যে প্রেম হঠাৎ আসে পর্ব-০১

0
224

#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:০১

“আপনি একটু দূরে সরে দাঁড়াবেন আমার না খুব অসস্থি লাগছে।”

অনুশ্রীর কথা শুনে মিহি হাসল ইহান। তড়িৎ আরেকটু কাছে এগিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আমি তো আপনার থেকে দূরেই দাঁড়িয়ে অনুশ্রী, তবুও আপনার অসস্থি লাগছে। এ তো ভাড়ি অন্যায়কর কথা।”

অনুশ্রী চমকে দূরে সরে গেল। থমথমে কণ্ঠে বলল,“আপনাকে দূরে যেতে বলেছিলাম কাছে আসতে নয়।”

আকাশে তখন তাঁরায় ভরপুর। শহর জুড়ে সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। কতক্ষণ আগে বর্ষা হওয়ার কারণে শহরের রাস্তায় পানিতে ভরপুর। অনুশ্রী আর ইহান দাঁড়ানো তাদের এলাকারই এক তিনরাস্তার মোড়ে। লোডশেডিং হয়েছে। যার দরুণ আশপাশ বেশ অন্ধকার। ইহান সরে দাঁড়াল নির্বিকার কণ্ঠে বলল,“আপনি আমায় কেন বুঝেন না অনুশ্রী?”

অনুশ্রীর বুক কাঁপল। থরথর করে মন মস্তিষ্ক সব অবশ ঠেকল। অনুশ্রী মিহি কণ্ঠে শুধাল,
“আমি বাড়ি যেতে চাই ইহান।”

ইহান চুপ হয়ে গেল। তাকে অসহায় দেখাল। গত এক বছর যাবৎ ইহান অনুশ্রীকে ভালোবাসে। মুখ ফোটে কখনও বলেনি কিন্তু নিজের আচরণে, কথার ধরনে বুঝিয়েছে বহুবার। কিন্তু অনুশ্রীতা মেয়েটা তা বুঝতে নারাজ। মেয়েটা অত্যাধিক জেদি। কিন্তু ইহানও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। একদিন না একদিন ওই জেদি মেয়ের মনে নিজের জন্য জায়গা ঠিকই করিয়ে ছাড়বে ইহান। ইহান আশপাশ দেখল। রিকশা বা কোনো ভ্যানট্যানের দেখা নেই। পেলে ভালো হতো। ইহানের বিস্মিত মুখ। থমথমে কণ্ঠস্বর। সে শুধায়,
“আশেপাশে কোনো রিকশা-টিকশা নেই। পানিটা একটু কমুক তারপর না হয় যান। একটু কি অপেক্ষা করা যায় না?”

অনুশ্রী কিছু বলে না। তার পরণে জামদানী শাড়ি। চুলগুলো বেনুনী করা। চোখে কাজল। হাতে কাঁচের চুড়ি। তার বাড়ি বেশি দূরে নয়। মোড়টা
পার হলেই পাঁচ মিনিটের রাস্তা। অথচ অনুশ্রী দাঁড়িয়ে। এলাকার এই মোড়টা চরম বাজে একটু বৃষ্টি হলো আর কি ওমনি হাঁটু অবদি পানি জমে। অনুশ্রী বিকেলে ক্যাফেতে গিয়েছিল। তিন বান্ধবীর জমজমাট এক আড্ডামহল। বৃষ্টি নেমেছিল। প্রায় পনের মিনিটের বৃষ্টি। বৃষ্টি হলেও ক্যাফের ভিতর ছিল খুবই রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। তাই অতোটা গুরুত্ব দেয় নি বিষয়টায়। কিন্তু এখন চরম বিরক্ত লাগছে অনুশ্রীর। এই শাড়ি চুড়ি পড়নে না থাকলে ঠিক পানি পেরিয়ে চলে যেত। তারওপর হঠাৎ এই ইহানের আগমন। এটা আরো পীড়াদায়ক। ইহান অনুশ্রীর চোখের সামনে তুড়ি মেরে বলল,
“এত কি ভাবছেন? আপনি চাইলে আমি কিন্তু আপনায় কোলে তুলে নিয়ে যেতে পারি।”

অনুশ্রী রাগী রাগী দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,“মজা করছেন আমার সাথে?”

ইহানের ঠোঁটে নিদারুণ হাসি দেখা যায়। সে মিহি কণ্ঠে আওড়ায়,
“মজা কি আমি করি অনুশ্রী নাকি আপনি করেন?”
“আমি চলে যাব এই বিচ্ছিরি পানি পেরিয়েই আমি চলে যাব।”

ইহান চুপ হয়ে গেল। করুণ কণ্ঠে বলল,
“যাবেন না আপনার শাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে।”

অনুশ্রী আবার চুপ হয়ে গেল। বিরক্তিতে তার সারা অঙ্গ কাঁপছে। মিনিট পাঁচ সময় ওভাবেই চলে গেল। ধীরে ধীরে মোড়ের পানি কমলো। অনুশ্রী তার শাড়িটা হাল্কা উচকিয়ে পা ফেলল অল্প পানিতে। ইহানও নামল। আদুরে স্বরে বলল,
“আর কিছুক্ষণ দাঁড়ানো যেত না? আপনি এত নিষ্ঠুর কেন অনুশ্রী?”

অনুশ্রী সরাসরি চাইল ইহানের দিকে। মানুষটার এলেমেলো চুল। ইহানের গায়ের রঙ ফর্সা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখের মনি কালো। লম্বাচওড়ায় সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। এক কথায় যাকে বলে সুদর্শন যুবক। তবুও অনুশ্রীর তাকে পছন্দ নয়। কেন নয় এর উত্তরও অনুশ্রী জানে না। মাঝে মাঝে আমরা কিছু মানুষদের অকারণেই অপছন্দ করি। অনুশ্রীর জন্য ইহানও তেমন টাইপেরই একজন মানুষ। অনুশ্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
“আপনি শুধু শুধু আমার পিছনে পড়ে কেন আছেন। আপনি জানেন আপনার জন্য এলাকার কিছু মানুষ খুব অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে।”

ইহান পুরো কথাটাকেই উপেক্ষা করে বলল,
“আমায় একটু ভালো কেন বাসছেন না অনুশ্রী?”
“আপনাকে বাবা পছন্দ করেন না।”
“তো বিয়ে কি আমি আপনার বাবাকে করব যে তার পছন্দ হতে হবে! অদ্ভুত!”

ইহানের তড়িৎ উত্তর। অনুশ্রীর চোখে মুখে বিস্ময়। এই ইহান এমনই যেন কোনো কিছুতেই তার যায় আসে না। ইহান ছন্নছাড়া। অনুশ্রী বলল,
“আপনাকে আমারও পছন্দ নয়।”
“আপনি মিথ্যে বলছেন।”

অনুশ্রী এতে বিরক্ত হলো আরো। বলল,
“আপনি মানুন বা না মানুন আপনাকে সত্যি আমার পছন্দ নয়।”

ইহান আর কিছু বলল না। আঘাত পেল মোটেও পেল না। এসব অনুশ্রী প্রায় বলে। ইহান কিছু মনে করে না। অনুশ্রী দ্রুত পা ফেলে চলে গেল নিজ গন্তব্যে। ইহান আর এগোলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ভাবল,এখন বাসায় ঢোকা ঠিক হবে না। একবার ঢুকলে আবার বের হওয়া মুশকিল।’


মোড়ের মাথার একটা দোকানের কর্নারে সাদা দেয়ালে লেখা ঝন্টু মামার চায়ের দোকান। চায়ের দোকানের পাশেই ক্যারামের ক্লাব। একটা বিশাল ক্যারাম বোর্ড আছে সেখানে। বাজি ধরেও খেলা হয় ক্যারাম। ইহান এসে বসল চায়ের দোকানে। তাড়া দিয়ে বলল,“মামা কড়া করে এককাপ চা দেও তো?”

ঝন্টু মামা চা বানাতে বানাতে মৃদু হাসলেন। বললেন,“কি মিয়া খুব অস্থির দেহায় যে?”

ইহান চাইল ঝন্টুর দিকে। ঝন্টুর একটা মুখের দোষ আছে সে কথায় কথায় সবাইকে ‘মিয়া’ বলে ডাকে। ইহান আশেপাশে তাকাল ঝন্টুর কথার উত্তরে বলল,“সত্যি অস্থির দেখাচ্ছে মামা?”

ঝন্টু চায়ের কাপটা ইহানের দিকে দিয়ে বলল,“লাগতাছে তো?”

ইহান চায়ের কাপে চুমুক দিল। ভারাক্রান্ত গলায় বিড়বিড় করে বলল,
“তুমিও বুঝলা আমার অস্থিরতা অথচ যার বোঝা উচিত সে বুঝল না।”
“কিছু কি কইলা মিয়া?”

ইহান হাল্কা হেঁসে বলে,“না মামা। চায়ে চিনি হয় নাই।”

ইহান কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল। ক্যারামের ক্লাবে ঢুকল। যেখানে তার এলাকার বন্ধু ইমন ছিল। তাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে বলল,
“কি রে এক দান খেলবি নাকি?”

ইহানের মুড অফ থাকায় বলল,“আজকে আমার মন ভালো নেই।”

ইমনের পাশেই ছিল রতন। টিটকারি দিয়ে বলল,“মন খারাপ না ছাই খেলায় হেরে যাবে এই ভয়ে নাটক।”

ইহানের মেজাজ বিগড়াল। বোর্ডে হাত রেখে বলল,“ইহান আর ভয়।”

রতন হেঁসে জবাব দেয়,“তাইলে হয়ে যাক হাজার টাকার বাজি।”
ইহানও রতনের চোখে চোখ রেখে বলল,“আচ্ছা।”

খেলা শুরু করা হলো।’
খেলায় লাল গুটি ক্যারামের পকেটে ফেলতেই চেঁচিয়ে উঠল ইহান আর ইমন। সেই মুহূর্তে সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন অনুশ্রীর বাবা ফারুক আহমেদ। ইহানকে দেখেই নাকমুখ কুঁচকালেন। ছেলেটাকে বিন্দুমাত্র পছন্দ করেন না তিনি। সারাদিন শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ক্যারাম খেলা ছাড়া আর কিছুই করতে দেখেন না। যে মেয়ে এর কপালে আছে তার ভাগ্য তো গেল সাথে মেয়ের বাপের ভাগ্যও গেল। ফারুক আহমেদ দ্রুত চলে গেলেন ওখান থেকে। ইহান খেলায় জিতে রতনকে বলল,“তাড়াতাড়ি হাজার টাকা বের কর শালা।”

রতন দোনামনা করল। মিনমিনিয়েই বলল,
“না দিলে হয় না।”
“কষিয়ে এমন চড় মারব যে বাপের নাম ভুলে যাবি।”

রতন আর দেরি করল না দ্রুত পকেট থেকে এক হাজার টাকার নোট বের করে দিল। ইহান নোটের ঘ্রাণ শুঁকে বলল,“ঝন্টু মামা কড়া করে তিনকাপ চা দেও তো?”

ঝন্টুও আওয়াজ করে বলল,“আইতাছি মিয়ারা?”


লাগাতার কলিং বেল বাজাচ্ছেন ফারুক আহমেদ। পড়ার টেবিলে বসা ছিল অনুশ্রী আর ওর ছোট বোন
তনুশ্রী। ক্লাস সেভেনে পড়ে। রান্নাঘরে কাজ করছিল তাদের মা সাহানা বেগম। স্বামী এসেছেন আলাপ পেতেই দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হাতের পানিটুকু শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে দ্রুত দরজা খুললেন। ফারুক আহমেদ ভিতরে ঢুকলেন। হাতে থলে। সাহানা বেগম স্বামীর হাত থেকে থলেটা নিয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেলেন। অনুশ্রী ততক্ষণে রুম থেকে বেরিয়ে বাবার হাতে পানি দিল। অনুশ্রীর বাবা সোফায় বসে পানির গ্লাস হাতে নিলেন। ঢকঢক করে পানিটা পান করলেন। বেশ বিরক্ত নিয়ে বললেন,“পাড়ার ছেলেপেলে গুলার একটাও ভালো না। রোজ দেখি ঝন্টুর দোকানের পাশে ক্যারাম খেলে আর হৈ-হুল্লোড় করে। মুখের ভাষার যা ছিরি।”

বাবার কথা শুনে অনু্শ্রীর বুঝতে বাকি নেই তিনি ইহান আর ওর বন্ধুদের কথাই বলছেন। ছেলেটা আসলেও পদের নয়। পড়াশোনা শেষ করেছে কোথায় চাকরি বাকরি করবে তা না দিনরাত বন্ধুবান্ধবের সাথে খালি আড্ডাবাজি করে। অনুশ্রী নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়ের ভাবনার মাঝে ফারুক আহমেদ বললেন,
“কি রে মা তুই কি ভাবছিস?”

অনুশ্রী চমকে উঠল। দ্রুত নিজেকে সামলে উত্তর দিল,“কিছু না বাবা।”

অনুশ্রী নিজের কক্ষে ঢুকে পড়ল।’


রাত তখন এগারোটার দখলে। বিল্ডিংয়ের তিনতলায় নিজ রুমের বেলকনিতে এসে দাঁড়াল অনুশ্রী। বাসায় কারেন্ট নেই। ঘুম আসছে না। হঠাৎ কারো কণ্ঠ শোনা যায়। অপরপ্রান্তের বেলকনি থেকে কেউ ক্লান্ত কণ্ঠে শুধায়,
“আপনার মনে আমার জন্য প্রেমদুয়ার কবে খুলবে অনুশ্রী? আমি যে দিনকে দিন বড্ড অধৈর্য্য হচ্ছি। পুরোপুরি অধৈর্য্য হওয়ার আগে আমায় টেনে তুলুন প্লিজ!”

#চলবে….