যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-১+২

0
13

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১ [দ্বিতীয় খণ্ড]

নিজের প্রেয়সীকে অন্য এক পুরুষের গাড়ি থেকে হাসিখুশি নামতে দেখে যেন থমকে যায় স্বচ্ছ। পুরুষটি বেশ যত্ন করে মোহকে গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজা খুলে দিচ্ছে। তার উপর স্বচ্ছ এই পুরুষটিকে দুই চোখে সহ্যই করতে পারত না কখনোই। স্বচ্ছের মাথায় র/ক্ত চড়ে যায় যেন! কপালের দুপাশের রগ ফুলতে থাকে। ইচ্ছে জাগে নিজের ব্যক্তিগত করে রাখা নারীর কাছে গিয়ে হেঁচকা টানে নিজের ব্যক্তিগত জায়গায় রেখে দিতে। তবে সে নিজে ছোটো হতে চায় না মোটেও। আর কোনোদিকে না তাকিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল সে।

“ধন্যবাদ আপনাকে। আমি ভাবতেও পারিনি আপনি আমাকে এতটা দূর অবধি সাহায্য করবেন।”

মোহের বিনয়ী কথায় মোটেও শৌভিকের গাম্ভীর্য ভাঙল না। বরং দৃঢ় সুরে মোহের পানে না তাকিয়ে জবাব দিলো,
“আমাকে এতটা মহৎ ভাবারও কিছু নেই। হয়ত নিজের স্বার্থও ছিল বলেই আপনাকে এতদূর সাহায্য করেছি। নয়ত করতাম কিনা তা জানি না। নিজের সত্যতা স্বীকার করতে আমি দ্বিধাবোধ করিনা।”

মোহ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে,
“ভবিষ্যতে আমার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই জানাবেন। দ্বিধাবোধ করবেন না।”

শৌভিক মৃদু হাসে। উত্তরে বলে,
“সাহায্যের বদলে সাহায্য এই ইকুয়েশন আমার ঠিক ভালো লাগে না। যাই হোক, আশা করছি কালকের সকালটা মন্ত্রী সরোয়ার সাহেবের জন্য অন্যরকম হবে।”

মোহের চোয়াল শক্ত হয়। কণ্ঠ শক্ত হয়।
“তার সেই পরিণতি দেখার জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি আমাকে! অপমানের বদলে অপমান আমি ফিরিয়ে দেব।”

“কাল দেখা হচ্ছে। আজকে আসি।”

মোহের মুখের দিকে না তাকিয়েই সরাসরি গাড়িতে উঠে বসে শৌভিক। মোহ হাঁটা ধরে তার বাড়িতে। শৌভিক লোকটিকে অদ্ভুত লাগে তার কাছে। শৌভিক কখনো মোহের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। এই ভদ্রতা ভীষণ ভালো লাগে মোহের কাছে। তার হাঁটার গতি বাড়ে। মনে তীব্র উত্তেজনা! কালকের জন্য অপেক্ষার প্রহর যেন কাটে না!

ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকা সত্ত্বেও ঘেমে একাকার হয়ে নিজের বর্তমান অবস্থানরত ক্লাবে ঢুকল স্বচ্ছ। প্রচণ্ড শব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো সে। সেই বিকট শব্দে যেন কেঁপে উঠল আশপাশ। কপাল বেয়ে ঘামের বিন্দু তার হালকা আকাশী রঙের শার্টে পড়ছে। মৃদু কাঁপছে শরীর। মনে উল্টাপাল্টা চিন্তা এতটাই বেড়ে গেছে যে আর জায়গা পাচ্ছে না। মোহের মুখশ্রী তার কল্পনা জগতে ভাসতেই ইথানের ছোট্ট মুখটিও ভেসে উঠল যেন! নিজেই নিজে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ইথান কে!”

এতদিন ইথানের পরিচয় নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না স্বচ্ছের। কিন্তু এখন চিন্তিত হতে না চাইলেও চিন্তাগুলো যেন জোর করে ঢুকে পড়ছে তার মস্তিষ্কে। সেই সঙ্গে ক্রোধের মাত্রা বাড়তে থাকে তার। হারায় নিজের নিয়ন্ত্রণ। ভেতরের ঘর থেকে ফারাহ বেরিয়ে আসে। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে,
“ভাইয়া! কখন থেকে বসে আছি জানো? খাবার আর তোমার কিছু কাপড় নিয়ে এসেছিলাম। কোথায় ছিলে?”

স্বচ্ছের মুখভঙ্গি বদলালো না। আগের মতোই তার চোখমুখ উপচে পড়ছে যেন ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। ফারাহ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“তুমি তো ঘেমে গেছো। শার্ট ভিজে কী অবস্থা! আগে যাও শার্ট চেঞ্জ করে এসো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”

বিনা শব্দ ব্যতীত ধীর পায়ে ফারাহর পাশ কাটিয়ে ভেতরের ঘরে গেল স্বচ্ছ। ফারাহর মুখের দিকে একবারও তাকালো না অবধি সে। ফারাহ সোফায় বসল হাফ ছেড়ে। টিফিনবক্সের খাবার বেড়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তৎক্ষনাৎ তার কানে এলো কাঁচের কিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দ। হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল ফারাহ। প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে ছুটল ভেতরের দিকে।

ভেতরের ঘরে পা রাখতেই নিচে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো কাঁচের টুকরো দেখে ছমছম করে উঠল ফারাহর শরীর। এগুলো কাঁচের বোতলে সম্ভবত ক্লাবে এসে স্বচ্ছ এবং তার বন্ধুরা মাঝে মাঝে ড্রিংক করত। সেসব এখনো খালি পড়ে ছিল বহুদিন। আরেকটু দূরে থাকা কিছু কাঁচের টুকরোতে পড়ছে তাজা র/ক্তের ফোঁটা। চোখ উঠিয়ে তাকাতেই আঁতকে উঠল ফারাহ। স্বচ্ছের চুলে ভর্তি মাথা থেকে বেয়ে বেয়ে থুঁতনি অবধি এসে টপটপ করে নিচে পড়ছে একেকটা র;ক্তের বিন্দু। ফারাহ কাঁচের টুকরো পেরিয়ে ছুটে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে নিজের ভাইয়ের কাছে। স্বচ্ছের র/ক্তে মাখা শার্ট খামচে ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“ভাইয়া! এই ভাইয়া! এটা তুমি কী করলে?”

স্বচ্ছের উত্তর আসেনা। হাত মুঠো করে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে রয়েছে একভাবে। তবে তার শরীরের কম্পন আন্দাজ করতে পারছে ফারাহ। ভয়ে কেঁদে দিলো ফারাহ।
“ভাইয়া, কথা বলো প্লিজ! তুমি কেন করলে এটা? কী হয়েছে তোমার? উঠো তুমি এখান থেকে! কত র/ক্ত পড়ছে! চলো আমার সাথে হসপিটালে।”

স্বচ্ছের হেলদোল হলো না। তবে তার শক্তি কমে আসছে সে বোধ করছে। তবে ফারাহর কান্না দেখে সে দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমি ম/রে যাইনি। ঠিক আছি।”

ফারাহ তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। স্বচ্ছের হাত টেনে ধরে বলে,
“চলো তুমি হসপিটালে। আমার কথা না শুনলে কিন্তু আমি কল করে বাবাকে ডাকব।”

“না, ডাকবে না।”

“তবে চলো!”

ফারাহর জোরাজোরিতে উঠে দাঁড়াল স্বচ্ছ। কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোবটের মতো হাঁটা ধরল সে।

সাদা ব্যান্ডেজে আবৃত স্বচ্ছের মাথা। মুখটা একেবারে পাঁশুটে। তার সামনেই তীক্ষ্ণ চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে ফারাহ। হাফ ছেড়ে সে বলে,
“আমাকে হার্ট অ্যা/টাক করাতে চাও নাকি? এমনটা কে করে? একটা পা/গলও নিজেকে আ/ঘাত করার কথা চিন্তা করে না!”

স্বচ্ছ যেন এখনো ভেতর থেকে ফুঁসছে। ফারাহর কথা শেষ হওয়া মাত্র সে গজগজ করতে করতে বলল,
“পাগ/ল তো আর প্রেমে পড়ে না তাই না? প্রেমে পড়লে তারাও ডেস্পারেট হতো কিংবা হতো না। কারণ সবাই তো স্বচ্ছের মতো একরোখা নয়।”

ফারাহ কিছুটা থম মে;রে রইল। অতঃপর হতাশ গলায় বলল,
“ভাইয়া! প্রেমে পড়লে এখন মানুষ জান দেয়? কোথায় প্রেমিকাকে নিজের বানানোর জেদ নিয়ে সেই কাজে লেগে পড়বে তা নয়! নিজেকে আ;ঘাত করার জন্য পা/গল হয়ে গেছে!”

স্বচ্ছ দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে।
“ফারাহ! তুমি তো জানো আমার না পাওয়ার অভ্যেসটা নেই। কারণ যা আমি ভালোবাসি, যা আমি চাই তা না পেলে আমি কতটা ডেস্পারেট হয় যাই। সেটা তুমি জানো। আর তখন আমার মনে হয়েছিল সব দোষ আমার নিজেরই। যদি না প্রেমে পা পিছলে পড়তাম তাহলে এতকিছু হতোই না।”

“ভাইয়া তোমার সমস্যা কী জানো? তুমি নিজেকে কারোর কাছে প্রকাশ করতে পারো না। আরে বাবা, তুমি তো তাকে ভালোবাসো! মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সামনে মানুষ নিজেকে তুলে ধরে পুরোটাই। তুমি কেন সেটা পারো না?”

তৎক্ষনাৎ বেডে নিজের হাতটা দিয়ে থাবা দিয়ে জোর গলায় বলে উঠল,
“পারার আগেই শৌভিক এমন করবে কে জানত?”

ফারাহ হতবাক হয় শৌভিকের নামটি শুনে। এই শৌভিক আবার কী করল? মনে দানা জমে কৌতূহলের।

সকাল সকাল বেশ আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ পড়তে মগ্ন ছিলেন সরোয়ার সাহেব। সেই মুহূর্তে সদর দরজা দিয়ে কামাল প্রবেশ করে। মুখটা উনার শুঁকনো। সরোয়ার সাহেবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বললেন,
“স্যার, কিছু অফিসার এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।”

হাত থেকে খবরের কাগজ নামিয়ে রাখেন সরোয়ার সাহেব। চশমার ভেতরে দেখা যাচ্ছে উনার কুঁচকে রাখা ভ্রু দুটি। সন্দিহান হয়ে জানতে চান,
“কারা?”

“উপরমহল থেকে। কিছুদিন আগে সাইফুল ইসলামের যেই ফ্যাক্টরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সরকারি জায়গা করতে সেই জায়গা নিয়ে কথা বলতে এসেছেন।”

ভেতরে ভেতরে আতঙ্ক সৃষ্টি হলো সরোয়ার সাহেবের। কিন্তু প্রকাশ করলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন,
“তো দাঁড় করিয়ে রেখেছ কেন উনাদের? যাও! ভেতরে নিয়ে এসো!”

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২ [দ্বিতীয় খণ্ড]

“আপনার নামে বেশ কিছু জ/ঘন্য অভিযোগ রয়েছে। আশা করছি আপনি ক্লিয়ার করবেন বিষয়গুলো।”

একজন বড়ো অফিসারের কড়া কথায় নড়েচড়ে বসলেন সরোয়ার সাহেব। জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“যারা রা/জনীতি করে তাদের বিরুদ্ধে কতই না অভিযোগ থাকে। আমরা তো আর একশ জনের মাঝে একশ জনকেই সন্তুষ্ট করতে পারিনা। তাই অভিযোগ থাকবে স্বাভাবিক। এসব বিষয়ে আপনাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে!”

কথা ঘুরানোর চেষ্টায় সফল হলেন না সরোয়ার সাহেব। অফিসার প্রত্যুক্তি করলেন,
“,এসব যেমন তেমন অভিযোগ নয় মন্ত্রী সাহেব। বেশ কয়েকটা বড়োসড়ো অভিযোগ উঠেছে।”

সরোয়ার সাহেব মৃদু হাসেন। কামাল দ্রুত বলেন,
“আমার মনে হয় বসে থেকে খোলাখুলি আলোচনা করে নিলে ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা যাবে।”

অন্য এক অফিসার সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন কামালের দিকে। মোটা সুরে বললেন,
“আপনি কে?”

কামাল আমতা আমতা করে বললেন,
“মন্ত্রী সাহেবের হয়ে কা…কাজ করি।”

“আপনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে ভালো হয়। আমরা শুধু মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

সরোয়ার সাহেব ইশারায় কামালকে চুপ করতে বলেন। এত কথাবার্তা শুনতে পেয়ে উপর থেকে নেমে এলেন মিসেস. জেবা সঙ্গে এলো সৌমিত্র। অফিসার বলতে শুরু করলেন,
“আপনি মন্ত্রী হওয়ার ক্ষমতাকে অপব্যবহার করছেন। আপনি সাধারণ মানুষের হক কেঁড়ে নিয়েছেন। যেই জায়গা সরকার কর্তৃক নিয়ে সমপরিমাণ অর্থ দেওয়ার জন্য এবং কাগজে লেখা ছিল তার অর্ধেকও তারা পায়নি। এছাড়া একটা মেয়েকে অপহরণ এবং সেই মেয়েটির বাবাকে বিনা কারণে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা আপনি করেছিলেন। এই সব অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে উঠেছে আর যা যা প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তার জন্য আপনাকে পদচ্যুত করা হতে পারে আপনি জানেন?”

সরোয়ার সাহেব ঘামতে থাকলেন। নিজের আতঙ্ক তিনি প্রকাশ করতে চাইলেন না। এসকল তুখোড় অফিসারদের সামনে নিজেকে চিন্তিত প্রদর্শন করা মানে ধরা খেয়ে যাওয়া। তিনি যথা সম্ভব শান্ত থেকে বললেন,
“দেখুন কে বা কারা এসব অভিযোগ তুলেছে আমি জানি না। আর কী প্রমাণ আমার বিরুদ্ধে যেটার কারণে আমাকে পদচ্যুত করার ভয় দেখানো হচ্ছে?”

“আপনাকে যেই আসল এগ্রিমেন্টের পেপার দেওয়া হয়েছিল সেটা আর আপনারা যেই নকল এগ্রিমেন্টের পেপার তৈরি করেছিলেন ফ্যাক্টরির জন্য সেটা আমরা চেক করেছি। সেখানে আকাশ-পাতাল অর্থের ব্যবধান। ব্যাংক থেকে টাকাও তোলা হয়েছে কিন্তু একজন মজুরির কাছেও টাকা যায়নি। আমরা সব খোঁজ নিয়েছি। আর যেই পুলিশের সাহায্যে আপনি মেয়েটির বাবাকে অপদস্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনিও সব স্বীকার করেছেন। আর মেয়েটির কি/ডন্যাপিং এর কেসটার প্রধান সাক্ষী মেয়েটি নিজেই। আর কী চান!”

সরোয়ার সাহেব এবার নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। হাঁসফাঁস করতে লাগলেন। দরদর করে ঘামতে লাগলেন। অস্বস্তি নিয়ে বললেন,
“অফিসার আমি এসব কেন করব? আমার কাছে কীসের কমতি আছে? আমি এসব করিনি।”

“এজন্য তো প্রমাণ লাগবে মন্ত্রী সাহেব। আপনার কাছ থেকে আমরা প্রমাণ নেব বলেই আপনার বাড়ি অবধি এসেছি। যদি প্রমাণ দিতে না পারেন নিজের তরফ থেকে তবে আমাদের পুলিশ টিমের সাথে আপনাকে যেতে হবে।”

থরথর করে কাঁপলেন সরোয়ার সাহেব। পিছিয়ে গেলেন কয়েক ধাপ। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বললেন,
“আমি এসব করতে পারি না। আমি করিনি।”

চোখমুখ খিঁচে রইলেন সরোয়ার সাহেব। বুকে হঠাৎই প্রচণ্ড ব্যথার আগমন ঘটেছে। এত উত্তেজনা আর নেওয়া যাচ্ছে না। মিসেস জেবা. উনার নিকটে আসতে চাইলে সৌমিত্র আঁটকে বলে,
“মা, যেও না। ওদের কথার মাঝে তোমাকে এলাও করবে না।”

মিসেস জেবা বিচলিত হয়ে বলেন,
“দেখতে পাচ্ছিস না তোর বাবা কেমন যেন করছে! কিছু হয়ে না যায়!”

মিসেস জেবা যেতে নিলেই হাত-পা ছেড়ে দিয়ে সোফায় এলিয়ে পড়েন সরোয়ার সাহেব। চোখের চশমাটুকু বাঁকা হয়ে যায়। চোখ দুটো নিভে আসে। মিসেস জেবা উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলেন স্বামীর এই অবস্থা দেখেই। সৌমিত্র ছুটে আসে। বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায় সরোয়ার সাহেবকে নিয়ে। কামাল সাহেব তৎক্ষনাৎ এম্বুল্যান্সের জন্য কল করেন।

অচেতন বাবাকে একমনে দেখছে স্বচ্ছ। মুখটা তার ফ্যাকাসে। পাশে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে সৌমিত্র। মিসেস জেবা উপস্থিত হলেন। স্বচ্ছ বহুদিন পর নিজের মাকে স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে যেন মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। নিজের স্বামীর এমন অবস্থায় ভেঙে পড়েছেন কিছু সময়ের ব্যবধানে। ছেলেকে দেখতে পেয়ে যেন উনার প্রাণও জুড়ায়। ছেলের মাথায় হাত রাখতে চাইতেই লক্ষ্য করেন মাথায় ব্যান্ডেজ। আঁতকে ওঠেন।
“কতগুলো দিন পর তোমাকে দেখলাম বলো তো? মায়ের কথা একবারও মনে পড়ে না তাই না? এত নির্দয় কেন হয়েছ তুমি স্বচ্ছ?”

স্বচ্ছ উত্তর দেয় না। মিসেস জেবা চিন্তিত কণ্ঠে বলেন,
“এই কয়দিনে এসব কী ঘটিয়েছ তুমি? তোমরা কি আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দেবে না নাকি? তোমরা কি চাও আমি ম;রে যাই?”

স্বচ্ছ উঠে দাঁড়ায়। কপাল জড়িয়ে আসে মায়ের কথায়। খানিকটা জোর গলায় বলে,
“মা এসব কেন বলছ?”

“কেন বলব না? তুমি বা তোমার বাবা কেউ আমাকে একটু শান্তিতে দিয়েছ? নিজেকে আয়নায় দেখেছ? শুঁকিয়ে গেছো কতটা? কোথায় থাকছ, কী করছ একা একা? আমায় বলো তো!”

“আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। তোমার ছেলে বড়ো হয়েছে। নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। সৌমিত্র থেকে সব শুনেছি। বাবা যা যা করেছে সব প্রকাশ্যে এসেছে! বর্তমানে উনার যা অবস্থা তার জন্য কিন্তু উনি নিজে দায়ি মা।”

মিসেস জেবা কষ্ট পেয়ে হালকা ধমক দিলেন ছেলেকে।
“চুপ করো। যেটাই হোক উনি তোমার বাবা।”

“বাবা জন্যই তো বারবার মানা করেছিলাম। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করতে মানা করেছিলাম। উনি কী করলেন?”

মিসেস জেবা উত্তর দিতে পারলেন না। স্বচ্ছ তপ্ত শ্বাস ফেলল। কেবিন থেকে বের হতে নিলে মিসেস জেবা অনুরোধ করলেন,
“যেও না। অন্তত তোমার বাবার জ্ঞান ফিরলে একটু কথা বলে যেও।”

“যাচ্ছি না, মা। আমার ভালো লাগছে না। তাই একটু হাঁটতে যাচ্ছি বাহিরে।”

স্বচ্ছে বেরিয়ে এলো। সরোয়ার সাহেবের কেবিনের সামনেই দুজন কনস্টেবল। সম্পূর্ণ পুলিশের হেফাজতে আছেন উনি বলা চলে। স্বচ্ছ ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো হসপিটাল থেকে। সারা দিনটা পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের পর এক নিস্তব্ধ পরিবেশ। সড়ক দিয়ে চলছে বড়ো বড়ো গাড়ি। স্বচ্ছের মনে কোথাও একটা গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্বস্তি মিলছে না কোথাও। নিজের স্বস্তির ঠিকানা কোথাও হারিয়ে ফেলেছে সে। নিজেকে ছন্নছাড়া লাগছে ভীষণ। রাস্তায় থাকা এক সোডিয়াম লাইটের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজল সে। মুহূর্তে মেয়েলি কণ্ঠে উচাটন সৃষ্টি হলো মনে। নরম কণ্ঠের সেই অধিকারিণী শুধালো,
“মাথায় লাগল কী করে?”

স্বচ্ছের মস্তিষ্ক নাড়া দেয়। চমকে গিয়ে চোখ খুলে পিছু ফিরে তাকায় সে। গাঢ় সবুজ ওড়নায় আবৃত সেই মুখশ্রী। অতি সাধারণ তার পোশাক-আশাকের মাঝে চেহারাটাতে যেন স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। স্বচ্ছ মুখ ফিরিয়ে বলল,
“এমনিই হুট করে এক্সি/ডেন্টলি লেগে গিয়েছে।”

মোহ মুখ ভার করে বলে,
“আপনি ভীষণ কেয়ারলেস।”

“কী করব বলো? কেয়ার করার মানুষটা কেয়ার করে না যে। তাই নিজের প্রতি নিজেই নির্দয় হয়ে যাচ্ছি।”

মোহ চোখ দুটো ছোটো করল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“স্টুপিড লোক!”

এই বলেই মোহ তার হাত দুটো স্বচ্ছের দুই গালে রেখে স্বচ্ছের মাথা নিচু করার চেষ্টা করে বলল,
“কোথায় লাগিয়েছেন দেখি?”

থতমত খেয়ে গেল স্বচ্ছ। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলল,
“কেন আপনি কি চিকিৎসা করবেন?”

“জি, না। আরো কয়েকটা মা/রব ওখানে।”

“তুমি আসলে একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে। রাতদুপুরে একটা ছেলেকে মা/রার হু/মকি দাও!”

মোহ স্বচ্ছকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ডক্টর দেখিয়েছিলেন?”

স্বচ্ছ মাথা নাড়ায়। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,
“এই সময় এদিকে একা কী করছ? কোনো কাজ ছিল?”

“আমার একটা বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। এখন বাড়ি যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে আপনাকে দেখলাম তাই রিকশা থেকে নেমে এলাম।”

স্বচ্ছ বিদ্রুপ করে বলল,
“অনেক উপকার করেছেন। এখন আমি একটা রিকশা ডেকে দেই। সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে। এই সময় দয়া করে বাড়ির বাহিরে থাকবেন না।”

মোহ মৃদু হাসে। সামনে প্রচুর রিকশা আছে দেখতে পেয়ে সেদিকে এগোতে যায়। পিছু ডেকে ফেলে স্বচ্ছ।
“মোহ!”

মোহ পিছু ফিরে তাকায়। উৎসুক হয়ে বলে,
“জি?”

“আলোর নিচে একটু দাঁড়িয়ে থাকবে?”

কৌতূহলী হয়ে মোহ জানতো চাইল,
“কেন?”

“তোমায় দেখে বোঝার চেষ্টা করব তোমার দুটো চোখে আসলে কী আছে! সেই দুটো চোখ কী রহস্য গোপন করে রেখেছে।”

মোহ কপাল কুঁচকালেও এরপরই হেসে দিয়ে সামনে ঘুরে ভালো করে দাঁড়িয়ে বলে,
“যতক্ষণ ইচ্ছে দেখুন। কোনো রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেন কিনা সেটা জানান।”

স্বচ্ছ তাকিয়ে রইল অপলক। সত্যিই সে বুঝতে চেষ্টা করল মোহের সরু চোখের চাওয়া। অনেকক্ষণ ফুরালো। স্বচ্ছ বুঝল এইতো তার স্বস্তির ঠিকানা। যাকে কিছু সময়ের ব্যবধানে সে হারিয়ে ফেলেছিল। এটাকে কী করে স্থায়ী ঠিকানা বানানো যায় সেটা সে বুঝেই উঠতে পারল না। স্বচ্ছ যেন আগের সকল রুষ্টতা ভুলে গেল নিমিষে। আপনাআপনি হেসে ফেলল পাগলের মতো নিঃশব্দে এবং বললো,
“তুমি তোমার নামের মতোই এক সীমাহীন মোহ। যেই মোহ কারোর চিরজীবনের ভ্রান্তি! কারো জীবদ্দশার এক স্বস্তির ঠিকানা।

চলবে….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]