যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-৩৪

0
28

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৩৪

লোমহর্ষক ঘটনার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো দ্রুত। অল্প সময়ের মধ্যে পুরো বাড়ি লোকে লোকারন্য হয়ে উঠলো। লোকের চেচামেচি হইচই শুনে ফজিলাতুন্নেছা রোমেলাকে ডাকলো-“এতো হইচই কই হইতেছে?”
রোমেলা তখন কেবলমাত্র ঘটনা শুনে বাইরে যাচ্ছিল। সে তড়িঘড়ি করে উত্তর দিলো-“শুনলাম জাহাঙ্গীর বউরে খুন করছে।”
ফজিলাতুন্নেছা চমকে উঠে বসলো-“কি বলেন বুবু? সত্য?”
“আপনে বসেন ভাবি। আমি একটু শুইনা আসি।”
রোমেলা চলে যেতেই ফজিলাতুন্নেছা বড্ড অস্থির বোধ করলো। সে চেচিয়ে মেয়েকে ডাকলো। নুমা মায়ের রুমে এসে দাঁড়াতেই বললো-“আমাকে একটু দোতলায় নিয়ে চল তো।”
“কেন মা?”
“চল না। ও বাড়িতে নাকি খুনটুন হয়েছে।”
নুমা বিস্মিত হলো-“তাই নাকি? এইজন্য অনেক লোকের ভীড় দেখছি। ওদের নতুন কোন কেওয়াজ ভেবে আমি আর গুরুত্ব দেইনি।”
কথা বলতে বলতে মা মেয়ে দোতলায় বারান্দায় উঠে এসেছে। উঠোন লোকে লোকারণ্য দেখে আরেকপ্রস্ত অবাক হলো। বা দিকে জাহাঙ্গীরের ঘরের খানিকটা দেখা যায় এখান থেকে। ওদিকটা ভীড় দেখে ফজিলাতুন্নেছা বুঝলো আসলেই ওই ঘরে কিছু হয়েছে। লোকে মুখরোচক আলোচনা করছে। কিছু কিছু কথা কানে আসছে ফজিলাতুন্নেছা আর নুমার। খানিকক্ষণ বাদে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেলো। লোকের ভীড় ঠেলে পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। ওই পুলিশগুলোর সাথে রুজাইফকে দেখে ফজিলাতুন্নেছা আর নুমা দু’জনই বেশ অবাক হলো। নুমা না পেরে ডাকলো-“রুজাইফ, কি হয়েছে?”
ডাক শুনে দোতলার বারান্দায় তাকাতেই দিদার সাথে চোখাচোখি হলো। রুজাইফ বললো-“আমিও জানি না। কেবলই এলাম, ভেতরে গিয়ে দেখি কি হয়েছে। তোমরা ভেতরে যাও। এসব দেখতে হবে না। আর নাদিয়া নাহিয়ান যেন এদিকে না আসে।”
ফজিলাতুন্নেছা অবশ্য সরলো না। তার চোখ চিকচিক করছে অজানা কারণে। নুমাকে বললো-“তুই যা। হাশেম আর নাদিয়া নাহিয়ানকে দেখ। আমি কিছুক্ষণ এখানেই বসবো। রোমেনা বুবু আসলে পাঠিয়ে দিস।” নুমা মাকে রেখে বেরিয়ে গেলো। সে জানে মাকে এখন বললেও সে এখান থেকে নড়বে না।

কিছুক্ষণ পরই রোমেলা এলো-“ভাবি, কি হইছে হুনছেন? সর্বনাশ হইয়া গেছে আপনের সতীনের।”
ফজিলাতুন্নেছা শান্ত গলায় সুধালো-“কি হইছে বুবু?”
“জাহাঙ্গীরের বউয়ের চক্কর আছিল পাশের গ্রামের রুস্তম আলীর লগে। জাহাঙ্গীর তো পলায়া থাহে। আইজ দুপুরে বাড়িতে ঢুইকা খুকুরে রুস্তমের লগে শোয়া পাইছে। তারপর ওর মাতা গরম হইয়া গেছে। ও দাও দিয়ে কো*পায়া মারছে দুইডারে। পোলাপান স্কুল থিকা খেইলা আইসা ঘরে ঢুইকা দেখে এই অবস্থা। ওগের কান্নাকাটি শুইনা সবাই ঘটনা জানছে।”
ফজিলাতুন্নেছা চুপ করে রইলো। অন্যের বিপদে সে কোনদিন খুশি হয়নি। কিন্তু আজ কেন যেন অন্তরটা শান্ত লাগছে। অনেকটা তীব্র গরমে তেষ্টায় শুকিয়ে যাওয়া গলা ঠান্ডা পানি পান করে শীতল করার মতো শান্তি। ফজিলাতুন্নেছার চোখ দুটো বাষ্পীভূত হলো। এতোদিন খোদা, এতোদিন সময় নিলে! ফজিলাতুন্নেছা চোখ দুটো মুছে নিলো আলগোছে। হুট করে কাঁধে স্পর্শ পেতে মাথা তুলে দেখলো রোমেলা তাকিয়ে আছে-“আমার মনে আছে ভাবি। এইরকম একটা সাজাইন্না নাটক বানাইছিল ওরা তোমার বড় পোলার লাইগা। আল্লাহর কি লীলা ভাবি, যেই নাটক সাজাইছিল তার চাইতে কঠিন নাটক ওদের জীবন শেষ করলো। এইটাই আল্লাহর বিচার ভাবি। এমনেই আল্লাহ পতন দেন শয়তানগুলার।”

★★★

মাজেদকে হতবিহ্বল দেখায়। সে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মা বলে দিলে তার জন্য সহজ হতো কিন্তু সে এখন জ্ঞানহীন হয়ে ঘরে পড়ে আছে। মাজেদ সাহায্যের আসায় অসহায় চোখে চারিদিকে তাকালো। কিন্তু চারিদিকে এতে লোকের মাঝে সাহায্য করার মতো কাউকে চোখে পড়লো না। মাজেদের এখন মনেহচ্ছে সে নিজেই জ্ঞান হারাবে। সে অসহায় হয়ে বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারে বসলো। বাচ্চাগুলো এখনো ঘরে রক্তের মধ্যে বসে আছে। ওদেরকে সরিয়ে নিতে হবে কিন্তু কে নেবে? মাজেদ বলতে চাইলো, কেউ একটু বাচ্চাগুলোকে বের কর। কিন্তু ওর মুখে কথা ফুটলো না। তার আগেই পুলিশদের এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। ওদের সাথে রুজাইফকে দেখে খানিকটা স্বস্তি পেলো মাজেদ। রুজাইফকে যে যত খারাপই বলুক ওকে কেন যেন ভরসা করা যায়। অন্তত এতটুকু বিশ্বাস আছে রুজাইফ ইচ্ছে করে ওদের কোন ক্ষতি করবে না। ভাবতে ভাবতেই রুজাইফ সামনে এসে দাঁড়ালো-“কি হয়েছে? কিছুটা কানে এসেছে তবুও আপনি বলুন।”
মাজেদ অনেক কষ্টে কথা বলে-“আমিও জানি না কি হইছে। এই ঘটনা সবার আগে লাকি দেখছে মনেহয়।”
পুলিশ ততক্ষণে ভেতরঘর দেখে এসেছে। রুজাইফকে কানে কানে কিছু বললো। রুজাইফ চিন্তিত মুখে উঠে গেলো। ঘরে উঁকি দিয়ে গা শিউরে উঠলো তার। ভয়াবহ অবস্থা ঘরের। সে নির্দেশ দিলো-“বাচ্চাদের সরিয়ে নিন আগে তারপর যা করার করুন।”
পুলিশগুলো তাদের কাজে লেগে গেলে রুজাইফ ফিরে এলো মাজেদের কাছে। ওর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার ওসি। মাজেদকে সাথে নিয়ে ওদের বাড়িতে ফিরলো। সর্বপ্রথম ঘটনা লাকি দেখেছিল। তার কাছ থেকে শোনা হলো। লাকির ভাষ্যমতে, সে বাচ্চাদের চিৎকার শুনে এসেছিল। তারপর দেখে এই অবস্থা। জাহাঙ্গীর কখন এসেছে কখন এই ঘটনা ঘটেছে এমনকি রুস্তম কখন ঢুকেছে এসব কিছুই সে দেখেনি।

বাড়ির বাকি সবার থেকে জবানবন্দি নেওয়া হলো। কেউই তেমন কিছু জানে না। কেবল শামসুন্নাহার একেবারেই নীরব। সে কোন কথাই বললো না কেবল নির্বাক বসে থাকা ছাড়া। পুলিশ লাশ দুটো আর জাহাঙ্গীরকে সাথে নিয়ে চলে গেলো। জাহাঙ্গীর কারো সাথে কোন কথা বলেনি। মাজেদ ভাইয়ের সাথে অনেকবার কথা বলতে চাইলো কিন্তু জাহাঙ্গীর কোন কথাই বললো না। কেবল রুজাইফের দিকে চেয়েছিল কয়েক সেকেন্ড।

রুজাইফ যথাসম্ভব ঝামেলা কমানোর চেষ্টা করে পুলিশকে সহযোগিতা করলো যাতে মাজেদদের কষ্ট কম হয়। পুলিশ জানালো পোস্টমর্টেম করে খুকুর লাশ বুঝিয়ে দেবে। এরইমধ্যে শামসুন্নাহার ঘোষণা দিলো, খুকুকে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে না। ওর লাশ যেন বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মাজেদ ধমক দিলো মাকে-“এখন এইসব কথা কওনের সময় না আম্মা। আপনে সবসময় উল্টা পাল্টা কথা কন৷ এখন মাতা ঠিক নাই আপনের তাই চুপ থাকেন।”
“না চুপ থাকুম না। যে মাতারা আমাগো বংশের মানসন্মান ডুবাইছে তারে এই ভিটায় দাফন করতে দিমু না।”
রুজাইফের মেজাজ চুড়ান্ত খারাপ হলো। তার কপালের শিরা দপদপ করছে৷ এতোকিছুর পরেও মহিলার কথাবার্তা শুনে জাস্ট ঘেন্না পেলো তার। সে ওখান থেকে দ্রুত পা চালিয়ে চলে এলো।

★★★

“দিদা।”
ফজিলাতুন্নেছা আজ অনেকদিন পরে মোনাজাতে দীর্ঘ সময় হাত তুলে রেখেছেন। ডাক শুনে মোনাজাত সংক্ষিপ্ত করে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখলো। রুজাইফের দিকে তাকিয়ে হাসলো-“ওইখানে দাঁড়ায়ে আছোস কেন? ভিতরে আয়।”
“উহু, ফ্রেশ হতে হবে। সব শুনেছ তো?”
“হুমমম।”
দু’জনের মধ্যেই নিরবতা ভর করলো। অনেক কথা ঠোঁটের আগায় আঁটকে আছে কিন্তু কেউই তা প্রকাশ করছে না। যেন মনে মনেই কথা সেরে ফেলছে দু’জন। একসময় রুজাইফ শ্বাস ফেলে বললো-“কিছু বলতে চাও?”
ফজিলাতুন্নেছা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে রুজাইফের দিকে তাকালো। রুজাইফের মনে হলো দিদা কি বলতে চাইছে সেটা সে বুঝেছে৷ মাথা নেড়ে শান্ত গলায় বললো-“রেস্ট নিয়ে নিচে নামছি তখন কথা বলবো।”
ফজিলাতুন্নেছা নিঃশব্দে মাথা দুলাতেই রুজাইফ হাঁটা দিলো।

ঘরের দোর আঁটকে বাতি জ্বালাতে যাবে তখনই নরম কোমল শীর্নকায় শরীরটা ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মৃদু কাঁপছে মেয়েটা। মোলায়েম হাত দু’টো রুজাইফের ঘামার্ত শার্ট আঁকড়ে ধরে আছে। বুকের উপর পড়ে থাকা মুখটার উপর ছোট ছোট চুল লেপ্টে রয়েছে। রুজাইফ নিজের ক্লান্তি দূরে সরিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো-“কি হয়েছে? ভয় লাগছে?”
সেঁজুতি মাথা দুলায়। কম্পিত কন্ঠে ফিসফিস করলো-“আপনি দেখছেন?”
রুজাইফ ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনা হলো-“হুমমম।”
“কি ভয়ংকর অবস্থা দেখছেন। চাচা কেন অমন করলো? এখন তো তার জেল হবে। চাচী চাচা কেউ না থাকলে ভাই বোন গুলার কি হবে? ছোট মানুষ ওরা, এই ঘটনা কি ভুলতে পারবে?”
সেঁজুতির কথা শুনতে শুনতে রুজাইফের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো আপনাতেই৷ হাতের মুষ্টি বন্ধ করে ফেললো। কঠিন স্বরে বললো-“না ভুললেই ভালো হবে। ওরা মনে রাখুক। মনে রেখে কষ্ট পাক।”
সেঁজুতি অন্ধকারে মাথা তুলে অবাক নয়নে রুজাইফকে দেখলো-“আপনারে মাঝে মাঝে আমি একটুও চিনতে পারি না। বড়ই অচেনা লাগে। লোকজন কত আজেবাজে কথা বলতেছিল জানেন? আব্বার তো শরীর খারাপ হয়ে গেছে চিন্তায়।”
রুজাইফ চোখে চোখ রাখতেই সেঁজুতি চোখ সরিয়ে নিলো। রুজাইফের পিঠের উপরের হাত দুটো আলগা হলো। খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ায়। রুজাইফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। সেঁজুতি বললো-“আল্লাহ বড় বাঁচা বাঁচাইছে আমাদের।”
রুজাইফের ভ্রু কুঁচকে গেলো-“মানে?”
“মানে আমরা কিছু করার আগেই সবকিছু হয়ে গেছে।”
রুজাইফের চোখে বিস্ময় খেলা করে। খানিকক্ষণ পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে স্লান হাসলো-“ভালো তো।”
“আপনে খুশি হন নাই?”
“হুমমম, অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু তোমার আজ কি হলো হঠাৎ করে? আমার কাছে এলে কেন?”
সেঁজুতিকে খানিকটা ভাবুক দেখালো। অন্যমনস্ক হয়ে রুজাইফকে দেখছে-“ওই দৃশ্য দেখার পর থেকে কেমন খারাপ লাগতেছিল। বারবার খালি আপনের কথা মনে পড়তেছিল। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“বলো।”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জানতে চাইলো রুজাইফ।
“আপনে ঠিক এইরকম কিছুই করতে চাইছিলেন কেন?”
রুজাইফের হাত থেমে গেলো। মুখ চোখের ভাব খানিকটা পরিবর্তন হয়ে আবার স্বাভাবিক হলো। রুজাইফ হুট করে সেঁজুতিকে কাছে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে দুষ্টুমির স্বরে জানতে চাইলো-“হুট করে আমাকে বেশি মনে করছো কেন? আমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছ নাতো? কি ডিল হয়েছিল মনে আছে? প্রেমে পড়লে তোমাকে কি করতে হবে?”
সেঁজুতি দ্রুত নিজেকে রুজাইফ থেকে ছাড়িয়ে নিল। ওড়নার কোনা আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে মাথা নাড়ে-“খেয়ে কাজ নেই তো আমার যে আপনার প্রেমে পড়বো। আপনে কাজ দিছিলেন আমাকে তার আপডেট দিলাম। পরে নাইলে দোষ দিবেন।”
রুজাইফ অবাক হওয়ার ভান করে বললো-“তাই বলে জড়িয়ে ধরে কাজের আপডেট দেবে?”
সেঁজুতি লজ্জা পেলো। লাজুক স্বরেই বললো-“অভ্যাস আপনেই বানাইছেন। এখন আমারে লজ্জা দিতে উল্টাপাল্টা বকতেছেন।”
“আমি অভ্যাস বানালেই বুঝি তুমি মেনে নেবে এতো সহজে?”
সেঁজুতি সহসা জবাব দিতে পারে না। সে বাঁচার জন্য এদিক সেদিক তাকালো। থাকতে না পেরে বলেই ফেললো-“আমি যাই নাইলে আব্বা খুঁজবে।”
রুজাইফ জবাব দিলো না। সেঁজুতি দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে পিছু ফিরে রুজাইফের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। রুজাইফের ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি। সেঁজুতি মনে মনে বিরবির করলো-“মহা ধুরন্ধর লোক। একদম কুংফু পান্ডার মতোই চালাক। নিজের সব চালাকি লুকায় রেখে সাধু সেজে থাকে। নিজেই কাছে ডাকে অথচ নিজ থেকে কাছে গেলে পঁচায়। ফাজিল বেডা।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin