যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
5

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০

সকালের তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে গরমে ঘেমে ঘেমে চা পান করছে সৌমিত্র। সেই চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়েও যেন আগুন বের হচ্ছে শরীর থেকে। যদিও তার এখানে আসার ইচ্ছে ছিল বা। তবুও ছুটে এসেছে তানিয়া নামক নারীর ডাকে। এই রোদের মধ্যে বাড়ি থেকে কেউ বের হয়? বিকেলেও তো ডাকতে পারত। এই নারী জাতি সবসময় পুরুষ জাতিকে দৌড়াদৌড়ির উপরে রাখতে পছন্দ করে। এসবই ভাবছে সৌমিত্র আর গরম চায়ে একটা করে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতীক্ষার পর সুদূরে পাওয়া গেল কাঙ্ক্ষিত রমনীর দেখা। মনোযোগ দিয়ে চেয়ে বুঝতে পারল ঘাড়ে লম্বা ব্যাগ ঝুলিয়ে হলুদিয়া পাখির ন্যায় সেজে হাতে ছাতা ধরে এগিয়ে আসছে তানিয়া।

সৌমিত্র হাফ ছাড়ল তাকে দেখে। তানিয়া ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। একসময় সৌমিত্রকে দেখে রাস্তা পার হয়ে দোকানে ছাউনির নিকটে এসে ছাতা বন্ধ করতে করতে বলল,
“বেশি দেরি করিয়ে ফেললাম?”

সৌমিত্র নিজের হাতের ঘড়িটা দেখেই বিস্তর হেসে বলল,
“নাহ। মাত্র সাতচল্লিশ মিনিট, বাইশ সেকেন্ড।”

তানিয়া স্পষ্ট বুঝল তাকে খোঁচা দিলো সৌমিত্র। তানিয়া সরু চোখে একবার তাকিয়ে তার ব্যাগের চেইন খুলে সৌমিত্রের কালো রুমালটা বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এইযে নিন আপনার জিনিস। আর আসতে হবে না। অপেক্ষাও করতে হবে না।”

“কীভাবে বুঝলেন আসতে হবে না? আসতে হতেও পারে।”

ভ্রু কুঞ্চিত হলো তানিয়ার। শুধাল,
“কেন?”

“হতেও পারে কোনো প্রয়োজন, অপ্রয়োজনে। কার জন্য কাকে অপেক্ষা করতে হতে পারে বলা যায়?”

“আপনি বেশ কথা প্যাঁচাতে পারেন।”

সৌমিত্র মৃদু হাসল। বলল,
“কথা প্যাঁচানোর কী দেখলেন? পুরুষজাতি স্ট্রেটকাট কথা বলে। মেয়েদের মতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে না। যেগুলো আমাদের মাথার উপর দিয়ে যায়।”

নারীজাতিকে অপমান করায় তানিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল এবার। শুকনো গলায় বলল,
“কী এমন প্যাঁচানো কথা দেখলেন নারীদের?”

“অনেককিছু। তারা প্রেমে পড়লেও ঘুরিয়ে বলে সে প্রেমে পড়েছে। যেসব আমাদের পুরুষদের সরল মস্তিষ্কে ঢোকে না। তারা রাগ করলেও পেঁচিয়ে কথা বলে। সেটাও আমরা বুঝিনা। আবার খুশি থাকলেও বুঝতে দেয় না। মুখে হ্যাঁ বললে মনে না বলে আর মনে না বললে মুখে হ্যাঁ বলে। এগুলো পেঁচানো কথা নয়ত কী?”

এসব কথা শুনে কিছুটা তেতে উঠল তানিয়া।
“আপনার দেখছি খুব অভিজ্ঞতা আছে।”

“এসব অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। নয়ত বিয়ের পর প্রতিদিন স্ত্রীর কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে যাবে আর কথায় কথায় গুষ্টি উদ্ধার করবে।”

এক মুহূর্ত আগেই জ্বলে ওঠা তানিয়ার মাথা এক মুহূর্তেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ফিক করে হেসে ফেলল সৌমিত্রের কথায়। সৌমিত্রও বিপরীতে হাসি উপহার দিয়ে জানতে চাইল,
“ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে বুঝি?”

তানিয়া তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো,
“ভার্সিটি যাব কেন? আমি তো পড়িনা।”

“ওহ। তাহলে বিয়ে করার পরিকল্পনা আছে? নিশ্চয় বাড়ি বসে থেকে বাসন পরিষ্কার করা, কাপড় ধুয়ে দেওয়া, রান্নাবান্না শিখছেন?”

ফের জ্বলে উঠল তানিয়া। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“মোটেও না। আমি ভার্সিটি পাশ করেছি এবারেই। পড়াশোনা শেষ করে হাওয়া খাচ্ছি।”

মুহূর্তেই গোলগোল আঁখিদুটি বড়ো বড়ো হলো সৌমিত্রের। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে প্রতিত্তোর করল,
“দেখে পিচ্চি মেয়ে মনে করেছিলাম। মেয়েরা আসলেই বয়স লুকায়। উল্টে তো আমিই পিচ্চি হয়ে গেলাম।”

“আপনি বুঝি ভার্সিটিতে পড়েন এখনো?”

সৌমিত্র মাথায় হাত রেখে চুলকাতে চুলকাতে ইতস্ততবোধ করে বলল,
“না মানে পড়লে পাশ করে যেতাম বিশ্বাস করুন। সিজিপিএ ধরে রাখতে পারিনি। আর একটা বছর যদি ধরে রাখতে না পারি বের করে দেবে ভার্সিটি থেকে।”

তানিয়ার দুঃখ প্রকাশ করা উচিত কিনা সে বুঝল না। তবে হাসি পেল ভীষণ। হাসি চাপিয়ে রেখে বলল,
“সারাদিন মেয়েদের নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকলে পড়ার সময় কী করে পাবেন বলুন মি. জুনিয়র?”

মি. জুনিয়র নামটি শুনে যেন মাথা ঘুরে গেল সৌমিত্রের। কিছুটা শুকনো গলায় বলে উঠল,
“অপমান করছেন জুনিয়র বলে? আমি কিন্তু আমার থেকে বয়সে বড়োই হবো।”

“তাতে কী? ক্লাসে তো জুনিয়রই!”

বলেই শব্দ করে হেসে দিলো তানিয়া। সৌমিত্র এবার প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। বলতে ইচ্ছে করল না। মাঝে মাঝে সামান্য অপমানিত হয়েও যদি কোনো নারীর মুখে এই সুন্দর হাসি ফোটানো যায় তবে খারাপ লাগবে না। হাসি শেষে তানিয়া বলল,
“তাহলে আমি যাই।”

“কোথায় যাচ্ছেন এই রোদের মধ্যে?”

“একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আসলে।”

কথাটা সামান্য ইতস্তত বোধ করেই বলল তানিয়া। সৌমিত্র সম্মতি জানিয়ে বলে,
“ওহ হ্যাঁ। তাহলে ঠিকই ধরেছিলাম মিস সিনিয়র গোলাপির বয়ফ্রেন্ড আছে।”

তানিয়া কিছু না বলে ঠোঁট প্রসারিত করে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সৌমিত্র বলল,
“এই গরমে হেঁটে গেলে মেকআপ উঠে যাবে। বয়ফ্রেন্ড ভয়ে পালানোর সম্ভবনা আছে। আপনি চাইলে আমি লিফট দিতে পারি।”

“না, ধন্যবাদ। আমি রিকশা নিয়ে নেব সামনের মোড়ে।”

তানিয়া আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল ছাতা মেলে। আজ তার আর ভয় লাগেনি সৌমিত্রের সাথে কথা বলতে। আসলে লোকটি ভয় পাওয়ার মতো মানুষ নয়।

পাতে খাবার নিয়ে শুধু সেটা হাত দিয়ে নেড়ে এলোমেলো করছে মোহ। তবে খাবার মুখে নেওয়ার কোনো নাম নেই। একবারের চোরের ন্যায় দৃষ্টি নিয়ে দাদীজানের দিকে তাকাচ্ছে। রাবেয়া বেগম মনোযোগ দিয়ে খাবার গ্রহণ করছেন। অতঃপর তিনি আনমনা মোহকে লক্ষ্য করেন।
“কী হইছে? খাইতাছস না ক্যান? এই বয়সে বুড়ি বেডিগো মতো কী এত চিন্তা করোস?”

মোহ হকচকিয়ে তাকায়। ইথান আজ নিজ হাতে ভাত খাচ্ছে। মোহের চিন্তা, স্বচ্ছকে সে গত রাত থেকে না খাইয়ে রেখেছে। সকালেও কিছু খেতে না দিলে বিষয়টা লজ্জার হয়ে যাবে তার কাছে। তবে সে কোনো বাহানাও পাচ্ছে না ঘরে যাওয়ার জন্য। অতঃপর মোহ উসখুস করে বলল,
“এত গরমে খাওয়া যাচ্ছে না দাদীজান। ঘরে ফ্যানের নিচে বসে থেকে খাই?”

রাবেয়া বেগম কপাল কুঁচকালেন। খুব একটা গরম কোথায়? ঝড়ের পর আশপাশ পরিবেশ বেশ ঠাণ্ডা। তিনি কিছু বলার আগে ইথান ফট করে বলল,
“তাহলে আমিও তোমার সাথে ঘরে খাব মাম্মা!”

মোহ হতাশা নিয়ে চাইল ইথানের দিকে। মাত্র একটা বুদ্ধি পেয়েছিল তাও ইথান নিজের অজান্তে ভেস্তে দিয়ে যাচ্ছে। মোহ হাসার চেষ্টা করে বলল,
“না বাবু। এখন এখানেই খাও। তুমি তো খেতে খেতে ভাত ফেলে দাও নিচে। বিছানায় ভাত পড়লে ঘুমাবে কী করে বলো সেখানে?”

ইথান যেন বুঝল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা। এখানেই খাব।”

মোহ এবার দাদীজানের উত্তরের আশা না করে দ্রুত পাতিল থেকে আরো ভাত তুলে নিলো। আর বলল,
“এতটুকু ভাত দিয়েছ কেন দাদীজান? তোমার নাতনির পেট ভরবে? আর একটু ডিম ভেজে নিয়ে যাচ্ছি। এমনি ভর্তা দিয়ে খেতে ভালো লাগছে না।”

এই বলে তড়িঘড়ি করে চুলোর দিকে গেল মোহ। রাবেয়া বেগম ভাত খাওয়া ছেড়ে নাতনির কাণ্ড দেখে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। মোহ কোনোকালেই এতগুলো ভাত খেত না। এবার থালভর্তি ভাত নিয়ে যাওয়া দেখে মাথা ভনভন করতে লাগল উনার।

খিদেতে যখন স্বচ্ছের নাজেহাল অবস্থা তখনই ঘরে এসে তার সামনে রাখল মোহ। বিরস মুখে বলল,
“কাল রাত থেকে খেয়ে থাকতে হয়েছে তার জন্য সরি।”

স্বচ্ছ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ মোহের শুকনো মুখের পানে। তপ্ত শ্বাস ফেলে খাবারের দিকে চেয়ে বলল,
“মানুষ যখন সরি বলে মুখে একটা অনুতপ্ত ভাবটা থাকতে হয়।”

“আমার মুখে অনুতপ্ত ভাব নেই কারণ আমি এখানে আপনাকে ডাকিনি। আপনি আমার বাড়ির অযাচিত অতিথি। খাবার খেয়ে একটা জ্বরের ট্যাবলেট খান। আশা করি ঠিক হয়ে যাবেন। আমি আপনার ভাইকে কল করে দেব। নম্বর দিয়েন দয়া করে। সে এসে নিয়ে যাবে।”

“তাড়িয়ে দিচ্ছো?”

“কেন দেওয়া উচিত নয়? কেন এসেছেন আপনি এখানে? উত্তর আছে আপনার কাছে?”

মোহের কড়া কণ্ঠ এবার স্বচ্ছকে বিব্রত করে তুলল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে লাগল,
“বললাম তো আমি একটা আত্মীয়…”

মোহ তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছের কথার মাঝে নিজে বলল,
“শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দরকার নেই। আমি এতটা বোকা নই। কাল থেকে সন্দেহ হয়েছিল আমার। আজকে শান্ত সব ক্লিয়ার করে দিয়ে গেছে। আপনি এখানে আমার খোঁজে এসেছেন। ঠিক নাকি ভুল?”

স্বচ্ছ হাতেনাতে ধরা পড়ে মুখটা ছোটো হয়ে গেল। চুপসে গেল চেহারা। চোখ দুটো ছুটে বেড়াচ্ছে তার ধরা পড়ার ভয়ে। মোহ বুঝে নিলো স্বচ্ছের মৌনতা। বলল,
“কেন এসেছেন এখানে? কী চান আপনি? একটা সাধারণ মিডল ক্লাস পরিবারের সাধারণ একটা শিক্ষকের মেয়ের জন্য আপনি নিজেকে ক্ষ/ত বি/ক্ষত করে ছুটে এসেছেন। কেন আপনার এই অস্থিরতা?”

স্বচ্ছ এবার হাজারও দ্বিধা সরিয়ে মোহের চোখে চোখ রাখে। ধীর গলায় বলে,
“পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল পথ হারিয়ে ফেলেছি। তাই তোমার কাছে এলাম। নিজের পথ চিনতে, নিজেকে গুছিয়ে নিতে।”

মোহ স্বচ্ছের এমন উত্তর আশা করেনি। গলা শুঁকিয়ে গেল তার স্বচ্ছের উত্তরে। পরপর ঢক গিলে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সে। মস্তিষ্কে খেলে গেল সরোয়ার সাহেবের কথাগুলো। হ্যাঁ, ওই ব্যক্তির কথাগুলোই মিলছে প্রত্যক্ষভাবে। মোহ মিলতে দেবে না। তার বাবার সম্মান আর মিশতে দেবে না। এতে ঝামেলা বাড়বে, সব উলোটপালোট হয়ে যাবে। নিজেকে ধাতস্থ করে সে বলল,
“আপনার পথ ভিন্ন, আমার পথ ভিন্ন। দুটো পথকে গুলিয়ে ফেলবেন না।”

“যদি কখনো দুটো পথের শেষে একে অপরের সাথে মিলে যায় তবে?”

মোহের কণ্ঠস্বর কাঁপছে। সেটা সে উপলব্ধি করতে পারছে। তবুও বলল,
“এটা অসম্ভব। হতে পারেনা। কখনো হবে না।”

স্বচ্ছ আর প্রশ্ন করল না। নিজের অহংবোধকে সে খোয়াবে না। বজায় রাখবে। বরং তার রাগ হলো নিজের প্রতি। কেন এত কথাগুলো বলতে গেল সে? তার রগে রগে জানান দিলো ক্রোধ। হালকা কেঁপে উঠে ডান হাতে আস্তে করে খাবার থালা টেনে নিলো সে। গরম ভাতের ধোঁয়া ক্রমশ কম হয়ে আসছে। সামনে ডিম ভাঁজি। বাকি দুটো জিনিস স্বচ্ছ চেনে না। গাঢ় সবুজ রঙের কিছু একটা। আরেকটা মরিচ দিয়ে কিছু। স্বচ্ছের মুখভঙ্গি অদ্ভুত হয় এসব দেখে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,
“এসব কী খাবার? কী বলে এগুলোকে?”

মোহের ভ্রু কুঁচকায়। শুধায়,
“কখনো খাননি?”

“মা বোধহয় দুয়েকবার ছোটো বেলায় জোর করে খাওয়াত। নাম মনে পড়ছে না।”

মোহ দুটো জিনিস ইশারায় দেখিয়ে বলে,
“ওটা কচু ভর্তা আরেকটা মরিচ ভর্তা৷ বাড়িতে এর চেয়ে ভালো খাবার হয় না। আপনি বোধহয় বাহিরের খাবারে বেশি অভ্যস্ত। তবে এগুলো খাবার অনেক স্বাস্থ্যকর। আজেবাজে জিনিস না খেয়ে মানসম্মত খাবার খাবেন। শরীর ভালো থাকবে।”

স্বচ্ছ চুপচাপ একটু করে ভর্তা দিয়ে ভাত মাখিয়ে খেয়ে দেখল। না খারাপও লাগছে না। ভালোই লাগছে। আস্তে আস্তে সমস্ত ভাত খেয়ে নিলো স্বচ্ছ। মোহ স্বস্তি নিয়ে বলল,
“ভালো লেগেছে আপনার?”

“হুমম। তখন ছোটোবেলায় টেস্ট বুঝতাম না এত। ভালো লেগেছে।”

মোহ মৃদু হাসল। থালা হাতে নিতে নিতে বলল,
“আশা করব, এরপর আমার জন্য এত অস্থির হবেন না। আপনার বাবা আমার বাড়ি বয়ে এসে আমার বাবার উপর শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গেছে। উনার ধারণা আমি আপনাকে ফাঁসাচ্ছি। উনার ধারণা সত্যি করে দেবেন না প্লিজ! আমার বাবার সম্মান আমার কাছে অনেক বেশি দামী।”

হুট করে বাবার বিরুদ্ধে এতগুলো কথা শুনে মাথার সবকিছু যেন উলোটপালোট হয়ে গেল স্বচ্ছের। আঁখি দুটো ছোটো হয়ে গেল। তার ধরণী কেঁপে উঠল। বিশ্বাস হলো না মোহের কথা।
“কী বলছ তুমি? বাবা এসব বলেছে? ভুল হচ্ছে না তো তোমার?”

“আপনার বাবাকে চিনতে আপনার ভুল হতে পারে। আমি উনাকে এতদিনে শিরায় শিরায় চিনেছি। বিন্দুমাত্র ভুল হবে না আমার। আমি জানি উনি আপনার বাবা তাই আমার চেয়ে বেশি হয়ত আপনার উনাকেই বিশ্বাস হবে। তাই বলিনি উনার কথা। কিন্তু না বলে পারলামও না।”

মাথা ভনভন করে উঠল স্বচ্ছের। মোহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বচ্ছের ফ্যাকাসে মুখটা দেখে দরজা খুলে চলে গেল। স্বচ্ছ মানতে চাইল না। তার বাবা যে সেদিন প্রমিস করেছিল এসব আর করবেন না! তবুও কেন প্রমিস ভাঙল?

চেয়ারে বসে থেকে তার হ্যান্ডেলে নিজের হাতের আঙ্গুলগুলি বারবার নাড়াচ্ছে সরোয়ার সাহেব। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আছেন তিনি। একসময় তার গাম্ভীর্যের কারণে যেন কেঁপে উঠল দেয়াল।
“মেয়েটা শুধু আমার রাজনীতিতে থাবা মা;রতে চাইছে না ইয়াকীন! মেয়েটার আমার ছেলের দিকেও হাত বাড়িয়েছে।”

কালো কুচকুচে ঘন দাড়িওয়ালা লোকটি মনোযোগের সহিত শুনল সরোয়ার সাহেবের কথা। কোঁকড়ানো চুলগুলো তার মাঝে কাটা ভ্রু ঢেকে দিয়েছে। গাঢ় শ্যামলা কপালে জমেছে ঘাম। সে জানতে চাইল,
“আপনি কী চাইছেন সাহেব?”

“তেমন কিছু না। তোমার যেটা কাজ সেটাই করবে। আশা করছি আমাকে একটা একটা করে শব্দ দিয়ে তোমায় বুঝিয়ে বলতে হবে না?”

“না সাহেব। আমি বুঝতে পেরেছি।”

সোজা হয়ে বসলেন এবার সরোয়ার সাহেব। চোখমুখ কুঁচকে পাশের টেবিল থেকে সিগারেট হাতে নিয়ে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে মুখে নিয়ে বললেন,
“ভোটের আগে কোনো ঝামেলা চাইনা আমি। আর ওই মেয়ের মতো পথের কাঁটাকে তো একদমই না।”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩১

মাত্র মেইন গেইট পেরিয়ে কংক্রিটে তৈরি রাস্তা দিয়ে সবে বাড়ি ঢুকতেই বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বের হওয়া এক ব্যক্তির সাথে ধা/ক্কা খেয়ে সবুজ ঘাসে পা পড়ল সৌমিত্রের। নিজেকে সামলে নিয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই অগোছালো চুলে সম্পূর্ণ শ্যাম বর্ণের লোকটাকে চিনতে ভুল হলো না সৌমিত্রের। দ্রুত সে শুধাল,
“ইয়াকীন না?”

ইয়াকীন উসখুস করে। কোনোরকমে এখান থেকে বের হওয়া তার উদ্দেশ্য। সরোয়ার সাহেব কড়া করে বলেছেন বের হওয়ার সময় যেন কেউ না দেখে। কিন্তু সৌমিত্রের চোখে পড়েই গেল সে। হালকা কেশে সম্মতি জানিয়ে ছোট্ট করে ইয়াকীন উত্তর দিল,
“জি।”

“হঠাৎ বাড়িতে কী করছ? বাবা ডেকেছিল নাকি কোনো কাজে?”

ইয়াকীন আবারও মাথা নেড়ে বলল,
“জি।”

সৌমিত্র হাসল হালকা। ইয়াকীনের কাঁধ চাপড়ে বলল,
“গুণ্ডামি, মা/রামা;রি তো ছেড়ে দিয়েছ তাই না?”

“জি। ছেড়ে দিছি। ওসব আর করব না।”

সৌমিত্র বেশ খুশি হলো। দুয়েকটা কথা বলে চলে এলো বাড়ির ভেতরে। ইয়াকীন দ্রুত নিজের পা চালিয়ে প্রস্থান করল মন্ত্রী সাহেবের বাড়ি থেকে।

স্বচ্ছের হাতে জ্বরের ট্যাবলেট ধরিয়ে দিলো মোহ। তার শুকনো মুখে আতঙ্ক। জানা নেই কতক্ষণ দাদীজানের সাথে লুকোচুরি খেলে উঠতে পারবে সে। বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি ধরা খেলো! মোহ দ্রুত গ্লাসের পানি দিয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। জ্বর অনেকটা কমে এসেছে মনে হয়। একটু আগে আপনার দেওয়া নম্বরে আপনার ভাইকে কল করেছিলাম।”

“কী বলল সে?”

স্বচ্ছের প্রশ্নের উত্তরটা দিতে গিয়ে ভ্রু কুঁচকায় মোহ। বিভ্রান্ত হয়ে বলে,
“আপনার ভাই এমন অদ্ভুত কেন? কেমন উদ্ভট তার কথাবার্তা! বলে কিনা এখানে যেন আপনাকে আর কয়দিন রেখে দিই। আপনি নাকি এখন নিজের বাড়ি থেকে এখানে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।”

স্বচ্ছ অবাক হলো না। সে জানে তার ছোটো ভাইয়ের কথাবার্তা আর কাণ্ড সম্মন্ধে। বিরক্তির শ্বাস ফেলে শুধু বলল,
“ও এগুলো বলেছে? সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নেই। কারণ ওর সাথে পাগলের কোনো পার্থক্য নেই। পাগলের কথা যেমন ধরতে নেই সৌমিত্রের কথাও ধরা বোকামি।”

“নিজের ভাইকে পাগল বললে আপনি নিজে কী? পাগলের বড়ো ভাই? মহা পাগল?”

স্বচ্ছ অন্য সময় হলে হয়ত রেগে যেত। তর্ক করত। এখন তার মন চাইল না। বরং প্রতিত্তোরে হাসি দিলো সে। মোহ বলল,
“ঔষধ খান দ্রুত। হাতে ধরে রেখেছেন যে!”

“এত তাড়া দিচ্ছো যে? আমাকে তাড়ানোর জন্য খুব তাড়া?”

মোহ এবার প্রতিত্তোরে শক্ত এবং কঠিন জবাব দিলো,
“থাকারই কথা৷ আপনার মন্ত্রী বাবাকে আমি জিততে দেব না৷ কখনোই না।”

স্বচ্ছ এর উত্তরে কিছু বলার মতো পেল না। সে লজ্জিত। মাথা নত হলো তার। অন্য সময় বাবার জন্য গলা উঁচিয়ে কথা বলেছে, ঝগড়া করেছে, তর্ক করেছে। আজ করতে পারছে না। অনুতপ্ত হতে হচ্ছে। তাও শুধু তারই বাবার জন্য। এসব ভেবেও মাথায় র;ক্ত চড়ে যাচ্ছে স্বচ্ছের। তাকে চুপ থাকতে দেখে মোহ আবারও বলে,
“ঔষধ কি হাতে ধরে রাখার জন্য দিয়েছি আপনাকে?”

স্বচ্ছ ভাবনার মাঝে মোহের কণ্ঠে খানিকটা চমকে তাকায়। একপলক মোহের চোখের দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“যদি আমার অসুস্থতা বেড়ে যায় আর জ্বর আরো বেড়ে যায় তবে কী করবে?”

মোহ কিছুটা চুপ থেকে স্বচ্ছের প্রশ্নটা ঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করল। তারপর ভেবে উত্তর করল,
“কী করব আবার? নেগেটিভ কথাবার্তা কোত্থেকে শিখেছেন? নিজের সুস্থতা কামনা করবেন।”

“কেন জানি না তবে নিজের সুস্থতা কামনা করতে মোটেও ইচ্ছে করছে না মিস মোহ! অসুস্থ থাকতে ইচ্ছে করছে।”

“আপনার সব আজগুবি ইচ্ছে।”

কথা শেষ হতে না হতেই পাশের ঘর থেকে রাবেয়া বেগমের ডাক শোনা গেল। মোহ ঘেমে যাওয়া কপালের দুপাশে কোঁকড়া চুল নিজ হাতে অন্যপাশে ঠেলে দিতেই দাদীজানের কণ্ঠে নেত্রপল্লব বড়ো বড়ো হলো। ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
“আপনি বসুন চুপচাপ। আমি আসছি।”

মোহ ছুটল দাদীজানের ঘরে। স্বচ্ছ মুঠোয় থাকা ঔষধ একবার দেখে নিয়ে জানালার দিকে ছুঁড়ে মারল নিশানা করে। আধশোয়া হয়ে পড়ল চৌকিতে। মনে মনে ভাবল, অসুস্থতা বাড়ানোর ইচ্ছের পেছনে আসল কারণটা যদি মেয়েটা জানত! বিড়বিড়িয়ে নিজে নিজে আওড়াল,
“আমার এই অসুস্থতায় তোমায় আমার সংলগ্নে নিয়ে আসে মিস. মোহ! এটা যেন অসুস্থতা নয়, এটা তোমায় নিকটে আনার এক বিশেষ জাদু!”

রাবেয়া বেগমের ঘরে পা রাখতেই মোহ দেখল তার দাদী লাঠি নিয়ে ঘর থেকে হম্বিতম্বি করে বের হচ্ছে। মোহ অবাক হলো ভীষণ। প্রশ্ন করল,
“আমাকে ডেকে কোথায় যাচ্ছো এভাবে?”

“ওই পোলার অনেক সেবা করতেছিস কাল রাত থাইকা। এহন মাইর না খাইলে যাইব না। শিক্ষা দিতে যাইতেছি।”

পিলে চমকে গেল মোহের। ধড়ফড়িয়ে উঠল বুক। এ কী সে ঠিক শুনল? স্বচ্ছের কথা দাদীজান জানল কী করে? এ তো মহাবিপদ! মোহ আশ্চর্য হয়ে ভাবতে ভাবতেই রাবেয়া বেগম ইতিমধ্যে তার ঘরের দরজা খুলে ফেলেছে। চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে সে ছুটল তার ঘরের দিকে।

চোখ বুঁজে থাকতেই হঠাৎ লাঠির শক্ত আ/ঘাত যখন এসে স্বচ্ছের বাহুতে লাগে তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে চকিতে তাকায় স্বচ্ছ। বয়স্ক মহিলাকে দেখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে ভালো করে দেখতেই যখন হাতেও রাবেয়া বেগম আ/ঘা;ত করেন হুড়মুড়িয়ে সরে চৌকির কণায় গিয়ে দাঁড়ায় স্বচ্ছ। রাবেয়া বেগম লাঠি নিয়ে এগিয়ে এসে বলেন,
“আমার বাড়িতে থাইকা আমারই সুন্দরীর সেবা নিচ্ছিস! ফাজিল কোনেকার!”

স্বচ্ছ দ্রুত রাবেয়া বেগমের লাঠি চেপে ধরে কোনোরকমে। রাবেয়া বেগম দমেন না। লাঠি ছাড়ানোর চেষ্টা করেন। তবে এমন শক্তপোক্ত যুবকের সাথে কি পারা যায়? মোহ ততক্ষণে ঘরে উপস্থিত হয়েছে। হতভম্ব হয়ে কী করবে সেসব জ্ঞান হারিয়েছে সে। স্বচ্ছ দুম করে বলে দিলো,
“আরে দাদীমা! আমি আপনার সুন্দরীর কাছে আসব কেন বলুন তো? আসল সুন্দরী তো আপনি। আমি তো আপনার কাছে এলাম।”

রাবেয়া বেগম কিছুটা ঠাণ্ডা হলেন এবার। ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন স্বচ্ছের দিকে। তার বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে ভেবে খানিকটা স্বস্তি পায় সে। মোহ ভাবে, তার বলা কথাগুলো কাজে দিয়েছে। কেননা, সে বলেছিল যদি তার দাদীজান কিছু জেনে যায় তবে উনার রূপের প্রশংসা করতে। রাবেয়া বেগমের ভাষ্যমতে তিনি যৌবনকালে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। তার পেছনে অনেক পুরুষ ঘুরেছে। পাত্তা পায়নি একমাত্র মোহের দাদা ছাড়া। অবশ্য সেটা এখনো রাবেয়া বেগমকে দেখলেই বোঝা যায়। চামড়া কুঁচকে গেলেও গায়ের রঙটা বেশ সুন্দর রয়েছে। মোহের ন্যায় কোঁকড়ানো চুল যদিও অনেকটা পড়ে গিয়েছে। রাবেয়া বেগম ক্ষ্যান্ত হতেই ফের কপাল কুঁচকে কাঠকাঠ গলায় বলেন,
“ফাইজলামি পাইছ তুমি আমার লগে? তুমি আমার কাছে আইছো কইলেই আমি বিশ্বাস করুম?”

“সত্যি দাদীমা! আমি আমার বন্ধুর কাছ থেকে আপনার কথা শুনেছি। বন্ধুর দাদু নাকি আপনার পেছন পেছন ঘুরত। তাই অনেক খুঁজে আপনার দেখা পেতে এলাম বিশ্বাস করুন।”

রাবেয়া বেগম যেন এবার কিশোরীর ন্যায় লজ্জা পেলেন। স্বচ্ছ ততক্ষণে বসে পড়েছে। স্বচ্ছের কাঁধে আলতো ধা/ক্কা দিয়ে বলেন,
“আজকাল পোলাপাইন তোমরা অনেক দুষ্টু!”

মোহের হাসি পায় এসব কথোপকথন শুনে। স্বচ্ছ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। রাবেয়া বেগম চৌকিতে বড়ো শ্বাস নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে বলেন,
“মোহ সুন্দরী! গিয়া আমার লাইগা পানি লইয়া আয় তো। আর হ্যাঁ ঠাণ্ডা টিউবওয়েল থেকে নিয়া আসবি।”

মোহ যেতে না চেয়েও যেতে হলো পানি আনতে। স্বচ্ছ চুপ থাকতে থাকতে হঠাৎ আগ্রহ নিয়ে শুধাল,
“দাদিমা? আপনি কী করে জানলেন যে আপনার সুন্দরী লুকিয়ে আমার সেবা করছে?”

রাবেয়া বেগম ফিক করে হেসে বলে উঠলেন,
“জানমু না আবার? কালকে তো এদিকে আইছিলাম রাতে। বারান্দা দিয়া যখন যাইতেছিলাম তখন ফ্যান চলার আওয়াজ শুইনা ঘর খুইলা দেখি তুমি ঘুমাইতাছো। প্রথমে মনে ভুল ভাইবা আইসা ঘুমাইছিলাম। সকালে মোহের খাবার নিয়া কাণ্ড দেইখা নিশ্চিত হইছি। বয়স বাড়ছে মানে এই না আমি কিছু বুঝি না। বুঝছ?”

“আপনি তো সুন্দরীর সাথে সাথে বেশ বুদ্ধিমতীও দাদিমা!”

রাবেয়া বেগম এবার সরু দৃষ্টিতে স্বচ্ছকে দেখলেন। কণ্ঠের স্বর কড়া করে বললেন,
“হইছে ঢপ কম দেও। তুমি কেন আসছো এইহানে আমি জানি। তুমি মন্ত্রীর ওই পোলাডা না? সত্যি কইবা!”

স্বচ্ছ উপায়ন্তর না পেয়ে স্বীকার করে,
“জি দাদিমা।”

“তোমার আর তোমার বাপের ব্যাপারে সব শুনছি আমি। দেখো, তুমি কেন আমার নাতনির জন্য এতদূর আইছো আমি জানি না। জানতেও চাইতেছি না। কিন্তু আমার নাতনির সাথে নিজের পায়ের তাল মেলাতে চেষ্টা কইরো না। তোমার বাপ এইডা হইতে দেবে না। আর আমার নাতনির পথচলাও খুব একটা সহজ না। ওর লগে তুমি চলতে পারবা না।”

স্বচ্ছ রাবেয়া বেগমের কথাগুলো শুনে নীরব হয়। প্রথম কথাগুলোর মানে বুঝলেও পরবর্তী কথাগুলোর মানে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে নির্বিকারে চেয়ে থাকে রাবেয়া বেগমের দিকে। দাদীজান আবারও বলেন,
“তোমার সাথে এসব কথা বলার জন্যই মোহরে বাহিরে পাঠাইলাম। তুমি তাড়াতাড়ি এখান থাইকা চইলা যাও। এমনি আমার নিরপরাধ সুন্দরীর মেলা বদনাম এই গ্রামে। তাও তোমার বাপের জন্য সে এইহানে চইলা আইছে। তুমি এখানে আইসা আমার নাতনিডারে অশান্তি দিও না। বুঝছ?”

স্বচ্ছ এবারও কোনো জবাব দিলো না। নিজেকে আরো ছোটো মনে হলো তার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সব কথা হজম করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তবে সহ্য করতে হচ্ছে। এবার রাবেয়া বেগম বললেন,
“যদি কোনোদিন মনে করো, আমার সুন্দরীর সবকিছু মাইনা নিয়া তার পাশে থাকতে চাও তাহলে সেদিন আমার সব কথা ফিরাইয়া নিমু। আমার নাতনির বদনামও নিজের মনে করতে যেদিন পারবা সেদিন আমার কাছে আইসো আবার।”

স্বচ্ছ সেদিন বিনা জবাবে সৌমিত্রের সাথে বিকেলে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার পথে বারংবার মোহের ঘরের জানালার দিকে দেখেছিল। মোহ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই। তার দৃষ্টি ছিল মলিন।

পরদিন সকাল সকাল প্রচণ্ড রোদের মাঝে গ্রামের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে মোহ। উদ্দেশ্য একটা গাড়ি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড অবধি যাওয়া। আজই ঢাকা শহরের দিকে যাবে সে। তবে একা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হলো মোহ। মাথায় থাকা আকাশী ওড়নার মাধ্যমে চেষ্টা করছে নিজেকে রোদের তাপ থেকে বাঁচাতে। এমন সময় তার সামনে হুট করে একটা কালো বোরখা পরিহিত মহিলা এসে দাঁড়ালেন। চোখ দুটোও দেখা যাচ্ছে না উনার। মোহ বিস্মিত হয়ে চেয়ে উনাকে চেনার চেষ্টা করেও পারল না। মহিলাটি আরো এগিয়ে একটা কাগজ বের করে বিনয়ী সুরে বললেন,
“আমাকে এই ঠিকানাটা বলে দিতে পারবেন?”

মোহ মানা করতে পারল না। জানতে চাইল,
“কোনটা দেখি?”

মহিলাটি আরেকটু এগিয়ে মোহের সংলগ্নে দাঁড়িয়ে কাগজটি এগিয়ে দিলো। মোহের নাকে ঠেকল উদ্ভট এক গন্ধ। প্রথমে তেমন কিছু মনে না হলেও কড়া সেই গন্ধে মুহূর্তেই কাগজে থাকা লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেল তার কাছে। জোর করে চোখ মেলতে চেয়েও মেলতে পারল না আর। মাথায় ঘুরে উঠল তার। পড়ে গেল সে মাঝরাস্তায়। মহিলাটি দ্রুত নিজের কাগজ লুকিয়ে চিৎকারে লোকজন জড়ো হলো।
“আপুটার এই রোদে মাথা ঘুরে গেছে।”

মোড়ে পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গিয়ে কপালের বাম দিকে হালকা কেটে গেল মোহের। র:ক্তের দেখা মিলল সেখানে। সকলে বলে উঠল,
“একে তো আগে হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার দরকার মনে হচ্ছে। এই কেউ গাড়ি ডাকো।”

সামনেই হঠাৎ উপস্থিত হলো একটি অটো। সেখানে থাকা ড্রাইভার তাড়া দিয়ে বলল,
“আপারে তাড়াতাড়ি উঠান। সময় নষ্ট করা যাইব না।”

অবচেতন মোহকে ধরে কোনোরকমে অটোতে তুলে দেওয়া হলো। অনেক মায়া করে বোরখা পরা মহিলাটি সাহায্য করতে চাইলেন। মোহকে ধরে বসলেন অটোতে। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার অটো নিয়ে যেতে শুরু করল নিজের গন্তব্যে। আয়না দিয়ে মহিলাটির দিকে শব্দহীন হাসি দিয়ে বলল,
“কাজটা ভালোভাবেই করতে পেরেছিস।”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২

বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে মোহের বাড়িটা একই রাস্তায় পড়লে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তানিয়া। গেট খোলা দেখে মনে মনে ভেবে নেয় গিয়ে মোহের একটু খোঁজ নিয়ে আসবে। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রধান দরজা খোলা দেখে ধীর পায়ে গিয়ে বাড়িতে ঢোকার দরজা হালকা খোলা দেখতে পায় সে। সেটির কাছাকাছি যেতেই ভেতর থেকে মিসেস সুফিয়ার কান্নাকাটি তানিয়ার কানে আসে। তানিয়া আঁতকে ওঠে। মিসেস সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাদের মতো বলে যাচ্ছেন,
“আমি কিছু জানি না। তুমি আমার মেয়েটাকে এনে দাও। আমি ওকে এখনি আমার সামনে চাই। আমার কাছে এনে দাও আমার মোহকে।”

মিসেস সুফিয়ার কথাগুলো শুনে চমকায় তানিয়া। মোহের কথা ভাবতে ভাবতে আরো শুনতে পায় আজহার সাহেবের কথা।
“আমি তো বুঝতেই পারছি না কী করব। এখানে পুলিশের কাছে গিয়ে লাভও হয়ত হবে না। গ্রামে যেতে হবে। খোঁজ নিতে হবে।”

“আমি তোমাকে বারবার বলছি! ওই মন্ত্রীটা আমার মেয়ের কিছু একটা করেছে। নয়ত এতক্ষণে ও ফিরে যেত বাড়িতে। ওর কিছু একটা হয়েছে।”

“তুমি তো ওর কাছে ফোনও রাখো নি। রাখলে হয়ত যোগাযোগ করতে পারত।”

মিসেস সুফিয়া আরো ভেঙে পড়লেন। নিজেকেই দোষী বোধ করলেন। তানিয়া এবার নিজের অস্থিরতা সইতে না পেরে দরজা ঠেলে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,
‘আসব আঙ্কেল আন্টি?”

অতি চিন্তার মাঝে মোহের মা-বাবা তানিয়ার গলা পেয়ে দরজার দিকে তাকালেন। তবে মিসেস সুফিয়ার অশ্রু ঝরানো থামছে না। আজহার সাহেব থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“তানিয়া মা! তুমি এখানে?”

তানিয়া ভদ্রতার সহিত সালাম দিয়ে বলল,
“আসলে মোহের খোঁজ নিতে এসেছিলাম। আপনাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছি। তার জন্য দুঃখিত। মোহের কি কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

আজহার সাহেবের মুখটা আরো মলিন হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমার মেয়েটা আজকে সকালে নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। মাথা ফেটে গিয়েছিল তাতে একটা মহিলা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারপর আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”

তানিয়া বিস্মিত হয়ে শুধায়,
“সে কী! মোহের চেনা কেউ যায়নি সাথে?”

“গেলে তো চিন্তা ছিল না। মোহকে এমনি গ্রামের মানুষ পছন্দ করে না। তাই হয়ত কেউ যায়নি। এখন ওর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ও বাড়ি ফিরে নি। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।”

তানিয়ার মুখের ভঙ্গিও পাল্টে গেল এমন খবর শুনে। মুখ ভার হয়ে গেল তার। মিসেস সুফিয়া নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“আমরা আর কতক্ষণ এখানে থাকব? চলো গ্রামে। এখনি চলো।”

তানিয়া ইতস্ততবোধ করে বলল,
“আমিও আসছি আঙ্কেল, আন্টি! মোহের খোঁজ পেলে জানাবেন দয়া করে। চিন্তায় থাকব।”

তানিয়া বেরিয়ে এলো। সে যতদূর জানে, মোহ এতটা দায়িত্বহীন মেয়ে নয়। সজ্ঞানে থাকলে সে নিশ্চিত নিজের পরিবারকে এতটা চিন্তায় ফেলবে না। তবে কী হলো মেয়েটার?

আবারও মস্তিষ্ক জুড়ে খেলে গেল দুঃস্বপ্ন। সেই দুরাকাঙ্ক্ষার চোটে কাঁপুনি দিয়ে উঠল শরীর। চোখ দুটো জোর করে মেলে চারিপাশে অস্পষ্ট দেখল মোহ। মাথায় তখন অসম্ভব য;ন্ত্রণা। মাথায় হাত দিতে গিয়ে সে বুঝল তার হাত নড়ানো যাচ্ছে না। সে চেষ্টা করল বারংবার। অবশেষে তার অচল মস্তিষ্ক বুঝে নিলো তার হাত বাঁধা শক্ত করে। শুধু হাত নয়। পা-মুখ সহ বাঁধা। বিনা বাতাসে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে শরীর। দুঃস্বপ্ন যেন দ্বিতীয় বারের মতো সত্যি হয়ে ধরা দিলো মোহের বাস্তবে। আতঙ্কে শিউরে উঠল গায়ের লোম, দুচোখে খুঁজতে থাকল বাঁচার উপায়। আশেপাশে কেউ নেই। তার মাথার ঠিক উপরে শুধু কম হোয়াটের টিমটিমে লাইট জ্বলছে। তাকে ফেলে রাখা হয়েছে একটা ময়লাযুক্ত মেঝেতে। প্রতিটা নিশ্বাসের সাথে উড়ছে ময়লাগুলো। মোহ মুখ থেকে আওয়াজ বের করতে থাকল। ছটফটিয়ে নিজের হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। ভয়ে অবশ হয়ে এলো শরীর। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো পানি। কতক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়েছে তার জানা নেই। আচ্ছা, ইথান কি তাকে ছাড়া কান্নাকাটি করছে? মা-বাবা কি জেনে গেছে সে নিখোঁজ? এই ভেবে আরো বিপাকে পড়ল মোহ। কপালের পাশে টনটনে ব্যথায় মনে পড়ল তার জ্ঞান হারানোর কথা। সে এখন উপলব্ধি করতে পারল ওই কালো বোরখা পরিহিত মহিলাটির চক্রান্ত। ওই কাগজের গন্ধ তার জ্ঞান হারাতে বাদ্ধ করেছে। বহু চেষ্টার পরেও যখন নিজের বাঁধন খোলা হলো না অশ্রু আপনাআপনি বেরিয়ে এলো মোহের। সে যে বাঁচতে চায়। মনে এক প্রশ্ন এলো। এই কি/ডন্যাপিং পূর্ব পরিকল্পিত? কেন এই পরিকল্পনা?

বাড়ি ফিরে এসে চিন্তিত তানিয়া নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই তার ফোন বেজে ওঠে। চকিতে তাকিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখল সেখানে লেখা ‘মি. জুনিয়র’। সৌমিত্রের কল দেখে কিছুটা অবাক হয়েই কল রিসিভ করল তানিয়া। কোনোপ্রকার হাই হ্যালো ব্যতীত সৌমিত্র সরাসরি বলে বসল,
“মিস. গোলাপি! সামান্য রুমাল সুন্দর করে ধুয়েও দিতে পারেন না? বাড়ির আদরের দুলালি নিশ্চয়? নাকি মেয়েদের মেকআপ আমার রুমালে মুছে নিয়েছেন।”

হঠাৎ এসব কথা শুনেই তানিয়ার কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ল। বলল,
“মানে কী?”

“মানেটা এই যে রুমালের একটা জায়গায় দাগ থেকে গিয়েছে।”

“সে কী! আমি যে এত সুন্দর করে ধুয়ে দিলাম। যাকগে, মানুষ মাত্রই ভুল। এখন কি আমাকে আবার রুমাল পরিষ্কার করে দিতে হবে?”

সৌমিত্র এক গাল হেসে দিয়ে বলে,
“তা অবশ্য না। আমার তো মনে হয় আমার রুমাল আপনার কাঁদা মাখা মুখ পছন্দ করেছে। তাই কাঁদার দাগ রেখে দিয়েছে।”

তানিয়া ভ্রু কুঁচকে মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“যত্তসব আজগুবি কথা!”

“আমার কথা এমনিতেও সকলের আজগুবি মনে হয়। পরে মিলে যায় কথাগুলো। ওইযে, বলে না? গরীবের কথা বাসী হলেও সত্যি হয়।”

এই কথাটা যেন তানিয়ার কানে পৌঁছায় না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে সে। মনে শুধু বান্ধবীর চিন্তা ঘুরঘুর করছে। অপরদিকে উত্তর না পেয়ে সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিলো।
“মিস গোলাপি! লাইনে আছেন? শুনতে পাচ্ছেন?”

তানিয়া হকচকিয়ে উঠে বলে,
“হুঁ, হুঁ। বলুন?”

“মনে হচ্ছে কারোর চিন্তায় গভীর মগ্ন ছিলেন?”

তানিয়া প্রথমে এড়িয়ে যেতে চায়।
“না তেমন কিছু না।”

“বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে বুঝি?”

তানিয়া এবার রাগে তেতে উঠে বলে,
“সবসময় প্রেমআলাপ ব্যতীত মাথায় অন্য কথা আসে না তাই না? আমি মোহের কথা চিন্তা করছিলাম। আচ্ছা, আপনার ভাই তো তার গ্রামের বাড়ির এড্রেস নিলো। তারপর কি সেখানে গিয়েছিল?”

সৌমিত্র অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে ওঠে,
“গিয়েছিল মানে? সেবাযত্ন থেকে শুরু করে লাঠির বাড়ি সব খেয়ে এসেছে। কিন্তু এ কথা কেন? কিছু হয়েছে নাকি?”

“মোহকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকালে নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল রাস্তায়। এক মহিলা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার নাম করে কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। আঙ্কেল আন্টি পাগল হয়ে যাচ্ছে! ওদিকে বাচ্চা ছেলে ইথানের কী অবস্থা কে জানে।”

সৌমিত্র হতভম্ব হলো। বিস্ময়ে মুখ থেকে কথা বের হলো না কিছু সময়। কিছুটা সময় পর জোরে বলে ওঠে,
“কী? এটা সত্যি? কালকেই দেখা হয়েছিল। আজকে সকালেই ওকে কে কিড/ন্যাপ করবে?”

তানিয়া একটু ইতস্তত বোধ করে বলল,
“জানি না। তবে আন্টি বারবার আপনার বাবার কথাই বলছিলেন। কারণ মোহের ঝামেলা একমাত্র উনার সাথে বোধহয়।”

সৌমিত্র আর কথা বলতে পারল না। বলার মতো কোনো অক্ষর পেল না। ফোন বিছানায় ফেলে ছুটল স্বচ্ছের ঘরে।

বদ্ধ ঘরে পড়ে থাকা মোহ নিজেকে শান্ত করল। চোখ বুজল। নিজের বাবা আজহার সাহেবের মুখটি ভেসে উঠল। তিনি একসময় মোহকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর কোনো বিপদই কঠিন নয়। বিপদ থেকে চাইলেই বেরিয়ে আসা যায় যদি সে ঠাণ্ডা মাথায় চেষ্টা করে। বিপদের সময় ভয় মানুষকে গ্রাস করে। এই ভয়টা যে কাটাতে পারবে, সে বিপদও কাটাতে পারবে।’

নিজের উত্তেজনা কমিয়ে আনে মোহ। নিজের মনে সাহসকে জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করে। তৎক্ষনাৎ কর্ণকুহরে ভেসে আসে ক্যাচক্যাচ আওয়াজ। ওমনি চোখ বন্ধ করে মোহ। কারোর হাঁটা চলা এবং তার উপস্থিতি উপলব্ধি করে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস আঁটকে নেয় সে। মনে আঁটে কঠিন পরিকল্পনা।

ইয়াকীন এসে মোহের সামনে বরাবর বসে। ভালো করে একবার পরখ করে নেয় বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে থাকা মেয়েটিকে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“এতক্ষণে তো জ্ঞান ফেরার কথা! কড়া কিছু তো দেওয়া হয়নি।”

মোহের মুখের কাপড় অনেকটা নেমে গেছে নিচে। সেটা খেয়াল করে ভালো করে বাঁধতে গেলেই ইয়াকীন খেয়াল করে মোহের গরম শ্বাস পড়ছে না। আঁতকে ওঠে সে। চোখ বড়ো বড়ো করে মোহের দিকে একবার তাকিয়ে ফের নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখতে গেলে একই অবস্থা দেখে মাথায় হাত পড়ে তার।
“এখনো সাহেব কী করবে এই মেয়েটারে সেটা বলেন নাই। কল উঠাইতেছেন না। এর মধ্যেই মেয়েটার উল্টাপাল্টা কিছু হয়ে যায় তাহলে…”

ইয়াকীন বিভ্রান্ত হয়ে পরে। পরক্ষণেই মনে হয় বিষয়টা ভালো করে চেক করে দেখা উচিত। তার জন্য হাতের পার্লস পরীক্ষা করতে হবে। মোহের হাত ধরতে গিয়ে ইয়াকীনের মোহের হাতের বাঁধন খোলার প্রয়োজন পড়ে। নিজের হাতের বাঁধন খোলা হচ্ছে জেনেই মোহ সুযোগ পেয়ে গেল। আগপাছ চিন্তা না করেই চোখ মেলেই ইয়াকীনের দিকে পা দিয়ে আক্র/মণ করে বসল। লা/থি দিয়ে ফেলল ইয়াকীনের প্রধান অঙ্গে সজোরে। ইয়াকীন য/ন্ত্রণায় চিৎকার দিতেই যেন ভুলে গেল। ছিটকে গিয়ে একপাশে পড়ে থেকে ব্যথায় ছটফট করতে আরম্ভ করে। সেই সুযোগে মোহ নিজের হাত দিয়ে তড়িঘড়ি করে নিজের পায়ের দড়ি খুলে ফেলে। দুর্বল শরীরে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে ব্যথায় কাতর ইয়াকীনের দিকে তাকায়। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ইয়াকীনের গলায় নিজের হাতে থাকা দড়ি দিয়ে ফাঁ/স দিয়ে ধরে এবং তার পিঠে এক পা তুলে দেয়। গলায় দ/ড়ির ফাঁ/সে অবস্থা বেগতিক হয় ইয়াকীনের। মোহ তীব্র ক্ষোভ ঢেলে শুধায়,
“আমাকে কিড/ন্যাপ করার কারণ কী? এটা কিসের পরিকল্পনা? কেউ আমাকে কিড/ন্যাপ করতে আদেশ করেছিল? নাকি অন্য উদ্দেশ্যে ধরে আনা হয়েছে?”

ইয়াকীন হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠার চেষ্টা করে হিসহিসিয়ে মোহকে বলে,
“ছাড় আমাকে।”

“ছাড়ব না। যদি আমাকে সত্যিটা বলা না হয় তবে আমি ছাড়ব না। তোকে ফাঁ/স দিয়ে মে/রে রেখে যাব।”

বলেই মোহ আরো শক্ত করে দ/ড়ি চেপে ধরে ইয়াকীনের গলায়। নিজেকে ছাড়াতে গিয়েও যখন ইয়াকীন ব্যর্থ হয়, দম বন্ধ হয় তখনি অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে,
“টাকা…টাকার জন্য এনেছি তোকে।”

মোহের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হয়না এ কথা।
“টাকা? টাকার জন্য যদি তুলতে হয় তবে তোরা বড়োলোকদের কিড/ন্যাপ করতি। আমাকে নয়। আর যদি কথা হয় খারাপ উদ্দেশ্যের তাহলে এতক্ষণে সেটা হাসিল করে ফেলা যেত যেহেতু আমি অবচেতন ছিলাম। তোদের উদ্দেশ্য অন্যকিছু। বলবি নাকি ম;রবি?”

ইয়াকীন ছটফটিয়ে বলে,
“মন্ত্রী সাহেব বলেছে তোকে তুলে আনতে। ছাড় এখন আমাকে বাঁচতে দে আমাকে। আমি ম/রে যাচ্ছি।”

মোহের সন্দেহ সত্যি হলো। চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইল ইয়াকীনের দিকে। তবে সে ছাড়ল না ইয়াকীনকে অন্য পা দিয়ে সজোরে আ/ঘাত করে ইয়াকীনের মাথায়। শক্ত মেঝেতে মাথা লেগে সেখানেই মাথা ফে/টে গিয়ে র;ক্ত ঝরে ইয়াকীনের। গলায় থাকা ফাঁ/সের চোটে জ্ঞান হারায় সে। মোহ তাকে ছাড়ে। দৌড়ে দরজার পানে ছুটে যায়। আবারও কিছু মনে করে ফিরে আসে। বিড়বিড়িয়ে নিজে নিজেকে বলে,
“এত বড়ো সুযোগ পেয়ে আমি হাতছাড়া করব না।”

লোকাল বাসে চেপে যাচ্ছে শৌভিক আর তার সঙ্গীটা। তার গাড়িটা বেশ পুরোনো হয়েছে। মাঝে মাঝেই নষ্ট হয়। অতিরিক্ত ভীড়ের চোটে একপ্রকার হিমশিম খাচ্ছে শৌভিক। এরই মাঝে তার চোখ এড়ায় না তার সামনে থাকা এক যুবক বারংবার তার পাশে থাকা সিটের মেয়ের পিঠে হাত দিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছাকৃত। মেয়েটি অস্বস্তিতে ভুগছে। সরে যাচ্ছে তবে জায়গা পাচ্ছে না। মুখে কিছু বলতেও পারছে না। হয়ত ভয়ে নয়ত লজ্জায়! এবার বাস ব্রেক কষলে ছেলেটি আবারও ইচ্ছেকৃতই মেয়েটার কাঁধ জোরে চেপে ধরলে শৌভিকের কান গরম হয়ে যায় মারা/ত্মক রাগে। ছেলেটিকে সামনে ফিরিয়ে নিজের হাতের পুরো শক্তি দিয়ে কষিয়ে থা;প্পড় বসায় সে। ব্যথায় যেন গাল জ্বলে যায় ছেলেটির। ঠোঁটের কোণ ফেটে বেরিয়ে আসে তাজা র/ক্ত। শৌভিক থামে না। ছেলেটির কলার ধরে বলে,
“জানো/য়ার শা/লা! কী পাইছিস ওই মেয়েটাকে? বাড়িতে বোনের সাথেও একই আচরণ করিস?”

সিটে থাকা মেয়েটি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। চলন্ত বাসে সৃষ্টি হয় ঝামেলা। মেয়েটি দাঁড়িয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে শৌভিককে বলে,
“লোকটা আমার সাথে তখন থেকে অশ্লী/লতা করার চেষ্টা করছিল ভাইয়া। লজ্জায় মুখ থেকে কথা বের হচ্ছিল না।”

শৌভিক তেতে উঠে বলে,
“কথা বের করতে কে বলেছে আপনাকে? আপনার পায়ে জুতো নেই? সেটা উঠিয়ে চালাতে শুরু করবেন। জুতো শুধু পায়ে দেওয়ার জন্য হয় না। মাঝে মাঝে শা/স্তি দিতেও ব্যবহৃত হয়।”

চলবে…