#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১৭
পরদিন অফিসে গেলো না রুজাইফ। ওকে ডাকতে এসে নুমা অবাক হলো। বিছানায় অসলভাবে গড়াগড়ি দিতে দেখে জানতে চাইলো-“অফিসে যাবি না?”
রুজাইফ ফুমার থেকে মুখ লুকালো যেন-“না ফুমা, আজ এদিকে একটা কাজ আছে। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। ওদের স্কুল কলেজে নামিয়ে দেবে আবার ছুটি হলে নিয়ে আসবে।”
“আচ্ছা।”
নুমা চলে যেতেই আবারও গায়ে কাথা টেনে ঘুমানোর চেষ্টা করলো রুজাইফ। কিন্তু ঘুমটা এলো না। আসবেই বা কেন? কোনদিন বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অভ্যাস নেই তার। সকালে ওঠা, খানিকটা সময় শরীরচর্চা করা তারপর দৈনন্দিন কাজে নেমে পড়া এভাবেই জীবন চলেছে তার। আজ অলসতা করতে চাইলেও শরীর সায় দেবে না। বাধ্য হয়ে খানিকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বিছানা ছাড়লো রুজাইফ। বিছানা গুছিয়ে বাথরুম সারলো। ফিরে এসে অফিস সহকারীকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে রাখলো, অফিসে কোন আপডেট থাকলে যেন তাকে জানায়। তারপর কাপড় পাল্টে হালকা সূরের গান ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে পুশআপ দেওয়া শুরু করলো। অল্প সময়ের মধ্যে ঘেমে নেয়ে একাকার হলো রুজাইফ। বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো। ঘামে ভেজা শরীর অল্প সময়ে শীতল হয়ে গেলো।
অক্টোবরের শেষ বলে একটু একটু ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। রুজাইফ বারকয়েক হাঁচি দিতেই সচকিত হয়ে উঠলো। মাথায় চিন্তা এলো, সিজন চেন্জ হচ্ছে। এইসময় অল্পতেই অসুস্থতা কাবু করে ফেলে। ঘাম নিয়ে বসে থাকা যাবে না। দ্রুত তোয়ালে নিয়ে গোসলে ঢুকলো সে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই শরীর বেশ ঝরঝরে লাগলো সেঁজুতির। মুখ খানিকটা বিস্বাদ লাগলেও পেটে খিদে বোধ হচ্ছে। ঘড়ি দেখে আড়মোড়া ভাঙলো। ক্লাস টাইম পার হয়েছে আগেই। মোবাইলের ক্যামেরায় নিজের মুখটা দেখে নিলো। দাগ বেশ বোঝা যাচ্ছে এখনো। এই দাগ নিয়ে ক্লাসে যাওয়া যাবে না। হতাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো সেঁজুতি। সচরাচর ক্লাস মিস দেয় না সে। আজ বাধ্য হয়ে দিতে হলো। বাবা আবার কি বলবে কে জানে? বললে বলুক। নিজের তো মেরেছে তো সেঁজুতি কি করবে? নিজের দোষ খুঁজে না পেয়ে মনে স্বস্তি এলো তার। ধীরে সুস্থে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো। তার রেখে যাওয়া রুমটা তেমনই আছে। বিশেষ কোন পরিবর্তন করেনি কুংফু পান্ডা। শুধু নতুন একটা আলমারি যোগ হয়েছে যেটাতে নাদিরা কাপড় রাখে। ঘনঘন হাই তুলছে সেঁজুতি। নুমা ঘরে ঢুকলো-“বাহ, উঠে গেছো? জ্বর কেটেছে?”
“হুম কাটছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। রাতে জ্বালাইছি আপনারে।”
নুমা সেঁজুতির কপাল দেখে বসলো ওর সামনে। কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো-“এসব আবার কি কথা? আমার নাদিরার জ্বর হলে করতাম না? তুমিও তো আমার আরেকটা মেয়ের মতোই।”
সেঁজুতির চোখ ছলছল হলো। নুমার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। কি সুন্দর মায়াবী চেহারা মানুষটার। ফর্সা মানুষটার এক মাথা চুল। প্রসাধন বিহীন চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। জোয়ান বয়সে নিশ্চয়ই আরও সুন্দর ছিলেন? সেঁজুতি হুট করে বলে ফেললো-“জানেন আমার না অনেক আফসোস ছিলো একটা ফুপুর জন্য। আমার অনেক বান্ধবীরে দেখছি, ফুপুর বাড়ি বেড়াইতে যায়। ফুপুরা তাদের আদর কইরা অনেক কিছু দেয়। আমারও শখ লাগতো। সবসময় ভাবতাম কেন একটা ফুপগ নাই আমার। আপনে তো আমার ফুপু লাগেন। আমি কি আপনারে ফুপু বইলা ডাকতে পারি?”
সেঁজুতির নিস্পাপ আবদার শুনে নুমার বুকটা মুচড়ে উঠলো। রুজাইফ তাকে কখনো ফুপু ডাকে না। ছোটর থেকেই সে রুজাইফের ফুমা। আজ হুট করে ফুপু ডাক শুনে কেমন যেন লাগে। বুকের কোথাও হাহাকার জাগে। অতীত মনে করিয়ে দেয়। নুমার নয়ন সিক্ত হয়ে ওঠে। সেঁজুতি অস্থির হলো-“আমি কি আপনারে কষ্ট দিয়ে ফেলছি? কান্দেন কেন?”
নুমা চোখের কোলের জল গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নেয়। মাথা নেড়ে বললো-“ডাইকো তোমার যা মন চায়। এখন হাত মুখ ধুইয়া খাইতে আসো। আমি যাই আমার ওনারে খাবার দেই।”
সেঁজুতি খুশি হয়ে গেলো। “এখনি আসতেছি, ফুপু।” বলে লাফিয়ে উঠলো। যেতে যেতে সম্বোধন শুনে নুমার পা আঁটকে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলো সেঁজুতিকে তারপর দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেলো। সেঁজুতি ফুরফুরে মেজাজে দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে চুল পরিপাটি করে রুম থেকে বেরুলো। সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে গেলো। পাশে রুজাইফের কামড়া থেকে মৃদু সুরে গান ভেসে আসছে, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি’। ভীষণ ভালো লাগো সেঁজুতির। অতি কৌতূহলে সেঁজুতি পায়ে পায়ে সেই কামরার দিকে এগুলো। দরজার হাতলে চাপ দিতেই খুলে গেলো দরজা। ভেতরে কাউকে দেখতে পেলো না। সাউন্ড বক্সে গান বাজছে। টেবিলে মোবাইল পড়ে আছে। সেঁজুতি এগিয়ে গেলো। ঠিকই ধরেছে সে। মোবাইলে গান চলছে। রুমে একবার নজর ঘুরিয়ে নিলো। রুজাইফ তো এসময় বাড়ি থাকে না। তাহলে এ ঘরে কো গান শুনছে? সেই সময় খুট করে আওয়াজ হলো। মাথা মুছতে মুছতে রুজাইফ বেরুলো ওয়াশরুম থেকে। সেঁজুতি তাকে দেখে আঁতকে উঠে পিছিয়ে যেতেই রুজাইফ তাকালো। সেঁজুতিকে দেখে তার ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই মেয়ে তার রুমে কি করছে? সেঁজুতির ঘাম ছুটে গেল নগ্ন গায়ের রুজাইফকে দেখে। মেদহীন পেটানো শরীরটা মনোমুগ্ধকর। শরীরে উষ্ণতা অনুভব করতেই সেঁজুতি বারকয়েক ঢোক গিলে চোখ বুঁজে নিলো।
সেঁজুতিকে দেখতেই কাল রাতের স্মৃতি ভেসে উঠলো মনের আয়নায়। রুজাইফ আড়ষ্ট হয়ে গেলো নিজের অজান্তে। সেঁজুতিকে চোখ বন্ধ করতে দেখে নিজের দিকে তাকালো সে। তোয়ালেটা গায়ের উপর ফেলে আলমারি থেকে গেঞ্জি নিয়ে দ্রুত পরে নিলো। কর্কশ কন্ঠে জানতে চাইলো-“আমার রুমে কি করছো?”
সেঁজুতি চোখ বুঁজেই জবাব দিলো-“আপনার রুমে গান বাজতেছিল তাই ভাবলাম অন্য কেউ আসছে নাকি। এইসময় তো আপনে অফিসে থাকেন।”
রুজাইফ তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো-“আমার সারাদিনের সিডিউল মুখস্থ করেছ নাকি?”
সেঁজুতি জবাব দিলো না। রুজাইফ বললো-“চোখ বুঁজে আছো কেন?”
সেঁজুতি লজ্জা পেয়ে কম্পিত কন্ঠে জবাব দিলো-“আপনে কাপড় ছ…”
রুজাইফ ধমকে উঠলো-“চোখ খোল।”
সেঁজুতি সাথে সাথে চোখ মেলে। গেঞ্জি পরিহিত রুজাইফকে দেখে মনে মনে স্বস্তি পেলো। আবার রুজাইফের চোখে চোখ পড়তেই ভয়ে ভীত হলো। কেমন রাগী নয়ন মেলে তাকিয়ে আছে দেখো? বেডাকে কুংফু পান্ডা কি সাধে ডাকি? সবসময় মনেহয় মারামারি করার মুডে থাকে।
“এখানে এসেছ কেন?”
“ভুলে চইলা আসছি। আর আসবো না।” বলেই দরজা খুলে চলে যেতে উদ্যত হয়। রুজাইফ দরজা আঁটকে দিলো। সেঁজুতি চোখ বড় বড় করে তাকায়। রুজাইফ পাত্তা না দিয়ে বললো-“বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছ কেন?”
সেঁজুতি দুঃখী কন্ঠে বললো-“আব্বা মারছে কালকে তাই রাগ কইরা চলে আসছি। দেখেন গালে কেমন দাগ বইসা গেছে। খুব কষ্ট পাইছি।”
সেঁজুতি তার চড়ের দাগ বসে যাওয়া গাল এগিয়ে দেয়। রুজাইফ একনজর দেখে অসস্তি নিয়ে দুই কদম পিছিয়ে যায়। এই মেয়েটা এমন গাধী কেন? কোন ছেলের এতো কাছে আসতে হয় না এটাও বোঝে না। সেঁজুতি কাঁদো কাঁদো হলো-“আব্বা জীবনে কোনদিন আমারে মারে নাই। এই প্রথমবার গায়ে হাত তুললো তাও আপনার জন্য।”
“আমার জন্য!”
আসমান থেকে পড়লো রুজাইফ। সেঁজুতি মুখ বাঁকালো-“তা নয়তো কি? আপনাদের এইখানে আসি দেইখা আব্বার রাগ। সেই রাগে জ্ঞান হারায়ে মারলো।”
রুজাইফ দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“বাবা মানা করার পরও আসো কেন এইখানে?”
সেঁজুতি হাসলো-“ভাল্লাগে। এই বাড়িতেই থাকতাম আগে। তার উপর নাদিরারে ভালা পাই। আপনের দাদী ফুপুরেও ভালা লাগে। নাহিয়ান তো আমার বন্ধু হইয়া গেছে।”
শুনতে শুনতে মুখ ফসকে প্রশ্ন করে ফেললো-“আর আমাকে?”
বলেই বোকা বনে গেলো রুজাইফ। এ কি ধরনের প্রশ্ন করলো সে? মেয়েটা তাকে কি ভাববে? সংকোচে মুখ ফিরিয়ে নিলো। প্রশ্ন শুনে সেঁজুতিও চমকে তাকিয়েছে। বলে কি লোকটা? সে বলেই ফেললো-“আপনেই তো নাটের গুরু। একদম ভালো লাগে না আপনেরে। ওইদিন মেরাজ ভাইরে যে লাত্থি দিছিলেন। আপনারে কোনদিনও ভালো লাগবে না আমার। আপনে আস্ত একটা কুংফু পান্ডা।”
বলেই দরজা খুলে ছুট দিয়ে পালিয়ে গেলো। রুজাইফ রাগতে গিয়েও রাগে না। উল্টো তার ঠোঁটের কোন মিষ্টি হাসিতে ভরে উঠলো।
★★★
জাহাঙ্গীর হাশেমের সাথে খাতির করে ফেলেছে। হাশেম চায়ের দোকানে এলেই কিভাবে যেন জাহাঙ্গীরের কানে খবর চলে যায়। সে তখনই চায়ের দোকানে চলে আসে। হাশেমের সাথে এটা সেটা গল্প শুরু করে। এমন ভাব করে যেন হাশেম খুব বুদ্ধিমান, অনেক জ্ঞানী কথা বলে। বোকা হাশেম তাতেই কপোকাত। এতোদিনের আলাপে জাহাঙ্গীর এটা বেশ ভালো মতোই বুঝেছে হাশেম স্বাভাবিক মানুষের মতো না। বুদ্ধির ঘাটতি আছে বেশ। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ হলো তার। হাশেম কে নাচাতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। ভেবে নিয়েছে, হাশেমকে ব্যবহার করে রুজাইফকে বাগে আনবে। আজ জাহাঙ্গীর চায়ের দোকানে বসে ছিলো আগে থেকে। হাশেম আসতেই জাহাঙ্গীর ডাকলো-“হাশেম বাই, চা খাইয়া চলেন একটু ঘুইরা আসি।”
হাশেম সরল হাসি দেয়-“কই যাইবেন? দূরে যাওয়ার কথা তো গিন্নিরে কয়া আসি নাই। তাড়াতাড়ি না ফিরলে সে রাগ করবে।”
জাহাঙ্গীর তার কাঁধে হাত রাখলো-“আরে তাড়াতাড়ি আসবোনে। এই কাছেই আমাগো জমিতে আলুর চাষ হইছে। আইজ যোগালিগুলা কতদূর কাজ করলো তাই দেখতে যামু। লন যাই। এই যামু আর আমু।”
“দেরি না হইলে চলেন। তাড়াতাড়ি যাইয়া তাড়াতাড়ি ফিরা আসুম।”
জাহাঙ্গীর খুশি হয়ে গেলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো-“চলেন যাই।”
★★★
স্কুল ছুটির পর নাদেরকে দেখে খানিকটা অবাক হলো নীলা। সেদিনের পর থেকে নাদের আসে না। মনে মনে নাদেরকে খুঁজে তার দেখা না পেয়ে মন কিঞ্চিৎ খারাপ হয়েছে তার। অনেকবার ভেবেছে ফোন দেবে নাদেরকে, হালচা জানতে চাইবে। কিন্তু কেন যেন জড়তা কাটিয়ে ফোন দেওয়া হয়নি। আজ নাদেককে দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠলো। তবে সে খুশি জাহির করলো না মোটেও। গম্ভীর মুখে নাদেরের কাছে এসে দাঁড়ায়। নাদেরকে বেশ শুকনো দেখাচ্ছে। ওকে দেখে হাসলো-“কেমুন আছো নীলা?”
“ভালো। আপনে?”
“জ্বর হইছিলো অনেক। ঠান্ডা লাইগা বুকে কফ জইমা গেছিল। হাসপাতালে ভর্তি আছিলাম দুইদিন। ভাবছিলাম তুমি দেখতে যাইবা। কিন্তু যাও নাই।”
নাদেরের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো-“আমি জানতাম না আপনে অসুস্থ। কেউ কয় নাই আমারে।”
নাদের মন খারাপ করে বললো-“তোমার আব্বা আমারে হাসপাতালে দেখতে গেছিল। আমি অবশ্য মানা করছিলাম কিছু কইতে। ভাবলাম এতোদিন আমারে না দেখলে তুমি নিজ থিকা খোঁজ নিবা। কিন্তু আমি ভুল আছিলাম।”
নীলা কি অজুহাত দেবে ভেবে না পেয়ে আমতা আমতা করে-“স্কুলে অনেক চাপ যাইতেছে। পড়ালেখা করে আর সময় পাই না। তাও জানলে অবশ্যই খবর নিতাম।”
“থাক আর মিছা কথা কউনের কাম নাই। এই নাও তোমার জন্য চকলেট কিনছিলাম।”
নীলা সংকোচে হাত বাড়ালো-“কষ্ট করতে গেলেন কেন? শরীর ভালো হইছে এখন? এই রোইদে বাইর হইছেন কেন খামাখাই?”
নাদের বিনা সংকোচে বললো-“তোমারে খুব দেখতে মন চাইতেছিল। না পাইরা চইলা আসছি। তুমি রাগ কইরো না।”
লজ্জায় অধোবদন হলো নীলা-“এমুন কইরা কইতেছেন কেন? আমি কি আইতে মানা করছি আপানরে? বেশি বেশি করেন আপনে।”
নাদের অসহায় হাসলো-“আইতেও তো কও নাই।”
নীলা অতিষ্ঠ হয়ে বললো-“আইসেন আপনে। আসলে কোন ক্ষতি নাই।”
নাদেরের চেহারা উজ্জ্বল হলো-“সত্যি বলতেছ?”
নীলা মাথা দুলাতেই নাদের বিজয়ীর হাসি দেয়-“থ্যাংয়ু। তোমারে না দেখলে কষ্ট হয় মেলা। আমি বিরক্ত করুম না। খালি স্কুল থিকা বাড়ি পর্যন্ত পৌছায় দিব। এর বেশি কিছু না।”
নীলা সলজ্জ হেসে মাথা দুলিয়ে মুখ লুকিয়ে হাসলো।
★★★
আজ স্কুলে যাওয়ার পরিকল্পনা রুজাইফের। শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে। প্রসেসিং কতদূর এগুলো সেটা দেখার ছিলো। কিছু হিসেবপত্র দেখবে ভেবেছে। নতুন বিল্ডিং তোলার জন্য ফান্ড এসেছিল কিন্তু সে কাজ হয়নি। টাকাও লাপাত্তা। অতোগুলো টাকা কোথায় গেলো সেটা খুঁজে বের করতে হবে। রুজাইফ জানে এসব নিয়ে কাজ করতে গেলে পরিনতি সুখকর হবে না তবুও করতে হবে। এটা বেশ ভালো স্কুল, একটু আন্তরিক হলে আরও ভালো করবে বলে তার বিশ্বাস। সেই চিন্তা করে সে স্কুলের ব্যাপারে সিরিয়াস হচ্ছে।
নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে দিদার সাথে দেখা করতে নিচে নামলো। ওইসময় ফোনটা এলো। ফোন এসেছে নাহিয়ানের কলেজ থেকে। ও প্রান্তের কথা শোনা মাত্রই রুজাইফের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে উঠলো। সে অতিদ্রুত জবাব দিলো-“আমি আসছি।”
ফজিলাতুন্নেছা অস্থির হলো-“কার ফোন আছিল রুজাইফ?”
রুজাইফ চিন্তিত হয়ে বললো-“নাহিয়ানের কলেজ থেকে ফোন আসছে। আমাকে ডাকলো।”
ফজিলাতুন্নেছার কপালে চিন্তার রেখা-“কেন? কি হইলো হঠাৎ কইরা?”
“জানি না দিদা। দেখি যেয়ে।”
রুজাইফ দেরি করলো না। দ্রুত জুতো পায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তার খুব টেনশন হচ্ছে নাহিয়ানকে নিয়ে। এখানে নতুন এসেছে। কাউকে চেনে জানে না। তাছাড়া নাহিয়ান লক্ষী ছেলে। পড়ালেখায় মোটামুটি ভালো। ওকে নিয়ে কখনো কমপ্লেন আসেনি। আজ হুট করে ফোন আসলো কেন? কিছু কি করেছে ও?রুজাইফের ভারী চিন্তা হচ্ছে।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১৮
রুজাইফ নাহিয়ানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যায়। নাহিয়ানকে দেখে আঁতকে উঠলো বাড়ির সকলে। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ করা আর সারা গায়ে রক্ত লেগে আছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে, হাতের কয়েক জায়গায় ছিলে আছে। হাশেম ছুটে এলো-“আব্বা, আমার আব্বার কি হইছে রে?”
নুমা আর্তনাদ করে উঠলো-“কি হইছে তোর? ও রুজাইফ কি হইছে ওর? কে মারলো ওরে?”
রুজাইফ ভীষণ রকম গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো-“কলেজে মারামারি করেছে। মাথায় দুটো স্টিচ লেগেছে এছাড়া বাকি সব ঠিক আছে। চিন্তার কিছু নেই ফুমা। বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
হাশেম ডুকরে কাঁদে-“আমার মানিকের গায়ে কেডা হাত দিলো? আমি কোনদিন আমার মানিকরে মারি নাই। কে করলো এই নিষ্ঠুরতা?”
নাহিয়ান বললো-“আব্বা, কিছু হয় নাই আমার। ঠিক আছি আমি।”
“দেখতেছি তো কেমন ঠিক আছোস।”
হাশেমের কথায় নাহিয়ানকে অসহায় দেখালো। রুজাইফের দিকে তাকিয়ে বললো-“ব্রো, আমি কিন্তু কিছু করিনি। ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছিলাম এমন সময় ওই ছেলেটা গায়ে পড়ে এসে ঝামেলা করলো।”
রুজাইফ হাত দেখিয়ে থামালো-“এখন এতো কথা বলার দরকার নেই। যা ঘরে গিয়ে রেস্ট নে। পরে সব শুনবো। ফুমা ওকে নিয়ে যাও।”
নুমার চোখ ছলছল হলো। নাহিয়ানকে ধরতেই ও যখন ব্যাথাময় আওয়াজ করলো নুমা কেঁদে দিলো। কে মারলো তার সোনার টুকরো ছেলেটাকে? নাহিয়ান নরম গলায় মাকে স্বান্তনা দিলো-“মা, কিছু হয়নি আমার। কেঁদো না প্লিজ। গা একটু ব্যাথা আছে ঠিক হয়ে যাবে।”
নুমা আর হাশেম মিলে ধরে নাহিয়ানকে দোতলায় নিয়ে গেলো। নাদিরা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলো। সেও গেলো বাবা মায়ের পিছু পিছু। রুজাইফ কেবল বসে রইলো ফজিলাতুন্নেছার সম্মুখে। তার চেহারায় কঠোরতার আভাস। কপালের শিরা ফুলে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করছে ঘনঘন। ফজিলাতুন্নেছা এতোক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলো। নাতিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করছিল। এখন ডাকলো-“রুজাইফ, কি হইছে? কে মারছে নাহিয়ানরে?”
রুজাইফ তার টকটকে লাল চোখ দুটো নিয়ে তাকাতেই ফজিলাতুন্নেছা ভয় পেলো। যা অনুমান করছে তাই কি? এরা কি জীবনেও শোধরাবে না? নিজেদের পতিত হওয়ার থেকে বেড়িয়ে আসবে না? বড্ড আফসোস হলো তার। বিশ বছর আগে সে আর তার সন্তানেরা কোন ষরযন্ত্র রুখতে পারেনি। এখন সেরকম কিছু হলে রুজাইফ হয়তো যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে। ওদের নিশ্চিন্হ করে ছাড়বে। ফজিলাতুন্নেছা সাবধান করলো-“ভেবে চিন্তে কাজ করিস দাদু ভাই। রাগের মাথায় কোন সিদ্ধান্ত নিস না। মাথা ঠান্ডা কর।”
রুজাইফ বরফ শীতল কন্ঠে উত্তর দিলো-“মাথা আমার ঠান্ডাই আছে দিদা। বলেছিলাম না এরা জাত শয়তান। কোনদিন ভালো হবে না। আজ আরেকবার প্রমান হয়ে গেলো। এইবার তো ওদের শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো।”
ফজিলাতুন্নেছা ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলো-“কি করতে চাস?”
“এমন কিছু যাতে শয়তানি বুদ্ধি মাথায় আসার সাহস না পায়। এদের সম্পদ…”
দরজায় রোমেলা এসে দাঁড়ায়-“সাজেদ আইছে ভাবি। আপনের লগে কথা কইতে চায়।”
ফজিলাতুন্নেছা অবাক হয়ে রুজাইফকে দেখলো। রোমেলাকে জবাব দিলো-“আমার সাথে কি কথা কইবে?”
“জানি না। দরজায় দাঁড়ায় রইছে।”
রুজাইফ উঠে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো। সাজেদ কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুজাইফ শীতল গলায় জানতে চাইলো-“কি চাই? এখানে কেন এসেছেন?”
সাজেদ হাত জোর করলো-“বাবা, আমার ছেলেটা জানতো না ও আপনের ভাই। না জাইনা ভুল কইরা ফেলছে। আপনে ওরে এতো বড় সাজা দিয়েন না। ওর জীবনডা নষ্ট হইয়া যাইবো।”
“সেটা নাহিয়ানকে মারার আগে ভাবা উচিত ছিলো আপনার ছেলের। কতো সাহস, আমার ভাইয়ের গায়ে হাত তোলে। ওইখানে পড়তে গেছে না গুন্ডামী করতে গেছে? যেমন বাবা তেমন ছেলে।”
রুজাইফ গর্জে উঠলো। দোতলা থেকে নুমাসহ সেঁজুতি আর নাদিরা মাথা বের করেছে। বড় চাচাকে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সেঁজুতির চোখ যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে। রুজাইফের গর্জনে সাজেদ কেঁপে উঠলেও দমলো না। অসহায় গলায় বললো-“বাবা, আপনে তো বড় ছোট ভাইয়ের ভুল মাফ করে দেন। আপনের কমপ্লেনটা তুইলা নেন বাবা। ওরে বাইর কইরা দিবে কলেজ থিকা। ওর জীবনডা নষ্ট হবে বাবা। বোঝেন একটু।”
রুজাইফ মাথা নাড়লো-“সব বোঝার দায় আমার? কি মনেহয় আপনাদের? বিশ বছর আগে যা করছেন তাই আবার করবেন? যদি তা ভেবে থাকেন তাইলে বড় ভুল করতেছেন। আপনাদের অস্তিত্ব মাটির সাথে মিশায়া দিব। এই রুজাইফরে চেনেই নাই এখনো।”
সাজেদ নতজানু হলো-“বাবা, মেরাজ ভুল করছে। মাফ কইরা দেন। আমি ওর হইয়া মাফ চাই। এমন কইরেন না বাজান। আপনে কি চান কন। যা চাইবেন তাই দিব তাও আমার পোলার জীবন নষ্ট কইরেন না।”
রুজাইফ উত্তেজিত হয়ে আরও কিছু বলতে চাইছিল। ফজিলাতুন্নেছা ওকে ইশারায় থামতে বললো। রুজাইফ খানিকটা সময় চুপ করে রইলো তারপর বললো-“সম্পদের বাটোয়ারা কইরা আমার অংশ বুঝায়া দিবেন। একমাস সময় দিলাম আপনাদের। এই একমাসের মধ্যে সুন্দর কইরা বিলিবন্টনের কাগজ রেডি করবেন। যদি তা না করেন আমি আমার মতো ব্যবস্থা নিব। তখন আবার আইসা কাঁইদেন না যে আপনাগো পথে বসাইলাম কেন।”
সাজেদ মাথা দুলায়-“আপনে যেমনে কইবেন তেমনই হইব বাবা। আপনে কোন চিন্তা কইরেন না। খালি আমার পোলার নামের অভিযোগ তুইলা নেন। ওর ভবিষ্যতটা রক্ষা করেন আমি আপনের সব কাজ কইরা দিব।”
রুজাইফ একটু নরম হলো না। কঠোর গলায় বললো-“যা বললাম সেই মতো ব্যবস্থা নিতে থাকেন। আমি ওদের কলেজের অধ্যক্ষের সাথে কথা বলবো। আরেকটা কথা এবারের মতো মাফ করলেও এরপর এইরকম কোন ভুল হইলে কোন মাফ হবে না। আপনাদের গোটা গুষ্টিকে বাকীজীবন জেলের ভাত খাওয়াব। আর এইটা কেন হুমকি না। সত্যি সত্যি এমন করবো।”
সাজেদ মাথা দুলায়-“আর ভুল হইবো না।”
“না হলেই ভালো।”
সাজেদ চলে গেলো। যাওয়ার আগে মুহুর্তের জন্য তার নজর গেছিল সেঁজুতির দিকে। দুজনার চোখাচোখি হতেই সেঁজুতি কেমন যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেলো।
★★★
“কি কইলো?”
উদ্বিগ্ন শামসুননাহার জানতে চাইলো। সাজেদ এসে মাথা নিচু করে বসলো। স্তিমিত কন্ঠে সুধালো-“তার ভাগের হিস্যা বুঝাইয়া দিতে কইতেছে। একমাস টাইম দিছে আমাগো। উকিল দিয়া সব হিসাব কিতাব কইরা কাগজ কইরা বুঝাই দিতে কইলো। নাইলে ওয় নিজে করলে আমাগো সমস্যা।”
“হুমকি দিতেছে?” জাহাঙ্গীর বললো।
“তা নয়তো কি? আমি তোগো বারবার কইতেছিলাম উল্টা পাল্টা করিস না। ঝামেলা আমাগোই বেশি হইবো। চুপচাপ আছে থাকতে দে ওরে ঘাটাইস না। তোরা শুনবি না কোন কথা। ওর কি? চাকরি কইরা খায়। সমস্যা আমাগো। আমাগো রুজি রুটি চইলা যাইব।”
মাজেদ আফসোস করলো। সাজেদ দাঁতে দাঁত ঘষে ছেলেকে দেখলো-“এই হারা*মজাদা আর মানুষ পাইলো না। ওরই ভাইরে মারা লাগবে তোর? এতো টাকা খরচ কইরা তোরে শহরের কলেজে ভর্তি করাইছি কি এইসব করার লাইগা?”
মিরাজ মাথা নত করলো-“আমি কি জানি ওইডা হের ভাই? পোলা বেশি ইংরেজি ঝারতেছিল, ভাব নিতেছিল দিছি ডলা দিয়া।”
সাজেদ ছেলেকে মারার জন্য উঠে যেতেই লাকি সামনে এসে দাঁড়ালো। সাজেদ দাঁড়িয়ে থেকে চেচিয়ে উঠলো-“হারা*মজাদা, ডলা দিতে কে কইছে তোরে? বেশি ভাব মারাও? এইদিকে তোমারে কলেজ থিকা বাইর করার ব্যবস্থা করতেছিল৷ জনমের মতো পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার ব্যবস্থা করতেছিল। এই ডলা খাইলে ভালো হইতো খুব?”
মিরাজ জবাব দিলো না। মাজেদ ভাইকে ডাকলো-“থাক বাদ দে। এখন কি করমু তাই ভাবি।”
জাহাঙ্গীর বললো-“আব্বার দলিল মাইনা ওরে সব বুঝায় দিলে তো আমাগো কিছুই থাকে না। আমরা চলুম কি দিয়া?”
“শম্ভু কাকার লগে আলাপ করি। দেখি সে কি কয়।”
মাজেদের কথায় জাহাঙ্গীর বললো-“যাই কন না কেন ভাইজান, এইসব ওরে না দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হইবো। ওরে দিলে আমরা খামু কি? আব্বা কি বুইঝা এমন কাম করলো? আমাগো পথে বসায়া দিলো।”
চাপা দীর্ঘ শ্বাস ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। রুম জুড়ে নিরবতা। মুখে না বললেও সবার মনে একটাই ভাবনা, কি করে এই অনার্থ ঠেকানো যাবে।
★★★
দিন কয়েক বাদে কলেজে যাওয়ার পর সেঁজুতির ডাক পড়লো বাবার কামরায়। ভয়ে ভয়ে গেলো সেঁজুতি। সেদিনের পর বাবার সাথে তার দেখা হয়নি। আজ হঠাৎ কি বলতে অফিসকক্ষে ডাকলো। সেঁজুতি ভেতরে ঢুকতেই বাবার সাথে চাচাকে বসে থাকতে দেখলো। মাজেদ সেঁজুতিকে ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বললো-“ওই বাড়িতে ভালো লাগতেছে?”
সেঁজুতিকে বিহ্বল দেখায়। সত্যি বললে যে বাবার পছন্দ হবে না সেটা সে ভালোই জানে। তাই চুপ করে রইলো। সাজেদ বললো-“আহা ভাইজান, কেমন প্রশ্ন করলেন? ভালো না লাগলে থাকতো নাকি? আচ্ছা সেঁজু মা, একটা কথা ক দেখি। ওরা এইসব সম্পদ টম্পদ নিয়া কথা বলে? আমাগো নিয়া আলোচনা হয়?”
সেঁজুতি মাথা নাড়ে-“না চাচা, আলোচনা করে না। কেউ এইসব নিয়া কোন কথা কয় না। আমি শুনি নাই।”
দুই ভাই চোখাচোখি করলো। সাজেদ বললো-“সেইদিন রুজাইফ কি কইলো সবই তো শুনছোস। ওয় আমাগো সব সম্পদ নিয়া নিতে চায়। এই স্কুল, বাসাবাড়ি, জমিজমা সব নিলে আমরা কই যামু কতো মা? নিজেরা কি খামু আর তোগো কি খাওয়ামু? চিন্তায় শেষ হইয়া যাইতেছি।”
কাঁদো কাঁদো হলো সাজেদ। সেঁজুতি বোকা বনে গেলো। সম্পদের ব্যাপার স্যাপার সে বোঝে না। তাই এসব নিয়ে ভাবনা নেই তার। কিন্তু বাবা চাচাকে চিন্তিত দেখে বুঝলো ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস। সেঁজুতি হুট করে বলে বসলো-“হের লগে বইসা সমঝোতা করলেই হয়। হেরা অতো খারাপ মানুষ নাতো বুঝায়া কইলে বুঝবো।”
সাজেদ চোখ মুছে মাথা নাড়ে-“নাহ বুঝবে না। আমাগো জমি বুঝায় দিতে কইছে রুজাইফ। একমাস টাইম দিছে তারমধ্যে সাতদিন পাড়ও হইয়া গেছে। এখন কেমনে কি করি কতো?”
সেঁজুতি কি উত্তর দেবে ভেবে পেলো না। তিনজনই চুপ করে আছে। সাজেদ বলে বসলো-“একটা কাম করতে পারবি মা? রুজাইফ যখন বাড়িতে থাকবে না তখন ওর ঘরে যাইয়া জমির কাগজ খুঁজবি। পাইলে আইনা দিবি আমাগো। কি পারবি না?”
সেঁজুতির গলা শুকিয়ে গেলো। বাঘের মুখ থেকে খাবার ছিনিয়ে আনার মতো কঠিন কাজ বললেও এতোটা ঘাবড়ে যেত না সে। এ যে সিংহের ঘরে প্রবেশ করে জীবন দেওয়ার মতো পরিস্থিতি। মানা করবে এমন অবস্থাও নেই। বাবা চাচা দু’জন এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা ফাঁসির আসামি, সেঁজুতি তাদের ত্রাণকর্তা। সাজেদ কন্ঠে মধু ঢেলে বললো-“মারে, আমাদের জন্য এইটুকু করতে পারবি না?”
সেঁজুতি মাথা দুলাতেই সাজেদ উৎফুল্ল হয়ে টেবিলে চাপড় দিলো-“এই না হলে আমাদের মাইয়া। আইজ থিকায় কাম শুরু করবি সেঁজু। যখনই সময় পাবি কাগজ খুঁজবি। অন্তত এই স্কুলের কাগজটা পাইলেও আমরা খায়াপইরা বাঁইচা থাকতে পারুম।”
মাজেদ মেয়েকে বললো-“ক্লাসে যা তুই। আর যা করবি সাবধানে করবি। রুজাইফ যেন না বুঝে কিছু।”
সেঁজুতি বাধ্য বালিকার মতে মাথা দুলিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। এরপরের কয়েকটা দিন সেঁজুতি কেবল আনমনা হয়ে থাকে। কিভাবে কি করবে ভেবে কুল পায় না। রুজাইফের ঘরে ঢোকার কথা ভাবলেই তার গলা শুকিয়ে আসে। তবুও একদিন সুযোগ হয়ে গেলো। নাহিয়ানের শরীর ভালো হয়েছে বলে ও কলেজ যেতে শুরু করেছে। সেদিন নাদিরার স্কুলে ডিবেট না কিসের যেন প্রতিযোগীতা বলে আসতে দেরি হবে ওদের। সে কথা শুনেই সেঁজুতি পরিকল্পনা করলো আজ রুজাইফের ঘরে ঢোকার একটা সুযোগ নেবে। যদিও রুজাইফের রুমটা বেশির ভাগ সময় আটকানো থাকে।
কলেজ থেকে ফিরে দ্রুত গোসল খাওয়া সেরে ঘুমের ভান করলো সেঁজুতি। খানিক বাদে পুরো বাড়ি জুড়ে নিরবতা নামতেই সেঁজুতি পা টিপে টিপে রুজাইফের ঘরের সামনে এলো। লক ধরে মোচড় দিতেই দরজা খুলে গেলো। সেঁজুতি পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করে দরজা চাপিয়ে দিলো। বুকটা ধুকপুক করছে তার। বারকয়েক লম্বা শ্বাস নিলো ছাড়লো। নিজেকে ধাতস্থ করে ছুটে এলো টেবিলের সামনে। টেবিলের উপর রাখা ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো খানিকক্ষণ। পড়ে তেমন কিছু পেলো না। নিচের ড্রয়ারটা খোলার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলোনা। এখানেও ড্রয়ারটা লক করা। সেঁজুতি আলমারির কাছে এলো। পাল্লা খুলে কাপড় চোপড় দেখলো। আলমারির ড্রয়ার যথারীতি বন্ধ। ফিরে এলো টেবিলের কাছে। কোমড়ে হাত দিয়ে দেখছে পুরো রুমটা। টেবিলের ড্রয়ারটা দেখলো। এটা খুলতে পারলে বেশ হতো। চাবি কি সাথে নিয়ে গেছে না রুমে রেখে গেছে? সেঁজুতি টেবিলের বই খাতা ফাইলের ফাঁকে ফাঁকে চাবি খুঁজতে লাগলো।
“আমার রুমে কি করছো?”
সেঁজুতির হাত থেকে বই পড়ে গেলো। সে যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেছে, হাত পা কাঁপছে অনবরত। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতেই রুজাইফকে দেখলো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে। চোখে সন্দেহ। সেঁজুতি ঢোক গিলে হাসার চেষ্টা করলো-“আআআমার আসলে গান শুনার ইচ্ছা হইছিল। তাই আপনের সাউন্ড বক্সটা নিতে আসছিলাম। কিন্তু কই রাখছেন খুঁজে পাইতেছি না।”
রুজাইফ এগিয়ে এসে সেঁজুতির একদম কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। তার তীক্ষ্ণ নজর জড়িপ করছে সেঁজুতিকে। আড়ষ্টতায় নজর নামিয়ে নিলো সেঁজুতি। রুজাইফ আরও খানিকটা এগিয়ে এসে ওর বাম বাহুর পাশদিয়ে হাত গলিয়ে দিলো। সেঁজুতির বাম কাঁধ ছুয়ে গেলো রুজাইফের হাত। নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে সেঁজুতির গলার কাছটায়। সেঁজুতির চুল থেকে আসা শ্যাম্পুর ঘ্রানে ক্ষনিকের জন্য মোহগ্রস্ত হয়ে গেলো রুজাইফ। মন চাইলো সেঁজুতির লম্বা চুলে মুখ ডুবিয়ে থাকতে। অনেক কষ্ট নিজেকে সামলে নিলো। এদিকে রুজাইফের এতো কাছে আসাতে গা শিরশির করে উঠলো মেয়েটার। অসস্তিতে চোখ বুঁজে নিলো সে। কিছু একটা এনে চোখের সামনে নাঁচালো রুজাইফ-“এটাই খুঁজছিলে?”
চমকে তাকিয়ে ছোট সাউন্ড বক্সটা দেখলো সেঁজুতি। নার্ভাস হয়ে মাথা নাড়লো জোরে। রুজাইফ গম্ভীর হয়ে ওর হাতে তুলে দিলো সেটা-“অজুহাতটা ভালো ছিলো। নেক্সট টাইম আরও শক্ত অজুহাত দিলে বিশ্বাস করতে সহজ হবে।”
সেঁজুতি চোখ দুটো গোল করে চাইলো-“কিসের অজুহাত? আমি সত্য বলতেছি।”
রুজাইফের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো মুহূর্তের জন্য। শীতল কন্ঠে বললো-“তুমি মেয়ে না হলে এই মুহূর্তে মেরে আধমরা করতাম। নেহাত দিদা মেয়েদের সন্মান করতে শিখিয়েছে।”
সেঁজুতি ভয় পেয়ে গেলো। ওর হাত কাঁপছে সেটা সাউন্ড বক্সের কাঁপুনি দেখে বোঝা যাচ্ছে। রুজাইফ সেদিকে তাকাতেই সেঁজুতি ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলো ঘর থেকে। রুজাইফ পিছু ডাকলো-“এরকম ভুল যেন দ্বিতীয় বার না হয় সেঁজুতি। হলে ভালো হবে না।”
সেঁজুতি জবাব না দিয়ে পড়িমরি করে ছুটলো। রুজাইফের চোয়াল শক্ত হলো হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ। যা অনুমান করেছিল ঠিক তাই হচ্ছে। ওর বিরুদ্ধে এবার এই মেয়েটাকে ব্যবহার করছে ওরা। কতটা নিচ মানসিকতা! তবে এবার রুজাইফও তাল দেবে। দেখবে কতদূর যেতে পারে এরা। এই খেলার শেষ দেখতে চায় সে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin