#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৯ [দ্বিতীয় খণ্ড]
“সরোয়ার সাহেব নিজেকে বাঁচাতে নিজেরই ডান হাত কামালকে ফাঁসিয়েছে। জানেন সেটা?”
কোল্ড কফির গ্লাসের স্ট্র হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল মোহ। শৌভিকের কথায় থেমে গেল সে। থমথমে গলায় বলল,
“হুঁ, জানি!”
“তো এখন কী করার কথা ভাবছেন?”
শৌভিকের দ্বিতীয় প্রশ্ন। মোহের অস্থির দুচোখে দেখা যাচ্ছে অশান্তি। হাফ ছেড়ে সে বলল,
“জানি না আর কী করার বাকি আছে! এটা বুঝতে পারছি উনি প্রচণ্ড ধূর্ত মানুষ। শুধু তাই নয় সেই সাথে খুব স্বার্থপর। নাহলে যাকে এতদিন কাজে লাগিয়ে এসেছেন তাকেই ফাঁসিয়ে দিতে পারতেন না।”
শৌভিক গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে মৃদু হাসি নিজের শুষ্ক ঠোঁটে ফুটিয়ে বলল,
“ধূর্ত আর স্বার্থপর না হলে রাজ/নীতি তার জন্য নয়। লুক! আমি নিজেও স্বার্থপর। স্বার্থের জন্যই আপনার সাথে ওঠাবসা।”
মোহের কান অবধি যেন গেল না কথাটা। সে অন্য খেয়ালে ব্যস্ত। মোহের সাথে যতবার দেখা হয়েছে আজ অবধি ততবারই মেয়েটাকে ছটফটে স্বভাবের লেগেছিল শৌভিকের। এখন কেমন যেন নেতিয়ে যাওয়া এক ফুলের ন্যায় লাগছে। শৌভিক ফট করে জিজ্ঞেস করল,
“কোনো বিষয়ে মনে হচ্ছে প্রচুর চিন্তিত!”
মোহ অন্য ভাবনায় ছিল। খানিকটা হকচকিয়ে উঠে বলল,
“কে?”
“আমার সামনে বসে আছেন যিনি!”
শৌভিকের অকপট স্বীকারোক্তি। মোহ নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। আসলেই তাকে মনমরা লাগছে? শৌভিক তা বুঝে বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমার ছোটো বোন যদি বেঁচে থাকত তাহলে বোধহয় আপনার মতো ছটফটে হতো।”
মোহ ফের চমকায়। উৎসুক নয়নে থেমে থেমে বলে,
“ছোটো বোন?”
“হুঁ। মাত্র এগারো বছর বয়সে মা/রা গিয়েছে রোড এক্সি/ডেন্টে। ওইদিন ওর জন্য শেষবার চোখের পানি ফেলেছিলাম আমি। জানাযায় বসে দো’আ পড়ছিলাম আর চোখ দিয়ে পানি পড়ে পাঞ্জাবি ভিজে যাচ্ছিল। সেদিন রাতে মনে হলো ওর একেকটা কথা। সে বেঁচে থাকতে বলত সবসময় হাসতে। ভেতরের দুর্বলতা নাকি বাহিরে বের করতে নেই। তাহলে নাকি সবাই উইক ভাবে। তার পরেরদিন সকাল থেকে আর কখনো আমি কোনো বিষয়ে মনমরা হয়ে থাকতাম না। কোনো সমস্যায় পড়লে ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছি। মনে হতো মনমরা হয়ে রইলে সে দুঃখ পাবে। আজও ওই ধারণা নিয়েই বেঁচে আছি।”
মোহ বুঝতে পারল শৌভিক তাকে পরোক্ষভাবে তাকে মন খারাপ করতে মানা করছে। মোহ মৃদু হেসে বলল,
“ওতোটুকু বয়সে অনেক পরিণত ছিল সে!”
শৌভিকও হাসার চেষ্টা করল। হাসিটা ছিল ফ্যাকাসে। বোনের কথা মনে পড়ছিল তার।
“পরিণত নয় বলুন অল্প বয়সে পেকে গিয়েছিল। এতটাই পাকা আর দুরন্ত ছিল যে একবার আমার এক কাজিনকে একটা ছেলে তার সামনে ডিস্টার্ব করায় তার কলার ধরে থা/প্পড় লাগিয়েছিল।”
ময়ন দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম মোহের। কী মারা/ত্মক মেয়ে! সে মৃদু হেসে বলে,
“কী ভয়ংকর ব্যাপার!”
“তার ছাপ কিন্তু আপনার মধ্যেও আছে। স্বচ্ছকে থা/প্পড় মে/রেছিলেন তো?”
মোহ বিষম খেলো! না চাইতেও স্মৃতিচারণ হয়ে গেল তার। প্রথম সাক্ষাৎ ছিল এক দুর্যোগের মতো। লোকটা দুর্যোগের মতোই হানা দিলো আবার সব শুনশান করে রেখেই বিদায় নিলো। ইশশ…কী স্বার্থপর! মোহ আমতা আমতা করে বলল,
“ওটা একটা মিস্টেক ছিল।”
“একটা ভুল থেকে এতকিছু?”
গোল গোল চোখে তাকাল মোহ। শৌভিকের এই কথাটির মানের উদ্ঘাটন করতে পারল না সে। প্রসঙ্গ পাল্টে হুট করে বলল,
“আপনি যে বললেন আমি আপনার বোনের মতো! তাহলে এখনো অচেনা মানুষের মতো আপনি, আপনি করে বলেন কেন আমায়?”
শৌভিকের চোখ যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। দুচোখে ফুটে ওঠা আকাঙ্ক্ষা মোহের চোখে ধরা পড়ল। মোহ বলল,
“একটা মেয়ের জীবনে তার বড়ো ভাইয়ের গুরুত্ব অনেক। আমার বড়ো ভাই ছিল না কখনো! তাই জীবনে আমাকে আড়াল কেউ ছিল না। ভাইরা নাকি বোনদের সব বিপদ থেকে আড়াল করে এমনটা শুনেছিলাম কখনো দেখিনি।”
শৌভিক ফের হেসে বলে,
“তাই ভাই হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছো আমাকে?”
তুমি সম্বোধন শুনে খুশি হলো মোহ। শৌভিক আবারও বলে উঠল,
“বোন হওয়া কিন্তু সোজা নয়। বোন হওয়ার এত শখ জেগেছে তখন এ টু জেড দায়িত্ব পালন করিয়ে নেব।”
মোহের দৃষ্টি সরু হলো এবার। ঠোঁট একদিকে বাঁকিয়ে দাম্ভিক সুরে বলল,
“সেম টু ইউ ব্রাদার!”
রেস্টুরেন্টে বসে নিজের নিউ ডিল ফাইনাল করল ফারাহ। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ক্লায়েন্টের সাথে হাত মিলিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো সে। আচানক তার দুই দর্শনেন্দ্রিয় দেখে ফেলল তার থেকে আর দুই টেবিল পরে বসা শৌভিককে। লোচনের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে এলো তার যখন সে দেখল সঙ্গে মোহও রয়েছে। দুজনের হাসিমুখে কথা বলার দৃশ্য দেখে কী প্রতিক্রিয়া করবে তা ভুলে গেল সে। তার ক্লায়েন্টের কণ্ঠে কোনোরকমে ঠোঁটে হাসিটুকু বজায় রেখে বিদায় জানিয়ে শৌভিক আর মোহকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে। তার মনে এলো স্বচ্ছের কথা। কয়েকদিন তার ভাইয়ের অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি তবে এই শৌভিক? এই লোকটার কারণে কি সদ্য ফুটন্ত গোলাপের মতো এক প্রণয়ের সম্পর্ক ঝরে পড়ল? ফারাহর মুখে হাত চলে গেল। চোখের পলক পড়ছে না। ধ্যান ফিরলে তৎক্ষনাৎ সিটে বসে পড়ল সে। শৌভিক বা মোহ তাকে দেখে ফেললে তো চলবে না! সে ঠিক করল যদি তার আন্দাজ ঠিক হয় তবে যে করেই হোক এই শৌভিককে শায়েস্তা করবে সে। শান্তিতে থাকতে দেবে না অসভ্য লোকটাকে। শৌভিকের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়ল ফারাহ। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে মাথা হেলিয়ে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করল শৌভিক এবং মোহকে। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে একটি লোক এসে দাঁড়াল মুখের সামনে। হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল ফারাহ। চশমা পরিহিত লোকটিকে চিনতে মুহূর্ত সময়ও লাগল না। কী সুন্দর হাসছে শৌভিক! যেন ফারাহকে ভয় পেতে দেখে আনন্দ পেয়েছে। আস্তে করে পানির গ্লাস তুলে ফারাহর দিকে এগিয়ে দিলো শৌভিক। ফারাহ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল। শৌভিক এক ধূর্ত হাসি দিলো।
“আমাদের স্টক করা শেষ?”
ফারাহ কপাল কুঁচকে ফেলে। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করে,
“মানে?”
শৌভিক এবার শব্দ করেই হাসলো। সেই হাসিতে যেন গা জ্বালা ধরে গেল ফারাহর। এত হাসার কী প্রয়োজন? হাসি থামিয়ে অবশেষে প্রত্যুত্তর করল মানুষটি।
“একজন ম/ন্ত্রী সাহেবের মেয়ে যাকে তাকে স্টক করে বেড়ায়! বিষয়টা কী ভালো দেখায় বলুন?”
শৌভিককে চোখ রাঙিয়ে ফারাহ বিরস মুখে জবাব দিলো,
“আমার এত ফালতু সময় নেই আপনাকে অনুসরণ করার!”
শৌভিক ফারাহর দুটো চোখে ইশারা করে বলল,
“আপনার দুটো চোখ আর আমার চারটা। সব দেখে ফেলি কিন্তু!”
ফারাহ এবার কিছু একটা ভেবে দমে গেল। বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে মুখটা অসহায় করে বলল,
“আচ্ছা, শুনুন! একটা কথা ছিল।”
“এতগুলো কথা বলে ফেললেন উইদাউট পারমিশন। এখন আবার পারমিশন কেন নিতে হবে?”
ফারাহ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“কারণ আপনি উত্তর দেন না সোজাসুজি।”
“ম/ন্ত্রীর মেয়েদের একটু তো বাঁকা কথাগুলো সোজা করে নেওয়ার গুনগুলো থাকা উচিত!”
ফারাহ ক্লান্ত নয়নে চেয়ে বলল,
“সত্যি সিরিয়াস আলোচনা করার আছে!”
শৌভিক এবার ফারাহর অপরপ্রান্তের সিটে বসে গালে হাত দিয়ে বলল,
“বলুন তবে!”
ফারাহও শান্ত মনে বসল। মিনমিন করে বলতে শুরু করল,
“মোহ আর আমার বড়ো ভাইয়া স্বচ্ছের মাঝে একটা না বলা সুন্দর প্রেম গড়ে উঠেছিল। আপনি কি তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাদের এই না বলা প্রেম, না হওয়া বিয়ে ভেঙে দিয়ে ঠিক করছেন? একজন প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করুন! আপনার মন তো ভেঙে যাবে তাই না?”
শৌভিক প্রথমে হাসতে চাইল৷ তবে হাসল না। খানিকটা সময় চুপ থেকে বলল,
“হুমম প্রেমিক হিসেবে ভেবে দেখলাম! আমি হলে আমার প্রেমিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম। আপনার ভাই সেই হিসেবে কী করেছে?”
ফারাহ শাসিয়ে উঠল এবার।
“এই আমার ভাইকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেন না।”
শৌভিক জবাবে কিছুই বলল না। ঠোঁটের কোণে এখনো হাসি লেগে রয়েছে তার। ফারাহ ফের শান্ত বনে গেল। বড়ো শ্বাস নিয়ে সে মিনমিন করে বলতে আরম্ভ করল,
“দেখুন, আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি প্রেম করবেন অনেক ভালো কথা। অবশ্যই বেশি বেশি করে প্রেম করবেন। প্রেম ছাড়া জীবন-যৌবন অচল। কিন্তু প্লিজ আমার ভাইয়ের না হওয়া বউয়ের সাথে প্রেম করবেন না!”
শৌভিকের মাঝে কোনো প্রকার হেলদোল দেখা গেল না। সে পানি পান করছে। যেন ফারাহর কথাগুলোকে শুনতেও পায়নি সে। ফারাহ এবার দুম করে বলে দিলো,
“আপনি প্রেম করবেন তো! আমি আপনাকে প্রেমিকা খুঁজে দেব। তাও আবার একদম পারফেক্ট। একদম ভেজালমুক্ত।”
শৌভিক চরমভাবে বিষম খেলো এবার। কাশতে কাশতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নিজের বুকে থাবা দিয়ে তবেই কাশি থামল তার। চশমা ভেদ করে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল সামনে থাকা ভার মুখ করে রাখা ফারাহর দিকে। ফারাহ বেশ সিরিয়াস মুডে বসে আছে। শৌভিক হাসবে না কাঁদবে বুঝল না এখন। তবে পেট ফেটে হাসি আসছে তার। তবে তা কোনোমতে চেয়ে বলল,
“তা ভেজালমুক্ত প্রেমিকা কোথায় পাবেন আপনি?”
“আছে। আপনার মন মতো খুঁজে দেব। একদম বিশুদ্ধ প্রেমিকা।”
শৌভিক আর মুখে কিছু বলল না। একমনে চেয়ে রইল এই বোকা মেয়েটির দিকে। নির্বোধ এই নারী যদি জানত তাকেই এই দুটো চোখজোড়া প্রেমিকা নজরে দেখতে পেরেছে তবে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো?
আকাশে মেঘের শোরগোল। চলছে বিদ্যুতের খেলা। মোহ হাঁটছে। মনোযোগ নেই রাস্তায়। নিজের মনকে শক্ত করতে চাইছে সে। কিন্তু দুর্বলতা তাকে আঁকড়ে ধরছে যেন! দমকা হাওয়ায় মাথা থেকে তার ওড়না পড়ে যায়। আকাশ পানে তাকায় মোহ। এই মেঘলা আকাশ, দমকা হাওয়াগুলো যেন জোর করে মনে করাতে চাইছে সেই মানুষটিকে। বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করল। মোহের হেলদোল হলো না। তবে আর হাঁটবে না সে। দাঁড়িয়ে থাকবে কিছুটা সময়। এখান থেকে অটোতে ওঠার চেষ্টা করবে। বৃষ্টির বেগ জোরে হলো। এই বর্ষণ দুটো মানুষকে কাছে এনেছিল। দুটো মানুষেট সংঘর্ষের পর তারা কোথাও গিয়ে মিলে গিয়েছিল। তখন থেকে বর্ষণে প্রেম খুঁজে পেতো মোহ। বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে দিলো মোহ। হাতে এসে জমা হলো বৃষ্টির বিন্দু। এমনই এক দিনে তার হাতে হাত ছিল স্বচ্ছের। হাতে হাত রেখে বৃষ্টি উপভোগ করেছিল তারা। মুহূর্তটা কোথাও অনেক তৃপ্তি আঁটকে গিয়েছিল। হঠাৎ মোহের ওড়নায় টান পড়ে। চমকে গিয়ে পিছু ফিরে তাকায় সে। একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়েকে ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ম্লান হাসি দেয়। কোনো কথা না বলে সরাসরি বাচ্চাটি তার হাতে থাকা অন্য ছাতা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“ভিজে যাচ্ছো তো। এই বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে। এই নাও আমার কাছে আরেকটা ছাতা আছে। এটা নাও।”
মোহ শান্ত সুরে উত্তর করল,
“না, বাবু। তোমার ছাতা আমি কী করে নেব বলো? ফেরত দেব কী করে?”
বাচ্চা মেয়েটি চুপ হয়ে কী যেন একটা ভাবতে লাগল। অতঃপর আবার বলল,
“তোমার বাসা কতদূর?”
“অনেকদূর!”
“আচ্ছা তাহলে ছাতাটা নাও। গাড়িতে ওঠার পর আমাকে দিয়ে দিও।”
বাচ্চার আবদার আর না রেখে পারল না মোহ। ছাতাটা মেলিয়ে নিজের মাথা উপরে ধরে মেয়েটির গালে হাত বুলিয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ।”
জবাবে ছোট্ট মেয়েটি একটি প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে পিছু তাকাল। মোহ আশেপাশে দেখে বলল,
“এখানে হয়ত গাড়ি পাব না। সামনে মোড়ের দিকে যেতে হবে।”
বাচ্চাটি বাধ্য মেয়ের ন্যায় বলে ওঠে,
“আচ্ছা। আমিও যাচ্ছি তাহলে তোমার সাথে।”
মোহ আর মেয়েটির পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বাচ্চা মেয়েটি হাঁটছে তার পেছনে তাকাচ্ছে। কিছু একটা মনে করে ভ্রু কুঁচকে নিজেও ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে নিলো মোহ। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির আগমনে কেউই নেই তেমন রাস্তায়। তাই সে আর কিছু না ভেবে সামনে এগিয়ে গেল।
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১০ [দ্বিতীয় খণ্ড]
বাহিরে থেকে পুরো ভেজা অবস্থায় বাড়ি ফিরল স্বচ্ছ। এখনো টপটপ করে পানি পড়ছে চুল আর জামাকাপড় থেকে। ছেলের এমন দশা দেখেই হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে এলেন মিসেস জেবা। বিচলিত হয়ে স্বচ্ছকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
“স্বচ্ছ! তুমি তো গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলে। তাও এভাবে ভিজলে কী করে? জানো, এই মৌসুমে ভিজলেই মানুষ কতটা অসুস্থ হয়ে পড়ে?”
ইতিমধ্যে চোখ ছোটো হয়ে এসেছে স্বচ্ছের। নিজের এক হাত কাঁধে রেখে ঘাড় বাঁকাতে বাঁকাতে মিসেস জেবাকে সে ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দিলো,
“সামান্য অসুস্থ হলে মানুষ ম/রে যায় না, মা।”
মিসেস জেবা হকচকিয়ে উঠলেন ছেলের মুখে এমন অলক্ষুণে কথা শুনে। চিল্লিয়ে স্বচ্ছের নাম ডাকলেন।
“স্বচ্ছ!”
স্বচ্ছের আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। মাথা খুব ব্যথা ধরে আছে। ঘুমানো দরকার। মায়ের পাশ কাটিয়ে আস্তে করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে গেল সে।
পড়ে পড়ে সন্ধ্যেবেলা ঘুমোচ্ছে সৌমিত্র। আচানক তার ফোনের রিংটোন তার শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলে। চোখমুখে বিরক্তির ছাপ পড়ে তার। ফোনটাকে পাত্তা না দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে ঘুমে মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করে। তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয়না। আবারও ফোনটা বেজে ওঠে। উল্টো হয়েই হাত বাড়িয়ে ফোনটা টেবিল থেকে নিয়ে সরাসরি রিসিভ করে সে। সৌমিত্র জানে এখন তার বন্ধুরা ছাড়া কেউ তাকে কল করবে না। তাই সে বলে ওঠে,
“কল ধরছি না মানে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছি বুঝিস না নাকি, শালা? দেখা হলে কানের নিচে মে/রে বালি চা;পা দিয়ে দেব।”
“বালি চাপা দিতে গেলে আপনাকে হয় সমুদ্র নয়ত মরুভূমিতে যেতে হবে।”
মেয়েলি কণ্ঠ। এই সুমধুর কণ্ঠে চোখটা মেলে তাকায় সৌমিত্র। দ্রুত আগে কানের কাছ থেকে ফোন নামিয়ে দেখে নিলো স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে রয়েছে ‘মিস. গোলাপি’ নামটি। সৌমিত্র প্রথমেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিজের আরেক হাত দিয়ে দুটো গালে চাপড় মা/রল। ঢক গিলে ফোনটা আবারও কানের কাছে ধরতে তানিয়া বলল,
“আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজে কি ডিস্টার্ব করলাম? তাহলে আমি রাখছি ঠিক আছে?”
সৌমিত্র ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল এবার। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“না, না। আমি একদম ডিস্টার্বড হইনি। যদি সামান্য ডিস্টার্ব ফিল করতামও তবে আপনার জন্য তা তাড়িয়ে দিতে রাজি!”
তানিয়ার হাসি পেল এবার। স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“একটু আগেই তো আপনি আমাকে বালি চাপা দিতে চাইলেন। আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর অপ/রাধে।”
সৌমিত্র কী বলবে বুঝতে না পেরে এক মুহূর্ত থম মে/রে রইল। পরক্ষণেই ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“একটা সিক্রেট বলি? আসলে আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলতে কিছুই নেই। সত্যি বলছি।”
তানিয়া এবার ফিক করে হেসেই ফেলল। এক মুহূর্ত আগে মনে থাকা এক বিরাট বিষণ্নতার পাথর সরে গেল সে যেন টের পেল। সৌমিত্র যেন তার বিষণ্নতা দূর করবার ঔষধ।
“এমনিতে মোহকে কল করতে গিয়ে আপনার কাছে কল চলে গিয়েছে। আমি খেয়াল করিনি। আপনার বালি চাপা দেওয়ার কথা শুনে বুঝেছি আমি মিস্টেক করে আপনাকে কল করে ফেলেছি।”
“উঁহু! ওই ভুলও যে ভাগ্যে লেখা ছিল। একটা ভুল একটা ভাগ্য পাল্টাতে পারে।”
তানিয়া এবার খানিকটা ভাবুক হয়ে উঠল। কণ্ঠস্বর কিছুটা ভার হলো এবার।
“হয়ত তাই হবে। আসলে মোহের থেকে একটা সাজেশন নেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু আমি জানি এক্ষেত্রে ওর সাজেশন কী হবে। আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
সৌমিত্র হালকা হেসে তানিয়ার কথায় মনোযোগ দিয়ে বলে ওঠে,
“দুটো করলে বেশি খুশি হবো।”
তানিয়া কিছুটা সময় নিয়ে আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
“যদি কখনো আপনি আপনার প্রাক্তনের বিয়ের কোনো ইনভাইটেশন পান তবে সেখানে কি উপস্থিত থাকবেন আপনি? আসলে সেই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত?”
সৌমিত্র বিনা ভাবনাচিন্তা ছাড়াই বলে ফেলল,
“আমি তো আমার দুটো এক্সের বিয়ের দাওয়াত চেয়ে চেয়ে নিয়েছি। এত কিপটে ছিল ওরা বিশ্বাসই করবেন না! আরেকটা এক্সের মন বড়ো ছিল তাই নিজে থেকে ইনভাইট করেছিল। আরেকটা তো শুনি খরচের ভয়ে পালিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। ভাবতে পারেন মিস. গোলাপি? বাবা-মায়ের পুরো খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে।”
সৌমিত্রের কথাবার্তা শুনে তানিয়া নিজের দুঃখ প্রকাশ করবার কথা ভুলে গিয়ে হতবাক হয়ে বসে রইল। তার কি হাসা উচিৎ নাকি রাগা উচিৎ বোধ করতে পারল না। তানিয়ার নীরবতা দেখে সৌমিত্র কী যেন একটা ভেবে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ওয়েট! আপনার প্রাক্তন আপনাকে তার বিয়ের জন্য ইনভাইট করেছে?”
তানিয়া মিনমিন করে বলল,
“হুঁ। রিসেপশন আছে কালকের পরের দিন ওদের। সেটাতে যাওয়ার জন্য ইনভাইট করেছে।”
সৌমিত্র এবার আরো হেসে সরাসরি বলে দিলো,
“ওয়াও! আপনার প্রাক্তন তাহলে কিপটে নয়। আমি তো আপনাকে সাজেস্ট করব আপনি যাবেন। শুধু তাই নয়, একটা ভালো গিফট নিয়ে যাবেন। পারলে একবেলা না খেয়ে যাবেন যাতে তার রিসেপশনে বেশি বেশি খেতে পারেন।”
তানিয়া হাফ ছেড়ে বলল,
“আমার হয়ত আপনার মতো বুকের পাটা হবে না। যে প্রাক্তনের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে আনন্দ করতে পারব!”
সৌমিত্র মজা করা বন্ধ করল এবার। তানিয়ার বিষণ্নতা প্রথমেই উপলব্ধি করলেও তাকে হাসানোর চেষ্টাই ছিল সে। এখন গাম্ভীর্য ধারণ করল সে।
“আমি তো জীবনে একটা প্রেমেও সিরিয়াস ছিলাম না। কারোর সাথে আমার প্রেম দুই মাসের বেশি টিকতে পারেনি। কিন্তু আমি জানি আপনি তার সাথে কয়েকটা বছর ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিলেন। আর সে আপনাকে একারণেই ইনভাইট করেছে। আপনার প্রাক্তন দেখতে চায় আপনি তাকে ছাড়া কতটা ভেঙে পড়েছেন। আর সে দেখাতে চায় আপনাকে ছেড়ে সে কতটা ভালো আছে। আপনার সেখানে যাওয়া উচিৎ। গিয়ে দেখিয়ে দেবেন ঠিক উল্টোটা। আপনি তাকে ছাড়া নিজের জীবনটা কতটা সুন্দর উপভোগ করছেন তা দেখাবেন। আমি আমার কথা বললাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছে মিস. গোলাপি!”
তানিয়া চুপ রইল খানিক্ষণ। শ্বাস-নিঃশ্বাস ঘন হলো তার। সৌমিত্র এপাশ থেকে তা শুনতে পাচ্ছে। তানিয়ার নীরবতা তাকে ভাবাচ্ছে। তবে একটা বিষয় সে মনে চেপে রেখেছে কয়েকদিন। তানিয়া এখনো কেন তার প্রাক্তনকে ভুলতে পারছে না সেদিকটি তাকে ভীষণ ভাবায়৷ শান্তি পেতে দেয় না মাঝরাতেও। এই বিষয়টা অসহ্য লাগলেও সে প্রকাশ করে না। একটা সময় তানিয়া আচানক বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে। আমি ফোন রাখছি।”
সৌমিত্রের উত্তরের অপেক্ষা না করেই কল কেটে দিলো তানিয়া৷ সৌমিত্র ফোন ধরে বসে রইল ঘুম ঘুম চোখে। দরজা খোলার জোরে শব্দ পেয়ে অনেকটা চমকে গিয়ে সামনে তাকাল সে। ফারাহ ছুটে এসেই সৌমিত্রের সামনাসামনি বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে তার নজর গেল কল লিস্টে থাকা সবার উপরের নামটি। চোখ ছোটো করে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
“মিস গোলাপি? এটা আবার নতুন কে?”
সৌমিত্র তাড়াতাড়ি নিজের ফোন অফ করে দিলো। চেঁচিয়ে বলল,
“মুখে তো খুব বলিস, আই এম অ্যা পারফেক্ট ওম্যান। দুনিয়ার সকল সভ্যতা তোর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা আছে। তাহলে অন্যের ফোন চোরের মতো স্টক করিস কেন?”
ফারাহ্ মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“আরে ধুর! ভাই-বোনদের সাথে এত সভ্যতা খাটানো যায় না।”
সৌমিত্র ফারাহর মতো ভাব নিয়ে হেসে বলল,
“তা অসময়ে আমার ঘরে কী করতে এলেন ওয়ান ওফ দ্যা বেস্ট মিস. ডিজাইনার?”
ফারাহ এবার নড়েচড়ে বসল পা তুলে নিজের ছোটো ভাইয়ের দিকে। মুখটা ভীষণ জড়োসড়ো করে বলল,
“ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে৷ আচ্ছা, তোমার কী মনে হয়? ভাইয়ার সাথে মোহের কী হয়েছে? তোমার কী মনে হয় না তাদের মধুর সম্পর্কে কোনো বাঁধা পড়েছে?”
“সেটা তোর আগে আমি খেয়াল করেছি। এমনকি ভাবির সাথে আলোচনাও করেছিলাম। কিন্তু এই দুজনের মনোমালিন্যের আগামাথা কিছুই খুঁজে পেলাম না। এমনকি ভাইয়া বলেছে ভাবির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না।”
ফারাহ ফট করে চুটকি বাজিয়ে বলল,
“আমি কিন্তু কারণটা জানি।”
সৌমিত্রও এবার আগ্রহী হয়ে তাকাল বোনের দিকে। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তাড়াতাড়ি বল! আমি চাইনা আমার ভাইয়ের বিয়েশাদি না হওয়ার জন্য আমার বিয়েটাও আঁটকে থাক।”
ফারাহর এবার শৌভিকের কথা স্মরণ হলো। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“অ্যা থার্ড পারসন! তৃতীয় ব্যক্তির জন্য সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না আমি জানপ্রাণ দিয়ে এই থার্ড পারসনকে উপড়ে ফেলে দেব। আমি সেই ব্যবস্থাও করে ফেলেছি। কিন্তু এখন আমাদের কী উচিত না ভাইয়া আর তার না হওয়া বউয়ের মাঝে কমিউনিকেশন বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা?”
সৌমিত্র ভাবতে শুরু করল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“কিন্তু কী করে?”
ফারাহ ভাব নিয়ে চুল ফু়ঁ দিয়ে উড়িয়ে বলল,
“একারণেই আমি এসেছি। আমি জানি তোমার মতো আস্ত একটা গাধার মাথায় এসব লাভ কমিউনিকেশনের বিষয় ঢুকবে না।”
ফারাহর মাথায় এবার মে/রে দিলো সৌমিত্র। তাকে তার ভাবভঙ্গি ভেঙ্গিয়ে বলল,
“তুই তো প্রেম নিয়ে পিএইচডি করে ফেলেছিস মনে হচ্ছে? জীবনে একটা প্রেম অবধি করতে পেরেছিস? আমি কয়টা প্রেম করেছি জানিস?”
ফারাহ এবার আরো দ্বিগুণ ভাব নিয়ে অনেকটা দাম্ভিক কণ্ঠে বলল,
“কোচ কখনো খেলতে মাঠে নামে না, ব্রো! কোচ ট্রেনিং করায়।”
একটু থেমে ফারাহ আবার বলে,
“আচ্ছা যেটা বলতে চাইছি সেটা শোনো। স্বচ্ছ ভাইয়ের অনেক জ্বর এসেছে বুঝলে? নাক-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে পুরো। একটা কাজ করা যাক! এই অসুস্থতার খবরটা ভাইয়ার প্রিয়তমা অবধি পৌঁছে দিলে কেমন হয়?”
সৌমিত্রের ঠোঁট প্রসারিত হয়ে হাসি আপনাআপনি বেরিয়ে আসে। ফারাহ একচোখ টিপে বলে,
“লেটস ডু ইট।”
আধঘণ্টা ধরে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে মোহ। স্ক্রিনে স্বচ্ছের নম্বরটা ভাসছে। সে কল করতে চাইছে স্বচ্ছকে। সৌমিত্র আধঘণ্টা আগেই কল করেছিল তাকে। জানিয়েছিল স্বচ্ছের অসুস্থতার কথা। তখন থেকে মনটা অস্থির হয়ে আছে তার। একটি বার তার খবর নিতেই হবে তার৷ তবে যদি কল না ধরে? মোহ আবার অপমানিত হবে। আর এই অপমানিত হওয়া জিনিসটাকে সে বরাবরই ঘৃণা করে এসেছে। কিন্তু একটা সময় মোহের সামান্য আ/ঘাতে স্বচ্ছের চিন্তার পাগলামি ছিল আকাশ ছোঁয়া। সেখানে সে কেন এত দেরি করছে স্বচ্ছের খোঁজ নিতে? অবশেষে মনের সাথে যুদ্ধ করে কলটা করেই ফেলল মোহ।
বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে রয়েছে স্বচ্ছ। প্রসারিত তার কপালে ভেজা কাপড় দেওয়া। যাকে বলে জলপট্টি। জ্বরের চোটে চোখমুখ লাল হয়ে এসেছে তার। মাঝে মাঝে ভীষণ কাশি উঠছে। মিসেস জেবা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। ছেলের মাথায় জলপট্টি দিয়ে ছেলের জন্য খাবার আনতে চলে গেছেন। ফোনের রিংটোন কানে এলে চোখ খুলল স্বচ্ছ। তীব্র জ্বরে চোখ দুটো ছোটো হয়ে এসেছে তার। টেবিল থেকে হাতিয়ে ফোনটা নিলো সে। ছোটো এবং ঘোলাটে দৃষ্টি মোহের নামটুকু দেখে থমকে গেল যেন। মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে উঠে বসল সে। কল রিসিভ করবে কি করবে না ভাবতে ভাবতে শেষ মুহূর্তে কল রিসিভ করে বসল সে। কানে ধরতেই পরপর দুটো হাঁচির শব্দ শুনতে পেল। ভ্রু দুটি কুঞ্চিত হলো তার। ওপাশ থেকে নরম কণ্ঠ তার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল,
“হ্যালো!”
স্বচ্ছ দুর্বল কণ্ঠটি কঠিন করার চেষ্টা করে বলল,
“হুমম বলো!”
মোহ থম মে/রে বসেই রইল। মাথা নিচু করে নিজের ওড়না শক্ত করে চেপে ধরে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
“আপনি ঠিক আছেন?”
“কেন? কী হয়েছে আমার?”
মোহ আরো শক্ত করে নিজের ওড়না খামচে ধরল। ঢক গিলে বলল,
“কেউ একজন বলল আপনার গায়ে অনেক জ্বর তাই বলছিলাম। আপনি কেমন আছেন এখন? জ্বর কমেছে?”
‘কেউ একজন’ কথাটি শুনে প্রথমেই ব্যক্তিটিকে উপলব্ধি করে ফেলল স্বচ্ছ। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দরজার আড়ালে বের হয়ে যাওয়া একটা হাতকে দেখতে পেল সে। বুঝতে দেরি হলো না তার দরজার আড়ালে সৌমিত্র লুকিয়ে তার কথা শুনছে। স্বচ্ছ বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি ঠিক আছি। সামান্য জ্বরে তেমন কিছু হয়না। ম/রে যাইনি আমি। ম/রে যেতে লাগলেও নিশ্চিত তুমি ওই কেউ একজনের থেকে খবর পাবে।”
মোহের কণ্ঠ হুট করে শক্ত হয়ে এলো। ঢক গিয়ে বলল,
“কথায় কথায় ম;রে যাওয়ার কথা বলার অভ্যেস ত্যাগ করার চেষ্টা করবেন। হয়ত এই কথায় আপনার খারাপ লাগে না তবে অন্যের খারাপ লাগতেই পারে। তার হৃদয়ে চোট লাগতে পারে। তার মনটা চূর্ণ বিচূর্ণ হতে পারে। সেসব হয়ত আপনার নজরে আসবে না।”
“আমি চাইব আমার জন্য তার হৃদয় ব্যথিত না হোক। আমার জন্য তার ছোট্ট এবং স্নিগ্ধ মনটা চূর্ণ না করুক। কারণ সামনে অনেক পথ চলা বাকি।”
মোহ মিথ্যে হেসে বলে,
“যদি হৃদয়কে বোঝানো যেত কারোর জন্য ব্যথিত না হতে তবে বোধহয় আগে হৃদয় তার নামটা মুছে ফেলত।”
নিজের গায়ে দেওয়া চাদর জোরে চেপে ধরে বসে রইল স্বচ্ছ। চোখমুখের গভীর রক্তিম বর্ণ ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করল। কণ্ঠ কাঁপছে তার। তবুও স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় সে বলল,
“আর কিছু জানার আছে?”
মোহ নিচু স্বরে জবাব দিলো,
“নিজের খেয়াল রাখার চেষ্টা করবেন। আপনার অসুস্থতা আপনার কাছে খারাপ না-ই লাগতে পারে। তবে আপনার আশেপাশের মানুষদের তা পীড়াদায়ক।”
মোহ কল কেটে দিলো। স্বচ্ছ ফোন হাতে নিয়ে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তখন মিসেস জেবার আগমন ঘটল। ফারাহ এবং সৌমিত্রকে একসাথে তাদের বড়ো ভাইয়ের ঘরের দরজার আড়ালে দেখে হতবাক হলেন তিনি। দুই ভাইবোন জোর কদম চালিয়ে গেল ইশারা যেন তাদের মা তাদের কথা স্বচ্ছকে না বলে দেয়। তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছ মিসেস জেবাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
“মা তোমার দুই ছোটো ছেলেমেয়েকে বলে দাও মাইক নিয়ে আমার অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে দিতে।”
চলবে….