#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১৩
সকাল থেকে নাদিরার পেটখারাপ। বারবার বাথরুম করতে করতে দূর্বল হয়ে গেলো মেয়েটা। সকালে রুজাইফ ঘুম থেকে উঠে খবরটা শুনেই দৌড়ে এলো নাদিরার কাছে। নাদিরার চেহারা একদম মলিন হয়ে গেছে এরইমধ্যে। নুমা মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুজাইফ জানতে চাইলো-“কাল ও বাড়িতে কিছু খেয়েছিলি?”
নাদিরা ভয় পেয়ে মাথা নাড়ে। রুজাইফ শান্ত গলায় আবার জানতে চাইলো-“সত্যি করে বল কি খেয়েছিলি?”
নাদিরা মায়ের দিকে তাকালো। নুমা মেয়েকে দেখছে। নাদিরা ঢোক গিললো-“সেঁজুতিপু তেহেরী খাইয়ে দিলো আমি মানা করতে পারিনি।”
“আর?” রুজাইফের কঠোর মুখ চোখ দেখে নাদিরার গলা শুকিয়ে গেলো-“টক মতো কি একটা যেন দিয়েছিল ওই দাদুটা।”
“কতবার করে বলে দিয়েছি যে ও বাড়িতে কিছু খাবি না৷ কথা শুনিসনি কেন?”
রুজাইফ গর্জে উঠতেই নাদিরার শরীর কেঁপে উঠলো ভয়ে। ঠকঠক করে কাঁপছে তার দূর্বল অঙ্গ। কেঁদে দিলো সে-“আর করবো না দা ভাই। এবারের মতো মাফ করে দাও।”
রাগে শরীর কাঁপছে রুজাইফের৷ নিজেকে সামলে নিতে অনেক বেগ পোহাতে হলো। নাদিরাকে শাসাল-“ওই বাড়ির ধারেকাছেও যাবি না। আর কোনদিন যদি শুনেছি তবে…”
ভীত নাদিয়া মায়ের বুকের মধ্যে সেধিয়ে গেলো। নুমা রুজাইফের দিকে তাকালো। রাগে বারবার হাত মুঠি করছে আর ছাড়ছে। নুমা কোমল কন্ঠে সুধায়-“বাদদে রুজাইফ। ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। আমি আর যেতে দেব না ওকে।”
রুজাইফ কিছুটা শান্ত হলো। শান্ত হয়ে বললো-“দেখি কোন ডাক্তার পাই কিনা।”
দুপুর গড়ালের ডাক্তার খুঁজে পাওয়া গেলো না। ছুটির দিন বলে ভালো ডাক্তার একজনও এলাকায় নেই। পেটের ব্যাথায় জ্বর এসেছে নাদিরার৷ সে শুয়ে শুয়ে কোকাচ্ছে। রুজাইফ দেখে নিজে তৈরি হতে গেলো। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা দুপুরে। সব গন্যমান্য মানুষ মানুষ থাকবে বলে রুজাইফকে যেতেই হবে অনুষ্ঠানে। নিচে নামতে গিয়ে টের পেলো নাদিরার ঘরে একটা নতুন কন্ঠের উপস্থিতি। ভ্রু কুঁচকে গেলো রুজাইফের। কন্ঠের মালিককে সে চেনে। চেনে বলেই সোজা ঢুকে গেলো নাদিরার কামরায়। যা ভেবেছিল তাই। সেঁজুতি বসে নাদিরার পাশে-“হইছে কি তোমার? কালকেই তো ঠিক দেখলাম।”
“পেট খারাপ হয়েছে সেঁজুতিপু।”
“বলো কি? কেমনে?”
“নিজে ওর পেট খারাপ বানিয়ে দিয়ে এখন ভনিতা করা হচ্ছে?”
দু’জনই চমকে পিছু ফিরলো। সেঁজুতির নয়নদ্বয় বড় বড় হলো। এই কুংফু পান্ডা কি করছে এখানে? তারপর নজর এলো রুজাইফের পরিপাটি পোশাকের দিকে।
আপাদমস্তক রুজাইফকে জরিপ করে মুখ হা হলো তার। এই কুংফু পান্ডা এসব কি পরেছে? দেখতে তো ফাটাফাটি লাগতেছে পুরাই সিরিয়ালের নায়কদের মতো। বাপরে কি বডি বানাইছে দেখো। এই বেডা যে এতো সুন্দর তা আগে বোঝা যায় নাই কেন? সেঁজুতি মনে মনে রুজাইফের প্রসংশায় পঞ্চমুখ। সে ভ্রু কুঁচকে রুজাইফকে আপাদমস্তক জড়িপ করছে বারবার। রুজাইফের চওড়া বুক, পাঞ্জাবির গুটিয়ে রাখা হাতার ফাঁকে জেগে ওঠা শিরা দেখে ঢোক গিললো। চোখ ফিরিয়ে বারবার দেখছে। রুজাইফ কি বলেছে তা আর মনে থাকলো না তার। না বুঝে জানতে চাইলো-“কি বললেন?”
এদিকে সেঁজুতিকে দেখে মেজাজ সপ্তমে উঠেছে তার। সকাল থেকে যে রাগটা দমিয়ে রেখেছিল সেটাই ফেটে ফুটে বাইরে আসতে চাইছে। তার উপর সেঁজুতি ভোলা ভালা লুক দেখে আরও খুন চাপছে মাথায়। সে দাঁত কিড়মিড় করলো-“কেন এসেছো?”
সেঁজুতি থতমত খেলো-“ওকে নিতে আইছি। আপা পাঠাইলো আমাকে।”
“প্ল্যান কি তোমাদের? ওকে নিয়ে উল্টোপাল্টা খাইয়ে মেরে ফেলবে?”
সেঁজুতি ঠিক বুঝলো না রুজাইফ কি বলতে চাইছে? সে বোকার মতো জানতে চাইলো-“মাইরা ফেলুম! কেন?”
রুজাইফ দু’কদম এগিয়ে এলো। ইশারা করে বললো-“আমাদের শেষ করলে এই সবকিছু তোমাদের হবে।”
এতোক্ষণে কিছু কথা মাথায় ঢুকলো সেঁজুতির। সে বিস্মিত হলো-“পাগল আপনে?”
“নাহ। একদম সুস্থ আছি। কিন্তু পাগল তোমরা, একেবারে সাইকো।”
“কিসব বলতেছেন।” সেঁজুতির মেজাজ চড়ছে। সে দাঁড়িয়ে গেলো উত্তেজনায়। রুজাইফ ওর কাছাকাছি এলো-“কিছুই বোঝ না তাই না? একদমই বোকা? অথচ কাল ওকে ইচ্ছে করে খাইয়ে পেট খারাপ বানিয়ে দিয়েছ। খাবারে কি মিশিয়েছিলে?”
সেঁজুতি হা করে একবার নাদিরাকে দেখলো তারপর রুজাইফকে। চুড়ান্ত বিস্মিত হয়ে বললো-“কি মিশাবো আর কেন? এই নাদিরা তোমাকে আমার প্লেট থেকে খাওয়াছি না? তুমি দেখছো আমি কিছু মিশাইছি?”
নাদিরা মাথা নাড়ে-“দা ভাই সেঁজুতিপু কিছু জানে না। প্লিজ কিছু বলো না আপুকে।”
রুজাইফ এগিয়ে এসে সেঁজুতির হাত চেপে ধরলো জোরে-“ওকে টানছো কেন? ছোট মানুষকে হাত করে আমাদের ক্ষতি করতে লজ্জা করে না? অথচ আমি তোমার বোনের জন্য ভালো চিন্তা করেছি।”
সেঁজুতির হাতে তীব্র যাতনা অনুভব করলো। লোকটার হাত তা না যেন লোহার হাতকড়া। ব্যাথায় মুখচোখ কুঁচকে এলো তার। সে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো কিন্তু রুজাইফের হাত আরও চেপে বসলো তার হাতে। সেঁজুতি দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সয়ে নিতে নিতে বললো-“আমি ওরে হাত করি নাই। সত্যি ভালা পাই তাকে। ওর ক্ষতি কেন করবো?”
রুজাইফের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে-“কেন করবে? তোমাদের আবার ক্ষতি করার কারণ লাগবে? রক্তের মধ্যেই শয়তানি তোমাদের।”
এবার সেঁজুতি চেচিয়ে উঠলো-“সেই রক্ত আপনের গায়েও আছে। তাইলে আপনেও…”
কথা শেষ করার আগেই রুজাইফ ওর গলায় হাত দিয়ে দেয়ালে চেপে ধরলো-“ফের যদি আমার সাথে তোমাদের রক্ত মিলমিশ করার চেষ্টা করেছ আমার চাইতে খারাপ কেউ হবে না।”
সেঁজুতি হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। রুজাইফের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে রইলো সে। সেঁজুতির গলা ছেড়ে দিয়ে হাত ঝাড়লো-“আর যেন ওর আসেপাশে ঘুরতে না দেখি। এখানে আসবে না।”
সেঁজুতি কিছু না বলে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারপর ছুটে চলে গেলো ঘর ছেড়ে। নাদিরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। রুজাইফ তাকাতেই সে চোখ বুঁজে নিলো-“আর যাব না দা ভাই। আমাকে বকো না প্লিজ।”
রুজাইফ চুপ করে থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
★★★
“মা, আমি এই বিয়া করুম না।” নীলা মায়ের হাতটা ধরলো। সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়ের হাতে নাদেরের আনা স্বর্নের চুড়ি জোড়া পরাতে পরাতে লাকির আঁখি দ্বয় সিক্ত হলো জলে-“এই বিয়া ঠেকানোর উপায় নাই রে মা। বিয়া তোরে করতেই হবে।”
নীলা কেদে দিলো নিঃশব্দে। মেরাজ বসে আছে অদূরে চেয়রে। দৃস্টি তার বোনের উপর নিবন্ধিত। পরীক্ষার কারণে আগে আসতে পারেনি। সে গতকালই এসেছে বাড়িতে। এসে বোনের বিয়ের খবর শুনে তার মেজাজ খারাপ হয়েছে। এখন মাকে বলেই ফেললো-“তোমরা এই বিয়েতে রাজি হইলা কেমনে? সকাল আপার ফেলে দেওয়া পোলা আমার বোন জামাই হবে?”
লাকি চোখ মুছে নিলো-“আমরা রাজি হওয়ার কে? নাদের আইসা ঝামেলা করতেছিল তখন ওই জজ আইসা সিদ্ধান্ত দিছে। গ্রামের মুরুব্বিগো সামনে কইছে কথা না মাইনা উপায় আছে?”
“আমার বোনের বিয়া ওই বেটা কেন ঠিক করবে? আব্বা কিছু কয় নাই কেন?”
“বড় ভাই নিজের মাইয়ারে বাঁচাইতে যায়া আমার মাইয়ারে কুরবানি দিলো।”
লাকির কথা শুনে চেচালো মেরাজ-“মানে কি?”
“নাদের সেঁজুতিরে বিয়া করতে চাইছে। সেঁজুতিরে বাঁচাইতে তারা আমার মাইরার গলায় দড়ি পড়াইছে।”
মেরাজের মুখ শক্ত হলো-“দাদী কিছু কয় নাই?”
“তোর দাদীরে তো জানোস। বড় পোলার কথা শুনলে অজ্ঞান হয়।”
লাকির গলার স্বরে শ্লেষ। মেরাজ সমানে পা নাচিয়ে যাচ্ছে। তার মুখচোখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। সে মায়ের দিকে তাকালো-“তুমি কিছু করবা না মা? আমার কিন্তু কিছু ভালো লাগতেছে না?”
লাকির চোখ দুটো জ্বলে উঠে আবার ম্রিয়মান হলো-“এতো চিন্তা করিস না। যা হওয়ার হইতেছে, ভবিষ্যতেও হইবে।”
সকাল খুশি মনে সেজেগুজে বসে আছে। শ্যামলী মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হলো। গালে হাত ছুঁয়ে চুমু দিলো-“মাশাল্লাহ, আমার মাইয়ারে কতো সুন্দর লাগতেছে।”
সকাল লাজুক হাসলো। শ্যামলী মেয়ের পাশে বসলো-“তোর মন খারাপ মারে? এই বাড়িতে আইতে পারবিনা আর।”
সকালের হাসি মুখ ম্লান হলো মুহূর্তেই-“মা, আমি তো এই বাড়ি থিকা দূরে গত এক বছর ধইরা। প্রথম প্রথম কষ্ট হইলেও এখন আর মন খারাপ হয় না মা। সোহান ভালো পোলা মা, আমারে ভালো রাখছে।”
শ্যামলী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“জামাই ভালো হইলে আর কিছু লাগে না রে মা। আল্লাহ তোরে সবকিছু দিক।”
এমন সময় সেঁজুতি ঘরে ঢুকলো। সকাল জানতে চাইলো-“নাদিরা আইলো না?”
সেঁজুতি মন খারাপ করলো-“কালকের খাওন খাইয়া ওর নাকি পেট খারাপ হইছে তাই তোমার স্যার আমারে মেলা কথা শুনাইলো। আমি নাকি নাদিরার মাথা খাইছি। আমরা নাকি তাদের মাইরা ফেলতে চাই সম্পদ দখলের জন্য। অনেক খারাপ খারাপ কথা কইছে আজকে।”
বলতে বলতে কেঁদে দিলো সেঁজুতি। হাতটা তখনও টনটন করছে বেথায়, গলার কাছটা জ্বলছে। সকাল তাকে জড়িয়ে ধরলো-“বাদ দে। বোন অসুস্থ দেইখা মন খারাপ হইছে লাগে। তবে মানুষটা ভালো আছে সেঁজু। চাইলে সে আমারে বিপদে ফেলতে পারতো কিন্তু ফেলে নাই।”
সেঁজুতি চুপ করে রইলো। বোনের কাঁধে মাথা রেখে নাক টানলো। মনে মনে বললো-“এইজন্যই তো কিছু কই নাই কুংফু পান্ডাকে। নাইলে বেডার নাক ফাটায় দিতাম না?”
★★★
হাশেম বড্ড চিন্তিত হয়ে এলোমেলো হাঁটছিল। একবার ভেতর বাড়িতে আসে আরেকবার বাইরে যায়। সে এখানে নতুন তাই সাহস করে বেশিদূর যেতেও পারছে না। কিন্তু তার মধ্যে বড্ড অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা পেটব্যাথায় কাতর হচ্ছে দেখে তার পিতৃ মন শান্ত হয়ে শ্বাস নিতে পারছে না। উপল দূর থেকে দেখছে হাশেমকে। অনেকক্ষণ দেখে শেষ মেস থাকতে না পেরে এগিয়ে এলো-“আপনে কি এই বাড়ির লোক?”
হাশেম তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হাসলো। হাত উঁচিয়ে উপলের দাদার দোতলা দেখিয়ে বললো-“আমি জজের ফুপা হই।”
উপল থমকালো খানিকক্ষণ। ভ্রু কুঞ্চিত করে ভাবলো কিছুক্ষণ। সম্পর্কগুলো বড্ড জটিল হয়ে উঠছে দিন দিন। সে জানতে চাইলো-“আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি ছটফট করছেন। কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন।”
হাশেম মাথা চুলকায়, ইতস্তত বোধ করে মৃদুস্বরে বললো-“মেয়েটার পেট খারাপ। সকাল থিকা বাথরুম দৌড়ায়ে কাহিল হয়ে গেছে। রুজাইফ ডাক্তার খোঁজ করছে তার আসতে বিকাল হবে। ততক্ষণ মেয়েটা কষ্ট পাবে ভাইবে আমার ভালো লাগতেছে না।”
উপল বললো-“আপনে এক মিনিট দাঁড়ান এইখানে আমি আসতেছি।”
সে দৌড়ে ঘরে গেলো। দু’মিনিট এর মাথায় এসে হাশেমের হাতে ওষুধের পাতা ধরিয়ে দিলো-“এই দু’টো ওষুধ খাওয়ান আপনার মেয়েকে। পেট ব্যাথা আর পেট খারাপ দু’টোই ভালো হয়ে যাবে।”
হাশেম অবুঝের মতো মাথা নাড়ে-“রুজাইফ দেখলে বকা দিবে।”
“বকা দিবে কেন? আমি ডাক্তার না হলেই ডাক্তারি পড়ছি। কিছু সাধারন অসুখের ওষুধ সবসময় থাকে আমার কাছে।”
হাশেম তবুও মানলো না-“আপনের কাছ থিকা কিছু নিছি শুনলে রুজাইফ আরও বকবে। ও অনেক রাগী আমরা ভয় পাই ওরে।”
উপল কি বলবে ভেবে পেলো না৷ হাশেমের বোকা বোকা কথা শুনতে মজাও লাগছে। সে বললো-“এক কাজ করেন, আমাকে আপনের রুজাইফের কাছে নিয়ে চলেন। আমি বলে দিলে ওষুধ খেতে সমস্যা নেই তো?”
হাশেম কি ভেবে রাজি হলো। উপলকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই নুমা বললো-‘কারে নিয়ে আইছো?”
হাশেম নুমার কানে ফিসফিস করলো-“ও ডাক্তার। নাদিরাকে ওষুধ দিবে। মাইয়া খাইছে কিছু?”
“উহু, পানি খাইলেও পেট ব্যাথা করতেছে। চলো উপরে চলো। মা আছে ওর কাছে।”
উপলকে নিয়ে নাদিরার রুমে এলো। উপল নজর ফিরিয়ে দেখছিলো সব। এ বাড়ির প্রতিটা ইঞ্চি উপলের চেনা। তাদের আগের ডেকোরেশন কিছু কিছু পরিবর্তন করেছে এনারা৷ উপল চুপচাপ দেখলো সব। সেঁজুতির রুমে এসে দাঁড়ায়। এই কামরাটা একদম অপরিবর্তিত আছে। উপল দেখলো বিছানায় যে মেয়েটা শুয়ে আছে তার চেহারা একদম নেতিয়ে গেছে। তার কাছে বসে আছে একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধা। উপল সালাম দিলো। ফজিলাতুন্নেছা উপলকে দেখে চেয়ে রইলো। একদম সেই চেহারা, গম্ভীর মুখশ্রী। সেদিন হট্টগোলে ছেলেটাকে দেখেছিল কি? ফজিলাতুন্নেছা সালামের উত্তর দিতে ভুলে গেলো।
★★★
অনুষ্ঠানের পুরোটা সময় সেঁজুতি সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে। কিভাবে কুংফু পান্ডাকে শায়েস্তা করবে। আজ বড্ড অপমান করেছে সেঁজুতিকে। এর শোধ তুলতে হবে তো। তাদেরই বাড়িতে থেকে তাকে আসতে নিষেধ করা। এর সাজা তো পেতে হবে ওই পান্ডাকে।
রুজাইফ এখানে খাবে না এটা ঠিক করা থাকলেও অন্যান্য মানুষের সামনে এই কথায় অটল থাকতে পারলোনা। শেষ মেস অনুরোধে ঢেকি গিলতেই হলো। সোহান আর নাদেরকে নিয়ে একসাথে খেতে বসতে হলো তাকে। তাই দেখে সেঁজুতি দুষ্ট হাসি দিলো। মাথা নাচিয়ে বিরবির করলো-“আমাদের খাওন খেয়ে পেট খারাপ হয় বলছিলেন না? পেটখারাপ কারে কর টের পাইবেন বাছাধন।”
খাবার পরিবেশনের সময় সেঁজুতি নিজের হাতে একগ্লাস বোরহানি এগিয়ে দিলো রুজাইফের দিকে। রুজাইফের সন্দেহ হলেও বলার উপায় নেই। ও চুপচাপ তা নিয়ে পাশে রেখে দিলো। ভেবেছিল খাবে না কিন্তু কথা বলতে বলতে কখন সেই বোরহানি তার পেটে চালান হয়েছে কেউ জানে না। টের পেলো হঠাৎ পেট মুচড়ে ওঠার পর। সাথে সাথে বাথরুমের চাপ তীব্র হলো। গুরুত্ব বুঝে রুজাইফ অতি দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। দিগবিদিক শুন্য হয়ে ছুটে বেরুবে এমন সময় কারো সাথে তীব্র সংঘর্ষ। গায়ে হাতে পায়ে গরম কিছুর অস্তিত্ব। তাকিয়ে দেখলো গায়ের উপর গরম মাংসের বাটি পড়েছে। তীব্র জ্বলুনি টের পেলো হাত পা উড়ুতে। সামনে সেঁজুতি বোকার মতো চাহুনি দিয়ে আর্তনাদ করলো-“ও আল্লাহ! কি হইলো এইসব?”
ততক্ষণে সাজেদ মাজেদ সবাই ছুটে এসেছে। রুজাইফ দুইদিকের চাপে দিশেহারা বোধ করলো। উত্তপ্ত নয়নে সেঁজুতিকে ভস্ম করে দিতে চাইলো। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুজাইফ দ্রুত ছুটলো নিজের বাড়ির দিকে। পেছনে সেঁজুতি মুচকি হাসছিল তখন। রুজাইফের অবস্থা দেখে যেন খেলায় জিতে যাওয়ার আনন্দ অনুভব করলো। নিজের হাতটা উঁচিয়ে কব্জির কিছু উপরে লাল হয়ে যাওয়া দাগটা দেখলো। এতক্ষণে যেন তার হাতের ব্যাথাটা কমলো।
চলবে—
© Farhana_Yesmin
#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১৪
দূর্বলতায় তিনদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলো না রুজাইফ। মাত্রারিতিক্ত বার ওয়াশরুম যেতে হয়েছে তাকে। খাবার মুখে তুলতে পারেনি একেবারেই। পানি খেলেও পেটে মোচড় দেয়। সেই সাথে তীব্র জ্বরে বেহুঁশ অবস্থা। এমন অবস্থায় তাকে বাসায় স্যালাইন দিতে হলো। তিনদিন পরে অনেকটা ঠিক হলেও দূর্বলতা রয়ে গেছে। আর চেহারার অবস্থা যাচ্ছে তাই। চোখ দুটো শুকিয়ে কোটরে ঢুকে গেছে। মুখ শুকিয়ে চোয়াল বেরিয়ে এসেছে। গলার স্বরে সেই দূর্বলতা বেশ টের পাওয়া যায়। নাদিরা বড্ড অপরাধী হয়ে ভাইয়ের কাছে বসে-“সরি দা ভাই, আমার জন্য তোমার এমন হলো।”
রুজাইফ সরল হাসি দিলো-“তোর জন্য কেন এমন হবে? আমার বেশি তেলের খাবার সহ্য হয় না জানিস তো। তোর শরীর ভালো হয়েছে?”
নাদিরা উৎফুল্ল হলো-“হ্যা দা ভাই, বাবা একজনকে নিয়ে এলো। সেও নাকি ডাক্তার। তার ওষুধ খেয়ে ভালো হয়ে গেলাম।”
রুজাইফের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“ডাক্তার? তাকে পেলো কোথায় ফুপা?”
“তা জানি না তবে ওষুধে কাজ দিয়েছে। তোমার স্যালাইনের ব্যবস্থাও সে করেছে। সদর থেকে ডাক্তার ডেকে এনে দেখিয়েছে। তোমার জ্ঞান ছিলো না তাই টের পাওনি।”
রুজাইফ বিরক্ত হলো মনে মনে। চেনাজানা নেই কে উপকার করলো? ফুপাকে তো ভরসা হয় না। কাকে না কাকে ধরে এনেছে। এদের নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকে রুজাইফ। সহজ সরল মানুষগুলো কেথা থেকে কি করবে আর ঝামেলায় পড়বে। জানতে হবে কাকে ধরে এনেছিল ফুপা।
তার দু’দিন পরে অনেকটা সুস্থ হওয়ার পর সকালে নাদিরা আর নাহিয়ানকে সাথে নিয়ে বেরুলো রুজাইফ। উদ্দেশ্য নাদিরাকে তার স্কুলে, নাহিয়ানকে কলেজে দিয়ে ও অফিস যাবে। নতুন প্রতিষ্ঠানে দু’জনার প্রথমদিন বলে রুজাইফ সাথে যাচ্ছে। দু’জনার টিচারের সাথে কথা বলে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তবে নিজের কাজে যাবে। ওদের দুই ভাই বোনের পরনে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ড্রেস। ভাগ্যক্রমে সেঁজুতিও ওইসময় কেয়া আর নীলার সাথে বেরিয়েছে। নাদিরাকে দেখে সে লাফিয়ে কথা বলতে গেলো। ওদের কলরব শুনে রুজাইফ গাড়ি থেকে মাথা বের করতেই সেঁজুতি পিছিয়ে এলো। নাদিরাকে ইশারায় পরে কথা বলবে বলে সরে এলো দ্রুত। রুজাইফকে একনজর দেখে মাথা নত করে নিলো। গত কয়দিনে রুজাইফের অবস্থা দেখেছে সে। জানে ভালোমতোই তার কি হাল হয়েছিল। মনে মনে অপরাধবোধে ভুগেছে এটাও মিথ্যে না। ভেবেছে এতোটা নির্দয় না হলেও পারতো। আফটারঅল এই লোকের জন্য তার পরিবার বুবুকে দেখতে পেয়েছে। লোকটা তার বুবুর জীবনের ঝামেলা মিটিয়েছে। আর সে কিনা লোকটাকে উল্টো পাল্টা খাইয়ে পেট খারাপ করিয়ে দিয়েছে? অনুশোচনা থেকেই সে জোর করে ভাইকে পাঠিয়েছে। লোকটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়েছে। আজ যখন রুগ্ন চেহারার রুজাইফকে দেখলো তখন আরেকদফা মন খারাপ হলো। নিজেকে শাসাল, খুব খারাপ করেছিস সেঁজুতি। তুই খারাপ মেয়ে। মন ভরা হিংসা তোর।
সেঁজুতিকে ভদ্র বালিকার মতল চুপচাপ তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে দেখে অবাক রুজাইফ। ভ্রু কুঁচকে ভাবছে এই মেয়ের আবার কি হলো? হুট করে ডেয়ার গার্ল থেকে ভদ্র বালিকাটি সাজলো কেন? সেঁজুতি যেতে যেতে পিছু ফিরলো একবার। তাতেই রুজাইফের সাথে চোখাচোখি হলো। বড্ড অসস্তি বোধ হলো রুজাইফের। ওরকম শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট সেঁজুতিকে হজম হচ্ছে না তার। কিছু একটা গড়বড় আছে ওর মধ্যে। নাদিরাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। থাকগে, যা খুশি হোক ওই মেয়ের ওর কি?
★★★
হাশেমের সময় কাটে না। অপরিচিত এলাকা বলে আগের মতো ঘুরে বেড়ানো হয় না। ঘরেই বা কতক্ষণ থাকা যায়। তাই মাঝে মাঝে আশেপাশে ঘুরে দেখতে বেরোয়। খুব বেশি দূর যাওয়ার সাহস তার নেই৷ সে ভুলোমনা। ভয় হয় দূরে গেলে পাছে যদি আর বাড়ির পথ চিনে ফিরতে না পারে? সে বাড়ির আশেপাশে চায়ের দোকানে বসে একটু চা খায়, লোকজনের কথা শোনে। তাকে নতুন দেখে অনেকে কৌতুহল প্রকাশ করে, জানতে চায় কোন বাড়িতে থাকে, কি সমাচার। হাশেম রুজাইফের পরিচয় দিলে দোকানীসহ আশেপাশের মানুষ তাকে বেশ সমীহ করে। চায়ের বিল নিতে চায় না। হাশেম বেশ মজা পায় তাতে। পরপর কয়েকদিন যাওয়ার পর এখন মোটামুটি কয়েকজনার সাথে ভালো পরিচয় হয়ে গেছে তার। জ্ঞানী ভাব ধরে নানা বিষয়ে মতামত পেশ করে। লোকে মনযোগ দিয়ে শোনে তার কথা। আজ হুট করে সেই চায়ের দোকানে জাহাঙ্গীর উপস্থিত হলো। দোকানীকে বললো-“কি খবর শ্যামল? তোর দোকান কেমন চলতেছে?”
শ্যামল গদগদ হলো-“আমনেগো দোয়ায় ভালো চলে ভাই। কিছু লাগবো আপনের?”
জাহাঙ্গীর হাশেমের পাশে বসলো-“দে এককাপ চা। বেশি কইরা চিনি আর দুধ মিলায়ে দিবি।”
দোকানে বসে থাকা আরেকজন বললো-“জাহাঙ্গীর ভাই, শুনলাম চাচার পরের পক্ষ ফেরত আইছে? আপনেগো সম্পদের উপর নিজেগো ভাগ নিতে?”
জাহাঙ্গীর রেগে গেলো-“কিসের ভাগ নিব? ভাগ ভইরা দিমু ওগো …. দিয়া। কত কাহিনি করসিলো মনে নাই? আব্বা ওগো ঘাড় ধইরা বাইর করেছিল গ্রাম থিকা।”
“তাইলে যে শুনলাম, চাচা তাগো সম্পদ লিখা দিছে। তারা আপনেগো বাড়িতেই থাকে। ঘর ছাইড়া দিছেন আপনেরা?”
জাহাঙ্গীর এবার উত্তেজিত হয়ে গেলো-“কই পাস এইগুলা কথা? আব্বার কি মাতা খারাপ যে ওগোরে বাড়ি লেইখা দিয়া এইখানে ডাইকা আনবো? আমরাই তাগো থাকতে দিছি। যতই হোক তারাও আমাগো পরিবার, তাগো হক আছে।”
শ্যামল চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা দুলায়-“ঠিক কইছেন ভাই। আর যাই হোক এইডা বালা কাম করছেন। তা তারা থাকবো কয়দিন?”
জাহাঙ্গীর চা নিতে নিতে বললো-“থাকুক যতদিন মনচায়। কতদিন আর থাকবো? শহরে থাকা মানুষ বেশিদিন গ্রামে থাকতে পারে নাকি?”
চা খেতে খেতে হুট করে কাচুমাচু হয়ে বসে থাকা হাশেমকে নজরে পড়ে জাহাঙ্গীরের। নতুন মানুষ দেখে সে জানতে চাইলো-“আপনে কেডা? আগে দেখি নাই আপনারে।”
“জজ সাহেবের ফুপা লাগে উনি।”
জাহাঙ্গীরের হাতের চা ছলকে গেলো। ওই রুজাইফের ফুপা এইটা? ঢোক গিললো জাহাঙ্গীর। এতোক্ষণ যা বললো সবই শুনেছে চুপচাপ? কি চালাক লোক! এসব কথা রুজাইফকে বলে দিলে? চা হাতে নিয়েও জাহাঙ্গীরের গলা শুকিয়ে এলো।
★★★
এখন প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় দেখা হয় ওদের সাথে। সেঁজুতি তার স্বভাব সুলভ চপলতা চেপে রেখে প্রতিদিন চুপচাপ চলে যায় ওদের সামনে থেকে। স্কুল দূরে হওয়ায় বাসায় ফিরতে নাদিরার তিনটে বাজে। কাজেই আগের মতো হুটহাট ওদের ঘরে যেতে পারছে না সেঁজুতি। শুক্র শনিবার রুজাইফ থাকে বলে নাদিরার ধারে কাছে ঘেঁষে না সে। সব ভেবে পড়ালেখায় মন দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, একা একা পড়ায় মন বসানো কঠিন। কেয়া নীলা পারতপক্ষে তার সাথে কথা বলে না। এমনভাব করে যেন নাদেরের সাথে নীলার বিয়েটা সেঁজুতি জোর করে দিয়েছে। আর ছোট চাচার মেয়েটা বয়সে ছোট। ওর সাথে বনবে না সেঁজুতির। বাধ্য হয়ে কলেজের সময়টুকু বাদ দিয়ে সেঁজুতি এখন বেশির ভাগ সময় কাঁচারিঘরে থাকে। উপল আর মেরাজ নেই বাড়িতে। ঘরটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। সেঁজুতি নিজের বইখাতা নিয়ে সারাদিন এখানে থাকে। রাতে শোয়ার সময় হলে কেয়াদের ঘরে চলে যায়। যদিও ওদের সাথে শুতে অসস্তি লাগে ভীষণ। কিন্তু বাধ্য হয়ে শুতে হচ্ছে। অন্তত নিজেদের ঘর তোলা পর্যন্ত এই এ্যাডজাস্টমেন্ট করতেই হবে।
পরিস্থিতি ভেবে রুজাইফের উপর আরেকপ্রস্ত রাগ হলো সেঁজুতির। এই লোকটা আসার পর থেকে তাদের পরিবারে ঝামেলা লেগেছে। বাবা চাচাদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ টের পায়। চাচারাও আগের মতো আদর ভালোবাসা দেখাচ্ছে না। সম্পর্কগুলো কেমন যেন হয়ে গেছে। আচ্ছা, সম্পদই কি সব? দেখতে গেলে রুজাইফরা আসাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সেঁজুতিদের হয়েছে। তবুও সবার নিজেদের অংশ নিয়ে কত চিন্তা। মন খারাপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো সেঁজুতি। তারপর নিচতলায় নেমে এলো। মাজেদ খেতে বসছিল। সেঁজুতিকে দেখে থামলো-“কিছু বলবা আম্মা?”
সেঁজুতি মাথা নাড়ে। মাজেদ মেয়েকে দেখে কাছে ডাকলো। কোমল গলায় জানতে চাইলো-“মন খারাপ?”
“আব্বা, আপা আইবো না? নীলাকে নিয়ে আসলা তোমরা আপাকে আনলানা কেন?”
মাজেদ সেঁজুতির হাত ছেড়ে দিলো-“ওর কথা আর কইয়ো না। সে আর আসবে না এই বাড়িতে। তার কপাল সে পুড়াইছে আমার কি করার আর?”
সেঁজুতি মুখ টিপে দাঁড়িয়ে রইলো। শ্যামলী মেয়ের মুখ দেখে কিছু আন্দাজ করলো-“আর কিছু কবি?”
মাজেদ ভাত মাখতে মাখতে তাকায়-“কি কবি ক। পড়ার টাইমে হুদাই এইখানে খাড়ায় আছোস কেন?”
সেঁজুতি তবুও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো-“ওই বাসায় গেলে কি তোমরা রাগ হবা?”
মাজেদের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“কোন বাসা?”
“ওই দাদীর কাছে। উনি ভালোমানুষ। আদর করে আমারে।”
শ্যামলীর চেহারা ফ্যাকাশে হলো। আড়চোখে শামসুন্নাহার কোথায় আছে দেখে নিলো। ফিসফিসিয়ে বললো-“যা কইছোস আর কইস না। তোর দাদী শুনলে কি করবো জানি না। আর ওরা যতই ভালো হোক ওগো কাছে কেন যাবি? যা পড়তে যা। জ্বালাইস না আর।”
সেঁজুতি মন খারাপ করে চলে গেলো।
★★★
সেদিন আধা বেলা অফিস করে দুপুরে বাসায় ফিরেছে। রুজাইফ। রাতের গাড়িতে তাকে ঢাকায় যেতে হবে কিছু বিশেষ কাজে। সেজন্যই আগে ফেরা। ভাবলো তাড়াতাড়ি যখন ফিরেছে তখন স্কুলটা একটু ঘুরে আসা যাক। সেই ভেবেই স্কুলের দিকে হাঁটছিল। পথে সেঁজুতির সাথে দেখা হলো। সে কলেজ থেকে ক্লাস করে ফিরছে। রুজাইফকে দেখা মাত্রই সেঁজুতি মাথা নিচু করে পাশ কাটাতে চাইলো। রুজাইফের ভ্রু কুচকে গেলো। এই মেয়ে এমন চোরের মতো পালিয়ে গেলো কেন? রুজাইফ পিছু ফিরে ডাকলো সেঁজুতিকে-“এই মেয়ে শোন।”
সেঁজুতি দাঁড়িয়ে গেলো। ঘুরে রুজাইফের দিকে চেয়ে জানতে চাইলো-“আমারে ডাকেন?”
আশপাশে চোখ বুলিয়ে আবার সেঁজুতিতে স্থির হলো রুজাইফের নজর-“আর কেউ তো নেই তাহলে তোমাকেই বলছি।”
সেঁজুতি মুখ বাঁকাল-“এই মেয়ে আবার কেমন ডাক? আপনে শিক্ষিত মানুষ, এই মেয়ে এই ছেলে এসব বলা মানায়? আমার সুন্দর নাম আছে একটা। সেই নাম ধরে না ডাকলে আমি শুনি না।”
রুজাইফের মুখ প্রথমে হা হয়ে গেলেও পরক্ষনেই সেঁজুতির চঞ্চল স্বভাবের কথা ভেবে মাথা নাড়লো সে। মনে মনে ভাবছে এই পাগলের নৌকা না নাড়লেই ভালো হতো। সে বললো-“তুমি কি সোজা ভাষায় কথা বলতে পারো না?”
সেঁজুতি যেন আকাশ থেকে পড়লো-“এইখানে কি বেকা কথা বললাম? আমি তো সব সোজা কথাই বললাম।”
রুজাইফ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে-“ফালতু কথা বলে আমার সময় নষ্ট করবে না। আগে বলো তুমি আমাকে দেখলে এমন চোরের মতো পালিয়ে যাও কোন? কি করেছো তুমি? নিশ্চয়ই তুমি কোন দূর্ঘটনা ঘটিয়েছ। কি করেছ বলো।”
সেঁজুতি থতমত খেলো। আমতা আমতা করে বললো-“আমি কবে কি করলাম? তাও আবার আপনার সাথে? করছেন তো আপনে। আমাদের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে বাস্তুহারা করছেন৷ আমাদের থাকা লাগতেছে মানুষের ঘরে।”
রুজাইফ রেগে গেলো-“ফালতু কথা বলবে না একদম। আমি শুধু আমার হকের জিনিস বুঝে নিয়েছি। তাতে তুমি ঘরহারা হলে আমার কি দোষ?”
সেঁজুতি রেগে মেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“আপনেরই দোষ।”
রুজাইফ হেসে দিলো। মুচকি হেসে বললো-“দোষ তোমার দাদাজানের। কিছু বলতে চাইলে তাকে বলো। আমার তো এখনও অনেক কিছু নেওয়া বাকি। তোমার দাদাজান যা দিয়ে গেছে তারমধ্য কেবল বাড়িটা নিয়েছি তাতেই এতো গা জ্বালা করছে? যখন সব নিয়ে নেব তখন কি করবে? এই যে স্কুল, আরও বাড়িঘর, জমিজমা এসব তো আমার।”
সেঁজুতি রেগে গেলো-“কিছু নিবেন না আপনে। এইসব আমার আব্বা অনেক কষ্ট কইরা তৈরি করছে, এতো বছর ধরে দেখভাল করছে। আজকে আপনে হুট করে আইসা সবকিছুর মালিক হবেন? আমি তা হইতে দিব না।”
রুজাইফের হাসি থামে না। সেঁজুতির হুমকিকে অল্প বয়সের প্রলাপ মনেহচ্ছে। সে বাঁকা হাসলো-“বটে! তোমার হুমকিতে আমি খুব ভয় পেয়েছি। ওমাগো, কি করবে তুমি? আমাকে মেরে ফেলবে?”
সেজুতর রাগগ বাড়লো। হিসহিসিয়ে বললো-“দরকার লাগলে তাই করবো।”
রুজাইফ সেঁজুতির হুমকি হেসে উড়িয়ে দিলো-“বেশ, আমিও দেখবো। তুমি কিভাবে আমাকে ঠেকিয়ে রাখো।”
সেঁজুতির ভস্ম করে দেওয়া দৃষ্টির বিপরীতে রুজাইফের বাচ্চামেয়েকে দেওয়া প্রশ্রয়ের হাসিটা দুপুরের কড়া রোদের মাঝে হঠাৎ বয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ার মতো মিষ্টি আর শীতল লাগছিল।
চলবে—
©Farhana_Yesmin