#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৭ [দ্বিতীয় খণ্ড]
রেস্টুরেন্টের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আরিদ্র। চোখমুখ ফ্যাকাসে, বর্ণহীন। একটু শান্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন পারছে না সে। নিজেকে কোনোরকমে স্থির করে নি/ষিদ্ধপ/ল্লীর প্রধান মহিলা হেনাকে কল করল সে। হেনা কল রিসিভ করতে চাইছিলেন না। ভয় পাচ্ছিলেন। একমাত্র ঈশানীর পালানোর জন্য প্রচণ্ড ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে উনাকে। তবে তিনি জানেন, কলটা না ধরলে আরিদ্রও উনাকে ছাড়বে না। কল রিসিভ করতেই আরিদ্র তাড়াহুড়ো নিয়ে বলল,
“ঈশানীর কোনো খবর পাওয়া গেছে?”
হেনা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলেন। কাঁপা সুরে উত্তর দিল,
“না, খোঁ…খোঁজ চলছে। পেয়ে যাব খুব দ্রুত। এই নিয়ে ভাববেন না বেশি।”
“কতগুলো সময় পার হয়ে গেছে আপনার খেয়াল আছে মিস. সর্দারনি? আমাকে যদি এখন ফাঁসতে হয় আপনাদের ব্যবসা কিন্তু থাকবে না আর।”
হেনা তোতলাতে থাকেন। কিছু বলতে চাইলেন তবে তার আগেই আরিদ্র বলল,
“আপনাদের তো অনেক বড়ো হাত থাকে। তা দিয়েও কিছু করতে পারছেন না? ইউজলেস আপনারা।”
হেনাকে কিছু বলবার সুযোগই দিলো না আরিদ্র। কল কেটে দিয়ে সমস্ত রাগে ফোন জোরে চেপে ধরল সে। সে দ্রুত গিয়ে গাড়িতে বসল। যেকোনো সময় মোহ বের হতে পারে। এখনি সে চায়না মোহের সামনাসামনি হতে। সে চেনে মোহকে। অনেক আগ থেকে দেখে এসেছে। কোনো কিছু হলে নিজের সাধ্যমতো কুরু;ক্ষেত্র বাঁধাতে জানপ্রাণ লাগিয়ে দেয় সে। ভয়টা তার মোহকে নিয়ে নয়। তার অতীতের ঘটনা বেরিয়ে আসা নিয়ে। কথাগুলো নিয়ে ধ্যানে থাকতে থাকতে হঠাৎ মোহকে আর ঈশানীকে রেস্টুরেন্টের বাহিরে আসতে দেখল আরিদ্র। ঈশানী তখন বোরখা পরিহিত। চোখমুখ সবই ঢাকা। তাই তার দিকে আর নজর পড়ল না আরিদ্রের। সে তার প্রতিটা সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে দেখল মোহকে। অবশেষে নিজের নোংরা দৃষ্টিটাও যেন আগের ন্যায় জেগে উঠল।
“স্বচ্ছের পছন্দ ভালো। এমনিতে ওকে তো আমিও ঈশানীর মতোই নিজের কন্ট্রোলে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই মোহ ঈশানীর মতো বোকা নয়। আবার যখন ভাগ্য চেয়েছে তোমার সাথে দেখা করাতে তখন এই সুযোগ আবার কাজে লাগাতে হবে।”
নিজের মনের গহীনে কথাগুলো আওড়ায় আরিদ্র। পরক্ষণেই স্মরণে এলো ঈশানীর কথা। দেখল মোহের হাত ধরে থাকা ছোটো ছেলে বাচ্চাকে। ফের নিবিড় ভাবনায় মজে গেল সে। বাচ্চাকে নিয়ে ভাবতে গিয়েও ভাবতে পারছে না। এটা তো অন্য কারোর বাচ্চাও হতে পারে! নিজে নিজেকে সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ঈশানীর কেউ নেই বর্তমানে মোহ ছাড়া। ওর খোঁজ পাওয়া গেলে মোহের কাছেই পাওয়া যাবে। নজর রাখতে হবে ওর দিকে।”
নিজের চিন্তার অন্ত ঘটিয়ে নিজের ফোনে মাকে কল করে সে সরাসরি বলে দিলো,
“মা, আমি আজকে মেয়ের সাথে দেখা করতে পারব না। আমার জরুরি কাজ এসে পড়েছে। কষ্ট করে কাল দেখা করতে বলে দিও, প্লিজ।”
রিকশায় বসেছে ঈশানী আর মোহ। বেখেয়ালি মোহের মন ফোনের দিকে আঁটকে। ক্ষণে ক্ষণে হাতের ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে সে। গত রাত থেকে স্বচ্ছের কোনো খবর না পেয়ে ভেতরে ভেতরে ভীতি জমেছে তার। আবার রাগও লাগছে মাঝে মাঝে। এভাবে যোগাযোগ না করে কীভাবে একটা লোক বেপাত্তা হয়ে যায়? মোহের উত্তাল অন্তরিন্দ্রিয়ে শুধু এবং শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে স্বচ্ছ নামক নাম। মনে সংশয় জাগছে, ক্লাবের দিকে যাবে কী না! আগপাছ ভাবতে ভাবতে নিজেকে সায় দিয়ে সে ঈশানীর দিকে তাকাল। ঈশানী ইথানকে কোলে দুহাতে আগলে ধরে বসে রয়েছে আর নানান গল্পে মেতেছে। ইথানও বেশ আগ্রহের সহিত গল্প করছে। মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে ঈশানীর সাথে প্রচণ্ড মিল হয়ে গেছে তার। অথচ ইথান সহজে কারোর সাথে মিশতে চায় না। হয়তবা একেই বলে মায়ের প্রতি টান। ওদের দুজনকে দেখতে দেখতে মোহ ঈশানীকে বলে ওঠে,
“ঈশানী! আমরা কি বাড়ি…”
ঈশানী তৎক্ষনাৎ চমকে গিয়ে বলে ওঠে,
“না! একটা আবদার আছে তোর কাছে। আজকে সারাদিনটা ইথানকে নিয়ে আমার সাথে কাটাবি প্লিজ?”
মোহ বিভ্রান্তিতে পড়ল। কী বলবে বুঝে উঠতে সময় লাগল। ঈশানী মোহের এক হাত ধরে বলে,
“ইথানকে আমি খুব একটা বেশি সময়ের জন্য কাছে পাইনা। ওকে নিজের কাছে রাখার সামর্থ্যও আমার নেই। আমি জানি তোর মাথায় লেগেছে কিন্তু…।”
ঈশানী থামলো। আবার বলল,
“আচ্ছা তোর কি বেশি শরীর খারাপ করছে? তবে যা। অন্যদিন না হয় ইথানের সাথে সময় কাটাব।”
মোহ ম্লান হাসে। কোমল সুরে বলে,
“আমার মোটেই শরীর খারাপ করছে না। মাথায় সামান্যই লেগেছে। খুব একটা ব্লি/ডিংও হয়নি। আর তুই ইথানের সাথে সময় কাটাবি আমি মানা করার কে বল তো?”
ঈশানী চোখ দুটোই যেন খুশিতে ভরে উঠল। অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলল,
“তাহলে চল আশেপাশের পার্কে যাই। ইথান খুশি হবে।”
মোহ হেসে সায় দেয়। কিন্তু হৃদয় যে তখনও ব্যাকুল। খানিকক্ষণের মাঝে বেজে ওঠে মোহের ফোনটি। অবচেতন মন তখন একটাই নাম যে এইবার নিশ্চিত এটি স্বচ্ছ। শুকনো কলিজায় পানি এলো যেন। অতিরিক্ত অস্থিরতায় নম্বর দেখার প্রয়োজনবোধ করল না সে। দ্রুত কল রিসিভ করে বলল,
“এতক্ষণে সময় হলো আপনার?”
,ওপরপাশে থেকে মেয়েলি মোটা সুরের ধমক ভেসে এলো তৎক্ষনাৎ।
“আপনার তো এতক্ষণেও সময় হয়নি বাড়ি ফেরার। কখনো আসবি তুই?”
দ্রুত নিজের কান থেকে ফোন সরিয়ে মায়ের নম্বরটা দেখে বিষাদে চোখ খিঁচে বন্ধ করে রইল মোহ। অতঃপর কানে আবার ফোন ধরে,
“মা, আমার দেরি হবে। তুমি চিন্তা করছ কেন? আমি চলে আসব। আজকে আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে অনেকদিন পর দেখা হয়েছে। তাই সারাদিন ওর সাথে থাকব।”
মিসেস সুফিয়া রাগে কটমট করে ওঠেন। চিল্লিয়ে বলেন,
“তুই কি আমাকে চিন্তায় মে;রে ফেলতে চাস মোহ?”
মোহ হতাশা নিয়ে বলল,
“মা! কী বলছ তুমি? আমার অবস্থা এতটাও রুগ্ন না। আমি একদম ঠিক আছে। মানুষের হাত-পা সামান্য কে/টে গেলে সে যেমন চলতে পারে ঠিক তেমনই কপালে একটু লেগেছে। তাই চলাফেরা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকব?”
“তোর কথার সাথে আমি কোনোদিন পারব না। জবাবের অভাব নেই তোর কাছে। তোকে বাইরে যেতে দেওয়াই ভুল। তুই ফিরে আয় আজকে। তারপর তোর বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দেব।”
নিজে নিজে অনেক বকাঝকা করে কল কাটলেন মিসেস সুফিয়া। দীর্ঘশ্বাস নিলো মোহ। নিজের শান্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। হাঁসফাঁস লাগছে ভীষণ।
বিকেল গড়িয়েছে। সূর্য অস্ত যায়। আকাশ লাল লালিমায় নিজেকে রাঙিয়েছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে সূর্যের অস্ত যাবার পরেও তার রঙ আকাশের গায়ে লেগে রয়েছে। মোহ ক্লাবের দরজাটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিগত পনেরো মিনিট যাবত। দরজায় ঝুলছে তালা। মোহের উজ্জীবিত মুখে নেই কোনো সজীবতা। জুতো দিয়ে মাটিতে আন্দাজে ঘষে ঘষে সময় পার করছে। মনে একমাত্র আশা! যদি স্বচ্ছ আসে! তবে সে এলো না। তার ফোনে কল এলো। কলটা করেছে ঈশানী। তাকে আর ইথানকে কিছু সময়ের জন্য পার্কে রেখে এখানে এসেছে সে। এখন হয়ত ফিরতেই হবে। বিষণ্ণ হৃদয়ে, মলিন মুখে সে হাঁটতে লাগল রাস্তার দিকে। বেশ কয়েকটি বাইকের আওয়াজ পাওয়া গেল। বেশ স্পিডে মোহকে পাশ কাটিয়ে গেল তার। চোখ তুলে এক মুহূর্তের জন্য যেন সে সৌমিত্রকে দেখতে পেল। হকচকিয়ে পেছনে তাকাতেই সৌমিত্র নিজের বাইক থামালো। দ্রুত নেমে মোহের সামনে এসে দাঁড়াল সে। মোহের চোখে তখন স্পষ্ট আকুলতা, কৌতূহল ফুটে উঠেছে। সৌমিত্রের মুখের দিকে উন্মুখ হয়ে রয়েছে স্বচ্ছের খবর জানতে। সৌমিত্র উশখুশ করে বলল,
“ভাবি! এখানে আপনি?”
“না, আসলে আপনার ভাইকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম কিছু হলো কিনা দেখতে আসি৷ কিন্তু এখানে এসে…”
“ভাইয়া এখনো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি? আমি তো ভেবেছিলাম ভাইয়া রাগের মাথায় বলেছিল ওসব কথা!”
মোহের কপাল ভাঁজ হয় তখন। উৎসুক হয়ে বলে,
“কোন কথা?”
সৌমিত্র উল্টো প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা আমাকে আগে একটা কথা বলুন৷ আপনার সাথে ভাইয়ার কোনো ঝামেলা হয়েছে বা রাগারাগি?”
মোহের সূক্ষ্ম স্মৃতিগুলো নাড়া দেয় তখন। শেষবার যখন দেখা তখন সেই মুহূর্ত রাগারাগির মোটেও ছিল না। সময়টাতে তৈরি হয়েছিল লজ্জা, স্পর্শের সংমিশ্রণে। কোনো রেষারেষি মোটেও হয়নি। মোহ দ্রুত মাথা নাড়াল,
“না।”
সৌমিত্রের নিজেরই মাথা যেন খারাপ হয়ে গেল এবার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তাহলে ভাইয়ার মাঝে এত পরিবর্তন কেন?”
“কোথায় উনি?”
সৌমিত্র এবার মাথা নত করে মিনমিন করে বলল,
“ভাইয়া বাড়ি ফিরে গেছে। গতকালই ফিরেছে। এটাই তার সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন।”
মোহ প্রথমে সামান্য অবাক হলেও পরক্ষণেই তার মুখে ফুটল হাসির রেখা। উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে উঠল,
“এটা তো ভালো কথা। অবশেষে উনি বাড়িতে ফিরেছেন। নিজের পরিবারের কাছে ফিরে গিয়েছেন।”
সৌমিত্র হতাশা নিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। বলে উঠল,
“আপনি বুঝতে পারছেন না ভাবি। ভাইয়া যে কতটা জেদ আর ইগো নিয়ে বাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল সেটা আপনার ধারণার বাহিরে। আমি বিশ্বাসই করতে পারিনা ভাই নিজের জেদকে দমিয়েছে। এটা অসম্ভব। যেই মানুষ যদি একবার কোনো কিছুকে না বলে সেই মানুষকে রাজি করাতে যদি সামনের মানুষ ম/রেও যায় তবুও সে হ্যাঁ বলেনা।”
মোহ মৃদু হেসে বলে উঠল,
“এক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। উনি পরিবারের কথা ভেবেছেন। উনার মা, যিনি উনাকে বড়ো করেছে তার থেকে দূরে থাকা। আবার নিজের ভাই-বোন থেকে দূরে থাকাটা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তাই তিনি ফিরেছেন। আমিও কখনোই চাইনি আমার জন্য উনি এতটা সাফার করুক। আমি খুশি হয়েছি উনার সিদ্ধান্তে। কিন্তু উনি ফোন কেন ধরছেন না? পরিবারের সাথে কি খুব ব্যস্ত ছিলেন? আর রাগের মাথায় উনি কী বলেছিলেন বলতে চাইলেন?”
মোহ অভিনিবেশ করল সৌমিত্রের পানে। আমতা আমতা করতে থাকল সৌমিত্র। যখন তখন সব কথা মুখ থেকে বের হয়ে যাবার কারণে এমনি এমনি ভাইয়ের হাতে মা/র খেতে হয়না এটা বুঝতে পারছে সে। তার নীরবতায় মোহ ফের বলল,
“কী হলো বলুন?”
“ভাইয়া বলেছে আপনার সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না। তবে ভাবি মন খারাপ করবেন না। ভাইয়ার কিছু একটা হয়েছে। আমি তার হাতে মা/র খেয়ে হলেও ঠিক তাকে আগের মতো করে ফেলব। টেনশন নেবেন না একদম। ধরে নিন এটা আপনার ফিউচার দেবরের দেওয়া কথা!”
সৌমিত্রের প্রথম কথাটাই শুধু শুনতে পেল মোহ। পরের কথাগুলো তার কর্ণকুহর অবধি পৌঁছালই না। নিজের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া ভয়াবহ দুর্যোগ রুখতে কষ্ট হচ্ছে তার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, ওড়না একহাতে মুঠো করে জোরে চেপে ধরে স্তব্ধ হয়ে রইল সে। ঢক গিলে নিচু সুরে জানতে চাইল,
“আমার দ্বারা কি কোনো ভুল হয়েছে? যোগাযোগ না রাখার কারণ উনি বলেছেন?”
“না। তবে কারণটা বরং তার থেকেই জেনে নিন আপনি। একদম চেপে ধরবেন। ছাড় দেবেন না। তাহলেই সত্যিটা বেরিয়ে আসবে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইয়াও আসবে এখানে।”
সৌমিত্রের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই বাইকের হর্নের আওয়াজ শোনা গেল। মোহ পিছু ঘুরে দাঁড়াতেই ফুল স্পিডে একটা বাইক যেন হাওয়ার গতিতে এসে ফট করেই থেমে গেল মোহকে দেখে। সৌমিত্র ধীর গলায় বলে,
“ওইযে রিয়্যাল ইনসান আ গেয়া। কথা বলুন আপনারা। আমি বন্ধুদের কাছে যাই।”
সৌমিত্র মুহূর্তেই কেটে পড়ল জায়গা থেকে৷ স্বচ্ছ নিজের কালো হেলমেট মাথা থেকে খুলে বাইক ছেড়ে মোহের সামনাসামনি দাঁড়াল। মোহ ঢুলঢুল চোখে তাকিয়ে রইল বেশ কিছু সময়। এটা ঠিক আগের স্বচ্ছ। তার মুখে কাঠিন্যতা, জটিলতা ধরা দিচ্ছে। সারাদিনের চিন্তায় ক্লান্ত, বিষণ্ণ, মলিন মোহের চোখ আটকা পড়েছে স্বচ্ছের ঘোলাটে দুটো নেত্রে। আচানক মৃদু হাসে মোহ। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“আপনি এসেছেন?”
স্বচ্ছ তার জবাব না দিয়ে উল্টো শুধাল,
“তোমার তো বাড়িতে রেস্ট করা উচিত। এখানে কী করছ?”
মোহ মাথা নিচু করে আবারও হালকা হেসে বলল,
“আমি ঠিক আছি। শুনলাম আপনি নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন?”
স্বচ্ছ শুধু অন্যদিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“হুঁ।”
“আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমার জন্য বাবা আর ছেলের মধ্যের ঝামেলা আমাকে খুবই ছোটো করছিল।”
স্বচ্ছ এবার জবাবই দিলো না। মোহ শুধু দেখছে তার পরিবর্তন। সে ভেতরে ভেতরে থমকাচ্ছে মানুষটিলে দেখে।
“কাল থেকে আপনার ফোনে কল করছিলাম। আপনি একবার রিসিভ করেন নি।”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
স্বচ্ছের পরিষ্কার একটি বাহানা। মোহের বোধগম্য হতে সময় লাগল না।
“ব্যস্ত ছিলেন না। ইচ্ছে করে কাজটা করেছেন। আপনি রেগে আছেন আমার ওপর?”
স্বচ্ছ আমতা আমতা করে বলল,
“রেগে থাকব কেন আমি?”
মোহকে পোড়াচ্ছে স্বচ্ছের খাপছাড়া কথা, জটিল উত্তর। শক্ত থাকার প্রবণতাকে ভেঙে দিচ্ছে স্বচ্ছের শব্দগুলো। প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা পরিবেশে হয়ত স্বচ্ছ দেখতেই পাবে না মোহের চোখ ভর্তি অশ্রু। সে ফের শুধাল,
“আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
স্বচ্ছ মাথা নাড়াল। গম্ভীর গলায় বলল,
“না, মোহ। ভুলটা তুমি করো নি। করেছি বোধহয় আমি। বাবার কথা মানি নি। বাবার সাথে সামান্য ইস্যু নিয়ে বড়ো ঝামেলা করেছি। নিজের জেদকে প্রাধান্য দিয়ে বাবার কথা গায়ে না লাগিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম। নিজের জেদের সঙ্গে আমি তোমাকে জড়িয়ে ফেলেছি। তোমাকে আর নিজের জেদকে একই সংমিশ্রণ বানিয়ে অবশেষে নিজেই বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম।”
এসব শুনে মোহের কণ্ঠস্বর আঁটকে গেল যেন। দম আঁটকে গেল কোথাও। দুঃস্বপ্নের মতো জ/ঘন্য এক অনুভূতি তৈরি হলো। আটকা আটকা গলায় সে বলল,
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন এতদিন যা হয়েছে সব আপনার জেদ ছিল? আপনি জেদের বর্শবর্তী হয়ে এসব…”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই।”
মোহের মুখ থেকে আর কোনো শব্দ বের হলো না। স্বচ্ছের চোখে আর চোখ মেলাতে পারল না। স্বচ্ছ বলল,
“তাই আমি অনেক ভেবে নিজের ভুল ঠিক করতে শুরু করেছি। আশা করি তুমিও বিষয়টা বুঝতে পেরেছ।”
মোহ দাঁড়িয়েই রইল থম মে/রে। স্বচ্ছ কিছুটা চুপ থেকে কঠিন গলায় বলে উঠল,
“তোমার কি আর কিছু জানার আছে?”
মোহ আবারও ঢক গিলে নিলো। দমাতে চেষ্টা করল নিজের বি/শ্রী অনুভূতি। যা বেরিয়ে আসার পরিক্রম চালাচ্ছে বারবার। মোহ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না। আর কিছু জানার নেই।”
মোহের ফোন বাজছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে স্বচ্ছের পাশ কাটিয়ে চলতে লাগল। তবুও মোহের মনে এক তীব্র আশা ছিল যে, স্বচ্ছ তাকে পিছু ডাকবে। কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তেই স্বচ্ছ ডাকল।
“মোহ!”
মোহ এক সমুদ্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পিছু ঘুরল যখন স্বচ্ছ স্পষ্ট বলে দিলো,
“আশা করছি সব ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে। বাবা যদি কিছু ভুল করে থাকে তবে সে শা/স্তি পাবে। মনে করি, আমাদের আর যোগাযোগ করার প্রয়োজন হবে না কোনো।”
ধক করে উঠল মোহের বুক। জমাট বাঁধা সকল অনুভূতি একাধারে ভাঙতে শুরু করল। সেই ভাঙনের আওয়াজ মোহ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মনে মনে চাইছে, সব মিথ্যে হয়ে যাক। এই মুহূর্ত তার ভ্রম হোক। সে নিজেও মিথ্যে হয়ে যাক। তবুও যেন আগের সকল অনুভূতি বেঁচে থাক।
মেইন রোডের ফুটপাত ধরে নিস্তেজ হয়ে হাঁটছে মোহ। পানসে মুখে নেই কোনো সতেজ ভাব। নেই কোনো প্রাণ। কোথাও একটা হারিয়ে গিয়েছে সে। প্রচণ্ড লজ্জা, অপমানিতবোধ করছে বর্তমানে। কোথাও বা জোর করে চলে আসছে স্বচ্ছের প্রতি সুন্দর অনুভূতি। নিজের প্রতি তার নিজের লজ্জাটা শুধুই এই অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতির কারণে। এই অনুভব কেন হলো! যদি না হতো তবে সে কঠিন থাকতে পারত। অনড় থাকতে পারত! কিন্তু প্রণয় তো জন্মে গিয়েছিল। এখন সরোয়ার সাহেবের কথা মোহের মনে পড়ছে। উনার কথা অনুযায়ী ঠিকই উনার ছেলের প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি কি এক সেকেণ্ডের জন্যও কখনো দুর্বল হয়নি? হয়ত হয়নি! তাই তো সে আজ এতটা দৃঢ় ছিল। যা মোহ হতে পারেনি।
আকাশকুসুম কল্পনায় এক মেয়ের সাথে আচানক ধা/ক্কা খেয়ে পড়ে গেল মোহ। হাতে লাগল তার। চোখমুখ খিঁচে ফেলল। যার সাথে ধা/ক্কা লেগেছে সেই মেয়েটি বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আশ্চর্য তো! কানা নাকি? কানা হলে রাস্তায় বের হয় কেন কে জানে!”
মোহ কিছু বলল না। নির্বিঘ্নে তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া ফোনটা তুলল। ফোনের স্ক্রিন ফেটে গিয়েছে। সেটা হাতে নিয়ে ফের পার্কের দিকে হাঁটা দিলো সে। একফোঁটা অনুভূতি মিশ্রিত অবাধ্য অশ্রু পড়েই গেল ফুটপাতে। মোহ নিজেই হতবাক হলো! ইশশ…এত দুর্বলতা!
বাড়িতে এসেছে মোহ। এখনো যেন সে ঘোরের মাঝে বন্দিদশায় রয়েছে। ক্লান্ত ইথান না খেয়েই মোহের বুকে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। চেয়ারে ভর দিয়ে মাথা রেখে একপানে জানালার দিকে চেয়ে আছে মোহ। মিসেস সুফিয়া রেগেমেগে মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। এসেই বলতে শুরু করলেন,
“কাল থেকে যদি তোকে বাড়ি থেকে বের হতে দিয়েছি! বেশি আশকারা পেয়ে গেছিস তাই না? মায়ের কথাও পরোয়া করিস না আজকাল। অবশ্য কখনোই তো পরোয়া করিস নি। মা যে কতটা চিন্তায় ম/রে যায় সেই খেয়াল আছে তোর?”
মোহের কান অবধি যেন পৌঁছায়নি তার মায়ের কথাগুলো। মিসেস সুফিয়া তা খেয়ালও করলেন। আরো রাগলেন তিনি। ধমকে উঠলেন।
“মোহ!”
মোহ হকচকিয়ে উঠে মায়ের দিকে তাকাল। ইথানের মাথায় হাত রেখে বলল,
“মা, কী করছ? ইথান ঘুমাচ্ছে তো।”
মিসেস সুফিয়া ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন মোহের মুখশ্রীর দিকে। এরপর বিচলিত হয়ে এগিয়ে এলেন। হালকা ঝুঁকে মেয়ের গালের পানি মুছে অস্থির চিত্তে বললেন,
“কী রে! কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
মোহ আবারও হতভম্ব হয়ে নিজের চোখে হাত রাখে। চোখে পাতা ভিজে। অথচ সে কাঁদছে তার নিজেরই খেয়াল নেই। মিসেস সুফিয়া অস্থির হয়ে মেয়ের চিবুক ধরে মেয়েকে গভীর পর্যবেক্ষণ করলেন। লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছে মোহের চোখ। শুকিয়ে কাঠ হয়েছে তার গোলগাল মুখ। মিসেস সুফিয়া ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলেন,
“কী হয়েছে? বল আমাকে।”
“কিছু না, মা।”
মিসেস সুফিয়া এবার রাগ দেখিয়ে বলেন,
“তোর ভাঙা গলা, এমন মুখ-চোখ আমার চোখের সামনে ভাসছে। তোকে আমি জন্ম দিয়ে মানুষ করেছি। তোকে আমি চিনি না?”
মোহ অন্যদিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বলে,
“ব্যস…এমনিতেই মনটা একটু খারাপ।”
মিসেস সুফিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে মোহের একটা হাত ধরে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আমাকে একটা কথা বল! তোর আর ওই ম/ন্ত্রীর ছেলে স্বচ্ছের মধ্যে কি কিছু আছে?”
কেঁপে ওঠে মোহের বুক। স্মরণে চলে আসে ফের আজকের তিক্ত স্বচ্ছের প্রতিটা বাণী৷ চোখমুখ জড়িয়ে বলে,
“কে বলেছে এসব কথা?”
“কেউ বলুক আর না বলুক। আমি কিন্তু আন্দাজ করতে পারি। তোর সাথে তার কথা হয় আমি জানি৷ সে কয়েকবার আমাদের বাড়ির সামনে এসেছিল তাও জানি। কোনো সম্পর্ক থাকলে আমায় খুলে বল।”
মোহ এবার ফিক করে হেসে দিলো। তার হাসিটা নিজের প্রতিই তাচ্ছিল্যের। তারপরেই মায়ের দিকে ম্লান মুখে চেয়ে বলল,
“ওই মানুষটা আর আমি দুজনই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো পৃথিবীর মানুষ। সেই পৃথিবী কখনো এক হবে না।”
চলবে….
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৮ [দ্বিতীয় খণ্ড]
কা/স্টারি জে/লের মাটিতে বসে ঝিমাচ্ছেন কামাল। কিছু সময়ের ব্যবধানে শুঁকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছেন তিনি। মনে শান্তি নেই। এমন জটিলভাবে ফেঁসে গেছেন যে জা/মিনও হচ্ছে না। অথচ উনাকে যেসব কাজের জন্য ফাঁসানো হয়েছে তার মূলে রয়েছেন সরোয়ার সাহেব। হঠাৎ কা/স্টারির দরজায় লাঠির আ/ঘাত পড়ল। চমকে মাথা উঠিয়ে তাকালেন কামাল। কনস্টেবল তালা খুলতে খুলতে বললেন,
“আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে।”
না চাইতেও যেন আশার আলো দেখলেন কামাল। তবে কি মন্ত্রী সাহেব এলেন? নিশ্চয় তাকে এই মুসিবত থেকে রক্ষা করতে এসেছেন। এতদিনের সব কাজের সঙ্গী কামাল উনার। তার জন্য নিশ্চয় কিছু ভেবে রেখেছেন সরোয়ার সাহেব। এই ভেবে টলমল করতে করতে উঠে কনস্টেবলের সাথে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ওয়েটিং রুমের দরজা দিয়ে ঢুকতেই বেঞ্চিতে বসা লোকটাকে দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন কামাল। সাথে হতাশও হলেন। ঢোক গিলে দুর্বল স্বরে বললেন,
“আপনি এখানে?”
“সরোয়ার সাহেরকে আশা করেছিলেন নিশ্চয়?”
কামালের মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। লোকটির মুখ থেকে বিদ্রুপ হাসির আওয়াজ বের হলো। পায়ে পা তুলে বসে থাকতে থাকতে উঠে এসে কামালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখে বলল,
“ইশশ… কী মুমূর্ষু অবস্থা! দেখে মনে হচ্ছে আর কিছু সময়ের ব্যবধানে ম/রেই যাবেন।”
কামাল রুক্ষ সুরে জবাব দিলেন,
“চলে যান এখান থেকে।”
আবারও হাসির আওয়াজ শোনা গেল। বলল,
“আপনার জন্য উপকারী একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আগে শুনুন।”
কামাল ফ্যালফ্যাল করে উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকেন। উনার বুঝে আসেনা সামনে থাকা এই লোকটি হঠাৎ কেন তার সাথে ব্যক্তিগত কথা বলতে এসেছে। এর মাঝে নিশ্চয় কিছু একটা রয়েছে। মানুষটি নিজের হাতের ঘড়ি দেখে বলল,
“আমাকে সময় দেওয়া হয়েছে মোটেই পাঁচ মিনিট। তাই সময় নষ্ট না করি। লেটস্ কাম টু স্ট্রেইট পয়েন্ট। এখন আপনার যা অবস্থা তাতে আপনি যে সারাদিন সাধনা করে গেলেও বের হতে পারবেন না সেটা আপনিও জানেন। উপরন্তু নিজে বাঁচতে আপনাকে আরো ফাঁসাবেন আপনার বস। তাই এখানে উপায় একটাই। তিনি আপনাকে ফাঁসানোর আগে আপনি উনার মুখোশ খুলতে সাহায্য করুন। তিনি ধরা পড়লে আপনার এখান থেকে বের হতে সময় লাগবে না।”
কামাল থরথর করে কেঁপে উঠলেন। মনে প্রচণ্ড দ্বিধা নিয়ে বললেন,
“আমি কিছু জানি না।”
“হাউ লং উইল ইউ বি ওনেস্ট টু হিম? হি ইজ নট ওনেস্ট টু ইউ!”
কামালের উত্তর এলো না। বিভ্রান্তি আর দুর্বলতায় মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। অপরপ্রান্তের মানুষ তীক্ষ্ণ চোখে বোঝার চেষ্টা করছে কামালের হেলদোল। অতঃপর চোয়াল শক্ত হলো লোকটির।
“সুযোগ একবারই দেব। বার বার নয়! আমি জানি ম/ন্ত্রী সাহেবের সব কৃতকর্মের প্রমাণ আপনিই দিতে পারবেন।”
কামাল তবুও নিশ্চুপ। যেন মুখে তালা লাগিয়ে রেখেছেন। সেই মানুষটি দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“ওকে দেন। আমি যাচ্ছি। আমি এই রুমের চৌকাঠ পার হলেই আপনার কোনো কথা আর কানে নিতে রাজি নই।”
কামালের পাশ কাটিয়ে ধীর পায়ে রুমের দরজার দিকে এগোয় পুরুষটি। সে জানে কামাল তাকে পেছন থেকে ডাকবেন। তাই ধীর পায়ের ধাপ ফেলছে সে। তৎক্ষনাৎ ডাক দিয়ে উঠলেন কামাল।
“আমি রাজি। আমি শুধু এখান থেকে বের হতে চাই।”
কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র পুরুষটির মুখে এক জটিল হাসির দেখা মিলল। তা কামালের চোখে পড়ল না।
ঘড়ির কাঁটা রাত একটা ছুঁইছুঁই। শান্ত পরিবেশ থাকায় ঘড়ির কাঁটা চলার শব্দ যেন আরো জোরে হচ্ছে। ইথান সারাদিন ঘোরাঘুরির ফলে বেশ ক্লান্ত। মোহের পাশে গভীর তন্দ্রায় নিমগ্ন। ঘুম আসছে না শুধু মোহের। এপাশ-ওপাশ করতেই কাটছে সময়। একটু পরপর হাতে নিচ্ছে ফোন। যদি স্বচ্ছ কল করে? যদি কল করে বলে, সন্ধ্যায় যত কথা বলেছে সব মিথ্যা, সব বানানো! যদি সরি বলে ক্ষমা চায়। ফের সেই হাতে চুমু খেতে চায়। তখন কি তার হাত এগিয়ে দেওয়া উচিত হবে? চুম্বনের স্মৃতি মনে পড়তেই কান গরম হলো মোহের। দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। কীসব ভাবছে সে! মোহ উঠে বসল। তার সব ভাবনার সামনে একটি করে ‘যদি’ শব্দ যুক্ত রয়েছে। তার কোনো ভিত্তি নেই। মনটা আবার বিষিয়ে ওঠে। ফাঁপড় লাগে মনে। বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পানি খেতে বসার ঘর পেরিয়ে ছোট্ট রান্নাঘরে ঢোকে সে। পানি খেয়ে পিছু ঘোরার পরই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে মিসেস সুফিয়াকে এত রাতে গম্ভীর চোখেমুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে।
“মা! এখনো ঘুমাও নি?”
মিসেস সুফিয়া এসে নিজেও পানি পান করে বললেন,
“তুইও তো ঘুমাস নি।”
“মা, আসলে ঘুম আসছিল না।”
মোহের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিসেস সুফিয়া শুধালেন,
“তা ঘুম কে কেঁড়ে নিয়েছে?”
স্বচ্ছের কথা প্রথমেই মাথায় এলো মোহের। এই লোকটাই তার বিষাদের কারণ। এই পুরুষটিই তার অনাকাঙ্ক্ষিত চিন্তার কারণ। মোহ ফট করে মায়ের কাছে আবদার করল,
“মা! একটু তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারি? খুব অশান্তি লাগছে।”
মিসেস সুফিয়া দীর্ঘশ্বাস নিলেন। মেয়ের চোখেমুখের অবস্থা দেখে ভীষণ চিন্তিত হলেন। তবে মোহ মুখই খোলে না সেসব বিষয়ে। বড্ড চাপা স্বভাবের হয়েছে বাবার মতো।
বিছানায় গুটিশুটি হয়ে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে রয়েছে মোহ। তার আলগোছে চুলের ভেতর দিয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মিসেস সুফিয়া। ছোটোবেলায় নিয়মিত এই কাজটা করতেন তিনি। যেন তিনি সেই ছোট্ট মোহকে আবার দেখছেন। আগে ছোটো বয়সে খুব মন খারাপ হলেই তার কোলে মাথা রেখে আদর নিতো। আজও তাই। মোহ হুট করে শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
“মানুষ বদলায় কেন, মা?”
মিসেস সুফিয়া কিছুটা অবাক হোন মোহের কথায়। পরক্ষণেই উত্তর দেন,
“তাদের নিজেদের স্বার্থে।”
“তারা কেন ভাবে না তাদের এই বদলানোতে আমরা ব্যথিত হই? আমাদের মন ভেঙে যায়?”
“কারণ তোর মন ব্যথিত হবার চেয়ে তার কাছে আগে নিজের স্বার্থের দাম বেশি!”
মোহের চোখে ফের পানি এলো। তার নিজেরও জানা নেই কেন সে এতটা নমনীয় হয়ে গেল! এমন তো সে ছিল না! এমন সে হতেও চায়নি। পানি গড়িয়ে পড়ার আগে চোখ বুঁজে নেয় মোহ। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“আসলেই বোধহয় উনার কাছে আমার দাম ছিল না।”
মিসেস সুফিয়া মেয়ের বিড়বিড়িয়ে বলা কথা শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
“কী বললি?”
মোহ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
“কিছু না। আমরা শুধু শুধু গিরগিটিকে দোষ দিই।”
মা-মেয়ের কথোপকথনে বাড়তে থাকল রাত। মোহ মায়ের স্নেহের আবেশে অবশেষে চোখ বুঁজল।
বি/য়ারের ক্যান খালি করল এক ঢোকে স্বচ্ছ। বাড়ির তিন তালায় ডান প্রান্তে ছোটো রুফটপের মতো জায়গায় চেয়ারে বসেছে সে। হাতের ক্যান ফেলে দিতে গেলেই আচানক মায়ের কণ্ঠে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতের ক্যান পড়ে যায়।
“এত রাতে কী করছ? ঘুমাও নি?”
স্বচ্ছ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মিসেস জেবা বি/য়ারের ক্যান দেখেই চটে গেলেন। এগিয়ে এসে ধম/কে বললেন,
“এসব কী খাও তুমি? এমনি স্বাস্থ্যের এই অবস্থা! আজেবাজে জিনিস খাওয়ার পারমিশন কে দিয়েছে তোমাকে?”
স্বচ্ছ কপাল কুঁচকে চোখ খিঁচে বলল,
“মাথা ব্যথা করছে, মা।”
“আগে বলবি না? আয় মাথা টিপে দেই।”
স্বচ্ছের হাত ধরে টেনে এনে সেখানকার কোণায় থাকা সোফার মতো বসার জায়গায় শুইয়ে তার মাথার কাছে বসে আস্তে করে কপালের চারিপাশে ম্যাসাজ করতে আরম্ভ করেন মিসেস জেবা। স্বচ্ছ চোখ বুঁজে চুপ রয়েছে। মিসেস জেবা জানতে চান,
“হঠাৎ বাড়ি ফিরে এলে যে? এর পেছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে?”
“কেন? মানা করছ ফিরতে?”
মিসেস জেবা হালকা রেগে বললেন,
“ধুর পা;গল ছেলে! আমি কিন্তু তোমাকে চিনি। আমার সামনে কথা ঘোরাতে চাইবে না। নিজের বাবার থেকে এক অংশ কম যাও না তুমি। সৌমিত্র এমনটা করলে আমি মেনে নিতাম। কিন্তু যখন তুমি নিজেই নিজের কথার খেলাপ করেছ তার ভিত্তি নিশ্চয় আছে।”
“হুঁ। তোমার স্বামীর সাথে তর্ক বির্তক করতে এসেছি। এতদিন তো শান্তিতে ছিল আমি না থাকায়। এত শান্তি তো তাকে দেওয়া যাবে না।”
স্বচ্ছ আবারও কথা ঘোরাল। মিসেস জেবা হেসে দিয়ে বললেন,
“ফা/জিল হয়েছ তুমি অনেক।”
স্বচ্ছ নির্বিঘ্নে হেসেও আবার চুপ হয়। মাথাব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। মস্তিষ্ক একটি মানুষের ভাবনা নিয়ে পড়েছে যে! সেই মানুষটিকে নিয়ে ভাবনা সে তাড়াতে পারছে না। সে শুনেছিল প্রেম, ভালোবাসা মানুষের হৃদয় গাঁথে। মস্তিষ্ক অবিচল করে দেয় কে জানত?
আজ সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হলো মোহের। প্রথমেই ফোন হাতে নিলো সে। স্ক্রিনে শৌভিকের মেসেজ দেখে টনক নড়ে তার। অবিলম্বে ফোনের লক খুলে দেখল শৌভিক লিখেছে, ‘ইমারজেন্সি দরকার পড়েছে। খুব শীঘ্রই দেখা করা প্রয়োজন। আপনার সময় আর সুবিধা মতো জায়গা বলে দেবেন। আমি পৌঁছে যাব।’
মোহ আন্দাজ করল শৌভিক সরোয়ার সাহেবকে নিয়েই আলোচনা করবে। তারও দরকার রয়েছে। এতকিছুর পরেও গায়ে ফুরফুরে হাওয়া লাগিয়ে সরোয়ার সাহেবের ঘুরে বেড়ানোটা খুব বিরক্ত লাগছে তার। তাই মোহ দ্রুত নিজের সুবিধা মতো একটি রেস্টুরেন্ট আর সময় বলে রিপ্লাই করল শৌভিককে। দ্রুত ফ্রেশ হবার জন্য উঠে চলে গেল তারপর।
সকালে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি অতিক্রম করতে করতে স্বচ্ছ খেয়াল করল ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে আরিদ্র। পাশের সোফায় সরোয়ার সাহেব বসে বসে বেশ আলাপ জুড়েছেন। আরিদ্রের পাশে থাকা সৌমিত্রের হেলদোল নেই বললেই চলে। ফোনের গেম খেলতে মশগুল সে। নামেই উপস্থিত রয়েছে তাদের আলাপে। স্বচ্ছ নেমেই আরিদ্রের কাঁধে হাত চাপড়ে বলল,
“আরে আরিদ্র! কখন এলি?”
“অনেকক্ষণই হলো। তোর রুমেই গিয়েছিলাম। দেখলাম পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস। তোর আর উন্নতি হলো না রে। একই রয়ে গেলি তুই।”
স্বচ্ছ জবাব না দিয়ে আরিদ্রের অন্যপাশে গিয়ে বসে। আরিদ্র আবারও বলতে থাকে,
“আঙ্কেলকে দেখেছিস? এই বয়সে কত মাথা খাটাচ্ছেন। ভাই, তুই থাকতে উনাকে এখন মাথা খাটাতে দিস কেন? আমি হলে তো কবেই উনাকে রেস্টে দিয়ে নিজে কাজে লেগে যেতাম।”
স্বচ্ছ মৃদু হেসে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“সমস্যা তো এখানেই। তোর আর আমার ইন্টারেস্ট সেম জিনিসে নয়।”
আরিদ্র তখনি স্বচ্ছের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভাই! এটা তোর ক্যারিয়ার। তোকে তো ভাবতে হবে নাকি! সারাজীবন এভাবে মর্জি মতো ঘুরলে হবে নাকি? অবশ্য তোর এই ছন্নছারা মনকে বসানোর জন্য আমি আঙ্কেলকে তোর বিয়ে নিয়ে ভাবতে বলেছিলাম। বিয়ে করলে অটোমেটিক মন সেট হয়ে যায়। বিলিভ মি!”
স্বচ্ছ ফট করে বিদ্রুপ হাসি দিয়ে বলল,
“বিয়ে? কে বিয়ে করবে আমাকে?”
আরিদ্র আরো আগ্রহ বাড়িয়ে বলল,
“বল যে তোকে কে বিয়ে করবে না! মাত্র আমি শুনলাম আমি আঙ্কেলের থেকে। উনার জানা চেনা মানুষের অভাব নেই। বাট এই মুহূর্তে উনার ইমেজ যেভাবে ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে তার জন্য দরকার সাপোর্ট। সেটা তুই যেদিক দিয়েই ভাব।”
কপাল কুঞ্চিত হয় স্বচ্ছের। আরিদ্রের কথার ভাবার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সৌমিত্র গেম খেলতে খেলতে ফিক করে হেসে দিয়েছে ঠাট্টা করে। কেননা, এসব ব্যাপারে আলোচনা সে আগে থেকেই শুনছে। আরিদ্র এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে লাগল,
“সামনে ভো/ট, স্বচ্ছ। তুই আঙ্কেলের জায়গায় কাজে না নামতে চাইলেও উনাকে হেল্প করতে পারিস তো। বড়ো একটা বিজনেস ম্যানের মেয়ের কথা বলছিলেন আঙ্কেল। উনার সাথে সম্পর্ক গভীর হলে উনি সবদিক থেকে সাপোর্ট পাবেন। আর তার একমাত্র মাধ্যম উনার একমাত্র বোনের সাথে যদি তোদের বাড়ির কারোর সম্পর্ক জড়ানো যায়। কিন্তু শুনলাম তুই নাকি রাজি হবি না? কেন হবি না? সব দিক থেকেই তো লাভ!”
স্বচ্ছের ধূসর চোখে দ্বিধা স্পষ্ট। তার বুঝতে বাকি থাকেনা সরোয়ার সাহেব নিজে বিয়ের প্রস্তাব রাখতে না পেরে সরাসরি আরিদ্রের দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন। আঁড়চোখে বাবার দিকে তাকায় স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেবের দুচোখ যেন আদেশ করছে স্বচ্ছকে রাজি হতে। আরিদ্র স্বচ্ছকে আলতো ধা;ক্কা দিয়ে বলল,
“মেয়ে কেমন হবে এগুলা নিয়ে ভাবিস না। সুন্দর না হলে আমি বোঝাচ্ছি তখনই বিয়েতে নাকচ করব।”
সৌমিত্র ফট করে হেসে লুটোপুটি খেতে লাগল। সোফায় আধশোয়া হয়ে ফোন রেখে ক্রমাগত হাসতে হাসতে বলল,
“ভাইয়ার পারসোনাল সুন্দরী আছে। দশ হাজার বাজি ধরলাম আরিদ্র ভাই! ভাইয়া জীবন থাকতে রাজি হবে না।”
স্বচ্ছ নীরব ছিল এতক্ষণ। এবার নিজের থুতনির ছোটো খোঁচা দাড়িতে হাতের আঙ্গুল বুলিয়ে এবার ধীর গলায় বলে উঠল,
“রাজি হবো না কেন? আমি রাজি। এই রাজি হওয়াতে যদি বাবার সুবিধা হয় আমার আপত্তি নেই।”
বিষম খেয়ে উঠে বসল সৌমিত্র। আরিদ্র তখনি সৌমিত্রকে চেপে ধরে বলল,
“দশ হাজার বের কর।”
মুখটা পানসে হয়ে গেল সৌমিত্রের। টাকা হারানোর ভয়ে নয়। স্বচ্ছ আর মোহের মাঝের সম্পর্কের কথাটা ভেবে। স্বচ্ছ রাজি হবে সেটা তার ভাবনার বাহিরে ছিল। সে গিয়ে স্বচ্ছের একহাতের বাহু দুহাতে চেপে ধরে বলল,
“ভাইয়া তুমি কী বলছ? কেন বলছ? ইয়া আল্লাহ, তোমার শরীর ঠিক আছে তো?”
স্বচ্ছ সৌমিত্রের মুখের দিকে না তাকিয়েই ডানে ঠোঁট বাঁকিয়ে নীরব হেসে বলে,
“না শুনেছিস তাই বলছি। বিয়েতে আমার আপত্তি নেই।”
স্বচ্ছ সৌমিত্রের প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে উঠে চলে গেল। সৌমিত্র মুখ হা করে বসে রইল একভাবে।
চলবে…