যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
16

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭ [দ্বিতীয় খণ্ড]

“ঈশানী আর আমার বন্ধুত্বটা কলেজ জীবন থেকে শুরু। আমাকে বাবা অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে পাঠায় পড়াশোনার জন্য। ঈশানীর সঙ্গে পরিচয় হয় তারপর কলেজে এসেই। সেখান থেকে বন্ধুত্ব শুরু। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু সময় তো সবার সবসময় ভালো যায়না। ঈশানীর জীবনে আরিদ্র নামের অ/মানুষের আগমন ঘটে গেল। ঈশানী তখন নজরকাঁড়া সুন্দরী। হাঁটুর নিচ অবধি লম্বা কেশ যখন সে ছেড়ে দিয়ে দুলিয়ে হাঁটত মেয়েরাও তার দিকে একবার করে তাকাতো সেই চুলের সৌন্দর্য দেখতে। এরপর আরিদ্র নামক ছেলেটির সঙ্গে ঈশানীর পরিচয় হয়। এই আরিদ্র ছিল সিনিয়র। হঠাৎ একদিন ঈশানী জানায় আরিদ্র তাকে প্রপোজ করেছে। আমি ওকে বলি, যা করবে যেন ভেবেচিন্তে করে। আরিদ্র স্বভাবতই স্মার্ট ছেলে ছিল। সেই সঙ্গে সুদর্শন। কোনো মেয়েকে আকৃষ্ট করার জন্য সব গুণই ছিল তার মধ্যে। আর তখন আমাদের বয়সটা ছিল আবেগের। আর ঈশানী অতিরিক্ত আবেগী, কল্পনাবিলাসী হওয়ার কারণে সে নিজেও আরিদ্রকে পছন্দ করে ফেলে। ওদের সম্পর্ক শুরু হয়। আরিদ্র আমাকে ঈশানী অর্থাৎ ওর গার্লফ্রেন্ডের বান্ধবীর মতো সুন্দর ব্যবহার করত। ঈশানীর ক্লোজ বলতে আমিই ছিলাম। তাই সবসময় আরিদ্রের সঙ্গে আমাকেও নেওয়ার চেষ্টা করত। যদিও আমি চেয়েছি তারা একান্তে থাকুক। সমস্যাটা হয় আরো কিছুদিন পর। অন্য এক ডিপার্টমেন্টের মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আরিদ্রের হবার ঘটনা ছড়িয়ে যায় পুরো কলেজে। মেয়েটা দাবি করেছিল সে প্রেগন্যান্ট। তারপর মেয়েটা একদিন তার সব কথা অদ্ভুতভাবে ফিরিয়ে নেয়। আর আচমকা গায়েব হয়ে যায়। আমরা ভেবেছি সে হয়ত অন্য কোথাও ট্রান্সফার নিয়েছে। ওই মেয়ের জন্য ঈশানী আর আরিদ্রের তীব্র মনোমালিন্য চলছিল। আবার সব ঠিক হয়। কিন্তু সন্দেহটা আমার মনে রয়ে যায়। আমি ঈশানীকে সাবধান করি। যার কারণে আরিদ্রকে নিয়ে সে ছোটোখাটো কথা কাটাকাটিও করে। তাই আর তাকে কিছু বলিনি। তবে আবার কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর খেয়াল করলাম আরিদ্রের প্রতি আমার অদ্ভুত আচরণ। আমি তার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। তবে ঈশানীর অনুপস্থিতিতে সে আমার সঙ্গে গল্প করতে চাইত, কথা বলার ছল করত। আমি সেটাও ঈশানীকে জানায় কিন্তু ও উল্টে আমাকে ভুল বুঝল। সেদিন ঈশানী আমাকে ভালোমন্দ অনেক কথা বলল। ওইযে, ভালোবাসা নাকি অন্ধ হয়! ঈশানীও অন্ধ হয়ে গেল। আর আমি তো অপমানিত হতে অভ্যস্ত নই। তাই ঈশানীর সঙ্গে বেশ কিছুদিন কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। আমি বুঝিনি ঈশানী বোকার মতো নিজের সর্বনাশ করবে। এই সুযোগে আরিদ্রও যা করার করে ফেলল। ঈশানীর গর্ভে বাচ্চা চলে আসে।”

মোহের কথার মাঝে নড়েচড়ে ওঠে ঘুমন্ত ইথান। মোহ কথা থামিয়ে ইথানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ওর হাতে ধরে থাকা খেলনা সরাতেই এতক্ষণ পর শ্রোতা শৌভিক আচানক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে ওঠে,
“সে কি ইথান?”

মোহের মুখশ্রী শক্ত হয়। ঢক গিলে ইথানের কপালে চুমু খেয়ে শৌভিকের পানে চেয়ে বহু কষ্টে মাথা দুলায়। স্তম্ভিত হয় শৌভিক। মোহ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“বাকিটা বাহিরে গিয়ে বলি। ইথান ঘুমোচ্ছে। আর আমি চাইনা ও এসব শুনতে পাক।”

মোহের কথায় সম্মতি জানাল শৌভিক। বসার ঘরে আসতেই রান্নাঘর থেকে মিসেস সুফিয়া বেরিয়ে মেয়ের আচরণে পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হোন। পরক্ষণেই আনন্দের হাসিটা আটকাতে পারেন না তিনি। ছুটে গিয়ে মোহের কাছে দাঁড়ান। মোহ মায়ের কাছে বেশ অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“দুঃখিত মা। এই কয়দিন তোমাদের সবাইকে কষ্ট দিয়েছি।”

মিসেস সুফিয়া আবেগে মুষড়ে পড়েন। মেয়ের হাতে চুমু খান। মোহ কঠিন ভাবে বলে,
“এবার আমি ঈশানীকে হ/ত্যার কেসটা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। আরিদ্রকে নামক হিংস্র জা/নোয়ারকে তড়পাতে দেখতে চাই। ভয়ে চুপ থাকতে চাইনা আর।”

মোহ এবং শৌভিক বসে পড়ে সোফায়। মোহ নিজ মনে বলতে শুরু করে,
“আমি সব জেনে নিজেই কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঈশানী আরিদ্রকে বলে তাকে বিয়ে করে নিতে। ওর জন্য আরিদ্রের সঙ্গে আমিও কথা বলেছিলাম। সেদিন আমরা দেখেছিলাম ওর আসল রূপ। একটা জা/নোয়ার ছিল সে। ওর ভেতরের পশু ঈশানীকে শাসিয়েছিল এবোরশন করার জন্য। ঈশানীর ছিল নিজের সম্মান হারানোর ভয়। তার মধ্যে সে ছিল অনাথ। মামা-মামীর কাছে মানুষ হয়েছিল সে। মামীও তেমন সাপোর্টিভ ছিলেন না। পছন্দ করতেন না ঈশানীকে। মামার কারণে সে পড়াশোনা করতে সক্ষম হয়েছে। এসবকিছু ভেবে ঈশানী নিজেই এবোরশন করতে রাজি হয়। আমি ওকে বারবার বুঝিয়েছি। সে ছোট্ট যেন হ/ত্যা না করে। তার ভুলে মাশুল হিসেবে ছোট্ট প্রাণ চলে যাচ্ছিল। আবার মা হিসেবে মায়াও লাগছিল সেই প্রাণের প্রতি। ডক্টর যখন কাজটা শুরু করতে চাইছিলেন বারবার সে মানা করে উঠে চলে আসে। আবার মন শক্ত করে বেডে শুয়ে পড়ে। শেষমেশ ডক্টর বিরক্ত হোন। আমিও ওকে বোঝাই যে কেউ জানবে না ও প্রেগন্যান্ট। আমি ওর খেয়াল রাখব। এরপর যেকোনো ভাবে আরিদ্রকে রাজি করাব। সে বাচ্চার মায়া কাটাতে না পেরে রাজি হয়। সব আমার পরিকল্পনা মতোই হচ্ছিল। তবে আরিদ্রকে আবার জানানোর পরেই ঝামেলা ঘটে গেল। ওকে আমি বলেছিলাম ঈশানীকে বিয়ে করতে নয়ত প্রমাণ সমেত ওর পরিবারকে সব দেখিয়ে দেব যে ঈশানীর গর্ভে তার সন্তান আছে। আরিদ্র তৎক্ষনাৎ ভয় পেয়ে রাজি হলেও ও ভয়ানক পরিকল্পনা আঁটছিল আমার জানা ছিল না। ডেলিভারির দিন হয়ে গেল। আরিদ্র সব শুনে নাটক করে বাচ্চার জন্য নিজেও হসপিটালে যাওয়াআসা করল। মিথ্যে আশ্বাস দিলো যে সে এবার তার পরিবারকে বলে ঈশানীকে বিয়ে করবে। আমরাও বোকার মতো বিশ্বাস করলাম। আর ঈশানীর প্রতি তার যত্ন দেখে ঈশানী গলে গেল। খানিকক্ষণের জন্য আমিও ভেবেছিলাম যে বাচ্চার জন্য হলেও হয়ত সে রাজি হয়েছে। তবে বাচ্চার ব্রেথিং প্রবলেম ছিল। সেই সঙ্গে নিউমোনিয়া। তাকে আলাদা অবজারভেশনে রাখা হতো। হঠাৎ একদিন সকালে আমি হসপিটালে গিয়ে দেখি ঈশানী উধাও। সারা হসপিটাল জুড়ে ওকে পাইনি। শুধু রয়ে গেছিল বাচ্চা। আমি আরিদ্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। আরিদ্র নিজেই আমাকে কল করে হুমকি দেয় যে বাচ্চাকে নিজের পরিচয় সে দেবে না। আর আমি কিছু করলে ঈশানীকে সে মে/রে দেবে। আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। পুলিশের সাহায্যে তাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। অন্যদিকে আরিদ্র ঈশানীকে উল্টো হু/মকি দেয়। বলেছিল, স্বইচ্ছায় যেন সে পতি/তাল/য়ের মেয়ে হয়ে যায় নয়ত সে বাচ্চার দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। ঈশানী আবারও নিরুপায় হয়ে সেই নিষিদ্ধ কাজে রাজি হয়। আর আরিদ্র মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে ইথানকে ভালো রাখবে। অথচ ইথানের কাছে সে আর আসেনি৷ তাকে আমি অনেক খুঁজেছি। পাইনি খুঁজে।”

“তাই ইথানের দায়িত্ব তুমি নিয়েছিলে?”

শৌভিকের শান্ত কণ্ঠে অনেক উৎকণ্ঠা৷ মোহ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে,
“হুমম। ওকে আমি জন্ম দিইনি এটা যেমন সঠিক। ওর মাম্মা ডাক ছাড়া আমি বাঁচব না এটাও তেমন সঠিক। সব থেকে বড়ো কথা, আমার পরিবার আমার পাশে ছিল। কেউ ইথানকে অবহেলা করেনি। হয়ত অন্য মা-বাবা চাইতেন না যে অবিবাহিত হয়েও মেয়েকে একটি বাচ্চা পালন করতে দিতে। এটা সমাজের কাছে খারাপ। ইথানকে নিয়ে আমি গ্রামে যাবার পর গ্রামের সবাই আমার পরিবারকে হেয় করতে লাগল। সকলে হু/মকি দিলো যেন গ্রাম থেকে আমি চলে যাই। আমার জন্য নাকি সমাজ নষ্ট হচ্ছে। আমি অপবিত্র, নষ্ট মেয়ে। গ্রামের মানুষের কাছে টিকতে পারিনি। তাই সব ছেড়ে আমরা এখানে চলে আসি। আমি ভাবিনি ঈশানীকে আবার ফিরে পেয়ে আমি হারিয়ে ফেলব। ভাইয়া, জানো? ওই নরপ/শু ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে মে/রেছে। আমার চোখের সামনে শেষ করে দিয়েছে। আমি কিছু করতে পারিনি। এই কিছু না করতে পারাটা আমার কাছে ভারি পাথরের মতো হয়ে গিয়েছে। যেটা আমার বুকে ভর করে আছে। নিজেকে নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে।”

শৌভিকের মুখে শান্তনার বাণী এলো না। মোহের মনে অদ্ভুত এই ভোগান্তি আঁকড়ে ধরে আছে। সে সোজাসাপটা উত্তর দিলো,
“আমি কখনোই তোমার সেই অনুভূতি বুঝতে পারব না৷ কারণ আমি কখনো তোমার মতো সেই ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়িনি। কিন্তু তোমাকে যতটা জানলাম, তুমি যেমন ক্ষমতা নিয়ে চলতে পারো সেটা যেকেউ অর্জন করতে পারবে না। তোমার প্রখরতা দিয়ে তুমি অনেককিছু করতে পারো। সকলের সাহস হবে না অবিবাহিত হয়েও একটি বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা বলে দাবি করা। এটা তুমিই করতে পারো। যদি তুমি এটা করতে পারো তাহলে তোমার মাধ্যমেই ঈশানী সঠিক বিচারও পাবে। ভাগ্যের বিপরীতে তুমি সেদিন যেতে পারো নি। কিন্তু আরিদ্রকে তার অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা তুমি করতে পারো।”

মোহ চুপ রইল কিছুটা মুহূর্ত। তার দুটি চোখে আগুন। মনে প্রচণ্ড ঝড়। অতঃপর সে সিদ্ধান্ত নিলো এবং সম্মতি জানিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করব এবং ততক্ষণ ক্ষান্ত হবো না যতক্ষণ ওকে আমি সেই মৃ/ত্যুর যন্ত্র/ণায় ছটফট করতে দেখছি।”

মোহের বলা প্রতিটি শব্দে রয়েছে কঠিন প্রখরতা। নিজের জোর দ্বারাই যেন সে নিজের কথাকে সত্যিতে বাস্তবায়িত করবে। অনেকটা ভেবে মোহ ফের বলল,
“এই সত্যি জঘন্য অতীতকে সামনে আনতে গেলে এটা প্রমাণ করতে হবে যে ঈশানীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। আর তাদের সম্পর্কের একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে ইথান। কিন্তু এর জন্য তো আরিদ্রেরও ডিএনএ স্যাম্পল লাগবে। সেটা কোথায় পাব? তার ঠিকানা তো আমি জানিই না।”

শৌভিক ইশারায় শান্ত হতে বলল মোহকে। অস্থিরতা কাটে না মোহের। শৌভিক নিজের ফোনটা বের করে একটি ছবি বের করে মোহের দিকে ধরে সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“এই সেই আরিদ্র?”

প্রথম ছবি প্রদর্শনেই নেত্রযুগল আপনাআপনি বড়ো হয়ে যায় মোহের। ক্রোধে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে সারা দেহ। নিজের রাগটা গিলে বলে,
“এ…এর ছবি কোথায় পেলে ভাইয়া?”

শৌভিক নিশ্চিত হয়। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। স্মিত হেসে বলে,
“ইথানের স্যাম্পল রেডি রাখো বাকিটা তোমার এই ভাইয়ের উপর ছেড়ে দাও।”

মোহের কৌতূহল তখন আকাশপানে। তবে শৌভিক কোনোকিছুরই উত্তর খোলসা করে দিলো না। সে অন্য চিন্তায় ব্যস্ত সেটা মোহ ভালোভাবে লক্ষ্য করেই বুঝতে পারল।
“তুমি কি অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তিত ভাইয়া?”

মিসেস সুফিয়ার দেওয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে চিন্তায় ডুবে থাকা শৌভিক খানিকটা চমকে উত্তর দিলো,
“একটা বিষয় তো আছেই!”

“কী সেটা?”

“ফারাহ।”

মোহ একটু থামল। গভীর চিন্তা করে বলে উঠল,
“মানে স্বচ্ছের ওই বোন? তাকে তুমি ভালোবাসো তাই না?”

মোহের মুখে মিটমিটিয়ে হাসি দেখা গেল প্রশ্নটা করার সময়। বিষম খেল যেন শৌভিক। হালকা কেশে উঠে গাম্ভীর্য ধরে রাখার চেষ্টা করে বলল,
“কে বলল এসব?”

“আসলে আমার চোখ দুটো একটু বেশিই তীক্ষ্ণ! তোমার ফোনের ওয়ালপেপারই অনেককিছু বলে দেয়।”

থতমত খেয়ে চোর ধরা পড়ার মতো অবস্থা হয় যেন শৌভিকের। মোহ তখন ঠোঁট টিপে হাসছে। ফারাহর ভুলে পাঠানোর তার ছবিটাই নিজের ওয়ালপেপারে সেভ করেছে শৌভিক। তারপরেই যেন ধরা খেয়ে গেল। মোহ উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“আমাকে তো বোন মানো! তাহলে এসব লুকানোর কী দরকার? আমাকে বললে তো দুয়েকটা সাজেশনও পেয়ে যাও ফ্রীতে।”

“পরে তোমাকে বিষয়টা খুলে বলব। আপাতত আসি। অনেক সময় ম্যানেজ করে তোমার বোবা মুখ খুলতে এসেছি। বো/ম মা/রলেও কারোর মুখ এত দ্রুত খোলেনা যত দ্রুত স্বচ্ছের নাম উঠতে তুমি মুখ খুলেছ। এখন আমার কিছু প্রচারের কাজ আছে। খুবই ব্যস্ত সময় পার করছি। আসি আমি। সময় করে আবার কিন্তু দেখা করব।”

বিদায় জানিয়ে চলে গেল শৌভিক। মোহ হালকা লজ্জা পেয়ে গেল। যদি কেউ জানত স্বচ্ছের সেদিনের উপস্থিতি নিয়ে মোহের মন আগে থেকেই উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করেছিল!

সন্ধ্যার পর টিভি চলছিল বসার ঘরে। সোফায় বসে বসে টিভিতে খবর দেখছিলেন আজহার সাহেব। ইথান দৌড়ে দৌড়ে নিজের খেলনা প্লেন নিয়ে খেলছে আর মাঝে মাঝে মোহের কাছে এসে নুডুলস খেয়ে যাচ্ছে। আজহার সাহেব মোলায়েম সুরে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন ঠিক আছো তো, মোহ?”

মোহ সোজাসাপটা জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, বাবা। এতদিন তোমাদের চিন্তায় রাখার জন্য দুঃখিত।”

সুযোগ বুঝে ইথানও অভিযোগ করল,
“মাম্মা আমার সাথেও এতদিন কথা বলেনি। আমি খুব রাগ করেছি।”

মোহ এবং আজহার সাহেব বিস্তর হাসেন। ইথান গাল ফুলিয়ে রাখে। অতঃপর মোহ আদুরে স্বরে ইথানকে,
“আমার অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। এই ভুলের পানিশমেন্ট হিসেবে কালকেই তোমার জন্য তোমার পছন্দের চকলেট আনব।”

ইথানের ছোটো মন তাতেই নেচে ওঠে। মোহের বুকটা ধুকধুক করতে থাকে। ইথানের দিকে তাকালেই এখন ঈশানীর কথা মনে পড়ছে। এই ছোটো ছেলেটা জানেও না সে নিজের মাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলল। মোহ দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। হঠাৎ টিভির খবরে সরোয়ার সাহেবের নামটি আসতেই টনক নড়ে তার৷ ইলেকশনের বেশি দেরি নেই। সারাদিন প্রচারেরই খবর। তাই সরোয়ার সাহেবের নাম আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে মোহ হতবাক হলো স্বচ্ছের নামটাও শুনতে পাওয়াতে। টিভিতে খবর পড়া মহিলাটি অনর্গল বলে যাচ্ছে স্বচ্ছ এবং শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী নাহিয়ান রায়হানের একমাত্র বোন অন্বেষার বাগদান হতে যাচ্ছে। টিভির দিকে তাকানোর সাহস হলো না মোহের। সে শুধু কান দিয়ে শুনছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। অস্পষ্ট হচ্ছে দৃষ্টি। হাতে নুডুলসের বাটিটা জোরে চেপে ধরে ঢক গিললো সে। কাটা চামচের মাথা জোরে চেপে ধরতে গিয়ে হাতে আচানক ফুটে গেল সূচালো মাথা। বাবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ঠোঁট কামড়ে নিজের আর্তনাদ আঁটকে নুডুলসের বাটি রেখে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে দ্রুত চ্যানেল পাল্টে দিলো সে। কণ্ঠস্বর কড়া করার প্রচেষ্টা করে বলল,
“এসব ইলেকশনের খবর দেখা উচিত নয়। দেখাচ্ছে তো এক অসৎ ব্যক্তির খবর। এসব দেখে কী হবে? তুমি অন্য কিছু দেখো বাবা।”

আজহার সাহেব মেয়ের প্রতিক্রিয়ায় অপ্রস্তুত হলেন। উনি একটু হলেও তো একটা সময় আঁচ করেছিলেন স্বচ্ছ এবং মোহ দুজন দুজনের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। হঠাৎ কী হলো? কেন এই অবিচল সমীকরণের সমাপ্তি ঘটল জানা হলো না আজহার সাহেবের। মেয়েকে প্রশ্ন করে উঠতে পারলেন না। মোহ ইথানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ইথান ঘরে এসো।”

চেয়ারে চোখ বুঁজে বসে আছে স্বচ্ছ। ছাইরঙা শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখা। এক হাত কপালে ঠেকিয়ে মাথা উপরের দিকে দিয়ে নিজের ভাবনায় মেতে রয়েছে সে। চিবুকের হাড় ওঠানামা করছে বারবার। তাকে ঘিরে রয়েছে তার বন্ধুমহল। তাদের মাঝে স্বচ্ছকে ঘিরেই চলছে কথাবার্তা। স্বচ্ছের ধ্যান নেই। হঠাৎ স্বচ্ছের এক বন্ধু নয়ন নিজের ফোন দেখে বলে উঠল,
“কীরে, ভাই! তোর বাপ নাকি ছোটোখাটো আয়োজন করবে তোর এঙ্গেজমেন্টের? এ তো দেখি সব জানাজানি হয়ে গেছে। মিডিয়া হইচই করছে খবর তৈরি করে।”

স্বচ্ছের ধ্যান ভাঙল। মাথা সোজা করে কপাল থেকে হাত সরিয়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে চাইল। নয়ন তার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো। স্বচ্ছ কাঠকাঠ গলায় বলল,
“যা ইচ্ছে তাই করার সুযোগ পেয়েছে। সুযোগ কে হাত ছাড়া করে? মন্ত্রী সাহেবও কাজে লাগাচ্ছেন। আমাকে ওই ধনির দুলালি মেয়েটার সাথে বিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যই তো সবার উপরে থাকা। মিডিয়া না জানলে সেই উদ্দেশ্য সফল হবে কী করে?”

“কিন্তু তুই কিছু বলবি না?”

স্বচ্ছের আরেক বন্ধু সজয়ের প্রশ্নে স্বচ্ছ কিছু সময় চুপ থেকে উত্তর দিলো,
“এখন চুপই থাকতে হবে। নিজেকে গুড বয় প্রমাণ করে যেতে হবে। রাফিনের কী অবস্থা?”

“যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। ওইটাকে তো টাকা দিলেই পটে যায়। টাকা পেয়ে নিজের বাপরে ভুলে গেছে। টাকা দিলে আমাদের দলেও এসে পড়বে।”

“এসে পড়বে না! নিয়ে আয় দলে। হাতে সময় কম।”

স্বচ্ছের কড়া আদেশ। মাঝে নয়ন বলল,
“তোর এঙ্গেজমেন্ট খবরটা এমনে প্রচার করা হচ্ছে! ভাবি তো…”

স্বচ্ছ তেতে ওঠে তৎক্ষনাৎ। ফুঁসে উঠে বলল,
“ওর যা ইচ্ছে ভাবুক গিয়ে। আমাকে তো কম জ্বালাচ্ছে না। আজকাল তো ওর নিজেরও একজন জুটেছে। যা ইচ্ছে করুক, আমার কী?”

স্বচ্ছের ভেতরে আগুনের লাভার মতো ফুটতে থাকা ক্রোধ এবং হিংসে সে লুকাতে পারল না। সকলে বুঝেও আর মজা করার সাহস পেল না। স্বচ্ছ উঠে গেল চেয়ার থেকে। ভার গলায় বলল,
“আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

বাড়ি ফিরল স্বচ্ছ। ঘরে যাওয়ার সময় ফারাহর ঘর আগে পড়ে। সেদিক পাশ কাটাতেই খেয়াল করল ফারাহর ঘর এখনো বন্ধ। বের হওয়ার সময়ও দেখেছিল ফারাহর ঘর বন্ধই ছিল ওপাশ থেকে। স্বচ্ছ ভাবল একবার ডাকবে ফারাহকে। তৎক্ষনাৎ মত বদলায় সে। ফারাহর প্রচণ্ড কাজ থাকলে এমনটা সচরাচরই করে থাকে সে। সারাদিন ডিজাইন, হাতের কাজ নিয়ে মাথা খারাপ করে। তাই নিজের ঘরেই সোজা এলো সে। গায়ের শার্ট আর ভেতরের গেঞ্জি খুলে গেল ফ্রেশ হতে।

গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে খালি গায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেডের কাছে বসতেই ফোনের ভাইব্রেশন টের পায় স্বচ্ছ। নিজের গালের দাড়ি মুছতে মুছতে অন্যহাতে ফোন ধরে মোহ নামক নারীটির নম্বর দেখে খানিকটা থমকায় সে। কল কেটে যায়৷ তবে স্বস্তি হবার জো নেই। মোহ আবারও কল করে। এবার আত্মবিশ্বাস নিয়ে কলটা রিসিভ করেই ফেলল স্বচ্ছ। ওপাশ থেকে মোহ অস্থিরতা নিয়ে বলল,
“হ্যালো!”

এই মেয়েলি কণ্ঠ যেন স্বচ্ছের গলার কাটা হয়ে বিঁধল। ছটফটিয়ে উঠল তৃষ্ণার্ত প্রাণ। মন বলল, মাত্র একটি শব্দ কেন? ওই কণ্ঠে শব্দের পর শব্দ উচ্চারিত হতে থাকুক বারংবার। স্বচ্ছ গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,
“হুমম, হ্যালো।”

“কেমন আছেন আপনি?”

“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”

মোহ চটপটে গলায় উত্তর দিলো,
“ভালো আছি। ভালো না থেকে উপায় আছে?”

“তাহলে কী বিষয়ে নিরুপায়ে পড়ে আমায় কল দেওয়া হলো?”

স্বচ্ছের সোজা প্রশ্ন। মোহ ঢক গিলে বলল,
“মোহ এতটা আত্মসম্মানহীন নয় যে যাকে তাকে কল করে অযথা বিরক্ত করবে।”

“হ্যাঁ, এখন তো অন্যকেউ জুটেছে।”

স্বচ্ছের বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটি অস্পষ্ট হয়ে শুনতে পেল মোহ। কপাল কুঁচকে জ্বলে উঠে বলল,
“কী বললেন আপনি?”

স্বচ্ছ দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“না কিছু না। তা মিস আত্মসম্মানী হঠাৎ আমাকে কল করার কোনো কারণ আছে?”

“একটা কথা জানার আছে। আশা করছি সঠিক উত্তর পাব। আমাকে নদীতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আপনি উদ্ধার করেছিলেন?”

মোহের শান্ত কণ্ঠ। সঠিক উত্তর জানতে চাওয়ার আকুতি। স্বচ্ছ ঘাবড়ে গেল খানিকটা। সে আন্দাজ করেছিল মোহ তার কাছে এটাই জানতে চাইবে৷ শুকনো গলায় সে বলে ওঠে,
“নদী? কীসের নদী? কীসের কথা বলছ?”

“আমি স্পষ্ট শুনেছিলাম একজন আমাকে তার বুক চিঁড়ে লুকিয়ে রাখার কথা বলেছিল৷ সে আমাকে নিরাপদে রাখার জন্য উন্মাদ ছিল। তার কণ্ঠস্বর কেন আপনার সঙ্গেই মিলে গেল বলুন তো?”

স্বচ্ছ নিজের কঠোরতা বজায় রাখার চেষ্টা করল।
“কীসের কথা বলছ সত্যি আমি জানি না। অবান্তর কথা বলছ তুমি।”

মোহ তেতে উঠল তখনি। তেজী সুরে শুধাল,
“তবে কেন আমাকে বলা হলো লোকটা আপনি ছিলেন? কেন বলা হলো আমার জন্য আপনি ছুটে এসেছিলেন?”

“কারণ তুমি কয়েকদিন যাবত কথা বলছিলে না। ট্রমাতে গিয়ে নিজের কথা হারিয়ে ফেলেছিলে। তোমার মুখ থেকে কথা শোনার জন্য আমার কথা বলা হয়েছে।”

তীব্র জেদ নিয়ে নিজের কথা সম্পূর্ণ করার শেষে থম মে/রে বসে রইল কিছু মুহূর্ত স্বচ্ছ। আঁখি দুটো বড়ো হলো তার। নিজে নিজের মাথা চাপড়াতে ইচ্ছে করল। এমন কথা বলার খুব দরকার ছিল এই তীব্র বিচক্ষণ মেয়েটির সামনে? মোহ বিস্মিত হয়ে বলল,
“তার মানে আপনি সব জানেন!”

স্বচ্ছ বাকরুদ্ধ বোবার ন্যায় বসে রইল। মোহ তেলেবেগুনে জ্বলছে। কেন এই লুকোচুরি সে জানতে চায়। তার রাগ ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশ অবধি। স্বচ্ছ অনেক ভেবে বলল,
“আমি কিছু ব্যাপার জানি কারণ মিস্টার শৌভিকের সঙ্গে হঠাৎ আমার যোগাযোগ হয়েছে আজ তাই। এত বেশি ভাবার দরকার নেই। তুমি যেদিনের কথা বলছ সেদিন আমি ব্যস্ত ছিলাম।”

“বিয়ে ঠিক করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন বুঝি?”

কঠিন সুর মোহের। স্বচ্ছ নীরব থাকে। মোহের রাগ নিভে এলো। গলা ধরে গেল হঠাৎ। কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। তবুও হালকা কেশে সে জানতে চাইল,
“বিয়ে করতে যাচ্ছেন শুনলাম। কিছুদিন পরই তো এঙ্গেজমেন্ট!”

স্বচ্ছ ছোটো করে উত্তর দিলো,
“হুঁ।”

“শুভকামনা আপনার জন্য। আপনার বাগদত্তা নিশ্চয় ভীষণ সুন্দরী?”

মোহের অযাচিত প্রশ্নে কেন যেন চোখের সামনে মোহকেই দেখল স্বচ্ছ। বাগদত্তা শব্দটি স্বচ্ছের দৃষ্টিতে সেই নারীর সঙ্গেই যায়। সে মৃদু হেসে বলল,
“সি ইজ লাইক এঞ্জেল। তার পদাঘাতে আমার একেকটা হার্টবিট মিস হয়।”

মোহ হাত কামড়াচ্ছে বসে বসে। দাঁতের দাগ উঠে গেছে হাতে। বিষাক্ত লাগছে চারিদিক। ঢক গিলে নিজের ক্রোধ ক্ষান্ত করে বলল,
“তাহলে তো ভালোই মানাবে আপনাদরকে।”

“না মানানোর কী আছে! মেড ফর ইচ আদার যে।”

মোহ উত্তর দিলো না। ইচ্ছে হলো ফোন ছুঁড়ে ফেলতে। কিন্তু সে তার রাগ বুঝতে দিতে চায় না। আচানক স্বচ্ছ রসকষহীন গলায় প্রশ্ন করে,
“আপনি নিজেও তো পিছিয়ে নেই মিস মোহ। আপনার বিয়ের খবর কবে পাচ্ছি?”

মোহ এবার বিভ্রান্তিতে পড়ল। চিকন ভ্রু জোড়া আপনাআপনি বেঁকে গেল। পরক্ষণেই স্বচ্ছকে বুঝতে না দিয়ে বলল,
“খুব শীঘ্রই। ভাবছি আমিও বিয়েটা সেরেই ফেলব। হয়ত আপনার আগেই হুটহাট একদিন বিয়ে করে সবাইকে চমকে দেব। মা-বাবাকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ কী? কিন্তু সমস্যা আছে এক জায়গায়?”

স্বচ্ছের রাগটা এবার তুঙ্গে। মোহের মুখে বিয়ে শব্দটা বিষ বিষ লাগছে এখন। তবুও সে নাছোরবান্দা। একে ওপরকে রাগে পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেন। হাসার ভান করে বলল,
“সমস্যাটা শেয়ার করতে পারেন। দেখি সমাধান করা যায় কিনা!”

মোহ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমার হাতে এক অপরিচিত ব্যক্তি এক সময় চুম্বন করেছিল। সেটা নিয়ে বড়োই দুশ্চিন্তায় আছি। যাকে বিয়ে করব তার দিকে তাকালেই তো একটা অপরাধবোধ কাজ করবে। তার আগে অন্যকেউ আমার কোমল হাতে চুমু খেয়েছে এটা ভেবে তো অনুশোচনা হবে।”

বিষম খেলো স্বচ্ছ। এবার মোহের কড়া ডোজটা তার আপাদমস্তক নাড়িয়ে দিলো। কাশতে কাশতে বুক ব্যথা ধরে গেল। পানি খেয়ে কোনোমতে মিনমিন করে বলল,
“ব্যক্তিটি আবেগে ভুল করেছে। মস্ত বড়ো ভুল। ওটা আপনি স্মৃতি থেকে মুছে ফেলুন।”

“সেটাই তো আমি পারি না। পুরুষ মানুষ দেখি খুব সহজেই চুমু খেয়ে আরেকজন চুমুর পার্টনার পেতে উঠেপড়ে লাগে। আমরা মেয়েরা তা পারি না।”

স্বচ্ছ চোখমুখ জড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে চটে গিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ কী পারেন আর কী না পারেন সব দেখা হয়ে গেছে।”

মোহ তীব্র ক্ষেপে উঠে বলল,
“কচু দেখেছেন আপনি। অসভ্য লোক। আপনাকে কল করাই ভুল হয়েছে আমার। আর কখনো যদি কল করেছি!”

“তা করবেন কেন? কল করার মানুষ পেয়ে গেছেন তো।”

মোহ রাগে-দুঃখে কী বলবে আর কী না বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। বিরক্তি নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আছে তাতে আপনার কোনে সমস্যা?”

স্বচ্ছ নিজের হাতের গ্লাস শক্তি দিয়ে চেপে ধরে গ্লাসের উপর রাগ ঝেরে বলল,
“আমার কেন সমস্যা হবে? আমি কে হই আপনার?”

“আপনি কে হোন আমার জানলে ভুবন পাল্টে যেত। দুনিয়া রঙিন হতো। আপনার মতো অসভ্য লোকের তো তা জানার ক্ষমতা নেই।”

মোহ রাগে গজগজ করতে করতে কল কেটে দিলো তখনি। সামনা-সামনি হলে এতক্ষণে যু/দ্ধ বেঁধে যেত তার কোনো সন্দেহ নেই। অভিমানে চোখে পানি এলো তার। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানার দিকে। জানালা দিয়ে চেয়ে আনমনে ভাবতে গেল, কেন ওই নিষ্ঠুর পুরুষটির মন তার প্রণয় ছুঁতে পারল না?

স্বচ্ছ গ্লাসটা ফেলেই দিলো আয়নার দিকে। শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল কাঁচের অংশগুলো। বিছানা উলোটপালোট করে বসে রইল সে। মেয়েটা যদি বুঝত এই পুরুষটি তার মোহেই উন্মাদ। এই মোহের ঘোর আমৃত্যু অবধি!

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮ [দ্বিতীয় খণ্ড]

ল্যাপটপের মাধ্যমে ফ্লাইটের টিকিট বুক করতে ব্যস্ত ছিল আরিদ্র। কপালে তার গভীর ভাঁজগুলো যেন স্পষ্ট চিন্তিত হবার বহিঃপ্রকাশ। খুব একটা গরম নয় পরিবেশ তবুও তার কপালের দুপাশে ঘাম চিকচিক করছে। ল্যাপটপটা ধপ করে পাশে রেখে কপাল চেপে ধরে বসল আরিদ্র। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আগামী সাত দিনের আগে একটাও ফ্লাইট খালি নেই। কী করব আমি? বাড়ি থেকে অন্য কোথাও চলে যাব? কিন্তু কোথায় যাব?”

আরিদ্র যখন নিজেকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ভুগছিল এমন সময় এক পুরুষালি কণ্ঠ তার শ্রবণেন্দ্রিয়-তে প্রবেশ করতেই কিছুটা চমকে উঠে দরজার দিকে মাথা তুলে তাকাল। স্বচ্ছ হাসিমুখে এগিয়ে এসে আরিদ্রের কাছে বসে আচানক তার কাঁধে চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কিরে ভাই! কেমন আছিস? খোঁজই তো নেই তোর। আমার বাড়িতেও যাস না। কী ব্যাপার?”

স্বচ্ছের এমন আগমন এবং তার কর্মকাণ্ড আশা করেনি আরিদ্র। অপ্রস্তুত হয়ে থতমত খেয়ে গেল সে। কিছু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“কী ব্যাপার হবে আবার! সবসময় আমিই খোঁজখবর নেব নাকি? তুইও তো নিতে পারিস।”

স্বচ্ছ ভ্রু উঁচিয়ে মৃদু হেসে বলে,
“সেজন্যই বোধহয় আমি এলাম। এবার আগে যা তো আমার জন্য কফি নিয়ে আয়। অনেকদিন তোর হাতের বানানো কফি খাইনা। আজকে অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার জন্য এলাম। আই নিড এ কাপ অফ কফি, প্লিজ!”

না চাইলেও স্বচ্ছকে মানা করতে পারল না আরিদ্র। নিজের উদ্বিগ্নতা একদিকে সরিয়ে রেখে স্বচ্ছকে বোঝার চেষ্টা করল সে। স্বচ্ছ বুঝি এখনো তার ব্যাপারে জানতে পারে নি? তার সঙ্গে কি মোহের যোগাযোগ হয়নি? আরিদ্রের মনের ভীতি স্বচ্ছের চোখে স্পষ্ট ধরা দেয়। আরিদ্র হাসি বজায় রেখে বলে,
“হ্যাঁ, অবশ্যই। একটু সময় দে। আমি আসছি।”

আরিদ্র কফির জন্য বেরিয়ে গেলে অস্থির চিত্তে উঠে দাঁড়ায় স্বচ্ছ। ফ্যাকাশে সবুজ কালার শার্টের হাতা জড়িয়ে আশেপাশে দেখে হন্তদন্ত হয়ে ড্রেসিংটেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। সাদা রঙের ড্রেসিং টেবিলে চিরুনীর আশেপাশে কিছু চুল আবিষ্কার করে স্বচ্ছ। পকেট থেকে আস্তে করে একটা প্যাকেট বের করে দুটো চুল তুলে নিয়ে আরিদ্রের ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে সে। সেখানকার বেসিনের সামনে আরিদ্রের ব্রাশটা তড়িঘড়ি করে নিয়ে প্যাকেটে ঢুকিয়ে সেটা স্বচ্ছ পকেটে রেখে হাফ ছেড়ে ওয়াশরুমে থেকে বেরিয়ে আসে।

আরিদ্রের বিছানায় এসে বসতেই তার ল্যাপটপে হাত পড়ল স্বচ্ছের। হাত টান দিতে গিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে নজর স্থির হলো স্বচ্ছের। তার মিনিট পাঁচেক পর আরিদ্র দুটো কাপ নিয়ে হাজির হয় ঘরে। স্বচ্ছ অস্থিরতা না দেখিয়ে বেশ আয়েশ করে আরিদ্রের থেকে কাপ নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল,
“তোর ল্যাপটপে দেখছি ফ্লাইটের টিকিট বুক করার পেজ ওপেন করা। এইতো সবে দেশে এলি। বিয়ের জন্য এসেছিলি শুনলাম। এখনো বিয়ের কিছুই শুনলাম না। আবার কোথায় যাচ্ছিস?”

স্বচ্ছের কাছে এমন প্রশ্ন যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। চমকে উঠে তার দৃষ্টি অস্থির হলো। সে যেন কিছু লুকাতে চাইছে। আরিদ্রের হাবভাব সবই স্বচ্ছ নিজের সূক্ষ্ম নজরে বন্দি করে নিলো। আরিদ্র অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিলো,
“আসলে এবরোডে ফিরতে চাচ্ছি। কিছু কাজ আছে?”

“এমন কী কাজ যেটা তোর ভাইয়ের বিয়ের চেয়েও দামি? আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস তো?”

স্বচ্ছের এমন প্রশ্নে রাগ উঠলেও তা প্রকাশ করতে পারল না আরিদ্র। স্বচ্ছের সন্দেহ হবে। সে ঠাণ্ডা মাথায় মিথ্যে সাজিয়ে বলে,
“দেখ, আমার ইচ্ছে আমি এবরোডেই সেটেল হবো। সেটার জন্য আমি সেখানে জবের এপ্লাই করেছি। সেখান থেকে ডেকেছে তাই।”

স্বচ্ছের আর ইচ্ছে করল না পাল্টা প্রশ্ন করতে এবিষয়ে। শুধু নির্বিঘ্নে জানতে চাইল,
“ফ্লাইট কবে তোর?”

“এক সপ্তাহ পরে।”

মৃদু হাসির রেখা দেখা গেল স্বচ্ছের শুঁকনো, পুরু ঠোঁটে। মনে মনে বেশ আনন্দ নিয়ে বলে ফেলল,
“সাতদিন যথেষ্ট সময়!”

কৌতূহলে উদ্দীপিত হলো আরিদ্র। ফট করে জানতে চায়,
“কীসের জন্য?”

“আরেহ! তুই আমার বিয়েতে তো থাকছিস না। এঙ্গেজমেন্টের সময় তো তোকে থাকতে হবে নাকি! আফটার অল বিয়ের ভূতটা আমার বাবার মাথায় তুই ঢুকিয়েছিস। এখন এভাবে মুখ লুকিয়ে পালালে চলবে না।”

বেশ ঠাট্টা করেই বলল স্বচ্ছ। আরিদ্রও জবাব স্বরূপ সামান্য হেসে হালকা গলা ঝেড়ে বলে উঠল,
“তা বিয়েতে তো তুই মন থেকে রাজি নাকি? কোনো পিছুটান নেই তো? মানে তুই হয়ত বুঝতে পারছিস আমি কীসের কথা বলছি।”

আরিদ্রের ইনিয়েবিনিয়ে কথাগুলোর মাঝখানের আসল অর্থ খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হয়নি স্বচ্ছের। সে প্রত্যুত্তরে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“পিছুটান তো তাকে বলে যাকে পেছনে ছেড়ে আসতে হয়। আমি তো কাউকে ছেড়ে আসিনি।”

স্বচ্ছের প্যাঁচানো কথা ভাবায় আরিদ্রকে। তবে সে ওতোটাও মনোযোগ দেয় না। অন্য বিষয়ে স্বচ্ছের সঙ্গে আলাপে মেতে ওঠে।

লোকজনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো শৌভিক। চোখ বুঁজতেই কানে বিরক্তির ঘণ্টার মতো বাজল এক ছেলের কণ্ঠ।
“ভাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে একজন এসেছে। অনেক সময় ধরেই অপেক্ষা করতেছে।”

শৌভিক চোখ মেলে তাকাল। মুখে সামান্য বিরক্তির ছাপ দেখা গেল। নিজের চশমার মাঝে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে চশমা ঠিক করে নিয়ে বলল,
“কে এসেছে?”

“একটা অর্ধবয়স্ক মহিলা। নাম বলল জেবা সুলতানা।”

টনক নড়ে শৌভিকের। এই নামটা সে চেনে। সে ভুল না হলে এটা মন্ত্রী সাহেবের স্ত্রী! তবে কী এমন দরকার পড়ল উনার স্ত্রীর যে এই অবধি আসতে হলো? তার মস্তিষ্ক ভর্তি প্রশ্ন আর দৃষ্টি ভর্তি বিস্ময়। সবকিছু একদিকে ঠেলে দিয়ে সে বলে,
“আসতে বলো উনাকে।”

ছেলেটি চলে গেল। কিছু সময়ের ব্যবধানে উপস্থিত হলেন মিসেস জেবা। শৌভিক অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। উনাকে দেখা মাত্র সে দ্রুত সালাম দিয়ে বলে উঠল,
“বসুন, ম্যাম! আর দুঃখিত। আপনাকে হয়ত অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।”

মিসেস জেবা গম্ভীর গলায় বলেন,
“ব্যাপার না। আমি শৌভিক মীরের সাথে কথা বলছি তো?”

শৌভিক উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
“অবশ্যই। আপনি যেহেতু অনেক সময় অপেক্ষা করেছেন আপনার জন্য শরবত জাতীয় কিছু আনা দরকার।”

“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আমার গাড়িতেই বসে ছিলাম।”

শৌভিক জোরাজোরি করল না।সোজা হয়ে বসে উৎসাহ নিয়ে বলে ফেলল,
“আপনি হঠাৎ…? মানে কোনো বিশেষ কারণ আছে কী?”

“আমি কথা ঘুরিয়ে বলব না। সোজাসুজি বলব। তুমি যেহেতু আমার ছোটো তাই তুমি করেই বলি। আমার মেয়ে তোমাকে অনেক পছন্দ করে। মানে শুধু পছন্দ করাতে সীমাবদ্ধ নেই। সে তোমাকে ভালোবাসে। সত্যি বলতে সে তোমার আচরণ, চরিত্র, তোমার যত্নশীলতা দেখে নিজের অনুভূতিগুলোকে বাড়িয়ে ফেলেছে। আর তুমিও নাকি তার প্রতি দুর্বল? এ কথা কতটুকু সত্য? দেখো আমি জানি যে রাজ/নৈতিক দিক থেকে তুমি একজন বিরোধী পক্ষের ছেলে। আমি শুধু মা হিসেবে এটা জানতে চাই যে তুমি কি আমার মেয়েটার অনুভূতি নিয়ে খেলা করছ? বা কোনো স্বার্থজনিত দিক আছে এর মধ্যে?”

মিসেস জেবার পুরো কথা শোনার পর কিছুটা চুপ থেকে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল শৌভিক। অতঃপর শান্ত গলায় জবাব দিলো,
“আমার অনুভূতিগুলোর প্রমাণ আমি আপনাদের কাছে দিতে যাব না! এতে আমার অনুভূতি ছোটো হয়ে যাবে। তবে এটা জানিয়ে রাখতে চাই যে আপনার মেয়ে আমার কাছে এসেছিল। আমি তাকে ভালোবাসি এটা বলতে আমার দ্বিধা বা লজ্জাবোধ নেই। কিন্তু আপনার মেয়েকে আমি বিয়ের প্রসঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছি। যদি আমার অনুভব দিয়ে আমি খেলতে চাইতাম বা স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইতাম তাকে আমি ফিরিয়ে দিতাম না। আঁটকে ফেলতাম। আজ সে আমার বিবাহিত করা স্ত্রী হতো। কিন্তু আমি কখনো চাইব না যাকে আমি ভালোবাসি তাকে এভাবে গ্রহণ করতে। আমি চাই তার পরিবার নিজে থেকে আমার হাতে তুলে দেক। বিয়েতে মেয়ের অভিভাবকের সম্মতি লাগে। এই সম্মতির বড়োই অভাব আমার।”

মিসেস জেবা কিছু সময় নিয়ে ভাবলেন। ছেলেটির কথাবার্তা যে কাউকে মুগ্ধ করবে! তার আচরণ যে কাউকে কাবু করবে। তার ভদ্রতা দিয়ে সে সবার আকর্ষণে আসবে। তিনি বললেন,
“তোমার সম্পর্কে আমি বেশি কিছুই জানি না। হয়ত সময় নিলেও জানতে পারব না। কারণ মানুষের ভেতরটা সেই মানুষ ছাড়া কেউ জানতে পারে না। তবে তোমার কথা শুনে মনে হলো আমার মেয়ে ভুল কাউকে পছন্দ করেনি। তার পাগলামির কারণ আমি মাত্র বুঝলাম। তুমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছ বলে সে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করেছে। নিজের ঘরে বসে বসে নিজের পছন্দের ডিজাইনগুলো নষ্ট করছে। আমি তো ওর মা! তাই ওর হঠাৎ এমন আচরণ আমার চোখে পড়ে। তুমি অনুমতি চাইছ! আমি তোমায় অনুমতি দিলাম। আশা করি আমার তোমার প্রতি যেই সুন্দর ধারণা জন্মালো তা ভুল হবে না।”

শৌভিক বিস্তর হাসল এবার। তাতে খানিকটা হতবিহ্বল হলেন মিসেস জেবা। শৌভিক স্পষ্ট বলতে থাকল,
“দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমাকে চিনুন, জানুন। তারপরেই না হয় ঠিক করবেন আমি আসলে কেমন মানুষ! আমি যে খুব সুবিধার মানুষ তাও না। কিছু কিছু খারাপ রেকর্ড আছে আমার। তাই তাড়াহুড়ো করবেন না। আপনি আপনার মেয়ের মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে এসেছেন মন্ত্রী সাহেব জানেন?”

“তাকে জানতে দিতে চাইনা জন্যই তাড়াহুড়ো করছি। এমনটা নয় যে আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না। এতটা অধম মা আমি নই যে নিজের মেয়ের বিয়ের জন্য যাকে ঠিক করব তার সম্পর্কে সামান্য খোঁজও নেব না। ফারাহর কথা শুনে যখন বুঝি ও তোমার সঙ্গে জীবন কাটাতে চায় তখন থেকে আমি তোমার সম্মন্ধে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছি। এরেঞ্জ ম্যারেজেও তো মেয়ে বা ছেলের পরিবার সবটা জানতে সক্ষম হয়না। কে কেমন সেটা তার মনের গহীনের ব্যাপার। ফারাহ আজ অবধি নিজের জন্য যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তাতে সে পস্তায় নি। তুমি চাইলে তোমার বাবার সঙ্গে আমি কথা বলব।”

শৌভিক নিজের মনের প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করতে পারল না। তার কি খুশি হওয়া উচিত? এবার সে অস্বস্তি বোধ করছে। সরোয়ার সাহেবের মেয়ে ফারাহ। অথচ বিয়ের বিষয়টা উনি জানবেন না? যদি না জানে তবে যে সে ঠকবাজ প্রমাণিত হবে। শৌভিকের প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মিসেস জেবা কিছু বুঝে আবার বললেন,
“হয়ত তুমি ফারাহর বাবার কথা ভাবছ। কিন্তু ভেবো না। সঠিক সময় আমি তাকে জানাব। এখন জানানো যাবে না। কারোর ধারণা নেই ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে! তবে আমি কিছুটা ইঙ্গিত পেয়েছি। তাই এত তাড়াহুড়ো করছি। এমন পরিস্থিতিতে হয়ত পড়ব যেখানে আমি নিজেকে সামলাতে পারব না। ফারাহর বাবা কখনো তার ছেলেমেয়ের অনুভূতিকে মূল্য দেন নি। আর দেবেও না হয়ত। তোমার বাবার কাছে আমি যাব বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি আজ এসেছি শুধু তোমার মুখ থেকে এটা জানতে যে আমার মেয়ের অনুভূতির সঠিক মূল্য দিতে পারবে তো?”

শৌভিকের অস্থির লাগছে এবার। কথাগুলো সাজাতে পারছে না। এলোমেলো কণ্ঠে বলল,
“বিশ্বাস করে ফেলেছেন তখন পিছুপা হবেন না। এই বিশ্বাসের ফল দেখার জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। তার প্রতি আমার আকর্ষণ কৃত্রিম নয়। কোনো ছল নয়। আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি তারই কথা ভেবে। কারণ আমার অনুভূতি অকৃত্রিম।”

মিসেস জেবা মনে অদ্ভুত শান্তি বোধ করলেন। উনার মাতৃ অনুভব শক্তি বলছে এই ছেলেটাই তার মেয়ের জন্য সঠিক। কন্যার জন্য সে ব্যতীত সকলে ভুল!

বিকেল গড়িয়েছে। তানিয়া বাড়ি ফিরছে। আজকে সে একটু দাওয়াতের জন্য তার আন্টির বাড়ি গিয়েছিল সকালে। হাঁটতে হাঁটতে অদূরে চায়ের দোকানে কিছু ছেলেপেলে নজরে পড়ল তার। গানের সুর ভেসে আসছে সেখান থেকে। ছেলেদের দল এক হয়ে গান গাইছে সুরে সুরে। সেখানে মাঝে মাঝে একজন পাগল মতো লোক দোতারা নিয়ে আসে। মাথায় আধপাকা ঝাঁকড়া চুল। মুখ ভর্তি বড়ো বড়ো দাড়ি। বেশ বয়স্ক! নিজমনে গান গেয়ে গেয়ে চলে যান। আজকে তার সঙ্গে ছেলেরাও তাল মিলিয়ে গাইছে। ধীর পায়ে সেই দোকানের কাছে যেতেই সৌমিত্রকে দেখে তৎক্ষনাৎ চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। আজকেও সৌমিত্র এসেছে ভেবে অবাক হলো বটে। আজ নতুন নয়! আজকে দিয়ে তিনদিন সৌমিত্র তানিয়ার পাড়ার এই চায়ের দোকানে সৌমিত্র তার বন্ধুদের নিয়ে আসে। তানিয়া বিকালে হাঁটতে বা ঘুরতে বের হয় সৌমিত্র জানে। সেকারণেই আসে। মোহের সঙ্গে ঘটা সেই দুর্ঘটনার পর থেকে সৌমিত্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি তানিয়া। একপ্রকার সে এড়িয়ে চলছে। তাই তো সৌমিত্রের এমন পাগলাটে পদক্ষেপ! সন্ধ্যে অবধি চায়ের দোকানে বসে বসে গান গেয়ে যায় আপনমনে তানিয়াকে স্মরণ করে। বয়স্ক লোকটির সঙ্গে সবাই তাল মিলিয়ে গাইছে,
“কেউ প্রেম করে,
কেউ প্রেমে পড়ে
আমার হয়েছে কোনটা,
জানে না এই মনটা।
কেউ ভুল করে,
কেউ ভুলে পড়ে
আমার হয়েছে কোনটা,
জানে না এই মনটা।”

আজ তারা তানিয়া আজও তাকে দেখেও না দেখার ভান করে দ্রুত চলে যেতে শুরু করে। তবে আজ তার এমন আচরণটা আর মেনে নিতে পারে না সৌমিত্র। পরপর তিনটে দিন সে অপেক্ষায় থেকেছে। ভেবেছে তানিয়া নিজ থেকে তার কাছে আসবে। জানতে চাইবে তার এই উন্মাদের মতো আচরণের কারণ! কিন্তু তানিয়ার এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টা এবার তার পুরো শরীরে জ্বালা ধরালো। তার দিকে একবারও না তাকানোর বিষয়টা তার ভেতরে লণ্ডভণ্ড করে ছাড়ল। সে গান ছেড়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠল,
“মিস তানিয়া!”

তানিয়া হকচকিয়ে উঠে থেমে গেল। তার পুরো শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়। সে আড় দৃষ্টিতে বুঝল সৌমিত্র রাস্তা পার হয়ে তার দিকেই আসছে। তানিয়ার মস্তিষ্ক বারবার তাকে পরামর্শ দিতে থাকল যেন সে তৎক্ষনাৎ স্থান ত্যাগ করে। কিন্তু তার মন সৌমিত্রের মনের দ্বারে ধরা দিতে চাইল। তানিয়ার সামনাসামনি এসে হাফ ছাড়ল সৌমিত্র। তানিয়ার সাহস হলো না একবারও ছেলেটার মুখের দিকে তাকানোর। সে শক্ত গলায় বলল,
“একে তো রাস্তার বেয়াড়া ছেলের মতো দলবেঁধে গান গেয়ে অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করছেন। তার উপর আমাকে রাস্তায় এত লোকের সামনে ডাকাডাকি করছেন। সমস্যা কী আপনার?”

“সমস্যা তো বোধহয় আপনিই মিস গোলাপি! সমাধানও বোধহয় আপনার কাছে আছে। আপনি দিতে চাইছেন না। অন্যায় করছেন আমার সাথে! তীব্র অন্যায়!”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৯ [দ্বিতীয় খণ্ড]

তানিয়া উত্তর দিতে চেয়েও নিজের মস্তিষ্ক ঘেঁটেঘুটে কোনো জবাব খুঁজে পেল না। তার প্রচণ্ড রাগ উঠে যাচ্ছে এবার। সে চেষ্টা করল নিজেকে ঠাণ্ডা রেখে সৌমিত্রকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার। কিছুটা দূরে যেতেই সৌমিত্র হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“মিস গোলাপি! আমাকে এড়িয়ে যাবেন না। আমার কিছু কয়েকটা কথা আছে। প্লিজ!”

তানিয়া তার কথাতে থামলেও সৌমিত্রের পানে পিছু ফিরে তাকাল না। সামনের দিকে মুখ করেই শান্ত গলায় বলল,
“এমনি আমার অনেক ছড়িয়ে গেছে পাড়ায়। আমার পরিবারের কানে উল্টোপাল্টা কথা গেলে তারা কষ্ট পায়। আজকের আকাশের অবস্থা ভালো নয়। তাই রাস্তায় বেয়াড়াপনা না করে বাড়ি চলে যান। নিজেও শান্তিতে থাকুন, আমাকেও থাকতে দিন।”

“আমি শুধু কিছু সময়ই চেয়েছিলাম। আপনার থেকে আজকে উত্তর না নিয়ে আমি কোথাও যাব না। সারারাত এখানে দাঁড়াতে হলে তাই দাঁড়াব। এক পাও নড়ব না কিন্তু!”

তানিয়া আর প্রত্যুত্তর করল না। সে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। তার মনে হলো এখানে থাকতে থাকতে ধৈর্যহারা হয়ে সৌমিত্র আপনাআপনি চলে যাবে।

আজ ইথানের মন বড্ড খারাপ। টেবিলে মাথা লাগিয়ে দিয়ে বসে আছে সে। চোখেমুখটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার! চেহারায় নেই উজ্জ্বলতা! মোহ হাতে একটা বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকে ইথানকে দেখে তার সামনে গিয়েই বলল,
“ইথান বাবু! দেখো তোমার ফেবারিট পাস্তা রান্না করেছি। খেয়ে দেখবে না?”

ইথান মুখ উঠিয়ে মোহের দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকাল। ছেলেটির মুখভঙ্গি দেখে ভেতরটা ভেঙে এলো মোহের। ইথান জেদ ধরে বলল,
“তুমি ঈশানী আন্টিকে এখনি কল করো। আমি জানতে চাই,আমাকে না জানিয়ে কোথায় গেল সে।”

মোহ বেকায়দায় পড়ে গেল। যেই মানুষটা নেই তাকে কী করে কল করবে? তবে ইথান তো জানেই না মানুষটা নেই। এটাও জানে না সেই মানুষটাই তার মা ছিল। তবুও ঈশানীর প্রতি তার অগাধ টান! আজ ঈশানীর কাছে যাবে বলে তুমুল জেদ ধরেছিল ইথান। ঈশানীর মৃ/ত্যুর কথা মোহ তাকে বলতে পারেনি। ছোটো মন শুধু শুধু কষ্ট পাবে। মোহ বলেছে, ঈশানী তার কাজে সারাজীবনের জন্য চলে গেছে আগের মতো! তাতেই ইথানের এক আকাশ সমান অভিমান। সেই সাথে মন খারাপ। মোহ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল,
“কল করার চেষ্টা করেছিলাম বাবু। কিন্তু ওখানে নেটওয়ার্ক কাজ করে না যে।”

ইথান মুখ থমথমে করে বলে,
“সে এমন কাজ করতে পারল? এভাবে চলে যেতে পারল? মায়া হলো না আমার জন্য?”

ইথানের প্রতিটা কথা মোহের ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। গলা ভেঙে আসছে মোহের। কী জবাব দিবে ছোটো ছেলেটাকে? বলার যে কিছুই নেই। এমন সময় মিসেস সুফিয়ার ডাক এলো। ইথানকে সাথে করে নিয়েই নিজের ঘর থেকে বের হলো মোহ। সোফায় আবিষ্কার করল হাস্যোজ্বল শৌভিককে। শৌভিককে দেখেই ছুটে গিয়ে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইথান। সঙ্গে সঙ্গে শৌভিকও তার পকেট থেকে দুটো বড়ো বড়ো চকলেট বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলো। এসময় শৌভিককে দেখে অবাকই হলো মোহ। অতিরিক্ত বিস্মিত হবার ভান ধরে সে শৌভিকের পাশের সোফায় বসতে বসতে বলল,
“বাবাহ্! এ তো দেখি রাতের বেলায় সূর্য! যাকে হাজারবার কল দিয়েও পাওয়া যায় না সে কিনা আমার বাড়িতে হাজির। ভাবা যায়?”

মোহের কথায় শৌভিক ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
“কেন? তোর বাড়িতে আসতে মানা করছিস?”

আজকাল শৌভিকের সঙ্গে মোহের সম্পর্ক তুইতোকারিতে গড়িয়েছে। শৌভিকের মতে বোনকে তুমি করে ডাকতে মজা লাগে না। মোহ হাফ ছেড়ে বলল,
“না, তা মানা করব কেন? আমার সেই সাধ্য আছে?”

“অবশ্য বাড়িটা তো আমারও। তুই মানা করলেও বা কী!”

সোফায় মাথা হেলিয়ে আয়েশ করে বসে বলে শৌভিক। মোহ ভেংচি কাটে তৎক্ষনাৎ। শৌভিক ফের সোজা হয়ে বসে বলল,
“যেটা বলতে আসা সেটা শোন!”

“কী?”

শৌভিক প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে বলল,
“আই গট ইট!”

মোহ চোখ ছোটো করে বলল,
“তুমি কী পেয়েছ?”

“তুই যেটা চেয়েছিলি। মিস্টার আরিদ্রের স্যাম্পল!”

চোখ দুটো জ্বলে উঠল মোহের। সেই সঙ্গে হতবিহ্বল হলো সে। কাঁপা সুরে বলল,
“কী বলছ? কিন্তু তুমি কী করে…!”

“প্লিজ এটা এখন জানতে চাস না যে আমি কী করে পেলাম। ইটস অ্যা বিগ সিক্রেট! পরে ঠিক সময়ে জানতে পারবি।”

মোহ খোঁচাখুঁচি করেও লাভ হলো না। শৌভিক মুখ খুলল না। মোহ দমে গেল। তবে যেন অবশেষে শান্তি পেল। সে জানে, এভাবে এগোতে থাকলে আরিদ্রকে সে ধরেই ফেলবে।

গরম গরম চা উপভোগ করছে শৌভিক। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে মোহকে একটা কথা বলার। অবশেষে সে মুখ খুলে বলল,
“শোন! তোর একটা সাজেশন দরকার।”

মোহ নিচের ঠোঁট উল্টিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
“পরামর্শদাতার আবার পরামর্শ দরকার! অবিশ্বাস্য!”

“তুই শুনবি আমার কথা?”

শৌভিকের গম্ভীর কণ্ঠে। মোহও এবার ভীষণ সিরিয়াস হয়ে বলল,
“কী বলো! শুনছি তো।”

“মিসেস জেবা সুলতানা মানে ফারাহর মা এসেছিল আমার কাছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

নেত্রপল্লব আপনাআপনি বড়ো হয়ে গেল মোহের। কান দুটোকে তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না। মুখ হা হয়ে গেল। কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়ে রইল সে। অতঃপর চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“কী বলছ! এটা কীভাবে সম্ভব?”

শৌভিক কিছুদিন আগের কথা মনে করে বলল,
“ঘটনার শুরুটা কিছুদিন আগে থেকে হয় যেদিন মিস ফারাহ আমার কাছে নিজে এসেছিল।”

অতীত…
ক্লাবে কিছু ছেলেপেলের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছিল শৌভিক। আচানক নীলয়ের আগমন ঘটে। দরজার কাছে দাঁড়াতেই তাকে দেখে শৌভিক বলল,
“কী রে নীলয়! তুইও এসেছিস। আয় এখানে বস। আড্ডা দেওয়ার সময় পেয়েছি অনেকদিন পর।”

নীলয় ঠাঁই দাঁড়িয়ে উসখুস করতে করতে বলল,
“ম্যাডাম এসেছে। আই মিন ভাবি এসেছে। দেখা করতে চায়। অনেক রেগে আছে।”

উপস্থিত সকলে হতবাক হলো। একে অপরের দিকে তাকাতাকি করল। শৌভিক সবার উপর খানিকটা চেঁচিয়ে বলল,
“কী রে! তোদের কার গার্লফ্রেন্ড এসেছে এখানে? আমি বলেছি না এখানে কোনো মেয়ে এলাও না? তবুও তোরা এখানে গার্লফ্রেন্ডকে আসতে বলিস কোন সাহসে? থা/প্রায়ে একেকটার দাঁত ফেলে দেব।”

সবাই থতমত খায় ভয়ে। সেইসময় নীলয় ফের নিচু গলায় বলল,
“শৌভিক ভাই! আপনার জন এসেছে। আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”

সবার নজর তখন চলে গেল শৌভিকের দিকে। লিডার এখন নিজেই পাপ করেছে! অপ্রস্তুত হয়ে গেল শৌভিক। আবার নিজেই হতভম্ব হয়ে রইল নীলয়ের কথায়। তার জন এসেছে মানে কী? ফারাহ এসেছে নাকি?

তার ভাবনার মাঝেই ফারাহ উদয় হলো। দরজার কাছে এসে শৌভিকের উদ্দেশ্যে বলল,
“কতক্ষণ দাঁড়াব আর রোদের মধ্যে? মি. শৌভিক! আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

উপস্থিত সকলের হাসি পেলেও শৌভিকের ভয়ে হাসা আর গেল না। ঠোঁট টিপে হাসি রোধ করার চেষ্টা করতে করতে একে একে উঠে সকলে যেতে যেতে ফারাহকে সালাম দিয়ে গেল। তখন ঘরে শুধু শৌভিক আর ফারাহ। শৌভিকের বিহ্বলতা কাটছে না। মাথা ভনভন করছে। ফারাহ এসে তার সামনাসামনি দাঁড়াল। অতঃপর মুখ ঘুরিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে শুধাল,
“আপনি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন?”

ফারাহর কণ্ঠে শৌভিকের অন্তর নড়ে ওঠে। মৃদু হেসে জানতে চায়,
“কী? শুধুমাত্র এই প্রশ্নটা করতে আপনি এখানে এসেছেন?”

“ব্যস…আমি যা বলব শুধু সেটার সোজা উত্তর চাই। কোনো হেয়ালি করবেন না আজকে।”

“ভালোবাসার প্রমাণ লাগবে আপনার? কী করে দেব বলুন? আপনার বিশ্বাস কী করে অর্জন করতে পারি?”

ফারাহ ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“কথাটা বিশ্বাস অর্জনের নয়। প্রতি পদে আপনাকে বিশ্বাস করেছি। সেটার প্রমাণ আপনিও পেয়েছেন। বিষয়টা ভয়ের। আজকাল চারিদিকে শুধু বিচ্ছেদের গল্প, স্বার্থপরতার উদাহরণ, দুঃখের সময়ে ছেড়ে যাওয়ার নমুনা। আমি সবসময় মানুষকে ভালোবাসার পরামর্শ দিয়েছি। কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। অনেক পুরুষকে মন ধরানোর চেষ্টা করেছি। কেউ বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। সকলের স্বার্থ ছিল, কারণ ছিল। অকারণে কেউ কখনো ভালোবাসতে পারে?”

শৌভিক মুখে হাসি রেখেই উত্তর দিলো,
“না পারে না। আমিও আপনাকে অকারণে ভালোবাসিনি। আমারও কারণ আছে। কারণটা হলো ভালো থাকা। আমি নিজের ভালো থাকা আপনার মধ্যে দেখেছি।”

তারপর কিছু সময় নীরবতা। শৌভিকের চোখ বিষণ্ণ ফারাহর দিকে। আর ফারাহর চোখ মেঝেতে। সে ঢক গিলে বলে উঠল,
“বিয়ে করবেন আমাকে?”

শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি! আচমকা ফারাহর এমন কথায় কান গরম হলো শৌভিকের। অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে রইল সে। তারপর কিছু বলতে উদ্যত হতেই ফারাহ বলল,
“সময় নিয়ে নয়। যা করার আজ কালের মধ্যে করতে হবে। হাতে সময় নেই। বাবা আপনার ক্ষতি করতে দু’বার ভাববে না। সো প্লিজ…”

শৌভিকের বোধগম্য হলো না ফারাহর কথা। নিজের চশমা ঠিক করে উৎসুক হয়ে বলল,
“আপনার বাবা মানে…!”

“বাবা সব জেনে গেছে। আর সে আপনাকে কখনো মানবে না। আমার ভয় এখানেই যে মোহের মতো যদি আপনাকেও কিছু করে তাহলে কী হবে? এর চেয়ে ভালো দ্রুত বিয়ে করে নেওয়া।”

ফারাহর কাতর কণ্ঠ। শৌভিক এবার বুঝল ফারাহর এত তাড়াহুড়োর কারণ। যে মেয়ের মুখে প্রণয়ের কথা ফুটতে বছরের পর বছর লাগার কথা সে নিজে থেকে বিয়ের কথা তোলার আসল রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারল শৌভিক। সে ফারাহর চোখের দিকে পাকিয়ে বলল,
“সরি মিস ফারাহ। এটা কাপুরুষের পরিচয় হবে। তাছাড়া বিয়ে এভাবে হয় না। বিয়ের জন্য অভিভাবকের অনুমতির প্রয়োজন হয়। নয়ত আপনাকে হালাল করে আমি পাব না। বিয়ের আগে আপনার বাবার কাছে আমার বাবা যাবে অনুমতির জন্য। তারপরেই বিয়ে হবে।”

ফারাহর রাগ হলো। চোখমুখ লাল হয়ে এলো। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
“আপনি এত জেদি কেন বলুন তো! বুঝতে পারছেন না আমার কথা? এত ট্যারা মানুষ কেন আপনি?”

“আমি তো এমনই। তাও এই ট্যারার প্রণয়ের ফাঁদে পড়ে গেলেন। বিষয়টা মজার না?”

“আমি মজা করছি না আপনার সঙ্গে। আপনি সিরিয়াস হচ্ছেন না কেন? আমি কি মজার কথা বলেছি আপনাকে?”

কঠিন কণ্ঠ ফারাহর। শৌভিকও গাম্ভীর্যের সঙ্গে জবাব দিলো,
“আমিও মজা করিনি। এভাবে বিয়ে হয় না ফারাহ।”

বর্তমান…
মোহকে সবটা বলে শেষ করল শৌভিক। এরপর বলল,
“তাকে আমি প্রত্যাখ্যান করি। বিষয়টাতে তার অভিমান হয়। সে চলে যায়। এরপর থেকে নাকি বাড়িতে অদ্ভুত আচরণ করছে। ওর মা সব জেনে আমার কাছে আসে। আর বিয়ের অনুমতি দেয়। তিনিও চান দ্রুত বিয়েটা দিতে।”

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বসে রইল মোহ। অনেকটা ভেবে বলল,
“ফারাহর মা কিছু একটা বুঝেই দ্রুত বিয়ে সেরে নিতে বলেছেন। আর একটা কথা ভাইয়া! প্রিয় মানুষকে পাওয়ার সুযোগ পেয়েও হাত ছাড়া করো না। জীবন বারবার সুযোগ দেয় না। একবার সুযোগ হারিয়ে গেলে সারাজীবন পস্তাতে হবে।”

“যেমন তুই পস্তাচ্ছিস?”

কেঁপে উঠল মোহ। স্বচ্ছের প্রতি তার অসীম অভিমান। এটি কোনোদিন শেষ হবে না। হয়ত স্বচ্ছও কখনো আসবে না অভিমান নিভিয়ে দিতে। মোহ কড়া কণ্ঠে বলল,
“আমি কেন পস্তাব? কীসের দায় পড়েছে?”

“জানি, জানি। সব জানি আমি।”

মোহ দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“তা কবে ভাবির ননদ হচ্ছি? আই মিন ডেট কবে? তাড়াতাড়ি ফাইনাল করো! আমি অনেক এক্সাইটেড।”

শৌভিক মাথায় অনেক ভাবনা নিয়ে বলে,
“আগে তো ম্যাডামের অভিমান ভাঙাতে হবে!”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি ভাঙাও। আর শপিংও তো করতে হবে নাকি! তোমার বউ ডিজাইনার বলে নিজের বিয়ের পোশাকও নিজে ডিজাইন করবে এমনটা তো হতে পারে না।”

চলতে থাকে মোহ শৌভিকের কিছু সময়ের জন্য আড্ডা। এরপর আকাশের মতিগতি খারাপ বুঝে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শৌভিক।

আজ অনেকদিন পর নাইট ক্লাবে এসেছিল আরিদ্র। রাত প্রায় আটটা। তার সাথে এক সুন্দরী রমনী জুটেছে। সুন্দরী রমনীর ইচ্ছে আরিদ্রের সঙ্গে লং ড্রাইভে যাওয়ার। সুন্দরীর ইচ্ছে মেটাতে পার্টি থেকে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে এসেছে তারা। পার্কিং প্লেসে যাবার আগেই অকস্মাৎ তাদের সামনে এসে একটি কালো রঙের গাড়ি হাজির হয়। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে তিনটি ছেলে। তাদের চেহারা মাস্ক আর টুপি দিয়ে ঢাকা। তাদের মাঝে একজন আরিদ্রের জামার কলার চেপে ধরে। তার সঙ্গে থাকা মেয়েটি ভয়ে দূরে সরে যায় প্রথমেই। আরিদ্র চটে গিয়ে বলল,
“কী হচ্ছে এসব! কে তোরা?”

দুজন ছেলে আরিদ্রের হাত ধরে। একজন তীব্র জোরে আরিদ্রের গালে ঘু/ষি মা/রে। ছিটকে পড়ে যায় আরিদ্র। ঠোঁটের কোণা কেটে যায় তার। সে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ানোর আগেই তিনজন মিলে বেধড়ক মা/র শুরু করা হয়। আরিদ্র কথা বলার শক্তি হারায়। তাকে সবাই ধরে গাড়িতে ওঠায় এবং গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই চলতে শুরু করে গাড়ি।

চলবে…