যে প্রেম হঠাৎ আসে পর্ব-০৪

0
99

#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:০৪

টানা চারদিনের জ্বরে ভুগে আজ খানিকটা সুস্থ ইহান। আশপাশের পরিবেশ ঠেকছে ফুড়ফুড়ে। সূর্যের মৃদু রোদে চারপাশ ফকফকে। ইহান গায়ের কাঁথা সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। সেই মুহুর্তে তার রুমে প্রবেশ করল ইহানের মা আকলিমা বেগম। ইহানকে বসতে দেখে তিনি খুশি হলেন। ছেলেটার জ্বরে ঘোরে চারদিন যাবৎ হুস ছিল না। আকলিমা বেগম খুশি মনে বললেন,
“শরীর ভালো লাগছে আব্বা?”

ইহান তক্ষৎণাৎ মায়ের পানে চায়। মাথা নাড়িয়ে জানায়, “হ্যাঁ আম্মা।”

আকলিমা বেগম ইহানের পাশ দিয়ে বসলেন। আঁচল দিয়ে ছেলের চোখ-মুখ মুছে বললেন,
“জানিস, চারদিন যাবৎ তোর হুস ছিল না। এমন জ্বর কিভাবে বাঁধালি আব্বা? সেদিন হঠাৎ ভিজেপুড়ে বাসায় এলি। কিভাবে ভিজলি– জিজ্ঞেস করলেও বললি না। কি হইছে আব্বা?”

ইহান তার মাকে জড়িয়ে ধরে। আদুরে কণ্ঠে বলে,
“আম্মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেও।”

আকলিমা বেগম খুশি মনে ছেলের মাথায় হাত বুলালেন। বললেন, “কিছু হইছে আব্বা?”

ইহানের উত্তর,
“কিছু হয় নি আম্মা।”
“তোর বাবা বলল তুই নাকি ঝন্টুর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গোসল করছিলি।”
“চেয়ারম্যান সাহেব তো কতকিছুই বলেন– ওনার কথা গায়ে মাখতে আছে কি?”

আকলিমা বেগম কিছু বললেন না। ছেলে যে কিছু একটা লুকাচ্ছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। আর স্বামীও যে মিথ্যে বলে নি তাও তিনি জানেন। আকলিমা বেগম কিছু বললেন না। চুপ থাকলেন। আলতো হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলালেন।’


দিনটি বুধবার। কৃষ্ণচূড়া রঙা জামা পড়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে অনুজা। চোখেমুখে বিস্ময়। খানিকটা চিন্তার ছোঁয়া। চিন্তার কারণটি হচ্ছে ইহান। ইহানের বিগত কিছুদিন যাবৎ জ্বর। অনুজা জেনেছে। জেনেই তার খারাপ লাগছে। কারণ ইহানের এই অসুস্থটা তো তার জন্যই। অনুজা বুঝতে পারে ইহান তার কাজে দুঃখ পায়। আঘাত পায়। তবুও তার পিছু ছাড়ে না। কেন ছাড়ে না অনুজার পিছু? অনুজা চায় ইহান তার পিছু ছেড়ে দিক। সেদিন রাতে ইহানের বলা সেই, “আমার শহর ভীষণ অসুস্থ রাত্রীপ্রিয়া, আপনি কেন সুখের ঔষধ হয়ে আমার শহরে আসেন না?”– কথাটা আজও অনুজার কানে বাজে। অনুজা কি করে?– কারো সুখের ঔষধ হতে পারে। ইহান তাকে নিয়ে বেশি ভাবছে। অনুভূতি বাড়াচ্ছে। ইহান কেন বুঝে না?– অনুজারা কাউকে ভালোবাসতে পারে না। কাউকেই না। অনুজা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে আওড়ায়,“আমি কারো সুখের ঔষধ নই ইহান। আমার সাথে আপনি কখনোই সুখি হবেন না। কখনোই হবেন না।”

এই উত্তরটা কি সেদিন রাতে দেয়া যেত ইহানকে? বোধহয় যেত। কিন্তু অনুজা দেয় নি। সে নীরবে স্থান ত্যাগ করে চলে আসে ঘরে। সারারাত আর ঘুম হলো না সেদিন। এরপর আর ইহানের দেখা নেই। অনুজা আঁচ করেছিল ইহান অসুস্থ। শেষমেশ তাই বেরুলো। দূর থেকে বাস আসতে দেখা যায়। অনুজা তার ভাবনা থেকে বের হয়। এগিয়ে যায় কাছে। বাস তার গন্তব্যে এসে থামে। অনুজা উঠতে যাবে তখনই কণ্ঠ শোনা যায় ইহানের। সে শুকনো কণ্ঠে বলে,
“মিস কৃষ্ণচূড়া, দাঁড়ান।”

অনুজা তক্ষৎণাৎ চমকে পিছন ফিরল। ইহানকে নজরে আসল তার। তবুও অনুজা দাঁড়াল না। দ্রুত বাসে উঠে গেল। এই ছেলে আর শোধরানোর নয়। অনুজা এত অবহেলা করে তবুও তার পিছু ছাড়ে না।’

এদিকে ইহান,
অনুজাকে বাসে উঠতে দেখে সেও দ্রুত উঠে পড়ে। কতদিন যাবৎ অনুজার সাথে কথোপকথন নেই ইহানের। এ কি মানা যায়! তাই তো একটু সুস্থ হতেই ইহান ছুট্টে চলে আসে অনুজার কাছে। অথচ দেখ, মেয়েটা দিব্যি ভাব নিয়ে চলে গেল। মেয়েটার আসলে ইহানকে ব্যাথা না দিলে চলে না।”

ইহান বাসে উঠে দম ফেলে। চারপাশে চোখ বুলায়। একদম শেষের সিটের আগের সিটটার জানালার ধারে বসেছে অনুজা। চোখে-মুখে অশেষ বিরক্তি। ইহান হেঁসে এগিয়ে গেল সেখানে। অনুজার নজরে পড়ল তাকে। অনুজা অবাক হয়। বিস্মিত নজরে তাকিয়ে। ইহান হেঁটে এসে অনুজার পাশের সিটটায় ঘাপটি মেরে বসে। জোরে দম ফেলে বলে,
“অবশেষে আপনার দেখা পেলাম অনুজা।”

অনুজা কথা বলে না। বাস চলতে শুরু করে। ইহান পুনরায় আওড়ায়, “কথা বলবেন না কৃষ্ণচূড়া?”

অনুজার চোখে হতাশ। মুখে বিরক্তির ছোঁয়া। সে বলে,
“আমার পিছু কেন ছাড়েন না ইহান?”
“পিছু ছাড়ব বলে তো পিছু নেই নি অনু।”
“আমাকে ভুলে যাচ্ছেন না কেন ইহান?”
“আপনি কি ভুলে যাওয়ার মতো মানুষ বলুন?–যে ভুলে যাব।”
“আমি মনে রাখার মতো মানুষও নই।”
“সারা পৃথিবীর কাছে হলেও আমার কাছে নন।”
“আমার আপনাকে পছন্দ নয়।”
“জানি তো।”
“তবুও আসেন কেন?”
“ভালো লাগে তাই।”
“ভালো লাগা বন্ধ করুন। পৃথিবীতে সব মানুষকে ভালো লাগতে নেই।”
“আপনি কি কখনো মার খেতে খেতে প্রেমে পড়েছেন অনুজা?– পড়েন নি। কিন্তু আমি পড়েছি। দারুণভাবে পড়েছি। তাই তো আপনাকে ছাড়তে পারি না।”

অনুজার টনক নড়ল। মুখ ফসকে বলেই উঠল,
“সেদিন আপনার বাবা আপনাকে কেন মারছিলেন ইহান?”

ইহান বাসের সিটে শরীর এলিয়ে দেয়। ক্লান্তহীন মুখে শুধায়,
“যেদিন আপনি আমার হবেন সেদিন বলব।”
“আমি আপনার কখনোই হব না।”
“দেখা যাবে।”
“দেখার কিছু নেই। আমি জানি আমি আপনার হব না।”
“একবার সুযোগ তো দিয়ে দেখুন। আমি আপনাকে আমার করেই ছাড়ব।”
“অনুজারা কাউকে সুযোগ দেয় না।”
“গোটা একটা দিন আমার সাথে কাটিয়ে তো দেখুন। আপনি প্রেমে পড়তে বাধ্য হবেন অনু।”
“আমি আপনার সাথে একঘন্টাও কাটাতে চাই না। সেখানে গোটা একটা দিন প্রশ্নই আসে না।”
“ভয় পেয়ে গেলেন বুঝি?”
“আপনি যা মনে করুন।”

বাস থামল। অনুজা নেমে পড়ল। ইহান নামল না। চুপচাপ বসে রইল। শরীর ক্লান্তিত লাগছে তার।’


রাতের আকাশটা আজ বড্ড সুন্দর। অনুজা দাড়িয়ে আছে তাদের বিল্ডিংয়ের রেলিংহীন ছাঁদে। ঘড়িতে বড়জোর আট’টা। আজকের শেষের টিউশনের মাহিন নামের ছেলেটা পড়ে নি। কোথাও একটা গেছে। যার দরুন দ্রুত বাড়ি ফেরা অনুজার। আজকাল দিনগুলোও কেমন তীক্ষ্ণ লাগে?– সহজে কাটতেই চায় না। অনুজা পুরো ছাঁদে ঘুরে ঘুরে হাঁটে। চারপাশের উঁচু বিল্ডিং দেখা যায়। দেখা যায় ছেলেদের খেলার মাঠ। উই দূরে বড় বড় ছেলেরা লাইট জ্বালিয়ে ক্রিকেট খেলছে। ইহানও খেলে। কিন্তু আজ খেলছে না। রাতের আকাশে চাঁদ দেখা যায়। অনুজা তাকায় সেদিকে। হঠাৎই ধুপ করে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। অনুজা চমকে উঠে সামনে থাকায়। ইহান দাঁড়িয়ে। পড়নে সবুজরঙা শার্ট, কালো প্যান্ট। চোখ এখনও লাল। অনুজা আতঙ্কিত স্বরে বলে,
“আপনি এখানে এলেন কেন?– চলে যান ইহান।”

ইহান হেঁটে এগিয়ে আসে। হাত ঘষতে ঘষতে বলে,
“যেহেতু আপনি আমার কেউ হন না। সেহেতু আপনার কথা আমি শুনব কেন?”

ইহানের কথা শুনে অনুজা হেঁসে ফেলে। দারুণ সুন্দর দেখায় সেই হাসি। ইহান চেয়ে রয়। মনে মনে আওড়ায়, “এভাবে হাসবেন না অনু, আপনার হাসিতে আমার দুঃখ লাগে।”

অনুজা তার হাসি থামায়। মৃদু কণ্ঠে জানায়,
“আমার কথা আমাকেই ফিরাচ্ছেন ইহান?”
“যে গোটা আমিটাকে ফেরাতে পারে,– তার একটি কথা আমি কি ফেরাতে পারি না?”

অনুজা কিছু বলে না। চুপ করে রয়।’
সুনসান নীরবতা বিরাজ করে পুরো ছাঁদে। হঠাৎ কারো পদধ্বনি শোনা যায়। অনুজা আঁতকে ওঠে। ভয়ার্ত কণ্ঠে শুধায়, “কেউ আসছে ইহান?”

ইহানের ডোন্ট কেয়ার ভাব,
“তো?”
“প্লিজ, চলে যান।”
“আমাকে গোটা একটা দিন না দিলে আমি যাচ্ছি না।”
“পাগলামি করা বন্ধ করুন।”
“আপনি পাগল বানাতে পারেন। আর আমি পাগলামি করলেই দোষ।”

পায়ের ধ্বনি ক্রমশ বাড়ে। অনুজার চোখের মুখে বিস্ময়। সে আওড়ায়,
“প্লিজ ইহান, চলে যান। কেউ দেখে নিলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে।”
“আপনি শুধু আমার হয়ে যান। আমি সবটা বুঝে নিব।”

অনুজার বুকের ধুকপুকানি বাড়ে। আর বোধহয় রক্ষা হলো না। অনুজা আরেকবার বলে,
“আপনি কি সত্যি যাবেন না ইহান?”

ইহানের তড়িৎ উত্তর,“না।”
অনুজা আর কিছু বলতে পারে না। ইহান আবার বলে,
“আমাকে গোটা একটা দিন না দিলে আমি সত্যি যাচ্ছি না।”
“জোর করলেই মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না ইহান।”

কথাটা বলেই ছাদের দরজার দিকে হেঁটে যায় অনুজা। সঙ্গে সঙ্গে দেখা মিলে পাঁচতলার রুনা আন্টির সঙ্গে। অনুজা কেঁপে ওঠে। মানুষটা সাঙ্ঘাতিক। তিলকে তাল বানাতে বেশ পটু। অনুজাকে আচমকা দেখেই সন্দেহের বীচ বাজল রুনা বেগমের। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “রাতের আঁধারে ছাঁদে কি করছ অনুজা?”

অনুজার কাঁপা উত্তর, “তেমন কিছুই না আন্টি।– এমনি হাঁটছিলাম।”

রুনা আন্টি মানলেন না। তিনি তড়িৎ গতিতে ছাঁদের ভিতর ঢুকলেন। অনুজা থমকে গেল। ইহানকে দেখে ফেলেছেন নিশ্চিত। রুনা আন্টি চারপাশ চোখ বিলান। অবাক হয়ে বলেন, “তুমি একা হাঁটছো অনুজা?”

অনুজা দ্রুত পিছন ঘুরে চায়। না ইহান নেই। পুরো ছাঁদের কোথাও ইহান নেই। অনুজা অবাক হয়। রুনা আন্টি আবার প্রশ্ন করেন, “কি হলো অনুজা?– কথা বলছ না কেন?”

অনুজা মৃদু হেঁসে জানায়, “জি আন্টি। একাই হাঁটছিলাম। বিয়ে তো করি নি করলে জামাই নিয়ে হাঁটতাম।”

রুনা বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না। সকাল বেলা ছাঁদে আচার শুকোতে দিয়েছিলেন তিনি। সারাদিন মনে ছিল না। মাত্র মনে পড়াতে নিতে এসেছেন। রুনা বেগম দ্রুত আচারের বৈয়ামটা নিলেন। নিচে যেতে যেতে বললেন, “রাত-বেরাতে একা একা ছাঁদে থাকতে নেই অনুজা। তাড়াতাড়ি ঘরে যেও।”

অনুজা মিষ্টি হেঁসে উত্তর দেয়, “জি আন্টি।”
রুনা বেগম চলে যান। অনুজা আশপাশ দেখে ইহান গেল কই? তখনই ওপাশের ছাঁদ থেকে ইহানের কণ্ঠ শোনা যায়। সে হেঁটে যেতে যেতে গায়,
❝তুমি আকাশের বুকে বিশালতার উপমা,
তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা।❞

#চলবে…