যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-০৮

0
26

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৮

রুজাইফ কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই রোমেলার কন্ঠ শোনা গেলো। তাকে নাস্তা খেতে ডাকছে মৃদুস্বরে। নার্ভাস হয়ে সেঁজুতির চোয়াল ছেড়ে দিলো সে। আঙুল উঁচিয়ে শাসায়-“তোমাকে তো আমি পরে দেখে নেব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদায় হও এখান থেকে। আর কখনো যেন না দেখি এ বাড়ির আশেপাশে। না হলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না।”
বলেই রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। সেঁজুতি সেদিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচায়, ‘আমার ঘরে বলে আমি আসবো না। আসবো একশোবার আসবো। কে ঠেকায় এটাও দেখবো।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো। কাল কলেজে যায়নি আজও না গেলে বাবা কি করবে জানে না। ভয়ে ভয়ে বারান্দার দরজায় উঁকি দিলো সেঁজুতি। মা চাচীরা কে কোথায় আছে দেখার চেষ্টা করলো। সে চায়না কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পাক সে এখানে এসেছে। উঁকি দিয়েই সরে এলো। মা চাচী দাদি সবাই উঠোনে। চিন্তায় ঠোঁট কামড়ে ধরলো সেঁজুতি। এখন এতো লোকের মাঝে সে ঘরে ঢুকবে কি করে? তাছাড়া এখন না গেলে তো মা কিছুক্ষণ পর তার খোঁজ করবে। তখন যদি তাকে রুমে না পায় তাহলে? উত্তেজনায় ঘামতে লাগলো সেঁজুতি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার উঁকি দিলো। দেখলো শামসুন্নাহার আর শ্যামলী ঘরে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো পায়ে পায়ে। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে রুজাইফদের বাড়ি থেকে বেরুলো। আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলো লাকির সরে যাওয়ার। দশ মিনিট পার হওয়ার পরও লাকির কোন নড়চড় নেই। অধৈর্য্য হয়ে যাচ্ছে সেঁজুতি। তখনই ভাগ্যক্রমে লাকি ঘরে ঢুকলো কিছু আনতে। এই সুযোগে সেঁজুতি এক ছুটে ও পাশের দালানে পৌঁছে গেলো। কোনরকমে দরজা পার হয়ে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লো। শ্যামলী সবজির বোল হাতে স্টোররুম থেকে আসছিল৷ সেঁজুতিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো-“তুই কই গেছিলি?”
সেঁজুতি নাভার্স হয়ে হাসলো ঠোঁট টেনে-“কই যামু? নামলাম নিচে। কলেজে যাইতে হবে না?”
“ওহহহ। ওগো দুই বইনেরে ডাকোস নাই কেন? স্কুল আছে না ওগো?”
“আচ্ছা ডাকতেছি।” সেঁজুতি হাফ ছেড়ে উপরে উঠতে শুরু করে। শ্যামলী পিছু ডাকে-“শোন, আইজ কোন ঝামেলা করবি না। কাইল রাইতে তোর বাপ রাগ করছে। কলেজ কামাই দিতে না করছে।”
সেঁজুতি মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে দোতলায় উঠে গেলো। শ্যামলী সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মেয়েটা নিজের কামরায় জন্য মনে মনে কষ্টে আছে বোঝে সে। কিন্তু কি করবে মেনে নেওয়া ছাড়া? নিজের ঘরে থাকার শান্তি আবার কবে হবে জানে না।

★★★

পিয়ন এসে খামটা হাতে দিতেই ভ্রু কুঁচকে গেলো মাজেদুরের। খামের উপর প্রেরকের নাম দেখে তার কোঁচকানো ভ্রু আরও কুঞ্চিত হলো। দ্রুত হাতে খাম খুলে কাগজটা বের করলো। কাগজটা পড়তে পড়তে হাত কেঁপে উঠলো তার। তপ্ত হচ্ছে মেজাজ। অসন্তুষ্ট হয়ে চেয়ারে হেলান দিলো। এই কাজ কে করলো আবার?
“ভাইজান, আছেন?”
সাজেদুরের গলা শুনে সাথে সাথে উত্তর দিলো-“আয়।”
সাজেদুর ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসলো। ভাইকে চিন্তিত দেখে জানতে চাইলো-“কিছু হইছে ভাইজান?”
মাজেদুর কাগজটা এগিয়ে দিলো। সাজেদ কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে অবাক নেত্রে ভাইয়ের দিকে তাকালো-“এই কাম কখন হইলো?”
“এখনই।”
“কি করবেন এখন?”
“কিছু করার আছে? যাওয়া লাগবে।”
“এইসব গ্রামের মানুষের কানে গেলে কি হইব বুঝছেন? আমাদের বাড়ির বদনাম, স্কুলের বদনাম। আরও মাইয়া আছে বাড়িতে তাগো বিয়া শাদী।” সাজেদূরের কন্ঠে অসন্তোষ। মাজেদ গুম হয়ে বসে রইলো। সাজেদ বললো-“ভালো উকিল ধরা লাগবে ভাইজান। উকিল ছাড়া কথা কওয়া যাইব না।”
“শম্ভু কাকাকে এট্টু খবর দে। কথা কইয়া দেখি কি কয়।”
সাজেদ মাথা নাড়ে-“আরেকটা খারাপ খবর আছে।”
মাজেদ বাধ্য হয়ে জানতে চাইলো-“কি খবর?”
“ওই পোলাতো জজকোর্টের জজ। সদরে পোস্টিং পাইছে।”
“কস কি?” বিস্ময়ে হতবাক মাজেদ।
সাজেদ মাথা দুলালো-“আমি ওইদিন ইউএনও অফিস গেছিলাম। তারে সেইখানে দেখলাম। পরে খোঁজ নিয়া জানলাম সে জজ হইয়া আইছে এইখানে।”
“তাইলে এখন কি করুম? ওয় তো সবাইরে নিজের ইশারায় নাচাইবো।”
“কি করবো জানি না। তয় প্রচুর ক্ষমতা তার। শুনলাম চাকরির রেপুটেশন অনেক ভালো। আগে ফরিদপুর আছিলো সেইখানে খোঁজ নিয়া দেখছি। সবাই একনামে চেনে।”
মাজেদুর চিন্তিত হয়ে উত্তর দিলো-“বোঝা যাইতেছে অনেক পরিকল্পনা কইরাই এইখানে আইছে। ফজিলাতুন্নেছা সবকিছুর শোধ নিবো লাগে।”
সাজেদ চতুর লোকের মতো হাসলো-“সবারই কোন না কোন দূর্বলতা থাকে ভাইজান। ওগোও আছে। আমাগ উচিত হইবো ওগো দূর্বলতা খুঁইজা বাইর করা।”
সাজেদের কথার নিগুঢ় মানে বুঝতে বেগ পেতে হলো মাজেদের-“কি কইতে চাস?”
“কইতাছি ওগো দূর্বলতা জাইনা রাখুম। ওরা বেশি লাফালাফি করবো তো সেই দূর্বলতায় আঘাত হানমু। বুঝছেন?”
বুঝেছে মাজেদ তবে কেন যেন কোনকিছুতেই কোন ভরসা পাচ্ছে না। বারবার মনেহচ্ছে এই ছেলে তাদের থেকে সবকিছু কেড়ে নেবে। মনকে কোনভাবেই বুঝ দিতে পারছে না৷
“ওই পোলা বলে স্কুলে আইছিলো? কিছু কইছে আপনেরে?”
“হুম, হিসাবের খাতা গুছায় রাখতে কইছে। হেয় নাকি দেখবো।”
চেয়েও টাকার কথাটা বলতে পারলোনা কেন যেন। কেন পারলোনা নিজেও জানে না।

★★★

গতকাল সারাদিন কয়েক জায়গায় ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছিল রুজাইফ। তারপর প্রফেশনাল কিছু পড়ালেখা করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেছিল ঘুমাতে ঘুমাতে। এখন সাতসকালে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বিরক্ত হলো। মাথায় বালিশ দিয়ে পড়ে রইলো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হলো না। নিচ থেকে হইচই এর আওয়াজ বাড়ছে। বালিশ সরিয়ে কান খাঁড়া করলো রুজাইফ। পরিচিত কন্ঠ কানে আসতেই লাফিয়ে উঠে বসলো৷ দরজা খুলে বেরুতেই কেউ তার গলা ধরে ঝুলে পড়লো-“দা ভাই, তোমাকে মিস করছিলাম।”
রুজাইফ বিস্ময়ে বোবা প্রায়। হতবাক হয়ে বললো-“নাদিরা! তুই? কিভাবে?”
নাদিরা রুজাইফের গলা ছেড়ে দিয়ে খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে-“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলো তো?”
“একা কিভাবে এলি!” রুজাইফের বিস্ময়বোধ কাটেনি এখনো।
“পাগল হয়েছ? একা আসবো? মা ছাড়বে? আমরা সবাই এসেছি। তোমাদের মিস করছিলাম তো।”
“ফু মাও এসেছে?”
উত্তর শোনার প্রয়োজন বোধ করলোনা রুজাইফ। লাফিয়ে নিচে নামলো। ফজিলাতুন্নেছা চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে সোফা কাম বেডের উপর নিমা, হাশেম নাহিয়ান। রোমেলা নিমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। নিমার চোখ দুটো ভেজা। ফজিলাতুন্নেছা রুজাইফকে দেখেই অভিযোগ করলো-“তোর ফু মার কান্ড দেখেছিস? একা একা চলে এসেছে এতোদূর।”
রুজাইফ এগিয়ে এসে সালাম করলো ফুপা ফুপুকে-“ফু মা, কিভাবে এলে?”
নিমা রুজাইফের মাথায় হাত রেখে আদর করে-“আর বলিস না। তোরা আসার একদিন পর থেকে এরা আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছে এখানে আসবে বলে। বাধ্য হয়ে আসতেই হলো।”
রুজাইফের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত-“সত্যি বলতে খুব খুশি হয়েছি। যদিও আমি চেয়েছিলাম খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে তোমাদের ডাকবো। কিন্তু এভাবে কেউ আসে? কাল রাতে আমাকে জানাতে পারতে। আমি সবব্যবস্থা করে রাখতাম। না বলে এলে পথে বিপদ হলে কি করতাম বলো তো?”
হাশেম স্বভাব সুলভ সরল হাসি দিলো-“কোন সমস্যা অয় নাই রুজাইফ বাবা। আমরা লঞ্চে আইলাম। ঘাটে নামার পর একটা পোলার লগে দেখা হইলো সেই সব সাহায্য করলো।”
নাহিয়ান খুশিতে লাফিয়ে উঠলো-“ব্রো, জাস্ট চিল। কোন সমস্যা হয়নি আমাদের। বরং আমরা বেশ এনজয় করেছি জার্নিটা৷ জীবনে প্রথমবার এমন জার্নি করলাম আমার তো খুব ভালো লেগেছে।”
রুজাইফ হেসে দিলো-“আচ্ছা ভালো হয়েছে। এখন যা তুই ফ্রেশ হয়ে নে। উপরে দুই নাম্বার ঘরে সবকিছু আছে দেখ।”
নাহিয়ান খুশি হয়ে গেলো। নিজের ব্যাগ নিয়ে উপরে গেলো। নাদিরা উপর থেকে চেচালো-“দা ভাই, কোনার ঘরটা আমার জন্য সাজিয়েছ তাই না? কি দারুণ সুন্দর দা ভাই। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”
রুজাইফ বলতে পারলোনা যে সে ঘরটা সাজায়নি৷ ওর ইচ্ছে ছিলো ওই ঘরটা নিজের মতো সাজিয়ে সে নিজে থাকবে। তবে নাদিয়ার উচ্ছাস দেখে সে চুপ করে রইলো। এমনকি ওই ঘরে থাকার জন্য মানাও করতে পারলোনা। হেসে উত্তর দিলো-“পছন্দ হয়েছে তোর?”
“আলবত হয়েছে। না হয়ে উপায় আছে? আমার দা ভাই নিজে সাজিয়েছে সব বেস্ট জিনিস নিয়ে।”
আরেকজনের রুচির প্রশংসা নিজের নামে নিয়ে খুশি হচ্ছে না রুজাইফ। তার অহমে আঘাত লাগছে ভীষন। কিছু না করতে পেরে উল্টো রাগ হচ্ছে ভীষণ ওই ডেয়ার গার্লের উপর।

চলবে—
©Farhana_Yesmin