#যে_ঢেউয়ে
#লেখনীতে_তানজিলা
২.
রিমু কাদঁছে। সামনে থাকা মেয়েটি সান্তনা দিল।
রিমু ক্রন্দন গলায় বলল, ‘আত্মহত্যার আড়ালে হত্যা এটা।’
মেয়েটি তীক্ষ্ণ দৃঢ়তে পরখ করে শুধায়, ‘তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ? হত্যা হলে, কাকে সন্দেহ করছ?’
রিমু থমথমে গেল। কথা যেন গলায় আটকে গেছে। কাপা কাপা গলায় বলল, ‘আমার.. আমার মনেহয় ভাইয়া! ভাইয়া তার সঙ্গে খারাপ কিছু করেছে।’
‘ইয়্যু মিন রে/ইপ?’
রিমু যেন থমকে যায়। নিজের ভাইয়ের উপর এত ঘৃণিত অভিযোগ আনতে হবে, ভাবেনি কখনও সে। কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়াল। সামনে থাকা মেয়েটি ভীষণ ধূর্ত, চতুর। সে ভাবল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে বলো। ছোট থেকে একসাথে মানুষ হয়েছ, তাইনা?’
রিমু মাথা নাড়ায়, বলে, ‘জি। ভাইয়া একটু রাগী, আবার হাসিখুশি। বাবার সঙ্গে ওর ঝগড়া হয় অনেক। আম্মুর সাথে মিল। আমার সাথে স্বাভাবিক। আগে জ্বালাতন করতো।’
‘তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট?’
‘তেমন একটা জানি না। কিন্তু যখন কলেজে নাকি স্কুলে পড়ত। ওর রিলেসন ছিল। মেয়েটা ওকে ছ্যাকা দিয়েছিল।’
মেয়েটি গভীর ভাবল, ‘আচ্ছা। তুমি যাও।’
রিমু উঠল, ‘ম্যাম, আমি এসব বলেছি কাউকে বলবেন না।’
মেয়েটি হাসল, ‘সাহস নিয়ে সত্যিই কথা বলতে এসেছ, তবে কিসের ভয় পাচ্ছো মেয়ে?’
‘আম্মু, বাবা জানতে পারলে খুব বাজে অবস্থা হবে। প্লীজ। আমি আপনার পায়ে..
মেয়েটি সরে গেল। বলল, ‘ঠিকাছে, যাও তুমি। আমি দেখব বিষয়টা।’
সোমার সুসাইড কেস মেয়েটি ই তদন্ত করছে। রিমুর কথা সব রেকর্ড করেছে। বারবার শুনে বোঝার চেষ্টা করল। রাতে অফিসার ঠিক করল, রিমুর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবে একান্তরে। রিমুর ভাইকে ওইদিন যখন দেখেছিল, মুখটা ভয়াত্মক ছিল তার। চোখে অসহায়ত্ব বোধ। অফিসার মেয়েটির মনে হয়নি, ছেলেটি দোষী। কিন্তু আজকে রিমুর কথায় কেসের মোড় পাল্টে গেল।
পরেরদিন সকালে রিমুর ভাইকে ডাকল সে। কিন্তু তার আগেই ঘটল আরেক ঘটন! সোমার ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে। রিমুর কথা মিলেছে, তাকে রে/ইপ করা হয়েছিল। অফিসার চিন্তিত হয়ে পড়ল। বিগত দিনের সবকিছু এনালাইসিস করতে লাগল। এরপর তাকে এসে বলল, ‘স্যার, উনি এসেছেন।’
অফিসার মেয়েটি মাথা নাড়াল। ধীর পায়ে প্রবেশ করল রিমুর ভাই। ছেলেটা বসল, ‘জি বলুন।’
অফিসার সোজা হয়ে বসল, মুখোমুখি, ‘সোমার ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে, তাকে রে/ইপ করা হয়েছিল ওইদিন।’
রিমুর ভাই শুনে চমকে যায়। চেঁচিয়ে বলে, ‘কিহ!’
অফিসার হাসলেন, ‘জি।’
রিমুর ভাই বিচলিত হয়ে পড়ে, ‘এসব কে করল?’
অফিসার মেয়েটি এগিয়ে এল, ‘আপনি বলেছিলেন, আপনি ওইদিন বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন তাইতো?’
‘জি।’
মেয়েটি আবারও চমৎকার হাসল, ‘কিন্তু আপনার ঘনিষ্ট বন্ধুদের থেকে জানলাম, আপনি ওইদিন বাইরেই বের হননি।’
রিমুর ভাইয অস্থির হয়ে উঠল। ঢোক গিলল। অনেকক্ষণ চুপচাপ রইল। কিছু বলবে তার আগেই অফিসার বলল, ‘দেখুন, মিথ্যে বলার চেষ্টা করবেন না, যে অন্যকারণে বাইরে ছিলেন। আপনাদের বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটগুলোতে সিসি টিভি লাগানো। ওইদিনের ওই ঘটনার আগে আপনাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়নি।’
আরেকদফা চমকে যায় রিমুর ভাই। অফিসার পানির গ্লাস এগিয়ে দিল, ‘পানি খান মিস্টার রিহান? তাইতো?’
রিহান পানি খেল। অফিসার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিটা বলবেন কী? অভিযোগের তীরটা কিন্তু আপনার দিকেই।’
রিহান ভীষণ বিচলিত হলো। অফিসার ডাকল, রি -হা- ন?’
রিহান চমকায় আবারও। নিজ থেকে কাপা গলায় বলে, ‘বিশ্বাস করুন ম্যাম, আমি কিছু করিনি। আমি ওইদিন বাসায় ঘুমাইছিলাম। তারপর মা বাজার থেকে ফিরে আমাকে ডাকে।’
রিহানের কণ্ঠে জোর বেশ। অফিসার জিজ্ঞেস করল, ‘মিথ্যে কেন বলেছিলে?’
‘মা বলেছিল। কারণ আমাকেই সন্দেহ করত।’
অফিসার হাসে, ‘তবে আপনার বোনের সন্দেহ আপনাকে।’
রিহান অবাক হয়, ‘রিমু আমাকে?’
‘জি, আপনাকে আগে বেশ কয়েকবার সোমার আশেপাশে দেখা গেছে। একবার ধস্তাধস্তি করতেও দেখছিল আপনার।’
রিহান প্রত্যুত্তর করেনা। অফিসার আবার বলে, ‘মনে আছে নিশ্চয়ই?’
রিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যিই কথা বলতেই হবে। ও বলল, ‘আমি সোমাকে পছন্দ করতাম।’
অফিসার মেয়েটির হাসি যেন নিভে গেল। রিহান বলল, ‘সোমা দেখতে কালো হলেও ভালো লাগতো আমার। ওর অসহায়ত্ব বোধ দেখে ওর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি জন্মেছিল। একারণে প্রায় ওর আশেপাশে থাকতাম।
আর ধস্তাধস্তির কথা বলছেন? ওইদিন পাশের বাড়ির বিয়েতে সকলে গেছিলাম, সোমা বাদে। আমি ওইদিন যখন বাসায় এসেছিলাম, সোমা কারোর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলে ও এড়িয়ে যায়। আমাকে বারবার এভাবে এড়িয়ে যাওয়াটায় আমার ভীষণ রাগ লাগে। আমিও হাল ছাড়ি না। দেখতে চাই। সোমার কথা বলার লোক নেই। যদি থাকেও তবে দেখায়নি কেন? আমি জোর করে ওর হাত থেকে ফোনটা নিতে চাইলে ও এমনভাবে রিয়েক্ট করে, যেন ওর সঙ্গে খারাপ কিছু করতে চাইছি আমি। তখন রাগে ছিলাম, ওর ওড়না কিভাবে পরে গেছিল–আমি জানি না। সেসময়ে রিমু আসে।’
একটানা বলে শেষ করে রিহান। অফিসার তীক্ষ্ণ নজরে পরখ করল। ঝুঁকে গিয়ে বলল, ‘রিমুকে কেন বলেছেন, সোমা আপনাকে ফাসাচ্ছে? সহজ সরল নয়?’
রিহান বলে, ‘আমি যেহেতু সোমাকে পছন্দ করতাম তাই ওর দিকে নজর থাকত। ওর একটিভিটি আমার অদ্ভুত লাগত।’
‘যেমন?’
‘ও রাতের বেলা ছাদে উঠত।’
‘এটাই?’
‘একা একা কথা বলত।’
‘আর?’
‘কথাগুলো ভালোবাসার। ও ওর স্বামীকে আদৌ ভালবেসেছিল মনে হয়না।’
‘কেন?’
‘ও লোকটাকে একটুকু পছন্দ করেনি। বিয়ের আগে না করেছিল। কিন্তু কেউ শোনেনি। শুধু এতটুকু নয়, নিজেকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছিল। এসবের কিছুই রিমু জানেনা। রিমু সবসময় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত মেয়ে, বাসায় বলতে গেলে খুব কম থাকে। ও এতোকিছু জানত না। তাই বলেছিলাম ওকে।’
অফিসার মেয়েটি বলল, ‘আচ্ছা আপনি আসুন। আর হ্যা, রিমুকে কিছু বলবেন না। আমিই ওকে জেরা করেছিলাম, ছোট মানুষ। ভয় পেয়ে বলেছে।’
রিহান আচ্ছা বলে গেল। মেয়েটি ভাবতে লাগল। তৎক্ষণাৎ এল ওর সহকর্মী। সব শুনেছে। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কী মনে হয়। ছেলেটি মিথ্যে বলছে, নাকি সত্য রফিক?’
রফিক বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না ম্যাডাম। তবে সত্য লাগছে।’
অফিসার বলল, ‘একটা মেয়েকে রে/ইপ করা হলো অথচ ছেলেটার টের পাবে না? ঘুম এতটাই গভীর হয়?’
রফিক ভাবল। বলল, ‘ম্যাডাম দুটো কারণ হতে পারে। যদি আমরা ধরে নেই, রিহান সত্য বলছে তবে হতে পারে ওইদিন ওকে কিছু খাওয়ানো হয়েছিল, যার দরুণ ও বুঝতে পারেনি কিছু। আরেকটা– সোমার সম্মতিতে সব হয়েছিল। অফিসার মেয়েটি সচকিত হয়। রফিককে বলল, ‘আচ্ছা মেয়েটার ফোনটা কী পেয়েছিলে?’
‘না ম্যাডাম।’
আরও ভাবল অফিসার। তারপর বলল, ‘ওর হাতে লেখা চিরকুট টা ফরেনসিকে পাঠাও। এখন তো মনে হচ্ছে মেয়েটার মধ্যে ঘাপলা ছিল।
পরেরদিন হঠাৎ রিহানের সঙ্গে সোমার ধস্তাধস্তির ভিডিও ভাইরাল হলো অনালাইনে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড়। চাপে পড়ে রিহানকে অ্যারেস্ট করতে হলো। রিহান ওইদিন কেঁদে ফেলল। অফিসারকে বলল, ‘বিশ্বাস করুন, আল্লাহর কসম। আমি কিছু করিনি।’
রিহানের কান্না অন্যরকম ছিল। চোখ দুটোই যেন বলছিল ও কিছু করেনি। অফিসার মেয়েটি বলল, ‘আপনি শান্ত হোন। নির্দোষ হলে আমি আপনার কিছু হতে দেব না। নিজেকে সামলে রাখুন।’
–
কেবিনে বসে অফিসার। রফিক এল। অফিসার চিন্তিত। গতকাল যেটা সমাধান করেছিল, আজকে যেন পাল্টে গেল। অবশ্য প্রমাণিত হলো রিহান দোষী নয়। নাহলে তখনকার ভিডিও হঠাৎ কেন ছাড়া হলো? সেদিন তবে অন্য কেউ ছিল। তখনই মাথায় এল রিমুর কথা। রিমু ছাড়া তো অন্য কেউ ছিল না। রফিক শুনে বলল, ‘এইটুকু মেয়ে কী করবে ম্যাডাম? তাছাড়া মেয়েটির সামনেই পরীক্ষা ছিল। এইটুকু মেয়ের সাহস হবে এত?’ অফিসারের কাছে যথাযথ লাগল কথা। তিনি ভাবতে শুরু করলেন তৃতীয় কে ছিল?
কয়েকদিন কেঁটে যায় কিন্তু ক্লু পায়না। এদিকে রিহানকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। অবস্থা খারাপ। অফিসারের দেখে ভীষণ মায়া লাগল। তারপর সেদিন রফিক হাতে করে নিয়ে এল, ‘ম্যাডাম লেখার ফরেন্সিক। সন্দেহ টা ঠিক ছিল। ওর লেখা নয়, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে লেখা।’
কেটে যায় কয়েকদিন। অফিসার এখনও বুঝতে পারছেন না কিছু। রিহানকে কোর্টে চালান দেয়া হবে শীঘ্রই। রফিক হঠাৎ বলল, ‘ম্যাডাম চলুন রিহানদের বাড়ি যাওয়া যাক।’
অফিসার তাকিয়ে বলল, ‘চলো। যদি কিছু পাওয়া যায়।’
তারপর গেল তারা।
রিমু তখন পড়ালেখা করছিল। নিচে কতকিছু ফেলানো। অফিসার ওর ঘরে ঢুকে বলল, ‘কী অবস্থা তোমার রিমু?’
সহসা রিমু চমকে উঠে। যায় থেকে কলম পড়ে যায়।রিমু বলল তৎক্ষণাৎ, ‘আপনি?’
অফিসার হাসল, ‘তোমাদের অবস্থা দেখতে এলাম।’
রিমু বলে, ‘আমি বলেছিলাম না ভাইয়া দোষী। দেখেছেন ম্যাডাম? ভাইয়া এমন হবে আমি ভাবতে পারিনি।’
অফিসার হাসল, ‘কষ্ট পেও না। কঠিন শাস্তি দেওয়াব।’
রিমু প্রত্যুত্তর করল না। তৎক্ষণাৎ ওর মা ডাকল। নাস্তা পানি দিতে। রিমু ওনাদের বাইরে আস্তে বলে গেল। অফিসার ধীর পায়ে গেলেন, কিন্তু হঠাৎ পায়ে কাগজ আটকে গেল। সে থেমে সরাল। এরপর গেল রিহানের ঘরে। কিছু একটা নিল ও।
আরও দুদিন কাটে। অফিসার রিহানের সঙ্গে দেখা করতে গেল। রিহান আবারও নিজেকে নির্দোষ দাবী করল। অফিসার হেসে বলল, ‘সামনের চমক দেখতে প্রস্তুত হও!’ রিহান উদ্বিগ্ন হয়। বুঝতে পারেনা কিছু।রফিক হাতে ফরেনসিক রিপোর্ট এল। অফিসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করল আবারও। বলল, ‘আগের ফাইল দাও।’
দুটো দেখতেই হাসি ফুটল, ‘ম্যাচ!’
এরপর রফিককে বলে, ‘খোজ নাও ও কোথায়।’
‘ঠিকাছে ম্যাডাম।’
রিমুর দিনকাল বিষণ্ন যাচ্ছে। আবারও প্রাইভেট শুরু করেছে। প্রাইভেট থেকে বেরোল ও। তখন সামনে অফিসারকে দেখে চমকে গেল। অফিসার বলল, ‘হেই রিমু।’
রিমু চমকে উঠল, ‘আপনারা এখানে?’
‘কেসের নতুন মোড় এসেছে। তোমাকে দেখাব। তাই ভাবলাম সরাসরি দেখাই? এসো।’
রিমু স্বাভাবিক ভাবে গেল। রিমু যাওয়ার পরপর অফিসার কোথাও চলে গেলেন। দুজন কনস্টেবল এসে রিমুর হাত ধরল। রিমু কিছুই বুঝতে পারছিল না। তারপর ওকে চেয়ারে বসাল জেলের ভেতর। খানিকক্ষণ বাদে অফিসার এল, ‘রিমু। তোমার এ অবস্থা কে করল?’
রিমু ক্রন্দন গলায় বলল, ‘জানিনা ওনারা কেন আমাকে এভাবে..
আর বলল না। অফিসার হেসে বলল, ‘তোমার মাসুম মুখে কতখানি মায়া!’
অফিসার চেয়ার টেনে বসল, ‘চলো শুরু করা যাক!’
রিমু অবাক হয়, ‘কী?’
অফিসার বলল, ‘রনিকে চিনো?’
রিমু স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার টিচার।’
অফিসার কুটিল হাসল, ‘শুধু তোমার টিচার? সোমার প্রেমিক।’
রিমু চমকে উঠল, ‘কিহ?’
অফিসার আবারও হাসল, ‘তুমি জানো, তোমার ভাইয়া সোমাকে পছন্দ করত?’
রিমু আবারও চমকে উঠল। বলল, ‘তাহলে কী একারণেই ভাইয়া এসব করেছে? আপুর প্রেমিক ছিল, আর ভাইয়া ওকে পছন্দ করতো। একারণেই ভাইয়া… ছিহ, কত নোংরা!’
অফিসার দাঁড়িয়ে রিমুর গাল বুলাল, ‘কতটা সহজ সরম তুমি।’
রিমু কাদল তৎক্ষণাৎ ওর চুল মুঠি করে টেনে ধরল। রিমু ব্যথায় কাতর হয়ে উঠল। অফিসার বলল, ‘এইটুকু মেয়ে, এতটা চালাক চতুর!’
রিমু বলল, ‘কি বলছেন আপনি?’
‘তুমি সোজাসুজি বলবে, নাকি আমাকে বাধ্য করতে হবে?’
রিমু অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
তখন অফিসার রিপোর্টগুলো সামনে এল, ‘মিথ্যে বলে লাভ নেই। সোমার সুসাইড নোট, ও নয় তুমি লিখেছিলে। তাও ওর মৃত্যুর কয়েকদিন আগে। অর্থাৎ সব প্রী প্ল্যানেড ছিল।’
রিমু অস্থির হয়ে উঠল। গলা শুকিয়ে এল। রফিক বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করবে, তোমার জন্য ভালো।’
রিমু অসহায় গলায় আবদার করল, ‘একটু পানি পাওয়া যাবে?’
অফিসার ইশারা করল দিতে। রিমু খেল। অফিসার বলল, ‘এইবার বলো।’
রিমু বলল, ‘জীবনে প্রথমবারের মত প্রেমে পড়লাম।রনি ভাইয়ার। ভীষণ রকমের প্রেম। কিন্তু ওই কালী কী করল? আমার ভালোবাসাকে কেড়ে নিল। রনি ভাইয়ার সঙ্গে আমার আড়ালে প্রেম করতে লাগল।’
অফিসার খটকা খেলেন, ‘থামো! তুমি তো বাইরে প্রাইভেট পড়তে। তবে সেখানে সোমা কিভাবে গেল?’
রিমু হাসল, ‘রনি ভাইয়া একসপ্তাহ আমাকে বাসায় পড়িয়েছিলেন। তারপর তার সময়ের অভাবে, পারেননি।’
‘আচ্ছা, তারপর কী করলে?’
‘ওই কালী ফিসফাস করে আমার ভালোবাসার সঙ্গে কথা বলত, আমার সহ্য হত না। তারপর ওইযে বিয়ের দিন সেদিন আমি বাড়ির কাছে রনি ভাইকে দেখেছিলাম। আমি আরও ক্ষিপ্ত হই। তারপর বাড়িতে গিয়ে ভাইয়া এবং ওই কালীকে দেখি।
সেদিন সারারাত আমি ঘুমাইনি। বাড়িতে একটা ব্রেসলাইট পেয়েছিলাম, ছেলেদের। ওইটা রনি ভাইয়ের। পরেরদিন যখন ওনার কাছে প্রাইভেট পড়তে গেলাম, প্রাইভেট শেষে ওনাকে সরাসরি বললাম ব্রেসলেটের কথা। উনি ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে লাগলেন। তখন আমি আবেগে পরে গেলাম, তার কাছে নিজের ভালোবাসা জহির করলাম। রনি ভাই আমাকে বললেন, তিনিও আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু বলতে পারেননি। সোমা তাকে বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখিয়ে বশে নিয়েছে। আমি রনি ভাইকে বললাম, ছেড়ে দিতে কালিটাকে। রনি ভাই বললেন, পারবেন না–সোমার কাছে তার নাকি কিছু ভিডিও আছে, যেখানে সোমার কিছু নেই ওনার কাছে। তারপর রনি ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, তবে সমাধান কি?
রনি ভাই বললেন, এভাবে সোমাও ভিডিও নিতে হবে। আমার গায়ে লেগেছিল ব্যাপারটা। কিন্তু রনি ভাইয়ের একটুখানি আদুরে কথা, ভালোবাসা যেন আমাকে উন্মাদ করে দিয়েছিল। আমি ঠিকাছে বললাম।
তারপর কেটে যায় আর কয়েকদিন। আমি সোমাকে দেখতাম, মাঝরাতে উঠে কোথাও যায়। মূলত কথা বলতে। আমার রাগ উঠত কালিটার উপর। তারপর আমি চিন্তা করিস সোমাকে ছাদ থেকে ফেলে দেব। এসব ভেবে চিরকুট লিখি সোমার মতন। তারপর রনি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়, রনি ভাই বললেন দ্রুত কিছু করতে হবে। সোমা নাকি তাকে জ্বালাচ্ছে অনেক।
এদিকে সেদিন আমি আম্মু বাজারে যাব, জানতেন রনি ভাই। আমিই জানিয়েছিলাম। বাজার থেকে ফিরে সোমাকে ভীষণ খুশি লাগছিল। আমার বিছানা এলোমেলো। এরপর এমন কিছু একটা চোখে পড়ে, যা আমার পৃথিবী উল্টে দেয়। সেই মুহূর্তেই আমি রনি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। আমার এত পরিমাণে রাগ উঠেছিল বলার বাইরে। রনি ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পরম শান্তি পেলাম। উনি আমাকে বললেন, সোমার ভিডিও করার জন্য সব করেছে। রাস্তা থেকে সরাতে ভালো হবে।
আমি তার কথা বিশ্বাস করলাম। তারপর আমি বাড়ি ফিরলাম। সোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া লাগল। ক্ষিপ্ত হয়ে ওর মুখে বালিশ চেপে ধরি। কিছুক্ষণ বাদে দেখি ও মারা গেছে। আমি মোটেও ওকে মারতে চাইনি।’
অফিসার বলল, ‘আশ্চর্য, কেউ টের পেল না?’
রিমু হাসল, ‘ভাইয়া ঐসময় গোসলে গেছিল। আর আম্মু ঘুমে, আম্মুর ঘুম অনেক গভীর। সহজে টের পান্না কিছু। তাছাড়া আমাদের মধ্যে ঝগড়ায় তেমন চেঁচামেচি ছিল না। সোমার নিজেরও ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। শান্ত ভাবেই। কিন্তু আমার হঠাৎ কী হলো!’
অফিসার বলল, ‘তারপর বলো।’
রিমু বলে, ‘উনি মারা যাওয়ায় আমি ভয় পেয়ে যাই। রনি ভাইকে কল করি। রনি ভাই নিজেও হতভম্ব হয়ে যায় আমার কাজে। তখন আমি নিরূপায় হয়ে তাকে হুমকি দেই, আমি ফাঁসলে তাকেও ফাসাবে। প্রমাণ হিসেবে সোমার ফোন তো আছেই।
রনি ভাই পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হলেন।’
অফিসার ভ্রু কুঞ্চন করলেন, ‘ওয়েট ওয়েট! দিনেরবেলা এল, কারোর চোখে পড়ল না? আর সিসি টিভি ফুটেজে তেমন কোন ছেলেকে দেখিনি।’
রিমু ঠোঁট প্রশস্ত করল, ‘জানতাম। তাই ওনাকে বলেছিলাম অন্য বেশে আসতে। আমাদের বাড়িতে দুধ দিত। মজার বিষয় লোকটা সেদিন আসেনি। সাইকেলে করে আসতো। ওভাবেই আসল রনি ভাই। তারপর উনি আমাকে বলল, প্রাইভেট এ যেতে, উনি করবেন। আমি ভয়ে ছিলাম, বাড়িতে ওনাকে রেখে যাব? কিন্তু উনি এমনভাবে বললেন, যে বিশ্বাস করে চলে গেলাম।’
সঙ্গে সঙ্গে অফিসার থাপ্পড় মারল। পরপর তিনটে। শাণিত গলায় বলল, ‘কিভাবে বেরোল তোর রনি ভাই?’
রিমু বলেনা কিছু। অফিসার আবারও কর্কশ গলায় বলল, ‘বল।’
রিমু বলে, ‘উনি বেরোয় নি, বাড়ির পিছনে ছিলেন। ওখানে অনেক গাছপালা। যখন আত্মহত্যার খবর জানাজানি হয়ে গেল, মানুষ জড় হলো তখনই উনি সাধারণ মানুষ হিসেবে আসেন।’
অফিসার মেয়েটি পানি চাইল রফিকের থেকে। পানি খেয়ে বসল। ঠাণ্ডা মাথায় বলল, ‘তোর টিনেজার প্রেম ই তোকে ধ্বংস করল। তোর ভাইকে কেন ফাসালি?’
রিমুর চোখ দিয়ে পানি পড়ল। ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, ‘ছোট থেকে বাবা মায়ের বেশি আদরের ভাইয়া। ছেলে যে তার। সে দোষ করলে মাফ, কিন্তু.. আমি.. আমি করলে মাফ নেই। কারণ আমি মেয়ে মানুষ। ভাইয়া কত কারণে টাকা নিত, মাঝেমধ্যে না বলে, চুরি করে–অথচ আমাকে মাত্র যাওয়া আসার নির্দিষ্ট টাকা দেয়া হয়! ও রাত করে ফিরলে কেউ কিছু বলেনা। আমার আস্তে একটু লেট হলে, কত কথা শোনানো হয়। পড়াশুনায় ওর তুলনায় আমি ভালো। তবুও ছেলে বলে আমার থেকে ওকে বেশি মূল্যায়ন করা হয়। সারাদিন বাড়িতে বেকার বসে থাকে, আম্মু কিছুই বলেনা। অথচ আমাকে পড়াশুনা থেকে উঠিয়ে , এটা কর ওটা কর। খাবারেও ভেদাভেদের শেষ নেই। একারণে প্রচণ্ড রাগ ছিল আমার। ভাবলাম, সুযোগ পেয়েছি এটাই। ব্যস!’
‘আর ভিডিওটা?’
‘ওট রনি ভাই ওইদিন জানালার ধার থেকে করেছিল।’
অফিসার বলল, ‘তোর ভাই তোকে কতটা ভালোবাসে তুই জানিস? এসব কখনও তাকে বলেছিস?’
রিমু কিছু বলেনা। অফিসার শান্ত হল, ‘এইবার আমি কাহিনী বলি।’
থেমে বলল, ‘তোর রনি ভাই, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তোকে প্রাইভেট পড়ানোর আগে থেকেই ছিল ওদের সম্পর্ক।’
রিমু বিস্ফোরিত নয়নে তাকাল। অফিসার হাসল, ‘তোর সোমা আপু আসলেই সহজ সরল নয়। পরকীয়া ও করত, ওর স্বামী না। ওর স্বামী শুধু বিয়ে করতে চেয়েছিল আরেকটা। এটাকেই বাহানা বানিয়ে ডির্ভোস নিয়েছে। বাকিটা তোর আপু বানিয়ে বলেছে।’
‘কী বলছেন এসব?’
‘রনি আগে ছাত্রলীগ করত। সোমার বাবা রাজনীতি করার দরুণ, ওদের পরিচয়। সোমা কালো হলেও ওদের বিপুল সম্পদে লোভ ছিল তোর রনি ভাইয়ের। ধীরে ধীরে সম্পদের লোভ নারী লোভে পাল্টে যায়। সোমাকে..
ডির্ভোসের পর ওরা দেখা করার জন্যই তোকে পড়ানোর বাহানা বানানো হয়। কিন্তু ওর ভাই যেহেতু সোমাকে পছন্দ করত সবসময় আশেপাশে থাকত, যার কারণে ওদের প্ল্যান ফ্লপ হয়। তারপর বাদ দেয়।’
রিমু কাদল, ‘যদি ওদের সম্পর্ক ই থাকে, তবে রনি ভাই এমন করল কেন? আর সোমা আপুও বা কেন তাকে ব্ল্যাকমেইল করত?’
অফিসার হেসে বলল, ‘ওদের সম্পর্কটাই এরকম। রেষারেষি সবসময়। ঝগড়া লাগে, আবার মিল হয়। মন্যমিলন থাকেই।’
‘আর আপু বিয়ে করল কেন?’
‘ঐযে মন্যমিলন, ঝগড়া। ক্ষোভ থেকে বিয়ে করে। তারপর আবার মিল হয়।
তারপর তোর আপুও বুঝতে পেরেছিল, রনি ওকে ভালোবাসার থেকে অন্য কারণে ওর সাথে আছে। তাই ছাড়তে যাতে না পারে একারণে। সোমা রনিকে অনেক ভালোবাসতো।এখন রনির ভালো লাগত না, পুরোনো হয়েছিল তো।
তুই যখন ভালোবাসার কথা বলেছি, রনির সোনার হাস পাওয়ার মতো মনে হয়েছিল। কচি মেয়ে.. আবার তার প্রতি অসীম প্রেম। ছেড়ে দেবে? রনির পছন্দের শখ জানিস কী? মেয়েদের উপভোগ করা। মেয়েবাজ রনি ভাই মেয়েদের বশে আনতে পারে বটে! তুই ওইদিন বলার পর রনি ভয় পেলেও ভাবল, ভালোই হয়েছে, ওর পিছু ছেড়েছে! তাই বিনিময়ে সোমার ফোনটা নিয়েছিল। ওইদিন যে তোকে যেতে বলেছিল? তুই যাওয়ার পর ও রে/ইপ করেছিল সোমাকে, তারপর ঝুলিয়েছে। চালাকির সঙ্গে সব প্রমাণ মিশিয়ে যায়।’
রিমু কেঁদে ফেলল সশব্দে, ‘উনি কোথায়?’
অফিসার বলল, ‘আমাদের কাছেই আছে। দেখা পাবি।’
রিমু প্রেমে এত বড় ধোঁকা মানতে পারছে না। তার রনি ভাই! অফিসার তখন ডাকল, ‘কনস্টেবল! নিয়ে যাও ওকে?’
রিমু আরও জোরে কাদতে লাগল। যেতে চাইল না। রফিক এগিয়ে আসল, ‘কি সাংঘাতিক ম্যাডাম। এতটুকু মেয়ে প্রেমের জন্য কী না কী করল!’
অফিসার হেসে বলল, ‘প্রেম হলো সর্বনাশের নাম।’
এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সোমার ফোন পায়নি, তারপর থেকে বিষয়টা খুব ভাবাল অফিসারকে। ওর নম্বর জেনে কল লিস্ট বের করল। শেষ কল একটা ছেলের ছিল। রনির। এর সম্পর্কে খোজ নিল অফিসার, জানতে পারল রিমুকে প্রাইভেট পড়াত। এরপর সোমার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে কথা বলে, ওখানেই একটু আধটু জানতে পারে সোমার আসল রূপের সঙ্গে। তারপর সোমার বাবা, অতীত সবকিছুর। সেখান থেকেই জানতে পারে, ওদের সঙ্গে রনির পুরোনো সম্পর্ক। এদিকে রিমুর দিকেও নজর রাখে। প্রাইভেট শেষে রিমু রনির সঙ্গে দেখা করে বিষয়টা জানল। সন্দেহ জাগল, এখানে ঘাপলা আছে। তারপর যেদিন রিমুর বাড়িতে গেল, ওখানে রিমুর লেখা কাগজ নিল। সোমার নোটের সঙ্গে ওর লেখা মিলল। তারপর প্রথমে রনিকে ধরল, এরপর রিমুকে। এতটুকু একটা মেয়ে, আবেগের বশে কী করে ফেলল!
•
আজকে কোর্টে শুনানি হলো। রিহান ছাড়া পেয়েছে। রিমু রনির শাস্তি হয়েছে। রিহান সব শুনে অবাক। যখন অফিসারের থেকে জানতে পারল, ওর প্রতি ওর বোনের ক্ষোভের কথা–ও বিশ্বাসই করতে পারেনি। রিহান বেরিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অফিসার মেয়েটিকে। কেন জানি মনে হয় চেনা চেনা। কাছে গেল, ‘আপনাকে ভীষণ ধন্যবাদ ম্যাডাম।’
সে হাসল, ‘এটা তো আমার কাজ। তবে সাবধানে থাকবেন এবার।’
রিহান মাথা নাড়াল। মেয়েটি যদিও ওর বড় তবে হাসিটা নজরকাড়া। অফিসার চলে যেতে লাগল, তখন রিহান জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নামটা জানা হয়নি।’
অফিসার হাসল, ‘রিয়ানা মেহা।’
তারপর থামল। বলল, ‘মনে পড়ে কিছু?’
অফিসার চলে যাচ্ছেন। রিহান ভাবতে লাগল। নামটা চেনা। মনে করতে করতে নিজেই চমকে উঠল। আরেহ, পাঁচ বছরের সিনিয়র তার। এটা তো সেই মেয়েটা যাকে স্কুল লাইফে পছন্দ করত! রিহান স্কুলের প্রপোজ ছেলে হয়ে কলেজের মেয়েকে প্রপোজ করেছিল, সেই মেয়েটি বলেছিল–’বড় হয়ে এসো, কেমন?’
সেসময়ে মজার ছলে নাকি সত্যিই বলেছিল জানেনা রিহান। তবে এখন কি সেই সময়? রিহান যাবে?
(সমাপ্ত)