যে ঢেউয়ে পর্ব-০১

0
2

#যে_ঢেউয়ে
#পর্ব_১
#লেখনীতে_তানজিলা

‘ডিভোর্সের পর বাড়ি এলে আম্মু বলেছিল– তোর কীসের এত ঢং রে কালী? মাইনা নিয়া থাকতে পারিস নাই? সতীনের সংসার করতিস, তোর মতন কাইলারে এখন কী করব আমি? বেরিয়ে যাহ, যেখানে ইচ্ছা!

আম্মুর কণ্ঠে কতটা ক্ষোভ, ঘৃনা ছিল, স্পষ্ট বোঝা গেল। দু’চোখের বিষ তার। তখন সবে একমাস হয়েছিল আপু এসেছে। আপুর বর পরকীয়া করত। সামনে বিয়ে করবে, তাই ডির্ভোস দিয়েছে আপুকে। আপু দেখতে কালো। ভীষণ কালো। শুধু তাই নয়, মুখে বেশ ব্রণ। ফেস কাটিংও সুন্দর নয় বেশি একটা।
যে লোকটার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, উনিও তেমন একটা ভালো দেখতে নয়। রাজমিস্ত্রির কাজ করত। আপুর থেকে বারো তেরো বছরের বড় ছিল। আপু তার অপছন্দ হওয়ার সত্বেও, চারলাখ টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেছিল লোকটা। শুধুমাত্র টাকার জন্যই!

সোমা আপু আমার আপন বোন ছিল নয়। বাবার বড় ভাইয়ের মেয়ে। সোমা আপুর আব্বু রাজনীতিতে সংযুক্ত ছিল। চৌদ্দ সালের নির্বাচনের সময় সংঘর্ষে মারা যায়। আপুর মা জন্মের সময় মারা যায়। আব্বু মরার পর, বাবা আপুকে এখানে নিয়ে আসে। তারপরথেকে আমাদের কাছেই আপু থাকত। বাবার সঙ্গে বড় আব্বুর ভালো সম্পর্ক ছিল না অতীতে। বড় আব্বু অন্যায় করেছিল বাবার সঙ্গে। যেহেতু বড় আব্বু রাজনীতিতে যুক্ত ছিল, নিজের দাপট দেখিয়ে বাবার হক মেরে খেয়েছিল। বাবাকে জমিজমার ভাগ দেয়নি। বাবা নিজের চেষ্টায় বাড়ি করেছিল।’

ফুপিয়ে উঠল রিমু। তার সম্মুখে থাকা আরেকটি মেয়েটি শক্ত গলায় বলল, ‘তারপর রিমু?’
রিমু চোখ মুছে বলল, ‘সোমা আপুকে আমার ভীষণ সহজ-সরল লাগত। চাপা স্বভাবের। তাকে যা কিছু বলা হোক, সে কখনও পাল্টা জবাব দেয়না। তার সহ্য করার সক্ষমতা এত! আমাদের বাড়িতে আসার পর, আম্মু তাকে সহ্য করতে পারত না, যেহেতু আপুর আব্বু অন্যায় করেছিল আমাদের সঙ্গে। আম্মু তাকে দিনরাত খোটা দিত, কালো দেখতে হওয়ায়। আপু কিছু বলত না, শুধু শুনত। নিজের মতো কাজ করত। বাবার সাথে অন্যায়ের জন্য মাঝেমধ্যে আমারও রাগ উঠত তার উপর। মাঝেমধ্যে আমিও দুটো কথা শোনাতাম।

যাইহোক, তারপর কয়েক বছর গেলে বাবা ওর বিয়ের ব্যবস্থা করে। আপু যেহেতু বেশি শিক্ষিত নয়, দেখতে ভালোও নয় তাই সহজে বিয়ের প্রস্তাব পেত না। যেই দেখত, সেই ফিরিয়ে দিত। কেউ কেউ যৌতুকের দাবি করত, সেগুলোর পরিমাণ বিশাল। যা কখনও আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারপর সেই রাজমিস্ত্রির প্রস্তাব পায়, তাদেরও দেখে পছন্দ হয়না আপুকে। কিন্তু যৌতুক দিলে বিয়ে করবে এমন শর্ত রাখে দুলাভাইয়ের বড় ভাই। তাদের যৌতুকের পরিমাণ অন্যদের থেকে কম থাকায় বাবা রাজি হয়। এ নিয়ে আম্মুর ক্ষোভের শেষ ছিল না। যে মেয়ের বাবা, আমাদের জমিজমা সব খেয়েছে, সেই মেয়েকে কেন তারা এতগুলো টাকা দিয়ে বিয়ে দেবে? আব্বু যুক্তি হিসেবে বলেছিল–তার ভাই যা করেছে, সেটা অন্যায়। তিনিও যদি একই কাজ করেন তবে পার্থক্য কোথায় রইল?
আম্মু বাবার সামনে কিছু বলতে না পারলেও আপুর উপর ক্ষোভ ঝেরেছিল। কী কী ভাষা বলে গালি দেয়নি! অথচ আপু তবুও মুখ ফুটে কিছু বলেনি। সেদিন রাতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আপু কেঁদেছিল। কান্নার শব্দ পেয়েছিলাম।

এভাবে ছোটখাটো করে বিয়ে হলো তাদের। বিয়ের পর থেকে আরও টাকার জন্য তাকে চাপ দিত লোকটা। কিন্তু লজ্জায় আপু, বাবাকে কিছু বলেনি। টাকা না পেয়ে আরও ক্ষিপ্ত হতো তার স্বামী। স্ত্রীর কোন সম্মান দিত না।
তারপর একদিন শুনি তার স্বামী নাকি তাকে রাখবে না, আরেকটা বিয়ে করবে। আপু ভেঙে পড়লেও সতীনের সংসার করতে রাজি ছিল। কিন্তু ওর স্বামীর কথা—যাকে দেখলেই বমি আসে, তাকে কেন রাখবে? টাকাও তো পাচ্ছে না। টাকা এলে নাহয় রাখা যেত।
আপুকে তালাক দিল। আবারও আপু এল। কিন্তু এখানে থাকাটাও কম কষ্টের ছিল না। বাবা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে গেছিল এবার।
আমাদের টানাপোড়েনের সংসার। আপু আসায় চাপ বাড়ল। আম্মুর রাগ আর দ্বিগুণ হয়। এইবার আম্মু গায়ে হাত তোলা শুরু করে। এদিকে আমার বড় ভাই বেকার, বাড়িতে ছিল। অনার্স শেষ করেছে কিন্তু জব পাচ্ছে না। সেও আম্মুর সঙ্গে তাল মেলাত। আম্মুকে উস্কে দিত।

মাঝেমধ্যে আমার চোখে পড়ত, ভাইয়া আপুকে অদ্ভুতভাবে দেখে। তারপর একদিন রাতে ঘরে লাইট অফ ছিল। কেউ ঘরে ঢুকল। আমি চকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সঙ্গে সঙ্গে লাইট জ্বালালাম। ভাইয়া! ভাইয়া আমাকে দেখে একটু হতভম্ব ছিল। তারপর বলল, ওর খাতা দরকার ছিল তাই এসেছে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই নেই। এভাবেই অনেক কয়টা মাস যায়। আমার এসএসসি পরীক্ষার কারণে আমি ব্যস্ত থাকতাম। বাড়িতে সারাদিন পড়াশোনা করতাম। পরীক্ষা শেষ হয়। এর মধ্যে একদিন উপলব্ধি করি ভাইয়ার সঙ্গে আপুর সান্নিধ্য বেড়ে গেছিল। কেউ আশেপাশে না থাকলেই ভাইয়াকে তার আশেপাশে দেখা যেত। বিষয়টা আমি আম্মুকে অবগত করলাম, আম্মু হেয় করে বলল, ‘ওই কালীর চেহারা দেখে মনে হয়, আমার ছেলের রুচি এত খারাপ?’
আমি কিছু বলার পাইনা। এর মধ্যে আপুটা কেমন যেন হলো। উদাসীনতা আরও বেড়ে গেল। কাজে অমনযোগী। আম্মু বিষয়গুলো বাবাকে জানাল। কাজের দরুন বাবাকে যেতে হয়েছে অন্য শহরে।
বাবা রাগান্বিত হয়ে জানিয়ে দেয়, আপু যেন নিজের থাকার জায়গা খুঁজে নেয়। আর পালতে পারবেন না উনি। আপু শুনে সব। কিছু বলে না।

আমাদের একটা বিয়ের দাওয়াত আসে। আপু বাদে সকলে গেছিলাম সেদিন। ভাইয়া বাড়িতে আসে একটুপর। কাছাকাছি হওয়ায় আমিও কিছুক্ষণ পর আসি, জামাতে সমস্যা হচ্ছিল। বাড়িতে এসেই ধস্তাধস্তির শব্দ। আমি বলি, কী হয়েছে? তারপর এগিয়ে যেতে হতভম্ব হয়ে যাই। সোমা আপু ক্রন্দনরত। ভাইয়া সম্মুখে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে উঠে। তারপর সোমা আপু দৌড়ে ওড়না উঠিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে থাকি। অবিশ্বাস্য লাগছে। ভাইয়া মাথা নিচু করে রইল, তারপর কোথাও গেল। আমি আর বিয়েতে গেলাম না। বিয়ে থেকে ফিরে আম্মুকে বললাম। আম্মু ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘কালীটার নজর শেষ পর্যন্ত আমার ছেলের উপর পড়ল?’ আমি বললাম যা দেখছিলাম। তবুও আম্মু বলে, ‘এসব মেয়েদের চিনিস না। চেহারা না থাকলেও ঠিকই ছেলেদের কাছে টেনে নেয়।’
তারপর বিড়বিড় করল, ‘এই মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে।’

আমি কেন জানি সব দেখে স্তম্ভিত হয়ে ছিলাম। কী করব, না করব বুঝতে পারিনি। আপুকে ওইদিন কিছু বললাম না। কিন্তু আম্মু আরও ক্ষিপ্ত হলো। তারপর? তারপর বাবাকে কল করে সব জানাল। বাবাও বলল, ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। এভাবে কেটে যায় কয়েকদিন। আম্মু সরাসরি সোমা আপুকে বলল, নিজের ব্যবস্থা অন্য কোথাও করতে। আপু অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিল। এর মধ্যে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে বলেছিল কিছু না। ঐদিনের দৃশ্য দেখার পর থেকে আমি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলতাম না। একদিন ভাইয়ার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই, ভাইয়া আমাকে বলল, ‘তুই যা ভাবছিস, ভুল। আমি কিছু করিনি রিমু। ওই মেয়েটাকে যতটা সরল ভাবছিস ততটা নয়। আমাকে ফাসাচ্ছে।’
বিষয়টা আমাকে ভাবাল। কে সত্যি, বলছে মিথ্যে বলছে আমি জানিনা। এভাবে আরো সময় কেটে যায়। আরেকদিন সকালে আমি আম্মু মিলে বাজারে যাই। ফিরে এসে আপুকে অদ্ভুত ভাবে দেখি। চোখমুখ শুকনো, কেমন অগোছাল। কেমন হয়ে বসে আছে সে। তারপর আমি যাই আমার প্রাইভেট এ। ফিরে এসে যা দেখি, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার ঘরের ফ্যানের সঙ্গে আপু ঝুলছে। হাতে কিছু একটা। গায়ে কিছু দাগ। আমি গলা শুকিয়ে যায়। নিজেকে শেষ করল কেন?’

চলবে।