#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭
“এইযে মিস! শুনুন। একটু দাঁড়াবেন প্লিজ!”
পুরুষালি শক্ত কণ্ঠ এসে পৌঁছায় তানিয়ার কর্ণকুহরে। চলা থামিয়ে শুকনো ঢক গিলে পিছু ফিরে তাকাতেই যেন কলিজা ছলকাতে থাকে তার। এক যুবক তার দিকে এগিয়েই আসছে ধেয়ে। মনে হচ্ছে আজই ধরে বেঁধে নিয়ে যাবে আর নিজের ক্ষোভ উগড়ে দেবে। তানিয়া ফ্যাকাসে মুখে সামনে ফিরে বুকে থুথু দিয়ে আগপাছ না ভেবে বড়ো বড়ো পায়ের ধাপ ফেলে একপ্রকার ছুটতে শুরু করে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“হায় আল্লাহ! আমাকে বাঁচাও। আর জীবনে কোনোদিন মায়ের কথার অবাধ্য হবো না। মায়ের কথায় বিয়েশাদিও করে ফেলতে রাজি আছি। তাও এদের খপ্পরে পড়তে চাই না।”
তানিয়াকে জোরে ছুটতে দেখে হতবাক সৌমিত্র। উপায়ন্তর না পেয়ে সেও একটু জোরে হাঁটা ধরে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“ও হ্যালো, মিস গোলাপী! আপনাকেই বলছি। একটু রেলগাড়ীতে ব্রেক মা/রুন।”
তানিয়া এবার আরো জোরে পা চালায়। অক্ষিকোটর থেকে মণি বেরিয়ে আসার উপক্রম তার৷ মিস গোলাপী বলে যে তাকেই সম্বোধন করা হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই তানিয়ার। পিছু ফিরে সেই লোকটি তার চেয়ে কত দূরত্বে রয়েছে দেখতে গিয়েই বাঁধাল বিপত্তি। ফট করেই কাঁদায় পা দিয়ে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে গেল রাস্তায়। লজ্জা, ভয়ে কী করবে সেই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারল না সে। অবশেষে সৌমিত্র এসে দাঁড়াতে পারল তানিয়ার সামনে। হাফ ছেড়ে রাস্তায় অসহায় হয়ে পড়ে থাকা তানিয়ার দিকে সামান্য ঝুঁকে বলল,
“বাঘ না ভাল্লুক দেখে দৌড়াচ্ছিলেন হ্যাঁ? নিজের তো লস করলেনই তার সঙ্গে আমারও এনার্জির লস করালেন।”
তানিয়া অতিরিক্ত আতঙ্কের চোটে উদ্ভ্রান্ত হয়ে বলে ফেলল,
“দয়া করে আমাকে মাফ করে দেন। আমি ইচ্ছে করে সেদিন ওই ভাইয়াকে থা;প্পড় খাওয়ায় নি। ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়৷ আমি জানি আমার মুখে মায়া মায়া ভাব নেই। তবুও একটু মায়া করুন আমার ওপর। শা/স্তি দেবেন না।”
সৌমিত্র ঠোঁট উল্টিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল তানিয়ার আজগুবি কথায়। তানিয়া একভাবে কাঁদার মধ্যেই মাথা নিচু করে বসে থাকে। খানিকটা সময় পর শব্দ করে হেসে ফেলে সৌমিত্র। তার হাসিতে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তানিয়া। সে কি খুবই মজার কথা বলে ফেলেছে?
“আপনি এখনো সেদিনের কথা নিয়ে পড়ে আছেন? আর সেদিনের কারণে আপনাকে পানিশমেন্ট দেব ভেবে এভাবে ছুটছিলেন মিস গোলাপী?”
সৌমিত্রের কথায় তানিয়া অবাক হয়ে শুধায়,
“তাহলে আমি এমনি এমনি ভয় পাচ্ছিলাম?”
“ইয়েস ম্যাডাম! আমার শুধু একটা প্রশ্ন ছিল। সেটার উত্তর জানা খুবই জরুরি আমার। যদি বলতেন ধন্য হতাম।”
“এভাবে উত্তর দেব?”
সৌমিত্র একবার নজর দেয় তানিয়ার পুরো অবস্থার দিকে। মেয়েটা কাঁদায় মাখামাখি। মুখেও পড়েছে ছিটেফোঁটা। সৌমিত্র ইতস্তত বোধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“ওহ সরি। উঠে আসুন। আমি হেল্প করছি।”
সৌমিত্রের হাত ধরে উঠে আসার ইচ্ছে বোধ করল না তানিয়া।
“নো থ্যাংকস। আমি একা উঠতে পারব।”
সৌমিত্র হাত সরিয়ে নিলো তানিয়ার কাছ থেকে।
“ওহ হো! বয়ফ্রেন্ড অন্য ছেলের হাত ধরতে মানা করেছে বুঝি? নো প্রবলেম। আমিও হলে তাই করতাম। আমি আবার কারোর প্রেমে আগুন টাগুন ধরাতে চাইনা, মিস গোলাপী!”
“মিস তানিয়া।”
“হ্যাঁ?”
তানিয়া ইতস্ততবোধ করে বলল,
“আমার নাম তানিয়া।”
“ওহ ওকে। বাট সত্যি কথা বলি? তানিয়ার চেয়ে গোলাপী নামটা বেশি মানাচ্ছে আপনাকে।”
তানিয়া নাক ফুলিয়ে তাকায় সৌমিত্রের পানে। কিছু বলতে চেয়েও বলে না। সে মনে করে এসব মন্ত্রীর লোকজনের সাথে কথা না বাড়ানোই ভালো হবে তার পক্ষে। তাই সে সোজা প্রশ্ন করে,
“আপনি কী জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে?”
“ওহ হ্যাঁ। একটা কথার জানার ছিল। তার আগে মনে হয় আপনার মুখের কাঁদা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।”
সৌমিত্রের কথায় তানিয়ার হাতে চলে যায় মুখে। সৌমিত্র প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে একটা কালো রুমাল বের করে দিয়ে বলে,
“বেশি সময় কাঁদা মুখে লেগে থাকলে র্যাশ হতে পারে। এই র্যাশের চক্করে আপনার বয়ফ্রেন্ড পালিয়ে গেলে আমি দায়ী হয়ে যাব। কারণ আপনি আমার ভয়ে পড়ে গেছেন।”
আঁখি দুটো সরু হয়ে এলো তানিয়ার। ছেলেটা অতিরিক্ত কথা বলে। তবে নীরবে সৌমিত্রের হাতের রুমাল নিয়ে মিনমিন করে বলে,
“থ্যাংকস।”
তানিয়া আস্তে আস্তে নিজের মুখের কাঁদা পরিষ্কার করে নেয়। তৎক্ষনাৎ আচানক দ্রুত তাদের সামনাসামনি হয় স্বচ্ছ। সৌমিত্র হকচকিয়ে উঠে ভাইয়ের দিকে তাকায়। স্বচ্ছের মেজাজ তখন তুঙ্গে। কঠিন স্বরে ছোটো ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“সামান্য একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে তোর এতক্ষণ লাগে? আমার সব সিক্রেট বিলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ হয় না তোর দ্বারা?”
সৌমিত্র আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
“আরে ভাই, মাত্র জানতে চাইছিলাম। কিছু জানার আগে একটা পরিচিত হওয়ার ব্যাপার থাকে না বলো? হুট করে প্রশ্ন করলে তো হয় না।”
ছোটো ভাইয়ের কথায় কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ করে না স্বচ্ছ। তানিয়ার দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরাসরি প্রশ্ন,
“এইযে, হ্যালো! আপনি মোহের বান্ধবী না?”
স্বচ্ছের রুক্ষ কণ্ঠে আপনাআপনি শিউরে ওঠে তানিয়ার গায়ের লোম। তড়তড় করে বলে দেয়,
“জি। ও আমার ভার্সিটি লাইফের বান্ধবী।”
“ও তো নিজের বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে জানো কিছু?”
তানিয়া ঢক গিলে একনাগাড়ে বলল,
“হ্যাঁ সেদিন ও বাসে ছিল৷ তখন দেখা হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে।”
স্বচ্ছ কিছুটা সময় নীরব রইল। আবার প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“ওর ফোন বন্ধ কেন সেটা জানো?”
“তা তো জানি না।”
“ওর গ্রামের বাড়ি কোথায়?”
তানিয়া কাঁপা স্বরে বলল,
“গা…গাজীপুরের একটা গ্রামে।”
“তুমি চেনো?”
“ওতোটা মনে নেই। তবে একবার ঘুরতে গিয়েছিলাম ওর সাথে।”
“ওর গ্রামের এড্রেস আমার চাই।”
তানিয়ার অবস্থা তখন বেগতিক। একের পর এক স্বচ্ছের প্রশ্ন শুনে মনে হচ্ছিল যেন আদালতের কাঠগড়ায় রয়েছে। কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়াই স্বচ্ছের কবল থেকে ছাড়া পেতে কোনোরকমে মোহের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে ফেলল সে।
“সৌমিত্র! আমি গাজিপুরের দিকে যাচ্ছি। বাড়িতে মাকে বলে ম্যানেজ করে নিস।”
সৌমিত্রের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে পেছন ফিরে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরল স্বচ্ছ। সৌমিত্র প্রথমে স্তম্ভিত হলো ভাইয়ের কথায়। তানিয়া ভীতি নিয়ে দু’ভাইকে দেখছে। আসলে তারা মোহের থেকে কী চাইছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। দুরুদুরু বুকে নিজ বাড়ির রাস্তায় তানিয়া যেই না হাঁটা দেবে তৎক্ষনাৎ পিছু ডাকল সৌমিত্র।
“ও হ্যালো মিস গোলাপী! আই মিন তানিয়া। আমার রুমাল নিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছেন?”
তানিয়া সাথে সাথে সৌমিত্রের হাতে তার রুমাল দিতে গেলে সরে গেল সৌমিত্র। কপাল কুঁচকে তাকাল তানিয়া। সৌমিত্র বলল,
“এভাবে কেউ রুমাল ফেরত দেয়? ধুয়ে ভালোমতো আইরন করে আমার হাতে তুলে দেওয়া দায়িত্ব আপনার। বাসায় গিয়ে আগে রুমালটা ধুয়ে দেবেন। এটা কিন্তু আমার ফেবারিট রুমাল। মা গিফট করেছিল। তাই এটা আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিচ্ছি না আপনাকে।”
“কিন্তু এটা আমি আপনাকে পরে কী করে দেব?”
“ওহ হ্যাঁ! আমার নম্বর সেভ করে রাখুন।”
তানিয়া সরল মনে দ্রুত সৌমিত্রের নম্বর সেভ করে নিতেই ভাইয়ের দিকে ছুট লাগায় সৌমিত্র। স্বচ্ছের পাশাপাশি এসে হাঁটতে হাঁটতে অস্থির চিত্তে বলে,
“কিন্তু ভাই, তুমি এসময় এতদূর গেলে ফিরবে কখন?”
“আজকে নাহলে কাল ফিরব।”
স্বচ্ছের দায়সারা উত্তরে শান্তি হলো না সৌমিত্রের।
“ভাই, মা আমাকে কথা শুনিয়ে শেষ করে দেবে। আর বাবা জানতে পারলে তো আমাকে আধম/রা করে ঝুলিয়ে রাখবে।”
“বড়ো ভাইয়ের জন্য সামান্য আধম/রা হতে পারবি না সৌমিত্র?”
সৌমিত্র একেবারে থ হয়ে গেল ভাইয়ের কথায়। মাঝে মাঝে তার ভীষণ সন্দেহ হয় এই স্বচ্ছ নামক যুবকটি আসলেই তার ভাই কিনা! স্বচ্ছের কথায় ফের নিজের বিস্ময় কাটালো সৌমিত্র।
“কিন্তু প্রথমে বাড়িতেই যাব এখন আমি। তারপর সেখান থেকে বের হবো গাজীপুরের উদ্দেশ্যে।”
গ্রামের দিকে নিত্যদিনের বৃষ্টি হওয়া এখন যেন বাধ্যতামূলক। চারিদিকে কাঁদা। পা দেওয়ার জায়গা নেই। সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ অথবা তাঁরা কোনোটারই দেখা নেই। খবরে দেখাচ্ছে প্রবল ঝড় হওয়ার সম্ভবনা। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা শনশন বাতাস যেন ঝড়েরই জানান দিচ্ছে। কোনোরকমে খালি পায়ে সাবধানে পা ফেলে ইথানকে কোলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগুচ্ছে মোহ। পা একেবারে কাঁদায় মাখামাখি। হাঁটতে হাঁটতে ইথানকে বকে বলল,
“বারবার বলেছিলাম আমার সাথে এসো না। বাড়িতে থাকো। তবুও মোড় অবধি আসতে হলো তোমাকে। এখন তো হাঁটতেও চাইছ না।”
ইথান নাকমুখ কুঁচকে বলে,
“ছি! নিচে এমন নোংরা আছে জানতাম নাকি?”
“আমি জানতাম বলেই তো তোমায় বারণ করেছিলাম। কিন্তু মায়ের কথা কি ইথান শোনে?”
ইথান বুঝদারের ন্যায় বলল,
“বাচ্চাদের ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হয় মোহ রানি। জেদ করা তাদের স্বভাব।”
মোহ ফিক করে হেসে দেয়। ইথান আজকাল বড্ড পাকা হয়েছে। স্কুলে ভর্তি করার সময় এসেছে। শহরে ফিরে সবার আগে ইথানকে ভালো একটা স্কুলেই ভর্তি করতে হবে তার। হাঁটার পথে হঠাৎ চোখেমুখে আলো পড়ল মোহের। চলা থামিয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। সঙ্গে খানিকটা রাগ হলো তার! মুখের উপর কে টর্চের আলো দেয়?
“আরে মোহ নাকি?”
মোহের কাছে বয়স্ক পুরুষের কণ্ঠ পরিচিত মনে হয়। চোখ মেলে তাকায় সে পিটপিট করে। একজন বয়স্ক লোক টর্চ ধরে দাঁড়িয়ে। মোহ বাধ্য মেয়ের মতো বলে,
“জি জালাল চাচা।”
“কবে আইলি আবার? কোলে এইডা কার পোলা? তোর?”
মোহ বিরক্ত হয়। প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে না পেয়ে ছোট্ট করে উত্তর দেয়,
“হুমম।”
“পোলাডায় এত্ত বড়ো হইছে? এখনো বিয়াশাদী করস নাই? বড়ো হইয়া যখন পোলা জিগাবে আমার বাপ কে! তখন কী উত্তর দিবি?”
মোহের মেজাজ খারাপ হচ্ছে এবার। ভীষণ গায়ে লাগছে কথাগুলো। ছোট্ট ইথানের সামনে কথাগুলো বলা কি আদেও ঠিক হচ্ছে? মোহ কড়া কণ্ঠে জবাব দেয়,
“এসব তো আমার ব্যাপার চাচা। আপনি বরং নিজের পালিয়ে যাওয়া মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন। তাহলে ভালো হয়।”
জালাল চাচা মুখ বাঁকালেন। ঝাঁজালো সুরে বললেন,
“মুখ থাইকা কথা এহনো যায় নাই না তোর? আমার মাইয়া আর যাই হোক তোর মতো আকাম কইরা বাচ্চা জন্ম দেয় নাই। নিজের আকামের জন্য তো গ্রাম ছাইড়া বাহির কইরা দিছিল গ্রামের লোকজন। এহনো বুদ্ধি হয় নাই তোর?”
“যতদিন আমার মুখ আছে ততদিন আমি জবাব দিয়ে যাব। যতটা পারি ততটা কথা বলব। আমি যা করেছি বেশ করেছি। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। তবুও আপনাকে আমি সাবধান করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার ছেলের সামনে এসব ফালতু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করবেন না। বলে রাখলাম।”
ইথানকে অন্যহাতে জড়িয়ে দ্রুত পায়ে জালাল চাচার পাশ কাটায় মোহ। সরল ইথান চুপচাপ সব দেখে মাকে জিজ্ঞেস করে,
“দাদুটা কী বলল মা? কিছুই বুঝলাম না।”
মোহ কেঁপে উঠে ইথানকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। মলিন সুরে বলল,
“কিছু না সোনা। বড়োদের কথার মাঝে ছোটোদের ঢুকতে নেই।”
বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরটায় এসে ইথানকে বিছানায় বসিয়ে নিজের হাতের খাম থেকে কাগজটি বের করল মোহ। সূক্ষ্ণভাবে চোখ বুলিয়ে নিলো কাগজের প্রতিটি লেখায়। এইটা মোহের সামান্য হাতি/য়ার। এটা নিয়ে এখন মোহকে শহরের দিকে রওনা দিতে হবে। তার জানা নেই, সে কতটুকু সত্যি বের করতে পারবে। তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
প্রবল বাতাসের গতির দাপটে সবটা যেন অন্ধকার দেখছে স্বচ্ছ। তবে ভালোই ভালোই গাজীপুরের সেই গ্রাম অবধি পৌঁছাতে পেরেছে সে। ঠিক ভালোই ভালোই বললে ভুলই হবে। মাঝে রাস্তা হারিয়েছে, কখনো এক রাস্তায় দুবার গিয়েছে। পায়ে ব্যথা উঠেছে তার। লাগা পায়ে বারংবার ব্রেক কষতে হয়েছে তাকে। মিনিট পাঁচেক নিজের পা’কে বিশ্রাম দিয়ে ফের যখন গাড়ি স্টার্ট দিলো তার উপলব্ধি হলো গাড়িটা কাঁদায় আঁটকে গেছে। লাগা পায়ে আর ইচ্ছে করল না জোর করে গাড়ি টেনে তোলার। গাড়িতে এক লা;থি মে/রে মাথা গরম করে বসে রইল সে। নিজের কর্মে আফসোস করে বলল,
“সৌমিত্রকে নিয়ে এলে ভালো হতো। আসতে চাইল, আমিই নিয়ে এলাম না। উফফ…এখন হাঁটতে হবে।”
ফোন বের করে সময় দেখে নেয় স্বচ্ছ। দশটা বাজছে ইতিমধ্যে। এই রাতে ও ছুটে এসেছে সামান্য একটা মেয়ের জন্য। এটা ভাবতেই নিজের প্রতিই বিস্ময় কাটছে না তার। এখন যদি মোহের বাড়ি খুঁজে না পায় কী হবে? অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই নরম মাটির কাঁদার নিচে ঢুকে গেল স্বচ্ছের পা। বিশাল অস্বস্তিতে পড়ে চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। অতঃপর নিজের পা দুটো টেনে তোলার চেষ্টা করতে করতে মোহের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ঝেড়ে বলল,
“সব দোষ তোমার মিস মঞ্জুলিকা! না তুমি এখানে আসতে আর না আমি এখানে ছুটে আসতাম। আমার অবস্থার জন্য শুধু তুমি দায়ী।”
গ্রামের লোকজন ঘরে ফিরছে আর স্বচ্ছের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে। সাধারণত এদিকে দামী গাড়ি নিয়ে কেউ প্রবেশ করেনা। তাই মানুষজনকে বেশ ভাবাচ্ছে বিষয়টা। স্বচ্ছ হঠাৎ করে অল্পবয়সী একটা ছেলেকে পেয়ে ডাক দেয়।
“এই ছেলে শোনো!”
ছেলেটি এগিয়ে আসে।
“জি, কন! কী কইবেন।”
“এই গ্রামের একটা বাড়ির ঠিকানা বলে দিতে পারবে?”
ছেলেটা দুর্দান্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“পারুম না ক্যান? এই গ্রামের এমন কোনো বাড়ি আছে? যেইডা শান্ত চিনবো না?”
“আচ্ছা আচ্ছা! আজহার সাহেবের বাড়ি চেনো তুমি?”
“ওহ! আজহার দাদু? মানে মোহ আপার বাড়ি?”
স্বচ্ছ দ্রুত জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। চিনো তুমি?”
“চিনমু না ক্যান? সামনে যাইবেন। প্রথমে একটা বাগান পাইবেন। বাগানের পাশ দিয়া গিয়া আমাগো এলাকার সবচেয়ে বড়ো বটগাছ পাইবেন। ওইডাও পার হইয়া যাইতে দেখবেন ডান দিকে একটা পাকা বাড়ি আছে। ওইডাই মোহ আপার বাড়ি।”
স্বচ্ছের কাছে ভীষণ ঝামেলার মনে হলো বিষয়টা। যদি ভুল বাড়িতে চলে যায়? সে ছেলেটিকে শুধাল,
“তুমি আমায় তার বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে?”
“আরে না না। এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে হইব। পাড়ায় খেলা দেখার লাইগা রাত হইয়া গেছে। এখন গেলে নির্ঘাত আম্মায় কাঁচা কুঞ্চি দিয়া বাড়াইব। আপনে আমার কথা মতো যান। বিশ্বাস করেন, বাড়ি পাইবেন।”
স্বচ্ছ আর কিছু না বলে অতি কষ্টে পায়ের ধাপ ফেলে হাঁটা দিলো। ফট করে ছেলেটি আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
“আইচ্ছা, আপনে কে হন মোহ আপার?”
স্বচ্ছ চট করে উত্তর দিলো,
“পাগল, হই পাগল! তোমার মোহ আপার রোগী।”
তড়তড় করে ব্যথা পায়ে নিয়ে চলে গেল স্বচ্ছ। শান্ত থ মে/রে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
মিনিট পনেরো হাঁটার পরে মাত্র বাগানের দেখা পেল স্বচ্ছ। এই পা নিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। অসহ্য লাগছে তার। নিচে কাঁদায় মাখোমাখো অবস্থা। এমন বিরক্তির সময় ফোন বেজে উঠলে সেটা বের করতে গিয়ে অসাবধানতায় ফোনটাও ফেলে দিলো কাঁদায়। সময় নষ্ট না করে দ্রুত ফোন হাতে তুলে দেখল যা হওয়ার হয়ে গেছে। ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। তপ্ত শ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বাগানের বেড়ায় আ;ঘাত করতেই মনে যেন হলো হাতে পেরেক ঢুকে গেল। মৃদু চিৎকার দিয়ে হাত টান দিয়ে অন্যহাত দিয়ে অনুভব করল ডান হাত থেকে র/ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেসবে ধ্যান না দিয়ে ফের চলতে লাগল। কেননা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
এক পর্যায়ে ঝড় শুরু হলো। স্বচ্ছ নিজের বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ে যখন আর চলতে পারল না তখন সামনে দুটো পাকা বাড়ি দেখল। তবে ছেলেটি যে বলেছিল যেই পাকা বাড়ি দেখবে সেটাই? এখন কোনটা হতে পারে মোহের বাড়ি?
বাহিরে ঝড়ের বাতাস ও বৃষ্টি দেখছে মোহ। ইথান তার কোলে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন। এমন সময় অন্য ঘর থেকে রাবেয়া বেগম চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,
“ও মোহ! ও মাইয়া! বাহিরের দরজাটায় বোধহয় লাঠি তুলে দেওয়া হয় নাই। একটু দিয়া আয় তো। আমি ঠিক মতো দেখতে পাইনা আন্ধারে।”
দাদীজানের কথামতো ইথানকে সাবধানে বালিশে শুইয়ে দিলো মোহ। হাতে টর্চ লাইট নিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে বাহিরের উঠোনে উঠতেই উপলব্ধি করল ঝড়ের বেগ অনেকটা। গা ভিজে যাচ্ছে। গামছা দিয়ে ঢাকল নিজের মাথা। পাশের আম গাছের এমন অস্থিরতা দেখে বুঝতে বাকি নেই যেকোনো সময় ডাল ভাঙবে তার। আস্তে আস্তে টিনের দরজার কাছে এগিয়ে দ্রুত লাঠি তুলে দিতেই ফাঁক দিয়ে একটি বলিষ্ঠ অবয়ব দেখে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল তার। এই রাতে কে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে? একমাত্র চোর ছাড়া? দরজা ফাঁক করে সামান্য উঁকি দিয়ে লোকটির মুখে টর্চ ধরার চেষ্টা করল মোহ। ঢক গিলে শুধাল,
“কে ও…ওখানে?”
তৎক্ষনাৎ টিনের সেই দরজায় করাঘাত পড়ল। লোকটি দরজা সজোরে টেনে ধরতেই খুলে গেল দরজা। পেছনে ছিটকে এলো মোহ। দ্রুত পুরুষটির মুখে টর্চ মারতেই চোখমুখ খিঁচে ফেলল সে। কাকভেজা অবস্থা, যে হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকছে সে হাতে তাজা র;ক্ত, শার্ট ভর্তি কাঁদা। ইশশ…কী বাজে অবস্থা!
চলবে….
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮
বারংবার নেত্র যুগলের পলক ফেলে সামনে থাকা এই মানবটি বাস্তব কিনা সেটা যাচাই করা শেষ হচ্ছে না মোহের। আশেপাশে তীব্র দুর্যোগের কথা যেন ভুলেই গেল। প্রকৃতির আন্দোলনে দুজনের কেউই সাবধান হওয়ার চেষ্টা না করে বোঝার চেষ্টা করছে তাদের চোখের সামনে থাকা মানুষটা এত সাধনা এবং আকাঙ্ক্ষার পর সত্যিই তাদের সামনে? সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে নিজের একহাত দিয়ে মোহ ছুঁয়েই ফেলল সেই মানুষটিকে। স্বচ্ছের কাঁদায় মাখামাখি শার্টে নিজের মসৃন হাতটা রাখতেই ভেজা অনুভব করল মোহ। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে প্রথমে স্বচ্ছের শার্ট হাত রাখার দিকে তাকাল। স্বচ্ছ তার ভেজা হাত মোহের হাত উপর রেখেছে। চক্ষুদ্বয় বড়ো বড়ো করে স্বচ্ছের ধূসর অক্ষিগোলকের দিকে চাইতেই স্বচ্ছ ফিসফিসিয়ে বলে,
“একা একটা সরল সোজা ছেলে পেয়ে সুযোগ নিতে চাইছ?”
মোহ বিলম্ব না করে হাত নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
“ছি! অসভ্য চিন্তাভাবনা।”
“যেভাবে বুকের উপর হাত রাখলে আমি তো ভাবলাম…”
মোহ স্বচ্ছকে পুরো কথা বলতে না দিয়ে নিজে বলে উঠল,
“যার যেমন মানসিকতা। আমি তো শুধু হঠাৎ আপনাকে এখানে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি এটা সত্যিই আপনি। তাই একটু চেক করে দেখছিলাম।”
“চেক করে কী বুঝলে? বাস্তব তো?”
মোহ কিছু বলবে তার আগেই মটমট শব্দ করে বড়ো আম গাছের ডাল ভেঙে গেল। মোহ তা উপলব্ধি করে দ্রুত স্বচ্ছের শার্ট খামচে ধরে তাকে টান দিলো নিজের দিকে। ভুলবশত নিজেকে সামলে উঠতে না পেরে মোহের সঙ্গে মিশে গেল স্বচ্ছ। তবুও রক্ষা হলো না। স্বচ্ছের হাতের বাহু ঘেঁষে নিচে পড়ে গেল ভারি ডালটা। বাহুর একাংশ ছিলে গেল স্বচ্ছের। সেসবে খেয়াল হয়েও হলো না তার। সে যেন অন্য দুনিয়ায় ভাসছে। যেমনটা, বহু খোঁজাখুঁজির পর কাঙ্ক্ষিত মূল্যবান রত্নের দেখা মেলার পর ভার মনটা প্রশান্তির বাতাস পায় ঠিক তেমন। তবে মোহ সরে গিয়ে স্বচ্ছের বাহুটা ধরে চিন্তায় পড়ে গেল বেশ। পুরো হাতেই র/ক্তার/ক্তি অবস্থা দেখে হকচকিয়ে উঠল। সেসব আবার ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে।
“আপনার অবস্থা তো ভালো নয়। আমার সাথে চলুন। ঝড়ের মাঝে তো যেতে পারবেন না কোথাও।”
স্বচ্ছ অকপটে বলল,
“আমার হাঁটতে ভীষণ সমস্যা হচ্ছে মিস মোহ। যন্ত্রণা করছে অনেক।”
মোহের রাগ হলো কিছুটা। এই অবস্থায় কে আসতে বলেছে এতদূর? কোনো কী দরকার ছিল? কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলে উঠল,
“আমার কাঁধে হাত রেখে ভর দিয়ে যেতে পারেন। তাহলে পায়ে চাপ কম পড়বে।”
মোহের দ্বিধা বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারল স্বচ্ছ। তার দিকে তাকিয়ে শুধাল,
“তুমি এটাতে কমফোর্ট ফিল করবে?”
মোহ আমতা আমতা করল। স্বচ্ছ মৃদু হেসে নিজের হাত বাড়িয়ে বলল,
“শুধু হাতটা ধরো। তাহলেই হবে। আমরা পুরুষ মানুষ বুঝলে? তোমাদের মতো এক আ/ঘাতে কপোকাত হবো না।”
“সেকারণেই তো সেদিন বাইক এক্সি/ডেন্টে পড়ে ছিলেন মাঝরাস্তায়। এই নারীর সাহায্য না পেলে বুঝতে পারতেন কত ধানে কত চাল!”
“খোঁটা দিচ্ছো?”
“খোঁটা নই সত্যিটা বোঝাচ্ছি। হাতটা ধরুন। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি।”
স্বচ্ছ বিনাবাক্যে মোহের চিকন হাতখানা ধরল এবার। অতঃপর হেসেই বলল,
“এই তুলো দিয়ে তৈরি পেন্সিল ধরে ভেতর অবধি যাব আমি? ছিঁড়ে যাবে না তো?”
ক্রুদ্ধ নজরে চাইল মোহ। রাগে গজগজ করে বলল,
“ছিঁড়লে আপনারই কয়েকটা হাড় ভাঙবে পড়ে গিয়ে। আমার কী?”
স্বচ্ছকে নিয়ে গিয়ে আস্তে করে ঘুমন্ত ইথানের পাশে বসাল মোহ। ফিসফিস করে বলল,
“আস্তে কথা বলবেন। আপনার পাশে ইথান আর পাশের ঘরে দাদীজান ঘুমায়।”
“আমি তো ভিজে গেছি। আমার জন্য…”
স্বচ্ছের মুখ সজোরে চেপে ধরে মোহ। পুরো কথাটা সম্পূর্ণই করতে দেয় না তাকে। কেননা, স্বচ্ছ উঁচু গলায় কথা বলছে। তার মুখ চেপে ধরে চোখ বড়ো বড়ো করে ইথানের দিকে তাকায় মোহ। অতঃপর স্বচ্ছকে ইশারা করে বলে,
“গলা নামিয়ে কথা বলুন। নয়ত কথা বলতে হবে না। চুপ থাকুন।”
স্বচ্ছ আর কিছু বলে না। মোহ সরে আসে। অতঃপর একটা টাওয়াল নিয়ে এসেই স্বচ্ছের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“মাথা আর গা মুছে নিন। আমি ওই রুমে গিয়ে স্যাভলন নিয়ে আসছি। আর কোনো আওয়াজ করবেন না।”
স্বচ্ছ ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিলেই দরজা পেরিয়ে পাশের ঘরে রাবেয়া বেগমের ঘরে প্রবেশ করল মোহ। রাবেয়া বেগমের চোখ সবে লেগে এসেছে। ভিড়িয়ে রাখা দরজায় সামান্য শব্দ হতেই চোখ মেলে তাকালেন উনি।
“মোহ তুই এহন কী করস? কিছু লাগব?”
কথা শেষ হতে না হতেই মোহের কাপড়ে কাঁদার দাগ দেখে ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“কাপড়ে কাঁদা লাগাইলি কই থাইকা?”
মোহ তাড়াহুড়ো করে জবাব দিলো,
“ওইযে দরজা লাগাতে বললে না? পড়ে গিয়েছিলাম তখন পা পিছলে।”
রাবেয়া বেগম চকিতে তাকিয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসেন। বিচলিত হয়ে বলেন,
“বলিস কী? লাগে নাই তো আবার?”
“ওই আরকি একটু আধটু ব্যথা পেয়েছি। তাই একটু স্যাভলন নিতে এসেছিলাম।”
“ওইযে দেখ শোকেসের উপরেই আছে। চল আমি তোরে লাগাইয়া দিই স্যাভলন। ভুলই হইয়া গেছে। এই ঝড়ে দরজা লাগাতে বলা উচিত হয় নাই। চল দেখি কোথায় কোথায় লাগল! তোর ঘরে চল। আমার ঘরে আলো কম।”
মোহ ভড়কে গেল তৎক্ষনাৎ। রাবেয়া বেগম উঠে দাঁড়ালেন মোহের ঘরে যেতে। মোহ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“তেমন কোথাও লাগেনি দাদীজান। আমি তো লাগিয়ে নিতে পারব স্যাভলন। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে না।”
রাবেয়া বেগমের জবাবের অপেক্ষা না করেই হাতে স্যাভলন নিয়ে ছুট লাগাল মোহ।
একহাত দিয়ে জোরে জোরে নিজের মাথার ঘন চুল মুছতে থাকে স্বচ্ছ। দুহাত না লাগালে কোনোমতেই ঠিক করে মুছতে পারছে না। অন্যহাতের অবস্থা একেবারেই বিমূঢ়। ভেজা শার্ট একটু খুলবে সেটাও পারছে না একহাতে। চুল মুছে মুখে টাওয়াল স্পর্শ করতেই অন্যরকম ঘ্রাণ এসে ঠেকল স্বচ্ছের নাকে। বেশ জোরে নিশ্বাস নিয়ে আবারও নিলো ঘ্রাণ। এটা সম্ভবত মোহের শরীরের ঘ্রাণ। প্রতিটা মানুষেরই আলাদা ঘ্রাণ থাকে। তবে সেই মানুষ সেটা বুঝতে পারে না। অপর মানুষ তা ভালোভাবেই বুঝতে পারে। যেমনটা এখন স্বচ্ছ বুঝছে। স্বচ্ছ নিশ্চিত হলো এটা মোহের টাওয়াল। দ্রুত মুখ মুছে টাওয়াল নিচে নামিয়ে জোরে জোরে দম নিলো সে। এই ঘ্রাণে আকর্ষণ আছে। যেটাতে স্বচ্ছ আতঙ্কিত!
মোহ এসে ঝটপট দরজার কপাট আঁটকে দিলো। একবার রাবেয়া বেগম জেনে গেলে কী যে কেলেঙ্কারি হবে তার ঠিক নেই। স্বচ্ছ অবাক পানে প্রশ্ন করে,
“কী হলো?”
মোহ ক্রোধের সহিত বলে,
“এসে তো বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার। দাদীজান জানলে আমাকে সাথে আপনাকেও জানে মে/রে ফেলবে। কে আসতে বলেছিল আমার এখানে? কেন এসেছেন?”
স্বচ্ছ বিব্রত হলো। ভেতরের বিশাল ইগো জাগ্রত হলো। বেশ দম্ভ নিয়ে বলল,
“তোমার কাছে আসব? আমার মাথা খারাপ নাকি? নিজেকে এত ইম্পর্ট্যান্ট মনে করো বুঝি? আমি আসলে এদিকে আমার একটা আত্মীয় থাকে তাদের বাড়িতে আসতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। আমি তো জানতামও না তুমি এখানে আছো।”
কথাগুলো কর্ণকুহরে যাওয়া মাত্র কান গরম হয়ে যায় মোহের। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারে না সে। পায়ের নখগুলো কুঁকড়ে যায়। সে কিনা ভেবেছিল স্বচ্ছ তার জন্য এসেছে! এই ভেবেই নিজের ভাবনাগুলোকে ধমক দেয় সে মনে মনে।
“হাত জ্বলছে। স্যাভলন নিয়ে কি দাঁড়িয়েই থাকবে?”
স্বচ্ছের কথায় খানিকটা চমকে উঠে নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিতে গিয়ে খেয়াল করে স্বচ্ছ ভালো করে নিজের গা মুছতেই পারেনি।
“আপনি তো শরীর মুছতে পারেননি ঠিক করে এখনো। এই অবস্থায় স্যাভলন লাগানো আর না লাগানোর সমান কথা।”
“কী করে মুছব? আমার এক হাতের অবস্থা বেহাল!”
“আমি সাহায্য করব?”
“অস্বস্তি না লাগলে করতে পারো।”
স্বচ্ছের স্পষ্ট উত্তর মোহ পাল্টা প্রশ্ন করে,
“আপনার অস্বস্তি লাগবে না?”
স্বচ্ছ স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“আমার লজ্জাবোধ কম। ছেলেরা খালি গায়ে সারা রাজ্য ঘুরে বেড়াতে দ্বিধাবোধ করবে না।”
মোহ কথা না বলে স্বচ্ছের ভেজা শার্টের বোতাম খুলতে সাহায্য করো। স্বচ্ছের উদাম গায়ে নিজের টাওয়াল ঠেকাতেই স্বচ্ছ নড়েচড়ে বলে ওঠে,
“তোমার টাওয়াল আমার নাকের কাছ থেকে দূরে রাখবে।”
মোহ বোকা বনে যায়। সরল মনে শুধায়,
“কেন?”
স্বচ্ছ ঢক গিলে বলল,
“ব্যস…এমনিই। দূরে রাখবে আমার নাকের কাছ থেকে।”
মোহ বিভ্রান্ত হয়ে মনে রাজ্যের অস্বস্তি নিয়ে স্বচ্ছের গা মুছিয়ে দেয়। স্বচ্ছ অন্যদিকে মুখ করে থাকে। অতঃপর মোহ নিজের টাওয়াল নাকে ঠেকিয়ে ভাবে, তার টাওয়ালের কি এতই বাজে গন্ধ করছে? স্বচ্ছ দৃশ্যটি অবলোকন করে। ভাবে, মেয়েটা তো বুঝবে না সেই গন্ধে কী বিপত্তি ঘটবে! একবার তা নাকে প্রবেশ করলে দ্বিতীয়বার ঘ্রাণ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মন। স্বচ্ছ চায় না নিজের মানসম্মানের দফারফা করতে। মোহ যত্নের সহিত নিজের রুমাল দিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে রুমাল হাতে পেঁচিয়ে দিয়ে বলে,
“এখানে ব্যান্ডেজ পাবেন না। তাই রুমাল পেঁচিয়ে দিলাম।”
স্বচ্ছ জবাব দেয় না। আঁড়চোখে মোহের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মোহের কথায় চমকে ওঠে। মাত্র দুদিনের তৃষ্ণা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার। মনটা এত লাগামহীন হচ্ছে কেন? তার মানসম্মানের দফারফা না করে কি মন থামবে না?
মোহ মনোযোগ দিয়ে স্বচ্ছকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“এই অসুস্থতা নিয়ে আপনি আত্মীয়দের বাড়িতে আসতে গেলেন কেন? পায়ে তো সমস্যা ছিলই এখন হাতও জ/খম হয়ে গিয়েছে। আর কোথাও কি লেগেছে আপনার? তাহলে বলুন দেখি স্যাভলন দিয়ে দিই!”
মোহের বিচলিত কণ্ঠ নাড়িয়ে দিলো স্বচ্ছের হৃদয়। তার জন্য মোহের অস্থিরতা দেখতে বেশ লাগে। ফট করে স্বচ্ছ বলে উঠল,
“বুকে ঢুকতে পারবে?”
নয়ন দুটোর পলক পড়া বন্ধ হলো মোহের। স্বচ্ছের কথা বোধগম্য হলো না তার। বিস্ময় নিয়ে শুধাল,
“জি? বুঝলাম না?”
“বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা করেছে দুদিন ধরে। তাই বললাম। সেখানে স্যাভলন লাগিয়ে দিয়ে পারবে কিনা!”
মোহ তৎক্ষনাৎ চিন্তিত হয়ে বলে ওঠে,
“তাহলে তো আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত। দেখান নি?”
“দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হলো, ডাক্তার এর কোনো সুরাহা বের করতে পারবে না। তাই যে ডাক্তার সুরাহা করতে পারবে তার খোঁজে বেরিয়েছিলাম। এখন ব্যথাটা নেই বললেই চলে।”
মোহ চটে গিয়ে বলল,
“আমাকে বোকা পেয়েছেন? গ্রামে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন বললেই হলো!”
স্বচ্ছ একহাতে মোহের কপালের পাশে গুঁতো দিয়ে বলল,
“ওসব তোমার এই নিষ্ঠুর মস্তিষ্কে ঢুকবে না।”
মোহ মুখ বাঁকিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে দেখল। ঝড়ের বেগ কমার নাম নেই এখনো। এই মুহূর্তে স্বচ্ছকে যেতে দেওয়া অমানবিক কাজ হবে বটে। অপরদিকে দাদীজান বিষয়টা জেনে গেলেও যা-তা অবস্থা হয়ে যাবে। মাথায় জং ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো মোহের। বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
“আপনি তো এই অবস্থায় কোথাও যেতে পারবেন না।”
স্বচ্ছ ইথানের পাশে ফট করে গা এলিয়ে শুয়ে নির্লিপ্তে বলল,
“যেতেই বা চাচ্ছে কে?”
মোহের ভ্রু দুটো বেঁকে গেল স্বচ্ছের এরূপ কথায়। স্বচ্ছ মুখ ফসকে বলে ফেলা কথা সামলাতে বলে ওঠে,
“মানে, ঝড় উঠেছে। আমি একটা অসুস্থ, দুর্বল মানুষ। কী করে যাব বলো?”
তপ্ত শ্বাস ছাড়ল মোহ। বলল,
“ঠিক আছে। আপনি এই ঘরে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি ইথানকে নিয়ে দাদীজানের কাছে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ বাহিরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ঘরের ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ করবেন না। মনে থাকবে?”
স্বচ্ছ হ্যাঁ বা না কিছুই বলে না। শুধু ঘরের আশপাশটা দেখে নেয়। ইটের পাকা ঘর। কোনো প্লাস্টার করা হয়নি। সামান্য লাইট কোনোরকমে জ্বলছে। উপরের ফ্যানও কতক্ষণ ঘুরবে ঠিক নেই। যা ঝড় উঠেছে কারেন্ট যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। সেই সাথে শক্ত চৌকিতে খানিকটা অসুবিধাবোধ করলেও প্রকাশ করেনা স্বচ্ছ। কথায় আছে, কিছু পেতে গেলে কিছু ত্যাগ করতে হয়। স্বচ্ছ না হয় মোহের দেখা পেতে এসে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করল! মোহ আস্তে করে ইথানকে কোলে উঠিয়ে নেয়। বাচ্চাদের ঘুম বেশিই গাঢ় হয়। এতে সুবিধা বেশিই। অতঃপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে বলে,
“যাচ্ছি তাহলে।”
মোহ পা বাড়ালেই হুট করে পিছু ডাকে স্বচ্ছ। উৎসুক হয়ে মোহ ফের ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালে স্বচ্ছ প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“তোমার ফোন বন্ধ রেখেছ কেন?”
মোহ সত্যি এড়িয়ে বলল,
“এমনিই। তাছাড়া আমার খোঁজ নেওয়ার তেমন কেউ নেই।”
“সেটা কী করে জানলে? যে কেউ নেই?”
“ওমনেই জেনেছি।”
স্বচ্ছ চাপা সুরে আওড়ায়,
“এমন তো হতেও পারে কেউ তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে? হতেও পারে তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে? তোমার খোঁজ না পেয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছে! হতে পারে না?”
মোহ মৃদু হাসে। হাসিতে কিছুটা তাচ্ছিল্য মিশে ছিল তার। বলে,
“হতে পারে না এমন। কারণ আমার এমন বিশেষ কেউ নেই। এক বাচ্চার মা জানলেই নাক সিটকায় সকলে। তাই কারোর বিশেষ কেউ হওয়ার আশা করি না।”
মোহ চলে গেল। তবে তার কথাগুলো দ্বারা স্বচ্ছের মনকে বিভ্রমে ফেলে দিয়ে চলে গেল। স্বচ্ছ যখন মোহকে ভেবেছে তখন তার মস্তিষ্ক কখনো তাকে বাচ্চার মা হিসেবে ভাবেই নি। শুধু ভেবেছে এক জেদি নারী! এই আপসহীন রমনীর জন্য সে বিভোর হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসার রঙ লেগেছে কি তবে?
বাবার সামনে মাথা নত করে বসে আছে সৌমিত্র। মুখ শুঁকিয়ে উঠেছে তার। বারবার তৃষ্ণা পাচ্ছে। একমাত্র সরোয়ার সাহেবের সামনেই দমে যায় সৌমিত্র। সরোয়ার সাহেব নির্লিপ্তে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। একসময় শান্ত গলায় ছেলেকে প্রশ্ন করেন,
“তোমার ভাই গিয়েছে বললে যেন?”
সৌমিত্র নিচু সুরে বলল,
“বন্ধুর বাড়ি। আমাকে এটাই বলে গিয়েছে বাবা। এটাই জানি আমি।”
সরোয়ার সাহেব বড়ো শ্বাস নিয়ে সোফায় ঠেস দিয়ে বসলেন। হালকা হাসলেন। উনার হাসিতে যে বিপদ লুকিয়ে আছে সেটা ভালো করেই জানে সৌমিত্র। সরোয়ার সাহেব সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ টেবিলে রেখে বললেন,
“আমি তোমাদের বাপ হই সৌমিত্র। রাজনীতিতে সারাদিন এদিকওদিক থাকি বলে তোমাদের দিকে আমার নজর থাকেনা এটা ভাবার দরকার নেই। তোমাদের প্রতিটা পায়ের ধাপ আমার নজরে থাকে।”
“বাবা আসলে…”
“স্বচ্ছ ওই শরীর নিয়ে গাজিপুরের একটা গ্রামে গেছে। কেন গেছে?”
সৌমিত্র জিহ্বা দিয়ে নিজের শুষ্ক ঠোঁট ভেজালো। ঢক গিলে বলল,
“বাবা ভাইয়া আসলেই জেনে নিও। আমি উঠি।”
সরোয়ার সাহেবকে শান্ত থাকতে দেখে দ্রুত পায়ে উঠে চলে গেল সৌমিত্র। সরোয়ার সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বড়ো ছেলের মতিগতি সুবিধার মনে হচ্ছে না উনার কাছে। কিছু একটা চিন্তা করে ফোন হাতে নিয়ে কাকে যেন কল করে বললেন,
“ইয়াকীন! কাল সন্ধ্যায় একবার আমার সাথে দেখা করবি। তোর জন্য একটা কাজ আছে আমার কাছে।”
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯
ভোর তখন সাড়ে পাঁচটা। রাতে প্রবল ঝড়ের পর আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। আকাশে লাল লালিমার মাঝে সবে সূর্যের চিহ্নের দেখা মিলছে। পরিবেশটা শীতল। মোহ তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠল। মাঝখানে মোটা কাঁথা নিয়ে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে ইথান। তার অন্যপাশে রাবেয়া বেগম। গত রাতে মোহ এই ঘরে ইথানকে নিয়ে ঘুমোতে আসায় বেশ অবাক হয়েছিলেন রাবেয়া বেগম। তবে মোহ ঝড়ের কারণে ভয় লাগছে এই বাহানার দ্বারা রাবেয়া বেগমকে সামলে নিয়েছে।
বিছানা থেকে আস্তে করে নেমে দুয়ার খুলে পাশের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় মোহ। কোনোরকমে এলোমেলো বিরক্তিকর চুলের খোঁপা করে খটখট শব্দ করে হালকা করে খুলে নেয় দরজা। একটু ফাঁক করতেই অন্ধকার রুমে আলো ছড়িয়ে পড়ে। ঘরে উঁকি দিয়ে স্বচ্ছের অবয়ব ফুটে ওঠে মোহের চক্ষুদ্বয়ে। খালি গায়ে উপুড় হয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে যাচ্ছে লোকটা। না চাওয়া সত্ত্বেও তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকল মোহ। যে করেই হোক স্বচ্ছকে এখন বের করতে বাড়ি থেকে। দাদীজান দেখে ফেললে ভয়ঙ্কর বিপদ!
চৌকির কাছে গিয়ে শুকনো গলায় নিচু স্বরে স্বচ্ছকে ডাকে মোহ।
“শুনছেন! ভোর হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠুন।”
ঘুমন্ত স্বচ্ছের কোনো হেলদোল হলো না। শুধু কেঁপে উঠল মৃদু চওড়া শরীরটা। মোহ আবার ডাকল।
“এত বেঘোরে কেউ ঘুমায়? আল্লাহ জানে দাদীজান একবার বুঝে গেলে কী অবস্থা করে! তার আগেই দ্রুত উঠুন প্লিজ।”
আগের মতোই কোনো সাড়া পেল না মোহ। এবার কিছুটা বিরক্ত হলো সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বচ্ছের বাহুতে হাত রাখল ডাকতে। তৎক্ষনাৎ যেন মনে হলো তার হাত পুড়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাত সরিয়ে ফেলল মোহ। আতঙ্কে ছেয়ে গেল চোখমুখ। খুব সাবধানে স্বচ্ছের কপালে হাত রেখে বুঝল মানুষটার প্রচণ্ড জ্বর এসেছে। পুড়ে যাচ্ছে গা। টেনশনে এবার মোহের মাথার স্নায়ুগুলি ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। একদিকে দাদীজানের ভয় অন্যদিকে লোকটির এই অবস্থায় কোনদিক সামলাবে বোধগম্য হলো না তার। আর কিছু না ভেবে দ্রুতই বারান্দা থেকে বাটি নিয়ে রুমাল ভিজিয়ে স্বচ্ছের নিকট এলো। স্বচ্ছের দ্রুত সুস্থ হওয়া প্রয়োজন।
এখনো উপুড় হয়েই ঘুমাচ্ছে স্বচ্ছ। মোহ বারবার ডেকেও তাকে সোজা করতে পারছে না। একসময় স্বচ্ছের হাত টেনে ধরল মোহ। হুঁশে না থাকা স্বচ্ছ নড়েচড়ে উঠে কষ্ট করে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। আধো চোখ মেলে মোহকে আবছা দেখে তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন করার চেষ্টা করল,
“সকাল হয়ে গেছে? কয়টা বাজে?”
“সকাল তো হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় আপনি যেতে পারবেন? মনে তো হয়না।”
“কেন কী হয়েছে আমার? একদম ফিট আছে। আন্ডারেস্টিমেট করো আমায়? আমি যেতে…”
কাঁপা স্বরে কথাগুলো বলে শেষ করতে পারল না স্বচ্ছ। তার আগেই গভীর ঘুমে চলে গেল সে। মোহ চটে গেল খানিকটা। কপালে ভেজা রুমাল রেখে ফুঁসে উঠে বলল,
“শরীরের জোর কমেছে। কথার জোর কমেনি।”
দুয়েকবার করে রুমাল মাথায় দিয়ে ঘর থেকে বাহিরে এলো মোহ রাবেয়া বেগম উঠেছে কিনা তা দেখতে। বাহিরে এসে হাফ ছাড়ল সে। হাতে ব্রাশ নিয়ে খালি পায়ে উঠান পেরিয়ে বড়ো দরজাটা খুলল। বাহিরের আবহাওয়া উপভোগ করতে বেশ লাগছে তার। বড়ো শ্বাস ফেলে হালকা করার চেষ্টা করল নিজেকে। দেখতে লাগল চারপাশটা। গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি চঞ্চল হয়। তার প্রমাণ এই ভোরে উঠে টিউশনে পড়তে যাওয়া। মোহ বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরকেই দেখছিল ব্রাশ করতে করতে। আচমকা একটি বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়াল তার সামনে। হাসিমুখে জানতে চাইল,
“আপা! কিরাম আছো?”
ছেলেটির নাম শান্ত। মোহ তাকে চেনে। গ্রামে দুষ্টুমির জন্য তার নামডাক অনেক। মোহও বিপরীতে হেসে জবাব দিল,
“হ্যাঁ ভালো আছি। তুই?”
“আমিও তো হেব্বি আছি। তোমারে দেইখা একটা কথা মনে পড়ল। তাই জিগাইতে আইয়া পড়লাম।”
“কী কথা?”
“কালকে রাত্রে তোমাগো বাড়ির খোঁজ করতাছিল একটা লোক। আমি ঠিকানা কইয়া দিছি। লোকটা কি তোমাগো বাড়িতে আইয়া পৌঁছায়ছে? দেইখা মনে হইতেছিল তোমাগো বাড়ি আগে কোনোদিন আহে নাই। আমারে নিয়া যাইতে কইতাছিল।”
মোহের ভ্রু দু’টো আপনাআপনি জড়িয়ে গেল। প্রথমেই স্মরণে এলো স্বচ্ছের কথা। অতঃপর ভাবল, উনি নাকি আত্মীয়দের বাড়ি এসেছেন? অনেক ভেবে জিজ্ঞেস করল,
“লোকটা কী প্রশ্ন করছিল তোকে?”
শান্ত একটু ভেবে বলল,
“কইতাছিলেন, আজহার সাহেবের বাড়ি চিনো তুমি? আমি তোমার নাম কইতেই সে কইল, হ তোমারই বাড়ি।”
মোহের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে গেল এবার। শুধাল,
“দেখতে কেমন? সুন্দর? চোখের মনির রঙ কি অন্যরকম? জামা কী কালার পরে ছিল?”
এত প্রশ্ন শুনে বিভ্রান্ত হলো শান্ত৷ মাথা চুলকে বলল,
“এতকিছু কেমনে কমু? আন্ধার ছিল তো। বাট গাড়ি লইয়া আইছিল মনে হয় আর ভালো কইরা হাঁটতে পারতাছিল না। পায়ে সমস্যা হইছিল মনে হয়।”
মোহ এবার পুরোটা ধরে ফেলল। নিশ্চিত হয়ে গেল স্বচ্ছের উদ্দেশ্যই ছিল তার বাড়ি অবধি আসা। নিজেকে ধাতস্থ করে দ্রুত শান্তকে বলল,
“আচ্ছা তুই যা।”
শান্ত চলে গেলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল মোহ। রাগে শরীর রি রি করে উঠল তার। হাত মুঠো করে বলল,
“মিথ্যুক মানুষ একটা! চোরকে বিশ্বাস করা যাবে তাও এই আহিয়ান স্বচ্ছকে বিশ্বাস করা যাবে না।”
মোহ ধুপধাপ শব্দ করে বাড়িতে ঢুকল। প্রথমে রাবেয়া বেগমের ঘরে উঁকি দিয়ে এরপর স্বচ্ছের ঘরে ঢুকতেই মোহ দেখল স্বচ্ছ উঠে বসে মাথা নিচু করে বসে আছে। প্রথমেই মোহের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল লোকটি মিথ্যে কেন বলল? কিন্তু স্বচ্ছের বেগতিক অবস্থা দেখে নিজেকে সামলে নিলো মোহ।
“উঠে পড়েছেন? কেমন লাগছে এখন?”
স্বচ্ছ অস্পষ্ট জবাব দিলো,
“মাথাটা ঘুরছে।”
মোহ তেতে উঠে বলে,
“ঘুরবেই। মিথ্যাবাদীদের এমনই হয়।”
স্বচ্ছ মাথা সোজা করে মোহের পানে সরু দৃষ্টি রাখে। মোহের কথা না বুঝে বলে ওঠে,
“কী? কী বললে তুমি?”
“জ্ঞানী ব্যক্তিরা এক বলাতেই সব বুঝে ফেলে। যা বলার বলেছি। বুঝতে চাইলে বুঝে নিন। নয়ত বুঝতে হবে না।”
“সবসময় তোমার বাঁকা উত্তর পাই কেন বলো তো? একটা অসুস্থ মানুষকেও ছাড় দেবে না তুমি? এতটা নির্দয়া কী করে হলে?”
মোহ কিছু বলল না। চুপ করে বাহিরে চলে গেল। কিছুসময় পর হাতে ভেজা কাপড় নিয়ে এসে স্বচ্ছের দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
“এই নিন। এটা দিয়ে পুরো শরীর মুছে নিন। জ্বর এসেছে আপনার।”
স্বচ্ছ তার দুর্বল চোখ পাকিয়ে বলল,
“পুরো শরীর?”
“হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি নিন ধরুন। হাত-পা সব মুছে নিন। আরাম লাগবে। আর জ্বর কমলেই চলে যাবেন প্লিজ!”
“তোমার সামনেই প্যান্ট খুলব এখন?”
স্বচ্ছের আচমকা এই কথায় মোহের নেত্রপল্লব বৃহৎ আকার ধারণ করল। একপ্রকার আশ্চর্য হয়ে বলল,
“কী?”
“না মানে তুমি হাত-পা মুছতে বললে। সেটার জন্য তো শরীর সব কাপড় খুলতে হবে তাই না? এজন্য বলছিলাম তোমার সামনেই খুলব? ব্যাপারটা বেশি হয়ে যাবে না?”
মোহ রাগে, লজ্জায় কাঁপতে শুরু করল। পিছু ফিরে দরজার দিকে যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে ওঠে,
“বেয়াদব লোক!”
চুলোর কাছে বসে ভাত রান্না করছেন রাবেয়া বেগম। চুলোটা আগের। আধুনিক গ্যাস, ইলেকট্রিক চুলো দিয়ে উনার চলবে না। উনি আগের চুলোতেই অভ্যস্ত। মোহ তার পাশেই বসে আছে আনমনে। ইথানের ঘুমটা এখনো ভাঙেনি। মোহ নিজের মনে ভেবে যাচ্ছে যা হচ্ছে একদমই ঠিক হচ্ছে না। সে ইতিমধ্যে আন্দাজ করে নিয়েছে স্বচ্ছের মনের অনুভূতির উপস্থিতি। বিষয়টা মোহের কাছে সুন্দর লেগেও লাগছে না। কোথাও একটা খুঁতখুঁত করছে। সরোয়ার সাহেবের কথা বারবার মস্তিষ্ক মনে করিয়ে দিচ্ছে। স্বচ্ছের এমন আচরণ যে এবার সরোয়ার সাহেবের কথাগুলো সত্যি বানিয়ে দিচ্ছে ভেবেই আঁতকে ওঠে মোহ। সে চায়না ওই মন্ত্রী সাহেবের কথা মিলে যাক। এতে তার কথার দাম যে কমে যাবে এবং এটা তার কাছে খুবই অসম্মানের।
চলবে…