#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:১০
“আমি যদি আপনাকে কিছু দিতে চাই অনু, আপনি কি নিবেন?”
হঠাৎই নীরবতার দড়ি ছিন্ন করে কথাটা বলল ইহান। কথা শুনে অনুজা ঘুরে তাকায়। প্রশ্ন করে তক্ষৎণাৎ,
“আপনার মনে হয় না এই আবদারটা শোভনীয় নয়।”
“আমি জানি শোভনীয় নয়, তবুও আমি চাইব আপনি উপহারটা নিন।”
“আমি নিব না ইহান।”
“প্লিজ অনু। নিন।”
এই বলে আড়াল করে রাখা জিনিসটা বের করল ইহান। একটা শপিংব্যাগ। ব্যাগের ভেতর সুন্দর শাড়ি। মেরুন রঙের সুন্দর শাড়ি। অনুজার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তবুও অনুজা এটা নিতে পারবে না। বাসায় নিলে হাজারটা প্রশ্ন আসবে। এত প্রশ্নের উত্তর অনুজা দিবে কি করে?– তার থেকেও বড় কথা। এটা নিলে ইহানের অনুজার প্রতি অনুভূতি বা প্রত্যাশা আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই ইহান যতই বলুক। অনুজা এটা নিবে না। ইহান শাড়িটা অনুজার হাতে এগিয়ে দিল। অনুজা নিলো। ইহান প্রশ্ন করল,
“শাড়িটা কেমন?”
“সুন্দর। কিন্তু আমি এটা নিতে পারব না ইহান।”
ফিরিয়ে দিয়ে বলল অনুজা। ইহানের হতাশার মুখ। সে শুধায়,
“আমি আপনায় অনুরোধ করছি অনু।”
“প্লিজ ইহান। আপনি বুঝুন, এটা নিলে বাসায় হাজারটা প্রশ্ন উঠবে। আমি সেই প্রশ্নের ভাড় নিতে পারব না। তাই প্লিজ এটা নেয়ার অনুরোধ করবেন না।”
ইহান আর পুনরায় কিছু বলল না। বসে রইল অনেকক্ষণ। দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। বুঝল। পরিশেষে বলল, “আপনায় নিতে হবে না অনু, আপনি শুধু আজকের বাকি দিনটুকুর জন্য পড়ুন। এবার অন্তত মানা করবেন না।”
ইহানের শেষ আশা। অনুজা মেনে নিলো। চেয়েও আর মানা করতে পারল না। বলল, “ঠিক আছে।”
অনুজা পুনরায় শাড়িটা হাতে নিলো। তাতে পেটিকোট, ব্লাউজ সবই ছিল। হঠাৎ ইহান বলে,
“আমার কিছু কাজ আছে অনু। আপনি কি?– আধঘন্টা এখানে একা কাটাতে পারবেন।”
অনুজা অবাক হয়ে বলল,
“কোথায় যাবেন?”
“দূরে নয় কাছেই যাব। আপনি ডাকলেই আমায় পাবেন।”
“আপনি যাবেনটা কোথায়?”
“আসলে গোসল করতে যাব। আমার আবার মেয়েমানুষদের সামনে গোসল করতে লজ্জা লজ্জা লাগে তাই আর কি।”
ইহানের কথা শুনে অনুজা হেঁসে ফেলে,
“ওহ! এই ব্যাপার। আচ্ছা যান।”
ইহান তক্ষৎণাৎ উঠে দাঁড়ায়। ভাব নিয়ে বলে,
“আমি কিন্তু আধঘন্টার আগে ফিরছি না। আমার আবার গোসল করতে আধঘন্টা সময় লাগে।”
“ঠিক আছে। যান। সমস্যা নেই।”
ইহান আর দাঁড়াল না। তাঁবুতে ঢুকে নিজের জামাকাপড় নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার পথে আবার বলল, “আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই আধঘন্টার আগে ফিরছি না।”
অনুজা হাসতে হাসতে জবাব দেয়,
“ঠিক আছে ইহান। আমি ভীতু নই।”
“আচ্ছা।”
ইহান চলে গেল। অনুজা ইহানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ তার মনটা নেচে উঠল। যেহেতু অনুজার কাছে পড়ার জন্য পোশাক আছে। আর ইহানও ধারে কাছে নেই। তাহলে তো অনুজা চাইলেই ঝর্ণার পানিতে গোসল সারতে পারে। অনুজা লাফ মেরে উঠল। মোবাইলে এলার্ম সেট করে ছুটে গেল দ্রুত।”
অন্যদিকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়া ইহান অনুজাকে ঝর্ণার দিকে যেতে দেখে খুশি হলো। ইহান বুঝেছিল অনুজার ভিতরকার ইচ্ছা। তাই তো এত বাহানা। ইহান কোথাও গেল না। গাছের আড়ালে উল্টোদিক ঘুরে বসে রইল। দূর থেকে অনুজার পানিতে লাফালাফি করার আর হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা আজ দারুণ খুশি। এই সুন্দর নির্জন প্রকৃতি তাকে কাবু করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। ইহান নিরালায় মৃদুহাসে। ঘুরে তাকায় না আর। বসে থাকে চুপচাপ।’
–
ইহান ত্রিশ মিনিট পর ফিরবে বললেও সে ফিরল আরো দশ মিনিট পর। অনুজা ততক্ষণে গোসল সেরে শাড়ি পড়ে রেডি। আশ্চর্যের ব্যাপার ইহানের আনা পেটিকোট আর ব্লাউজ দুটোই পারফেক্টলি ফিট হয়েছে অনুজার। অনুজা তার ভেজালো পোশাক উইদূরে শুকোতে দিয়েছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুকোলে হয়। নয়তো আরেক বিপদ। প্রবল বাতাস বইছে চারিপাশে। অনুজার ধারণা শুকিয়ে যাবে।’
ইহান তার ভেজালো কাপড় ভালোমতো নিগড়ে শুকোতে দিচ্ছে। অনুজা দূর থেকে তাকিয়ে। সদ্য গোসল করে আসায় ইহানকে অনেকটা সতেজ দেখাচ্ছে। ইহান যথেষ্ট সুদর্শন যুবক। গোসল সেরে আসায় তার সুদর্শনতা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেল যেন। অনুজা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ইহানের দিকে। হুস আসতেই দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। সে সত্যি সত্যি ইহানের প্রেমে পড়ে যাচ্ছিল নাকি। অনুজা আঁতকে উঠল। এটা সম্ভব নয়। অনুজা কখনই ইহানকে ভালোবাসতে পারে না। তার প্রেমে পড়তে পারে না। অনুজা মাথা ঝেড়ে বসল।’
ইহান এগিয়ে আসে। মৃদু হেসে বলে,
“দুঃখিত, একটু দেরি হয়ে গেল।”
“কোনো ব্যাপার না।”
“আমাকে দশমিনিট সময় দিন আমি এক্ষুণি খাবার সাজাচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
ঘড়ির কাঁটায় দুপুর দেড়টা ছাড়িয়ে। শুঁকনো জমিনের ওপর চাদর বিছিয়ে সবুজ উঠোনে সামনাসামনি বসেছে ইহান আর অনুজা। তাদের সামনেই রয়েছে দুটো প্লেটে খিচুড়ি বাড়া, আর একটা প্লেটে পাঁচ পিস মাছ ভাজা। ছালাত হিসেবে টমেটো, শশা। টকের স্বাদ পেতে চার টুকরো লেবু। বোতল ভর্তি বিশুদ্ধ পানি। আর সফট ড্রিংকস।’
এছাড়া রয়েছে খোলা আকাশ। প্রকৃতি ছোঁয়া বাতাস। ছায়া দেয়ার জন্য গাছ। স্রোতে ভরা বিল। পাখিদের কলরব। আর সুন্দর সময়।’
ইহান অনুজার পাতে একপিস মাছ এগিয়ে দিয়ে বলল, “শুরু করুন অনু। দেখুন জীবনে প্রথম বার রান্না করলাম। ভালো হলে ভালো বলবেন। ভালো না হলে বলার দরকার নেই। দুধভাত মনে করে চুপিচুপি খেয়ে নিবেন। আমি কিছু মনে করব না।”
অনুজা হেঁসেই উত্তর দিল, “ঠিক আছে।”
অনুজা শুরুতে একটুখানি খিচুড়ি মুখে দিল। একটু চিবুতেই বলে উঠল, “দারুণ হয়েছে ইহান।”
ইহানের মুখে হাসি ফোটে। যাক রাত জেগে ইউটিউব দেখাটা বৃথা যায়নি।’
সুন্দর সময় আর অফুরন্ত ভালোলাগা নিয়ে হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে পার হলো ইহান অনুজার দুপুরের খাবার। তবে তারা একা নয়। তাদের খাবারের ভাগ বসাতে ছুটে এসেছিল ছোট্ট ছোট্ট দুষ্ট পাখি। ইহান করছিল তাদের নিয়ে বাড়াবাড়ি। আর অনুজা সায় দিয়ে করছিল হাসাহাসি। দারুণ মিষ্টিময় সময়।’
বেলা প্রায় বিকেল চারটার দখলে। ইহান অনুজা শুয়ে আছে শুঁকনো জমিনের ওপর বেশ দূরত্ব নিয়ে। এর শুরুটা হয়েছিল ইহানের মাধ্যমে। ইহান আগে শুয়ে পড়ে। অনুজা শুতে চায় না। ইহানও এবার আর জোর করে না। কিছু সময় পর অনুজা নিজেই শুয়ে পড়ে। এখান থেকে আকাশটা বড্ড মায়াবী লাগছে। অনুজা প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা ইহান, এই জায়গাটার নাম কি?”
ইহানের খামখেয়ালির উত্তর,
“আপনায় বলব কেন?”
“আশ্চর্য! বললে কি হবে?”
“জামাই নিয়ে ঘুরতে আসবেন।”
“বাজে বকা বন্ধ করুন।”
“আচ্ছা করলাম। এই জায়গাটার কোনো নাম নেই।”
“সত্যি কি নাম নেই?”
“জানি না। একবার একবন্ধুর সাথে তার বাইকে চড়ে এদিকটায় এসেছিলাম তখনই এটা দেখি। ব্যস সুযোগ বুঝে আপনায় নিয়ে এলাম।”
“তাই বলে নাম হবে না।”
“আচ্ছা। তাহলে, আজ থেকে আপনার জন্য এই জায়গার নাম ‘নামহীন নগর।”
অনুজা অবাক হয়ে মনে মনে দু’বার আওড়ায়,
“নামহীন নগর, নামহীন নগর। অদ্ভুত মানুষের অদ্ভুত নাম।”
অনুজা আনমনা হাসে। কিছু সময়ের নীরবতা চলে। হঠাৎ ইহান মলিন মুখে প্রশ্ন করে,
“আমায় ভালো কেন বাসেন না অনু?”
অনুজার বুকের ভেতর আচমকা কামড়ে ওঠে। প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। অনুজা শোয়া থেকে উঠে বসে। ইহানও বসে। আবার বলে,
“কেন বাসেন না অনু? আমায় একটু ভালোবাসলে কি হয় আপনার?”
অনুজা কিছু সময় চুপ থেকে জানায়,
“আপনাকে আমার ভালো লাগে না।”
“আপনি মিথ্যে বলেন।”
“আমার সত্যিটাকে আপনি মিথ্যে মনে করলে আমি কি– করতে পারি বলুন!”
“আমায় ভালো না লাগলে– আপনি কি সত্যিই আমার সাথে আসতেন?”
“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন, আপনার সাথে চুক্তি হয়েছে আমার।”
ইহান চুপ হয়ে যায়। অনুজা বলে,
“আমার মনে হয় আমাদের এখন এখান থেকে বের হওয়া উচিত।”
“আমায় কি সত্যিই ভালোবাসা যায় না অনু?”
“আপনাকে ভালোবাসা যায় কিনা জানি না। কিন্তু আমি আপনায় ভালোবাসতে পারব না।”
“সমস্যাটা কোথায়?”
“গোটা আপনিটাই একটা সমস্যা।”
“আপনার বাবা আমায় পছন্দ করেন না এটাই কি সমস্যা?”
“ধরে নিন তাই।”
“কিন্তু বিয়ে তো আমি আপনার বাবাকে করব না। তাহলে তার পছন্দের কি দরকার?”
অনুজা তড়িৎ রেগে তীক্ষ্ণ স্বরে শুধায়,
“পাগলের মতো কথা বলবেন না। যে লালনপালন, যত্ন দিয়ে বড় করেছে তার পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার থাকবে না। আর আপনাকে কেন বাবা পছন্দ করবে? আপনি পড়াশোনা শেষ করেও বেকার ঘুরছেন, সারাদিন শুধু পাড়ায় পাড়ায় টো টো করেন, ঝন্টুর দোকানে বসে জুয়ার মতো কেরাম খেলেন, বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করেন। তাহলে কোন মেয়ের বাবা আপনাকে তার জামাই হিসেবে পছন্দ করবে বলুন। তাই এসব আবেগী ভালোবাসা বাদ দিন।”
শেষের কথাটা ছুরির ন্যায় বুকে আঘাত হানল ইহানের। সে শুধু এতটুকু বলে,
“আমার ভালোবাসা আপনার কাছে আবেগ লাগে অনুজা?”
“তা নয়তো কি– এসব বাদ দিন। এগুলো বলাও বেকার। এখন বাড়ি কি যাবেন?”
ইহান বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। উল্টোদিক ঘুরে বলল, “তৈরি হয়ে নিন।”
শেষ কথাটা কেমন যেন ঠেকল ইহানের। ছেলেটা কাঁদছে নাকি! থমকে উঠল অনুজা। বলতে বলতে একটু বেশিই বলে দিল নাকি। অনুজা ডেকে উঠল,
“ইহান।”
ইহান দাঁড়াল না। হঠাৎই হাঁটা ধরল।’
–
অনুজারা যখন বাসস্ট্যান্ডে নামে তখন সন্ধ্যে। সারাপথে ইহান কোনো কথা বলল না। অনুজার কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও বলা গেল না। যাওয়ার পথে শুধু বিষণ্ণমুখে ইহান শুধায়, “আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি অনু, শাড়িতে আজ আপনায় সুন্দর লাগছিল। ভালো থাকবেন।”
ইহান চলে গেল। অনুজা ঠায় দাঁড়িয়ে। সে লক্ষ্য করল ইহান যাওয়ার পথে একবারও ঘুরে তাকায়নি। ওদিকে এমনে সময় কতবার ঘুরে তাকায়। অনুজার হঠাৎ মনে হলো অবশেষে অনুজার পিছু ছাড়ল বুঝি ইহান। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। অনুজা ধরতে পারল না দীর্ঘশ্বাসটা কিসের?– স্বস্তির নাকি বিষণ্ণতার।’
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️.