যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-২৫

0
22

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-২৫

চাঁদ রাতে নাদের এসে হাজির হয়েছে নীলাদের বাড়িতে। তার হাতে একগাদা ব্যাগ। নীলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সামনেই। সাজেদ আর লাকি বেশ খুশি নাদেরকে দেখে৷ নাদের একে একে শশুর শাশুড়ীর হাতে উপহারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে লাজুক কন্ঠে বললো-“আমি পছন্দ কইরা আনছি আম্মা। দেখেন কেমন হইছে।”
লাকি প্যাকেট থেকে শাড়ীটা বের করে দেখলো। নীল আর লালের মিশেলে সুন্দর একটা তাতের শাড়ী। লাকি হাসলো-“অনেক সুন্দর শাড়ী। কিন্তু তুমি খামাখা এতো কিছু করতে গেলা কেন?”
“কি কন আম্মা? বিয়ার পর প্রথম ঈদ কিছু না দিলে কেমনে হয়?”
সাজেদ প্রসন্ন মুখে বললো-“গত পরশু তোমাগো বাড়ি গেছিলাম। তোমারে পাই নাই।”
“মা বলছিল আমারে। কাপড় কিনা দিয়া আইছেন। মা খুশি হইছে।”
নাদের অস্থির চাহুনি দিয়ে নীলাকে দেখলো। সাজেদ আর লাকি উঠে দাঁড়ায়-“ওর লগে কথা কও তাইলে। আর রাইতে খাইয়া যাইও।”
নাদের হঠাৎ সাজেদকে ডাকলো-“আব্বা, একটা কাজের অনুমতি চাই।”
সাজেদ অবাক হয়ে দাঁড়ায়-“কি?”
“নীলারে বাসায় নিয়া যাইতে চাই। বিয়ার পর প্রথম ঈদ, মা কইলো বউরে বাড়িতে নিয়ে আয়। বউ ছাড়া ঈদ হয় কেমনে?”
সাজেদ লাকির দিকে তাকালো। মাথা নেড়ে বললো-“তোমার বউ তুমি নিয়া যাবা আমাগো বলার কি আছে। দেখো ওর লগে কথা কইয়া। ও রাজি থাকলে আমাগো বলার কিছু নাই।”
দুজন চলে গেলে নাদের নীলার দিকে তাকালো। নীলা তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বুক ধুকপুক করছে। নাদের ওকে কাছে ডাকলো-“এইদিকে আইবা একটু?”
নীলা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। নাদের ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিয়ে হাতে প্যাকেটটা দিলো-“দেখো তো পছন্দ হয় কিনা।”
নীলা প্যাকেট খুলে শাড়ীটা বের করলো। সোনালী পাড়ের একটা লাল টুকটুকে শাড়ী। নীলা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো। নাদের ওর কানের কাছে ফিসফিস করলো-“পছন্দ হইছে?”
নীলা বিরবিরিয়ে উত্তর দিলো-“মেলা।”
নাদের নীলার দিকে আবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে থেকে বললো-“কাইলকা সকালে নামাজে যাওনের আগে এই শাড়ী পরা তোমারে দেখতে মন চাইতেছে।”
নীলা চমকে উঠে নাদেরের দিকে তাকায়। দু’জনার চোখাচোখি হলো। নীলা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। তার গাল দুটোয় আবির মাখা হয়েছে যেন।
নাদের মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো-“যাইবা আমার লগে বাড়িতে? বিয়ার পরে প্রথম ঈদ বউ ছাড়া কেমনে করি?”
নীলা লাজুক লতার মতো গুটিয়ে গেলো। মাথা দুলিয়ে মৃদুস্বরে বললো-“যামু। তয় বিকালে আবার চইলা আসুম কিন্তু।”
নাদের চেহারায় আনন্দের হাসি-“আচ্ছা আইসো। মা যে কি খুশি হইবো তুমি জানো না।”
নীলা নত মুখে উঠে দাঁড়ায়-“আমি তাইলে নিজের জিনিস গুছায় নেই।”
“হহ যাও। আমি আব্বা আম্মার লগে কথা কই।”

★★★

ঈদটা ভীষণ আনন্দে কাটলো নাদিরা নাহিয়ানদের। সেঁজুতি সকালে গোসল করে নতুন জামা পড়ে মায়ের হাতের বানানো খাবার খেয়ে নাচতে নাচতে নাদিরাদের ওখানে এলো। বাড়ির পুরুষেরা নামাজে গেছে ততক্ষণে। নাদিরা গোসল সেরে নতুন জামা পড়ে বসে ছিলো মন খারাপ করে। সেঁজুতিকে দেখে ওর মুখে হাসি ফুটলো-“আমি ভেবেছি তুমি আজ আর আসবে না। আমার বুঝি সারাদিন একাই থাকতে হয়।”
সেঁজুতি ওর চিবুক ধরে আদর করলো-“একা থাকবা কেন? আমাগো বাড়ি গেলেই কত মানুষ।”
নাদিরা মাথা ঝাঁকাল-“ভাইয়া যেতে দিবে না।”
সেঁজুতি মুখ বাঁকাল-“রাখো তোমার ভাইয়া। বেডা নিজেরে কি যে মনে করে। তার কথা এতো শোনা লাগবে কেন?”
নাদিরা হেসে দিলো-“এভাবে বলো না আপু। দা ভাই শুনলে কিন্তু আস্ত রাখবে না।”
“ধুর, তারে আমি ভয় পাই নাকি? শুনলে শুনুক। ভাই কি ওইরকম কুংফু পান্ডা হয় নাকি? ভাই হবে আমার ভাইয়ের মতো আদর আদর। কত সুন্দর কইরা বুঝায়, একটুও রাগ নাই।”
নাদিরা মুচকি হাসলো-“একদম ঠিক বলেছ আপু।”
সেঁজুতি আরও উৎসাহী হলে বললো-“আমি ঠিকই বলি। তোমার ওই গুন্ডা ভাই জানে কি শাসন করা ছাড়া? বোনদের যে ভালোবাসা দিতে হয় সেইটাও জানে না।”
“আচ্ছা! তা কেমন ভালোবাসা দেওয়ার কথা বলছো? বলো দেখি। আমিও সেই রকম ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করবো।”
নাদিরা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়েছে। সেঁজুতি চমকে উঠলো। তার চেহারা ফ্যাকাসে। পিছু ফিরে দেখলো রুজাইফ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাত বুকে আড়াআড়ি ভাজ করে রেখেছে। গায়ে অফ হোয়াইট কালার পাঞ্জাবি, মাথায় টুপিতে ভীষণ সৌম্য দর্শন লাগছে তাকে। এই কুংফু পান্ডা কখন এলো? ঢোক গিলে আমতা আমতা করে সেঁজুতি। রুজাইফ ভ্রু নাচালো-“কি হলো বলো? চুপ করে গেলে কেন?”
“আমি নিচে যাচ্ছি। আব্বু আর ভাইয়ার কাছ থেকে সালামি নেব।”
নাদিরা চলে যাচ্ছিল সেঁজুতি ওর হাত ধরে-“চলো আমিও যামু।”
রুজাইফ গম্ভীর হলো-“উহু, তুমি দাঁড়াও। কি বলছিলে বলো।”
সেঁজুতি অসহায় নয়নে নাদিরাকে দেখলো। নাদিরা
সেঁজুতির হাত ছাড়িয়ে চলে গেলো। রুজাইফ এগিয়ে আসতেই সেঁজুতি পেছাল। পেছাতে পেছাতে একদম আলমারির গায়ে সেটে গেলো। রুজাইফ গম্ভীর কন্ঠে সুধায়-“কি হলো? কথা বলছো না কেন? কি যেন বলছিলে নাদিরাকে। বোনদের ভালোবাসতে হয়।”
সেঁজুতি ভয়ে মাথা নাড়ে। রুজাইফ বিরক্ত হয়ে বললো-“আমাকে তুমি ভয় পাও না, তাই না?”
সেঁজুতি মাথা দুলিয়ে সায় জানালো-“পপপাই তো। ভয় পাই। এই দেখেন ভয়ে কথা বলতে পারতেছি না।”
রুজাইফ আপাদমস্তক জড়িপ করলো সেঁজুতিকে। গোলাপি আর নীলের মিশেলে একটা থ্রিপিস তার পরনে। লম্বা চুলগুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। মুখে কোন প্রসাধনী নেই তবুও দেখতে ভালো লাগছে। রুজাইফ সুধায়-“আর কি যেন নাম বলছিলে? কুংফু পা..”
সেঁজুতি হুট করে রুজাইফের গলা ধরে ঝুলে গেলো। ঠোঁট ফুলিয়ে আদুরে কন্ঠে আবদার করলো-“আজকে ঈদের দিন, আজকেও আমাকে বকা দিবেন? আপনি আসলেও কুংফু পান্ডা। না না কুংফু পান্ডা না খরুস পান্ডা। কুংফু পান্ডার মনে দয়ামায়া আছে কিন্তু আপনে নিষ্ঠুর।”
সেঁজুতির কান্ডে রুজাইফ রীতিমতো হচকে গেলো। এই মেয়ে হুটহাট এমন সব কাজ করে হতচকিত করে দেয়। রুজাইফ দরজার দিকে তাকালো। শোরগোল টের পাচ্ছে। দরজা হাট করে খোলা। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হবে। রুজাইফ গলা থেকে সেঁজুতির হাত সরাতে চাইলো-“কি করছো এসব? ছাড়ো গলা ছাড়ো।”
“ছাড়বো না। আগে কন আজকে বকবেন না৷ নাদিরারে আমাদের বাড়িতে নেব। আপনে ওরে বাঁধা দিবেন না।”
নিচ থেকে নুমার গলা পাওয়া যাচ্ছে। ওর নাম ধরে ডাকছে। রুজাইফের হাসফাস লাগে। সে জোর দিয়ে সেঁজুতির হাত সরায়-“আরে কি হলো ছাড়ো বলছি।”
“ছাড়ুম না। আগে অনুমতি দেন।”
পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রুজাইফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে। সে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। সেঁজুতি নির্বিকার। বাধ্য হয়ে রুজাইফ হার মেনে নিলো-“আচ্ছা, নিয়ে যেয় নাদিরাকে। তোমাকেও বকবো না খুশি?”
সেঁজুতি বত্রিশ পাটি বের করে হাসলো-“হাজার টাকা সালামি দেন তাইলে ছাড়ুম।”
রুজাইফ পকেট হাতড়ে টাকা বের করে অতিদ্রুত। সেঁজুতির চোখের সামনে মেলে ধরলো-“এবার ছাড়ো।”
সেঁজুতি হাত পেতে টাকা নিয়ে গলা ছাড়লো। চোখ টিপ দিয়ে রুজাইফের দিকে তাকিয়ে হাসলো-“একটু চালাকি না করলে জীবনে বেঁচে থাকা কঠিন, তাই না জজ সাহেব?”
রুজাইফ যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। কিন্তু সেঁজুতির কান্ডে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। মন চাইছে মেয়েটাকে তুলে আছাড় দেয়। এগিয়ে যেতেই নাহিয়ান ডাকলো-“ব্রো, নিচে সবাই ডাকছে তোমাকে তাড়াতাড়ি এসো। এই সেঁজুতি তুমিও এসো। তোমার ভাই আর বাবা এসেছে।”
রুজাইফ সেঁজুতিকে চোখ দিয়ে শাসিয়ে নিচে চলে গেলো।

★★★

মাজেদের ভীষণ অসস্তি হচ্ছিল নিজের পুরনো বাড়িতে ঢুকতে। মেয়ে সারাদিন এখানেই পড়ে থাকে। এখন ছেলেও কারণে অকারণে এ বাড়িতে চলে আসে। ঈদের নামাজ শেষ করে ছেলের প্রলোভনে পড়ে সেও চলে এলেন রুজাইফদের বাড়িতে। এখন আসার পর বড্ড লজ্জা লাগছে। নুমা প্লেটে খিচুড়ি তুলে দিতে যাচ্ছিল মাজেদ বাঁধা দিলো-“আমি খাবো না। সকালে নামাজ থিকা আইসা আব্বার সাথে খাইতে বসতাম। এইবার আব্বা তো নাই মার সাথে বসুম।”
নুমা কিছু বললো না। প্লেট বেড়ে উপলের দিকে এগিয়ে দিলো-“তুমি খাও। তোমার তো আর সমস্যা নাই।”
উপল মানা করলো না। খাওয়া শুরু করার আগে আশেপাশে তাকালো-“আর কেউ নাই? সবাই খেয়েছে?”
“নাহ, ওরা কেউ খায়নি। রুজাইফ আর নাহিয়ান কেবল নামাজ পড়ে আসলো। আসতেছে মনেহয়।”
উপল মাথা নাড়ে-“সবাই আসুক একসাথে খাই।”
মাজেদ তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ায়-“আমি যাই তাইলে। মা অপেক্ষা করতেছে আমার জন্য।”
ফজিলাতুন্নেছা মাথা দুলাল। মাজেদ হন্তদন্ত হয়ে চলে যেতেই ওরা দোতলা থেকে নামলো। উপলের সাথে কোলাকুলি করলো রুজাইফ আর নাহিয়ান। নাদিরা বাবাকে নিয়ে এলো। উপলকে ঈদ মোবারক জানিয়ে বললো-“আমার সালামি?”
সেঁজুতি এগিয়ে এসে হাত পাতলো-“ভাইয়া, আমার সালামি?”
উপল হেসে দিলো-“সালাম কর আগে।”
সেঁজুতি মুখ বাঁকায়-“করতাম না আগে সালামি দেও।”
“সালাম না করলে সালামি নাই।”
“ধ্যাাৎ, নিতাম না তোমার সালামি। ফুপা, আপনে দেন সালামি।”
সেঁজুতি হাত পাততেই হাশেম একশো টাকা দিলো। নাহিয়ান হাত বাড়ালো-“আমারটা দাও আব্বু।”
হাশেম হেসে একে একে নাহিয়ান, উপল আর রুজাইফকে টাকা দিলো। নাদিরা মুখ ফুলাল-“সবাইকে দিলা আব্বু আমাকে দিলা না। তোমরা আমাকে ভালোই বাসো না।”
হাশেম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করে-“তুমি তো আমার আম্মা হও। তোমারে সবার চাইতে বেশি দিব।”
বলেই দুশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো। নাদিরা খুশি হয়ে লাফিয়ে ওঠে-“ইয়েএএএ।”
নাহিয়ান দশ টাকার নোট এগিয়ে দিলো-“নে আমার তরফ থেকে।”
নাদিরা ঠোঁট ওল্টায়-“এতো কম টাকা আমি নেই না। দা ভাই তুমি দাও।”
রুজাইফ একহাজার টাকা দিতেই নাহিয়ান ছো মেরে কেড়ে নিলো। নাদিরা চেচিয়ে উঠলো-“ভাইয়া, আমার টাকা দাও না হলে খারাপ হবে।”
নাহিয়ান দোতলায় উঠে টাকা দেখাল-“এটা আর পাচ্ছিস না তুই। এটা আমার।”
“মা দেখো।”
নাদিরার চেহারা কাঁদো কাঁদো হলো। উপল মিটিমিটি হাসছিল ভাই বোনের কান্ড দেখে। সে পকেট থেকে হাজারের নোট বেড় করে নাদিরার দিকে এগিয়ে দিলো-“নাও তোমার সালামি।”

★নেক্সট কোন প্রাপ্তি পোস্ট বা রিভিউ না পেলে এই গল্পের পরবর্তী পার্ট লিখতে বসবো না। আপনারা গল্পের পর্ব বাদে বাকি সব পোস্ট ইগনোর করেন। বইয়ের প্রচারনা পোস্ট রিচ পায় না আপনাদের ইগনোরের কারণে। আর কত বলবো ভাই?★

চলবে—
©Farhana_Yesmin