#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫ [দ্বিতীয় খণ্ড]
মাথা নিচু করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে মোহ। একহাতে বেডের সাদা চাদর চেপে বসে রয়েছে। পা দ্রুত দুলাচ্ছে বিরতিহীন ভাবে। কান গরম হয়ে আছে তার। ডাক্তার আর সৌমিত্রের সামনে স্বচ্ছ তাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ংকর লজ্জার কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে সেটা স্বচ্ছ নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে। তাই সে গম্ভীর মুখে সৌমিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সৌমিত্র একবার চোখ গোল গোল করে মোহকে দেখছে একবার স্বচ্ছকে দেখছে। ডাক্তার আরো একবার চেক-আপ সারছে মোহের। সৌমিত্র ঠোঁট টিপে হেসে স্বচ্ছের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। স্বচ্ছ চোখ বড়ো বড়ো করে সৌমিত্রের দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
“কী আশ্চর্য! গায়ে পড়া মেয়েদের মতো করছিস কেন?”
সৌমিত্র সরে গেল এবার। তার পুরুষত্বে আঙুল তোলাতে অকপট রাগ দেখাল সে।
“ভাই! এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। তুমি ছোটোকাল থেকে আমার ফুল বডি দেখো নি? তাহলে তুমি কেমনে আমাকে মেয়ে মানুষ বলে আখ্যা দাও?”
এই কথাগুলো কানে গেল মোহেরও। সে হাসতে চাইল না। তবে না হেসে পারলও না। হাসি আটকাতে গিয়ে অদ্ভুত শব্দে হেসে ফেলল। স্বচ্ছ বিষম খেয়ে সৌমিত্রের ঘাড় ধরে বলল,
“তুই বের হ এখান থেকে। তোকে এখন আর এখানে দেখতে চাচ্ছি না।”
“ভালো মানুষের কদর নেই। আমিই কিন্তু ভাবীরে আনছিলাম এখানে।”
“এনে অনেক উপকার করছিস। এখন যা এখান থেকে তুই।”
সৌমিত্র মুখ কালো করে যেতে নিলো। তৎক্ষনাৎ পিছনে ঘুরে ভাইয়ের কানে কানে বলে দিলো,
“যেভাবে ভাবীরে জড়িয়ে ধরেছিলে তাতে বলা যায় তুমি রোমিও এরও উপর লেভেলে চলে গেছো। প্রাউড ওফ ইউ।”
স্বচ্ছ হাত উঁচু করে মা/রতে যেতেই সৌমিত্র ছুট দিলো বাহিরের দিকে। ডাক্তার এসে স্বচ্ছকে বললেন,
“সিরিয়াস কিছু হয়নি উনার। এখনি বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। আর কিছু মেডিসিন লিখে দিয়েছি। আ/ঘা;তপ্রাপ্ত স্থান দ্রুত শুকিয়ে যাবে।”
“থ্যাংক ইউ ডক্টর।”
মোহ নিজ থেকে নামতে চাইলে বেড থেকে স্বচ্ছ নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। মোহ কিছু বলতে উদ্যত হলে স্বচ্ছ আগেই বলে ফেলে,
“কোনো অজুহাতের দরকার নেই। ব্যস… আজকের দিনটা আমি যা বলব সেটাই করো। প্লিজ!”
স্বচ্ছের কথা উপেক্ষা করা হয়ে ওঠেনি মোহের। স্বচ্ছের হাতের বাহুখানি চেপে দাঁড়াল সে। বিমূঢ় মুখে স্বচ্ছ ধীর পায়ে মোহের সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে বেরিয়ে এলো। যেতে যেতে স্বচ্ছ প্রশ্ন করল,
“কীভাবে এমনটা হলো?”
“তেমন কিছু না। ওই কোনো একটা ছেলে নেশা করে গাড়ি ড্রাইভ করছিল। সেই সময় আমি যেই অটোতে বসে ছিলাম সেটাতে ধা/ক্কা দেয় আর আমার মাথায় লেগে যায়।”
কথাগুলো মোটেও বিশ্বাসযোগ্য লাগে না স্বচ্ছের নকট। সে বিষয়টি অন্যদিক থেকে ভাবে। তার বাহু ধরে বিশ্বস্ত নিয়ে হাঁটতে থাকা নারীটির জন্য বুকে আতঙ্ক এসে চাপ দেয়। নিজে নিজেই মাথা নাড়ায় আর বিড়বিড়িয়ে বলে,
“এটা অন্যকিছু।”
“কিছু বললেন?”
স্বচ্ছ মোহের প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। দুজনে বাহিরে এসে যখন অটোর অপেক্ষা করছে তখন সৌমিত্র নিজের গাড়ি সমেত এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির গ্লাস খুলে দাঁত বের করে হাসি দিলো। স্বচ্ছ একবার মোহের দিকে তাকাল। বেশি সময় রোদের মধ্যে মেয়েটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইল না স্বচ্ছ। তাই সৌমিত্রকে পাল্টা হাসি দিয়ে সে বলল,
“ছোটো ভাই! একটু নামো তো তুমি গাড়ি থেকে!”
স্বচ্ছের মুখে এত আদুরে ডাক শুনে হতবাক হয়েই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সৌমিত্র। নিজের কানে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে বলল,
“আমার কান খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোমার ব্রেইন?”
সৌমিত্রের কথার কোনোরূপ জবাব না দিয়ে তার হাত থেকে ছোঁ মে/রে গাড়ির চাবিটা ছিনিয়ে নিলো স্বচ্ছ। মোহের জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে মোহকে ইশারা করে বলল,
“বসো।”
মোহ একবার সৌমিত্রের দিকে তাকাল। তারপর কী যেন মনে করে উঠে গেল গাড়িতে। স্বচ্ছ তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে সোজা বলে দিলো,
“আমি মোহকে তার বাড়িতে ছেড়ে দিতে যাচ্ছি। তোর ইচ্ছে হলে তুই এখানে দাঁড়িয়ে থাক, নয়ত রাস্তায় শুয়ে পড় আর তা না হলে অটো, ট্যাক্সি কিছু ধরে বাড়ি চলে যেতে পারিস।”
সৌমিত্রের মুখ অসহায়ত্বে যেন ভরে গেছে। তার মতো অসহায় ব্যক্তি এ দুনিয়ায় এখন একটাও পাওয়া যাবে না। এক হতাশার শ্বাস নিয়ে সে একরাশ বিরহ নিয়ে বলল,
“তাই তো বলি নিম পাতার রস যেই মুখ দিয়ে সবসময় বের হয় সেদিক দিয়ে মধু বের হচ্ছিল কেন! এই দুনিয়ায় সবই ছলনা।”
স্বচ্ছ সৌমিত্রের কথা বিন্দুমাত্র কানে তুলতে গেল না। গাড়ির অন্যদিকে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। সযত্নে মোহের সিটবেল্ট লাগিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো তৎক্ষনাৎ। সৌমিত্র অসহায়, অবলা পুরুষের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। পরক্ষণেই অনুভব করল তার খিদে পেয়েছে। সারাদিন দৌড়াদৌড়িতে কিছুই মুখে তোলা হয়নি। আর সৌমিত্র মানেই খাবার ছাড়া অচল। সৌমিত্র জানে সামনে আরেকটু হাঁটলে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। তাই ভাবনাচিন্তা না করে সেদিকে হাঁটা ধরল।
অনেকদিন পর তানিয়া নিজের বান্ধবীদের সাথে সময় কাটাতে রেস্টুরেন্টে এসেছে। এক কথায় বলা যায় নিজেকে বেশি সময় দিতে চায় তানিয়া। প্রাক্তনকে ভুলে থাকতেই এই প্রচেষ্টা। হালকা বেগুনি রঙের জামা পরে চুলের বাঁকা বিনুনিতে এক সাধারণ রূপসীর ন্যায় ফুটে উঠেছে সে। বান্ধবীদের আড্ডার এক পর্যায়ে তানিয়ার এক বান্ধবী রিয়ানা বলল,
“কীরে তানি? গতকাল দেখলাম তোর আশিক, তোর প্রেমিক যে তোরে ছাড়া কিছু বুঝত না সে অন্য এক কচি মেয়ের সাথে এঙ্গেজমেন্ট সেরে নিয়ে ছবি পোস্ট করে লিখেছে মাই উডবি ওয়াইফ! তোর অনুভূতি কী?”
এইটুকু কথাই তানিয়ার কাটা গায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল যেন। মুখে হাসি বজায় রাখার চেষ্টা বৃথা গেল তানিয়ার। কারো সঙ্গে চোখ নেলাতে পারল না সে। চোখে পানি জমে গেছে তার।
“আমার আর কী অনুভূতি হবে! আমি ঠিকই আছি। দেখছিস তো তোরা।”
“এককালে দুইটার কত প্রেম! নিজের প্রেমিক নিয়ে খুব গর্ব করতিস তখন। গেল তো কাঁচকলা দেখিয়ে!”
তানিয়ার অন্য বান্ধবীর জবাবে তানিয়া মুখ খিঁচে বলল,
“বাদ দে এখন এসব কথা। আমি অতীতে যেতে চাইনা।”
রিয়ানা হেসে হেসে বলে,
“তোর বয়ফ্রেন্ড আমার ক্রাশ ছিল জানিস? প্রেম করতে চেয়ে দেখলাম তুই পটিয়ে ফেললি। আমার অভিশাপেই এই দশা তোর।”
এই বলেই হাসিতে ফেটে পড়ল তানিয়ার বান্ধবীমহল। রাগে-দুঃখে কান্না বেরিয়ে পড়ল তানিয়ার। মুখ লাল করে উঠে দাঁড়াল সে। কিছুটা জোরে বলল,
“রিয়ানা, তুই থামবি?”
তানিয়ার ধমকে যেন রাগ উঠল রিয়ানার। সেও দাঁড়িয়ে বলল,
“না থামলে কী করবি?”
নিজের রাগটা যেন সামলে ওঠা হলো না তানিয়ার। হাতের কাছে পানির গ্লাস পেয়ে সেটা নিয়ে রিয়ানার মুখে পানি ছুঁড়তে একবারও ভাবল না সে। তার কাণ্ডে হতবাক উপস্থিত সকলে। অপমানে রিয়ানার রাগ তখন তুঙ্গে। চিল্লিয়ে উঠল সে।
“তানিয়া তুই…”
এতটুকু বলেই তানিয়ার দিকে নিজের হাত দিয়ে থা/প্পড় মা/রতে উদ্যত হলো সে। এই মুহূর্তে তানিয়ার হাত ধরে সরিয়ে নিজের কাছে টেনে আনলো সৌমিত্র। অসময়ে সৌমিত্রকে দেখে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তানিয়া। সে বুঝতেই পারছে না এই অবস্থাতে সে কী করবে বা কী বলবে। সৌমিত্র তাকে শুধাল,
“ঠিক আছেন আপনি?”
তানিয়া শুধু মাথা দুলায়। সৌমিত্র তানিয়ার বান্ধবীদের দিলে তাকায়। সোজা কথায় বলে,
“বন্ধুরা হয় অসময়ে পাশে থাকার জন্য। দুঃখের সময়ে দুঃখ দিয়ে কথা বলার জন্য নয়। ভবিষ্যতে তানিয়ার সাথে মেশার চেষ্টা করবেন না। আপনারা কেউই তার যোগ্য নন।”
তানিয়া নির্বাক হয়ে রইল শুধু। হাত কোমল হাতটি ধরে সেখান থেকে বিদায় নিলো সৌমিত্র। বাহিরে এসে তানিয়ার হাত ছেড়ে হাফ ছাড়ল সৌমিত্র। তানিয়ার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় চেয়ে রইল। তানিয়া ঢক গিলে ইতস্তত হয়ে বলল,
“আসলে ধন্যবাদ…”
সৌমিত্র হাত উঠিয়ে ইশারায় তানিয়াকে থামতে বলল।
“ওখানেই থেমে যান মিস. গোলাপী। একটু আগে যা যা ঘটেছে সব ভুলে যান। খারাপ স্মৃতি দূর করে দিন।”
তানিয়া আবার নীরব হলো। সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“এখন আমার খিদে পেয়েছে। চলুন অন্য রেস্টুরেন্টে যাই। না খেলে এবার ম/রে যাব।”
“আমি…”
“হ্যাঁ আপনিও যাবেন৷ আপনার জন্য এখান থেকে অর্ডার দিয়েও বের হয়ে এলাম। এখন আপনি আমায় ট্রিট দেবেন। রাজি?”
তানিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল প্রথমে। এরপর খানিকটা খুশি হয়ে বলল,
“হ্যাঁ, রাজি!”
সৌমিত্র ইশারায় তানিয়াকে আগে হাঁটতে বলে। অতঃপর দুজনেই চলা শুরু করে। আর কিছু সময় পর সন্ধ্যা নেমে আসবে। আকাশ লাল লালিমায় আচ্ছন্ন। সৌমিত্র দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটছে। তানিয়া হুট করে বলে ফেলল,
“গতকাল সে এঙ্গেজমেন্ট সেরে নিয়েছে।”
তানিয়ার এই কথাই একবার তার দিকে তাকাল সৌমিত্র। তারপর আবার সামনে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
“তো দুঃখ কীসের এত? দাওয়াত দেয়নি বলে মন খারাপ?”
“আপনি সবসময় সব বিষয়ে মজা নিতে পছন্দ করেন?”
তানিয়ার কণ্ঠ ধরে এসেছে তখন। সৌমিত্র হাফ ছেড়ে বলল,
“সে আপনাকে ছেড়ে চলতে শিখে গেছে। আপনার উপর নির্ভরশীল নয় সে। তবুও যদি আপনি তার নির্ভরশীল থাকেন তবে তা দেখে আমি কেন পুরো দুনিয়া হাসবে। জীবনে তার উপরই নির্ভরশীল হবেন যে আপনার উপর নির্ভর করবে।”
“কখনো ভাবিনি একা চলতে হবে।”
“আমি আছি তো!”
ফট করে মুখ ফসকে বলে ফেলা কথাটা বলে নিজেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল যেন সৌমিত্র। হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল তার। ভীত চোখে তানিয়ার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করল। তানিয়ার চোখেমুখে তখন বিস্ময়। সৌমিত্র ততক্ষণে নিজেকে সামলে বলল,
“আই মিন, তোমার ইচ্ছে হলে তোমার মন খারাপের সময় আমায় ডেকে নিতে পারো। তোমার প্রয়োজনে ডাকতে পারো। প্রয়োজন না হলেও ডাকতে পারো। আমি সবসময় উপস্থিত থাকব।”
তানিয়া মৃদু হাসল এবার। অতঃপর চলতে শুরু করল সে। সৌমিত্র নিজেই বোকা কথা বলার জন্য নিজের কাছে লজ্জিত হলো যেন!
গাড়ি এসে স্থির হলো মোহের বাড়ির রাস্তার সামনে। এতক্ষণ চুপ থাকা মোহ এবার বলল,
“আপনার ভাইকে নিলে তো কোনো সমস্যা… ”
মোহের কথা সম্পূর্ণ হতে দিলো না স্বচ্ছ। তার বাম হাতটি মোহের কপালে রেখে মোহের হাত সিটে ঠেকিয়ে দিয়ে বলল,
“কথা বলবে না বেশি। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। আর ওকে নিতে বলছ! ও মেয়েদের থেকেও বেশি কথা বলে।”
মোহ আর কিছু বলার সাহস পেল না। আজকে একটু বেশিই গম্ভীর লাগছে স্বচ্ছকে। বারবার তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে মোহ। একসময় উৎসুক হয়ে বলে ফেলল,
“কিছু হয়েছে?”
স্বচ্ছ সামান্য হকচকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“কেন?”
“আপনাকে অন্যরকম লাগছে আজকে।”
স্বচ্ছ ঢক গিলে ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির কাঁচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, কিছু হয়নি।”
“তাহলে আমি যাই এখন?”
তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছ নিজের সমস্ত দুশ্চিন্তা ঢেলে বলল,
“একা যেতে পারবে তো। মাথা ঘুরে আসবে না তো? আমি এগিয়ে দেই?”
মোহ মৃদু হেসে বলে,
“প্রয়োজন নেই। আমি একদম ঠিক আছে। আর মাথা সামান্য কে/টে গেছে। এর বেশি কিছু হয়নি। আমি আসছি।”
স্বচ্ছ আর জবাব দিলো না। তার নীরবতা দেখে দরজা খুলল মোহ। আচানক স্বচ্ছ ডেকে উঠল,
“মোহ!”
আচমকা ডাকে সামান্য চমকে গিয়ে স্বচ্ছের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল মোহ। স্বচ্ছ সামান্যতম লজ্জা ছাড়াই মোহের চোখে চোখ রেখে বলল,
“আই ওয়ান্ট টু কিস ইউর হ্যান্ড।”
চক্ষু যেন কপালে উঠল মোহের। লোকটা কি সকল লাজ বিক্রি করে এসেছে? ঘনঘন চোখে পলক ফেলে দেখতে থাকল স্বচ্ছকে। মোহ অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে পুনরায় শুধাল,
“হু?”
জবাবটা আর পেল না মোহ। স্বচ্ছ মোহের দুটি হাত নিজের হাতের মুঠোর নিয়ে আকস্মিকভাবে নিজের ঠোঁটের স্পর্শখানি যত্ন করে মোহের দুই হাতের তালুতেই লাগিয়ে ফেলল। মুহূর্তেই এমন কাজে প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করতেই যেন সময় চলে গেল মোহের। ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেল হাত দুটো। কান গরম হয়ে গেল। জবানটা সামান্যও খুলল না তার। স্বচ্ছ এবার নিজের দরজা খুলে দিলো মোহের জন্য। ঢক গিলে গাড়ি থেকে নামল মোহ। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট দিলো স্বচ্ছ। একবার তাকালও না লাজুক মোহের পানে। লাজুকতার আবরণে মেয়েটির মুখশ্রী যে চোখ ধাঁধানো ছিল তা স্বচ্ছ জানে। তাই-ই তো পুনরায় চোখ তুলে তাকায়নি সে।
বসার ঘরের সোফায় বসে রয়েছেন সরোয়ার সাহেব। ইতিমধ্যে মিসেস জেবা বেশ কয়েকবার বলেছেন উনাকে নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে। তবে শুয়ে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগছে না উনার। স্থির হয়ে বসে থেকে মস্তিষ্কে যেন বিভিন্ন গুটি সাজাচ্ছেন তিনি। যার মাধ্যমে এসব ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। দ্রুত বাড়ির কোনো এক সহকর্মী ছুটে এসে খুলে দিলো দরজা। সরোয়ার সাহেব তাকিয়েই দেখলেন নিজের বড়ো ছেলে। স্বচ্ছ দরজায় দাঁড়িয়েই রুক্ষ সুরে বলল,
“আমি ফিরে এসেছি, বাবা।”
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৬ [দ্বিতীয় খণ্ড]
রাতে খাবার টেবিলের কাছে এসে মুখ হা হয়ে গেল সৌমিত্রের। মিসেস জেবা একেকটা খাবারের পদের বাটি সাজাচ্ছেন খুশিমনে। এত পদের খাবার দেখে তার হঠাৎ মনে হলো এগুলো সব স্বচ্ছের পছন্দের খাবার। সৌমিত্র হাত দিয়ে একটা চিংড়ি মাছ তুলতে গেলেই মিসেস জেবা এসে ধমকে উঠলেন।
“এই রাখ ওটা। আমার ছেলে টেবিলে এসে খেতে না বসা পর্যন্ত একটা খাবারেও হাত দিবি না।”
সৌমিত্র হতবাক হলো। মিসেস জেবা ফের রান্নাঘরে গেলেন। সৌমিত্র চিল্লিয়ে মাকে শুধাল,
“মানে কী? ভাইয়া কোথায়?”
“কোথায় আবার? আমার স্বচ্ছ বাড়ি ফিরে এসেছে। খবর রাখিস তুই? সারাদিন তো তোর নিজেরই কোনো খবর থাকে না।”
সৌমিত্র চিন্তায় পড়ে গেল ভীষণ। গভীর ভাবনায় পড়ে গেল। বিড়বিড়িয়ে নিজে নিজেকে বলল,
“ভাইয়া এভাবে বাড়ি চলে এলো? এত তাড়াতাড়ি হার মেনে গেল বাবার কাছে? এইতো আজকেই তো বলল চাকরি খোঁজার কথা। আবার আজই বাড়ি চলে এলো। বিষয়টা মিলছে না কেন?”
আগামাথা কিছুই না বুঝতে পেরে যখন সৌমিত্র স্বচ্ছের ঘরে যেতে উদ্যত হলো তখন স্বচ্ছ নিজেই উপস্থিত হলো খাবারের টেবিলে। ভাইয়ের গম্ভীর ভাবটা ভাবালো সৌমিত্রকে। তৎক্ষনাৎ সে স্বচ্ছের হাত চেপে ধরে বলল,
“তুমি বাড়িতে ফিরে আসবে আমাকে জানালে না তো? তুমি নিজের জেদকে নিজেই দাবিয়ে দিলে? ভাবতে পারছি না!”
স্বচ্ছ বড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে পড়ল। অতঃপর বলল,
“অনেক ভেবেচিন্তেই ফিরে এসেছি। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি আমার একেকটা পদক্ষেপের উপর অনেক কিছু করছে।”
সৌমিত্রের আর কিছু বলার সুযোগ হলো না। সরোয়ার সাহেব এসে বসলেন খাবার টেবিলে। সৌমিত্রও সুড়সুড় করে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল। সরোয়ার সাহেব সৌমিত্রের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,
“আমি অনেক খুশি হয়েছি তোমার ফিরে আসাতে।”
স্বচ্ছের গম্ভীর মুখে সামান্য হাসির রেখার দেখা মিলল। বাবার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“আশা করি এই খুশিতে তুমি তোমার কথাও রাখবে। আমার জন্য আমি আর অন্য কোনো মানুষের জীবনে ঝামেলা চাই না।”
সরোয়ার সাহেব ছেলের দিকে বেশ গভীরভাবে তাকালেন।
“আমার কথা শুনে চলো স্বচ্ছ। তোমার খারাপ হবে না কখনো।”
স্বচ্ছের মুখে হাসির রেখা আরো প্রগাঢ় হলো। বাধ্যগত ছেলের ন্যায় যেন বলল,
“তুমি আমার বাবা। তোমার একেকটা কথা সাথে সাথে পালন তো আমাকে করতেই হবে।”
সরোয়ার সাহেব এবার খানিকটা বিস্মিত হলেন ছেলের আচানক এতটা পরিবর্তনে। উনি ঠিক বুঝলেন না স্বচ্ছের পরিবর্তন ঠিক কীসের কারণে! সে কি মোহের নিরাপত্তা নিয়ে অস্থির নাকি বিষয়টা অন্য? অপরদিকে সৌমিত্র নিজেও নিজের বিস্ময়ের অবকাশ করতে পারছে না। ভাইয়ের এত বিনয় ব্যবহার দেখে মাথা ভনভন করছে তার। না জানি কী চলছে তার ভাইয়ের মাথায়!
ফাঁকা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে ফারাহ নিজ অফিসের বাহিরে। একটু আগেই খবর পেয়েছে তার ভাইয়ের বাড়িতে ফেরার। এরপর সে নিজেও বেশ চমকেছিল। সে স্বচ্ছকে যতটা জেদি হিসেবে জানে সে মনে করেছিল তার ভাই কোনোদিন ওই বাড়িতে পা রাখবেই না। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টেছে স্বচ্ছ। হয়ত বাবার অসুস্থতার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল ফারাহ। কিন্তু এই ব্যস্ত শহরে তার জন্য একটাও খালি গাড়ি নেই। তার গাড়িটার কাঁচ ভেঙে ফেলেছিল সেদিনের ছেলেপেলে। সেটাই ঠিক করতে গ্যারেজে দেওয়া হয়েছে। এখন বেশ বিরক্ত হয়েই সামনে হাঁটা ধরল ফারাহ। কংক্রিটের ফুটপাতে মিনিট দুয়েক হাঁটতে হাঁটতে হুট করেই উঁচু হিল জুতো পরা পা মচকে গেল। ফলে হিলের অংশটুকু ভেঙে গিয়ে ফারাহর পা আরো মুচড়ে গেল। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল ফারাহ। অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠল সে। ফুটপাতের কিছু লোক তার দিকে তাকাল কিন্তু এগিয়ে এলো না কেউই। চোখমুখ জড়িয়ে কোনোরকমে পায়ের হিল জুতো দুটোই খুলে হাতে নিলো। এইভাবে আর হাঁটা সম্ভব নয় তার। ভাবল সে সৌমিত্রকে কল করবে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ পরক্ষণেই ভাবলো এখান থেকে বাড়ির দূরত্ব অনেকটা দূরেই। সৌমিত্রের আসতে অনেক সময় লাগবে। আশেপাশে তাকিয়ে গাড়ি খুঁজতে যেয়ে একধাপ ফেলতে গেলেই যেন ব্যথায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে তার। চোখে পানি টলমল করছে। ব্যথা কমার অপেক্ষা করতে রাস্তাতেই চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছু সময়। অতঃপর ফোন বের করে স্বচ্ছের নম্বর ডায়াল করতে চাইতেই হুট করে এক গাড়ি কেউ একজন দাঁড় করায় তারই সামনে। হঠাৎ এমন কাণ্ডে চমকে ওঠে ফারাহ। রাগও লেগে যায় তার। রাগটা আরো বেড়ে যায় যখন গাড়ি থেকে শৌভিককে বেরিয়ে আসতে দেখে। অন্যদিক ঘুরে সে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে ফের ব্যথায় থেমে যায়। হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে থাকে। শৌভিক এসে সরাসরি ফারাহর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। বেশ আগ্রহী হবার ভান করে জানতে চায়,
“এ কী! মন্ত্রী সাহেবের একমাত্র ছোটো আদরের মেয়ে রাস্তায় জুতা হাতে নিয়ে কী করছে!”
ফারাহ আগুন চোখে শৌভিককে লক্ষ করেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। শৌভিকের নজর গেল ফারাহর পায়ের দিকে। ফারাহ খালি পায়ে দাঁড়িয়ে সেই সঙ্গে তার হাতে ভাঙা হিল জুতো দেখে ঘটনা উপলব্ধি করে ফেলল সে। খানিকটা চিন্তিত হলো যেন। চশমার ফাঁকে কপালে হালকা ভাঁজ দেখা গেল। নরম গলায় শুধাল,
“পা কি মচকে গেছে?”
ফারাহ তবুও মুখ ফুলিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে। শৌভিক আবার বলল,
“কী কথা বলবেন না? আপনার বাবাকে জে/লে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছি জন্য রাগ করেছেন আমার উপর?”
ফারাহ শুধু ফুঁসছে যেন। হুট করে জোরে বলে উঠল,
“আপনার সাথে কথা বলে কী লাভ বলুন তো? আপনার সাথে কথা বললে শুধু ধোঁয়াশা বাড়ে মানুষের। আর কিছু না।”
শৌভিক না চাইতেও মৃদু হাসে। জিজ্ঞাসা করে ফারাহকে,
“আর কোনো অভিযোগ আছে?”
ফারাহ আবার ক্রোধের সহিত তাকাল। রমনীর নেত্র দুটোতে যেন আগুন জ্বলছে। অত্যন্ত বিদ্রুপ করে বলল,
“জি, না। আপনি এখন আসতে পারেন।”
শৌভিক তার উত্তর না দিয়েই ফারাহর হাত থেকে জুতো নিজের হাতে নিয়ে নেয়। হতভম্ব হয়ে তাকায় ফারাহ। ধমকে প্রশ্ন করে,
“কী করছেন?”
“এভাবে রাস্তায় অতি সুন্দরী রমনী দেখলে রাস্তার সব কুকুর দৌড়ে আসবে রমনীর কাছে। তাই তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। তাকে আমার গাড়িতে ওঠার অনুরোধ করছি! দয়া করে সে যেন আমার অনুরোধটা রেখে বাধিত করে।”
শৌভিকের কথা যেন হজম হলো না ফারাহর। অন্যদিকে তাকিয়ে ভার গলায় বলল,
“আমি একাই যেতে পারব।”
“আপনাদের পুরো বংশের কি সকলের এই সমস্যা আছে? আপনাদের কাজকর্ম যেমনই হোক, মুখ অত্যন্ত বেশি চলে।”
ফারাহ আঁখি দুটি বড়ো বড়ো করে তাকাল এবার। ক্রোধ ঝেরে বলল,
“কী বললেন আপনি?”
শৌভিক হাসার ভান ধরে ঘাড় বাঁকা করে বলল,
“না, কিছু না। আমার সঙ্গে যাবেন ম্যাডাম প্লিজ?”
ফারাহ আগপাছ ভেবে নিলো এবার। এই মুহূর্তে লোকটির সাথে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় দেখতে পেল না সে। তাই গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হুঁ। নেহাতই আজকে আমার পা মচকে গেছে তাই। নয়ত আপনার সাহায্য নিতাম না।”
শৌভিক অন্যদিক মাথা ঘুরিয়ে হালকা হাসল। অতঃপর নিজের বাহু এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাঁটতে তো পারছেন না। ধরুন আমার হাত। হাত ধরবেন নাকি এটার জন্যেও অনুরোধ করতে হবে?”
ফারাহ কোনো কথা না বলে এবার দুহাতে শৌভিকের বাহু জড়িয়ে ধরল। মিনমিন করে বলল,
“আমার জুতা আপনি ধরবেন না প্লিজ। দরকার হলে ফেলে দিন।”
“এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি গাড়িতে উঠুন।”
ফারাহ মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে পায়ের ধাপ ফেলে গাড়ি পর্যন্ত এলো। তার নাকে আসছে শৌভিকের পারফিউমের মৃদু সুগন্ধ। এর আগে কখনো মানুষটির এত কাছাকাছি আসেনি সে। কোনো কারণ ছাড়া ভর করা লজ্জায় তার বুক ধুকপুক করছে। শৌভিক গাড়ির দরজা খুলে দিতেই সিটে বসে পড়ল ফারাহ। এরপর হাফ ছাড়ল সে। মন খুলে শ্বাস নিতে না নিতেই শৌভিক নিচে বসে পড়ল ফারাহর পায়ের কাছে। হকচকিয়ে উঠল ফারাহ। শৌভিক শুধু জানতে চাইল,
“বাম পায়ে লেগেছে তাই না?”
ফারাহ হ্যাঁ বলারও সুযোগ পেল না। শৌভিক ফের ফারাহর পায়ে হাত দিয়ে সরাসরি মুচড়ে দিলো। ব্যথায় চিৎকার করার সময়টুকুও পেল না ফারাহ। হা করে বোবার মতো বসে রইল সে। শৌভিকও গাড়িতে উঠে বসে বলল,
“পা ঠিক হয়ে গেছে আপনার। এরপর থেকে একটু নিচু জুতো পরার চেষ্টা করবেন। আমার আইফেল টাওয়ার দরকার নেই।”
ভালোমতো কানেই এলো না যেন শৌভিকের কথা। ফারাহ আবার চমকে তাকিয়ে বলল,
“কী বললেন?”
শৌভিক ঠোঁট টিপে হেসে মাথা নাড়িয়ে জানালো, ‘কিছু না।’
সারারাস্তা চুপচাপ এলো দুজন। গাড়িটা যখন ফারাহর গন্তব্যে পৌঁছল তখন ফারাহ শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় শৌভিকের দিকে। নিচু গলায় বলে,
“আমি যখনই বিপদে পড়ি তখনই আপনাকে পাই কেন বলুন তো? আপনি আমাকে ফলো করেন নাকি সবই কাকতালীয়?”
শৌভিক চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে,
“কাকতালীয় ব্যাপার আমার পছন্দ নয়। পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে তার পেছনে একটা করে কারণ থাকে। সেই কারণ হয়ত পরে প্রকাশ পায়। কিন্তু কারণ তো অবশ্যই।”
ফারাহ আর কথা বাড়াতে সাহস পেল না যেন। গাড়ির দরজা খুলে বলল,
“আমি আসছি। ধন্যবাদ আপনাকে।”
ফারাহ নেমে গেল। শৌভিক চলে গেল নিজ বাড়ির দিকে। ফারাহ একমনে তাকিয়েই রইল শুধু। মনে মনে ভাবল, মানুষটা একটু উদ্ভট বেপরোয়া ধরণের। তবে এই বেপরোয়াগিরিতে কোথাও কোথাও রয়েছে নম্রতা৷ ফারাহ নিজমনে বলে ফেলল,
“আপনার সঙ্গে বারবার দেখা হোক কারণে অকারণে।”
স্বচ্ছকে বেশ কয়েকবার কল করেও তার খবর পাওয়া গেল না। মোহ ভার মুখে নিজের ফোনটা রেখে দিলো। খানিকটা চিন্তা হচ্ছে তার। স্বচ্ছের অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা ভাবাচ্ছে তাকে। ইথানের ডাকে আধশোয়া হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে আরম্ভ করল সে। ইথান চোখ বুজল শান্ত হয়ে। তার বাড়িতে থমথমে পরিবেশ। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই মিসেস সুফিয়া শুরু করেছিলেন তাণ্ডব৷ মোহকে বাড়ির বাহিরে বের হতে দিতে নারাজ তিনি এবার। অনেক ভাবনাচিন্তা করে আবার উঠে বসে মোহ। কপালে থাকা চুল পেছনে ঠেলে দিয়ে ফোন নিয়ে জানালার কাছে এসে ফের কল করে স্বচ্ছকে।
বড়ো জানালার কাছে চেয়ার নিয়ে বসেছে স্বচ্ছ। রুমে শুধু জ্বালিয়ে রেখে ড্রিমলাইট। অন্ধকার আকাশটা মাঝে মাঝে চমকাচ্ছে। বাতাসে উথাল-পাতাল করছে জানালার দুটো পর্দা। স্বচ্ছের ধ্যান, চোখ দুটোই স্থির। সৌমিত্র তার মাঝেই হুড়মুড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। স্বচ্ছের তাতে ভাবান্তর ঘটল না। সে জানে সৌমিত্র ছাড়া এখন ঘরে কেউ আসবে না। সৌমিত্র গুটিপায়ে ভাইয়ের নিকট ধাবিত হতেই দেখে বিছানায় একাধারে বাজছে স্বচ্ছের ফোন। দেরি না করে ফট করেই ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে নাম দেখে দাঁত বের করে হেসে বলে,
“ভাই! ভাবীজান তোমাকে মিস করা শুরু করে দিয়েছে। নাও তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করো।”
স্বচ্ছের মধ্যে তবুও হেলদোল দেখা গেল না। চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে শান্ত চোখ দুটো তার বাহিরেই দৃষ্টিপাত করছে। সৌমিত্র জোরে ডাকল এবার।
“ভাইয়া! শুনতে পাচ্ছো? ভাবী কল করেছে!”
স্বচ্ছ মাথা ঘুরিয়ে দেখল এবার সৌমিত্রকে। দৃঢ় গলায় বলল,
“করতে দে তাকে কল।”
“রিসিভ করবে না তুমি?”
“না।”
স্বচ্ছের জবাব যেন একেবারেই হজম হলো না সৌমিত্রের। ভাইয়ের কাছে এসে বড়ো বড়ো করে চোখ পাকিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“বলো কী তুমি?”
সৌমিত্র পরক্ষণেই থেমে স্বচ্ছের দিকে পিটপিট করে চেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
“ওহ হো! ঝগড়া হয়েছে লাভবার্ডসের মধ্যে। তা কী নিয়ে ঝগড়া করলে তোমরা? এইত বিকালেই হসপিটালে রোমান্টিক লাভারের মতো জড়িয়ে ধরলে তাকে। তারপর কী এমন হলো? বলো কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে? বলো, বলো! আমি সলিউশন করে দেব। আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে লাভগুরু বলে চেনে জানো তো?”
স্বচ্ছের চোখে দেখা গেল না বিন্দুমাত্র বিচলতা। সৌমিত্রের কথাতে বিন্দুমাত্র জবাব দিলো না সে। একটা সময় সে হুট করে বলল,
“আমি ঠিক করেছি মোহের আমি আর কোনো যোগাযোগ রাখব না। অতীতের স্বচ্ছ হতে চাই আমি।”
স্বচ্ছের কথা কর্ণপাত হওয়ার পর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় সৌমিত্রের। থম মে/রে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে স্বচ্ছের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্বচ্ছের কপাল, গাল হাতিয়ে নিলো সে। ঢক গিলে বলল,
“ভাইয়া! তুমি ঠিক আছো? কোনো অসুখ করেনি তো তোমার? নাকি রাতে উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছ? ভুল করে ড্রিংক করে ফেলো নি তো?”
স্বচ্ছ সৌমিত্রকে দূরে ঠেলে দিয়ে বিছানায় এসে বসে বলল,
“আমি ঠিক আছি। সজ্ঞানে কথা বলছি!”
সৌমিত্র তড়িঘড়ি করে বসে স্বচ্ছকে চেপে ধরে বলে,
“ভাইয়া তোমার নিশ্চয় কিছু হয়েছে। তুমি বাবার সামনে চিৎকার করে বলেছিলে তুমি ভাবীকে ভালোবাসো। কী হলো হঠাৎ তোমার?”
স্বচ্ছ যেন তীব্র বিরক্তবোধ করল এবার৷ অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
“মানুষের মন পাল্টায় আমারও পাল্টে গেছে৷ তখন পা/গলামি করেছি এখন একটু ম্যাচিউর চিন্তাভাবনা করার চেষ্টা করছি। দ্যাটস ইট। আর এটাতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমার এই সিদ্ধান্তে আমি আর মোহ দুজনেই শান্তিতে থাকব।”
“ভাইয়া তোমাকে আমি কখনো কোনো মেয়ে মানুষের জন্য পাগলামি করতে দেখিনি। এই প্রথম তোমায় দেখেছিলাম যে তুমি কতটা ডেস্পারেট হতে পারো একটা মেয়ের জন্য। তাকে তুমি এভাবে ছেড়ে দিচ্ছো বিশ্বাস করতে পারছি না। আর মোহও হয়ত তোমাকে…”
কথাটুকু শেষ করবার আগে স্বচ্ছের তীক্ষ্ণ চাহনিতে বন্ধ হলো তার কথা। বিছানা থেকে উঠে বাহিরে বের হতে উদ্যত হলো সে। তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছ পিছু ডেকে বলে ওঠে,
“কামাল আঙ্কেল বর্তমানে কোথায় আছে জানিস?”
“শুনেছি কাস্টারিতে। তার বিরুদ্ধে নাকি প্রমাণ পাওয়া গেছে। একাউন্টে উনার সেইসব টাকা ট্রান্সফারের ইনফরমেশন ছিল যা ফ্যাক্টরির জন্য ছিল। তাই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
স্বচ্ছ আর প্রত্যুত্তর করল না। সৌমিত্র অনেকটা বিষণ্ণ হয়েই চলে এলো। ভাইয়ের এমন পরিবর্তন সে মানতে নারাজ! সৌমিত্র চলে গেলে নিজের ফোনের দিকে একবার তাকাল স্বচ্ছ। মোহের ৮ বার কল এসেছে। নিজের হাতটা মুঠো করে নিজেকে সংযত করল সে।
স্বচ্ছ ফোন তুলল না। ফোনটা রেখে দিলো মোহ ক্লান্ত হয়ে। হয়ত লোকটা ঘুমোচ্ছে। হয়ত সেও ভীষণ ক্লান্ত! তবুও মনটা সেই বুঝ মানতে চাইছে না। ভার হয়ে যাচ্ছে বারংবার। বেখেয়ালি মোহের খেয়াল হলো ইথান তাকে ডাকছে।
“মাম্মা! তুমি ঘুমাবে না?”
মোহ মলিন হেসে উত্তর দেয়,
“ঘুমাব তো।”
“কখন? তোমার তো ব্য;থা লেগেছে। তুমি তো বলো কোথাও লাগলে বেশি বেশি রেস্ট নিতে হয়। তাহলে তুমিও তাড়াতাড়ি ঘুমাবে এসো। তাহলে তুমি ভালো হয়ে যাবে।”
ছোট্ট ইথানের সঙ্গে কথাতে পারল না মোহ। ধীর পায়ে বিছানায় এসে ইথানের পাশে শুয়ে পড়ল। ইথান আবারও চোখ বুজল। মোহ একমনে তাকিয়ে রইল তার নিষ্পাপ মুখখানার দিকে। আচ্ছা, ঈশানী তো ফিরে এসেছে। এখন নিশ্চয় সে ইথানকে নিজের কাছে রাখতে চাইবে। মোহও ইথানকে তার কাছে দিতে বাধ্য। কিন্তু এতগুলো বছরের মায়া কি সে আদেও কাটাতে পারবে?
সকাল সকাল রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে মোহ। সঙ্গে এসেছে ইথান। মিসেস সুফিয়াকে অনেকটা মানিয়ে বের হতে হয়েছে তাকে। বলতে গেলে মায়ের অবাধ্য হয়েই বেরিয়েছে মোহ। কারণটা ঈশানী। তারা দুজন খাচ্ছে। ঈশানী মাঝে মাঝে ইথানকে খাওয়াচ্ছে। এরই মাঝে ঈশানী বলল,
“তোর এই অবস্থা আমায় বলিস নি তো? তাহলে বাড়ি থেকে বের হবার কী দরকার ছিল?”
মোহ হাফ ছেড়ে বলে,
“তুইও মায়ের মতো করিস না তো। সামান্য কপাল একটু কে/টে গেছে। আর তোরা এমন ভাব করিস যেন আমি কোমায়।”
ঈশানী হেসে দিলো। মোহ আবার বলল,
“আর কতদিন বাহিরে কাটাবি তুই? তোকে কোথাও পারমানেন্ট হতে হবে তো।”
“হুঁ, ভাবছি এই বিষয়ে।”
দুই বান্ধবীর কথা আর খাওয়া চলতে থাকল এভাবেই।
আজ বিয়ের জন্য এক পাত্রীর সঙ্গে আলাদা করে দেখা করার জন্য রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে আরিদ্র। অপেক্ষা করছে মেয়ের জন্য। এরই মাঝে একটা কফি অর্ডার দিয়ে সে ওয়াশরুমের দিকে যেতে উঠে দাঁড়াল। আচানক জোরে হাসির আওয়াজ শুনে ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে দেখল সে। মুহূর্তে মস্তিষ্ক শূন্য হলো তার৷ তড়িৎ গতিতে বসে পড়ল। মাথার চুল একহাতে চেপে ধরল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“মেয়েটা মোহ না?”
হাত-পা কাঁপছে আরিদ্রের। কী করবে এই মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারছে না। নিশ্চিত হতে সাহস নিয়ে সে আবারও উঠে দাঁড়াল। আবারও মোহের চেহারা চিনতে ভুল হলো না তার। বসে পড়ল সে। এইতো সেদিন ঈশানীর পালানোর খবর পেয়েছে। সেটা তার একটি অতিরিক্ত চিন্তা। তার উপর মোহকেও এই শহরে দেখে নিজের অতীত যেন আরেকবার ঘুরে এলো সে। একই সময়ে তার ফোনে হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের টোন বেজে উঠল। নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় ফোনের মেসেজ ওপেন করল সে। তার আঙ্কেল অর্থাৎ সরোয়ার সাহেব তাকে সেই নির্দিষ্ট মেয়েটির ছবি পাঠিয়েছে। যাকে ঘিরে সরোয়ার সাহেবের এত সমস্যা। ছবি ওপেন করেই ফোনটা হাত থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হলো তার। চোখ ডলে আবারও দেখল। সে কী ভুল দেখছে? মোহের ছবি জ্বলজ্বল করছে ফোনে। এবার যেন নিজের অতীতেই জড়িয়ে গেল আরিদ্র।
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷ গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]