#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৩১
কয়দিন ধরে সেঁজুতির ভীষণ মন খারাপ। রুজাইফদের বাড়ি ছেড়ে এসে তার হাসফাঁস লাগে। তাদের বাড়িটার একতলার কাজ কোনরকমে শেষ হতেই তারা বাড়িতে উঠেছে। নতুন বাড়ির কোনকিছু আগের মতো সাজানো না। রুমগুলোও ছোট ছোট। মাজেদের অবস্থা আগের মতো নেই বলে খুব বেশি কিছু ডিমান্ড করা যাচ্ছে না। সেঁজুতি তার জন্য বরাদ্দ ছোট্ট রুমটা কোনরকমে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। লাগোয়া বাড়ি বলে চাচীদের সব কথাই তার কানে এসেছে। তারউপর তার চাচাতো ভাই বোনেরা কেউ তার সাথে কথা বলছে না। দেখলে মুখ বাঁকিয়ে চলে যাচ্ছে। একা একা কলেজে যাওয়া আসা করতে হচ্ছে। এদিকে রুজাইফকে বড় গলায় বলে এসেছে আর যাবেনা ও বাড়ি। তাই নাদিরার সাথে কথা বলতে পারছে না। দুইদিন ধরে রুজাইফ তাকে দেখেও দেখে না। গতকাল কলেজ থেকে ফেরার পথে রুজাইফ অফিস থেকে ফিরলো। বাড়ির সামনে ওকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো। আজ সকালেও অফিস যাওয়ার সময় চোখাচোখি হলো, তখনও চোখাচোখি হতেই রুজাইফ নজর ফিরিয়ে নিলো। ব্যাপারটা বড্ড গায়ে লাগছে সেঁজুতির। তাদের বাড়িতে থাকতে এই লোক সকাল বিকাল বিরক্ত করতো তাকে অথচ আজ যেন চিনতে পারছে তাকে৷ অপমানবোধ তাকে সুঁইয়ের খোঁচা খাওয়ার মতন খোঁচাচ্ছে। হাজারো ভাবনায় আনমনা হলে বইয়ের উপর মাথা দিয়ে চুপচাপ পরে রইলো সে। হঠাৎ মাথায় স্নেহময় স্পর্শ পেতেই চমকে মাথা তুললো সেঁজুতি। পেছনে মাজেদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। অপ্রতিভভাবে হাসলো সে-“আব্বা, কখন আইছেন?”
মাজেদ শুকনো হাসি দিলো-“আইছি মেলাক্ষন। খাইতে বইছিলাম তোরে ডাকলাম সারা পাই নাই। আইসা দেখি মন খারাপ কইরা বইসা আছোস। কি হইছে রে মা? মন খারাপ কেন তোর?”
সেঁজুতি মাথা নাড়ে-“কই মন খারাপ? মন খারাপ না আব্বা।”
মাজেদ দীর্ঘ শ্বাস গোপন করে-“তাইলে চল খাইয়া নেই। তোর মা ডাকতাছে অনেক সময় ধইরা।”
“চলো আব্বা।”
সেঁজুতি উঠে দাঁড়ালো। মাজেদ এগিয়ে যেতেই সেঁজুতি পিছু ডাকলো-“আব্বা, একটা কথা কমু? রাগবা নাতো?”
মাজেদ অবাক হয়ে মাথা দুলালো। সেঁজুতি মৃদুস্বরে বললো-“একা একা ভালো লাগে না আব্বা। নিজের রাগ জেদ ভুইলা বুবুকে এইবার না হয় বাড়িতে ডাকো। দেখতেছে তো নিজের ছাড়া কেউ আপন না। স্বার্থে টান লাগলে ভাই ভাইরে চিনতেছে না। আর তুমি এগো লাইগা কত কি করছো। বুবুরে দুইবার বিয়া দিলা, তার জীবনে সমস্যা তৈরি করলা তাও কি হেগোর মন পাইলা?”
মাজেদ বিস্মিত হয়ে মেয়ের মুখ পানে চাইলো। সেঁজুতি ঢোক গিললো-“মানলাম বুবু একা বিয়া কইরা অন্যায় করছিলো তাই বইলা তাকে ধইরা আইনা আরেকখান বিয়া দেওয়ার মতো পাপ কি সে করছিলো? এট্টু টাকাপয়সা কম হইলেও সোহাগ ভাই ভালো মানুষ। বুবুরে অনেক ভালোবাসে। তোমরা তারে এতো পেরেশান করছো তাও কিন্তু সে বুবুরে কোন অশান্তি দেয় নাই।”
মাজেদ মনে মনে ভীষণ লজ্জিত হলো। কয়দিন ধরে সেও একই কথ ভাবছিল কিন্তু চক্ষু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারছে না। বড় মেয়ের প্রতি করা অন্যায়ের কথা মনে করে অপরাধবোধ জেগে ওঠে মনে। ভাবছিল মেয়েটাকে বাড়িতে ডাকবে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে সংকোচ হয়। তাছাড়া বড্ড একা হয়ে গেছে সে। কারো সাথে দুদণ্ড কথা বলবে এমন পুরুষ এখন বাড়িতে নেই বললেই চলে। এখন সেঁজুতির কথায় মাজেদের চেহারায় স্বস্তি ফিরে এলো। এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলো। মোলায়েম গলায় বললো-“কাইল তোর বুবুরে ডাকমুনে। ওরা আইসা কয়ডা দিন থাকুক আমাগো সাথে। নতুন বাড়ি তো সকাল দেখেও নাই।”
সেঁজুতি খুশি হয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে-“হাঁচা আব্বা! আপনে সত্যি বুবুরে ডাকবেন?”
মাজেদ মাথা দুলায়-“ডাকমু। কাইল ফোন দিমুনে। এখন চল ভাত খাইতে যাই। মেলা রাইত হইছে।”
সেঁজুতি মেনে নিয়ে বাবার পিছু পিছু এলো। চুপচাপ বসে ভাত খেলো।
★★★
রুজাইফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেঁজুতিদের একতলা বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। বাতি জ্বলছে এখনো। তারমানে ওরা সজাগ আছে। কপালে আঙুল ঘষলো রুজাইফ। আজও দেখা হয়েছিল সেঁজুতির সাথে। কিন্তু ইচ্ছে করে ওকে এভোয়েড করেছে রুজাইফ। মেয়েটা অনেক কিছু বোঝে না বা বুঝতে চায় না। মুলত ওকে কিছু বুঝ দিতেই ওকে ইগনোর করছে। দেখা যাক সেঁজুতির বুঝ আসে কিনা। শ্বাস ফেলে পাশের দুই বাড়িতে নজর দিলো। তার ধারণা সাজেদ আর জাহাঙ্গীর আশেপাশেই লুকিয়ে আছে। দু্টোকে ধরে জেলে দিতে পারলে শান্তি পেতো।
রুজাইফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোর্টে মামলা করবে জমি বুঝে নিতে। এতোদিন এদের সাথে আপোষে সব কাজ করতে চেয়েছে। কিন্তু এরা ভদ্র মানুষ না। আপোষ করাটাকে দূর্বলতা ভাবছে। এদের সাথে এদেরই ভাষায় কথা বলতে হবে। কোর্টে দৌড়ঝাপ না করলে টের পাবে না কার সাথে লাগতে এসেছে। রুজাইফ আরেকবার সেঁজুতিদের ঘরের দিকে তাকিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো।
★★★
কলেজ থেকে ফিরে সকালকে দেখে খুশিতে চেচিয়ে উঠলো সেঁজুতি। বোনকে জড়িয়ে ধরলো-“বুবু, তুমি আইছো?”
সকাল হাসলো-“হহহ, আব্বা ফোন দিছিল না আইসা কেমনে পারি।”
সেঁজুতি হাসি মুখে বোনকে দেখলো-“দুলাভাই আইছে?”
সকাল মাথা দুলায়-“আইছে। আব্বার লগে দেখা করতে গেছে স্কুলে। আব্বাই ডাকছে তারে।”
সেঁজুতি বোনের হাত টানলো-“ঘরে চলো আপা, মেলা গল্প আছে তোমার লগে।”
সকাল ওকে থামিয়ে বললো-“থম। চল আগে ওই বাড়িতে যাই। সবার লগে দেখা কইরা আসি।”
সেঁজুতি একবার মুখ ঘুরিয়ে দোতলা দালানটাকে দেখলো। তারপর মলিন কন্ঠে বললো-“তাইলে তুমি যাও আপা। আমি কেবল আইলাম হাতমুখ ধুইয়া কিছু খাইয়া নেই। খিদা লাগছে বহুত।”
সকাল মন দিয়ে বোনকে দেখছিলো। সে বললো-“একা যামু? চলনা তুই। আমার চাইতে তোরে ভালো চিনে ওরা।”
সেঁজুতি মাথা নাড়ে-“না বুবু, তুমি যাও। আমি এখন যামু না ওই বাড়িতে।”
সকাল খুবই অবাক হলো সেঁজুতির কথায়। যে মেয়ে সারাদিন ওই বাড়িতে পড়ে থাকে সে হুট করে ওই বাড়ি যাবে ন বলতেছে কেন? ঘটনা কি? সকাল সন্ধিহান গলায় সুধায়-“যাবি না কেন? কিছু হইছে? কেউ কিছুল কইছে তোরে?”
সেঁজুতি ছলছল নয়নে বোনের দিকে তাকালো। তার গলা ধরে আসছে কান্নায়। সে মাথা দুলিয়ে বললো-“বাড়ির মানুষই কত কিছু কইতেছে আর কে কি কইবো? আসলেই তো, আমি নিজের বাড়ি থুইয়া ওই বাড়িতে কেন থাকুম? তুমি যাও বুবু আমি ওই বাড়িতে আর যামু না।”
“কিন্তু ভাই তো তোরে ভালো পায়? হেয় কিছু কয় নাই?”
সকালের কথায় চমকে উঠলো সেঁজুতি-“ভালো পায় মানে কি? হেই বেডার লাইগাই তো সব ঝামেলা লাগছে।”
সকাল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো-“উহু, তুই বোঝোস নাই। রুজাইফ ভাইজান তোরে অনেক ভালো পায়। তার লগে তুই আবার কোন উল্টাপাল্টা করোস নাই তো?”
সেঁজুতি রেগে গেলো-“হহহ এখন নিজের বইনের দোষ দেখবা তুমি। ওই দামড়া বেডায় সাধু। হেয় যে সবসময় আমারে…”
কথা শেষ করতে পারে না সেঁজুতি। রুজাইফ এসে দাঁড়িয়েছে উঠনে। সে গরম চোখে সেঁজুতির দিকে তাকাতেই সেঁজুতি ঢোক গিললো। সকাল রুজাইফকে দেখে হাসলো-“ভাইজান, আপনে কেমুন আছেন?”
রুজাইফ হাসলো-“ভালো। তুমি কখন এলে? এসো বাসায় এসো।”
“এই তো যাইতেছিলাম আপনের কাছে। সেঁজুতিরে কইতেছিলাম যাওয়ার জন্য সে কয় যাইব না আপনেগো বাড়ি।”
রুজাইফ একপলক দেখলো সেজুতিকে। মাথা নেড়ে বললো-“না এলে না আসবে। জোর করো না কাউকে। তুমি এসো একসাথে চা খাই।”
“জ্বি ভাইজান।”
সকাল দেখলো সেঁজুতির মুখ কালো হয়ে গেছে। রুজাইফ অবশ্য দাঁড়ায়নি। হেঁটে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে গেলো। সকাল সেঁজুতির কাছে এসে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো-“হইছে কি তোগো? ভাইজান রাগ হইছে লাগে। কি করছোস তুই?”
সেঁজুতি গরম চোখে তাকায়-“এতো ভাইজান ভাইজান করো ক্যা? আমরা কেউ না তোমার? থাকো তোমার ভাইজান নিয়ে।”
সেঁজুতি দুপদাপ পা ফেলে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। সকাল কয়েকবার ডাকলো সেঁজুতিকে কিন্তু সে সারা দিলো না। অগত্যা একাই পা বাড়ালো ও বাড়িতে। অন্তত কথা বলে বুঝে আসুক আসলে কি হয়েছে?
ফজিলাতুন্নেছা আর নুমার সাথে কুশল বিনিময় করলো সকাল। নাদিরা বেশ খুশি তাকে দেখে। গাল ফুলিয়ে অভিযোগ জানালো সেঁজুতির বিরুদ্ধে। সকাল হাসিমুখে শুনলো সব। রুজাইফ নাস্তা খেতে বসে ডাকলো তাকে-“সব শুনেছ তো? তোমার চাচারা কি কান্ড করেছে?”
সকাল নত মুখে মাথা দুলায়-“আব্বা বলছে সব। সে আপনাদের সম্পদ বুঝায় দিতে চাইতেছে অনেক আগে থিকাই কিন্তু দাদী আর চাচাদের কারনে পারতেছে না। তারা ঝামেলা করতেছে।”
“আমি তো কোর্টে মামলা করার প্ল্যান করতেছি। এইভাবে আর কতোদিন?”
সকাল ঠোঁট চেপে ধরে-“ভাইজান, কিছু মনে না করলে একটা কথা কই?”
রুজাইফ সম্মতি দিতেই সকাল বললো-“মামলা কইরেন না। ওনারা না হলে আপনাগোর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আর সেইটা আপনে কোনভাবে ঠেকাইতে পারবেন না। যেমন ধরেন ফুপার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। তাই বলতেছি ওদের শায়েস্তা করার অন্য উপায় খোঁজেন।”
রুজাইফ চিন্তিত হলো। সকালের কথা ফেলে দেওয়ার মতো না।
চলবে—
©Farhana_Yesmin