যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব-৪২+৪৩+৪৪

0
11

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪২

নিজের বাড়ির প্রধান দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ফারাহ। পাশে সযত্নে দাঁড়িয়ে থাকা শৌভিকের দিকে ইতস্তত হয়ে চাইল সে। শৌভিক দৃষ্টি নামিয়ে ছাতা ফারাহর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভেতর অবধি ছাতা নিয়ে যেতে পারেন। সমস্যা নেই।”

“তার কোনো প্রয়োজন হবে না।”

শৌভিক আরো কিছু বলতে উদ্যত হলো। সঙ্গে সঙ্গে দরজার ওপাশ দিয়ে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো তিনটা ছেলে। যাদের মধ্যে একজনকে শৌভিক চেনে। মাথায় ক্যাপ পড়া এবং কাটা ভ্রু দেখে শৌভিক নিশ্চিত হলো এটা সেই ছেলেই যাকে সে একদিক বাস থেকে নামিয়ে শায়েস্তা করেছিল। রাফিন তার বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়ার পথে ফারাহ এবং শৌভিকের সামনে পড়ল। নিজের বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল রাফিন। আচানক শৌভিকের সামনা-সামনি হওয়ায় তার মুহূর্তে মনে পড়ে সেদিনের দিনটা। ফারাহর পাশাপাশি দেখায় অতিরিক্ত রাগে থরথর করে কেঁপে ওঠে রাফিন। আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে ওঠে,
“তুই এখানে কোন সাহসে আসিস? তাও আবার মন্ত্রী সাহেবের মেয়ের সাথে? তোর তো সাহসের প্রশংসা করতে হয়! মন্ত্রীর মেয়েকে হাত করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চাস?”

শৌভিক একবার আঁড়চোখে ফারাহকে দেখে নিলো। মেয়েটি হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। শৌভিক মেয়ের সামনে ঝামেলা করতে চায় না। তাই সে ফারাহর হাতে নিজের ছাতা ধরিয়ে গম্ভীর সুরে বলে,
“আমি আসি তাহলে।”

শৌভিক যাওয়ার জন্য ফারাহর পাশ কাটায়। তৎক্ষনাৎ রাফিন ছাতা ছেড়ে দৌড়ে এসে হঠাৎ শৌভিকের এক গালে ঘু/ষি মে/রে বসে। আকস্মিক ঘটনায় শৌভিক কিছুটা দূরে ছিটকে যায়। রাফিন সাহস পায় নিজের দুজন বন্ধুর জন্য। আজ সে একা নয়। সে শাসিয়ে বলে,
“সেদিনই তোরে সাবধান করছিলাম। আজকে যখন তোরে নিজের বাগে পাইছি। ছাড়ব?”

রাফিনের দুই বন্ধু এগিয়ে আসে। ফারাহ স্তম্ভিত। নিজের গালে হাত বুলাতে গিয়ে রাফিন ধা/ক্কা দেয় শৌভিককে। বৃষ্টিভেজা সড়কে পড়ে যায় শৌভিক। হাতে ব্যথা পায়। ফারাহ ছাতা ফেলে ছুটে আসে আগপাছ না ভেবে। শৌভিক উঠে এবার রাফিনকে চেপে ধরতে চায়। কিন্তু রাফিনের দুই বন্ধু তা দেয় না। ফারাহ এগিয়ে এসেই রাফিনকে হাত দিয়ে ধা/ক্কা মে/রে সরিয়ে দিয়ে হাঁটু মুড়িয়ে বসে শৌভিকের নিটকে। রাফিনের দুই বন্ধুকে ধমক দিয়ে বলে,
“এই সরে যাও তোমরা। নয়ত সব কয়টার খবর করতে আমার মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে।”

দুটো ছেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সরে যায়। রাফিন তড়িঘড়ি করে বলে,
“ম্যাডাম আমি বুঝতে পারছেন না। এ আপনার সঙ্গে সম্পর্ক মধুর করতে চাইছে। ওরে চেনেন না আপনি। ভালে হয় এসব থেকে দূরে থাকেন। ওরে আমরা দেখে নিচ্ছি।”

ফারাহ উঠে যেন তেড়ে এলো রাফিনের দিকে। নিজের হাত উঠিয়ে বলল,
“এই ছেলে, এই! থা/প্পড় চিনো? এক চ/ড়ে সব দাঁতকপাটি ফেলে দেব। আমাকে দেখে কি ছোটো বাচ্চা মনে হয় তোমার? যে আমি কিছু বুঝি না? এমনি তোমাদের ঝামেলার জন্য আমার প্রিয় ডিজাইনিং ড্রেসটা নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছি। এখন যদি তোমরা আরো ঝামেলা করো তাহলে নিজের মুখের কথা সত্যিতে পরিণত করব।”

ফারাহর কথায় ভড়কালো সকলেই। কারণ সে কার মেয়ে সেটা সকলেরই জানা। ফারাহ পিছু ফিরে তাকাল। শৌভিক উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাত নাড়ানোর চেষ্টা করছে। ব্য/থায় কুঁকড়ে গেছে মুখ। চশমা রাস্তায় লুটোপুটি খাচ্ছে। ভিজে গিয়েছে শৌভিকের প্রশস্ত শরীর। চশমার আড়ালে রাখা ছোটো চোখ দুটো দৃশ্যমান হতেই ফারাহর মনে হলো লোকটাকে আলাদা লাগছে এখন। খেয়াল করল ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্ত। যাতে একটু একটু করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ফারাহ দূরন্ত পায়ে ছুটে শৌভিকের সংলগ্নে দাঁড়াল। অনুশোচনা বোধে তাড়াহুড়ো করে নিজের ভেজা ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে শৌভিকের ঠোঁট মুছে দিয়ে মিনমিন করে বলে,
“আই এম সরি। আমার জন্য সত্যিই আপনাকে ক/ষ্ট পেতে হলো। বাবা পি/স্তল না ধরলেও তার সেক্রেটারির ছেলে…”

“তেমন কিছুই না। আপনার বাবার ওই সেক্রেটারির ছেলের সাথে আমার পুরোনো একটা শত্রুতা আছে। তার এই কাণ্ড ওই শত্রুতার জন্যই। আমিও দুঃখিত। আমার জন্য আপনার ডিজাইনার ড্রেস খারাপ হয়ে গেল।”

“উচ্ছন্নে যাক ড্রেস। আপনার ব্লি;ডিং হচ্ছে। আমার বাড়ি চলুন না হয়। আমি ফার্স্ট এইড করে দেব!”

শৌভিক হেসে উঠতে চাইল। কিন্তু ঠোঁট প্রসারিত করতে গিয়েই পেল ব্য;থা। তবুও হাসি মুখ করে বলল,
“আ/হত তো হয়েই গিয়েছি। নি/হত করতে চান? আপনার বাড়ির দরজার সামনেই আমার যা অবস্থা! বাড়িতে গেলে আমার ডে/ড বডি খুঁজে পাওয়া যাবে তো?”

কথা বলতে বলতে শৌভিকের ঠোঁটের কোণ দিয়ে আরো র/ক্তের দেখা পাওয়া গেল। ফারাহ সরল মনে এগিয়ে দিলো নিজের রুমাল।
“র:ক্ত পড়ছে মুছে নিন।”

শৌভিক হাত বাড়াতে গেলেই তার হাতে অসম্ভব যন্ত্র/ণা করল। বলল,
“বৃষ্টির পানিতে এমনিতেও ধুয়ে যাবে।”

ফারাহ সন্তুষ্ট হলো না। নিজেই রুমাল নিয়ে পায়ের গোড়ালি উঁচু করে উদ্যত হয়ে একহাতে আলতো করে শৌভিকের ভিজে দাড়ি স্পর্শ করল। অন্যহাতে সযত্নে মুছে দিলো র;ক্তখানি। শৌভিক বুঝল না এতে লাভ কী পেল মেয়েটি! বৃষ্টিতে এমনিতেই সব ধুয়ে যাচ্ছে। তবে প্রথম অচেনা মেয়ের এই স্পর্শ তার হৃদস্পন্দনের গতি বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। কেমন যেন করে কাঁপতে থাকল তার কণ্ঠস্বর। নিজের এই দুর্বলতা আড়াল করতে সে বলল,
“আমি আসি। বাড়ি গিয়ে নিজের ফার্স্ট এইড করে নেব। আমিও বাড়ি যান। মন্ত্রীর তুলতুলে মেয়ে। ঠাণ্ডা লেগে যাবে আবার।”

শৌভিক ঝুঁকে নিজের চশমা তুলে নিলো। দ্রুত পায়ে চলল মেইন রাস্তার দিকে। ফারাহ ভেতরে গেল না। তাকিয়ে রইল সেই ভিজতে ভিজতে হেঁটে যাওয়া সেই অমায়িক পুরুষটির দিকে।

সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে মোহ। বাহিরে প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়েছে। বাহিরে মাঝে মধ্যে বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা গেলেও তার বাড়িতে একেবারেই নিস্তব্ধতা। মিসেস সুফিয়া রেগেমেগে চোখমুখ লাল করে ফেলেছেন। নীরবতা ভেঙে তিনি কিছু বলতে গেলে হাতের ইশারায় উনাকে থামিয়ে আজহার সাহেব বলেন,
“আমার মেয়ের সাথে আমি কথা বলব।”

মিসেস সুফিয়া চুপ রইলেন। আজহার সাহেব মাথা নুইয়ে রাখা মেয়ের দিকে তাকান। বোঝায় যাচ্ছে সে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে এত মানুষের সামনে। তবুও তিনি শুধালেন,
“তোমার মামী যা বলছে তা সত্যি? তুমি মন্ত্রী সাহেবের ছেলের সাথে দেখা করতে বাহিরে বেরিয়েছিলে?”

“জি, বাবা। কিন্তু তার কিছু কারণ…”

মোহকে পুরো কথা বলতেই দেওয়া হলো না। মিসেস আফিয়া বলে ওঠেন,
“দেখেছেন আপনারা? আমি বলেছিলাম। আজহার ভাই, আমি এখনো বলছি আপনি নিজের মেয়েকে সামলান। এমনিতে কিন্তু কম অঘটন ঘটায় নি আপনার মেয়ে। যার একটার ফল ইথান।”

ইথানের প্রসঙ্গ আসতেই যেন আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠল মোহ৷ না চাইতেও রূঢ় কণ্ঠে বলে ফেলল,
“মামী! কথাটা আমাকে নিয়ে হচ্ছিল। ইথানের প্রসঙ্গ তুলবেন না। আমি ইথানকে নিয়ে কোনো অভিযোগ সহ্য করব না।”

আফিয়া এবার হতাশ কণ্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ, তুমি দোষ করবে আর কেউ বললেই সমস্যা! সবার প্রশ্রয় পেয়েই এমন হয়েছ তুমি।”

আজহার সাহেব এবার আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,
“আমি আমার মেয়ের সাথে একা কথা বলব। মোহ, আমার ঘরে এসো।”

আজহার সাহেব উঠে গেলেন ঘরের দিকে। মোহও গেল পিছু পিছু। তার বাবা ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসলেন আস্তে করে। মোহ গুটি গুটি পায়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল একমনে। আজহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলতে চাইছিলে তুমি। বলো এখন। এখানে কেউ বাঁধা দেবে না তোমায়।”

মোহ কৃতজ্ঞতার সাথে বলল,
“আমাকে বিশ্বাস করার জন্য ধন্যবাদ বাবা।”

“আমি তোমাকে ভালো করে চিনি মোহ। তোমার সকল পদক্ষেপের কোনো না কোনো কারণ থাকে। জানি আমি। বলো আমায়।”

মোহ স্বচ্ছের পুরো ব্যাপারটা বলে দিলো ধীরে ধীরে। সবটা শুনে ভাবুক হয়ে উঠলেন আজহার সাহেব।মোহ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আজহার সাহেব ভার কণ্ঠে বলেন,
“ছেলেটা উদ্দেশ্য খারাপ নয়। ও প্রথম থেকেই সবসময় ওর বাবার কাজের জন্য লজ্জিত হয়েছে। এখন আমাদের জন্য ও নিজে কষ্ট পাচ্ছে। এটা যেমন ওর জন্যও ঠিক নয়। তোমার জন্যও ঠিক নয়। এমনিতেই মন্ত্রী সাহেবের রাগ তোমার উপর উপচে পড়ছে। এখন যদি তোমার জন্য উনার ছেলে উনার সাথে ঝামেলা করে থাকে তবে সেই রাগটাও যদি তোমার উপরই ঝাড়তে চান। তাহলে কী হবে বুঝতে পারছ?”

মোহ চুপ করে রইল। একধ্যানে তার নজর বাহিরের দিকে। একটা সময় তার মনে হলো বাহিরে কিছুটা দূরে সরু রাস্তার ওপাশে এই তীব্র বর্ষণে নিজেকে ইচ্ছেমতো সিক্ত করছে। মোহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা যখন মানুষটিকে চেনার চেষ্টা করল তখনি তার গায়ের লোম শিউরে উঠল। কারণ মানুষটি স্বচ্ছ। তার অবচেতন, উদাসীন মন ব্যকুলতায় ছেয়ে গেল। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“বাবা, বাবা! স্বচ্ছ এখনো যায়নি। রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজছেন। উনার গায়ে জ্বর। আমার একটা অনুরোধ…”

আজহার সাহেব মেয়ের মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই বললেন,
“সে অসুস্থ হলে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারো।”

এই অনুমতির যেন অধীর আগ্রহে ছিল মোহ। তার বাবার মুখের কথা শেষ হতেই সে যেন বিদ্যুতের বেগে ছুটল বাহিরের দিকে। তার গোল গোল দুটো চোখের অস্থিরতা ধরা দিলো আজহার সাহেবের চোখে। কারোর প্রতি মেয়ের এত উচাটন কখনো দেখেন নি তিনি। তবে কি মেয়ের মনের অজান্তে সৃষ্টি হলো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি? যা বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব?

রাস্তার একপাশে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ। তার এলোমেলো জীবন উপলব্ধি করছে সে। বৃষ্টির একেকটা ফোঁটায় নিজের সময়ের সাথে আউলিয়ে যাওয়া জীবনটা নিয়ে ভাবছে সে। মনে করছে, আগে তো তার জীবন এমন ছিল না! আড্ডা, ঘোরাঘুরি, লেট নাইট পার্টি, ঘুম এসব মিলিয়েই কেটে গিয়েছিল দিন। হঠাৎ কী হলো? এত পরিবর্তন কী করে হলো তার? নিজেকে প্রশ্ন করতেই উত্তরটা সে নিজেই পেল। এর পেছনে এক নারীর অবদান রয়েছে। এমনই তো বর্ষণ ছিল সেদিনও। যেদিন মোহ আনবীর নামক এক রমণী এসে তার সবকিছু উলোটপালোট করে দিয়ে গেছে!

এত ভাবনার মাঝে একসময় স্বচ্ছের অনুভূত হয় তার গায়ে আর বৃষ্টি পড়ছে না। নিজের দুর্বল চোখ দুটি খুলতেই সে তার সামনে তার দুনিয়া উলোটপালোট করে দেওয়া নারীটিকে খুঁজে পায়। ছাতা ধরে কপাল কুঞ্চিত করে বিচলিত নয়নে তাকিয়ে রমনী। সে ভাবে হয়ত এই মোহ তার নিছকই কল্পনা। কিন্তু মোহ যখন কড়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“এভাবে বৃষ্টিতে কেন ভিজছেন?”

স্বচ্ছ নড়েচড়ে উঠল। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকানোর চেষ্টা করল। অস্ফুটস্বরে বলল,
“এমনিই। ইচ্ছে করল হঠাৎ!”

“ভালোবাসেন আমায়?”

মোহের আচমকা এক প্রশ্নে স্বচ্ছের ভেতরের প্রতিটা স্নায়ু সজাগ হয় যেন। দুর্বল নেত্রপল্লবে ভেসে ওঠে তার অব্যক্ত অনুভূতি। কান গরম হয়ে আসে। অনুভূতি ব্যক্ত করে সে কি নিজের জয় পাবে? প্রণয়ের জয়?

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৩

অনেক সময় ধরে প্রতীক্ষায় থাকা মোহকে ভীষণ উতলা দেখাচ্ছে। অকৃত্রিম চোখজোড়ার পলক পড়ছে না। স্বচ্ছ বলল,
“যদি বলি ভালোবাসি না তাহলে?”

মোহ সহাস্যে বলল,
“তাহলে আপনি মিথ্যে বলছেন।”

“আর যদি বলি ভালোবাসি?”

“তাহলে বলব ভালোবাসবেন না আর।”

পানিতে ভিজতে ভিজতে লাল হয়ে থাকা স্বচ্ছের চোখ তখন বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হলো। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“কেন?”

“কারণ এই ভালোবাসা আপনার জন্য বিষ হয়ে দাঁড়াবে। দূরে যান এই ভালোবাসা থেকে যা আপনার জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই ভালোবাসার জন্য আপনাকে মুহূর্তে মুহূর্তে কটাক্ষ হতে হবে। সময়ে সময়ে লোকে আপনার দিকে তীর ছুঁড়বে। আপনি সহ্য করতে পারবেন না সেটা।”

স্বচ্ছ নীরবে চেয়ে রইল। মোহের অদ্ভুত প্রত্যাখ্যানের কারণ বোধগম্য হলো না যেন। তীব্র এক যাতনা ছেঁয়ে গেল হৃদয়ে। মোহ স্বচ্ছের প্রতিত্তোর না পাওয়ায় বলল,
“বৃষ্টিতে এভাবে ভিজবেন না। বাবা আপনাকে বাড়ির ভেতরে যেতে বলল।”

মোহ বাড়ির ভেতরে যেতে উদ্যত হলো। স্বচ্ছ আচানক ডেকে প্রশ্ন করল,
“এসব কথা কি তুমি ইথানের জন্য বললে?”

মোহ থমকায় এমন প্রশ্নে। তার মৌনতায় স্বচ্ছ বলে,
“এই ভালোবাসা যদি আমার জন্য বিষ হয় তবে আমি সেই বিষপান আমার জন্য শ্রেষ্ঠ পান হবে। আর আমার নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বরাবরই আগ্রহ বেশি। একারণেই হয়ত যারা আমার জন্য উম্মুক্ত তাদের প্রতি কখনো ভালোবাসা আসেনি। আমাকে যদি মুহূর্তে মুহূর্তে কটাক্ষ হতে হয় তবে কটাক্ষপাতই আমার সুখ। যারা তীর ছুঁড়বে তাদের তীর আমি তাদের দিকে ফিরিয়ে দিতে জানি। সর্বশেষে আমি আমার সামনে থাকা নারীকেই চাই।”

মোহ স্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। এরপর নিচু সুরে বলল,
“আপনার পরিবার মানবে না। আপনার বাবা মানবে না। কলহ বাড়বে।”

“বাবা? জানো, একসময় বাবাকে কতটা সম্মান করেছি। আজ আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। এই পরিবর্তন অবশ্য উনার জন্যই হয়েছে। আগের মতো বাবা ভক্ত থাকলে হয়ত বাবাকে যেভাবেই হোক রাজি করাতাম। এখন তার প্রয়োজনবোধ করি না। আর কথাটা যদি আমার পরিবারের বাকি সদস্যকে নিয়ে হয় তবে বলব তারা আমাকে খুশি দেখতে চায়। সেই খুশিটার যার মাধ্যমে আসুক তারা সেটা মানতে আপত্তি করবে না।”

“আমরা সবসময় যেটাকে সহজ করে দেখি সেটা কি আদেও অনেক সহজ? আমি কখনো চাইনি আমাকে দেওয়া আপনার বাবার অপবাদ সত্য হোক। যদি সত্যি হয় তবে আমার পরিবারকে উনি ছাড় দেবেন না। আপনার জন্য উনি থেমে থাকবেন না। আমার আগে ভয় হতো না। এখন ভয় হয়। উনি লোক দিয়ে আজ আমাকে অপ/হরণ করিয়েছেন। কাল আমার পরিবার, আমার ইথানকেও ছাড়বেন না। সকলের নিরাপত্তার প্রশ্ন এখানে। জেদ করবেন না।”

স্বচ্ছ এবার বাক্যহীন রইল। তবে তার ঘোলাটে লোচন দুটিতে সুবিশাল অনুরাগ। মোহ তার ভাবাবেগ বুঝল। ভাঙা স্বরে বলল,
“বাড়িতে চলুন। ঠাণ্ডা লাগবে।”

মোহ ফের বাড়ির দিকে উদ্যত হয়। এবার আচমকা সে অনুভূত করে তার হাতকে আঁকড়ে ধরেছে কোনো শীতল বাঁধন। তীব্র টান অনুভব করে সে। সেই টানে ছিটকে আসে স্বচ্ছের একবারে সংলগ্নে। স্বচ্ছের ভিজে শার্ট লেগে ভিজে যায় মোহের ওড়নাখানি। মোহের নিঃশ্বাস প্রগাঢ় হয়। স্বচ্ছ ভীষণ ব্যগ্র হয়ে শুধাল,
“কোনো জেদ করব না। সব মেনে নেব। শুধু জানতে চাই, তুমিও কি তবে অনুভব করো আমায় আমার অনুপস্থিতিতে? প্রণয় জন্মেছে কি ভুল করে হলেও? এটা জানতে চাওয়াও কি অপরাধ?”

“একটা নারী যে কিনা ভীষণ কঠোর। কঠিন তার মন। সেই কঠিন মন থেকে যখন নম্রতা বেরিয়ে আসে। দুটো পুরুষের সামনে যখন তার নমনীয়তা প্রকাশ পায়।”

“কোন দুটো পুরুষ?”

“প্রথমজন সেই নারীটির বাবা। আর দ্বিতীয়জন…”

মোহ থামল কথার মাঝ পথে। স্বচ্ছের চেহারায় দেখা গেল ভীষণ আকুলতা। সে জানতে উৎসুক। তবে মোহ পুরোটা বলল না। স্বচ্ছ অস্থির হয়ে জানতে চাইল,
“আরেক জন কে বলো?”

মোহ মৃদু হাসল।
“সেটা আপনি খুঁজে বের করুন। আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেই নিজের উত্তরটাও পেয়ে যাবেন।”

মোহ আর ছাতা ধরে দাঁড়াল না। ধীর পায়ে ঢুকে গেল রাস্তার ওপাশ দিয়ে বাড়িতে। স্বচ্ছ থমথমে হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। মোহ যে চলে গেছে সেটা বেশ কিছুক্ষণ পর উপলব্ধি করতে পারল। সে চিল্লিয়ে বলল,
“এই মেয়ে উত্তরটা বলে যাও।”

স্বচ্ছের আর ঘরে ঢোকা হলো না। সংকোচবোধ নিয়ে আর মোহের বাড়ি যাবে না সে। এতে মোহের সমস্যাও হতে পারে। সে ফিরল বিপরীত পথের দিকে। আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল। মোহের বলা কথাগুলো এখনো তার কানে বাজছে এবং হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করছে।
নিজ ঘরের জানালা দিয়ে কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইল মোহ। ভেবেছিল স্বচ্ছ আসবে। তবে এলো না। আসলেই সে ভীষণ জেদি। কারোর কথা শোনার নয়। হঠাৎ বাবার গম্ভীর কণ্ঠে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মোহ। আজহার সাহেব প্রশ্ন করলেন,
“স্বচ্ছ এলো না?”

“না, বাবা।”

“ছেলেটাকে বোঝাতে চাইলাম নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। আমাদের জন্য শুধু শুধু ঝামেলা করছে।”

মোহ হতাশ হয়ে বলে,
“আমি কম চেষ্টা করিনি বাবা। তিনি বুঝতেই চান না।”

আজহার সাহেব আর কোনো কথা বললেন না। কিছু সময় নীরব থেকে প্রস্থান করলেন।

পরদিন সকাল হলো। সবসময় ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা সৌমিত্র আজ ৬ টা বাজে উঠে গেছে। তখন থেকে কেমন উতলা হয়ে পায়চারি করছে সারা ঘর। নয়টায় ঘুম ভেঙেছিল রিহানের। সকাল সকাল তানিয়াদের বাড়ি যাওয়ার কথা তার। বিয়ের কথাবার্তা নতুন করে পাকা করতে হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে হয়ত আজই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে আসবে। নয়টায় উঠে রিহান প্রথমে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো। বিছানায় বসে বসে রিহানের কাণ্ড দেখছিল সৌমিত্র। রিহান সৌমিত্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“এমনিতে আমি কেমন দেখতে রে সৌমিত্র? ভালোই তো তাই না বল? একদম ফিট শরীর না? বিয়ের পাত্র হিসেবে কেমন?”

সৌমিত্র মুখ বাঁকিয়ে, খিঁচে বলল,
“খুবই জঘন্য এই মুহূর্তে।”

রিহান চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল। অসহায় হয়ে জানতে চাইল,
“কী বলিস?”

“তোমার ভুঁড়ি দিন দিন বাড়ছে রিহান ভাই। চিকনি চামেলি পাত্রীর পাশে মানাবে না।”

রিহান মুখ ভার করে আয়নায় নিজের দেখল। ঠিকঠাকই তো লাগছে। খারাপ তো লাগে না। সৌমিত্র ফের বলল,
“তোমার ওই চিকনি চামেলি পাত্রী ছেড়ে একটু তোমার মতোই ফিটফাট পাত্রী খোঁজা উচিত। ওকে বাদ দাও।”

রিহান তাড়াতাড়ি করে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“আরে কী বলিস? পাত্রী দেখেছিস তুই? এক দেখাতে পছন্দ হবে। আমার মা তো বর্তমানে তাকে ছাড়া কিছু ভাবছে না।”

সৌমিত্র যেন ব্যর্থ হলো। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“তাহলে তো সব শেষ, সোনার বাংলাদেশ!”

রিহান এবার টাওয়াল হাতে নিয়ে ঢুকল ওয়াশরুমে। অনেকক্ষণ বসে থেকে থেকে সৌমিত্র ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কান পেতে দিলো ওয়াশরুমের দরজায়। বিয়ের খুশিতে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে গোসল সারছে রিহান। সৌমিত্র কিছু একটা ভেবে আস্তে করে ওয়াশরুমের দরজা লক করে দিলো। নিজে নিজে বলল,
“সরি রিহান ভাই! এই লক খুলবে না।”

শাওয়ার শেষে ওয়াশরুমের দরজার লক খুলতে গিয়ে তাজ্জব হলো রিহান। দরজা আর খোলে না। অনেকক্ষণ টানাটানির পরেও যখন কোনো লাভ হলো না তখন সে চিৎকার দিয়ে ডাকল সৌমিত্রকে।
“এই সৌমিত্র! ঘরে আছিস? দেখ ওয়াশরুমের দরজার লক খুলছে না।”

সৌমিত্র ওপরপাশেই দাঁড়িয়ে। রিহানের কণ্ঠস্বর শুনে সে বলল,
“কী বলো?”

“হ্যাঁ। তুই একটু দেখ তো ওপরপাশে লক হলো কিনা!”

সৌমিত্র লক না খুলেই দরজা টানাটানির ভান করে বলল,
“না তো। লক তো করা নেই।”

“এখন কী হবে? খুলছে না তো।”

“আচ্ছা তুমি ওয়েট করো। আমি কাউকে ডেকে নিয়ে আসি।”

রিহান চিন্তিত হয়ে বলল,
“তাড়াতাড়ি কর ভাই। বিয়ের কথা বলতে যেতে হবে তো। আমার বিয়ের কী হবে?”

সৌমিত্র কোনো কথা না বলে নিজের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরটাও লক করে দিলো। বলল,
“বিয়ে হবে স্বপ্নে স্বপ্নে!”

রৌদ্রজ্জ্বল দিন। স্বচ্ছ নিজের এক বন্ধুর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। সামনে পড়েছে এক বড়ো স্কুল। জ্বরের মধ্যে রিকশায় আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না তার। বৃষ্টিতে ভেজার পর থেকে জ্বর আরো বেড়েছে। মাথাব্যথায় সব অসহ্য লাগছে। স্কুলের সামনে থাকা বড়ো গেট দিয়ে বাচ্চাদের খেলাধুলা দেখছে স্বচ্ছ। তাদের খেলাধুলা দেখে যেন ছোটোবেলায় ফিরে যাওয়া যায়। সুন্দর, সোনালী অতীত যেন ভীষণ আকর্ষণীয় ছিল। এসবের মাঝে স্কুলের মেইন গেইট দিয়ে মোহকে দেখল। স্বচ্ছ ভাবল তার চোখের ভুল। কিন্তু পরক্ষণেই যেন তার ভুলটাই সত্যি হলো। নীল, সাদার সংমিশ্রণে এক পোশাকে মোহ। মাথার কাপড়টুকু পড়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে তার কোঁকড়া চুলের বেণীর প্রতিটা ভাঁজ। স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ নামতে চাইল রিকশা থেকে। কিন্তু দমে গেল শৌভিককে দেখে। একটু সময় পরেই ইথানকে কোলে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো শৌভিক। মোহ শৌভিককে দেখে বিনয়ী হাসে। অন্য সময় মোহের হাসি স্বচ্ছের সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে দিলেও আজ সেই হাসি যেন হৃদয় থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক অবধি দহনের সৃষ্টি করল। কারণ হয়ত মোহের পাশে থাকা শৌভিককে সে দুচোখেই দেখতে পারে না। সেই অসহ্যকর মানুষকে কেন মোহের পাশে থাকতে হবে তার কারণ খুঁজে পেল না সে। শৌভিক হেসে হেসে কথা বলছে মোহের সাথে। আবার ইথানের গাল আলতো করে টেনে দিচ্ছে। স্বচ্ছ তেতে রিকশাওয়ালাকে বলল,
“এই মামা! কতক্ষণ এখানে দাঁড়াবেন? যাবেন নাকি নেমে যাব?”

“আরে সামনে এতগুলা গাড়ির মধ্যে কেমনে যামু? ওদিক তো যাওন যাইব না।”

“তাহলে ইউটার্ন নিন। যেতে হবে না ওদিকে।”

রিকশাওয়ালা কিছু না বুঝে বলল,
“কিন্তু আপনে তো ওদিকে যাইতে…”

“এখন আর যাব না বলছি না? আর এক সেকেন্ড এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে ম/রে যাব আমি নয়ত মে/রে ফেলব।”

রিকশাওয়ালা দ্রুত গাড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করলেন। আপনমনে নিচু গলায় বললেন,
“এ কোন পাগলরে উঠাইলাম!”

শৌভিক অমায়িক হেসে তার কোলে থাকা ইথানের গালে হাত দিয়ে শুধাল,
“স্কুলে যাবে তুমি?”

ইথান মাথা চুলতে বলল,
“হ্যাঁ। মাম্মাম বলেছে বড়ো হতে গেলে পড়াশোনা করতে হয়। আর স্কুলে অনেক বন্ধু পাওয়া যায়।”

“হ্যাঁ ঠিকই বলেছে। জীবন সুন্দর করতে শিক্ষার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া স্কুলে অনেক মজা করতে পারবে।”

ইথান খুশি হয় আনন্দ করার কথা শুনে। তারপর শৌভিকের মুখের দিকে তাকিয়ে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করে কী যেন! তারপর আধো আধো করে বলে,
“আচ্ছা তুমি কে? তোমাকে তো আগে দেখিনি। তুমি কি মাম্মার বয়ফ্রেন্ড?”

শৌভিক চমকালেও উচ্চস্বরে হেসে দিলো। মোহ বিষম খেয়ে দ্রুত ইথানের মুখে লাগাম দিতে মৃদু ধমকিয়ে বলল,
“ইথান! এসব বলে না। চুপ করো!”

শৌভিক ইথানকে নামিয়ে দিলো। ইথান নামতে পেরে আশেপাশে তাকাল। কিছুটা দূরে তার সমবয়সী বাচ্চারা খেলছে। সে অভিভূত হলো এবং দেরি না করেই ছুট লাগাল। মোহ আঁতকে উঠে ইথানকে ধরতে গিয়ে থেমে গেল বাচ্চাদের সাথে মিশতে দেখে। পাড়ায় সে বাচ্চাদের সঙ্গে ইথানকে খেলতে দেয়না। কেননা, সেসব বাচ্চাদের অভিভাবক ইথানকে নানান কথা বলে অপমান করে। আজ বাচ্চাদের সাথে সাথ দিতে পেরে ইথানের হাসিটা দেখে মোহও পুলকিত হয়। ইথানকে আটকায় না। শৌভিক বলে,
“তাহলে দেখা হচ্ছে।”

মোহ বাধ্য মতো বলে,
“জি।”

“আমি আসি তাহলে। আমার কিছু কাজ আছে।”

মোহ সম্মতি দিতেই শৌভিক বিদায় জানিয়ে চলে যায়। মোহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইথানের চাঞ্চল্য উপভোগ করে। মিনিট বিশেক ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল মোহ। অতঃপর ইথানকে নিয়ে বের হলো সে গেটের বাহিরে। একটি অটো ধরতে যাবে তৎক্ষনাৎ তার আকস্মিকভাবে একটি কালো বোরখা পরিহিত মহিলার সঙ্গে ধা;ক্কা লেগে যায়। মোহ এবং ইথান দুজনেই দুজন থেকে আলাদা হয়ে দূরে ছিটকে যায় কিছুটা। মোহ ক্ষেপে যায় মহিলার এমন আচরণে। তড়িঘড়ি করে ইথানের হাত চেপে ধরে মহিলাটিকে কড়া কণ্ঠে বলে ওঠে,
“চোখে কি দেখতে পান না নাকি? আপনার তাড়া আছে বলে এভাবে ধা;ক্কা দিয়ে যাবেন? যদি আমার ছেলে রাস্তায় গাড়ির সামনে গিয়ে পড়ত?”

মোহের কঠিন সুর। তবে সেই মহিলাটি রইল জবাব বিহীন। মোহের বিরক্তি লাগল এবার। মহিলাটি রইল নিস্তব্ধ। কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বের হওয়া বন্ধ হয়েছে তার। তবুও যেন নিজের উপর জোর খাটিয়েই উচ্চারণ করল,
“মোহ!”

মোহ নিজের নামটি শুনে যেন হতবিহ্বল হলো। তার চেয়েও বেশি থমকালো মহিলাটির কণ্ঠস্বরে। চোখে এসে গেল রাজ্যের বিস্ময়। সেই মুহূর্তেই মহিলাটি নিজের মুখের নিকাব টেনে উপরে তুলে ফেলল। মোহের মাথা ভনভন করে উঠল। এ যেন কাল্পনিক! এ যেন ভ্রম! এ যেন স্বপ্ন! ছোট্ট করে মহিলাটির নাম ধরে ডাকতে সক্ষম হলো মোহ।
“ঈশানী!”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৪

ঈশানী মোহকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলো। কেটে গিয়েছে কত গুলো বছর। কীভাবে বদলে গেছে জীবন! সেসব ভেবে ঈশানীর কান্নার বেগ বাড়ল। মোহ তখন হতবিহ্বল হয়ে শুধু মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। তার বিস্ময় কাটতে চাইছে না। এতদিন পর নিজের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী যাকে জীবিত দেখার কথাই নয় তাকে সরাসরি দেখতে পারছে সে। অনুভব করতে পারছে তার স্পর্শ। মোহের মনে তখন রাজ্যের কৌতূহল। সে ঈশানীকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে রেখে অবাক হয়ে শুধাল,
“এতগুলো বছর কেটে গেছে ঈশানী! তুই জীবিত আছিস? কখনো ভাবিনি। তুই যোগাযোগ করলি না কেন কারোর সাথে? না আমার সাথে, না তোর মামা-মামীর সাথে। কেন এমনটা করলি?”

ঈশানী কাঁদতে কাঁদতে মাথা নুইয়ে বলল,
“তোকে কী করে বোঝাব? কোন মুখে বলব? সবই আমার বাধ্যবাধকতা ছিল। আমাকে মিথ্যে বলা হয়েছিল। এতদিন মিথ্যার রাজ্যে বসবাস করে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু মেনে নিয়েছিলাম।”

মোহ ভ্রু কুঁচকায়। টলমল চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,
“তোর কথার অর্থ বুঝিনি।”

ঈশানী চোখ বুঁজে নিজের সকল লজ্জা এড়িয়ে বলল,
“আমার ভালোবাসা আমাকে প;তিতা বানিয়ে ছেড়েছে। পুরো আড়াই লাখ টাকাই নিষি’দ্ধপ/ল্লীতে ব্রিকি করা হয়েছে আমায়। এই পাঁচটা বছরে কতগুলো পুরুষ আমাকে ছুঁয়েছে তার হিসাব আমার কাছে নেই। আমি অপবিত্র। আমার স্থান ডাস্টবিনে। কিন্তু আমি পালিয়েছি। শুধু একটাই উদ্দেশ্যে পালিয়েছি সেটা হচ্ছে আরিদ্রকে খু/ন করতে চাই আমি। আজ নতুন সব মেয়েদের অন্য জায়গায় পাঠানো হচ্ছিল তার মাঝে আমি ঢুকে পড়েছিলাম। তারা জানতে পেরে গেছিল। ততক্ষণে আমি পল্লীর বাহিরে। সবটা দিয়ে ছুট লাগিয়ে আসতে তোর সাথে দেখা হবে ভাবিনি৷”

“ওই জা/নোয়ার তোকে ওই জায়গায় বিক্রি করে দিলো আর তুই মেনে নিলি? একবার তো খবর দিতে পারতিস। কিছু না কিছু করতাম। আমি তোর খোঁজ করেছি কত জানিস?”

ঈশানী নিজের বুকের একপাশে হাত রেখে শুষ্ক এবং কাঁপা ঠোঁটজোড়া দিয়ে বলল,
‘আমার সন্তানের জন্য আমি চুপ করে ছিলাম বিশ্বাস কর। আরিদ্রকে আমি দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বাস করি এই ভেবে আমার বাচ্চা তারও বাচ্চা। সে বলেছে আমি নিজের করুণ সেই দশা মেনে নিলে সে আমাদের বাচ্চাকে সুন্দর করে বড়ো করে তুলবে। কিন্তু কয়দিন আগে জানলাম আমার বাবু নেই তার কাছে। সেদিন সে হসপিটালে খোঁজ নিতে যায়নি। বাবুর বেঁচে আছে নাকি নেই সেটার খোঁজও সে রাখেনি। আমার বাবু আর বেঁচে নেই। ও মে/রে ফেলেছে।”

ঈশানীর বুক কাঁপল নিজের সন্তান নিয়ে এ কথা বলতে। ফের শব্দ করে কাঁদল সে। মোহ একবার ইথানের গোল চেহারার দিকে চাইল। ইথানের চোখেমুখে বিস্ময়। হয়ত ঈশানীকে চেনার চেষ্টা করছে। তার বড়ো বড়ো চোখ দিয়ে একনজরে ঈশানীকে দেখে যাচ্ছে সে৷ মোহ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে ঈশানীর দুটো হাত চেপে ধরল শক্ত করে। ঈশানী তার চোখের দিকে চাইল কান্না থামিয়ে। মোহ থেমে থেমে বলল,
“তোর বাবু আছে। ভালো আছে, সুস্থ্য আছে।”

ঈশানীর অশ্রু ভরা নয়ন দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল যেন। থরথর করে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। ঘনঘন শ্বাস ফেলে উত্তেজিত হয়ে বলল,
“তুই জানিস তার খবর?”

উত্তরে মোহ মুখে কিছুই বলল না। শুধু নিজের দুচোখের ইশারা দ্বারা ইথানের দিকে তাকাল। এতকিছুর মাঝে ঈশানী খেয়াল করেনি তার সংলগ্নে থাকা ইথানকে। ঈশানী নির্বিকার হয়ে অপলকে দেখল ইথানকে। ঘন চোখের পাপড়ি দ্বারা আবৃত তার ছোটো ছোটো দুচোখ, জোড়া ভ্রু, নাক এবং মুখের ধরণ যেন একেবারেই আরিদ্রের মতো। রাস্তার মাঝে ধপ করে বসে পড়ল ঈশানী। নেত্রযুগল থেকে বেয়ে বেয়ে পানি পড়ে বোরখা ভিজে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ ঈশানী দুহাতে ছোট্ট ইথানের গালে হাত রাখল। হাতটাও তার ভীষণ কাঁপছে। ইথান কৌতূহলী নয়নে চেয়ে রইল। মুহূর্তেই অসংখ্য চুম্বন একে দিলো ইথানের মুখে। এ এক মিশ্র অনুভূতি যা ঈশানী কথায় প্রকাশ করতে পারল না। জাপ্টে ধরে রইল ইথানকে। ইথান তখন থতমত খেয়েছে। তার কাছে ঈশানী অপরিচিত একজন। অসহায় পানে সে চাইল মোহের দিকে। কিছু সময়ের মাঝেই ছটফটিয়ে ঈশানীর থেকে ছাড়া পেয়ে ছুট লাগাল মোহের দিকে। মোহকে জড়িয়ে ধরে রইল সে। মিনমিন করে বলে উঠল,
“ওটা কে মাম্মা? আমাকে এভাবে চুমু খেল কেন?”

মোহ একটু ইথানের দিকে ঝুঁকে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“মনে আছে? একদিন ওর সাথে আমার ছবি দেখেছিলে?”

ইথান মাথা নাড়ায়। এরপরই বলে,
“এটা সেই আন্টি?”

আন্টি সম্বোধন শুনে বিষণ্নতা আরো বাড়ে ঈশানীর। পরক্ষণেই ভাবে এটা স্বাভাবিক। ইথান তো কখনোই তাকে দেখেনি। তবে মোহ তাকে সন্তানের স্নেহে বড়ো করেছে তাও একা। এটা ভেবে স্বস্তি লাগছে ঈশানীর। মনে উদয় হয়েছে পরম শান্তির। মোহ ইথানকে ভালো করে ধরে বলল,
“না বাবু। ও তোমার আন্টি নয়। তোমার মা হয়।”

বিচলিত কণ্ঠ মোহের। জানে না সে ইথানের প্রতিক্রিয়া কী হবে। সে আদেও সত্যিটা ইথানকে বলে ঠিক করল কিনা! তৎক্ষনাৎ ইথান মোহকে অবাক পানে জিজ্ঞেস করল,
“মা কয়টা হয়? তুমি তো আমার মা।”

ঈশানী ঢক গিলে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আসলে বাবু, আমি তোমার মায়ের বান্ধবী যে তাই তোমার মা বলতে চেয়েছে আমিও তোমার মায়ের মতোই।”

ইথান সরল মনে ঈশানীর কথা বিশ্বাস করে। মোহকে জড়িয়ে বলে,
“হুঁ, আমার মা তো একটাই।”

মোহ বুঝতে পারে ইথানের সামনে আর কোনো কথা বলা চলবে না। তাই সে ইথানকে বলে,
“যাও তো বাবু। স্কুলে ওদের সাথে আবার খেলা করো। আরো কিছুক্ষণ এখানে থাকব আমরা।”

ইথান কোনোকিছু না ভেবেই দৌড়ে গেল অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করতে। ঈশানী তখন বলল,
“ও তোকে মা ভাবে। আমাকে ও কোনোদিন দেখেই নি। তুই ওকে বড়ো করেছিস। তাই তোকে মা ভাববে স্বাভাবিক। এখন ওর এই ছোট্ট মনে এসব ঝামেলা ঢুকিয়ে দিস না। ও তোকে অনেক ভালোবাসে। ও আমাকে মা ডাকবেই বা কেন বল? আমি মা হিসেবে কী করেছি ওর জন্য? এক সময় তো এবোরশন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই বুঝিয়ে দিলি ও নিষ্পাপ। আমার পাপে ও কেন ভুগবে। তাই ওকে জন্ম অবধি দিয়েছি। তারপর আর ওর জন্য কী করতে পেরেছি বল? কিছু না। ওর মা হিসেবে তুই ঠিক আছিস।”

“এসব কথা পরে হবে। তুই এখন আমার সাথে আমার বাড়ি চল। তোকে আর ওখানে ফিরতে হবে না। তুই নিজের জীবন নিজে গড়বি এখন থেকে।”

ঈশানী তড়িঘড়ি মোহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল,
‘”না,না। আমি যেতে পারব না এই মুখ নিয়ে আঙ্কেল, আন্টির সামনে। তুই মাফ কর আমায়।”

মোহের কণ্ঠ কড়া হলো। খানিকটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“তো কোথায় থাকবি? তোর ওই মামা-মামীর কাছে? ওরা তো আর এই দেশেই থাকে না।”

“আমার কাছে টাকা আছে। কিছুদিনের জন্য কোনো হোস্টেল বা অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দে আমায় দয়া করে। তোর বাড়িতে যেতে বলিস না। এই মুখ আমি উনাদের দেখাতে পারব না। আমি তোর চোখেই চোখ রাখতে পারছি না। বিশ্বাস কর।”

মোহ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বুঝল ঈশানীর মনের জটিলতা। সে ভালো করে দেখল ঈশানীর মুখটা। আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই তার মুখে। শুঁকিয়ে গিয়েছে। চোখ বসে গিয়েছে। তার এই করুণ অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে জানা আছে মোহের। খুব ভালো করে চেনা আছে।

ড্রয়িংরুমে বসে কোনোরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই ইচ্ছেমতো ফোনে গেম খেলছে সৌমিত্র। এমন সময় তৈরি হয়ে নিজ ঘর থেকে বাহিরে এলেন মিসেস যামিনী। ব্যস্ত কণ্ঠে সৌমিত্রকে বললেন,
“রিহান কোথায় রে? রেডি হয়েছে? বের হতে হবে আবার। সাথে না হয় তুইও চল।”

সৌমিত্র গেম খেলতে খেলতে সহজ কণ্ঠে বলল,
“রিহান ভাই তো বাড়িতেই নেই মনে হয়। আমার ঘরে তো দেখলাম না তাকে।”

মিসেস যামিনী চমকালেন। বললেন,
“কী বলিস? ও কোথায় যাবে এসময়? ও জানে তো এসময় আমরা পাত্রীর বাড়িতে যাব।”

“ভাই কোথায় গেছে সেটা তো বলতে পারব না। কিন্তু বাড়িতে নেই এটা জানি।”

মিসেস যামিনী ভীষণ চিন্তিত হলেন। তারপর সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন,
“আমি উপরে গিয়ে দেখে আসি।”

সৌমিত্রের গেম খেলা বন্ধ হয়ে গেল। ফোন রেখে উদ্বেগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
“আরে উপরে নেই। ওখানেই তো আমি ছিলাম। আমার ঘরেও নেই। তাই তো দরজা লক করা। তুমি হাঁটুর ব্যথা নিয়ে কষ্ট করে উপরে না গিয়ে যাও ফোন দিয়ে রিহান ভাইকে কল করো।”

মিসেস যামিনী সৌমিত্রের কথায় আশ্বস্ত হলেন যেন। বিড়বিড় করতে করতে নিজের ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলেন।
“ছেলেটা এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে কোথায় যাবে?”

সৌমিত্র তা শুনতে পেয়ে বলল,
“আমার তো মনে হয় ভাইয়ের একদমই পছন্দ হয়নি পাত্রী। তোমার তো তাড়া বেশি। বিয়েটা দিতেই হবে। তাই ভাইয়ের পছন্দ অপছন্দ দেখছ না। আমিও পাত্রীকে ছবিতে দেখলাম। আমারও কিন্তু ভালো লাগেনি। রিহান ভাইয়ের সঙ্গে মানাবেই না।”

বেশ ডাহা মিথ্যা কথাগুলো বেশ আরামে বলে চুপ করে রইল সৌমিত্র। মিসেস যামিনী এবার বেশি চিন্তিত হলেন। দ্রুত ঘরের দিকে এগোলেন। ফের ফোনের গেমে মগ্ন হলো সৌমিত্র। মিনিট দুয়েক পরেই কে যেন বারংবার তার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকতে থাকল। সৌমিত্র বিরক্তি বোধ করে বলল,
“কী সমস্যা? যা বলার আছে পরে বলো। এখন ব্যস্ত আছি।”

“আমাকে ওয়াশরুমে লক করে দিয়ে গেম নিয়ে প্রচুর ব্যস্ততা দেখাচ্ছিস তুই?”

রিহানের কণ্ঠে ভড়কে গিয়ে নিজের ফোনটি ফেলে দিলো সৌমিত্র। ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের শার্টের বুকের অংশ ফাঁক করে ফুঁ দিয়ে বলল,
“এভাবে কেউ চমকে দেয় ভাই? আমি ভাবলাম ওয়াশরুমে ওখানেই তোমার ইন্না-লিল্লাহ হয়ে গিয়েছে আর তোমার অতৃপ্ত আত্মা আমার উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছে।”

রিহান তখন বেশ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রয়েছে। তা বুঝে থমথমে হয় সৌমিত্রের মুখ। আমতা আমতা করে শুধাল,
“কীভাবে বের হলে?”

“ঘর মুছতে এসেছিল একজন। ও খুলে দিয়েছে। তুই আমায় বলেছিলি দরজা নাকি লক নেই। কিন্তু দরজা তো লক করাই ছিল। তার মানে সেটা তুই করেছিলি। কেন?”

সৌমিত্র শুকনো ঢক গিলে এগিয়ে আসে। বেশ জড়োসড়ো হয়ে রিহানের হাতটা চেপে ধরে। রিহান তখন রিহান বিস্ময়ের শেষ সীমানায়।
“রিহান ভাই, তুমি আর যাই করো এই বিয়েতে রাজি হবে না প্লিজ। এর জন্য আমাকে তোমার হাত-পা যাই ধরতে হোক সব ধরব। তুমি তবুও রাজি হবে না।”

“কেন রে? কী হয়েছে? ব্যাপার কী বল তো? ওই মেয়েকে তুই চিনিস? ওর সাথে কোনো চক্কর আছে নাকি?”

সৌমিত্র বেশি আবেগপ্রবণ হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“শুধু চক্কর না। টক্কর, বক্কর সব আছে। তুমি এই বিয়েতে নাকচ করো জলদি!”

রিহান চোখজোড়া সরু করে তাকাল। সৌমিত্রের চোখেমুখে তখনও রাজ্যের আতঙ্ক। গাম্ভীর্য ধারণ করে বলল,
“আগেই সন্দেহ করেছিলাম। কত দিন এগুলা করিস? তোর না আগে বেশ কয়েকটাই গার্লফ্রেন্ড ছিল। এখন ওই মেয়েকে ধরেছিস?”

সৌমিত্র লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে বলল,
“নাউজুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ! আমি খাঁটি প্রেমিক। কোনো খাদ নেই ভালোবাসায়। ওরা শুধু আমার বান্ধবী ছিল। আর কিছু না।”

“বাট তুই তো এখনো ভার্সিটি শেষ করে উঠতে পারছিস না। ওদিকে মেয়ের অনার্স করা শেষ! ও তোর সিনিয়র হচ্ছে।”

“আরে রাখো তো তুমি সিনিয়র জুনিয়র! প্রিয়াঙ্কা-নিক এদের দেখো না? আমি তো বলব তুমিও সিনিয়র খুঁজে নাও।”

রিহান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশা নিয়ে বলল,
আপাতত মাকে বোঝানোর চেষ্টা করি! কী করে বিয়ের সম্বন্ধ কাটিয়ে ওঠা যায় তাই ভাবি। তারপর সিনিয়র নাকি জুনিয়র খুঁজব দেখা যাবে।”

সৌমিত্র খুশিতে গদগদ করে রিহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আজ নিজ হাতে খিচুড়ি রান্না করেছে মোহ। কিছুক্ষণ আগেই রৌদ্রময় দিনটি কালো মেঘ মেঘলা করে তুলেছিল। বৃষ্টিও হয়েছে ফের। নিজের বান্ধবীর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন খুশি করে দিয়েছে তাকে। অতঃপর তার খুব করে মন চাইল স্বচ্ছকে তার হাতের রান্না খাওয়াতে। লোকটা নিজের সকল বিলাসিতা ছেড়ে পড়ে আছে বাহিরে। তার জন্য মায়া হয় মোহের। তাই নিজের ইচ্ছে না দমিয়ে সৌমিত্রের থেকে স্বচ্ছ যেখানে থাকে সেখানকার ঠিকানা নিলো সে। বেরিয়ে পড়ল সে। ক্লাবে পৌঁছানোর পর দরজায় টোকা দিতেই তার মনে হলো দরজা একটু খোলা। মোহ একহাতে দরজা ঠেলতেই দুপাশে খুলে গেল দরজা। মোহ হতবাক হলো। দরজা খোলা কেন? একটু ইতস্ততবোধ করেই ভেতরে প্রবেশ করল সে। বাহিরের ঘর পেরিয়ে ভেতরের ঘরের কাছাকাছি যেতেই তার নজরে পড়ল ভেতরে এক সোফায় মাথার নিচে হাত দিয়ে শুয়ে থাকা স্বচ্ছের উপর। ভ্রু কুঁচকে বিনা শব্দে এগিয়ে গেল সে। তার সংলগ্নে এগিয়ে গিয়ে নিচু সুরে ডাকল,
“শুনছেন!”

অতিরিক্ত জ্বরের ঘোরে নিজের চোখ দুটো যেন জোর করেই মেলল স্বচ্ছ। আচানক মোহকে দেখে চমকালেও প্রকাশ করল না সে। গম্ভীর মুখে ধীরে ধীরে উঠে বসে মাথা নিচু করে নিজের কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে রইল। মোহ খেয়াল করল, স্বচ্ছের গায়ে ভেজা টিশার্ট। সে হকচকিয়ে উঠল।
“এ কী! আপনার না জ্বর? আপনি ভেজা টিশার্ট গায়ে দিয়ে শুয়ে রয়েছেন?”

স্বচ্ছ তেমন কোনো আগ্রহ দেখাল না যেন। ছোট্ট করে জবাব দিল,
“হুঁ। তো?”

“আপনার কি সত্যিই বুদ্ধিভ্রম হয়েছে? ভেজা জামাকাপড় পরে কেউ শুয়ে থাকে? এটা কেমন অভ্যেস।”

“স্বচ্ছের একান্ত অভ্যেস এটা।”

মোহ কিছু না ভেবেই স্বচ্ছের গালের কাছে হাত রাখল। অতঃপর চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“জ্বরে ম/রতে চান?”

“আমার মনে হয় আগুনে পু;ড়ে ম/রার চেয়ে জ্বরে ম;রাটা অনেক ভালো। কষ্ট অন্তত কম হবে।”

স্বচ্ছের কথার আগামাথা কিছুই বুঝল না মোহ। চোখমুখ কুঁচকে বলল,
“জ্বরে আপনার মাথাও গেছে। দেখি এখনি টিশার্ট খুলে ফেলুন।”

স্বচ্ছ স্পষ্ট জবাব করল,
“না।”

“জেদ করছেন কেন?”

“আমার জেদ সহ্য করছ কেন তুমি?”

মোহ হতাশ হয় স্বচ্ছের ত্যাঁড়া উত্তরে। কড়া সুরে বলে ওঠে,
“টিশার্ট খুলবেন কি না?”

স্বচ্ছ জবাব দেয়না এবার। মোহের মুখের দিকে একবার দেখলও না সে। মোহ ক্ষিপ্ত হচ্ছে এবার। আবারও বলল,
“এমন জেদ করলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”

তবুও স্বচ্ছ নীরব। এবার মোহের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। কিছুটা দূরে থাকা লম্বা টেবিলে ছু/রির দেখা পেল সে। বিলম্ব না করে দ্রুত ছু/রি হাতে নিয়ে এলো স্বচ্ছের কাছে। এবার স্বচ্ছ খানিকটা থতমত খেল বটে। ছু/রিটা স্বচ্ছের বুকের কাছে ধরলে স্বচ্ছ ভড়কে যায়।
“একি! এবার সত্যিই মে/রে দেবে নাকি?”

চলবে…