#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৩০
নিস্তব্ধ রাতে চারিদিকে সুনসান নীরবতা। দরজায় খুট করে আওয়াজ হতেই রুজাইফ উঠে বসলো। শিরদাড়া টানটান করে দরজায় তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা মেয়েলী অবয়ব দেখা গেলো। ঘরে ঢুকেই দরজা আঁটকে দিলো সে। রুজাইফের ঠোঁটের কোনে আবছা হাসি। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো-“আমি জানতাম তুমি আসবে। এসো আমার কাছে।”
সেঁজুতি পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। রুজাইফের সামনে দাঁড়ালো নিশ্চুপ। রুজাইফ ওর হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে দিলো। আবছা আলোয় মুখটা দেখলো। ভীত চমকিত মুখে বিষাদের ছায়া। রুজাইফ ওর চিবুক ধরে মুখটা তুলে ফিসফিস করলো-“কি হইছে? এতো চুপচাপ কেন?”
“আপনে এতো রাইতে কেন ডাকছেন আমারে?”
“তুমি তোমার বাবাকে কতটা ভালোবাসো সেটা দেখতেই ডেকেছি।”
সেঁজুতি রুজাইফের দিকে তাকালো। মানুষটা কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। সেঁজুতির বুক টিবটিব করে। সে কম্পিত কন্ঠে বললো-“এতো রাইতে একটা জোয়ান মেয়েকে এইভাবে রুমে ডাকার মানে জানেন? কেউ টের পাইলে আমার কত বদনাম হইবো। আপনে কি কিছুই ভাবেন না?”
রুজাইফ হাসলো-“কিন্তু তোমার দাদী তো এইটাই চায়। তোমাকে আর আমাকে একসাথে রেখে বদনাম করতে।”
সেঁজুতি অবাক হয়ে তাকালো। ওর কান দুটো ঝা ঝা করে উঠলো এমন কথা শুনে। দাদী যখন বলেছিল তখনও এতটা খারাপ লাগেনি। কিন্তু এখন রুজাইফের মুখে কথাটা শুনে ভীষণ লজ্জা লাগলো। সে আঁধারে মুখ লুকালো। রুজাইফ তা টের পেলো বেশ ভালোভাবেই। সে সেঁজুতির কানের কাছে ফিসফিস করলো-“তুমিও দাদীর কথা শুনে আমাকে সিডিউস করেছ অনেকবার। ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ উদ্ধার করতে চেয়েছ। তুমি কি ভেবেছিলে আমি কিছু জানবো না?”
সেঁজুতির মনে হলো মাটি ফাঁক হলে এই মুহূর্তে সে মাটির তলদেশে ঢুলে যেত। এতোটা লজ্জা সে তার জীবনে পায় নি। রুজাইফ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে সেঁজুতির লাজুকতা-“ভাবলাম সবসময় তোমাকে সুযোগ না দিয়ে মাঝে মাঝে নিজেরও সুযোগ নেওয়া উচিত।”
সেঁজুতি নিজেকে বাঁচাতে মরিয়া হলো-“আব্বার জন্য কথা দিছিলাম আপনারে তাই আসলাম। আপনে কিন্তু আমারে ব্লাকমেল করতেছেন?”
রুজাইফ ভ্রু নাচালো-“সত্য! তাহলে তো ব্লাকমেলটা ভালোমতো করা উচিত। বলো, বাবার জন্য কি কি করতে পারবে? নিজের মান সন্মান খোয়াতে রাজি আছো?”
সেঁজুতি ভীত চোখে চাইলো-“কি কন এইসব? মাইরা ফেলতে চান আমারে?”
রুজাইফের মুখের হাসি গায়েব হলো-“মেরে ফেলতে চাইবো কেন? জানতে চাইছি বাবার জন্য কতটা করতে পারবে? দাদীর কথা শুনে এ বাড়িতে থাকছো আমার উপর নজর রাখছো। তাই ভাবলাম বাবার জন্য নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু করতে পারবে?”
সেঁজুতি আমতা আমতা করে-“কি চান কনতো।”
“তোমাকে আমার পাশে চাই। এতদিন দাদীর কথায় অনেক কিছু করেছ এবার আমার কথায় অল্প কিছু করবে। পারবে না?”
সেঁজুতি চুপ করে থেকে বললো-“কেন করমু আপনের জন্য? কে আপনি আমার?”
রুজাইফ হাসলো-“আমার জন্য করবে কারন আমি তোমার বাবাকে বাচিয়ে রাঁখবো। তুমি কি জানো, তোমার দুই চাচা তোমার বাবাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার কথা ভাবছে। আর তাতে তোমার দাদীর সায় আছে।”
সেঁজুতি দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ে-“কোনদিন সম্ভব না। চাচারা আব্বারে অনেক ভালোবাসে। তারা আব্বারে ছাড়া কিছু করব না।”
রুজাইফ কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে থেকে বললো-“যদি করে তাহলে কি করবে?”
সেঁজুতি চুপচাপ বসে রইলো খানিকক্ষণ তারপর মৃদুস্বরে বললো-“এমন হইলে ওদের পুলিশে দিব। আমার আব্বা সারাজীবন ওদের জন্য চিন্তা করছে। ওরা যদি আব্বার কথা না ভাবে তাইলে আমিও ভাববো না।”
রুজাইফের মুখে হাসি ফুটলো-“গুড। এমন কিছু শুনতে চাইছিলাম।”
রুজাইফ সেঁজুতির হাতে হাত রাখতেই সেঁজুতি কেঁপে উঠে হাত সরিয়ে নিতে গেলে রুজাইফ তার হাত আঁকড়ে ধরলো-“ঈদে তো সালামি পাওয়ার আশায় গলা ধরে ঝুলে গেছিলো। এখন এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন?”
সেঁজুতির কান আবারও গরম হলো। রাগ করে বলেই ফেললো-“আপনি এতো খারাপ কেন?”
“তুমি ভালো যে তাই।”
সেঁজুতি ফিক করে হেসে দিলো-“এতো পটাইতেছেন কেন হুমম? সবসময় তো দৌড়ানির উপর রাখেন।”
রুজাইফ ওর আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো। দু’হাতে সেঁজুতির চিকন কোমড় আঁকড়ে ধরে শরীরের সাথে মিশিয়ে নিলো। সেঁজুতির পিঠ ঠেকেছে রুজাইফের বুকের সাথে তা বুঝতে পেরে মেয়েটার যেন বেহুশ হওয়ার দশা। সেঁজুতি আমুলে কেঁপে উঠে কম্পিত গলায় ডাকলো-“কি করেন? ছাড়েন আমারে। যাইতে দেন।”
রুজাইফের জড়ানো কন্ঠে জবাব দিলো-“উহু, ছাড়বো না। আজ রাতে আমার সাথে থাকতে হবে তোমাকে।”
“মাথা খারাপ হইছে আপনের।”
“উহু, মাথা শরীর দুটোই খারাপ। তুমি ভালো করে দাও।”
“আমি কেমনে ভালো করুম? ছাড়েন তাড়াতাড়ি।”
সেঁজুতি রুজাইফকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইলো। কিন্তু রুজাইফকে এক ইঞ্চিও সরাতে পারলোনা। বরং রুজাইফ আরও শক্ত বাঁধনে বাঁধলো তাকে। হুমকি দিলো-“এভাবে নড়াচড়া করলে কিন্তু আরও কঠিন সাজা হবে।”
“যাইতে দেন। কেউ টের পাইলে বিপদ হবে।”
“কেউ টের পাবে না। বাসায় তো কেউ নেই তো কে টের পাবে? শোন, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে যাবে তুমি। আজ অনেক খাটুনি গেছে আমার।”
বলেই রুজাইফ ওকে আরেকটু নিবিড় করে ধরলো। সেঁজুতির হাসফাঁস লাগে। সে ছটফটিয়ে উঠলো-“এমন করেন কেন? সবসময় জড়ায় ধরেন। আমার কষ্ট লাগে বোঝেন না?”
রুজাইফ আলগোছে সেঁজুতির কাঁধে নাক ঘষলো-“আমার কষ্ট বোঝ তুমি? বুঝলে এতো জ্বালাতে?”
সেঁজুতি আমুলে কেঁপে উঠলো রুজাইফের স্পর্শে। কোমড়ে উপর রাখা ওর হাতটা জোড়ে চেপে ধরলো-“আমি জ্বালাই আপনেরে?”
রুজাইফ হুট করে সেঁজুতিকে ঘুরিয়ে নিলো। সামনাসামনি বসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো-“অনেক জ্বালাও। জ্বালানি পুরিয়ে ছাড়খাড় করে দাও।”
সেঁজুতির অভিমান হলো। ঠোঁট উল্টে বললো-“তাইলে আমারে ঘরে থাকতে দিছেন কেন? তাড়ায় দিলেই পারেন।”
সেঁজুতির অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে রুজাইফের বুক ধড়ফড় করে। এই মেয়েটা কি কিছুই বোঝে না? তার এতো অন্যায় রুজাইফ দেখেও দেখে না। কেন? একটা বার কি ভাবে না সেঁজুতি? না বোঝার মতো এতোটাও ছোট তো না সে? রাগ হলো তার। গম্ভীর হয়ে বললো-“ঠিক আছে চলে যেয় কাল। আর আঁটকে রাখবো না।”
★★★
দিন দুয়েক পরে হাশেম বাড়ি ফিরে এলো। সেঁজুতি চলে গেলো নিজের বাড়িতে। কেউ আটকায়নি তাকে। রুজাইফ কঠিন ভাবে নিষেধ করে দিয়েছ, কেউ যেন সেঁজুতিকে না আঁটকায়। নাদিরা কিছুটা গাইগুই করলেও ভাইয়ের উপর দিয়ে কথা বললো না। সাজেদ আর জাহাঙ্গীর পলাতক। এর মধ্যে রুজাইফ সম্পদ বুঝিয়ে দিতে চাপ দিলো মাজেদকে। সু্যোগ পেয়ে শামসুন্নাহার শর্ত জুড়ে দিলো-“জাহাঙ্গীর আর সাজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিলে সম্পদ বুঝিয়ে দেবে।”
রুজাইফ অনড়ভাবে বললো-“আগে সম্পদ বুঝিয়ে দিক তারপর অভিযোগের ব্যাপারে ভেবে দেখব।”
শামসুন্নাহার বড্ড বেকায়দায় পড়েছে। একদিকে দুই ছেলের জন্য মন পুড়ে। আরেকদিকে তাদের বউদের অশান্তি। দিনরাত শ্যামলীর সাথে ঝগড়া খোঁচাখুঁচি চলছে। শ্যামলী মুখ বুজে সহ্য করলেও সেঁজুতি সহ্য করছে না। সে দুপদাপ চাচীদের মুখের উপর জবাব দিচ্ছে। যার ফলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে লাকি আর খুকু। সেঁজুতির নামে উল্টো পাল্টা কথা বলে বাড়ি মাথায় তুলছে। সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরতেই মাজেদের কানে এলো, লাকি সেঁজুতিকে নিয়ে উল্টো পাল্টা বকছে। মাজেদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে চেচিয়ে উঠলো-“তোমার এতো বড় সাহস আমার মেয়েকে নিয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলো।”
লাকি আদব লেহাজ ভুলে জবাব দিলো-“কমু না কেন? আপনের দুই ভাইকে পুলিশ ধরতে চায় আর আপনেরে কিছু কয় না। কেন? কিসের খাতিরে?”
মাজেদ হতভম্ব গলায় বললো-“কি কইতে চাও তুমি? কিসের খাতিরের কথা কও? ওরা হাশেমের ক্ষতি করতে চাইছে। আমি তো কিছুই জানি না। আমারে কেন ফাঁসাইব?”
লাকি বললো-“আপনে জানেন না মানে? আম্মা কইছে না ওগো সম্পদ দিব না। ওইগুলা সব আমাগো পোলাপাইনের। আপনে সাধু সাইজা ওই পোলার লগে খাতির করেন, তারে হাতে রাখার লাইগা টাকাপয়সা দেন, ওরা শত্রু জানার পরও আপনের মাইয়া ওই বাড়িতে থাকে। ওদের লগে খায় দায় বেড়ায়। কি মনে করছেন, কিছু বুঝি না আমরা? এখন আবার ওগো সম্পদ বুঝায় দেউনের লাইগা ব্যস্ত হইছেন।”
“তো কি করুম? আব্বা নিজে ওগো সম্পদ দিছে এইখানে আমার কি করার আছে? আর সেঁজুতিরে আমি ওইখানে থাকতে দিতে চাই নাই। আম্মা জোর করছে বইলা আমার মাইয়া ওই বাড়িতে থাকছে।”
“আর সাধু সাইজেন না। সবই বুঝি আমরা। ঘাষে মুখ দিয়া তো চলি না। সবই তো দেখি এই চোখে।”
মাজেদ হতবুদ্ধি হয়ে বললো-“কি বোঝ?”
লাকি দাঁত চেপে তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো-“আপনে নিজের ভাইগোরে বাদ দিয়া একা একা সম্পদ হাতানোর চিন্তা করতেছেন। তাই মাইয়া লেলায় দিছেন ওই পোলার পিছনে। দুইজন মিলামিশা জমিজমা ভাগ কইরা খাওয়ার মতলব করতেছেন। নাইলে সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আপনের বিরুদ্ধে করে নাই কেন? কেন পুলিশ আপনেরে ধরলো না?”
শ্যামলী এগিয়ে এলো-“লাকি, অনেকদিন ধইরা তোমার এইসব বাজে কথা শুনতাছি। কিছু কই না বইলা য খুশি তাই করাব তাই কবা? আম্মা, আপনে কিছু কন না কেন? আপনে তো সবই জানেন, তারপরও একটা কথা কইতেছেন না?”
শামসুননাহার লাকিকে থামানোর চেষ্টা করলো-“লাকি, থামো এইবার। নিজেগো মধ্যে অশান্তি করলো ওরা আরও যুত পাইবো। এমুন কইরো না বউ।”
লাকি খেঁকিয়ে উঠলো-“করুম না মানে? আমার জামাই পালায়া পালায়া থাকবো আর আমি চুপচাপ বইসা ওনার সুখ দেখুম? আম্মা, আপনে হয়তো আপনের ছেলেরে ভালোবাসেন কিন্তু হেয় আমার স্বামী। তারে ছাড়া আমার দিন কেমনে যায় তা আমি জানি। এইসব মানুম না আমি।”
শামসুন্নাহার বিরক্ত হয়ে চেঁচাল-“তাইলে কি নিজেরা মারামারি কইরা মরবা? তাতে কার লাভ হইবো? ওই পোলারই তো?”
মাজেদের কেমন অন্ধকার লাগছিল চারপাশ। সে ধপ করে মাটিতে বসলো। হাফ ধরা গলায় বললো-“মা, আপনের কথায় সব হইলো এখন কথা শোনা লাগে আমার। কেন আম্মা? দোষ কি আমার?”
শামসুন্নাহার ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো-“মাজেদ, ওগো কথা ধরিস না। মাথা নষ্ট হইছে ওগোরে। বাদ দে বাজান।”
“বাদ দিমু! আমারে কইলে তাও বাদ দিতাম কিন্তু আমার মাইয়ারে বদনাম করার চেষ্টা করতেছে। কেমনে বাদ দেই আমরা? আমার মাইয়ার কি দোষ? ওরে তো আমি চইলা আসতে কইছিলাম। আপনের কথায় কিছু কই নাই। আইজ সবাই আজেবাজে কথা কইতেছে আর আপনে চুপচাপ শুনতেছেন। একটা কথাও সেঁজুতির পক্ষে কইলেন না।”
শামসুননাহার বড্ড বিরক্ত হলো-“আরে কইলাম তো। আর তুই খামাখা এমন করতেছোস। ওরা কইলেই কি সেঁজুতি খারাপ হইয়া গেলো? আমগো মাইয়া আমরা চিনি না?”
মাজেদ অদ্ভুত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সবকিছু কেমন যেন ধুসর লাগছে তার। সারাজীবন এদের জন্য কি করেনি সে। আজ তার পরিবার নিয়ে কথা বলতে একবার ভাবছে না! বুকে চাপ ধরা ব্যাথা টের পেলো সে। চোখ বুঁজে বসে রইলো চুপচাপ।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
★সংসারের কাজে বেশি ইনভলভ হয়ে গেছি বলে লেখা থেকে খানিকটা দূরে সরে গেছি। চেয়েও বেশি লিখতে পারছি না। রেগুলার হলে হয়তো সমস্যা মিটে যাবে।★