যে প্রেম হঠাৎ আসে পর্ব-০২

0
157

#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:০২

আঁধারের শহরে আচমকাই কারো কণ্ঠ শুনে থমকে গেল অনুশ্রী। বুকে ফুঁ দিল বার কয়েক। থমথমে কণ্ঠে বলল,“আপনি কি মানুষ নাকি অন্যকিছু? আচমকা কেউ এইভাবে বলে।”

ইহান খানিকক্ষণ শব্দ করে হাসল। রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই হাসি বড়ই ছমছমে শোনালো। ইহান বলল,“ইস! বড্ড ভয় পেলেন বুঝি?”

আঁধারের ভিড়েও কঠিন দৃষ্টি নিয়ে তাকাল অনুশ্রী। তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিল,
“আপনি আর মানুষ হলেন না।”

ইহান ঘোর আপত্তি জানাল। উত্তর দিল ,
“আপনি বড্ড অদ্ভুত করে কথা বলেন অনুশ্রী। আমার তো মানুষদের মতোই হাত, পা, চোখ, নাক আছে। তাহলে আমি কিভাবে মানুষ হলাম না?”

অনুশ্রী বিরক্তির নিশ্বাস ছাড়ল। ছোট্ট করে বলল,
“আমি কি সেই ইঙ্গিতে বলেছি।”
“তাহলে কি কোন ইঙ্গিতে বলেছেন?”

অনুশ্রী হাল ছেড়ে দিল। আর জবাব দিল না। এ ছেলের সাথে কথা বলাই বেকার। অনুশ্রী ভিতরে ঢুকতে নিলো সঙ্গে সঙ্গে বারণ করল ইহান। বলল,“যাবেন না অনুশ্রী। আপনি দাঁড়ান আমি যাচ্ছি।”

ইহান চলে গেল। অনুশ্রী অবাক হয়ে চেয়ে রইল ইহানের দিকে। সে ভাবে নি ইহান সত্যি সত্যিই চলে যাবে। অনুশ্রীদের ব্লিডিংটা ছয়তলা। ওরা থাকে তিনতলায়। ওদের সোজাসুজি ব্লিডিংটাও ছয়তলা। আকস্মিকভাবে ওপাশের তিনতলাতেই ইহানদের বাসা। আর অনুশ্রী ইহানের বেলকনিও খুব কাছাকাছি। চাইলেই হাত বাড়িয়ে একে অপরকে ছোঁয়া যায়। ইহানরা এই এলাকায় আছে বিগত দশ বছর যাবৎ। আর অনুশ্রীরা এখানে এসেছে কেবল একবছর হয়েছে। অনুশ্রীর এখনও মনে আছে তার সাথে ইহানের প্রথম দেখা হওয়া সময়টা।”

অনুশ্রী তখন অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আচমকা বাসা চেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিলেন অনুশ্রীর বাবা। আগের বাসাটা তুলনামূলক ছোট ছিল। যার দরুন নতুন বাসায় আসার এত তোড়জোড়। দিনটি ছিল শুক্রবার। এপ্রিল মাসের পহেলা তারিখ তারা নতুন বাসায় ওঠে। চার তারিখ দেখা হয় ইহানের সাথে অনুশ্রীর। তাও এই বেলকনির দৌলতে। অনুশ্রী সেদিন কেবল গোসল সেরে বেলকনিতে পা রাখে। আকাশটা ছিল খানিকটা মেঘলাময়। ভেবেছিল বৃষ্টি হবে। তাই কাপড় ছাঁদে না দিয়ে বেলকনিতে দেয়ারই সিদ্ধান্ত নেয় অনুশ্রী। হঠাৎ কাপড় মেলতে গিয়ে কারো উচ্চ আওয়াজে কথা বলার শব্দ পাওয়া যায়। অনুশ্রী কৌতুহলী তাকায়। তখনই দেখতে পায় ওপাশের বিল্ডিংয়ের তিনতলাতেই বাবার বয়সী একজন লোক থাপ্পড় মারছেন একজন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারি ছেলের গালে। যে কিনা ইহান ছিল। ইহান মার খেয়েও থাকে নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে। অনুশ্রী অবাক হয়ে কিছুটা সময় দেখেই যায় ইহানকে। ইহানের তার দিকে নজর পরে তার ঠিক পাঁচ মিনিট পর। ইহানের সেদিনকার দৃষ্টি খুবই অদ্ভুত ছিল। সে তাকিয়েই থাকে অনুশ্রীর দিকে। আর তাকে মারতে থাকে সেই ব্যক্তিটি। অনুশ্রী কিছু মুহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় ইহানের আচরণে। তার হঠাৎ কষ্ট হয় এভাবে কেউ এতবড় ছেলেকে মারে। যেন তেনভাবে মারা নয় লাঠি দিয়ে মারা। অনুশ্রী পরে অবশ্য জেনে ছিল মারতে থাকা ব্যক্তিটি ইহানের বাবা ছিল। কিন্তু কেন মেরেছিল এর উত্তর আজও জানতে পারে নি। ইহানকে জিজ্ঞেস করারও যায় নি যদি কিছু ভাবে।’

এরপর থেকেই ইহানের আগমণ ঘটে অনুশ্রীর জীবনে। প্রথম ইহানের সাথে অনুশ্রীর কথা হয় ওই ঘটনার দ্বিতীয় দিনে। বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল অনুশ্রী। হঠাৎ পিছন থেকে কারো ভাড়ি কণ্ঠ শোনা যায়। সে বলে,“এই মেয়ে শোনো।”

অনুশ্রী খানিকটা চমকে গিয়ে পিছন ফিরে। কালকের ছেলেটাকে দেখে বিষম খায়। মাথা নুইয়েই বলে,“জি বলুন।”

ইহান সেদিন কিছু বলে না। বাস আসার পুরোটা সময় শুধু অনুশ্রীকেই দেখে যায়। আর অনুশ্রী অসস্থিতায় ভোগে। পাল্টা আর একবার বলে,“কিছু কি বলবেন?”

ইহান বলে না। চুপ করে থাকে।’

তারপরই এখানে সেখানে তাদের প্রায় দেখা হয়। কথা হয়। অনুশ্রী বুঝে সবটা। ইহানের অনুভূতিও সে বুঝতে পারে। কতবার বারণ করেছে কিন্তু ইহান মানতে নারাজ। আঠার মতো লেগেই আছে অনুশ্রীর জীবনে। ভালোবাসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অনুশ্রীরা কাউকে ভালোবাসতে পারে না।”

হঠাৎই এক দমকা হাওয়া গায়ে লাগতেই নিজের ভাবনা থেকে বের হলো অনুশ্রী। গায়ের ঘর্মাক্ত ভাবটা একটু হলেও বুঝল তার। প্রচুর গরম লেগেছিল বিদেয় অনুশ্রী বেলকনিতে পা রাখে। কিন্তু ইহান যে এতরাতেও বেলকনিতে বসে থাকবে ভাবতে পারে নি। অনুশ্রীর হঠাৎ কেন যেন মনে হলো ইহান তার অবস্থাটা টের পেয়েই চলে গেছে ভিতরে। সত্যি কি এমন?’

অন্যদিকে,
জানালার আড়ালে বসে তাকিয়ে রয় ইহান। জ্বালিয়ে রাখা মোমবাতিটা নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করা। অনুশ্রীকে দেখা যায়। মেয়েটা কেন যে ইহানকে বুঝতে চায় না কে জানে। ইহান নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মলিন কণ্ঠে বিড়বিড়ায়,“আমায় কি সত্যিই ভালোবাসবেন না অনু?”


গ্রীষ্মের দাবদাহ গরমে মাথায় ছাতি চেপে হাঁটছে অনুশ্রী। গায়ে জড়ানো সাদা সেলোয়ার-কামিজ। মাথায় গোমটা। অনুশ্রী দিনে তিনটে টিউশনি করায়। আজ ভার্সিটি বন্ধ। যার দরুণ অনুশ্রী ভেবেছে দ্রুত টিউশনিগুলো শেষ করে বাসায় ফিরবে। শেষের টিউশনিটা শেষ করতে করতে অনুশ্রীর প্রায় রাত আটটা বাজে। এত দেরি হয় বলে মা প্রায় বলে টিউশনিটা ছেড়ে দিতে। কিন্তু অনুশ্রী ছাড়ে না। অনুশ্রীর বাবা একজন চাকরিজীবি মানুষ। মাস শেষে যে বেতনটা আসে তা দিয়ে বাসা ভাড়া, সবার খাওনপোষনেই চলে যায়। অনুশ্রীর পড়াশোনার খরচটা অনুশ্রী নিজেই চালানোর চেষ্টা করে। তনুশ্রীর পড়াশোনার খরচাটাও তো দিনকে দিন বাড়ছে।’

অনুশ্রীরা মধ্যবিত্ত। এই নিয়ে তার মনে কোনো খোপ নেই। জীবনে টাকা পয়সা থাকলেই সুখ থাকে এমনটা নয়। অনুশ্রী নানা কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছে। দাবদাহ গরমের রোদ্দুরটা গা চুইয়ে ঘাম ছড়াচ্ছে। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। অনুশ্রী না দেখেই বুঝতে পারে এটা ইহান ছাড়া আর কেউ নয়। অনুশ্রী বিরক্ত নিয়ে বলে,“আপনি আবার আমার পিছু নিচ্ছেন ইহান?”

ইহানের ঠোঁটে তখন মিষ্টি হাসি। সে হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে শুধায়,“যা এটা কি করলেন অনুশ্রী? ধরা পড়ে গেলেন তো।”

অনুশ্রী অবাক হয়ে বলল,
“কিসের ধরা?”
“আপনি আমায় ভালোবাসেন তার ধরা।”

অনুশ্রীর বিস্ময়ের শেষ নেই। সে তাকায় ইহানের দিকে। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“মানে?”
“আমি শুনেছি আমরা যাদের মন থেকে পছন্দ করি বা ভালোবাসি তাদের না দেখেই আমাদের আশেপাশে তারা আছে কি না এটা উপলব্ধি করি। আপনি কিছুক্ষণ আগে আমায় না দেখেই বলে দিয়েছেন আমি এসেছি। এটাকে কি প্রেম বলে না অনুশ্রী?”

অনুশ্রী উচ্চ শব্দে হাসল। ইহানের বুকে জ্বালা ধরাল সেই হাসি। ইহান নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটছে। অনুশ্রী বলে,
“আপনি আসলেও একটা পাগল ইহান। কে বলেছে আমি আপনাকে দেখিনি। আপনার পায়ের জুতো দেখেই আমি বুঝেছিলাম এটা আপনি। তাহলে কোথায় আপনায় দেখলাম না? আর তাছাড়া আমার পিছু নেয়া মানুষটা আপনি ছাড়া আর কে আছে বলুন তো। সোজাসাপ্টা বলছি,আমার পিছু ছাড়ুন ইহান। আমি আপনায় কখনোই ভালোবাসব না।”

ইহানের তড়িৎ উত্তর,
“আমায় ভালোবাসতে আপনি বাধ্য অনু।”
“আমি বাধ্য নই।”
“অবশ্যই বাধ্য।”
“বাড়ি যান ইহান।”

ইহান গেল না। নিঃশব্দে হাঁটল। অনুশ্রী দ্রুত হাঁটা ধরল। রাস্তার কিনারা ছেড়ে ফুটপাতে পা রাখল। কিছুদূরেই নর্দমার জমা পানি দেখা যায়। নির্ঘাত কাল বিকেলের বৃষ্টির পানি। বৃষ্টির পানি হলেও নর্দমায় মিলেমিশে কালো পানি দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে দ্রুত যেতে হবে। নয়তো পাশ থেকে কোনো গাড়ি গেলে অনুশ্রীকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। যেটা বর্তমানে অনুশ্রী মোটেও চাচ্ছে না। অনুশ্রী খানিকটা ভয়ার্ত মুখে ছুটে চললো দ্রুত। ইহানও পিছু পিছু আসে তখন। আচমকাই দূর থেকে গাড়ি আসতে দেখা যায়। অনুশ্রী তখন নর্দমার পানির মাঝপথে দাঁড়ানো। অনুশ্রী দ্রুত হাঁটে তখনই ঘটে আরেক বিস্মিত ঘটনা অনুশ্রীর জুতো ছিড়ে যায় হঠাৎ। অনুশ্রী দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগে গাড়িটা ফুল স্পিডে চলে যায়। অনুশ্রী ভয়ার্ত হয় প্রচুর। হাতের ছাতা দিয়ে নিজেকে ঢাকবে তারও সময় পায় না। অনুশ্রী ভয়ার্ত বেসে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার সাদাজামা বোধহয় গেল। কিছু সময় যায় পরিবেশ হয় শান্ত। অনুশ্রী উপলব্ধি করে সে ভেজে নি। তার গায়ে কোনো প্রকার নর্দমার পানি লাগে নি। অনুশ্রী চোখ খুলে তাকায়। তখনই দেখে তাকে ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল ইহান। ইহানের সমস্ত শরীর নর্দমার পানিতে ভিজে। অনুশ্রী বিস্মিত নজরে তাকিয়ে। ইহান মিষ্টি হেঁসে আওড়ায়,
“দেখলেন অনুশ্রী, আপনার প্রেমবৃষ্টিতে নিজেকে ভিজাতে পারলাম না, অথচ নর্দমার বৃষ্টি কি সুন্দর আমায় ভিজিয়ে দিল।”

#চলবে…..

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.