যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
6

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৪ [দ্বিতীয় খণ্ড]

স্বচ্ছকে ভিজে গায়ে দেখে সরোয়ার সাহেব ব্যতিব্যস্ত হলেন। উৎকন্ঠা হয়ে শুধালেন,
“তোমার শরীর এমনিতে ভালো নয়। কোথা থেকে ভিজে আসছ? বাহিরে তো বৃষ্টিও হয়নি! তবে? দিনদিন নিজের প্রতি খুব বেখেয়ালি হচ্ছো, স্বচ্ছ।”

স্বচ্ছ কাঁপছে থরথর করে। জ্বর উঠেছে তার প্রচণ্ড। কিন্তু তা স্বচ্ছের মনের রাগ পুষিয়ে রাখতে ব্যর্থ। তার দুর্বল চোখে ভাসছে পানিতে মৃ/ত্যুর সামনে থাকা মোহ এবং এসবের পেছনে তার বাবা। সে এগিয়ে এলো সরোয়ার সাহেবের দিকে। সরোয়ার সাহেব ছেলের অবস্থা দেখে খানিকটা ভড়কালেন। লাল চোখমুখে প্রচণ্ড অসুস্থতা! স্বচ্ছকে চুপ থাকতে দেখে তিনি আবারও বললেন,
“স্বচ্ছ! নিজের ঘরে যাও আর পোশাক পাল্টাও নিজের। কোনো কথা থাকলে পরেও বলা যাবে। ঠাণ্ডা বসছে তোমার গায়ে। আর তখন মেহমানদের সামনে এভাবে উঠে চলে গেলে কেন? এটা কোন ধরনের অভদ্রতা?”

স্বচ্ছ দাঁড়িয়ে থেকে শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়তে চাইল। তবে তার শক্তি অবশিষ্ট নেই। সে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল। সরোয়ার সাহেব ছেলের দুর্বলতা দেখে উঠে দাঁড়ান তড়িঘড়ি করে। উনাকে স্বচ্ছ উদ্দেশ করে বলল,
“আমার এই অবস্থা কেন সেটা তোমাকে তোমার লোকেরা এখনো জানায় নি বাবা?”

স্বচ্ছের কণ্ঠে তেজ নেই। রয়েছে দুর্বলতা, শীতলতা।সরোয়ার সাহেব ছেলের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলেন না।
“কী বলছ তুমি? বুঝলাম না ঠিক!”

সরোয়ার সাহেবের অস্বীকার্য শুনে ভেতরটা হতাশ হলো স্বচ্ছের। সে মাথা উঁচিয়ে তাকানোরও শক্তি পাচ্ছে না আর। তবুও সে থেমে থেমে বলল,
“আপনি কি কখনো থামবেন না মন্ত্রী সাহেব?”

সরোয়ার সাহেব তখনও বুঝলেন না। এবার ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। বিরক্তও হলেন বেজায়।
“স্বচ্ছ তুমি কী বলছ? জ্বরের ঘোরে তোমার মাথা ঠিক নেই। আমি তোমার মাকে ডাকছি দাঁড়াও।”

সরোয়ার সাহেব নিজের স্ত্রীকে ডাকতে উদ্যত হলেন। তৎক্ষনাৎ নিজের সামর্থ্যের বিরুদ্ধে টলমল করে উঠে দাঁড়াল স্বচ্ছ। ক্রোধে ফেটে পড়া কণ্ঠ বেরিয়ে এলো তার। হুংকার ছেড়ে বলল,
“আপনার এই না জানার ভান আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি কি মোহকে রেহাই দেবেন না? আপনি বলেছিলেন আপনার কথামতো চলতে। আমি সব করেছি মোহের জন্য। আপনার প্রতি এতটুকু বিশ্বাস ছিল যে আমি আপনার কথা শুনলে হয়ত মোহকে আপনি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ওর প্রতি আরো দশগুন নিষ্ঠুর হলেন আপনি। জঘন্য পরিকল্পনা করলেন নদীতে ফে/লে হাত-পা বেঁধে খু/ন করার। এত জঘন্য মানুষে কেন পরিণত হলেন আপনি?”

হকচকিয়ে উঠলেন সরোয়ার সাহেব। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরতে থাকল উনার। ছেলের পানে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বললেন,
“স্বচ্ছ! আমি এমন করিনি। এটা হতেই পারে না। অসম্ভব!”

“আপনি কতটা নিচে নামতে পারেন তার প্রমাণ আমি আগেও পেয়েছি। কী করলে আপনি থামবেন বলুন? আপনি আমার বাবা না হলে অন্য কথা ছিল। আপনাকে খু/ন করে আমি আজীবন জেলে কাটাতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই বাপ-ছেলের সম্পর্কের কারণে আমি সেটাও পারছি না। আপনি একটা মেয়ের সঙ্গে আমার জীবনটাও জাহান্নাম বানিয়ে তুলেছেন। ওই মেয়েটার সঙ্গে আমি গভীরভাবে জড়িত তা জানার পরেও।”

সরোয়ার সাহেব স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। দিশেহারা বোধ করলেন। সেই সঙ্গে হলেন বিভ্রান্ত। স্বচ্ছকে ভীষণ উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলছে। শরীর টলমল করছে। তিনি কোনোরকমে স্বচ্ছের হাত ধরে আশ্বস্ত করতে চাইলে নিজের হাত সরিয়ে চোখমুখ খিঁচে ফেলল স্বচ্ছ। তার মুখশ্রীতে ঘৃণ্য অনুভূতি স্পষ্ট। সরোয়ার সাহেব কোনোরকমে বললেন,
“আমি এবার এমন কিছু করিনি। আমার উদ্দেশ্যে ছিল শুধুমাত্র তোমাকে আবার আগের মতো ফিরে পাওয়া। তুমি যেন আমার কথা শুনে চলো আগের মতো আমি সেটাই চাইছিলাম এবং সেটা পেয়েও গিয়েছিলাম। আমার একটা কথারও অমান্য করো নি। তাও কেন আমি এসব ঘাঁটাতে যাব বলো, স্বচ্ছ?”

স্বচ্ছ নিস্তেজ গলায় পাল্টা জবাব দিলো,
“সেটা তো আপনি জানেন! আপনাকে আর আমি দুচোখে সহ্যও করতে পারছি না। আপনি নিজের অপ/রাধ স্বীকার করবেন না। তাই তো?”

সরোয়ার সাহেব স্বচ্ছকে বোঝাতে ব্যর্থ হলে আরো বিভ্রান্তিতে পড়েন। কী বলে স্বচ্ছকে শান্ত করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। তিনি কিছু বলার জন্য উদ্যত হলেন তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছের নজর গেল ছোটো টেবিলে থাকা কাঁচের ছোটো ফুলদানির দিকে। হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে টেবিলে আঘাত করে সেটাকে ভেঙে ধারালো করে ফেলল সে। ভাঙার আওয়াজে চমকে উঠলেন সরোয়ার সাহেব। দুই পা পিছিয়ে গেলেন। স্বচ্ছ হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে থাকল,
“আপনাকে তো আমি মা/রতে পারব না। কারণ ওইযে বাবা-ছেলের সম্পর্ক! কিন্তু আপনি স্বীকার না করলে আমি নিজেকে মা;রতে পারব।”

কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দ কানে এলে ঘরের দরজার কাছে এসে থমকাল ফারাহ। পিলে চমকে গেল ওর। সে ভাবেও নি তার ভাইয়ের মাথায় এত ভয়ানক কিছু চলছে। পিছু পিছু হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন মিসেস জেবা। সরোয়ার সাহেব ছেলের এমন পাগলামি দেখে উনার নিজের মস্তিষ্কই শূন্য হলো। হাত উঁচিয়ে ছেলেকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে উনি বলেন,
“না,না,না। পাগ/লামি করো না। আমাকে এবার বিশ্বাস করো। আমার লক্ষ্য ছিল তুমি আর আমি সেটা পেয়েছি। একটা কথা ভেবে দেখো, আমি এখনো পুলিশের নজরবন্দি। আমার ফোন থেকে শুরু করে আমি কখন কোথায় যাই সব ইনফরমেশন পুলিশ প্রতিটা আপডেট পায়। যদি এমন কিছু করতাম তাহলে পুলিশ এতক্ষণে জেনে যেত। আমাকে অবিশ্বাস করো বলে সবকিছুতেই আমাকে ইনভলভ না করে একটু লজিক ভাবো স্বচ্ছ। তুমি যা করছ বোকামি।”

ফারাহ এই সুযোগে দ্রুত এগিয়ে এসে স্বচ্ছের হাত থেকে ভাঙা কাঁচের ফুলদানি কেঁড়ে নিলো। ভাগ্যিস বেশ আলগা করে ধরে ছিল জিনিসটা! সেই সাথে ফারাহ খেয়াল স্বচ্ছের শরীর প্রচণ্ড গরম। তাপে যেন দগ্ধ হচ্ছে সমস্ত গা৷ ফারাহ তার কাঁধ চেপে ধরে অস্থির চিত্তে বলল,
“ভাইয়া, ও ভাইয়া! এমন করো না। আমার সাথে ঘরে চলো। তোমার শরীরে অনেক জ্বর।”

মিসেস জেবাও কী করবে ভেবে কূল পেলেন না। ছেলের কাছে এসে বাবা ও ছেলের দ্বন্দ্ব দেখে কেঁদে ফেললেন। স্বচ্ছকে অনুরোধ করে বলে ওঠেন,
“দোহাই লাগে, আমার সাথে চলো। আমি জানি না তোমার বাবা কী করেছে। কিন্তু তোমার শরীরের দিকে একটু তাকাও স্বচ্ছ।”

আর কোনো কথা বের হচ্ছে না স্বচ্ছের মুখ থেকে৷ শরীরের কাঁপুনি বেড়েই চলেছে তার। চোখ দুটো দিয়ে সব ঘোলা দেখছে। সরোয়ার সাহেবের মুখটাও অস্পষ্ট হচ্ছে সময়ে সময়ে তবুও সে আঙ্গুল উঠিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আপনি ছাড়া মোহের আর কোনো শত্রু নেই। আর কে এত জঘন্য পরিকল্পনা করতে পারে! আপনি আবারও ছল করছেন আমার সঙ্গেও।”

“যদি তোমার তাই মনে হয় তাহলে তোমার যেভাবে মন চায় আমার থেকে প্রমাণ নিতে পারো। আমি এখনো সম্পূর্ণ উপরমহলের পুলিশের হেফাজতে। চব্বিশ ঘণ্টা নজর আছে। তাই এটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”

স্বচ্ছের মাথায় এই মুহূর্তে আর কোনো কথা ঢুকল না। সবটা অস্পষ্ট লাগছে। সে ঢলে পড়ছে। ফারাহ আর মিসেস জেবা মিলে তাকে ধরল। চোখ বুঁজে এসেছে তার। সরোয়ার সাহেবও এগিয়ে এলেন। শরীরে আর বাকি শক্তিও অবশিষ্ট নেই তার।

রাতে রেড ওয়াইন বা হু/ইস্কি খাওয়ার অভ্যেস আছে নাহিয়ান রায়হানের। বিশাল বাড়ির দ্বিতীয় রুফটপের পাশেই ছোটোখাটো ব্যক্তিগত বার রয়েছে উনার। প্রতিদিন রাতে সময় কাটান এবং একা একা ভাবনাচিন্তা করতে পছন্দ করেন। আজকেও তার বিপরীত কিছু ঘটেনি। উপুড় করা কাঁচের গ্লাস সোজা করে রেখে ওয়াইনের বোতল শেল্ফ থেকে বের করলেন তিনি। হঠাৎ তার কাজে বাগড়া দিয়ে বসল অন্বেষা। তার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে মৃদু হাসি দিয়ে বলল,
“লেট মি ডু ইট!”

অন্বেষা বোতল কাঁত করতেই গ্লাসে হালকা তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়ল। অতঃপর গ্লাসটি হাতে নিয়ে মিষ্টি হাসির সঙ্গে ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো অন্বেষা এবং শুধাল,
“আজকে টেনশনের এমাউন্ট বেশি মনে হচ্ছে!”

নাহিয়ান গ্লাসে চুমুক দিয়ে মেঝের দিকে একপানে তাকিয়ে থেকে বললেন,
“না, তেমন কিছু না। শুধু ভাবছি ওই স্বচ্ছ ছেলেটার কথা।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং! তাই না?”

“তোমার ওকে ভালো লেগেছে মনে হচ্ছে!”

নাহিয়ানের কথায় হাসিটা প্রসারিত হলো অন্বেষার। তার হাসিতে তার উত্তর লুকিয়ে। নাহিয়ান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আদেও স্বচ্ছ তার জন্য ঠিক কিনা সেটা ভেবে। অন্বেষা বলতে থাকল,
“আমি তো পুরোটা সময় তার চোখই দেখেছি। ঘোলাটে চোখের মণিতে অনেক কিছু লুকানো জানো, ভাইয়া? আর সব থেকে বড়ো কথা হচ্ছে আমি ভেবেছিলাম আমি সব পুরুষের নজর কাঁড়তে পুরোপুরি সক্ষম। কিন্তু সে আমাকে ভুল করে দিলো! আমি আমাকে তার চোখে দেখতে পাইনি একবারও। আর তখন থেকে আমার লক্ষ্য এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আমায় ওর নজরে আসতে হবে। ওর ধূসর মণিতে আমি বিচরণ করব।”

বোনের কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন নাহিয়ান। অন্বেষার মতো জেদি মেয়েটাকে সে কীভাবে সামাল দেয় সে নিজেই জানে। নিজেকে ধাতস্থ করে অন্বেষাকে ধীর গলায় বলল,
“তুমি এই ব্যাপারেও জেদ করছ? এটা কিন্তু সারাজীবনের ব্যাপার।”

অন্বেষা নাহিয়ানের কথার গভীরতা বোঝারও চেষ্টা করল না। সরাসরি বলে দিলো,
“জেদই তো আমাদের টিকিয়ে রাখে, ভাইয়া।”

অন্বেষার কথার পৃষ্ঠে আর কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পেলেন না নাহিয়ান। চুপচাপ গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকল। অন্বেষার দুচোখ চকচক করছে, চোখ ভর্তি আকাঙ্ক্ষা।

একেবারে গর্তে ঢুকে যাওয়া ঘন পাপড়িতে আবৃত নেত্রপল্লব পিটপিট করে চারিদিকে চাইল৷ ভেতরটা অস্থির অস্থির লাগছে মোহের। বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে আরম্ভ করে সে যেন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আচানক কর্ণকুহরে ভেসে আসে এক স্নেহময়ীর গলা। মায়ের গলা চিনতে ভুল হয়না। মোহ ভালো করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। আশেপাশে আর পানি চোখে পড়েনা তার। শুধু দেখতে পায় মিসেস সুফিয়াকে এবং একটু পিছে দাঁড়িয়ে আছে আজহার সাহেব ও উনার কোলে ইথান। ইথানকে দেখে উত্তেজনায় হুড়মুড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করে সে, তবে হাতে তৎক্ষনাৎ স্যালাইনের সুঁচের টান পড়ে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে সে। মিসেস সুফিয়াও বিচলিত হয়ে মেয়ের হাত ঠিক জায়গায় রেখে চিন্তিত সুরে বলেন,
“কী করছিস! হাতে ক্যানোলা লাগানো।”

মোহের হাতের পিঠে মিসেস সুফিয়া ছুঁতেই ‘উঁহু’ করে চোখ খিঁচে নিলো মোহ। তার মা খেয়াল করল তার হাতে কোনো কিছু বসে গিয়ে দাগ হয়ে গেছে। দুটো হাতের পিঠই অসম্ভব লাল হয়ে রয়েছে। মস্তিষ্ক পুরোপুরি সজ্ঞানে ফিরতেই ঈশানীর মৃ/ত্যুর দৃশ্য স্মৃতিতে ভেসে উঠতেই ভেতরটা নাড়া দিয়ে ওঠে মোহের। সে অসহায় পানে চাইল ইথানের দিকে। ইথান মিনমিন করে মোহকে ডাক দিয়ে ওঠে,
“মাম্মা!”

ইথানের দিকে তাকাতেই ঈশানীর মুখটা ভেসে উঠছে মোহের স্মরণে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মোহ। হাত বাড়িয়ে ইথানকে কোলে নিতে চায়। ছোটো ইথানও মাকে এতক্ষণ দেখতে না পেয়ে অনেক বিচলিত এবং উৎকণ্ঠিত। সেও দ্রুত আজহার সাহেবের কোল থেকে নেমে মোহের কাছে গিয়ে বসল। ইথানকে একহাতে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে মোহ শব্দ করে। অস্ফুটস্বরে বলে,
“ঈশানী, ঈশানী!”

মোহকে এই মুহূর্তে কী প্রশ্ন করা উচিত সেটা বুঝে উঠতে পারল না কেউই। সবাই নির্বাক হয়ে মোহের অবস্থাই পর্যবেক্ষণ করছে। সেই মুহূর্তে মোহই কান্না থামানোর চেষ্টায় ঢক গিলে মায়ের দিকে চেয়ে উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“আমাকে নদী থেকে কে উদ্ধার করেছে, মা?”

মিসেস সুফিয়া হাত দিয়ে ইঙ্গিত করেন মোহের বেডের অন্যপাশের দিকে। মোহ ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যপাশে শৌভিককে দেখে মনে মনে সামান্য বিস্মিত হলো বটে৷ দুর্বল স্বরে বলল,
“ভাইয়া, তুমি!”

শৌভিক চুপ থাকে৷ কেননা মিথ্যে বলতে তার মন সায় দিচ্ছে না, অপরদিকে স্বচ্ছ তাকে মানা করে দিয়েছে তার বিষয়ে যেন কাউকে না বলে। মোহও অনেকক্ষণ নীরব রইল। তার মনে হয়েছিল কখনো না কখনো স্বচ্ছ এসেছিল। সে সামান্য স্বচ্ছের কণ্ঠ পেয়েছিল। স্বচ্ছের বলা কথাটি যে এখনো তার কানে বাজছে। উষ্ণ আলিঙ্গন সে এখনো অনুভূতি করতে পারছে। খানিক সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরেছিল মোহের নদীর কিনারায়। সে কেশে উঠেছিল তখন। কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুই মনে নেই তার। তবে কি সবই ভ্রম? অবচেতন মস্তিষ্কও বিপদের সময় তাকেই খোঁজে? শৌভিকের প্রশ্নে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে তার।
“মোহ! তুমি কী করে পানিতে পড়ে গেলে? তুমি কি একাই পড়ে গিয়েছ? কে তোমায় হাত-পা বেঁধে ফেলে দিলো? বলতে পারবে? কাজটা কি সরোয়ার সাহেরের?”

আরিদ্রের চেহারাটা মনে ভেসে উঠতেই মুখটা তেতো হয়ে এলো মোহের। সে দ্রুত শৌভিকের জবাব হিসাবে মাথা নাড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বলতে লাগল,
“না, না, না। উনি নন। আমি জানি এটা কে করেছে। আমি তাকে মাটিতে পুঁ/তে ফেলতে চাই। ওই জা/নোয়া/র যত সেকেণ্ড মুক্ত ভাবে ঘুরে বেড়াবে সেই প্রতিটা সেকেন্ড আমার অন্তরাত্মা তড়পাবে।”

“কে সে? নাম কী তার? ও কি তোমার সাথে একাই এই কাজটা করেছিল? নাকি অন্য কারোর সাথেও একই কাজ করেছে? আসলে আমি আরেকটি মেয়েকে নদী থেকে উদ্ধার করেছি আর তোমার বান্ধবী তানিয়ার কথা অনুযায়ী সে তোমার বান্ধবী!”

মোহের হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যায় হুড়মুড় করেই। তার চাহনিতে অনেক আশা দেখে শৌভিক। মোহ বিড়বিড়িয়ে বলে,
“ঈশানী!”

ছোট্ট ইথানের কানে আসে ঈশানী নামটি। সে জিজ্ঞেস করে বসে,
“মাম্মা! ঈশানী আন্টির কী হয়েছে?”

ইথানের উত্তর মোহের নিকট নেই। মোহ নিজের মধ্যেই নেই তখন। নার্স এসে সেই মুহূর্তে মোহের হাত থেকে ক্যানোলা খুলে দেয়। মোহ অত্যাধিক আশা নিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে শৌভিককে জিজ্ঞেস করে,
“ও কোথায়? কোথায় রয়েছে ও? পাশের ওয়ার্ডে?”

মোহ শৌভিকের জবাবের তোয়াক্কাও করেনা। তাড়াতাড়ি করে ঝড়ের গতিতে ইথানের পাশ দিয়ে নিজের রুগ্ন শরীর নিয়ে নেমে ছুটেই বেরিয়ে যায়। সকলে প্রথমে থতমত খেলেও পরক্ষণেই তার পিছু নিলো। মোহ প্রথমে তার ডান পাশের কেবিনের দরজার কাঁচ দিয়ে দেখল ভেতরে কে আছে। সেদিকে ঈশানীকে না পেয়ে বাম দিকে ওয়ার্ডে দেখতে ছুট লাগাল সে। তার অভ্যন্তরে যে এখনো আশা বেঁধে রয়েছে যে, ঈশানী বেঁচে গেছে। বাম দিকে কেবিনে ঈশানীর মুখটা মোহের নজরে আসতেই তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলল সে। ওয়ার্ড বয় দুজন মিলে সবেই ঈশানীর দেহ স্ট্রেচারে তুলছিল। তা দেখে দৌড়ে এলো মোহ। একজনকে প্রায় ধা/ক্কা দিয়ে বলল,
“কী করছেন ওর সাথে?”

ঈশানীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মোহ। নিস্তেজ ঈশানীর মুখ। গলায় ফাঁ/সের দাগ স্পষ্ট। সেখানে মোহ হাত লাগিয়ে আদুরে গলায় মৃ/ত ঈশানীকে শুধাল,
“খুব যন্ত্রণা দিয়েছে ওই অমানুষটা তাই না রে?”

ওয়ার্ড বয় বিরক্ত হয়ে মোহের উদ্দেশে বলে ওঠে,
“আরে ম্যাডাম! কী করছেন? উনি তো ম/রে গেছেন।”

মোহ আরেকবার বড়োসড়ো ধা/ক্কা খেল। পা থেকে মাথা অবধি কেঁপে উঠল। মিসেস সুফিয়া এসে মোহের হাত চেপে ধরে বললেন,
“ও সত্যিই আর নেই রে মোহ! ওকে প্রশ্ন করে কী করবি? উপরওয়ালা তার আয়ু এই অবধিই রেখেছে। পাগলামি করিস না, মা। তোর শরীর খারাপ।”

মোহের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো যেন। সবটা অন্ধকার লাগল। তার উপরে যেন চেপে রেখেছে কেউ ভারি পাথর। শ্বাস নিতে কষ্ট অনুভব করল সে। মায়ের কাছ থেকে ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে। চোখে ভাসছে শুধু সেই নির্মম দৃশ্য। সে সেখানেই উপস্থিত ছিল। ঈশানীকে সে একটু একটু করে প্রাণ হারাতে দেখেছে কিন্তু কিচ্ছু করতে পারেনি। এই কষ্টটা তার ভেতরে ভীষণ পোড়াচ্ছে। সে মেঝেতে বসে পড়ল হাত-পা ছড়িয়ে। বিড়বিড়িয়ে বলতে আরম্ভ করল,
“আমি ছাড়ব না। আমিও তার গলায় ফাঁ/স দেব। আমার সম্মানও শেষ করতে চেয়েছে। আমি শেষ করতে চাই তাকে। আমি একটুও ছাড় দেব না।”

শৌভিক দূর থেকে মোহকে পর্যবেক্ষণ করছিল সবটা। ভেবেছিল মোহের মা-ই তাকে সামলাতে পারবে। তবে মোহের পরিস্থিতি ঠিক লাগল না। সে এগিয়ে এসে ঝুঁকে বসল মোহরে সামনে। শান্ত সুরে ডেকে উঠল ,
“মোহ!”

মোহ চোখ বুঁজে বিড়বিড় করছিল। আঁখি খুলল সে। তার চাহনি অদ্ভুত ভয়া;নক লাগছে। দিশেহারা তার দৃষ্টি। সে শৌভিকের হাত চেপে ধরে বলতে থাকল,
“জানো ভাইয়া, এই অমানুষটা অনেক বছর আগেও ঈশানীর খুব খারাপ অবস্থা করেছে। তবুও ওকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু ওকে ওই জা/নোয়ার বাঁচতে দিলো না ভাইয়া। আমার সামনে শেষ করে দিলো। আমি কিছু করতে পারলাম না জানো? আর আমি যদি তখন নদীতে না ঝাঁপিয়ে পড়তাম তাহলে…”

পুরোটা বলল না মোহ। শৌভিকের গলা শুঁকিয়ে গেছে মোহের এমন পরিস্থিতি দেখে। সে মোহকে যতদূর জানে, মোহ সব পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাতে পারে। প্রচণ্ড শক্ত মনের মেয়ে সে। আজ কেন মেয়েটার এই অবস্থা?

হঠাৎ মোহ উঠে দাঁড়ায়। নিজে নিজেকে বলে,
“আমি এখনি যাব আরিদ্রকে শেষ করতে। নাহলে ও আবার আসবে। ঈশানীর সম্মান আর প্রাণ দুটোই কেঁড়ে নিয়েছে। আমার সম্মান, প্রাণ আর ইথানকেও শেষ করতে দুইবার ভাববে না। আমিই জীবন্ত পুঁ/তে ফেলব তার আগে।”

মোহ কারোর বাঁধা না মেনে ছুট লাগায়। মিসেস মোহ আটকাতে চাইলে শোনে না। তাকে দরজার কাছে তিনজন নার্স ধরে। সে ছোটার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। চিৎকার, চেঁচামেচির শেষ থাকেনা। ডাক্তার আসেন। মোহের দুর্গতি ও মানসিক অবস্থা দেখে উপায়ন্তর না পেয়ে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিলেন। আস্তে আস্তে শক্তি ফুরিয়ে এলো মোহের। ছটফটানো কমতে থাকল। শান্ত হলো পুরোটাই।

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৫ [দ্বিতীয় খণ্ড]

দুর্বল শরীর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল স্বচ্ছ। একটু আগেই তার মা তার ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে গেলেন। সামনে থাকা বড়ো ঘড়িটার ছোটো কাঁটা দুটোতে ঠেকেছে। পা মেঝেতে রাখতেই যেন শরীর ভেঙে এলো তার। মাথা যন্ত্র/ণায় ছিঁ/ড়ে যাচ্ছে যেন। সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারছে জ্বরে শরীরে যেন আগুন জ্বলছে। ঢক গিলে উঠে দাঁড়াল সে। আস্তে পায়ে হেঁটে কাবার্ড থেকে সাদা ডেনিম জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো সে।

রাত জাগার খারাপ অভ্যেস রয়েছে ফারাহর। রাত জেগে মাথার মধ্যে থাকা বিভিন্ন ডিজাইন নিয়ে কাজ করার পর সকালে সবার পরে ওঠে সে। আজও রান্নাঘর থেকে কফি সমেত যখন সে বের হলো তখন সিঁড়ি থেকে কারোর ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘরের দরজার কাছেই থেমে গেল সে। চক্ষু দুটি সরু করে আবছা আলোয় কাউকে নামতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমের দূরত্ব বেশি দূর নয়। আর ড্রয়িংরুমের শেষ মাথায় বড়ো সদর দরজা। সেই দরজায় যখন খোলা হলো ফারাহর টনক নড়ল। কফিটা রেখে তাড়াতাড়ি করে ছুটল বাহিরের দিকে।

দারোয়ানকে গেট খুলতে বলে অসুস্থ শরীর নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল স্বচ্ছ। পুরো শরীর কাঁপছে তার। তবুও কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ির চাবিটা অন্যহাতে ঘুরানোর আগেই কালো কাঁচের জানালায় ঠকঠক করে আওয়াজ করতেই চকিতে তাকাল স্বচ্ছ। বাহিরে ফারাহকে দেখে বিরক্ত হলো সে। সে চাইছিল না তার বাহিরে যাওয়ার কথা কেউ জানুক আর ফারাহ জেনেছে মানে কথা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে দুনিয়া ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে সে। জানালার কাঁচ অল্প নামাতেই কাঁচ ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল ফারাহ। তৎক্ষনাৎ কিছু একটা ভেবে জানালা পুরো না খুলে ফারাহকে পাত্তা না দিয়ে গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে দ্রুত ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো স্বচ্ছ। ফারাহ্ গাড়ির কাঁচ না ছেড়ে জোরে চেপে ধরে গলা ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“আমি কিন্তু এখনি বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেব ভাইয়া যে এতটা অসুস্থ হয়ে তুমি বাহিরে যাচ্ছো।”

গাড়ি চালাতে গিয়েও পারেনা স্বচ্ছ। দাঁতে দাঁত চেপে জানালার কাঁচ পুরোটা ওপেন করে। ঢক গিলে ক্রোধ সমেত জিজ্ঞেস করে,
“কী চাই?”

ফারাহ তাড়াহুড়ো করে স্বচ্ছের কপালে হাত রেখে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে ফেলে। নিজের হাতে ফুঁ দিয়ে বলে,
“মনে তো হচ্ছে জলন্ত চুলোর উপরে হাত রেখেছিলাম। এই অবস্থায় কোথায় যাচ্ছো তুমি? কিছু আগে তোমার জ্ঞানও ছিল না ভাইয়া। অসুখ কমার অপেক্ষা করতে পারছ না? এত রাতে কোথাও যেও না। কিছু একটা হয়ে গেলে কী হবে বলো তো?”

“সবকিছু তো আমার অপেক্ষা অনুযায়ী হয়না। অপেক্ষা করলে অনেক কিছু হাত ফসকে যায়। আমার কিছু হবে না। হলেও বা আমি ম/রে যাব আর সব ঝামেলা তো সেখানেই শেষ হবে।”

ফারাহ প্রচণ্ড বিরক্ত হলো ভাইয়ের কথায়। দ্রুত পায়ে হেঁটে গাড়ির অন্যপাশে গিয়ে দরজা খুলে স্বচ্ছের পাশে বসে বলল,
“সবসময় আজেবাজে কথা বলো না তো। শরীরের সাথে মাথাটাও গেছে তোমার। চলো দেখি কোথায় যাবে।”

স্বচ্ছের কপাল কুঁচকে গেল ফারাহ গাড়িতে বসাতে। ভাঙা গলায় জোর দিয়ে কথা বলতে চেয়েও আঁটকে আসছে। তবুও সে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কোথায় যাবে?”

ফারাহ চোখ রাঙাল প্রথমে। ঝাঁজ নিয়ে বলল,
“তোমার সাথে বসেছি মানে তোমার সাথেই যাব। কিন্তু এখন যদি তুমি মানা করেছ আমি বাড়ির সবাইকে ডাকব চিল্লিয়ে। তুমি খুব ভালো করে জানো আমার গলায় জন্ম থেকে অটো মাইক সেট করা। এখান থেকে চিৎকার করলে সারা মহল্লা জাগবে।”

স্বচ্ছ আর কথা বলার মতো কোনোকিছু খুঁজেই পেল না। পেছন থেকে একটা গায়ের শাল নিয়ে ফারাহর দিয়ে এগিয়ে দিলো। ফারাহ আবিষ্কার করল সে নাইট ড্রেস পরিহিত। এভাবে সে বাহিরে যাবে? তড়িঘড়ি করে শাল দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নিলো সে।

মাঝরাস্তায় গাড়ি জোরে চালাচ্ছে স্বচ্ছ। ফারাহর ভয় করছে। একে তো তার ভাই অসুস্থ তার উপর ওভার স্পিডে যদি কিছু একটা ঘটে যায়? নিজের ভয় কাটাতে স্বচ্ছকে ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল ফারাহ।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি ভাইয়া?”

“হসপিটালে মোহের কাছে।”

উত্তর দিতে বেশ সময় নিলো স্বচ্ছ। তবে উত্তর শোনার পর নেত্রপল্লবের আকার বড়ো হয়ে গেল তার। চমকে উঠে পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে বলল,
“এই তীব্র জ্বর নিয়ে তুমি তড়পাতে তড়পাতে তার কাছে ছুটছ। অথচ সে সজ্ঞানে থাকলে তার থেকে নিজেকে আড়াল করো কেন?”

“নিষেধাজ্ঞা, নিষিদ্ধ এই ট্যাগগুলো এমন সময় এমন কিছু জিনিস অথবা মানুষের উপর লাগে যাদের প্রতি আমাদের নির্লজ্জ অনুভূতি জোকের মতো লেগে যায়। ব্যস…এর থেকে আর বেশি প্রশ্ন করবে না। উত্তর পাবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞা আমি উপড়ে ফেলবই।”

কোথাও একটা ধোঁয়াশার ব্যাপারটা থাকা নিশ্চিত হলো ফারাহ। তবে উল্টে আর কিছু জিজ্ঞেসা করতে পারল না। হসপিটালে নেমে যত দ্রুত সম্ভব ঢুকে গেল স্বচ্ছ। ফারাহ গেল পিছু পিছু।

নিচের ফ্লোরের শেষদিকে এসে পৌঁছাল স্বচ্ছ। আশেপাশে আগে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। তার ক্ষীণ নজরে আপাতত মোহের মা-বাবা কাউকে দেখল না। তবে তার থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে শৌভিক। সে এখনো বাড়ি যায়নি। মোহের প্রতি শৌভিকের সহানুভূতি দেখে স্বচ্ছের কেমন অনুভূতি হওয়া উচিত সেটা বুঝতে পারল না। শৌভিক তাকে দেখে এগিয়ে এলো। ম্লান হেসে বলল,
“ভালো সময়ে এসেছেন। আঙ্কেল মানে মোহের বাবা এতক্ষণ এখানে বসে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়েছেন বলে উনাকে একটু আশেপাশে হেঁটে আসতে বললাম।”

শৌভিকের কথার উত্তরে কিছু বলতে পারল না স্বচ্ছ। হাতের তর্জনী আঙ্গুল কপালের একপাশে চেপে ধরল। মাথায় প্রচণ্ড ব্য;থা। স্বচ্ছের এলোমেলো, টলমলে, অগোছালো অবস্থা দেখে শৌভিক কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধাল,
“আপনাকে দেখেও তো ঠিক মনে হচ্ছে না। আপনি ঠিক আছেন?”

“সামান্য জ্বর। সমস্যা নেই।”

স্বচ্ছের ক্ষীণ কণ্ঠ। শৌভিক মাথা দু’বার নাড়িয়ে চুপ থাকে কিছু মুহূর্ত। কিছুটা সময় নেওয়ার পর মনে অনেকটা দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করে,
“আপনি কি আপনার বাবার সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন? আপনার কি মনে হয় কাজটা আপনার বাবা করেছেন?”

স্বচ্ছ তাচ্ছিল্যের সহিত বলে ওঠে,
“মনে না করার আছে। উনিই তো…”

“মোহের কথা অনুযায়ী উনি নন। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। অন্য একজনের নাম নিয়েছিল সে। নামটা যেন কী! ওহ হ্যাঁ, আরিদ্র বোধহয়।”

থমকালো স্বচ্ছ। মস্তিষ্কে তালগোল পাকিয়ে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় একের সাথে আরেকটা মেলাতে থাকল। ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে অন্যহাত মুঠো করে বলল,
“আরিদ্র আমারই কাজিন। ও বাবার সঙ্গে মিলে এমনটা করেছে? কিন্তু ওকে আমি যতদূর চিনেছি ও এমনটা করার সাহস পাবে না।”

“একটা মানুষকে আপনি ততক্ষণ চিনতে পারবেন না যতক্ষণ না সে নিজের খোলস মুক্ত করে আপনার সামনে মেলে ধরবে। আবার এটাও ঠিক যে কাজটা আপনার কাজিনই করেছে সেটা দৃঢ়ভাবে বলা যাচ্ছে না। পৃথিবীতে অনেক আরিদ্র আছে। একমাত্র মোহই সবটা স্পষ্ট করে বলতে পারবে। আপনি এখন শান্ত হয়ে থাকুন যতক্ষণ না মোহ স্বাভাবিক হচ্ছে।”

স্বচ্ছ নিজের উত্তেজনা শান্ত করল বড়ো শ্বাস নিয়ে। কণ্ঠ এখনো হালকা কাঁপছে তার। সে উৎসুক হয়ে জানতে চায়,
“কেমন আছে, মোহ?”

শৌভিক অনেকটা নির্জীব হয়ে বলল,
“ওর মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত। ওর মতো একটা মেয়ে যে সবসময় মানসিকভাবে শক্ত থাকে, সহজে ভাঙে না তার পাগ/লামি দেখে আমি বুঝেছি তার উপর দিয়ে কত ঝড় গেছে। জোর করে একপ্রকার ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। ঘুম ভাঙলে জানি না কী করবে।”

মোহের অবস্থা স্বচ্ছের হৃদয়ের ক্ষ/ত বাড়াল। এক সাহসী নারীর এই হাল তার মন মানতে পারছে না। ঢক গিয়ে স্বচ্ছ বলে,
“ওকে আমি একবার দেখতে…”

স্বচ্ছের কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই শৌভিক স্বেচ্ছায় বলল,
“দেখতে পারেন তবে আপনার হাতে বেশি সময় নেই। আঙ্কেল যেকোনো সময় আসতে পারেন।”

স্বচ্ছ এগিয়ে গেল মোহের কেবিনের দিকে। শৌভিক ডানে তাকাতেই ফারাহ সরে গেল। তা স্পষ্ট বুঝল শৌভিক। সে ফারাহকে খেয়াল করেছে অনেক আগেই। সে এগোয় ডান দিকেই ধীর পায়ে।

দাঁত কিড়মিড় করে হাঁটতে হাঁটতে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে ফারাহ। আপনমনে রাগের সাথে আওড়াতে থাকে,
“লোকটা আস্ত একটা থার্ড পার্সন। একদম অসহ্য। এত রাত অবধি এখানে থাকার মানে কী! বিরক্তিকর একটা লোক। আবার আমার পিকচার ভুল করে তাকে পাঠানোর পর ঢং করে বলেছিলেন, সি ইজ অলসো মাই ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল।”

কথা বলতে বলতে হসপিটালের বাহিরে দাঁড়াল ফারাহ। দুটো হাত শালের সঙ্গে জড়িয়ে সামনে তাকিয়ে থাকল আনমনে। ফট করে পেছন থেকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি এসে ফারাহর পাশাপাশি বুকে হাত রেখে নির্বিঘ্নে স্বীকারোক্তি জানাল,
“আমার সরল মন যা বলেছে আমি তো সেটাই বলেছি। এতে আমার দোষ কোথায়?”

ফারাহ তীব্র গতিতে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়িয়ে পাশ ফিরে শৌভিকের মৃদু হাসি পর্যবেক্ষণ করে। সংকোচে কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। গলা খাঁকারি দিয়ে ঝাঁজালো গলায় বলল,
“আপনি আমার পিছু করছেন?”

“না, না মোটেই না। মন্ত্রী সাহেবের মেয়ের পিছু নেওয়ার ক্ষমতা আছে নাকি আমার? মন্ত্রী সাহেব জানলে আস্ত থাকবে না আমার।”

শৌভিকের সরল উত্তরে গা জ্বলে উঠল ফারাহর। ধমকে বলল,
“একদম ঠাট্টা করবেন না। আর আমি যাচ্ছি আমার পিছু করবেন না।”

শৌভিককে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই হাঁটা দেয় ফারাহ। হসপিটালের একপাশে মহল্লা এবং তার পাশে একটা পুকুর। পুকুর ঘিরে লম্বা গাছ। হাঁটার রাস্তাও করে দেওয়া হয়েছে। রাস্তাতে পানি পড়ে রয়েছে ভীষণ। তার পা ভিজে যাচ্ছে। অতঃপর কিছুটা সামনে কিছু ছেলেপেলেকে সিগারেট খেতে দেখে সে ভাবল হসপিটালে ফিরে যাওয়ার কথা। পেছন ঘুরে দুইধাপ ফেলতেই মনে হলো পিচ্ছিল কোনো বস্তুতে পা পড়ল তার। আর কোনোমতেই নিজেকে সামলে ওঠা গেল না। হাঁটু গেঁড়ে পড়ে গিয়ে কোনোরকমে দুহাত মাটিতে রেখে নিজেকে ঠেকাল। হাঁটুতে জ্বলতে শুরু করেছে তার। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে কলার খসা দেখে মাথা গরম হয়ে গেল। মানুষজনের কোনো আক্কেল নেই? রাস্তায় এসব ফেলে কেউ? ফারাহর কানে এলো ছেলেপেলেদের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হচ্ছে। তারা হয়ত তার দিকেই আসছে। ভীত হলো ফারাহ। তখনি তার মুখে টর্চের লাইট পড়লে চমকে সামনে তাকাতে গিয়ে চোখ বুঁজে ফেলে সে। শৌভিক ফোনের টর্চ সরিয়ে ফারাহর হাত ধরে তাকে তুলল। শৌভিককে দেখে ছেলেপেলে সেখানেই থেমে গেল। ফারাহর দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। তার দুই হাঁটুতে ব্যথা লেগেছে। হাঁটতে গেলে নিশ্চয় আরো ব্য;থা লাগবে। শৌভিক বলল,
‘আমার বাহুটা ধরে আপাতত চলতে থাকুন। আপনাকে কোলে তো নিতে পারব না। কারণ রাস্তাঘাটে এখনো কিছু লোকজন আছে, হসপিটাল পাবলিক প্লেস। পুরুষ মানুষ হলেও আমার লজ্জা শরম ভাসিয়ে দিইনি। তাছাড়া আপনার থেকে অফিশিয়াল পারমিশন পাওয়া যায়নি এখনো।”

ফারাহ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে কোনোরকমে শৌভিকের বাহু চেপে ধরে শুধাল,
“কীসের অফিশিয়াল পারমিশন?”

“এইযে আমি স্বীকারোক্তি দিয়েছি যে মিস. ফারাহ মি. শৌভিকের ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল গার্ল। কিন্তু সে বলল না আমি তার হাজব্যান্ড ম্যাটেরিয়াল কি না!”

ফারাহ চকিতে তাকাল। মুখের জবান বন্ধ হয়ে গেল। কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ছেয়ে গেল। কণ্ঠস্বরে জোর দিয়ে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম আপনি সেদিন মজা করে…”

“আমাকে এতদিনে চিনলেন? আমি যাকে তাকে এসব কমপ্লিমেন্ট দেব? উঁহু না, এই কমপ্লিমেন্ট আপনার জন্য রিজার্ভড ছিল।”

ফারাহ আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। চোখ বড়ো বড়ো করে সামনে তাকিয়ে হাঁটছে। তার মৌনতার মাঝে জড়িয়ে থাকা লাজুক ভাব শৌভিকের চশমা পরিহিত চোখে ধরা দেয় খুব ভালোভাবেই। সে নির্দ্বিধায় বলতে থাকে,
“হয়ত আমার মরণ খুব কাছে নাহলে শত্রুর মেয়েকে নিজের বধূ বানানোর ভূত মাথায় চাপতো না।”

“আপনি জানেনই যখন আমি আপনার জন্য কতটা কঠিন তবুও কেন নিজেকে ব্যক্ত করলেন?”

ফারাহর প্রশ্নে অনেক কৌতূহল সঙ্গে সংশয়। শৌভিক একটুও না ভেবে বলল,
“কোথাও হেরে গেছি আপনার কাছে। মনে হয় আমাকে আর আমি খুঁজে পাব না, যতক্ষণ না আপনাকে ব্যক্তিগত করে দাবি করতে পারব!”

শিহরণ জাগল ফারাহর মনে। তারপরই নিজেকে সামলে বলল,
“কিন্তু আমাদের দুজনের এসব সম্পর্ক কখনো সুষ্ঠু হবে না।”

শৌভিকের হাঁটার গতি ধীর হয়ে গেল। মাথা নিচু করে জবাব ব্যতীত চলতেই থাকল। ফারাহ পলকহীন পর্যবেক্ষণ করল শৌভিককে। অদ্ভুতভাবে নিশ্চুপ হয়ে গেল সে। আচানক বলে উঠল,
“হয়ত।”

নির্জীব সম্পূর্ণ শরীর। কোথাও নেই চাঞ্চল্য। মুখে নেই সেই ঝাঁজালো বাণী। নাক দিয়ে শুধু শ্বাস নিচ্ছে মোহ। স্বচ্ছের অস্থিরতা বাড়ছে। সে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে বেডে মোহের পাশে। মোহের হাতে হাত রেখেছে। স্বচ্ছের এত বিদঘুটে পরিস্থিতি আর সহ্য হচ্ছে না। দম ফুরিয়ে আসছে। কোথাও খুশি নেই, শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। মেয়েটাকে সে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। নিঃশ্বাস ভার হয় স্বচ্ছের। মাথা তুলে মোহের মাথায় হাত বুলায়। তার সামর্থ্য থাকলে সে মোহকে বুকে আগলে সামলাতো। কিন্তু তার অনেক কাজ সমাপ্তি করা বাকি রয়েছে। নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়াল স্বচ্ছ। এখন ফিরতে হবে। অনেক রাত হয়েছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সময় থামছে না। থামবেও না।

বহু কষ্টে নিজের নমিনেশন পেয়েছেন সরোয়ার সাহেব। মাঝখানে মোহ নামক মেয়েটির জন্য যত বড়ো বিপাকে তিনি পড়েছিলেন যে এবার ক্ষমতা উনার হাত থেকে হারাতেই বসেছিল। ভো/টে দাঁড়ানোই হতো না আর উনার। অবশেষে নিজের দলের লোকজনকে বুঝিয়ে দিলেন কী করে প্রচার করতে হবে। সব বুঝিয়ে ফোন কেটে দিতে না দিতেই অন্য আরেকটি ফোন কল এলো। স্বাভাবিকভাবেই কল রিসিভ করে তিনি বলেন,
“হ্যালো, আরিদ্র।”

“আঙ্কেল আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। আপনার হেল্প প্রয়োজন, প্লিজ।”

আরিদ্রের আতঙ্কে ভরা গলা। সরোয়ার সাহেব উৎসুক হয়ে বলেন,
“কী হয়েছে? কী সমস্যা?”

আমি একটা খু/ন করে ফেলেছি। রাগের মাথায় করেছি। তখন হুঁশ ছিল না। বুঝতে পারছি না এখন কী করব। যদি বিষয়টা নিয়ে তদন্ত হয় তখন আমার সমস্যা হয়? আমি কী করব আঙ্কেল?”

সরোয়ার সাহেব আঁতকে ওঠেন। অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“মাথা ঠিক আছে তোমার? কী বলছ তুমি জানো? কাকে খু;ন করেছ?”

“ঈশানী। মোহের বান্ধবী। আসলে আঙ্কেল, মোহের সঙ্গে অনেক আগে থেকে পরিচয়। ওর বান্ধবীর সঙ্গে আমি একটা ছোটো মিস্টেক করে ফেলেছিলাম কয়েক বছর আগে। সেটাকে ঢাকা দিতে ওর বান্ধবীকে নিখোঁজ করার ব্যবস্থা করি। কিন্তু এত বছর পর ঈশানী মোহকে পেয়ে যায়। আমি মোহকে চিনতাম। বুঝতে পেরেছিলাম যে যেকোনো সময় ঈশানীর মাধ্যমে আমি ফেঁসে যাব। তাই নিজেকে বাঁচাতে প্রথমে মোহকে কিড;ন্যাপের প্ল্যান করি। তারপর তার মাধ্যমে ঈশানীকে অপ/হরণ করি। ঈশানীর কিছু কথায় আমার রাগ উঠে আর দড়ি দিয়ে…”

আরিদ্র নিজের বাক্য শেষ না করে থেমে থেমে বলল,
“ওকে নদীতে ফে/লে দিয়েছিলাম তাড়াহুড়ো করে। আর মোহও লাফ দিয়েছিল নদীতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। হয়ত ও নিজেও ম/রে গেছে।”

সরোয়ার সাহেব তখনি হিসহিসিয়ে বলে ওঠেন,
“ম/রেনি ও। বেঁচে আছে। এসব করার আগে আমাকে একবারও জানালে না? এখন তোমার পারসোনার শত্রুতার কারণে স্বচ্ছ আমাকে ভুল বুঝছে। ভাবছে আমি কাজগুলো করিয়েছি। সবে মাত্র আমার ছেলে আমার কথামতো চলছিল। ওকে সামাল দিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। কিন্তু তোমার একটা ভুল আমার সব শেষ করে দিলো। স্বচ্ছ আর কোনোমতেই আমাকে বিশ্বাস করছে না।”

আরিদ্র দিকবিদিকশুন্য হয়ে অসহায় প্রায় হয়ে বলে,
“আঙ্কেল আই এম সরি। আমি ভুল করেছি আমি জানি। আমি তখন বুঝতে পারিনি। এখন আমি যেন বেঁচে যাই, ফেঁসে না যাই তার একটা ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ। মোহ ভালো থাকলে ও আমার নাম পুলিশের কাছে বললেই আমি ফেঁসে যাব।”

সরোয়ার সাহেব শাসিয়ে উঠলেন।
“ইউ আর অ্যা ইউলেস। আমি তোমার জন্য কিচ্ছু করতে পারব না। বরং তুমি যে কাজটা করেছ সেটা জানাজানি হলে অন্তত সবাই আমাকে বিশ্বাস করবে। তুমি জাহান্নামে যাও।”

সরোয়ার সাহেব ফোন কেটে দিলেন। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে উনার। আজকে কিছু না করেও উনাকে দোষী হতে হচ্ছে। এখন কী করে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবেন সেটা অজানা।

সকাল দশটার পর ঘুম ভেঙেছে স্বচ্ছের। তবে এখনো বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। উঠতে মন সায় দিচ্ছে না। সারা শরীর ব্য;থা। যেন কেউ হাতুড়ি পি/টিয়েছে শরীরে। কপালে হাত রেখে চোখ বুঁজে শুয়ে ছিল সে। দরজার ওপাশ থেকে মায়ের কণ্ঠ শোনার গেল হঠাৎ।
“স্বচ্ছ, এখনো ঘুমাচ্ছ?”

স্বচ্ছ ভরাট সুরে বলল,
“না, ভেতরে এসো।”

দরজা খুললেন মিসেস জেবা। হাতে গরম পানির মগ ধরে রেখেছেন। গলা ঝেড়ে কাশি দিয়ে বললেন,
“আমি একা আসিনি। একজন এসেছে তোমাকে দেখতে।”

সূক্ষ্ম নজরে মায়ের দিকে তাকিয়ে আধশোয়া হলো স্বচ্ছ। সে নিজের ঘরে কোনো মেহমানকে ঢুকতে দিতে পছন্দ করেনা। সে জানতে চাইল,
“কে?”

মিসেস জেবাকে আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না। পেছন থেকে অন্বেষা হাজির হয়ে বলল,
“আমি। মে আই কামিং।”

স্বচ্ছ কিছু বলল না। উঠে বসে অন্বেষাকে পর্যবেক্ষণ করল সে। প্রথমে চিনতে পারেনি। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখার পরই চিনতে পেরে চোখ সরিয়ে নিলো। সেটাও অন্বেষা লক্ষ্য করে বলল,
“চিনতে পেরেছেন?”

স্বচ্ছ শুধু মাথা দুলায়। মিসেস জেবা ঘরে ঢুকে এসে স্বচ্ছের পাশে বসে তার হাতে গরম পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
“গরম পানি খাও। ঠাণ্ডা পানি খেতে যেও না।”

স্বচ্ছ গ্লাস হাতে নিয়ে বসে রইল। মিসেস জেবা মুখ একটু স্বচ্ছেট কাছাকাছি নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন,
“তোমার বাবা চায় খুব দ্রুত তোমার বিয়েটা সারতে। শুধু তিনি না আমিও চাই। তুমি সংসারী হলে তবেই শান্তি পাব। তোমার ছন্নছাড়া জীবনযাপন আর ভালো লাগছে না আমার। একজনের সাথে জীবন বাঁধা পড়লে তোমার দায়িত্ববোধ বাড়বে। এখানেই কথাবার্তা সেরে নাও। ভালোমন্দ আলাপ বলে নাও তোমরা। আমি যাচ্ছি।”

মিসেস জেবা উঠে গিয়ে অন্বেষাকে বললেন,
“তুমি গিয়ে বসে কথা বলো।”

অন্বেষা জবাব স্বরূপ বিনীতে হাসি দিলে মিসেস জেবার বের হন ঘর থেকে। অন্বেষা স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে থেকে গিয়ে স্বচ্ছের জানালার পাশে থাকা চেয়ার এগিয়ে নিয়ে এসে বসে।
“আমাকে চিনতে পেরেছেন তো?”

অন্বেষার প্রশ্নে স্বচ্ছ ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“হুমম।”

“নাম কী আমার বলুন তো?”

স্বচ্ছের নামটা মনে নেই। মনে করার চেষ্টাও করল না। সোজা জবাব দিলো,
“সরি, সেটা জানি না।”

“অন্বেষা আমার নাম। আমি কিন্তু আপনার পুরো বায়োডাটা জানি। খুঁজে খুঁজে সব বের করেছি।”

“আপনি যা করেছেন সেটা কি আমাকেও করতে হবে?”

অন্বেষা প্রথম দেখাতেই বুঝেছে আহিয়ান স্বচ্ছ নামক পুরুষটি কেমন হতে পারে! সে প্রস্তুত ছিল স্বচ্ছের তীরের মতো ছোঁড়া কথার। সে মৃদু হেসে জবাব দিলো,
“না, আমি তা চাইনি। আমি তো চাই আপনি আমাকে সামনাসামনি দেখে জানুন। এমনিতে এরেঞ্জ ম্যারেজে বিয়ের পরেই একে অপরকে জানা যায়। তাই না?”

স্বচ্ছ নিরুত্তর। অন্বেষা আজ আরেকটু সুন্দর হবার প্রচেষ্টায় সামান্য সেজে এসেছে। সালোয়ার-কামিজ পরে একপাশে ওড়না নিয়ে চুল ছেড়ে দিয়ে বাঙালি নারীর মতো সাজার প্রচেষ্টা করেছে সে। সে ভেবেছিল এই বাঙালি সাজে হয়ত সামান্য হলেও স্বচ্ছের আগ্রহ জন্মাবে তবে স্বচ্ছের মুখভঙ্গি দেখে তা মনে হচ্ছে না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে ছোটোখাটো জবাব দিচ্ছে অন্বেষার কথাতে। বড়োই ইগোতে লাগল বিষয়টা অন্বেষার কাছে। এভাবে কে এড়িয়ে চলে? সে কি একটুও আকর্ষণীয় নয়? সে পরিষ্কার করে জানতে চাইল,
“এই সম্মন্ধে কি আপনার কোনো আপত্তি আছে?”

“যদি থাকত আগেই মানা করে দিতাম। রাজি হয়েছি জন্য আমার ঘর অবধি পা বাড়াতে পেরেছেন।”

“ওহ, হ্যাঁ। আপনার মা বলছিলেন আপনার ঘরে নাকি বাহিরের মানুষকে ঢুকতে দিয়ে পছন্দ করেন না। বাট আপনার বাবা বলল যেন ঘরে এসে আপনাকে দেখে যাই। আপনার অসুস্থ শুনলাম? কেমন আছেন এখন?”

স্বচ্ছ গম্ভীর সুরে প্রত্যুত্তর করল,
“আগের থেকে বেটার।”

অন্বেষা চুপ রইল কিছুক্ষণ। ফট করে বলল,
“আপনার সুন্দর চোখে আমার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই কেন প্রথম থেকে বলুন তো? এর কোনো কারণ আছে?”

স্বচ্ছের বিরক্ত লাগলেও প্রকাশ করতে পারল না। উঠে দাঁড়াল সে। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনার কি কথা বলা শেষ? আমি এখনো ফ্রেশ হইনি। ফ্রেশ হতে হবে।”

তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে থাকে অন্বেষা। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“নো প্রবলেম। আবার অন্য কোনোদিন কথা হবে। আপনি ফ্রেশ হন। আমি যাচ্ছি তাহলে।”

অন্বেষা দরজার দিকে পা বাড়ায়। যেতে যেতে স্বচ্ছের আকর্ষণ পাওয়ার ইচ্ছেটাকে তীব্র করে তোলে। এ যেন তার চ্যালেঞ্জ! সে স্বচ্ছের ঘোলাটে চোখ জুড়ে শুধু নিজেকে দেখতে চায়। এ এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

আজ তিনদিন পেরিয়েছে। সময়ের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারেনি মোহ। এ যেন এক দুঃসাহসী মেয়ের বোবা পুতুল হয়ে যাওয়ার গল্প। তানিয়া আজকে মোহের বাড়িতে এসেছে। মিসেস সুফিয়া ভার মুখে তানিয়াকে সোফায় বসতে বললে তানিয়া প্রশ্ন করে,
“মোহ কোথায় আন্টি?”

মিসেস সুফিয়ার মুখ আরো মলিন হয়। বিষাদ মাখা মুখে দুঃশ্চিন্তাসহ তিনি বলেন,
“ওর ঘরে। সে কী আর বলব তোমায়! আমার মেয়েটা যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গেল। কোনো কথা নেই তার মুখে। ওর সঙ্গে আমরা কত কথা বলার চেষ্টা করেছি। তবে কিছুতে কথা বলছে না। খাইয়ে না দিলে খাচ্ছে না, ঘুম পাড়িয়ে না দিলে ঘুমোচ্ছে না। সারাদিন একভাবে বসে থাকে একদিকে চেয়ে৷ আমার আর ভালো লাগছে না। ইথানের মনের অবস্থাও খারাপ হচ্ছে। মোহের এই অবস্থা দেখে সেও মানতে পারছে না। ও তো তোমার বান্ধবী তাই তোমায় ডাকলাম। দেখো একটু কথা বলে। যদি ওর মুখে কথা ফোটে!”

তানিয়া দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মিসেস সুফিয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করছি, আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দুর্বল হবেন না।”

তানিয়া কথা শেষ করে গেল মোহের ঘরের দিকে।

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৬ [দ্বিতীয় খণ্ড]

আজকাল মন মেজাজ ভীষণ খারাপ যাচ্ছে ফারাহর। তার অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তৈরি হয়ে সকালের খাবার খেয়ে সবে নিজের কাজের জন্য বের হচ্ছিল সে। এমন সময় সরোয়ার সাহেব তাকে ডেকে পাঠায় নিজের ঘরে। বরাবরই ফারাহ তার বাবার সামনাসামনি একা হতে ভয় পায়। আজও একটু ভীত সৃষ্টি হলো মনে। দম নিয়ে সরোয়ার সাহেবের ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত হলো সে। ছোটো সোফায় তার বাবা এবং মা দুজনেই গম্ভীর মুখে বসে আছে। মিসেস জেবা চিন্তিত মুখে তাকায় ফারাহর দিকে। ফারাহর মনে হলো নিশ্চিত কোনো ঘটনা ঘটেছে। সরোয়ার সাহেব তাকে ইশারায় ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে তাদের সামনে থাকা চেয়ারে বসতে বলেন। ফারাহ ঢক গিলে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে। বাবা-মা দুজনের দিকেই একবার করে নজর দিয়ে নিচু স্বরে শুধাল,
“কী হয়েছে বাবা? হঠাৎ ডেকে পাঠালে। আমি আসলে কাজে বাহিরে যাচ্ছিলাম তো। তাই একটু তাড়া আছে।”

“মাঝে মাঝে দুয়েকদিন বাবার কথাবার্তা শুনে কাজে দেরি হলে কোনো ক্ষতি হবে না।”

সরোয়ার সাহেবের শান্ত কণ্ঠ। আরো নড়েচড়ে বসল মোহ। সে জানে না এখন তাকে কোন বিষয়ে কথা শুনতে হবে। তবে ছোটো মেয়ে এবং যথেষ্ট শান্ত হওয়ার দৌলতে তাকে বড়ো দুই ভাইয়ের মতো সবসময় বাবার তোপের মুখে পড়তে হয়নি।

“আমার সব ছেলেমেয়েরই বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। তোমার নিজের ব্যাপারে কী ভাবলে?”

সরোয়ার সাহেবের আচানক ভাবলেশহীন হয়ে তাকাল ফারাহ। কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল,
“সবে তো বড়ো ভাইয়ার বিয়ের কথা চলছে বাবা। আমার কথা উঠছে কেন?”

“কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমিও তোমার বড়ো ভাইয়ার পথেই হাঁটছ!”

অপ্রস্তুত হলো ফারাহ। তার দুচোখে অস্থিরতা। শুঁকনো ঢক গিলে জিজ্ঞেস করল,
“মানে?”

ঠাণ্ডা গলায় সরোয়ার সাহেব উত্তর দিলেন,
“তুমি বোধহয় তোমার ভাইয়ের দুই কাঠি উপরে উঠে গেছো। যার তার সাথে মেলামেশা করছ। তোমাকে ছোটো থেকে কোনো ধরাবাঁধার মাঝে রাখিনি। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেছ। তোমার অন্যরকম বিশ্বাস ছিল। খারাপ লাগছে এই ভেবে যে বিশ্বাসটার মর্যাদা ভঙ্গ করছ তুমি।”

“বাবা তুমি কী বলছ? মা, তুমি একটু পরিষ্কার করে বাবাকে কথা বলতে বলবে প্লিজ?”

মিসেস জেবার দিকে চেয়ে কিছুটা শক্ত গলায় বলে ওঠে ফারাহ। অতঃপর মিসেস জেবা মুখ খুললেন।
“তোমার কি তোমার বাবার প্রতিপক্ষের ছেলের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে ফারাহ?”

ফারাহ মুখশ্রীতে বিস্ময় এবং সংশয়। ফ্যাকাসে হয়ে উঠল চেহারা। তার দৃষ্টি হয়ে উঠল অশান্ত। সরোয়ার সাহেব সোফায় ভর দিয়ে বসে বলতে লাগলেন,
“রাফিন জানালো তোমাদের চেনাজানা আগে থেকেই। সে তোমাকে বৃষ্টিতে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়, তুমি তিন দিন আগের রাতেও তার সঙ্গে দেখা করেছ। তাও রাত দুটোর দিকে। আমি কি ঠিক বলছি?”

ফারাহর বিস্ময় শেষ হলো না। অস্ফুটস্বরে সে বলল,
“রাফিন।”

“হ্যাঁ, কামাল ভাইয়ের ছেলে। হঠাৎ গতকাল আমাদের বাড়িতে এসে তোমার নামে এসব বলছিল। আমরা তো বিশ্বাস করতে পারিনি। পরে মনে হলো ওর মিথ্যে বলে লাভ কী? তাই তোমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে।”

স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো জবাবে জানালেন মিসেস জেবা। রাফিনের মতো বিগড়ে যাওয়া, রাগচটে ছেলেকে টাকা দিয়ে সামাল দিয়েছেন সরোয়ার সাহেব। নয়ত তার বাবার জে/ল হওয়াতে ছেলেটা রাগে ফেটে গিয়েছিল যেন। ফারাহ কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। সেদিন রাতে মোহকে দেখতে গিয়ে শৌভিকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেটা সে প্রকাশ করতে পারবে না। সে সাহস জুগিয়ে বলে উঠল,
“উনি আমার অনেকদিনেরই পরিচিত। আমার বিপদে সাহায্য করেছেন সবসময়। আমি অস্বস্তিতে পড়লে উনি স্বস্তি হয়ে গিয়েছিলেন আমার। উনার এমন ব্যক্তিত্ব যেকোনো মেয়ের মনে ধরবে। আমি মিথ্যে বলব না। আমারও মনে ধরেছে। উনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে কী সমস্যা? তবে এখনো উনার সঙ্গে সেই রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আমার। হয়ত উনি বাবার প্রতিপক্ষ। সেটা বাহিরের জগতে। উনি তোমার প্রতিপক্ষ বলে আমাকে তো কখনো বিপদের মুখে রেখে এড়িয়ে যান নি বাবা।”

সরোয়ার সাহেব মোটেও মাথা গরম করলেন না। শব্দহীন ঠোঁট সামান্য প্রসারিত করে হাসলেন। নিজের চশমা ঠিক করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“জেবা! জানো তো, আমার সব ছেলেমেয়েকে আমি শিক্ষিত করিয়েছি যে ভবিষ্যতে তারা নিজের পথ নিজে বাছতে পারে। কিন্তু যখন চোখের সামনে নিজের সব সন্তান ভুল পথে বোকার মতো পা বাড়ায় তখন তার থেকে কষ্টের আর কিছু হয়না।”

সরোয়ার সাহেবের কথার পর নীরবতা বিরাজ করল ঘরে। একটু সময় নিয়ে মিসেস জেবা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“ফারাহ, তুই যেহেতু বলছিস ছেলেটার সঙ্গে তোর তেমন সম্পর্ক নেই তাহলে ঠিক আছে। আমি আর তোর বাবা চাইছিলাম তোর ভাইয়ের বিয়ের সাথের তোরও একটা ব্যবস্থা… ”

সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। তেতে উঠল ফারাহ। তেজ নিয়ে বলল,
“মা, ভাইয়ার সঙ্গে যা করছ আমার সঙ্গে তা করার চেষ্টা করো না। এটা তিক্ত হলেও সত্যি যে ভাইয়া নিজেকে জোর করে তোমাদের কথার সঙ্গে মানিয়ে চলছে। ভাইয়ার মুখের দিকে তাকিয়েছ কখনো? তার সুখ, তার দুঃখ, তার শান্তি, তার অশান্তি, তার ভালো লাগা অনুভব করার চেষ্টা করেছ? তাকে আর প্রাণবন্ত দেখায় না। মুষড়ে গেছে। কিন্তু আমি তোমাদের সিদ্ধান্তে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব না। হ্যাঁ, মি. শৌভিকের সঙ্গে আমার তেমন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। কিন্তু উনাকে আমি পছন্দ করি। সারাজীবন উনার মতো মানুষকেই আমি চাইব। তোমাদের জেদের জন্য নিজের সুখ হারাম করব না। আমি আসছি।”

ফারাহ দ্রুত উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে। তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। এমন দাম্ভিক বাবার সামনে এতগুলো কথা বলা যেমন তেমন কথা নয়। তবে আজ সব যেন তার মন উগলে দিয়েছে। সে বাইরের দিকে যেতে উদ্যত হয়। সরোয়ার সাহেবের শক্ত গলা কানে এলো এবার।
“তোমরা কী পেয়েছ আমাকে? একজন একটা ছোটোলোক মেয়েকে পছন্দ করে তাকে ভালোবাসে বলে জাহির করবে, তুমি আমার শত্রুকে পছন্দ করো বলে জাহির করবে আর আমাকে সব হজম করতে হবে?”

ফারাহ জবাব দিলো না। সরোয়ার সাহেব আবারও বললেন,
“কতটুকু চেনো তুমি তাকে? শৌভিক মীর রাজনীতির পোকা। ও এবার জিততে যেকোনো কিছু করবে। তোমাকে ভুলিয়ে কাবু করে নেওয়া তার রাজনীতি খেলারই এক অংশ। তোমার মাধ্যমে সে আমাকে দুর্বল করে আসনে নিজে বসতে চায়। এগুলো প্যাঁচ কতটুকু বোঝো তুমি?”

সরোয়ার সাহেবের প্রতিটা কথা গায়ে লাগার মতো। ফারাহর গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে। মৃদু কেঁপে পিছু ফিরে তাকিয়ে সে বিষাদ নিয়ে বলল,
“বাবা তোমার স্বভাব হয়ত স্বার্থ দিয়ে সম্পর্ক মাপা। কিন্তু সবার স্বভাব যে একই হবে তা তো নয়। তুমি কারোর সাথে একটা আত্মীয়তা পাতাতে গেলে আগে স্বার্থের পরিমাণ মাপো। ভাইয়া বিয়ে তুমি ওই লোকের বোনের সঙ্গে একারণেই দিচ্ছো যেন তোমার স্থান আরো উঁচু হয়। মাকে তুমি একদিন একারণে বিয়ে করেছিলে যাতে নানাভাইয়ের রাজনীতির আসন তোমার কাছে চলে আসে। মা তো এসব না বুঝে বা না বোঝার ভান করে সবসময় তোমাকেই সাপোর্ট করে যাচ্ছে। মানুষ হয়ত একারণেই বলে লাভ ইজ ব্লাইন্ড। কিন্তু আমি এতটাও অন্ধ হয়ে যাইনি। মানুষ চেনার ক্ষমতা ফারাহর আছে।”

ফারাহ নিজ মনে বেরিয়ে গেল। ঠাঁই বসে রইলেন সরোয়ার সাহেব। উনার সব ছেলেমেয়ে কেন যেন উনাকে এখন অন্য চোখে দেখে। এটা সরোয়ার সাহেবের সহ্য হচ্ছে না। মিসেস জেবা কিছু একটা বলতে চেয়েও চুপ করে রইলেন।

জ্যামে আঁটকে অধৈর্য হয়ে বসে আছে ফারাহ। রাগের জ্বালায় অনেক কথাই বলে এসেছে সে আজ। কথাগুলো শুধু নিজের জন্য বলেছে তেমনটা নয়। স্বচ্ছের পরিস্থিতি দেখতে দেখতে হুট করে সব মিলিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে গেছে। এর পরিণতি কি শৌভিককে হজম করতে হতে পারে? ফারাহ ঢোক গিলল। বিরক্তিতে মাথার সামনের চুল মুঠোয় ধরতেই পাশের বাইকে শৌভিকের দলের একজনকে চিনতে পারল সে। তাড়াতাড়ি করে জানালার কাঁচ খুলে আগপাছ না ভেবে ডাক দিলো,
“এইযে ভাই, শুনুন!”

মেয়েলি কণ্ঠে পাশ ফিরে তাকায় বাইকে থাকা নীলয়। ফারাহকে চিনতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না তার। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,
“ভাবি! থুক্কু ম্যাডাম কিছু বলবেন?”

ভ্রু দুটো কুঁচকে যায় ফারাহর। হালকা ধমকে উঠে বলে,
“আগের নামটাই ভালো ছিল। আগের নামে সম্বোধন করুন।”

নীলয় হকচকিয়ে উঠল। আকাশ থেকে পড়ল। গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিন করে বলল,
“ভাবি!”

“সাউন্ডস্ গুড। আপনার ভাই কোথায় জানেন কী?”

“এখন বোধহয় উনার ক্লাবে আছেন।”

“এড্রেস দিন তো। আমি যাব ওখানে।”

নীলয়ের চোখ দুটো এবার বেরিয়ে আসার উপক্রম। মাথা নাড়িয়ে সে মানা করল,
“না এখন ওখানে আপনি কী করে…”

“আমার ব্যাপার আমাকে বুঝতে দিন। এড্রেস দিন। নয়ত নিজে নিয়ে চলুন।”

নীলয় চমকে উঠে নিজেকে দেখিয়ে ঢক গিলে বলে,
“আমি? না, না। আমি আপনাকে ওখানে গিয়ে গেছি জানলে ভাই মে/রেই ফেলবে।”

উল্টে ফারাহ শাসিয়ে উঠে বলল,
“এত মধুর করে ভাবি ডেকেছেন। তো ভাবির জন্য শ/হীদ হতে পারবেন না? চলুন বলছি!”

নীলয়ের অবস্থা তখন কাঁদো কাঁদো। কোনোরকমে সম্মতি জানিয়ে জ্যাম ছাড়লে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“যেমন হিটলার ভাই তেমন হিটলার ভাবি জুটতে যাচ্ছে কপালে।”

মোহের মুখে কথা ফোটাতে সক্ষম হলো না তানিয়া। কথা বলা তো দূর তানিয়ার এত কথার বিপরীতে মোহ তার দিকে তাকায় নি অবধি। তানিয়ার এবার নিজেকে অসহায় লাগছে। গালে হাত দিয়ে একমনে চেয়ে আছে মোহের দিকে। অতঃপর সে মোহের হাতে হাত রেখে বলে,
“তুই কেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিস, মোহ? আমি জানতাম তুই কখনো ভেঙে পড়তে পারিস না। তুই অন্যকে ভাঙতে জানিস। একবার মন খুলে কথা বল। কতদিন এভাবে চলবে বল?”

মোহ আগের মতোই নিশ্চুপ। নির্জীবের ন্যায় একদিকে তাকিয়ে বসে আছে। তানিয়া মোহের হেলদোল না পেয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। মিসেস সুফিয়া হাজির হলেন চা নিয়ে। তানিয়াকে চা দিয়ে বিষণ্ণ গলায় বললেন,
“কিছু বলল ও?”

তানিয়া মাথা নিচু করে ‘না’ জানাল। মিসেস সুফিয়া আকুল হয়ে জানতে চাইলেন,
“একটা অক্ষরও না?”

“না, আন্টি। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ও একটা গভীর ট্রমার মাঝে রয়েছে। সময় হয়ত পেরিয়ে গেছে কিন্তু ওর মনে ওইদিনের দুর্ঘটনা এতটা গভীর দাগ কেটেছে যে আশেপাশের কোনোকিছু ওকে আর আকৃষ্ট করছে না। ও নিজের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমার মনে হয় ওকে সাইকোলজিস্ট দেখানো দরকার।”

“কী করব আর কী না করব কিছুই বুঝতে পারছি না।”

তানিয়া ফের শান্তনা দিয়ে বলল,
“অস্থির হবেন না। কোনো না কোনো ব্যবস্থা ঠিক হবে।”

বিকেল হয়। আকাশের মতিগতি বোঝা দায়। কখনো কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে নয়ত দেখা যাচ্ছে সূর্যের লাল লালিমা। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ শৌভিক উপস্থিত হয়েছে মোহের বাড়িতে। মিসেস সুফিয়া তাকে দেখে অবাক হলেও নিমিষে তাকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। উনার হাতে ফলমূলের ব্যাগ ধরিয়ে দিলো শৌভিক। তাকে সোফায় বসতে দেওয়া হলো। বসেই সে জিজ্ঞেস করল,
“মোহের কী অবস্থা আন্টি?”

মিসেস সুফিয়ার মুখ থমথমে হলো মুহূর্তেই। নিচু সুরে বলল,
“ওর অবস্থার কথা আর কী বলব বাবা! কোনোদিকে হুঁশ নেই। কারোর কথায় সাড়া দেয় না। কথা বলতে যেন ভুলে গেছে।”

“হুমম। তানিয়া আমাকে কল করে বলল। এখানে এসে মোহকে দেখে যাব করে করে আসাই হচ্ছিল না। তবে তাকে অনেক কল করেছি। সে রিসিভ করেনি। আজ তানিয়া জানাল মোহ এখনো ওই ঘটনা আঁকড়ে বসে আছে। তাই সব ব্যস্ততা ঠেলে এলাম। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি?”

মিসেস সুফিয়া সম্পূর্ণ হতাশ গলায় বলেন,
“হ্যাঁ অবশ্যই। সবাই তো চেষ্টা করল। তুমিও করে দেখো।”

শৌভিককে মোহের ঘর অবধি নিয়ে গেলেন মিসেস সুফিয়া। মোহের ঘরে ঢোকার পরে মোহের বিবর্ণ চেহারা দেখে সত্যিই ভেতরে ভেতরে বিচলিত হলো শৌভিক। সে গিয়ে আস্তে করে চেয়ার টেনে বসল। ইথান নিজের খেলনা ধরে ঘুমিয়ে গেছে। এতক্ষণে একবারও মুখ তুলে তাকায়নি মোহ। শৌভিক গলা ঝেড়ে বলল,
“কয়েকটা দিন চলে গেছে। সময় পেরিয়ে গেছে। তুমি কেন এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছ?”

মোহ নীরব, প্রতিক্রিয়াহীন। শৌভিক বুঝল তাকে কথা বলাতে অনেকটা বেগ পেতে হবে।
“মোহ, একমাত্র তুমি জানো সেদিন কী কী ঘটেছিল। কাজটা কে ঘটিয়েছিল। তোমার মন কী চাইছে না সেই লোকটা যে এই হাল করল তারও দুনিয়া পুড়িয়ে দিতে?”

মোহের মাঝে কোনো হেলদোল নেই। সে যেন কোনো জাদুতে হঠাৎ এক জড় বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে। শৌভিক আবারও বলল,
“তুমি কি সরোয়ার সাহেবকেও নিজের জায়গাটা বুঝিয়ে দিতে চাইবে না? হাতে আর মাত্র এক সপ্তাহ রয়েছে। এরপর কামালের কেসটা কোটে উঠবে। তুমি কী করবে ভেবে রেখেছ?”

শৌভিক এবার নিজেও হতাশ হচ্ছে। মোহের বিপর্যয় দেখে তার চোখ জ্বলছে। অসহ্য লাগছে। শেষবার তার মাথায় একটা কথা এলো। তবে এতে দ্বিধা রয়েছে তার অনেক। তবুও সব ভাবনা ছেড়ে বলে ফেলল,
“সেদিন নদী থেকে কিন্তু আমি তোমাকে উদ্ধার করিনি। তোমার ভাই তোমার প্রেমিক পুরুষের কাছে হার মেনেছে। স্বচ্ছ তোমাকে নদী থেকে উদ্ধার করতে পেরেছিল সঠিক সময়ে, জানো?”

ঠিক পাঁচ সেকেণ্ড সময় লাগল মোহের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে। তার দৃষ্টি সরে গেল। শরীর হালকা দুলে উঠল। মাথা তুলে শৌভিকের দিকে তাকাল সে ঝটপট। কাঁপা কণ্ঠে অস্পষ্ট উচ্চারণ করল,
“স্বচ্ছ?”

চলবে…