#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৪
সদর টিনের দরজায় সজোরে আ/ঘাত করল মোহ। মেঘের গুড়গুড় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সামান্য ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। ইথানের গায়ে বৃষ্টি পড়লেই ঠাণ্ডা লাগার ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে। অনেক সময় অপেক্ষা করার পর দরজার ওপাশ থেকে ছিটকিনি খোলার শব্দ শোনা গেল। দরজা দুদিকে সরিয়ে দিয়ে লাঠি হাতে এক বৃদ্ধা মহিলা প্রচণ্ড খুশি হয়ে প্রফুল্লের সাথে বলে উঠলেন,
“কে আইছে গো! আমার সুন্দরী আইছে। আমার একমাত্র নাতনি আইছে।”
রাবেয়া বেগম অর্থাৎ নিজের দাদীমার এত আনন্দ দেখে না হেসে পারল না মোহ। ফিক করে হেসে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মানুষটিকে। সালাম দিয়ে বলল,
“কেমন আছো দাদীজান!”
“ভালো আর থাকি কোথায়! একা একা কী আর ভালো লাগে? এহন তোরে দেইখা খুশিতে মন নাইচা উঠছে।”
রাবেয়া বেগমের কথার উত্তরে মোহ ফট করে মজা করে বলে দিলো,
“আবার সত্যি নাচ শুরু করো না এই বয়সে। কোমড় ভেঙে যাবে।”
“ভাইঙা গেলে তুই সেবা করবি। দেহি তোর মুখখানা! কেমন শুকাইয়া গেছস৷ কিছু খাস না? পাটকাঠির মতো হইতেছিস ক্যান? মাইয়া মানুষ একটু মোটাসোটা না হইলে হয়?”
“এইযে তোমার বাড়ি এসেছি। এখন তুমি ভালো মন্দ খাওয়াবে। আর আমি মোটা হবো।”
রাবেয়া বেগম আয়েশ ভঙ্গিতে বললেন,
“তা তো খাওয়ামুই। তোর পোলাডা কেমন আছে? কেমন আছো বাবু?”
ইথানও অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে সালাম দিয়ে বলল,
“আমি তো ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
রাবেয়া বেগম ইথানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সালাম নিয়ে বলল,
“এইতো ভালো, ভালো। আসো ভিতরে আসো তোমরা। বৃষ্টি আইব।”
রাবেয়া বেগমের পিছু পিছু সদর দরজা পেরিয়ে উঠোনে প্রবেশ করে মোহ আর ইথান। উঠোনের ডান পাশে মাটির চুলাসহ রান্নাবান্না করার জন্য ছাউনি দেওয়া। সামনে যেতেই দেখল ইটের পাকা বাড়ি। দুই বছর আগেই মাটির বাড়ি ভেঙে ইটের বাড়ি তৈরি করা হয়েছে৷ প্রায় বহুদিন পর গ্রামের বাড়ির নিজের ঘরে পা রাখল মোহ। তার দাদী পরিষ্কার রেখেছে সব কিছুই৷ ব্যাগ বিছানায় রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে।
দুপুরের খাবার খেয়ে দরজা খুলে দরজার কাছে বসলেন রাবেয়া বেগম। হাতের ছোটো বাটিটা রেখে তাতে তেল ঢেলে হাক ছেড়ে ডাকলেন নাতনীকে।
“মোহ! এই মাইয়া! এই আয় দেখি।”
মোহ ক্লান্ত শরীরে পা রাখে বারান্দায়। ঝুম বৃষ্টি প্রকৃতিকে ম্লান করে তুলছে। বাতাসের চোটে বাঁকা হয়ে আসছে বৃষ্টির ঝাঁপটা। মোহ দাদীর কাছে গিয়ে বসল। রাবেয়া বেগম যত্ন করে মোহের আঁকাবাঁকা ঢেউ খেলানোর ন্যায় চুলে হাত দিয়ে তেল দিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“তেলও তো দিস না চুলে। কী করছস এগুলা চুলের?”
“ঘরে-বাইরে যেতে হয় দাদীজান। তখন তেল কে দেয়?”
“হ বুঝি তোগো মতো মাইয়াগো শখ! বাইরে ফ্যাশন কইরা চুল খুইলা যাবি আর পোলাদের দেখাবি।”
মোহ ফিক করে হেসে দেয়। বলে,
“কী এসব বলো দাদীজান? তা এসব তুমি জানো কীভাবে? নিশ্চয় তুমিও এসব করেছ এককালে!”
“আমাদের সময় এগুলা শ্যাম্পু ট্যাম্পু আছিল? তেল দিয়াই ঘুরতাম। আমি যা করছি তা করছিই। তুমি কী করতাছ?”
মোহের কপাল কুঁচকে এলো রাবেয়া বেগমের এ কথায়। দাদীর দিকে ঘুরে সামনাসামনি বসল সে। উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“কী করেছি?”
রাবেয়া বেগম নির্লিপ্তে বললেন,
“সবই শুনছি আমি। এইহানে তোর মা তোরে কী জন্য পাঠাইছে আমি জানি। মন্ত্রীর পোলাডারে কী তোর ভাল্লাগে? ভালোবাসছ?”
ধুকপুকানি বাড়ল মোহের শরীরের অভ্যন্তরে থাকা সেই ছোট্ট হৃদয়ের। যেন হৃদয় দাদীজানের কথা শুনে নিয়েছে। বাহিরের প্রকৃতির শীতলতা ছাড়িয়ে সর্বাঙ্গে শীতলতায় হিম হয়ে এলো মোহ। ঢক গিলে নিজেকে শক্ত রাখার বৃথা চেষ্টায় বলল,
“ভালোবাসার কথা কোত্থেকে আসছে দাদীজান? ওসব কিছু না। কিন্তু জানি না কেমন যেন করে সবসময় ওই লোকের সামনে গিয়ে পড়ি। পরিস্থিতি এমন তৈরি হয় যে উনার নিকটস্থ থাকা ছাড়া আমার কাছে উপায়ই থাকে না। অন্যদিকে উনার বাবা যিনি সবসময় আমাদের পেছনে উঠেপড়ে লেগে আছেন। জানো তো দাদীজান? উনার বাবা আমার বাবার শিক্ষা নিয়ে কথা তুলেছে, আমার চরিত্র নিয়ে কথা তুলতেও পিছপা হননি।”
“তাতে তোর রাগ হয় নাই?”
“হয়েছে তো। খুব রাগ হয়েছে। রাগে নিজের মাথায় আ/ঘাত করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সকালেও ওই স্বচ্ছ নামক ব্যক্তিটির স্বপ্নে যেন বিভোরই হয়ে গেলাম। এরপর মায়ের সাথে কাটাকাটি হলো। বাসে উঠে অনেক ভাবলাম। পরে মনে হলো, মায়ের কাজটা ভুল নয়। বরং আমারই উচিত ছিল একাজটা করা। আমি আর কখনো স্বচ্ছ অথবা উনার পরিবার কারোর মুখোমুখি হতে চাইনা। নিজের পরিবারের সম্মান, নিজের আত্মসম্মান আমার কাছে দামী। সেই দাম রাখতে আমি এজীবনে ইচ্ছাকৃত উনার সামনাসামনি হতে চাইনা। ঘৃণা করতে চাই ভীষণ!”
বেশ মনোযোগের সহিত কথাগুলো শুনে অনেক সময় ধরে থম মেরে বসে রইলেন রাবেয়া বেগম। অতঃপর বললেন,
“ঘৃণা করতে পারবি তো? না পারলে আমারে কইবি। মনে চাইপা রাখবি না। বুঝছস?”
মোহ মলিন হাসল দাদীর কথার প্রতিত্তোরে। হৃদয়ের শীতলতা একটু একটু করে কেটে গিয়ে সেখান থেকে আগুন ছড়াচ্ছে। অপমানের আগুন, মিথ্যে অপবাদের আগুন। সেই আগুন নিজেকে শান্ত করতে হবে।
হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে স্বচ্ছ। ভ্রু দুটো অস্বাভাবিকভাবে কুঞ্চিত। চোখেমুখে অধৈর্য একটা ভাব। ফোনের স্ক্রীনে দৃষ্টি অস্থির। কর্ণকুহরে ভেসে এলো বোনের কণ্ঠস্বর। ফিরে তাকাল না সে। ফারাহ গলা ছেড়ে ডাকতে ডাকতে ঘরে আসছে।
“ভাইয়া! মাই ডিয়ার ব্রো! আমার প্রিয় ভ্রাতা! দেখো, আমি তোমার জন্য মায়ের আদেশে স্যুপ এনেছি। খেয়ে উদ্ধার করো দয়া করে।”
ফারাহ ঘরে ঢুকে স্যুপের বাটিটা একেবারে স্বচ্ছের মুখের সামনে ধরতেই এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চাইল স্বচ্ছ। ফারাহ সুন্দর হাসি দিয়ে খানিকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“গন্ধটা সুন্দর না বলো? সুন্দর তো হবেই। হওয়ারই কথা। কারণ রান্নাটা তো ফারাহ করেছে।”
“বিচ্ছিরি গন্ধ। একদম তোর ফেসের মতো বিচ্ছিরি। সরা আমার মুখে সামনে থেকে।”
ফারাহ স্যুপের বাটি নিজের কাছে নিয়ে বি/স্ফোরিত গলায় বলল,
“তুমি আমার মতো একা ফ্যাশন ডিজাইনার সঙ্গে এত পাকা একটা শেফকে আন্ডাররেস্টিমেট করছ ভাইয়া? গুণী মানুষের সাথে এমনটা করলে অভিশাপ লাগে কিন্তু।”
স্বচ্ছ এবার চরম বিরক্ত হয়ে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“আহ, ফারাহ! তোমার এসব গুণের কথা আমায় পরে শোনাবে। এখন নয় প্লিজ।”
ফারাহ বেশ তীক্ষ্ণ নজরে ভাইকে দেখল। অতঃপর স্যুপের বাটি রেখে স্বচ্ছের পাশে বসল। বুঝতে পারল তার ভাই কোনো বিষয় নিয়ে অনেকটা চিন্তিত।
“কী হয়েছে? মুখটার এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে মাত্র প্রেমে ছ্যাঁকা খেলে?”
স্বচ্ছ কিছুটা চুপ থেকে হুট করে প্রশ্ন করে ফেলল,
“আচ্ছা, ফারাহ। তোমরা মেয়েরা সবসময় এমন আচরণ করো কেন বলো তো? যখন ইচ্ছে হয়, কারোর সুন্দর করে সেবাযত্ন করো, খোঁজখবর নাও। আবার ইচ্ছে না হলে সেটা বন্ধ করে দাও। তোমাদের কি কখনো মনে হয় না? তোমাদের সেই খোঁজ নেওয়ার আশায় সেই মানুষটা বসে থাকে?”
ফারাহর চোখেমুখে বিস্ময় আর উত্তেজনা দেখা গেল ভাইয়ের প্রশ্ন শোনার পর। স্বচ্ছের বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরে বলল,
“প্রেমে সত্যিই ছ্যাঁকা খেয়ে গেলে নাকি ভাই? কথাবার্তা ব্যর্থ প্রেমিকের মতো ঠেকছে কেন?”
স্বচ্ছ নিজ উত্তর না পেয়ে উল্টো প্রশ্ন শুনে চোখমুখ জড়িয়ে হাত ঝেড়ে বলল,
“আরে আশ্চর্য! প্রেমে ছ্যাঁকা খাব কেন? তাও আবার আমার মতো মানুষ? অদ্ভুত কথাবার্তা বলো তুমি।”
“তাহলে কার কথা বলছ খুলে বলো!”
স্বচ্ছ ঢক গিলে নিলো কথা বলার আগে। মেয়েটার নাম নিতেও যেন বেগ পেতে হয় তার।
“ওইযে ওই মেয়েটা! মোহের কথা বলছিলাম। কাল সে জেনে গেল আমায় হসপিটাল থেকে ছেড়ে দেবে। বাড়ি গিয়ে একবারের জন্যও খোঁজ নিলো না আমার? যে আমি বেঁচে আছি নাকি ম/রে গেছি? কত নিষ্ঠুর তোমাদের নারী জাতির মন! একটা অসুস্থ মানুষের প্রতি সামান্য মায়াও নেই?”
ফারাহর হাসি পেল এবার। হাসি চেপে বলল,
“আচ্ছা! তাহলে ভাই মোহ রানির মোহের বেড়াজালে বাঁধা পড়ছে।”
“তেমন কিছু না। আমি শুধু বোঝার চেষ্টা করছিলাম যে এ আবার কেমন শক্ত মন? আমি হলে একবার তো খোঁজ নিতাম!”
“তো ও খোঁজ নেয়নি তাতে তোমার কী শুনি?”
ফারাহর প্রশ্নে এবার জটিল বাঁধা পড়ল স্বচ্ছ। উসখুস করতে করতে বলল,
“আমার আবার কী? কিছুই না। আমি শুধু বলছি আমার খোঁজ নেওয়া ওর দায়িত্ব! একান্ত দায়িত্ব। আর ও ওর দায়িত্ব অবহেলা করছে।”
“বড়োই অন্যায় করে ফেলেছে। আমার মনে হয় এই অন্যায়ের শা/স্তি একমাত্র মুখোমুখি হলে দিতে পারবে। দেরি কীসের?”
স্বচ্ছ এবার অপ্রস্তুত হয়ে নিজে দায়সারা ভাবে উত্তর দিতে চেষ্টা করল,
“আমার এত দায় কীসের? মোটেও ইচ্ছে নেই ওর মুখোমুখি হওয়ার।”
“তাহলে প্লিজ স্যুপটা খেয়ে বাঁচাও আমায়! আমি পাঁচ মিনিট পর আবার আসছি।”
ফারাহ চলল নিজের কাজে। অন্যদিকে অন্তর যে স্থির হলো না স্বচ্ছের। ফোনের স্ক্রিনের মোহের নম্বরটাকে দেখে কল দিতে চেয়েও রেখে দিলো। সে কেন কল করতে যাবে? করবে না। সেও নি/ষ্ঠুর হয়ে দেখাবে। কিন্তু মন যে মানে না। অস্থিরতা বাড়ে। স্বচ্ছ আনমনে বলে,
“নারী মন নাকি অত্যন্ত কোমল হয়। তোমার শক্ত মন কি একবারও আমার কথা তোমায় মনে করিয়ে দেয় নি মিস মোহ? আমায় অস্থিরতায় ফেলে মজা নিচ্ছো খুব তাই না? সময় আমারও আসবে।”
রাতটা গভীর হয়েছে। ঢাকা শহরে বৃষ্টির বেগ কমলেও একেবারে থামছে না কিছুতেই। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ময়লার স্তুপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানেই এসে গাড়ি থামায় আরিদ্র। গাড়ির ভেতরে লাইট অন করে হাতের ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। ময়লার স্তুপের পাশ দিয়ে যাওয়া গলিতে সূক্ষ্ম দৃষ্টিপাত করে টিপটিপ বৃষ্টিতেই গাড়ি থেকে নেমে আগপাছ না ভেবে গলির ভেতরে ঢুকে যায় সে। একটু হাঁটতেই আসে কাঙ্ক্ষিত জায়গা! নেত্রপল্লব চকচক করে ওঠে তার। চারিদিকে রমনীর ভীড়। প্রতিটা ঘরের দরজায় দুটো করে নারীর লাস্যময়ী দৃষ্টি টানতে বাধ্য করে যেন। নিষিদ্ধপল্লীতে এসে নিজের নিষিদ্ধ ভাবনাগুলো বাস্তবে রূপান্তর করে আরিদ্র। এত নারীর ভিড়েও চারিপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে থাকে বিশেষ একজনকে। এমন সময় তার সামনে ছাতা ধরে দাঁড়ায় একটি মধ্যবয়সী নারী। পান চিবুতে চিবুতে বলে,
“মেলা দিন পর দেখা দিলেন স্যার। তবে আপনেরে ভুলি নাই।”
আরিদ্র মৃদু হাসি দিলো।
“ভুলে যাওয়ার কথাও না। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে? তোমাদের ব্যবসার কী হাল?”
“সবই চলতেছে জম্পেশ! আপনার কী হাল? চলেন বসেন আমার ঘরে।”
আরিদ্র আর মহিলাটি গিয়ে ঘরে বসল। আরিদ্রকে বসতে দেওয়া হলো চেয়ারে। আরিদ্র প্রশ্ন করে বসল,
“লাস্ট যাকে এখানে দিয়ে গেলাম সে আছে নাকি গেছে?”
“না থাইকা যাবে কই? আছে আছে। এখনো বাজারে ওর দাম মেলা। এইযে একটু আগেই একজন পছন্দ কইরা নিয়া গেল।”
আরিদ্রের মুখে সূক্ষ্ণ হাসির রেখার দেখা মিলল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“মেনে নিয়েছে তাহলে।”
মহিলাটি হেসে হেসে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”
মিনিট দশেক গল্প পড়ার পর নূপুরের রিনঝিন আওয়াজ এলো আরিদ্রের কানে। অনুভূত হলো ঘরের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে এক রমনী। সেদিক থেকে আসছে কড়া পারফিউমের গন্ধ। এবার নারীটি বলে উঠল,
“হেনা, আজকের জন্য এটা দিয়ে গেল লোকটা।”
আরিদ্রের সাথে গল্প করা মহিলাটি অর্থাৎ এই জায়গার প্রধান তড়িঘড়ি করে টাকা দিয়ে তার কিছু অংশ মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আরিদ্র। মেয়েটি টাকা পেয়ে দ্রুত চলে যেতেই আরিদ্রের চোখে চোখ পড়ল। পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। হাত থেকে পড়ে গেল টাকা। মুখশ্রীর রঙ পাল্টে গেল। মাথা ঘুরে এলো। একহাতে দেওয়াল ধরে আটকা গলায় বলল,
“আরিদ্র! তুমি!”
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫
আরিদ্র নিঃশব্দে হেসে সেই বিস্ময়ে টাকা ফেলে দেওয়া লাস্যময়ী রমনীর মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করে নিলো। মেয়েটির লম্বা কালো কেশগুচ্ছকে আর খুঁজে পেল না আরিদ্র। অথচ হাঁটু অবধি সুন্দর চুলের বাহার দেখেই মেয়েটিকে একসময় চোখে ধরেছিল আরিদ্রের। আজ তা কোনোরকমে কোমড় ছুঁয়েছে তাও পাতলা ফিনফিনে হয়েছে চুল। মেয়েটির এলোমেলো গায়ের কাপড় দেখে আরিদ্রের বুঝতে বাকি রইল না কিছু আগেই সে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। আরিদ্রকে দেখে থরথর করে কাঁপুনি উঠেছে মেয়েটির। আরিদ্র নির্লিপ্তে বলল,
“ঈশানী যে! কেমন আছো ঈশানী?”
ঈশানী নিজেকে সামাল দিলো। শক্ত করার চেষ্টা করল মন থেকে। যান্ত্রিক স্বরে বলল,
“ঠিক যেমনটা রাখতে চেয়েছিলে তেমনটাই তো আছি। দেখছই তো।”
“হুমম দেখছি। ভালোই ইনকাম হচ্ছে তোমার। অন্তত তোমার এই রূপটাকে কোনো কাজে তো লাগিয়ে দিতে পেরেছি! তোমার কাছে একটা ধন্যবাদ পাওনা আমার।”
ছলছল দৃষ্টিপাত করল ঈশানী আরিদ্রের দিকে। এই লোকটার চোখে মায়া বলতে কিছু দেখতে পেল না সে। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“তোমার মাঝে সামান্য অপরাধবোধও নেই আরিদ্র। প্রথম দিনের মতোই অনুতাপহীন তুমি।”
আরিদ্র আগের ন্যায় হাসিমুখে তাচ্ছিল্যের সহিত জবাব দিলো,
“তো তোমার কী ধারণা? আরিদ্র কখনো পাল্টাবে?”
ঈশানী উত্তর করল না৷ চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে সেই সঙ্গে সামনেই যেন ভাসছে কোনো অভিশপ্ত অতীত। সেই অতীতের দড়ি ধরে ঈশানী আজ এখানে। ঈশানী ঢক গিলে দুয়েক পা করে এগিয়ে আরিদ্রের কাছে এলো। সাহস করে আরিদ্রের মুখের পানে তাকিয়ে বেশ আশা নিয়ে জানতে চাইল,
“তুমি যেভাবে রেখেছ আমি সেভাবে আছি। কখনো কোনোদিন পালানোর চেষ্টা করিনি। করবও না। শুধু আমায় একটা কথা বলো। আমার বাবুটা কই আছে? ওকে তুমি সাথে রেখেছ তো তাই না? ওকে ভালো মতো বড়ো করেছ তো?”
আরিদ্র একেবারেই না জানার ভান করে ভ্রু কুঁচকায় একবার। জিজ্ঞেস করে,
“কোন বাবুর কথা বলছ? মনে আসছে না ঠিক।”
ঈশানীর কান্না পেয়ে গেল। চোখজোড়া থেকে যেন বেরিয়ে আসছে জলন্ত লাভা। সেই লাভায় জ্বলে উঠছে নেত্রপল্লব। চোখমুখ খিঁচে কেঁদে উঠে আরিদ্রের বুকের শার্টের অংশ খামচে ধরল ঈশানী।
“এই তুমি এ ব্যাপারে মজা করো না৷ আমি তো শুধু একটাই আবদার করেছি তোমার কাছে। আমার বাবুটাকে ভালো রাখতে বলেছি। এতটুকু কথা তো তুমি রেখেছ তাই না বলো?”
আরিদ্র প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ঈশানীর হাত ঝেড়ে ফেলল দ্রুত। অসহ্য হয়ে বলল,
“তোমার সন্তান আমার কাছে নেই ঈশানী। ওসব উটকো ঝামেলা নিজের ঘাড়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না আমার। তোমার বাচ্চার কাহিনী সেদিনই শেষ।”
ঈশানী তেড়ে আসতে লাগে আরিদ্রের নিকটে। দুটো হাত ধরে ফেলেন হেনা। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ঈশানী। ছটফট করতে থাকে বিরতিহীনভাবে। এমতাবস্থায় এলোমেলো শাড়ির কুঁচি খুলে পড়ে। দৃশ্যমান হয় ঈশানীর পেট ও খোলা কোমড়। হেনা দ্রুত ডাকেন বাকি মেয়েদেরকে।
“এই কে কোথায় আছিস! এই ছেড়িডারে নিয়া যা এহনি।”
চারজন মেয়ে ছুটে এসে ঈশানীকে ধরে ফেলল। টানতে টানতে বাহিরে নিয়ে গেল। ঈশানীর মুখের কথা থামানো গেল না। যাওয়ার আগে বলে গেল,
“তোরে আমি ছাড়ুম না। আমি ছাড়লেও তোর পাপ তোরে ছাড়বে না। মিলিয়ে নিস।”
একারণেই আসার একেবারে ইচ্ছে ছিল না আরিদ্রের। কিন্তু হেনা ডেকেছিল তাকে। বাধ্য হয়ে আসা। পুরো শরীর রি রি করছে ক্রোধের আগুনে। হয়ত কেউ মাঝখানে না থাকলে ঈশানীর কোনো ব্যবস্থা করেই ক্ষ্যান্ত হতো আরিদ্র। তবে তা হওয়ার নয়।
রাত এগারোটা বাজতে চলল প্রায়। জানালার বাহিরে চেয়ে একমনে অন্তরিক্ষে বিদ্যুৎ চমকানো দেখছে স্বচ্ছ। ঘন কালো আকাশ যখন হঠাৎ হঠাৎ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন তা উপভোগ করছে স্বচ্ছ। এক পর্যায়ে সে মনে মনে কল্পনা করে নিলো ওই বিজলীই যেন মোহ। তা মনে করে বিস্তর হাসি ফুটল মুখে।
“তুমি ঠিক আমার জীবনে ওই বিদ্যুৎ চমকানোর মতো মিস মোহ। ওই বিজলী যেমন হঠাৎ এসে জানান দিচ্ছে আকাশকে তার রশ্মি সম্পর্কে তুমিও হঠাৎ হঠাৎ এসেই আমায় জানান দাও তুমি আমার জীবনে আলো ছড়ানোর জন্য আছো। আবার এক মুহূর্তেই হাওয়ার সাথে গায়েব হয়ে যাও। এমন কেন বলো তো?”
স্বচ্ছ প্রশ্ন করেছে ঠিকই তবে উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই। কিন্তু স্বচ্ছ কল্পনাজগতে হঠাৎ অনুভূত করে ফেলল কেউ তার কানের একেবারে সংস্পর্শে এসে ফিসফিস করে বলল,
“কারণ আমি এমনই। হঠাৎ আসব। রশ্মি ছড়াব। মোহ ছড়িয়ে দেব আপনার অন্তরে, আপনার ঘোলাটে বর্ণের এই গভীর আঁখি দুটোয়। অতঃপর আবার পালাব।”
স্বচ্ছ আনমনে প্রশ্ন করল,
“পালাবে কেন? রয়ে যেতে পারো না? অনন্তকালের জন্য?”
“না পারিনা। এটা আমার জীবন নিয়ম বহির্ভূত হয়েছে যেন। আপনি মানুষটা নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছেন আমার জন্য।”
আকাশের গুড়গুড় ডাকে বালিশে এলিয়ে রাখা মাথা তুলে তাকাল স্বচ্ছ। চোখ কচলাতে কচলাতে ভাবল কিছুক্ষণ আগের কল্পনার কথোপকথনগুলো। কিছু মুহূর্তের জন্য চোখ লেগে এসেছিল তার। চোখ বুঁজে নিজের কল্পনায় ডুব দিয়েছিল সে। বাস্তবে মোহের সঙ্গে আলাপ করার অভিলাষ পূর্ণ না হওয়ায় বুঝি এই কল্পনা এসেছিল মনে। একারণেই হয়ত বলে, মানুষ কল্পনায় সবচেয়ে সুখী!
অজস্র দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে কললিস্টের প্রথমে মোহের নম্বরে প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে কল করল স্বচ্ছ। বিগত বারের মতোই ওপাশ থেকে ফোন বন্ধের কথা আসতেই দাঁতে দাঁত খিঁচে কানের পাশ থেকে ফোন সরিয়ে নিলো সে। এতবার কল দিয়েও ফোন বন্ধ থাকার বিষয়টা এবার তাকে চিন্তার সাগরে ফেলছে। নইলে তো ফোন বন্ধ থাকার কথা না। সৌমিত্র হাতে ব্যাগ নিয়ে স্বচ্ছের ঘরে প্রবেশ করল। চিন্তায় অতি মগ্ন থাকায় কিছু টেরই পেল না স্বচ্ছ। সৌমিত্র ব্যাগ টি টেবিলে রেখে বলল,
“ভাই, ভাই! তোমার ঔষধগুলো আমার ঘরে ছিল। এখনি বোধহয় কিছু ডোজ আছে খেয়ে নাও।”
আচানক ছোটো ভাইয়ের কণ্ঠে চকিতে পেছনে তাকাল স্বচ্ছ। কম্পিত গলায় বলল,
“হ্যাঁ? কিছু বললি?”
চোখমুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হয় সৌমিত্রের। সন্দেহি নজরে তাকায় বড়ো ভাইয়ের দিকে। কাছে এসে উৎসুকভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভাই? তোমার কী হয়েছে? কিছু আগে ফারাহ বলল তোমার নাকি কিছু হয়েছে। অন্যমনস্ক লাগছে তোমাকে।”
“আসলে একটা কথা ভাবছি আমি।”
“কী কথা?”
স্বচ্ছ আগের মতোই অন্যমনস্ক ভাব নিয়ে বলতে লাগল,
“মেয়েটা না নিজে খোঁজ নিচ্ছে আর না তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছি। কেমন যেন অশান্ত লাগছে এবার আমার।”
সৌমিত্র বেশ ভালোভাবে বুঝে নিলো স্বচ্ছ মোহের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আজকাল সবসময় মোহ ব্যতীত অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা শুনতেই পায় না স্বচ্ছের মুখে। অথচ কিছুদিন আগে মোহ নামটা যেন আগুন ধরানোর ন্যায় কাজ করত। স্বচ্ছের সামনে মোহ নামটা উচ্চারণ করা বারণই ছিল। সৌমিত্র তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
“মোহের কথা বলছ?”
“আর কোন নারীর পাল্লায় আমি পড়েছি বলতে পারিস? এই প্রথম কোনো রমনী আমাকে এত অস্থির করে নিচ্ছে।”
কথাগুলো রাগের সহিত বলে ফেলল স্বচ্ছ। সৌমিত্র ফিক করে হেসে বলল,
“তো তুমি অস্থির হচ্ছো কেন? শান্ত হয়ে থাকলেই তো হয়।”
কড়া চাহনি দিয়ে এবার সৌমিত্রের জবান বন্ধ করে স্বচ্ছ। সৌমিত্র আমতা আমতা করে বলে,
“আসল কাহিনী কী?”
“কী আবার? মোহের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। বুঝিনা মেয়েরা এত ইরেসপন্সবল কী করে হয়? হাউ? তাকে ফোনে না পেয়ে কোনো মানুষের চিন্তা হতে পারে এটা বুঝতে পারে না? আশ্চর্য!”
“এতই চিন্তা হলে ওর বাড়ি গিয়ে দেখে এসো। এড্রেস তো আছেই তোমার কাছে। তাহলে দেরি কীসের?”
স্বচ্ছের চোখ দুটো সরু হলো এবার। অতঃপর এমন ভাব ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল যেন সৌমিত্রের কথার তোয়াক্কাই করল না সে। কেমন যেন গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,
“তোর কী মনে হচ্ছে? আমি ওর জন্য এতটাই পাগল হয়ে গিয়েছি যে এত রাতে, এই আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো অবস্থায় বেরিয়ে গিয়ে ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকব ও ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য? আমাকে কি এতটা ডেস্পারেট মনে হচ্ছে ওর জন্য? ও কেমন আছে তা জানার জন্যও আমি ইন্টারেস্টেড নই। আমি ঘুমাব এখন।’
স্বচ্ছ যে ভাবসাব নিয়ে এমন কথাগুলোই বলবে সেটা সৌমিত্রের অজানা ছিল না। হতাশা নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরল। যেতে যেতে বলল,
“ভাগ্যিস ইন্টারেস্টেড নও। ইন্টারেস্টেড না হয়েই তোমার যা অবস্থা! ইন্টারেস্টেড হলে না জানি আরো কেমন অবস্থা হতো।”
স্বচ্ছ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তবে কিছু বলার আগেই কেটে পড়ল সৌমিত্র। তাই বিছানা ছেড়ে আর ওঠা হলো না স্বচ্ছের। উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকল সৌমিত্রের কথাগুলো। আচ্ছা, মেয়েটার বাড়ি গিয়ে কি সে দেখে আসবে? কোনো বিপদ হলো কিনা? পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে দায়সারা ভাব নিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ওকে নিয়ে আমার ভাবার এত সময় আছে নাকি? যে এত রাতে ওর বাড়ি ছুটব? ধুর!”
স্বচ্ছ সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বুঁজল। উদ্দেশ্য লম্বা একটা ঘুম দেবে। একবারে সকাল দশটার আগে চোখ খুলবে না।
তালা দেওয়া বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের রশ্মিতে চকচক করে উঠছে তালা। মোহের বাড়িটা ফাঁকা। জনমানবশূন্য। স্বচ্ছের চিন্তা প্রগাঢ় হলো। ভেতরের অস্থিরতা তাল মিলিয়ে অতিরিক্ত হতে থাকল। গাড়ির চাবি শক্ত করে ধরে বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে শান্ত করতে থাকল নিজেকে। গলি ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় শুধু মনে হলো, একবার যদি দেখা পেত সেই ছিমছাম গড়নের মেয়েটার! তবে কতই না শান্তি পেত মনটা!
গাড়ির ভেতরে বসে দরজা বন্ধ করে ভেতরের লাইট জ্বালিয়ে স্বচ্ছ বসে রইল অনেকক্ষণ। মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, মোহ গেল কোথায়? তার কি কোনো বিপদ হয়েছে? ফোনটাও যে বন্ধ!
নানান চিন্তা মাথায় নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো সে। তবে বাড়ির দিকে গেল না আর। নিজের মনটাকে হালকা করতে ঘুরতে থাকল দিকবিদিক। একসময় বৃষ্টির ফোঁটা নিজের বাঁধ ভেঙে পড়তে শুরু করল ধরণীতে। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় গাড়ির গ্লাস হয়ে এলো অস্পষ্ট। সেটা পরিষ্কার করতে করতে গাড়ি থামাল সে। পাশেই চায়ের সেই দোকানটা। যেখানে স্বচ্ছের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মিস. বিছুটি পাতার সঙ্গে। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দোকানটার দিকে মনোযোগের সহিত তাকায় স্বচ্ছ। তবুও যেন শান্তি হচ্ছে না তার। না পেরে গাড়ি থেকে নেমে সেই দোকানের ছাউনির নিচেই দাঁড়িয়ে শীতলতম বাতাসে নিজেকে হালকা উপলব্ধ করল সে। বৃষ্টির ঝাপটায় চোখমুখে ছিটে এলো পানি। সেসবে ধ্যান নেই স্বচ্ছের। স্মরণ করতে ব্যস্ত মোহের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের দৃশ্যগুলো। ইশশ…কী জোরেই না থা/প্পড় মে/রেছিল মেয়েটা। ভাবতেই গালে হাত চলে যায় স্বচ্ছের। মৃদু স্বরে বলে,
“তোমার গায়ে ভীষণ জোর মিস মোহ! এতটাই জোর করে এখন আমার গাল থেকে ব্যথাটা অন্তর অবধি চলে গেছে বোধহয়।”
স্বচ্ছ সামনে তাকাল। ওই সামনে গাছটার সামনেই স্বচ্ছ বাইক দিয়ে কাঁদা ছুঁড়েছিল মোহের গায়ে। কী গাঢ় অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল মোহ তার পানে। আজ আবারও সে ওই দৃষ্টির দেখবার জন্য তড়পাচ্ছে। স্বচ্ছ অনুভব করল, কোনো এক একরোখা রমনীর চিন্তায় সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
সকাল সকাল বড়ো লিভিংরুমে ফুল লাগাতে ব্যতিব্যস্ত শৌভিক। মাঝে মাঝে দাড়ি চুলকে ফুল হাতে নিয়ে এদিক ওদিক করে ভাবছে কোনদিকে কীভাবে ফুল লাগালে তার একমাত্র চাচাতো বোনের পছন্দ হবে। তার এই ভাবনায় পাড়া দিবে কোনো এক মেয়েলি কণ্ঠ দিয়ে উঠল চিৎকার। ফুল ফেলে দিয়ে হকচকিয়ে পেছন ফিরে তাকাল শৌভিক। কাঙ্ক্ষিত মেয়েটিকে দেখেই ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“তোদের নারী জাতির সমস্যা কোথায়? গলা আছে বলে যখনতখন চিৎকার ছাড়তে হয় কেন? তেলাপোকা দেখলে এক চিক্কুর, কাঁদতে কাঁদতে চিক্কুর, হাসতে হাসতে চিক্কুর! এত চিৎকার দিস গলা ফেটে যায় না?”
শৌভিকের চাচাতো বোন মীরা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
“সাধে তো চিৎকার করি না। দেখো তো কোন বেনারসি অর্ডার দিয়েছিলাম আর কোনটা দিয়ে গেছে? অর্ডার দিয়েছিলাম লালটা। আর পেলাম গোলাপী। বিয়েতে কী পরব?”
“এজন্য বারবার বলি চল অনলাইনে এসব হাজার হাজার টাকা খরচ করে অর্ডার না দিয়ে মার্কেটে নিয়ে যাই। মার্কেটের লোকজন আমাকে দেখলে এমনি জিনিসপত্রের দাম অর্ধেক কমিয়ে দেবে। চাচার টাকাও কম যাবে। শুনিস কোথায় আমার কথা?”
মীরা শৌভিকের হাতে তৎক্ষনাৎ শাড়ি ধরিয়ে বলল,
“এতই যখন দাপট তোমরা যাও না, যাও! শাড়িটা চেঞ্জ করে নিয়ে এসো কোম্পানিতে গিয়ে। মনে হচ্ছে শাড়ি অদলবদল হয়েছে আমার শাড়ির সাথে। এখন গিয়ে আমারটা খুঁজে নিয়ে এসো। তারপর বুঝব কত বড়ো সিংহ তুমি।”
“এখন আমাকে বেনারসি নিয়ে কোম্পানিতে ছুটতে হবে? তোর হবু বরকে ধরিয়ে দিতে পারিস না?”
“ওকে ধরিয়ে দেব বিয়ের পর। এখন তুমি যাও।”
শৌভিক বাহানা দেখিয়ে বলল,
“কাজ আছে আমার।”
“এত কাজ করতে হবে না। সাহের কোম্পানিতে যাও। মেইন শোরুমে ঢুকে পড়ো। আর আমার মেইন বেনারসিটা নিয়ে এসো।”
শৌভিক পড়ল বিপাকে। এখন কিনা বেনারসি নিয়ে বাহিরে ছুটতে হবে?
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল স্বচ্ছ। আধভেজা তার শরীর। ভেজা শার্ট শুঁকিয়ে যেতে চলল। সারারাত কেটেছে গাড়িতেই৷ খোলা গ্লাস দিয়ে আসা বৃষ্টির বিন্দুগুলোকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি মোটেও। নিজের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়িতে উঠতে যাবে তখনি নিজের মাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখল। হাতে তার ফোন। কাকে যেন কল করলেন মিসেস জেবা। তৎক্ষনাৎ বেজে উঠল স্বচ্ছের ফোনটা। স্বচ্ছের ফোনের রিংটোন বাড়িতেই পেয়ে চকিতে সিঁড়ির কাছে তাকালেন মিসেস জেবা। অতঃপর তড়িঘড়ি করে ছেলের নিকটে এলেন৷ অতি চিন্তা নিয়ে বললেন,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ? এই অবস্থায় বাড়ির বাইরে পা রাখো কীভাবে? এখনো তো ঠিক করে হাঁটতেও পারো না। কোথায় যাওয়া হয়েছিল?”
স্বচ্ছ সময় নিয়ে বাহানা দিয়ে বলল,
“বাড়িতে বসে কতদিন থাকা যায় মা? বাহিরে একটু আশপাশ ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। আর কিছু না।”
“সারারাত ঘুরতে হয় তোমার? বাড়ির ছেলে কেন সারারাত বাইরে থাকবে?”
স্বচ্ছ অবাক হলো মায়ের কথায়৷ তার মা কী করে জানল? গলা খাঁকারি দিয়ে শুধাল,
“মা, তোমায় কে বলল আমি সারারাত বাহিরে ছিলাম?”
“তোমার ভাই সৌমিত্র।”
তখনি হয় সৌমিত্রের আগমন। নিজের ফোন হাতে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে গেম খেলতে খেলতে নিচে নামছে সে। স্বচ্ছের দৃঢ় ইচ্ছে করল সৌমিত্রের হেস্তনেস্ত করতে। তবে শান্ত থাকল সে। সৌমিত্র তার ভাইকে দেখামাত্র ঘাড় চাপড়িয়ে বলল,
“আরে ভাই! নট ইন্টারেস্টেড থেকে সারারাত মেয়ের বাড়ির সামনে? নট ব্যাড!”
মিসেস জেবা ভ্রু কুঁচকে সূক্ষ্ণ নজরে দেখলেন এবার নিজের দুই ছেলেকে। বুঝলেন না তাদের কথোপকথন।
“কোন মেয়ে? কার বাড়ির সামনে কথা বলা হচ্ছে?”
স্বচ্ছ তড়িঘড়ি করে সৌমিত্রের মুখে এক থাবা দিয়ে সরিয়ে দিলো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল,
‘আরে মা! ওর কথা তোমরা কেন সবসময় সিরিয়াসলি নাও সেটাই তো বুঝিনা। ও তো নেশা না করেও নেশাখোরের মতো যাচ্ছেতাই বকে। স্টুপিড কোথাকার!”
সৌমিত্র দাঁত বের করে হাসল। ভাই এবং মায়ের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে গানের সুরের ন্যায় বলে উঠল,
“সব দোষ এখন সৌমিত্র ঘোষ হবে! সত্যি কথার ভাত নেই বলে।”
মিসেস জেবা দুই ছেলের কর্মকাণ্ডের কিছুই বুঝলেন না। তবে স্বচ্ছের ঠিকই বোধগম্য হয়েছে সৌমিত্রের প্রতিটা কথা।
মুখ হা করে বেঘোরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে ফারাহ। টেবিলে মাথা লাগিয়ে গভীর ঘুমের মৃদু শব্দ তুলছে নাক দিয়ে। টেবিলের আশেপাশে, নিচে, উপরে পড়ে আছে যাবতীয় কাগজ, পেন্সিল, বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড়৷ মাথার উপরে স্লিপ মাস্ক কপালে নেমে এসেছে। চোখমুখ ফুলে উঠেছে নিদ্রার অভাবে। ফোনের রিংটোন বিকট হয়ে এসে ঠেকল ফারাহর কানে। হকচকিয়ে উঠে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় হাতাতে থাকল টেবিল। ফোন হাতে পেয়েই রিসিভ করে ক্রুদ্ধ হয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠল,
“তোমাদের সমস্যা কী হ্যাঁ? কালকে পইপই করে বারণ করে এসেছি না? যে ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা যা ইচ্ছে হয়ে যাক আমায় কল করবে না। কানে কালা তোমরা?”
ফোনের ওপাশ থেকে এলো কাঁপা বিনয়ী কণ্ঠ। অফিসের ম্যানেজার বলল,
“ম্যাম, আমরা তো আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। আসলে একটা ক্লায়েন্ট এসেছিল। বিয়ের শাড়ির জন্য।”
“তো ওখানে কি বিয়ের শাড়ি কমতি পড়েছিল?”
“না, ম্যাম। আসলে উনি দাবী করছেন উনাকে অন্য শাড়ি দেওয়া হয়েছে। মানে ভুল করে অন্য ডিজাইনের শাড়ি চলে যায়। আমরা চেক করে দেখলাম আসলেই ঠিক বলছেন উনি। আমাদের মার্কেটে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ শাড়িটা অর্ডার করেছিলেন যেটা আপনি কয়েক পিসই স্টোক করে রাখতে বলেছিলেন সেটাই অর্ডার করেছেন। আমাদের এখানে তো একটাও ওই শাড়ি নেই। দুই পিস আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন৷ ক্লায়েন্ট নানান কথা শোনাচ্ছেন ম্যাম।”
ফারাহ দপ করে জ্বলে উঠল যেন। চোখেমুখে রাগ নিয়ে বলল,
“কথা শোনাচ্ছে মানে কী? আমাদের সম্পর্কে তার জ্ঞান আছে কি নেই? আমরা সহজে এসব ভুল করি না। কথা শোনালেই শুনবে তোমরা। মানুষ মাত্র তো ভুল। মুখে তালা মে/রে দাও উনার। আমি আসছি এখনি।”
হাতে ব্যাগ নিয়ে চটপট করে ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করল ফারাহ। একহাতে চোখ ঘষছে। কোনোরকমে উপরে একটা গাউন পরিধান করে ফ্রেশ হয়ে ছুট লাগিয়েছে অফিসের দিকে। ওয়েটিং রুমে পা রাখতেই সোফায় বসারত মানুষটিকে দেখে থমকে গেল তার দুটো পা। চলা বন্ধ হলো। লোচন দুটি স্থির হলো। চোখে চিকন ফ্রেমের হালকা পাওয়ারের চশমা এবং হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটিকে চিনতে মুহূর্ত সময়টাও নিলো না। এই লোকটার কথা সে প্রায় প্রতিদিন ভেবেছে। লোকটাই এমন যে ভাবতে হয়ত বাধ্য করেছে। তার শেষ কথাটির অর্থ খুঁজেছে শুধু।
মেজাজ গরম করে অস্থির মনে বসে ছিল শৌভিক। এখানে আসার পরই তাকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অন্যদিকে তার কিছু বন্ধু কল দিয়ে যাচ্ছে কিছু কাজের জন্য। সব মিলিয়ে মাথাটা বেশ গরম। পায়ের ধুপধাপ শব্দে মাথা তুলে তাকালে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা এক চেনা নারীর দিকে নজর আটকালো তার। অভিভূত হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। হালকা হাসি এলো মনে মনে। তবে হাসল না। মনে প্রশ্ন জাগল এই মানবীর কী কাজ এখানে?
ম্যানেজার এলো। ভবঘুরে ফারাহর ধ্যান ভাঙাল। শান্ত গলায় বলল,
“ম্যাম, ইনিই তিনি। যার শাড়ি নিয়ে সমস্যা হয়েছিল।”
শৌভিক বুঝতে পারল। এই উদ্ভট মেয়েটিই কোম্পানির কোনো দায়িত্বে আছে। ফারাহ নিজেকে ধাতস্থ করে হালকা কেশে বলল,
“আপনি? শাড়ি নিয়ে ঝামেলা করছিলেন?”
শৌভিকও নিজেকে সামলে জবাবে বলল,
“তা একটু করছিলাম। বাট গোলমাল আপনার জানলে হয়ত ঝামেলাটা করতাম না।”
ফারাহ গোলগোল চোখে তাকাল। উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“কেন?”
“নারী জাতির সাথে গোলমাল জিনিসটা আমার একেবারেই অপছন্দ। কারণ তাদের সাথে কথা বাড়ানো মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা/রা। এমনটাই আমি মনে করি।”
ফারাহ কিছু বলতে চাইল। শৌভিক তার আগেই আরো বলে ফেলল,
“তার উপর আপনার মতো ঝালযুক্ত মানুষের সাথে গোলমাল করা আমার মতো মিষ্টি মানুষের শোভা পায় না। এখন দয়া করে শাড়িটা যদি পাল্টে দিতেন। ধন্য হতাম।”
“আপনি কি আমাকে ইনসাল্ট করছেন?”
কিছুটা রাগ নিয়ে জানতে চাইল ফারাহ। শৌভিক হেঁসে উঠল। তার মনখোলা হাসিটা বেশ সুন্দর। ফারাহ এক পলক না চেয়ে পারল না। শৌভিক বলল,
“আজকাল মানুষ প্রশংসা আর অপমানের পার্থক্য বোঝে না। এটা কোনো কথা হলো? আমি স্বয়ং সরোয়ার সাহেরের একমাত্র কন্যাকে ইনসাল্ট করব! সেই যোগ্যতা কি আমার তৈরি হয়েছে?”
ফারাহ সরু চোখে তাকাল। শুধাল,
“আপনি আমায় চেনেন?”
“কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিনে নিতে হয়।”
ফারাহ মুখ বাঁকাল। শৌভিকের হাতে শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনি আমায় সেদিন সাহায্য করেছিলেন বলে আপনার সঙ্গে আজ কথা বাড়ালাম না। শোধবোধ!”
শৌভিক ধন্য হওয়ার মতো মুখভঙ্গি করে বলল,
“থ্যাংক ইউ মিস। অনেক বড়ো উপকার করলেন। আজকে আসি। আর হ্যাঁ শাড়ির কোনো সমস্যা দেখা দিলে নিশ্চয় আবার বিরক্ত করতে চলে আসব।”
ফারাহ অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সহিত বলল,
“ফারাহ সাহেরের ডিজাইন করা শাড়িতে সমস্যা দেখা দেবে? কোনোমতেই না।”
শৌভিক উত্তর দিলো না। ফারাহর পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলো। কাঁচের দরজা ঠেলে বের হওয়ার আগে পিছু ফিরে বলল,
“আপনার আরেকটা উপকার করতে খুব ইচ্ছে করছে।”
ফারাহ পিছু ফিরে কৌতূহলী দৃষ্টিতে চায়। শৌভিক দরজা ঠেলে বের হতে হতে বলল,
“পরবর্তীতে অন্তত মাথায় উপর স্লিপ মাস্ক না লাগিয়ে চুল ঠিকমতো আঁচড়ে আসবেন। নয়ত এক সেকেন্ডের জন্য আমার মতো আমজনতা ভাববে, সরোয়ার সাহেবের কন্যার মাথার তার ছিঁড়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা আবার কিছু জ্ঞানী সাংবাদিক প্রচারও করে দিতে পারে। বি কেয়ারফুল!”
তব্দা খেয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ফারাহ। মাথার উপর থেকে আই মাস্ক সরিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে সেখানে থাকা থাই গ্লাসের সামনে দাঁড়াল সে। এলোমেলো চুলের বাহার দেখে সত্যিই মনে হচ্ছে সে সদ্য পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে আসা এক রোগীর মতো দেখাচ্ছে। রাগ দুঃখে চোখমুখ জড়িয়ে এলো তার। পরবর্তীতে এই লোকের সামনে দাঁড়াতে তার একশ বার ভাবতে হবে।
জায়গাটা রাস্তার মোড়ের সেই চায়ের দোকান। এখানকার চায়ের দোকানদারের বানানো চা টা বেশ ভালো মানতেই হবে। সৌমিত্র প্রায় প্রতিদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে বিকেলের দিকে এখানে একবার করে চা খেয়ে আসে। মাঝে মাঝে স্বচ্ছ উপস্থিত থাকলেও আজ নেই। এই অনুপস্থিতির কারণটা হয়ত কিছুটা আন্দাজ করতে পারে সৌমিত্র। সে শুনেছে মোহ তার বাড়িতে নেই। পুরো বাড়িটাই ফাঁকা। স্বচ্ছের সাথে সৌমিত্রেরও বেড়েছে চিন্তা। হঠাৎ সৌমিত্রকে বিস্ময়ে ফেলে উপস্থিত হয় স্বচ্ছ। গাড়ি থেকে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় এসে বলে,
“আমার নামেও একটা চা দিতে বল জলদি।”
স্বচ্ছকে পেয়ে স্বচ্ছের বন্ধু যেন হা/মলে পড়ল। চায়ে চুমুক দিয়ে দাঁত কেলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী রে স্বচ্ছ! কী শুনছি এসব? তুই নাকি প্রেমের জোয়ারে হাবুডুবু খাচ্ছিস? ঘটনা সত্যি নাকি?”
স্বচ্ছ চটে গিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রথমেই সৌমিত্রের দিকে। সে জানে এসব বলা তার ভাইয়েরই কাজ। তবে তার কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হয় না এই মুহূর্তে। ফোন বের করে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইতেই রাস্তার বিপরীত পাশে এক মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এই মেয়েটাকে স্বচ্ছ চেনে। হ্যাঁ, এটাই তো বোধহয় মোহের বান্ধবী। আচ্ছা, মেয়েটা তো জানতেই পারে মোহ কোথায়! তৎক্ষনাৎ সে আগপাছ না ভেবেই জোরে ডাক ছাড়ল।
“এই মেয়ে শোনো!”
রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে সবেমাত্র বাড়ি ফিরছিল তানিয়া। কোনো কঠিন স্বর পেয়ে পাশ ফিরে তাকায় সে। সেদিন যাদের সাথে ঝামেলা হয়েছিল তাদের চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হলো না তানিয়ার৷ বিলম্ব না করে জোরে পা চালালো সে। সেদিনের ভুলের কারণে যদি শা/স্তি পেয়ে হয় আবার? এই ভেবে আতঙ্ক ঘিরে ধরল তাকে।
তানিয়ার জোর কদমে হাঁটা দেখে মাথায় রাগ চড়ে বসল স্বচ্ছের। সৌমিত্র কিছু না বুঝে জিজ্ঞেস করল,
“ভাই! ওই মেয়েটাকে চেনো তুমি? ডাকছ কেন?”
“মেয়েটা মোহের বান্ধবী। জানতে চাই, ও মোহের সম্পর্কে জানে কিনা!”
“ও কি বলবে? দেখছ না! তোমার ডাকেই পালাচ্ছে।”
“বলবে না কেন? তুই বলাবি তাকে দিয়ে।”
সৌমিত্রের চক্ষু চড়কগাছ তখন।
“কী বলো ভাই! আমি কীভাবে?”
“তুই যদি তার সঙ্গে কথা বলে জানাতে পারিস আমায় মোহের বিষয়ে তাহলে তোকে তোর রিসেন্ট ফেবারিট ব্র্যান্ডের বাইক কিনে দেব।”
সৌমিত্র যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
“আরে আরে! সত্যি?”
“আমার কাজটা করে দিয়েই দেখ! মেয়েটা গেল। জলদি থামা গিয়ে।”
সৌমিত্র এক মুহূর্ত দেরি করল না। একপ্রকার ছুট লাগায় তানিয়ার দিকে। হাত দিয়ে ডাকল,
“ও হ্যালো, মিস! শুনুন।”
তানিয়ার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো এবার। আজ বুঝি তার নিস্তার নেই!
ব্যাগ থেকে সব কাপড় নামিয়ে রাখতে ব্যস্ত মোহ। ইথান জানালা দিয়ে বাড়ির পেছনের বাগান দেখছে। হুট করে প্রশ্ন করছে,
“মাম্মা! ওই বাগানে যাই?”
“কাল সকালে আমি নিয়ে যাব তোমায়। একা যেতে হবে না।”
ইথান বিনাবাক্যে রাজি হয়। মোহ কাপড় নামাতে গিয়ে হুট করেই কাপড়ের ভাঁজ থেকে একটা ছবির মতো কিছু পড়তে দেখল। বেশ আগ্রহের সহিত নিচু হয়ে সেটা হাতে তুলল। হ্যাঁ, এটা তো ছবিই! ছবি উল্টিয়ে দেখতেই গলা শুঁকিয়ে এলো তার। মুখে এক ফ্যাকাসে ভাব চলে এলো। হাত দুটো অনবরত কাঁপছে। তার সাথে তার প্রিয় বান্ধবীর ছবি। কতই না আহ্লাদের সহিত তোলা ছবিটা। এই স্মৃতি তার কাছে বেদনাদায়ক। ইথান মোহের হাতে ছবি দেখে এক লাফে মায়ের কাছে এলো। মায়ের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ছবিতে তোমার পাশে এটা কে মাম্মা?”
ইথানের প্রশ্নে নিষ্ক্রিয়, নির্ণিমেষ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মোহ। কারণ ইথানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার পক্ষে বেশ জটিল!
চলবে…