#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৫
রুজাইফের বুকের সাথে লেপ্টে থাকা সেঁজুতি একবার মুখ তুলে তাকালো মাত্র তারপরই দিকবিদিকশুন্য হয়ে বাড়ির দিকে ছুটলো। চোখের পলকে বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলো। সেঁজুতির বুকের ভেতরের হৃদযন্ত্র অনবরত ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে। রক্তকনিকা ছুটছে তুমুল বেগে। সে একেবারে দোতলার ঘরে এসে থামলো। দরজা আঁটকে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায় হেলান দিয়ে। চঞ্চল হৃদয় তোলপাড় হচ্ছে, বেসামাল শ্বাসের গতি। শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে অজানা রোমাঞ্চকর অনুভবে। কি হয়ে গেলো এসব? চেনা নেই জানা নেই এমন মানুষের বুকে লেপটে গেলো এভাবে? এমনটাতো সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
কি হয় লোকটা তাদের? মানুষটার সাথে সম্পর্কের নাম জানে না এখনো। যতটুকু শুনেছে তাতে মানুষটা তার সৎ চাচাতো ভাই হবে। ভাইয়ের সাথে এমন পরিস্থিতিতে পড়াটা মোটেও সুখকর না। বাবার কানে গেলে কি হবে তা আন্দাজ করা যায়। সেঁজুতি লজ্জা আর ভয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেলো। সে কি লোকটার সাথে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে? পরক্ষণেই মনকে বুঝ দিলো, বাড়াবাড়ি করলে বেশ করেছে। লোকটা কেন তাদের দালানটাই দখল করলো? তার পছন্দের ঘরটা কেন কেঁড়ে নিলো? এইটুকু সাজা প্রাপ্য লোকটার। না এইটুকু না আরও অনেক সাজা পেতে হবে। যতদিন সেঁজুতির ঘরটা না ছাড়বে ততদিন পর্যন্ত লোকটাকে ঠিকঠাক শ্বাস নিতেও দেবে না সে।
রুজাইফ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক পলকের জন্য চেহারাটা দেখতে পেয়েছিল। চোখ বুঁজতেই স্পষ্ট দেখতে পেলো মেয়েটাকে। তার কাজল কালো চোখে অপার বিস্ময়, ভয় আর লজ্জার মিশেল ছিলো। কে মেয়েটা? সাথে সাথে চোখ খুলে ফেলে রুজাইফ। আড়ষ্ট হয়ে গেলো ভেতর ভেতর। তার তিরিশ বছরের জীবনে এমনটা প্রথম হলো। বিক্ষিপ্ত মনে গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো। নীলা আর কেয়া চুপি চুপি পালাতে যেয়ে ধরা খেয়ে গেলো তার কাছে। রুজাইফ ডাকলো-“তোমরাই বুঝি রত্নপুরের রত্ন? এইজন্য রত্নপুরের এই দশা।”
কেয়া ঝাঁঝালো উত্তর দিতে গিয়ে বাঁধা পেলো। নীলা ওর হাত ধরে টানলো-“আইজ স্কুল লেট। চাচা বাড়িতে আইসা কি করবো কে জানে। তাড়াতাড়ি ঘরে চল।”
বাধ্য হয়ে রুজাইফকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে চলে এলো কেয়া। এই লোকটাকে তো পরে দেখে নেবে সে। খুব মুখ চলে লোকটার। মুখ বন্ধের কাজে কেয়া এক্সপার্ট এটা তো আর জানে না লোকটা। তবে সমস্যা নেই জেনে যাবে শিগগিরই।
রুজাইফ নিজেকে দেখলো। এখন আবার গোসল দিতে হবে তাকে। গাড়ির দিকে তাকিয়ে আফসোস হলো৷ এই গাড়ি পরিস্কার করতে খবর হয়ে যাবে। রুজাইফ আশেপাশে তাকিয়ে ড্রাইভারকে খুঁজলো। এই ছেলে গাড়ি ফেলে গেছে কোথায়? সে থাকলে নিশ্চয়ই গাড়ির এই হাল হতো না।
রুজাইফের ভাবনার মাঝেই ড্রাইভার আজম আলী যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো। কাচুমাচু হয়ে দাঁড়াতেই রুজাইফ গর্জে উঠলো-“কোথায় ছিলে আজম? গাড়ির কি অবস্থা হয়েছে দেখছো? কিভাবে পরিস্কার করবে এখন? দেখো ভেতরে বালু ঢুকেছে কিনা। গাড়ি না চললে তোমার খবর করে ছাড়বো। গাড়ি ফেলে তুমি কোন চুলোয় গেছিলে?”
“স্যার, ভাবছি নাস্তা কইরা আসি। কেবলই গাড়িরথন সরছি আর এরমধ্যে এই কাম হইছে। আমি অহনই পরিস্কার করতেছি।”
“আমি ফ্রেশ হয়ে নামতে নামতে যেন গাড়ি তৈরি পাই।”
বলেই পুনরায় বাড়িতে ফিরে এলো রুজাইফ। ওকে অমন অবস্থায় বাড়িতে ঢুকতে দেখে অবাক হলো ফজিলাতুন্নেছা-“তোর আবার কি হইলো রুজাইফ? এই অবস্থা কে করলো?”
“কে করবে আবার। এসব ফালতু কাজ করার লোকের অভাব আছে নাকি? যত্তসব গেয়ো ফাউল লোকজন।”
বিরবির করতে করতে দোতলায় উঠে এলো। আরেকটা সাদা শার্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। অনেকবার সাবান দিয়ে ঘষার পরও চেহারা লালচে হয়ে আছে। দেখেই আবারও মেজাজের পারদ বাড়ছে তার। এভাবে অফিস গেলে লোকে হা করে তাকিয়ে থাকবে নির্ঘাত। আবারও রুমালে সাবান লাগিয়ে মুখ ঘষতে শুরু করলো সে। এবার মুখ ধোঁয়ার পর খানিকটা সন্তুষ্ট দেখালো। অনেকটাই স্বাভাবিক লাগছে দেখতে। দ্রুত গোসল সেরে কাপড় পরে নিচে নেমে এলো। দিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে দেখলো গাড়ী অনেকটাই পরিস্কার হয়েছে।
“গাড়ি চলে আজম?”
আজম ভিজে গেছে অনেকটা। কাচুমাচু হয়ে জানালো-“চলে স্যার, তয় একটু চেক করা লাগবো।”
পেছনের সীটে বসে মাথা নাড়লো রুজাইফ-“আমাকে কোর্টে নামায় দিয়ে তুমি গাড়ি কোন গ্যারেজে দেখিয়ে এনো।”
“জ্বি স্যার।”
★★★
“মা, রু দাভাই ফোন দিয়েছিলো?”
চোদ্দ বছর বয়সী নাদিয়া নিমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডালে ফোড়ন দিতে দিতে মেয়ের মুখ পানে তাকায় নিপা। কৌতূহলে নাদিয়ার চেহারা ঝলমল করছে। নিমার চেহারা কিছুটা মলিন হলো। মেয়েটা নানাবাড়ি যাওয়া নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড। এখন মানা করলে মন খারাপ হবে। কিন্তু না বলেও উপায় নেই। চুলা থেকে ডাল নামিয়ে মেয়ের দিকে ঘুরলো নিমা-“রুজাইফ ফোন দিয়েছিল কাল রাতে।”
খুশিতে চেহারা চকচক করে উঠলো নাদিয়ার-“কি বললো দা ভাই?”
“বললো তোমাদের জন্য স্কুল খোঁজ করছে। পেলে তখন নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আপাতত ওদিকটা গুছিয়ে নিচ্ছে। একটু সময় লাগবে যেতে।”
নাদিয়ার মন খারাপ হলো-“আমরা গেলেই তো ভালো হতো। দাভাইকে একা একা কিছু করতে হতো না।”
নিমা কড়াইতে তেল দিয়ে মাছ ছাড়তে ছাড়তে বললো-“ওখানে অনেক ঝামেলা নাদিয়া। কে কিভাবে নেবে আমাদের সেসব ভাবতে হবে তো। আমরা গেলে তোর নানু আর রুজাইফ বিপদে পড়ে যেতো। এই চেয়ে এই ভালো, রুজাইফ সব ঠিকঠাক করে আমাদের ডাকবে।”
নাদিয়া মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিলো নিমা ডাকলো-“বাবা কোথায় নাদিয়া? নাহিয়ানকেও ডেকে আনো। দুপুরে খেতে হবে তো।”
খেতে বসে আবারও কথা তুললো নাদিয়া-“মা, চলোনা আমরা নানু মনিকে না জানিয়ে রত্ন পুর চলে যাই।”
“হ্যা মা চলো যাই। নানু মনিকো ছাড়া ভালো লাগছে না এখানে। তাছাড়া ওখানকার স্কুলেই তো পারত হবে তাহলে দেরি করে লাভ কি?”
নাহিয়ান বোনের সাথে তাল দিলো। ওদের বাবা হাশেম মাথা নিচু করে খাচ্ছে আর ওদের দেখছে। নিমা মাথা নাড়ে-“মোটেই না। রুজাইফ বারবার মানা করেছে। ওখানে অনেক ঝামেলা হচ্ছে নাকি।”
হাশেম বড় ঢেকুর ছাড়ে। নিমা চোখ বড় বড় করে তাকাতেই দাঁত বের করে হাসলো-“ও বউ চল যাই। পোলা মাইয়া এতোবার কইতেছে যখন যাই চল৷ কেউ কিছু কইবে না। আমারও আম্মা ছাড়া ভালো লাগতেছে না।”
তিনজনার মুখের দিকে তাকিয়ে নিমা হেসে দিলো-“মা কালকেই গেলো আর আইজ তোমরা এই শুরু করছো? মা যে রাগী, কথা না শুনলে না জানি কি করে।”
“কিছু কবে না। মা আমারে ভালোবাসে। দেখলে খুশি হইবো। রুজাইফও খুশি হইবো দেইখো।”
“আরে না, আমরা একা গেলে রুজাইফ রাইগা যাবে৷ পাগলামি ছাগলামি বুদ্ধি কইয়ো না কইলাম।”
“মা প্লিজ, চলো না।”
দুই ভাইবোন মিনতি করলো-“এখানে একা একা ভালো লাগছে না।”
“তোদের স্কুল নাই? হুদাই কামাই দিবি কা?”
“আরে বউ, চলো যাই। পোলাপান খুশি হইলে আর কি লাগে? চলো চলো। রুজাইফ গাইল দিলে আমি গাইল খামু যাও।”
অগত্যা নিমা মেনে নিলো। হাল ছেড়ে দিয়ে বললো-“শুক্কুরবার যামু লঞ্চে কইরা। ওইদিন রুজাইফের ছুটি থাকবে।”
“ইয়েএএএএএ। হিপ হিপ হুররেএ।”
দুই ভাইবোন লাফিয়ে উঠলো। হাশেম হে হে করে হাসে ছেলেমেয়ের খুশি দেখে। নিমা হাশেমকে দেখে। অল্পতেই আনন্দিত হওয়া হাশেমের বড় গুন। বোকা বোকা কাজকর্ম করা এই মানুষটাকে নিয়ে নিমার ভোগান্তির শেষ নেই। তবুও কেন যেন হাশেমের আনন্দ দেখে তার ভালো লাগে। অকারণে চোখ ভিজে ওঠে।
★★★
বরিশাল সদরে জেলা জজ আদালতের চতুর্থ তলায় নিজের নির্ধারিত কামরার এলো রুজাইফ। চেয়ারে বসতেই একজন এগিয়ে এলো-“সালাম স্যার, আমার নাম মতিন। আমি আপনার অফিস সহকারী।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। বড় স্যার আছেন?”
মতিন পান খেতে খেতে একগাল হাসলো-“স্যার এতো সকালে আসে না। এট্টু অপেক্ষা করতে হবে স্যার।”
রুজাইফ টেবিলের ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে-“জরুরি কোন কেস আছে? না থাকলে আজ আমি বড়স্যারের সাথে দেখা করে চলে যাব।”
মতিন হাসলো-“স্যার, কেসের তো অভাব নাই। এই দেশে বিচারকের অভাবে মামলা মিটমাট হয় না। এই যে আপনার টেবিলে আপাতত দশটা ফাইল রাখা সেগুলো খুব জরুরি তাই রাখছি। এখন আপনে আপনের সুবিধা মতো সময়ে ফাইল ক্লোজ করবেন।”
রুজাইফ বড্ড বিরক্ত হলো। এই লোক তো দেখা যাচ্ছে বেশি কথা বলে। একটা কথা বিপরীতে দশটা বাক্য বলা বাঁচলতার লক্ষন৷ রুজাইফ বললো-“আজ তাহলে কাজ শুরু করবো না। এই এলাকায় আমি একদমই নতুন। সব গুছিয়ে নিতে আজ দিনটা লাগবে আমার।”
“বাসা নিছেন স্যার? কোন এলাকায়? কোন সাহায্য লাগলে আমাকে জানাবেন।”
“রত্নপুর আছি আপাতত।”
“রত্নপুর! এতোদূর কেন স্যার? বরিশাল সদরে সুন্দর সুন্দর বাসা আছে। কাছাকাছি থাকলে আসা যাওয়াতে
সুবিধা হয়।”
মতিন আঙুলের চুনটুকু মুখে চালান করলো। দৃশ্যটা সুখকর লাগলো না রুজাইফের। সে একটা ফাইল টেনে নিয়ে তাতে মুখ গোঁজার আগে বললো-“মতিন, আপনি একটু দেখেন জজ স্যার আসছে কিনা।”
“জ্বি স্যার।”
মতিন বেরিয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো-“স্যার, একটা সালিসি করতে হইবে।”
রুজাইফ ঘাবড়ে গেলো-“কি সমস্যা?”
“এক মেয়ের দুইটা স্বামী। মেয়েটা তাদের একজনকে ডিভোর্স দিতে চায়।”
“এটা কখনো সম্ভব? কি সব বলেন?”
রুজাইফ অসন্তোষ নিয়ে তাকালো। মতিন হেসে দিলো-“স্যর, আপনিতো পুরান মানুষ। পাঁচ বছর চাকরি কইরা ফেলছেন। বিচিত্র সমস্যার অভিজ্ঞতা থাকার কথা তো আপনার।”
“কি হয়েছে তাই বলেন। আচ্ছা বলা লাগবে না। তাদের ডাকেন দেখি কি সমস্যা।”
“আপনে যাইয়া চেয়ারে বসেন স্যার। আমি আসামিদের পাঠাই।”
রুজাইফ আদালতে যেয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পরেই দুইজন ছেলে আর একটা মেয়ে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটার বেশ ভুষা এককথায় চমৎকার। লাল নীলের মিশেলে একটা তাঁতের শাড়ী, লম্বা বেনী করা চুল, আয়ত নয়ন আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ। স্নিগ্ধ কোমল একটা মুখশ্রী। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাও দারুণ স্মার্ট। পাঁচফিট দশ হবে উচ্চতা। নরমাল প্যান্টের সাথে কালো রঙের শার্ট, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। ফর্সা গায়ের রং তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। সম্ভবত রোদে থাকে ছেলেটা। তৃতীয়জনকে দেখলো রুজাইফ। খুব বেশি লম্বা না তবে চেহারায় তাগড়া ভাব। লম্বা গোফ আর ধূর্ত নয়নদ্বয় ঘুরছে সর্বদা। টাইট জিনসের প্যান্টের সাথে পরা লাল শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খোলা। লোমশ বুক দৃশ্যমান। রুজাইফ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“কি সমস্যা?”
তাগড়া যুবক এগিয়ে এলো-“ও কি কবে আমি কই।”
রুজাইফ তাকে থামালো-“ওই বলবে। আপনি বলুন কি সমস্যা। তার আগে নিজের পরিচয় দিন।”
মেয়েটা পাশের জনকে দেখলো। সে ইশারায় মেয়েটাকে আশ্বস্ত করে ইশারা দিলে মেয়েটা মুখ খুললো-“আমার নাম সকাল। পিতা মাজেদুর রহমান। ঠিকানা, ব্যাপারী বাড়ি রত্নপুর।”
চলবে—
©Farhana_Yesmin