ! আপনি সবসময় এমন গম্ভীর হয়ে থাকেন কেন? কিছুদিন ধরে একদম স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন না। কেমন যেন হয়ে থাকেন। বেশি কথাও বলেন না। এমন করেন কেন? আমি কি কোনো ভুল করেছি?’
এক দমে কথাগুলো বলে চুপ হয়ে গেল অর্ষা। ভয়ও লাগছে। আবার রেগে না যায় সে! তবে এমন কিছুই হলো না। আহনাফ অর্ষার এতগুলো কথার পিঠেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সর্বসময়ের মতোই নিরব ও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেছে। নিজের মতো রেডি হতে ব্যস্ত সে। এদিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্ষা। মানুষটা ভীষণ একগুঁয়ে, নি’ষ্ঠু’র!
আহনাফ অফিসে যাওয়ার পূর্বেও কিছু বলে যায়নি। নিরবে বাড়ি ছেড়েছে। অর্ষার এখন মনে হচ্ছে, তাকে কথাগুলো বলাই ভুল হয়েছে। কেননা তার মনে হচ্ছে, কথাগুলো বলার পর থেকে আহনাফ আরো বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে।
একরাশ মন খারাপ নিয়ে ফোন করে গ্যাঞ্জাম পার্টির গ্রুপ কলে। সর্বপ্রথম লামিয়াই জয়েন হয়। আপাতত এখনো কেউ কলে জয়েন হয়নি।
ওপাশ থেকে লামিয়া জিজ্ঞেস করে,’কী ব্যাপার বোকারানী, কেমন আছিস?’
বিষন্ন কণ্ঠে অর্ষা উত্তর দেয়,’আলহামদুলিল্লাহ্, তুই?’
‘আমি তো একদম ঝাক্কাস আছি। কিছুদিন বাদে সুইজারল্যান্ড আসব। এই খুশিতে তো রাতে ঠিকমতো আমার ঘুমই হয় না।’
অর্ষা নিশ্চুপ। লামিয়া বলল,’তোর মন খারাপ কেন?’
‘আর মন খারাপ! মন থাকলে না মন খারাপ করব।’
‘কী হয়েছে সেটা তো বলবি।’
সেই সময়ে কলে জয়েন হয় জুঁই আর রেশমি। দুজনে একসাথে বলে,’তোরা দুটোয় কী বলিস রে?’
এরপর আবার দুজনেই হেসে ফেলে একসাথে একই কথা বলায়। লামিয়া এ কথার উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল,
‘তোরা দুজনে একসাথে কলে আসলি কীভাবে সেটা আগে বল?’
‘টাইমিং মিলে গেছে তাই। এখন বল তোদের কী খবর? অর্ষা চুপ করে আছিস কেন?’ বলল জুঁই।
উত্তরে লামিয়া বলল,’আমি ও’কে সেটাই জিজ্ঞেস করেছি। কী হয়েছে অর্ষা? আমাদের বল।’
কেয়ার ফোন করা, আহনাফের হঠাৎ পরিবর্তন, গম্ভীর আচরণ সবকিছুই অর্ষা তিনজনকে বলল। সব শুনে জুঁই বলল,
‘তুই এত্ত গা’ধী কেন? রাগ করেছে যে কেন সেটা এখনো বুঝিসনি?’
‘শুধু গা’ধী না। সাথে আনরোমান্টিকও। আমি আগে সুইজারল্যান্ড যাই। এই দুটোকে যদি আমিষ না বানাচ্ছি তারপর বলিস!’ বলল লামিয়া।
অর্ষা করুণস্বরে জানতে চায়,’তোরাও কেন রাগ দেখাচ্ছিস?’
রেশমি বলল,’আরে বা’ল! তোরে তো মাথায় তুলে আ’ছা’ড় দেওয়া উচিত। তুই আহনাফ ভাইয়াকে ঐ প্রশ্নটা কেন করতে গেছিস? কেয়া আপুর কথা বলাটাই ঠিক হয়নি।’
‘আমার কি বিষয়টা জানা উচিত নয়? আল্লাহ্ না করুক, যদি সত্যিই কখনো এমন সিচুয়েশন আসে? তখন কী করব বল তো?’
লামিয়া আহ্লাদী হয়ে বলল,’ভয় পাস না জানু। এমন কিছু হবে না ইন-শা-আল্লাহ্। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ।’
‘হ্যাঁ, এসব চিন্তা-ভাবনা করে, এসব প্রশ্ন করে নিজেদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করিস না। ভাইয়ার রাগ ভাঙা।’ বলল জুঁই।
অর্ষা অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করল,’কীভাবে?’
লামিয়া, জুঁই আর রেশমি এবার শব্দ করে হেসে ফেলে। রেশমি হাসতে হাসতে বলে,’হাজবেন্ডের রাগ ভাঙাবি সেটাও আমাদের শিখিয়ে দিতে হবে?’
‘তোরা মজা নিচ্ছিস! নে।’
জুঁই তখন মশকরা করে বলল,’অ্যাই তোদের ফুলসজ্জা হয়েছে তো?’
লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে যায় অর্ষার। কান দুটো গরম হয়ে ওঠে। রাগ দেখিয়ে বলে,’তোদের কিছু বলাই বৃথা। আমি ফোন রাখলাম।’
লামিয়া ব্যস্ত হয়ে বলল,’এই, এই শোন! ফোন রাখিস না। রাগ করছিস কেন বল তো? আমরা তো একটু মজাই করছি।’
‘তোরা অনেক ফা’জি’ল। নি’র্ল’জ্জ। তোদের মুখে কিছু আটকায় না।’
তিনজনে ফের আবার হেসে ফেলে। জুঁই বলে,’আচ্ছা শোন। এক কাজ কর তুই। ভাইয়ার পছন্দমতো খাবার রান্না কর। তার সাথে সুন্দরমতো কথা বল। নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চা। আর হ্যাঁ, পারলে ভাইয়াকে ডেডিকেট করে একটা গান শুনিয়ে দিবি। রাগ গলে একদম পানি হয়ে যাবে।’
লামিয়া বলল,’আমি জুঁইয়ের সাথে এক মত।’
রেশমি বলল,’আমিও।’
অর্ষা জানাল,’আচ্ছা ঠিকাছে। গান শুনাতে পারব কিনা জানিনা, তবে চেষ্টা করব।’
‘শোন, যদি লজ্জা লাগে তাহলে কৌশলে গান গেয়ে বুঝিয়ে দিবি।’ বলল লামিয়া।
রেশমি হতাশ হয়ে বলল,’আহারে! তোদেরই জীবন বুঝলি। বিয়েশাদী করে কী সুন্দর সংসার করতেছিস। হাজবেন্ডের সাথে রাগ-অভিমান, ঝগড়া হচ্ছে। রোমান্স হচ্ছে। আর আমি! আমি শা’লা সিঙ্গেলই রয়ে গেলাম!’
লামিয়া হেসে বলল,’এক কাজ কর। আঙ্কেল-আন্টি দুজনেই যখন বাড়িতে থাকবে, তখন সাউন্ড বক্সে একটা গান ছাড়বি।’
‘কী গান?’ উৎসাহের সঙ্গে জানতে চাইল রেশমি।
লামিয়া হাসতে হাসতে বলল,’বাবা আমার কি বিয়ে হবে না, বাবা আমার কি বিয়ে হবে না! এই গানটা।’
‘ভাইরে! জু’তা দিয়ে মা’র’বে আমারে আব্বায়।’
বাকিরা তখন রেশমির কথা শুনে হেসে ওঠে।
.
.
দু’দিনের দিন মনেপ্রাণে সাহস সঞ্চয় করে অর্ষা। আজ সে আহনাফকে কৌশলে একটা গান ডেডিকেটেড করবে। এজন্য আগে আগে ওর পছন্দমতো রান্নাবান্না করেছে। সব কাজে অবশ্য লিলিয়াও সাহায্য করেছে। লিলিয়ার পরামর্শেই অর্ষা গাঢ় নীল রঙের একটা শিফন শাড়ি পরেছে। শাড়িটা তার খালা শাশুড়ি দিয়েছিল। এর আগে কখনো পরা হয়নি। আজ-ই প্রথম। একটু নার্ভাসও লাগছিল তার।
আহনাফ রাতে বাড়ি ফিরে অর্ষার সাজসজ্জা দেখেও কিছুই বলল না। খেতে বসে শুধু জিজ্ঞেস করল,’সব খাবারই তো দেখছি আমার পছন্দের। আজ কি কোনো স্পেশাল ডে? নাকি আমার বার্থডে?’
শেষের প্রশ্নটা কনফিউশন নিয়েই করল। অর্ষা লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফের দিকে তাকাতেও পারছে না। লিলিয়া হেসে বলল,
‘না, না। তোমার জন্মদিন নয় আজ। অর্ষার ইচ্ছে হয়েছে তাই তোমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেছে। খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে।’
আহনাফ একবার শুধু অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’ওহ। থ্যাঙ্কিউ।’
এরপর বাকিদেরও বলল একসাথে খেতে। খাওয়ার মাঝেই সে অর্ষার রান্নার প্রসংশা করেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সে কোনো রকম কার্পণ্য করেনি তারিফ করতে।
খাওয়া শেষে ঢেকুর তুলে বলল,’বাই দ্য ওয়ে, কোথাও গিয়েছিলে আজ?’
অর্ষা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,’উঁহু! কেন?’
‘হঠাৎ শাড়ি পরেছ তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
অর্ষা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আহনাফ খেয়ে নিজের রুমে চলে যায়। অর্ষারও খাওয়া শেষ হলে লিলিয়া বলল,’টেবিল আমি গুছিয়ে রাখব। তুমি ঘরে যাও।’
অর্ষা কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে রুমে গেল। আহনাফ বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। কাজ করছে নাকি ফেসবুকিং করছে বুঝতে পারছে না। অর্ষা রুমে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে থাকা টুলে বসল। ফোনের ক্যামেরা অন করে আয়নার সামনে রেখে, আড়দৃষ্টিতে আয়নার মাঝেই একবার আহনাফের দিকে তাকাল। বুকের ভেতর তার ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। গান গাওয়ার সময় যদি কণ্ঠস্বরও কাঁপে, তাহলে বিচ্ছিরি একটা ঘটনা ঘটে যাবে। তার সকল প্ল্যানও বৃথা যাবে।
মনে মনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে গলা পরিষ্কার করে। প্ল্যান অনুযায়ী ফোনের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে গান শুরু করে। গান গাওয়ার পূর্বে বলে,
‘দিস লিরিক্স ফর ইউ।
আমার পোড়া কপালে
আর আমার সন্ধ্যে সকালে
তুমি কেন এলে জানি না এখনো,
ফন্দি আটে মন পালাবার
বন্দি আছে কাছে সে তোমার…
যদি সত্যি জানতে চাও
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই।
যদি মিথ্যে মানতে চাও, তোমাকেই চাই।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]