যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-২০+২১+২২

0
13

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০ [দ্বিতীয় খণ্ড]

রাত তখন আটটা পনেরো। শীতল ধরণী জুড়ে ঝিরিঝিরি বর্ষণ নিজের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে। ভিজে রাস্তা ধরে ছাতা নিয়ে হাঁটছে তানিয়া। মাথায় তার সৌমিত্রের চিন্তায় গিজগিজ করছে। তাই মাকে মিথ্যে মাথাব্যথার ঔষধ আনার নাম করে বেরিয়েছে সে। বাড়িতে সদস্য বলতে সে আর তার মা। তার বাবা থাকে বিদেশে। তাই যেকোনো কাজে তাকেই বের হতে হয়। সেকারণে তানিয়ার মাও মানা করতে পারেন নি। অবশেষে নজরে এলো চায়ের দোকানটা। দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে তবে তার সামনের ছাঁদনার হলুদ লাইটে একজন মানবকে দেখে হতভম্ব না হয়ে পারল না সে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত লোকটার কাছে গেল। লোকটি ছাঁদনার নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাতাসের ঝাঁপটার ফলে বৃষ্টির ছিটায় শার্ট সহ শরীরের কিছু অংশ আধভেজা হয়েছে। সামনের চুলগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। তানিয়া তার পাশে এসে দাঁড়ালেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বৃষ্টির দিকে চেয়ে গুনগুনিয়ে গান করছে মানুষটা। তবে তানিয়ার আগমনে তার মুখে মৃদু হাসির উদয় হয়েছে। গান শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল তানিয়া। সে পুরুষটির চিন্তায় পাগল হচ্ছিল আর কাঙ্ক্ষিত লোকটি কিনা মজা নিয়ে গান গাইছে? তানিয়া কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল,
“এখনো বাড়ি কেন যান নি? সবাই তো চলে গেছে। আপনি কেন রয়ে গেলেন? বৃষ্টি হচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন না নাকি?”

গুনগুনিয়ে গান করা থামায় সৌমিত্র। তবে তানিয়ার দিকে না চেয়েই উত্তর দিলো,
“আমি কী বলেছিলাম মনে নেই? আপনার কাছ থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অবধি আমি এখান থেকে নড়ব না।”

“এখানে থেকে আপনার লাভটা কী হচ্ছে? এসব পাগলামি করে আপনি তো নিজের ক্ষতি করছেন।”

তানিয়ার কণ্ঠে অস্থিরতা৷ তবে সৌমিত্রের মাঝে সেভাবে কোনো হেলদোল দেখা গেল না৷ সৌমিত্র এবার ছাতা নিয়ে ব্যাকুল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা রমনীর দিকে চাইল। বলল,
“লাভটা হলো এইযে আমি বুঝতে পারলাম আপনি আমার জন্য এখনো চিন্তা করেন বুঝতে পারলাম এবং ক্ষতির কথা যদি বলে থাকেন তাহলে বলব প্রেম জিনিসটাই তো ক্ষতি। এইযে প্রেমে পড়লে মানুষের মন অন্যের দখলদারত্ব হয়ে যায়। তার মনোযোগে শুধু কাঙ্ক্ষিত মানুষটি ঘুরতে থাকে। অন্যকিছু ভাবার তার ইচ্ছে হয়না। এসব কি ক্ষতি নয়? চরম ক্ষতি! তবুও মানুষ প্রেমে পড়ে!”

তানিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,
“প্রেমে তো এর আগে আপনি অনেকবার পড়েছেন। আবার সেসব প্রেমকে খেলার মতো করে খেলে সব ছাড়িয়ে গেছেন। আমি তো একবার খেলার পাত্রী হয়েছিলাম একজনের। আবার কি সেই পাত্রী হতে বলছেন?”

তানিয়ার প্রতিটা কথায় সৌমিত্র বুঝল মেয়েটা প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সৌমিত্র হাল ছাড়ল না। বলে উঠল,
“সেসব আমি নিছকই মজার ছলে করেছি৷ যাদের সঙ্গে খেলেছি তারাও জানে তাই কখনো সিরিয়াস ছিল না। কিন্তু আমি এবার শুধু প্রেমে পড়িনি মিস গোলাপি! আমি এবার ভালোও বেসেছি। আমার প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিকে প্লিজ এড়িয়ে যাবেন না আপনি।”

তানিয়া এবার অস্থির হয়ে উঠল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“ভালোবাসা, প্রেম আমার কাছে শুধুই কিছু মিথ্যে শব্দ। এর কোনো সত্যতা নেই আমার কাছে আর। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি দয়া করে আপনি এসব আবদার নিয়ে আমার কাছে আসবেন না।”

সৌমিত্র ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“এটাই আপনার শেষ কথা?”

তানিয়া জেদ নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা। প্রেম-ভালোবাসা এসবের আর জায়গা নেই আমার জীবনে। শুধু পরিবারের জন্য তারা এখন আমার যেখানে বিয়ে ব্যবস্থা করবে আমি সেখানে বিনা আপত্তিতে বিয়ে করব।”

হাতের মুঠো শক্ত হলো সৌমিত্রের। পরক্ষণে কয়েকটি বড়ো শ্বাস নিতেই তানিয়া রূঢ় কণ্ঠে বলল,
“আপনার সব জানা শেষ? তবে এখন যান এখান থেকে।”

আচানক অমায়িক হাসল সৌমিত্র। ছাঁদনা থেকে বেরিয়ে তার ভেজা বাইকে বসতে বসতে বলল,
“নিজের বলা কথাটা মনে রাখবেন মিস গোলাপি! আজ আসি তবে। শীঘ্রই দেখা হচ্ছে।”

তানিয়াকে বিস্ময়ে ফেলে রেখে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল সৌমিত্র। বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে গেল সৌমিত্রের বাইকটি।

আরিদ্রকে হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় মাস্ক পরিহিত ছেলেপেলেরা একটা বড়ো মাঠে ফেলে দিলো। গড়িয়ে এক অবহেলিত বলের মতো পড়ে রইল আরিদ্র। তার মুখটাও বাঁধা। চেষ্টা করেও আর্তনাদ করে লাভ নেই কোনো। রাগে তার শরীর রি রি করছে আর ব্যথায় শরীর করছে ব্যথা। কে তাকে এভাবে তুলে নিয়ে এলো তার আন্দাজও করতে পারছে না কোনোমতেই। তাকে যখন চার-পাঁচ জন ছেলে ঘিরে তখন আগমন ঘটল আরেকজনের। নেভি ব্লু টিশার্ট পরিহিত ছেলেটির মুখেও মাস্ক। তার হাতে হকি স্টিক কয়েকটি। আস্তে আস্তে আশেপাশের ছেলেদের হাতে হকিস্টিক ধরিয়ে দিলো সে এবং কণ্ঠস্বর মোটা করে বলল,
“অনেকদিন খেলা হয়না। আজকে আমরা ইচ্ছে মতো হকি খেলব। কী বলিস তোরা?”

প্রতিটা ছেলে গর্জন করে সম্মতি দিলো। কণ্ঠস্বর চেনার চেষ্টা করল আরিদ্র। মোটা কণ্ঠস্বর যেন কারোর সঙ্গে মেলাতে পারছে না। কিন্তু সে বুঝে গেল তার সঙ্গে এখন যা হবে তাতে সে বেঁচে থাকবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। নড়েচড়ে গোঙাতে থাকল সে। সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ে সজোরে মা-রা হলো। আর্তনাদ করতে চেয়েও পারল না আরিদ্র। কাঁপতে থাকল তার সারা শরীর। সব ছেলেকে নির্দেশ করা পুরুষটি আঙ্গুলের ইশারা করে বোঝাল যেন আরিদ্রের মুখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। সে আরিদ্রের প্রতিটা আর্তনাদ উপভোগ করতে চায়। পৈশাচিক আনন্দ লাভ করতে চায়। খুলে দেওয়া হলো আরিদ্রের মুখ। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার দিয়ে উঠে বলল,
“কোন হারা** বে তুই? সাহস থাকলে আমার চোখ আর হাত-পা খোল শালা কু** বাচ্চা! যা করছিস তার জন্য তোর মাংস কে/টে কুকুরকে খাওয়াব রে! চিনস না তুই আমাকে।”

তার তেজ দেখে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল তার সামনে থাকা ব্যক্তিটি। তার ঘোলাটে দৃষ্টির অভ্যন্তরে ভাসছে ক্রোধের লাভা। হকিস্টিক শক্ত করে ধরে বেধড়ক মা/র শুরু করল সে। সঙ্গে শুরু করল তার সঙ্গে থাকা ছেলেগুলোও। একেকটা আ/ঘাত আরিদ্রের শিরা-উপশিরা কাঁপিয়ে তুলছে। তার ব্যথা ভর্তি চিৎকারে কেঁপে উঠছে সম্পূর্ণ মাঠ। তেজ কমে এলো আরিদ্রের। আ/ঘাতে তার শার্ট, প্যান্ট ছিঁড়ে গেল জায়গা জায়গায়। মুখের কিছু অংশ কে/টে গেল। কিছু কিছু দেহের অংশ ফে/টে তাজা র/ক্ত বের হওয়া শুরু হলো। তার বুকে পা তুলে দিয়ে চাপ দিতেই কেশে উঠল সে। কমে গেল আরিদ্রের সকল তেজ। ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করার মতো শক্তিও সে পেল না। শুধু বড়ো বড়ো শ্বাস নিতে পারছে আরিদ্র। তা করতেও তার বড়ো কষ্ট হচ্ছে। বোধ করছে মৃ/ত্যু যেন তার কত কাছে! নিজের সমস্ত কুকর্মের কথা মনে পড়ছে আরিদ্রের। বিশেষ করে সেই মুহূর্তের কথা যখন সে ঈশানীকে মে/রে ফেলেছিল। নিশ্চয় মেয়েটারও এমন কষ্ট হয়েছিল? সেটারই কি সাজা পাচ্ছে তবে আরিদ্র? আরিদ্র কানে শুনতে পেল একেকটা হকিস্টিক মাটিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এরপর পায়ে হাঁটার শব্দ দূর যেতে থাকল। ছেলেরা কি চলে যাচ্ছে তবে? কিন্তু তার কী হবে? সে কি এখানেই পড়ে থাকবে? হালকা বৃষ্টি এখনো পড়ছে। সেই বৃষ্টির পানির সঙ্গে আরিদ্রের র/ক্ত মিশে ঘাসে গড়িয়ে পড়ছে। লাল হয়ে যাচ্ছে পুরো জায়গাটি।

করিডোর ঘুরে ঘুরে নিজের মাথার চুল মুছছে স্বচ্ছ। দুইহাত ভীষণ ব্যথা করছে তার। চুল মুছে টাওয়াল গলায় ঝুলিয়ে হাত দিয়ে নিজের এলোমেলো চুল ঠিক করতেই কল এলো তার ফোনে। টাওজারের পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিলো স্বচ্ছ। অচেনা নম্বর দেখেই ভ্রু কুঁচকালো প্রথমে। রিসিভ করে কানে ধরে গম্ভীর আওয়াজে বলল,
“হ্যালো, কে বলছেন?”

অপরপ্রান্তের মেয়েলি কণ্ঠটি নরম সুরে বলল,
“আপনি কি সবসময় সিরিয়াস মুডেই থাকেন?”

স্বচ্ছ মেয়েলি কণ্ঠ স্মরণ করার চেষ্টা করল। ব্যর্থ হয়ে শুধাল,
“সরি বাট আপনাকে চিনতে পারলাম না।”

অন্বেষা হতবাক হয়ে জবাব দেয়,
“ফিয়ন্সের কণ্ঠ শুনেও যদি এখন চিনতে না পারেন বিয়ের পর তো চেহারাও ভুলে গিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করবেন যে আমি কে!”

“ওহ মিস অন্বেষা!”

অন্বেষা মৃদু হেসে বলে,
“ইয়েস। অ্যান্ড ইউ নো হোয়াট? ইউ আর সাচ অ্যা আনরোমান্টিক পারসন। বিয়ের আগে মানুষ নিজের ফিয়ন্সের সঙ্গে ডেটে যায়, রাত জেগে কথা বলে আরো কত কিছু! আপনি আমাকে কল অবধি করলেন না। উল্টে আমাকে কল করতে হচ্ছে। আই ডোন্ট লাইক ইট।”

স্বচ্ছ কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে বলল,
“যখন পছন্দই নয় রাজি কেন হলেন বিয়েতে?”

অন্বেষার হাসির আওয়াজ পেল স্বচ্ছ। অতঃপর বলল,
“সত্যি বলব? কারণ আপনি এই অন্বেষার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখান নি। কথায় বলে, আমরা সচরাচর তার পেছনেই ছুটতে থাকি যাদের আমাদের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না। আমার ক্ষেত্রেও বিষয়টা ঠিক সেরকম। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমিও বিয়েতে রাজি হবো না। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার টাইপ মনে হয়েছে। মনে হয়েছে এমনই তো খুঁজছি। যার চোখ কথা বলবে, যার আচরণ হবে সবার থেকে আলাদা। সে আমার দিকে বাকিসব ছেলেদের মতোই অপলক দৃষ্টিতে না তাকিয়ে তার দিকেই আমি তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবো। জাস্ট রাজি হওয়ার কারণ!”

“প্রচুর মুভি দেখেন তাই না?”

“হ্যাঁ। দেখা তো হয়।”

স্বচ্ছ অন্বেষার ভালো লাগার কথাকে সোজাসুজি তুচ্ছ করে বলল,
“আপনি মুভির হিরোর সঙ্গে আমাকে রিলেট করতে চাইছেন। আমি কিন্তু তেমন মানুষ নই।”

অন্বেষা নিজের কথাতে অটল থেকে বলল,
“আই ডোন্ট কেয়ার। বাই দ্যা ওয়ে, কাল আপনি শপিং-এ আসছেন তো?”

স্বচ্ছ বিভ্রান্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
“কীসের শপিং?”

“আমাদের এঙ্গেজমেন্টের শপিং। আর কিছু বিয়ের শপিংও করার কথা ভেবেছি। শুনলাম আপনার বোন একজন দুর্দান্ত ডিজাইনার।”

“হ্যাঁ কিন্তু মনে হয় না ও আমার বিয়ের জন্য কিছু ডিজাইন করবে বলে!”

“স্ট্রেইঞ্জ! যাই হোক কালকে শপিং-এ আপনাকে আসতে হবে। আপনার পছন্দ অনুযায়ী আমি ড্রেস সিলেক্ট করব।”

স্বচ্ছের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কিছু বলতে পারল না৷ তার বিশিষ্ট বাবার মতে এখন তাকে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। খুশি রাখতে হবে নাহিয়ান রায়হানের পরিবারকে। সে দ্রুত বলল,
“এখন রাখছি। রাত হয়েছে।”

বলেই কল কেটে দিলো সে। ভার মুখে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে। ফারাহর ঘরের সামনে দিয়ে যেতেই তার ঘরের দরজা আজও বন্ধ দেখল স্বচ্ছ। আজ দরজায় কড়া নাড়ল স্বচ্ছ৷ ভেতর থেকে বেশ কিছু সময় আওয়াজ এলো না। তারপর দরজার লক খোলার শব্দ হলো। দরজা খুলে গেল। মাথা বের করে দিয়ে বাহিরে উঁকি দিলো ফারাহ। মেয়েটার চুপসে যাওয়া মুখশ্রী এবং এলোমেলো করে বাঁধা চুল দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে স্বচ্ছের। চোখমুখ কেমন যেন হলুদ হলুদ লাগছে ফারাহর। সে শুকনো কণ্ঠে স্বচ্ছের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“কী চাই?”

ফারাহর কপালে হাত রাখে স্বচ্ছ। টেম্পারেচার একদম নরমাল। তবে আচরণ একদম অস্বাভাবিক। ফারাহকে ঠেলে তার পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল স্বচ্ছ। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল ফারাহ।
“এই তোমার ম্যানারস্ নেই? তুমি জানো না যখন তখন একটা মেয়ের ঘরে ঢুকতে নেই?”

ফারাহর কথার কোনো কর্ণপাত না করে সোজা ফারাহর বেডের উপর গিয়ে আয়েশ করে বসল স্বচ্ছ। অতঃপর বলল,
“ওহ তাহলে তুমি মেয়ে? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”

প্রথম থেকেই মেজাজ খারাপ ছিল ফারাহর। ভাইয়ের এমন কথায় ক্ষ্যাপা বিড়ালের ন্যায় ক্ষেপে উঠল সে। স্বচ্ছের সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ ক্ষ্যাপা চাহনি দিয়ে বলল,
“মানে কী? শোনো একদম পিঞ্চ করবে না। আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।”

ফারাহর শুকনো মুখের দিকে একবার তাকিয়ে একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে তার হাত ধরে নিজের পাশে শান্ত করে বসাল স্বচ্ছ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ফারাহ ভাইয়ের বিষণ্ণ এবং গম্ভীর চেহারার পানে। স্বচ্ছ ধীর গলায় বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি চলে যাব কিন্তু আমাকে একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হবে।”

“সেটা কী?”

“এনি প্রবলেম? কোনো জটিল সমস্যা হয়েছে? কিছুদিন ধরে তোমার আচরণ মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। ভাইকে আর চিন্তাই ফেলো না। আমাকে বলো কী হয়েছে।”

স্বচ্ছের হিম কণ্ঠ। সেই সঙ্গে উৎসুক চাহনি। উত্তর না জেনে আজ সে যাবে না সেটা বুঝে নিলো ফারাহ। ফারাহ পড়ল বিপাকে। শৌভিকের কথা কি আদেও তার জানানো উচিত কিনা সেটা নিয়ে দোটানায় ভুগতে থাকল মনে মনে। শৌভিককে যে স্বচ্ছ দুচোখে সহ্য করতে পারে না তা খুব ভালোভাবে জানা ফারাহর। অনেক ভাবনাচিন্তা করে সে মিনমিন করে বলল,
“না ভাইয়া। কিছু হয়নি আমার। কোনো সমস্যা নেই।”

তীক্ষ্ণ হলো স্বচ্ছের দৃষ্টি। যেন তীক্ষ্ণতা দিয়েই বের করবে সকল উত্তর। বোনের ব্যাপারে সে কোনো পরোয়া করতে রাজি নয়। সে তৎক্ষনাৎ বলে,
“আমার কাছে লুকিয়ে যেও না। কেউ তোমাকে আজেবাজে কথা বলেছে? রাস্তায় কোনো ছেলে তোমাকে ডিস্টার্ব করেছে? নাকি কেউ অশ্লীলতা করার চেষ্টা করেছে? আজকাল পরিবেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে ফারাহ। যেকোনো কিছু হতে পারে। সেটা তুমি ভাইকে বলতে পারো। বিলিভ মি! আমি সলভ করে দেব।”

কথাগুলো বলতে বলতে অস্থির হয়ে পড়ল স্বচ্ছ। ফারাহর এমন আচরণে ভাইয়ের এমন মরিয়া হওয়া দেখে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ রইল ফারাহ। তার ভাইটা ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট ছোটো থেকে সেটা সে জানে। সহজে কাউকে কৈফিয়ত দেয়না। অন্যান্য ভাইদের মতো বোনকে নিয়ে আহ্লাদও করেনা সে। যদিও না কথা হয় তখন বেশির ভাগ ঝগড়াঝাটি হয়ে থাকে। কিন্তু অন্যকেউ ফারাহকে বিরক্ত করলে সেই ব্যক্তির মাথা ফা;টিয়ে দেওয়ার রেকর্ড পর্যন্ত আছে স্বচ্ছের। ফারাহ স্বচ্ছের হাতে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে সামান্য হাসি নিয়ে বলল,
“তেমন কিছু হয়নি ভাইয়া। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে বলো তো যে আহিয়ান স্বচ্ছের বোনকে বিরক্ত করবে? তাছাড়া তোমার বোনও ভীষণ স্ট্রং। কেউ কিছু করলে এভাবে ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে থাকবে না। আসলে আমার কিছুদিন ধরে মুড সুইং হচ্ছে। আর কাজেরও চাপ রয়েছে। তাই ঘরেই আছি। সেকারণে তুমি কত কী ভেবে নিলে বলো তো? রিল্যাক্স মাই ব্রাদার।”

“আর ইউ সিওর? তোমার সত্যি কোনো জটিল সমস্যা হয়নি তো?”

তখনও সন্দেহ দূর হয়নি স্বচ্ছের। ফারাহ তখন হাসি দিয়ে স্বচ্ছের পিঠের দিকে গিয়ে তার কাঁধ ধরে ঝুলে পড়ে বলল,
“হান্ড্রেস পার্সেন্ট! তাছাড়া তোমার তো বিয়ে সামনে। এমন টেনশনে থাকলে শুকিয়ে যাবে। তোমার সেই সুন্দরী, স্মার্ট বউ তখন তোমাকে পছন্দ না করলে তো বিপদ হয়ে যাবে। যদিও তোমার ওই মর্ডান ফিয়ন্সের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”

স্বচ্ছ এবার হেসে ওঠে। ফারাহ ফুঁসে উঠে বলল,
“আর একটা কথা। ওর বা তোমার জন্য যদি আমি কিছু স্পেশাল ডিজাইন করব ভেবে থাকো তাহলে ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলে দাও। ফারাহ সারোয়ার তার জন্যই ডিজাইন করে যাকে তার ভালো লাগে।”

স্বচ্ছ এবার চাপা হাসি দিয়ে মজা করে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাছাড়া তোমার ওই হিজিবিজি ডিজাইনের প্রতি আমারও ইন্টারেস্ট নেই।”

স্বচ্ছের কাঁধ ঝেড়ে দিয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল ফারাহ। নিজের বেড থেকে বালিশ তুলে তা ভাইয়ের দিকে ছুঁড়ে মা/রার আগেই উঠে দাঁড়াল স্বচ্ছ। ফারাহকে ধরে ফেলল। রাগে গজগজ করতে করতে তাকাল ফারাহ। কিছু সময় অব্যাহত থাকল ভাই-বোনের খুনসুটি।

পরদিন সকাল এগারোটার দিকে শপিং এ এসেছে শৌভিক। পাশেই রয়েছে মোহ। ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত শৌভিক। তা দেখে মোহ বিরক্ত হচ্ছে। কেনাকাটা মূলত তারা ফারাহ এবং শৌভিকের বিয়ের উদ্দেশ্যেই করতে এসেছে। ফোনের কল কেটে ফোন পকেটে রাখতেই শাড়ি দেখা ছেড়ে মোহ ক্রোধ নিয়ে বলল,
“শাড়ি কি পছন্দ করবে তুমি? নাকি সারাদিন ফোন কল নিয়ে পড়ে থাকবে?”

শৌভিক তেজোহীন সুরে বলল,
“আরে বাবা, অনেক কষ্ট করে সময় বের করে তোর সঙ্গে এলাম। আজকে এই সময় একটা মিটিং ছিল। বাবার সঙ্গে আমার থাকার কথা ছিল। একটু তো ম্যানেজ করতে হবেই বল। রাগ করছিস কেন?”

মুখ বাঁকিয়ে আবার শাড়ির দিকে তাকায় মোহ। উল্টেপাল্টে বেনারসি দেখতে থাকে। অতঃপর দোকানদারকে ইশারা করে দেখিয়ে বলে,
“ভাই, আপনি গোলাপি আর নীল রঙের বেনারসি দেখান তো।”

দোকানদার নিখুঁত কাজের দুটো রঙের বেনারসি বের করতেই নীল রঙের বেনারসিতে চোখ যায় শৌভিকের। সেটা হাতে নিতেই মোহ মিষ্টি হেসে বলে,
“ভাবিকে নীলপরি বানাতে চাও?”

শৌভিক বেনারসি ঘেঁটে বলে,
“ওকে কেমন লাগবে তাই বল!”

“সেটা তুমি ভেবে নাও। কল্পনা করে নাও তাকে কেমন দেখাতে পারে। তোমার বউ হচ্ছে সো চয়েসও তোমায় করতে হবে।”

তাদের দুজনের কথোপকথন চলতে থাকল বেনারসি নিয়ে। অন্যদিকে বেনারসি এবং শাড়ির সেকশনের বিপরীত দিকেই রয়েছে লেহেঙ্গা সেকশন। সেখানে এসেছে অন্বেষা। সঙ্গে এসেছে অন্বেষার ভাবি। আবার না চাইতেও আসতে হয়েছে স্বচ্ছকে। নিজের সঙ্গে করে সৌমিত্রকেও টেনে এসেছে স্বচ্ছ। দুজনেই এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। অন্বেষা এঙ্গেজমেন্টের জন্য লেহেঙ্গা দেখছে। স্বচ্ছকে দেখাচ্ছে। তবে স্বচ্ছের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখছে না সে। স্বচ্ছ একাধারে ফোন ঘেঁটে যাচ্ছে মাথা নিচু করে। সৌমিত্র আশপাশটাতে চোখ বুলাতেই তার নজরে ধরা পড়ে শৌভিক এবং মোহ। তৎক্ষনাৎ সে স্বচ্ছের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,
“ভাই, ভাই! এটা কী দেখছি? শৌভিক ভাই আর মিস মোহ এখানে তাও আবার বেনারসি দেখছে।”

মস্তিষ্কে ছ্যাৎ করে যেন আগুন ধরে গেল। ফোন জোরে চেপে ধরে বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল স্বচ্ছ। না চাইতেও রাগে ঘোলাটে হয়ে এলো তার দৃষ্টি। নিজেকে বুঝ দিতে চেয়েও অবুঝ হয়ে বেপরোয়া হলো মন। মাথায় সূক্ষ্ম প্রশ্ন হানা দিলো, ‘তারা দুজন মিলে কেন বেনারসি দেখছে? তাদের উদ্দেশ্য কী?’

প্রশ্নের পরেই স্বচ্ছের স্মরণ হলো মোহের কিছু কথা। যেদিন মোহ তাকে কল দিয়েছিল এবং তাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। মোহ বলেছিল, সে খুব শীঘ্রই বিয়ে করবে। এসব মনে হতেই শ্বাস যেন আঁটকে গেল তার। অস্থিরতা বাড়ছে আস্তে আস্তে। বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলছে আর নিজের দৃষ্টি দ্বারাই যেন গ্রাস করতে চাইছে তাদের দুজনকে। স্বচ্ছের তীব্র বাসনা জেগেছে যে সে ওদের কাছে যাবে এবং মোহকে হেঁচকা টানে নিয়ে এসে তাকে শাসাবে। কিন্তু সেটা করতে না পেরে চোখমুখ লাল হয়ে উঠল তার। এরই মাঝে সৌমিত্র বলল,
“আরে ভাই দেখো! এই শৌভিক ভাই তো মিস মোহের জন্যও বেনারসি পছন্দ করছে।”

মোহের কাঁধে লাল বেনারসি তুলে দিলো শৌভিক। মোহ গোলগোল চোখে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ে তোমার আর তোমার বউয়ের। বেনারসি চয়েস করছ আমার জন্য?”

“বউয়ের জন্য তো নীল বেনারসি ফাইনাল। তোরও তো এক কালে বিয়ে হবে নাকি? সেজন্য এডভান্স দেখে রাখছি। লাল রঙ তোকে বেশ মানাচ্ছে।”

মোহ মুখ কালো করে নিজের কাঁধ থেকে বেনারসি রেখে বলল,
“আমার বিয়ের শখ ঘুচে গেছে।”

“স্বচ্ছের জন্য?”

মোহ আগুনের ন্যায় জ্বলে উঠে বলল,
“ওই নাম আমি শুনতেও চাইনা। আমার বয়েই গেছে উনার জন্য নিজে আজীবন কুমারী থাকতে। নিজে তো বিয়ে করছেন হুরপরী। আমিও একটা সুদর্শন পুরুষ দেখে বিয়ে করেই নেব। লোকটার কথা তুমি তুলবে।”

মোহের আচানক জ্বলে ওঠা দেখে আর কিছু বলল না শৌভিক। নিজের হাসি চেপে একটা কলাপাতা রঙের শাড়ি মোহের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা আয়নায় ট্রাই করে আয় তো। আমার বিয়ের সময় এটা পরে আমার সামনে হাজির হবি। আমার বিয়ে দিতে হবে তো।”

মোহ দেখল শাড়িটা বেশ সুন্দরই। খয়েরি রঙের পাড় শাড়ির। তারও বেশ ভালো লেগেছে। সে সামনের বড়ো আয়নার দিকে শাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল নিজেকে দেখতে।

অপরদিকে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল স্বচ্ছের। স্থির থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল তার কাছে। হেস্তনেস্ত করার তীব্র ইচ্ছা জাগছে মনে। দাঁতে দাঁত চেপে মোহের দিকেই এগিয়ে গেল সে।

নিজের কাঁধে শাড়ি জড়িয়ে দেখছিল মোহ। হঠাৎ সে দেখতে পেল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক প্রশস্ত পুরুষ। তার চেহারা আয়নায় ফুটে উঠল যখন চমকে উঠল মোহ। স্বচ্ছ কিছুক্ষণ শক্ত নজরে মোহকে পরখ করে থেমে থেমে বলল,
“মানাচ্ছে না একদম। লাল অথবা হলুদ রঙই মোহকে ফুটিয়ে তুলতে পারে।”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২১ [দ্বিতীয় খণ্ড]

স্বচ্ছকে দেখে পা দুটো অসাড় হয়ে গেল মোহের। তার নিজস্ব ভুবন জুড়ে নেমে এলো শীতল হাওয়া। তার ক্ষমতা হলো না পিছু ফিরে স্বচ্ছের চোখে চোখ রাখার। সেই ধূসর চোখে সে আবারও হারাতে চায় না। মোহের স্মৃতিতে ভেসে উঠল অন্বেষা এবং স্বচ্ছের বাগদানের তরতাজা খবর। তখনি তার ব্যক্তিগত ভুবনে ছেয়ে গেল উত্তাপে। মেজাজ হারাতে লাগল সে। চোয়াল শক্ত করে স্বচ্ছকে জবাব দিলো,
“আমার এই শাড়িটাই পছন্দ হয়েছে। আমি এই শাড়িই নেব। বাই দ্যা ওয়ে, ইটস মাই পারসোনাল ইস্যু। আপনার হঠাৎ এখানে ইন্টারফেয়ার করাটা মানাচ্ছে না মি. স্বচ্ছ৷”

“বিয়ে করার প্ল্যানিং করছ তুমি?”

স্বচ্ছের নির্বিকার এবং কড়া কণ্ঠ। তবে মোহ এসব নিয়ে আতঙ্কে পড়েনা। দ্বিগুণ মেজাজ হারিয়ে বলে,
“করতেই পারি। কেন বিয়ে করার অধিকার কি একমাত্র আপনি নিয়ে রেখেছেন নাকি?”

ক্রুদ্ধ মনে স্বচ্ছ ক্রুর হেসে বলল,
“না, না তা হবে কেন? বিয়ে তুমি করতেই পারো। ইভেন একটা কেন? দুইটা, চারটা, দশটা যত ইচ্ছে বিয়ে করতে পারো। কিন্তু কী জানো? স্বচ্ছের কিছু যায় আসে না।”

মোহ কী প্রতিক্রিয়া দেবে সেটা বোঝার ক্ষমতায় হারিয়ে ফেলল। নিজেকে সামলে বলল,
“আশ্চর্য! আপনাকে কি আমি বলেছি যে আমার বিয়েতে আপনার কিছু যায় আসে? আমি জানি আপনার যায় আসে না। সেকারণে নিজেও বিয়ে করছেন। তবে কেন আপনি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে ঢুকে পড়ছেন? আমাকে কোন রং মানাবে সেটা একমাত্র তো আমিই ঠিক করব।”

মোহের কথাতে স্বচ্ছ এবার দমে গেল যেন। তবুও তেজ কমলো না সামান্যও। বলল,
“আমি বলছি কারণ আমি চাইনা তোমার বিয়েতে তোমাকে একটা ভূতের মতো লাগুক। এই শাড়িটা যে চয়েস করে দিয়েছে তার চয়েস ভীষণ জঘন্য। এটা পরলে নির্ঘাত বিয়ের আগে তোমার সো কলড হাজবেন্ড তোমাকে দেখে কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক করবে।”

মোহ তীব্র ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল,
“আপনার চয়েস থেকে একশ গুন বেটার আছে। শুধু আপনার চয়েস থেকে যেন আপনার থেকেই লোকটা বেটার আছে। আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না কেন বেকার আপনার সঙ্গে সময় নষ্ট করছি? যান না, যান! নিজের কাজ করুন গিয়ে। আমাকেও আমার কাজ করতে দিন।”

মোহের মুখে নিজের এবং শৌভিকের তুলনা শুনে মাথায় যেন র;ক্ত উঠে গেল স্বচ্ছের। সে উচ্চস্বরে বলল,
“জায়গাটা তোমার রেজিস্ট্রি করা নাকি? আমি তো এখান থেকে যাব না। কোনোমতেই না। তোমার যা ইচ্ছে করো।”

মোহ এবার সূক্ষ্ম খোঁচা দিয়ে বলে,
“মন্ত্রী মশাইয়ের ছেলের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি যেহেতু এখান থেকে যাচ্ছেন না সেহেতু আমিই চলে যাচ্ছি।”

স্বচ্ছের জবাবের অপেক্ষা না করেই তার দিকে এক ঝলক দেখে চোখ নামিয়ে শৌভিকের দিকে হাঁটা ধরল স্বচ্ছ। স্বচ্ছ তখন ক্রোধে কাঁপছে। সৌমিত্র ছুটে এলো তার নিকটে। হতাশা নিয়ে বলল,
“ভাইয়া তুমি এখানেও ঝগড়া করবে?”

সৌমিত্রের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে চাইল স্বচ্ছ৷ কঠিন স্বরে,
“তুই আমার ঝগড়া দেখছিস? ওই মেয়েটা যে ঝগড়া করে গেল সেটা দেখছিস না?”

“আরে বাবা, তুমি তো এগিয়ে এলে তার দিকে। তুমি কথা বলতে শুরু করলে সে তো আর মুখে পাতা দিয়ে থাকবে না।”

“আমি তো আসতে চাইনি। ও আমাকে বাধ্য করছে ওর দিকে আসতে। আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে অশান্তি দিয়ে যাচ্ছে শুধু। আমাকে তড়পে না নিলে তো তার চলে না।”

সবটা শুনে চুপ রইল সৌমিত্র। অনেকক্ষণ কিছু একটা ভেবে একটু কাশি দিয়ে বলল,
” ভাইয়া তুমি কি কোনোভাবে এখনো তার উপর আকর্ষিত? আই মিন, তোমার বিয়ে ওই মিস মর্ডান গগার্লের সাথে হচ্ছে। তুমি যদি এখন তার প্রতি এডিকক্টেড হয়ে থাকো তাহলে বিয়ের পরেও যদি ফিলিংস না যায় তাহলে তো পরকীয়া শুরু হয়ে যাবে তাই না ভাইয়া?”

মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরে রইল সৌমিত্র। স্বচ্ছ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে আক্রমণাত্মক ভাব। যেকোনো মুহূর্তে হা/মলা হতে পারে। সৌমিত্র এবার ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে ধীর কণ্ঠে বলল,
“না, না। তুমি তো ভালো আর চরিত্রবান পুরুষ ভাইয়া। তুমি এসব পরকীয়ায় জড়াবে না আমার সেই কনফিডেন্স আছে।”

স্বচ্ছ প্রত্যুত্তর না করে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। সৌমিত্র বুঝল, পরিস্থিতি জটিল। পরক্ষণেই চোখ ঘুরিয়ে নিতেই শৌভিক এবং মোহের দিকে ফের নজর যায় তার। মোহ নীল রঙের বেনারসির সঙ্গে আরো কয়েকটা শাড়ি ব্যাগে নিয়ে শৌভিকের হাতে ধরিয়ে দিল। সৌমিত্র ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“সম্ভবত মিস মোহও এবার গিভ আপ করে বিয়ে করতে যাচ্ছে! এই ভাইয়া, দেখো কী সুন্দর নীল বেনারসি কিনলো ওরা। আমি এটা ভাবছি এমন তেজস্বী নারীর স্বামীটা কে হতে যাচ্ছে। লোকটা কী শৌভিক ভাই? তাহলে খুব একটা খারাপ লাগবে না। মানে দুজন ম্যাচ করবে ভালো। কী বলো, ভাইয়া?”

নিজের কথা শেষ করেই স্বচ্ছের দিকে তাকাল সৌমিত্র। অতঃপর স্বচ্ছের মুখখানা দর্শন করে তার জমিন যেন নড়বড়ে হয়ে গেল। স্বচ্ছের চোখেমুখে যেন কালরাত নেমে এসেছে। যার চোখে তাকালেই সৌমিত্রের চোখে যন্ত্রণা হচ্ছে। সৌমিত্র শুকনো ঢক গিলতেই স্বচ্ছ থেমে থেমে বলল,
“মোহের বিয়েশাদি বিষয়ক কোনো শব্দ যদি তুই আর বলেছিস তাহলে তোকে পরবর্তী একমাসের জন্য হসপিটালে ভর্তি হতে হবে অ্যান্ড ইটস মাই থ্রেট।”

স্বচ্ছ হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল নিজের কথা শেষ করে। অন্বেষার কথা মাথায় রইল না তার। মাথার ভেতর যে অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে সেটাই তো নিভছে না। স্বচ্ছ বেরিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করল মোহ এবং শৌভিক গোল্ডের সেকশনে প্রবেশ করছে। এখন নিশ্চয় গয়না কিনবে! এসব ভাবতেই বিদ্বিষ্ট হচ্ছে হৃদয় ক্ষণে ক্ষণে। এস্কেলেটর দিয়ে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে এলো তার। চারিদিকে শুধু মোহ এবং শৌভিককে দেখতে পেল। কোনোরকমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতেই দুহাতে নিজের চোখমুখ চেপে ধরল সে। ফলস্বরূপ একটি লোকের সাথে ধা/ক্কা খেয়ে গেল স্বচ্ছ। ধা/ক্কা খেয়ে সামান্য ভারসাম্য হারানো লোকটি রাগান্বিত কণ্ঠে স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পা/গল নাকি? চোখ থাকতেও অন্ধ নাকি আপনি? পাবলিক প্লেসে নেশাখোরের মতো চলাফেরা করছেন কেন?”

মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় শুধু শৌভিক নামটা ভাসছিল স্বচ্ছের। যার কারণে অপরিচিত লোকটির দিকে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে শৌভিক মনে হলো তার। তৎক্ষনাৎ সরাসরি বাঘের মতো খামচে ধরল লোকটির শার্টের কলার। চোয়াল শক্ত করে শাসিয়ে বলল,
“কী বললেন আপনি আমাকে? আমি নেশাখোর? হ্যাঁ, আমি নেশাখোর। আমি অন্ধ। যা কী করবি, কর।”

অবস্থা তখন বেগতিক। আশেপাশের সব মানুষজন জমা হতে লাগল। সৌমিত্র দূর থেকে এসব দেখে একপ্রকার দৌড়ে এলো। স্বচ্ছের কাছ থেকে জোর করে লোকটির কলার ছাড়িয়ে নিলো। অতঃপর অনুরোধের স্বরে লোকটিকে বলে উঠল,
“সরি ভাই। আসলে আমার ভাইয়ের মেজাজ ঠিক নেই। রাগটা হয়ত আপনার উপর ঝেড়ে ফেলেছে। কিছু মনে করবেন না। মাফ করে দেন।”

লোকটি স্বচ্ছকে একনজরে দেখে ঝাঁজ নিয়ে বলল,
“এমন পাগল ভাইকে রাস্তায় না ছেড়ে ঘরে বন্দি করে রাখুন। যত্তসব!”

আবারও তেতে উঠে তাকাল স্বচ্ছ। তার ক্রোধে পূর্ণ চোখ দেখে থেমে গিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল লোকটি। স্বচ্ছ তেড়ে যেতে চাইল লোকটির দিকে। তবে সৌমিত্র তাকে ধরে বাহিরে নিয়ে যেতে চাইল।
“ভাইয়া ঝামেলা করো না প্লিজ। চলো, বাহিরে চলো।”

বাহিরে প্রায় পার্কিং এরিয়ায় প্রায় আধঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ তার গাড়ির সামনে। পরিপাটি তার সম্পূর্ণ পোশাক ও চেহারা এখন এলোমেলো। চুলগুলো একপাশ থেকে অন্যপাশ হয়ে অপরিপাটি হয়েছে। শার্টের তিনটে বোতাম খুলে রেখে শার্টের হাতা মুড়িয়ে রেখেছে স্বচ্ছ। তার সঙ্গে রয়েছে সৌমিত্রও। স্বচ্ছের ফোনটা পঞ্চম বারের জন্য বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে অন্বেষার নম্বরটা দেখে আবারও বিরস মুখে কল কেটে দিলো সে। সৌমিত্র তা দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলে,
“মিস. ছাম্মাকচাল্লো তো জানে না যে আমরা বাহিরে। হয়ত আমাদের খুঁজছে। ওকে বিষয়টা জানিয়ে দেওয়া উচিত না?”

স্বচ্ছ আগের মতোই বিরস মুখে জবাব দিলো,
“তোর দরদ হলে তুই জানিয়ে দে। আমাকে এখন ঘাঁটাস না।”

কথার মাঝে ষষ্ঠ বারের মতো কল বেজে ওঠে। বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছায় স্বচ্ছের মেজাজ। তবে ফোনে এবার মায়ের নম্বর দেখে প্রতিক্রিয়া অন্য রূপ ধারণ করে তার। কল রিসিভ করে সে হ্যালো বলতেই মিসেস জেবা বিচলিত কণ্ঠে ছেলেকে বলেন,
“তুমি এখনি হসপিটালে চলে এসো স্বচ্ছ।”

ভড়কে যায় স্বচ্ছের মন। কার কী হলো ভাবতে ভাবতে উত্তেজনাপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে মা? কার কী হয়েছে?”

“আরিদ্রের অবস্থা ভালো নয়। কারা যেন ওকে গত রা;তে অনেক মা/রধর করেছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। দেরি করো না।”

মিসেস জেবা কল কাটলেন। স্বচ্ছের চিন্তা নিমিষে গায়েব হয়ে গেল কোথাও। তার ঠোঁটে সূক্ষ্ম আমোদের রহস্য ভেদ করা সম্ভব হবে না সহজে। সৌমিত্রও খানিকটা উৎকণ্ঠিত হয়ে ভাইকে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে ভাইয়া? বাড়িতে কারোর সমস্যা হয়েছে?”

“না। আরিদ্রকে নাকি কারা মা/রধর করেছে। এখন সে হসপিটালে ভর্তি। মা যেতে বলল।”

সৌমিত্র তাড়াহুড়ো করে বলে উঠল,
“তাহলে দেরি করছি কেন? তাড়াতাড়ি চলো।”

বিলম্ব না করে গাড়িতে উঠে বসল সৌমিত্র। তবে স্বচ্ছের মাঝে কোনো হেলদোল বা ব্যাকুলতা দেখা গেল না। সে সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবল। তারপর ধীর পায়ে গিয়ে গাড়িতে বসল।

আরিদ্রের পুরো হাত-পা এবং শরীর জুড়ে ব্যান্ডেজ করা। নড়তে গেলেও যেন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। শরীরের প্রতিটা অংশে এমনভাবে আ/ঘাত করা হয়েছে যেন প্রতিটা অংশই পচে গেছে। ডাক্তারের মতে, সাতদিনের বেশি লাগতে পারে আরিদ্রের এমন ক্ষ/ত বিক্ষ;ত শরীর নিয়ে উঠে বসতে। আর প্রায় একমাস লেগে যেতে পারে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে৷ সম্পূর্ণ মাথা জুড়ে ব্যান্ডেজ করা আরিদ্রকে চেনা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে! কোথায় সে সুদর্শন টগবগে যুবক ছিল! আর এক রাতের ব্যবধানে তার মুখশ্রী পাল্টে ফেলেছে অপ/হরণকারীরা। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে গিয়েও কষ্ট হচ্ছে তার। আরিদ্রের মা মিসেস জামিলা একাধারে কেঁদে চলেছেন ছেলের দশা দেখে। পাশে মিসেস জেবা উনাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। স্বচ্ছ এবং সৌমিত্র অবাক চোখে আরিদ্রের দশা পর্যবেক্ষণ করছে। মুখ বিষণ্ণ করে আরিদ্রের পাশে বসল স্বচ্ছ৷ বেশ দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
“কী করে হলো এমন তোর? এইতো দেখা করে এলাম তোর সঙ্গে বেশিদিনও হয়নি। হঠাৎ করে এই অবস্থা কে করল? কে মা/রল তোকে?”

আরিদ্র কথা বলার প্রয়াস করলেও টনটন করে ব্যথা করতে লাগল চোয়াল। মিসেস জামিলা কান্নারত অবস্থায় জানালেন,
“গতকাল কোন যেন এক রাস্তায় নাকি ওকে ফেলে দিয়ে গেছিল মে/রে। তখন নাকি ওর জ্ঞানও ছিল না। সারা শরীরের করুণ অবস্থা দেখে লোকজন তাড়াতাড়ি করে হসপিটালে আনে ওকে। সারারাত বাড়ি ফিরছিল না দেখে খুব টেনশন হচ্ছিল আমার। এরপরে জানতে পারলাম এই অবস্থা!”

স্বচ্ছ অনেক ভেবে বলল,
“তা কারা ওকে মে/রেছিল ও বলতে পেরেছে?”

“না। ওকে নাকি দেখতেই দেওয়া হয়নি। ছেলেটাকে চোখমুখ বেঁধে পি/টিয়েছে।”

বলে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন মিসেস জামিলা। সৌমিত্র খানিকটা বিচলিত হয়ে বলল,
“কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি?”

আরিদ্র এবার অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“না। গাড়ির নম্বর প্লেট সম্ভবত ভুয়া ছিল।”

স্বচ্ছ আরিদ্রের হাতে হাত রেখে দৃঢ় আশ্বাস দিয়ে বলল,
“চিন্তা করবি না। তুই ঠিক হয়ে নে৷ আমি দেখছি কী করা যায়। আমার ভাইটাকে যারা এভাবে মা/রল তাদের খোঁজ তো নিতেই হবে।”

স্বচ্ছের কথাতে বেশ ভরসা খুঁজে পায় আরিদ্র। সে নিজেও ভেবে পাচ্ছে না কে বা কারা করল তার সাথে এমন? কার সাহস এত উচ্চ পর্যায়ে উঠে গেল? আরিদ্রের তীব্র ইচ্ছে জাগল দ্বিতীয় খু/ন করার। যে তাকে আধম/রা করে ছাড়ল তাকে সে এমনি এমনি ছাড়বে? কখনোই না!

আজ বেশ কয়েকদিন গ্যাপ দিয়ে নিজের অফিসে এসে চাপে পড়ে গেছে ফারাহ। মেজাজ ইতিমধ্যে তুঙ্গে উঠে আছে তার। এসি চলা সত্ত্বেও ইচ্ছে করে ফাইল দিয়ে বাতাস করছে নিজের মুখে। তা দেখে তারই এসিস্ট্যান্ট গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ম্যাম, এসির পাওয়ারটা কি বাড়িয়ে দেব?”

দাঁত কিড়মিড় করে এসিস্ট্যান্টের দিকে তাকাল ফারাহ।
“আমাকে কি গারমি কি রানি মনে হয়?”

থতমত খেয়ে গেল মেয়েটি। মিনমিন করে বলল,
“আসলে ফাইলটা না দেখে আপনি বাতাস করছেন তাই ভাবলাম আপনার গরম লাগছে।”

ফারাহ দ্রুত ফাইল টেবিলে সজোরে আ;ঘাত করে বলল,
“তো? এমন বিদঘুটে অগোছালো ফাইল দেখার থেকে তো পুড়িয়ে দেওয়া ভালো। মাত্র দুই-তিন দিন আমি ছিলাম না। কাজকর্মের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছ সবাই। এখন আমাকে ফাইল চেক করতে বলছ?”

কথা আঁটকে গেল মেয়েটির৷ আর একটা শব্দ বলার সাহস হলো না। নিচু স্বরে আটকা আটকা গলায় বলল,
“স…সরি ম্যাম।”

মেয়েটির কথাকে কানে না তুলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজল ফারাহ। তৎক্ষনাৎ তারই ফোনের রিংটোনের আওয়াজ পেল সে। তার এই মুহূর্তে কারোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে এসিস্ট্যান্ট মেয়েটিকে ইশারা করে বলল,
“ফোনটা রিসিভ করো তো।”

“ম্যাম, ফোনটা তো আপনার। যদি কিছু পারসোনাল…”

ফারাহ এবার ঠাণ্ডা স্বরে বলে,
“এত প্রশ্ন করো কেন? না আমার প্রেমিক আছে আর না বর। সিঙ্গেল লাইফে এসব পারসোনাল কথাবার্তা থাকে না। তাই তাড়াতাড়ি কল কাটার আগে রিসিভ করো।”

মেয়েটি ফারাহর ফোন আতঙ্ক নিয়ে রিসিভ করে কানে ধরে বলে,
“হ্যালো, কে বলছেন?”

অপরিচিত মেয়েলি কণ্ঠস্বর চকিতে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে শৌভিক পরখ করল যে ফারাহর নম্বরটা ঠিক আছে কিনা! নম্বরটা ঠিকঠাক দেখে আবারও সে কানে ফোন ধরতেই ওপরপাশ থেকে আবারও অচেনা মেয়েলি কণ্ঠ জবাব দিলো,
“আমি ফারাহ ম্যামের এসিস্ট্যান্ট জেসিয়া।”

শৌভিক এবার বুঝতে পারল ব্যাপারটি৷ বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“হোয়ার ইজ মাই ওয়াইফ?”

বিষম খেল জেসিয়া। ফারাহ চোখ খুলে কপাল ভাঁজ করে তাকাল। জেসিয়া ঢক গিলে পুনরায় জিজ্ঞেসা করল,
“আপনি কে হোন ম্যামের?”

শৌভিক এবার খানিকটা হতাশ হয়ে বলে,
“এটা আবার বলতে হবে? স্বামী হই স্বামী! ভালোবাসার স্বামী। দ্রুত ফোনটা দেন। সে হয়ত কথা বলার মুডে নেই। তাকে বলুন, তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য স্বামী অপেক্ষা করে আছে।”

এবার কাশি উঠে গেল জেসিয়ার। সে জানামতে ফারাহ অবিবাহিত। তার বিয়ে কি এই দুইদিনেই হয়েছে? জেসিয়ার এমন হাল দেখে উঠে দাঁড়াল ফারাহ। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো? কে কল করেছে?”

জেসিয়া এবার শুকনো ঢক গিলে প্রত্যুত্তর করে,
“আপনার স্বামী, ম্যাম।”

দুটো চক্ষু যেন কপালে উঠে গেল ফারাহর৷ হতভম্ব হয়ে সে নিজেকেই সামলাতে না পেরে হিল জুতোর সঙ্গে টাইলসের মেঝেতে পিছলে গিয়ে পড়তে নিলো। টেবিল ধরে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে জেসিয়ার থেকে ফোন থেকে জেসিয়াকে চলে যেতে ইশারা করল ফারাহ। জেসিয়া চলে গেলে সে ফোনটা দেখতেই শৌভিকের নম্বর দেখে প্রথমেই উড়ুউড়ু করে উঠল মন। হৃদয়ে নেমে গেল এক প্রশান্তির বন্যা। তখনি আগের কথা মনে করে আগুব জ্বলে উঠল শীতল মনে। প্রশান্তির বন্যার মাঝে উদ্ভব ঘটল জলন্ত লাভার৷ ফোন কানে ধরেই উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
“এই ফাজিল, অসভ্য লোক! আমার মতো একটা কুমারী নারীকে বিবাহিত বানিয়ে দিতে লজ্জা করল না আপনার?”

“না গো পত্নী। বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই আমার মধ্যে। বউয়ের কাছে স্বামী এত লজ্জা পেলে চলে বলো?”

শৌভিকের আদুরে কণ্ঠে তেতে ওঠে ফারাহ।
“সমস্যা কী আপনার? আমাকে রিজেক্ট করে শান্তি হয়নি? এখন আবার কেন জ্বালাতে উঠেপড়ে লেগেছেন?”

শৌভিক শব্দ করে হেসে বলে,
“ইশশ…মেয়েটা এখনি আমার জ্বালাতন সহ্য করতে পারে না। সে নাকি আমায় বিয়ে করবে। কী শখের বাহার!”

ফারাহ শুধু রাগে ফুলছে। বিপরীতে কিছু বলার মতো মেজাজে সে আর নেই। শৌভিক তার নীরবতা দেখে জানায়,
“সো মিস এবার নিচে আসুন দেখি। কতদিন দেখিনি আপনার রাগে ফুলে থাকা মুখখানা। পরিদর্শন করে একটু জীবন ধন্য করি। আধঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। প্লিজ, আর অপেক্ষা করাবেন না। আমার ধৈর্য অনেক কম।”

ফারাহ কড়া সুরে উত্তর দেয়,
“পারব না নিচে যেতে। আমি কল কাটছি।”

“আমি বলেছিলাম আমার ধৈর্য কম। পরিক্ষা নিও না। পাঁচ মিনিটে তুমি না এলে আমাকে উপরে যেতে হবে। আর উপরে গেলে সবাইকে চেঁচিয়ে জানিয়ে আসব মিস ফারাহ আমার একমাত্র স্ত্রী।”

ফোনটা কেটেই দিলো ফারাহ আর জবাব না দিয়ে। শব্দ করে ফোন টেবিলের উপর রেখে পানির গ্লাস থেকে পানি পান করে নিলো প্রথমে। বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে কৌতূহল বশত তার রুমের জানালার কাছে গেল সে। উঁকি দিতেই দেখল পাঞ্জাবি পরনে পুরুষ একমনে দাঁড়িয়ে ফোনের দিকে চেয়ে। না চাইতেও সেই অসামান্য পুরুষটিকে দেখে মন গলে যেতে আরম্ভ করল ফারাহর। মিনিট দুই তিনেক ভেবে নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।

বিল্ডিংয়ের বাহিরের সিঁড়ি দিয়ে ফারাহকে নিচে নামতে দেখে মুখে বিজয়ের হাসি ফুটল শৌভিকের। মেয়েটা যে মুখে রাগি ভাব ফোটানোর চেষ্টা করছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। মেয়েটা শৌভিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল সরাসরি।
“কী চাই?”

শৌভিক উল্টো প্রশ্ন করে,
“চাইলে পাব? এখন চাইছি তুমি এই শৌভিকের গাড়িতে উঠে বসো।”

ফের ক্ষেপে উঠল ফারাহ।
“মোটেও না। আমি কেন আপনার গাড়িতে উঠে বসব?”

“এত ভয় পেয়ো না আমাকে। ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি। যাকে বিয়ে করার জন্য বিশ্বাস করতে পারো তার সঙ্গে কোথাও যাওয়ার জন্য বিশ্বাস করতে পারো না?”

মন নরম হলো ফারাহর। তবুও মুখ গোমড়া করেই গাড়িতে গিয়ে বসল সে বিনা কথায়। শৌভিক মৃদু হেসে নিজেও গাড়ির দিকে ধাবিত হলো।

অন্ধকারের ঢল নেমেছে ধরণিতে। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টে হলুদ আলোতে জ্বলজ্বল করছে রাস্তা। এই সন্ধ্যায় ফারাহর অজানা শৌভিক তাকে কোন গন্তব্যে নিয়ে যেতে চাইছে। উসখুস করতে করতে সে প্রশ্ন করল,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

শৌভিক ড্রাইভিং এর দিকে ফোকাস রেখে বলল,
“আর মিনিট দশেক সময় দাও। জানতে পারবে।”

ফারাহ আচমকা খেয়াল করল শৌভিক আজ তাকে তুমি করে সম্বোধন করছে। আঁড়চোখে চশমা পরা লোকটিকে দেখল ফারাহ। তারপর উৎসুক হয়ে শুধাল,
“আজ হঠাৎ আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আগে তো আপনি ছাড়া কথাই বলতেন না।”

“বউকে আপনি, আপনি করলে পর পর লাগবে। তাই তুমি বলার অভ্যেসটা করে নিচ্ছি।”

দুরুদুরু করছে ফারাহর মন। এতবার বউ, পত্নী সম্বোধন মেনে নিতে পারছে না। হৃৎস্পন্দনও বেড়ে বেড়ে যাচ্ছে। ভালো করে লোকটির মুখের দিকে তাকাল ফারাহ। বোঝার চেষ্টা করল শৌভিক আসলেই তার সঙ্গে মজা করছে নাকি সত্যি বলছে।

তার ভাবনার মাঝে একটি আগেকার দিনের রাজকীয় ধরনের বাড়ির সামনে পৌঁছায় সে। বাড়ির সদর দরজা সহ পুরোটাতেই আগেকার দিনে করা নকশা দেখতে পায় ফারাহ। তবে বাড়ির যে প্রতিনিয়ত যত্ন করা হয় তা বাড়ির রং দেখেই বোঝা যায়। গাড়ি থেকে নেমে ফারাহ প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
“এটা কার বাড়ি?”

মনোযোগ দিয়ে ফারাহর উৎসুক চাহনির দিকে তাকায় শৌভিক। এভাবে মেয়েটাকে কৌতূহলী রাখতে তার ভালো লাগছে। অতঃপর সে জবাবে বলে,
“বিয়ে করার আগে শ্বশুরের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে না? শ্বশুর ছাড়া বিয়ে কী করে হবে বলো?”

যেন বড়োসড়ো একটি বাতাসে ধা/ক্কা লেগে গেল ফারাহর। কাঁপুনি দিয়ে উঠল সর্ব শরীর। পলকহীন নয়নে চেয়ে রইল শৌভিকের দিকে। মুখে কিছু না বললেও তার চোখই যেন শৌভিককে প্রশ্ন করছে ‘আর ইউ সিরিয়াস?’

ফারাহর নরম হাতটি স্বইচ্ছায় প্রথমবারের মতো নিজের মুঠোয় নিলো শৌভিক। ফারাহকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল সে।

ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে মগ্ন ছিলেন মীর সাহেব। তখনও খেয়াল করেন নি বসার ঘরটাতে কারোর আগমন ঘটেছে। যখন উনার সামান্য নিকটে সামনাসামনি উনার ছেলে এবং ফারাহ এসে থামল তখন কথা বন্ধ হয় উনার। হতবাক চোখে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে ফোনটা আগে কেটে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন। শৌভিক ফারাহকে দেখিয়ে বলে,
“নাও, হবু বউমার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছিলে তাই তাকে আনলাম। তাকে নিয়ে আসতে কত কাণ্ড করতে হয়েছে জানো? তার জেদ দেখলেই বোঝা যায় সে হলো শ্বশুরের বউমা।”

মীর সাহেব ছেলের কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। তখন ফারাহ নিচু গলায় উনাকে সালাম দিতেই শৌভিক আবারও বলল,
“দেখেছ! শ্বশুরের সামনে নরম আর আমার সামনে গরম। কিছুক্ষণ আগেই আমার উপর চোটপাট করছিল তোমার হবু বউমা।”

মীর সাহেব এবার মৃদু ধমকালেন ছেলেকে।
“হয়েছে চুপ করো। মেয়েটাকে আর অস্বস্তিতে ফেলো না।”

ফারাহ দমে যাবার মেয়ে নয়। সে শৌভিকের দিকে ছোটো দৃষ্টিতে তাকিয়ে মীর সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“না, আঙ্কেল। এই লোকটার কথায় আমি মোটেও অস্বস্তিতে পড়ি না।”

মীর সাহেব শান্ত সুরে বলেন,
“তোমার কথাই কয়দিন ধরে আমার ছেলের মুখে শুনছিলাম। আমি তো এটা ভাবতেও পারিনি আমার ছেলে নিজে নিজে কাউকে এভাবে পছন্দ করে ফেলবে। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না তবে এই ছেলেটার মতো বিরস ছেলে আমি একটাও দেখিনি।”

ফারাহ বুঝতে পারল না এর উত্তরে সে কী বলবে৷ তাই নীরবই রইল সে। মীর সাহেব এবার বলেন,
“আমি কখনোই তোমাদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াব না। আর না কোনো আপত্তি করব। তোমরা যদি একে অপরের প্রতি এই একই অনুভূতি সারাজীবন পোষণ করতে পারো তবে এতে আমি তোমাদের বিয়েতে রাজি আছি। তোমরা যথেষ্ট বড়ো হয়েছ, সবই বোঝো। আমি চাই তোমরা নিজেদের নিয়ে ভালো থাকো এতটুকুই।”

এবার ফারাহ শৌভিকের দিকে তাকায়। সত্যিই শৌভিক বিয়ের পরিকল্পনা করছে ভেবে অনেকটা অবাকই হয়েছে। খুশি হওয়া উচিত কি তার? মনের মাঝে চাপা এক অনুভূতি জাপ্টে ধরেছে। মীর সাহেব এবার কিছুটা ভেবে বলেন,
“কিন্তু ফারাহর বাবা যদি বিয়েতে মত দিতেন ভালো হতো। বিয়ের পর উনি জানতে পারলে উল্টোটা ভাবতে পারেন। এতগুলো বছর ধরে আমি উনার প্রতিপক্ষ। বিয়েটা উনি কেমন চোখে নেবেন জানা নেই আমার।”

বাবার কথা শুনে এবার মুখ খোলে ফারাহ। ভার কণ্ঠে বলে,
“উনি এমন একজন মানুষ যিনি কখনো ছেলেমেয়ের অনুভূতির তোয়াক্কা করেন নি। হয়ত করবেনও না। এইযে যেমন আপনি কত সুন্দর করে আমাকে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করলেন না। আপনি আপনার ছেলের অনুভূতি কত সুন্দর বোঝেন। তার অনুভূতির মূল্য দেন। বাবার কাছে আমার অনুভূতির মূল্য শূন্য।”

ফারাহর কথায় এক গোপন দুঃখের সন্ধান পান মীর সাহেব। এত বছরের শত্রুতায় তিনি সরোয়ার সাহেবকে হাড়ে হাড়ে চেনেন। শৌভিক তৎক্ষনাৎ প্রসঙ্গ এড়াতে বলল,
“বাবা, তোমরা দুজন কি এসব কথাই বলে সময় পার করবে? এমনি মিস জলন্ত আগুনকে আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এনেছি। আসল কাজ কি সারতে পারব না?”

মীর সাহেব এবার আরাম করে সোফায় বসে বললেন,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ সেরে ফেলো। এটার অপেক্ষাই তো করছি। আজকে সব মিটিং, কাউন্সিল ক্যানসেল করেছি হবু পুত্রবধূর আংটি পরানো দেখব বলে।”

হতবিহ্বল হয় ফারাহ। জবান যেন বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে লাগল। শৌভিক শান্ত গলায় ফারাহকে সুন্দর করে সম্বোধন করল,
“ফারাহ!”

এত সুন্দর ডাক প্রত্যাখান করতে পারল না ফারাহ। সেই পুরুষটির চশমায় আবৃত দুটি ছোটো নয়নের দিকে দৃষ্টি রাখল। অপলক দৃষ্টি। শৌভিক ফারাহর দুটো হাত উঁচিয়ে ধরে শুধায়,
“এই শত্রুর ছেলেকে বিবাহ করে শত্রুতার সম্পর্কে মিষ্টতা তৈরি করতে রাজি?”

নিশ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে এলো ফারাহর। লজ্জায় বেষ্টিত হলো তার ছোটো মুখটা। শৌভিক তার একটি হাত ছেড়ে নিজের পকেট থেকে একটা আংটি বের করে সামনে তুলে ধরে ধীর গলায় বলল,
“আই এম স্টিল ওয়েটিং টু হেয়ার দ্যা অ্যান্সার ফ্রম ইউর সুইট ভয়েস।”

মিশ্র অনুভূতির ছাপ দেখা গেল ফারাহর চেহারায়। তাদের সামনের রয়েছে মীর সাহেব যিনি কিনা মনোযোগ দিয়ে তাদের দেখছেন। ফারাহর লজ্জা করছে উত্তর দিতে। মাঝে মীর সাহেব ফোনের ক্যামেরা বের করে ফোকাসে ফারাহ ও শৌভিককে রেখে অধীর আগ্রহে বসে রয়েছেন ছবি তোলার জন্য। অধৈর্য হয়ে তিনি বলেন,
“আহা! মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে আর তুমি উত্তর জানতে চাইছ। জানো না নাকি মৌনতা সম্মতির লক্ষণ?”

শৌভিক বাবার প্রতি বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
“তুমি চুপ করো। একে তো আমি রোমান্টিক মানুষ না তার উপর একটু রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করছি তার মাঝে পানি ঢেলে দিও না।”

“আচ্ছা চুপ করছি।”

মীর সাহেব থেমে গেলেন। শৌভিক ফের নিজের শীতল দৃষ্টি রাখে ফারাহর দিকে। ফারাহর হাতখানা একটু শক্ত করে ধরে বলে,
“চারিদিকে এত বিচ্ছেদ, বিরহ, প্রবঞ্চনার মাঝে তুমি আর আমি পরিণয়, ভালোবাসা এবং প্রণয়ের উদাহরণ হবো। তুমি কি রাজি, ফারাহ?”

কাঁপতে কাঁপতে হালকা মাথা দুলিয়ে সায় দিলো ফারাহ। সঙ্গে সঙ্গে দেরি না করে পরানো হলো তার অনামিকা আঙ্গুলে সুন্দর আংটি। মীর সাহেব হাসিমুখে নিজের মোবাইলে স্মৃতি ধারণ করে যাচ্ছেন। অতঃপর হাত তালি দিয়ে উঠলেন। ফারাহ তড়িঘড়ি করে শৌভিকের হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল। মীর সাহেব পরক্ষণে বললেন,
“ইচ্ছা ছিল অনেক বড়ো করে বাগদান অনুষ্ঠান করার। তা যখন হচ্ছেই না তখন বিয়ের পর আমি অনুষ্ঠান করবই। কারোর কথা শুনব না বলে দিলাম।”

বাবার কথায় সায় না দিয়ে পারল না শৌভিক। মীর সাহেব মেতে উঠলেন ছেলের বিয়ের আনন্দে।

চারটা দিন পেরিয়ে গিয়েছে। এই রাতটা পেরিয়ে কালকেই শুরু হবে স্বচ্ছের বাগদানের অনুষ্ঠান। অথচ স্বচ্ছ বাড়িতেই উপস্থিত নেই৷ রাত কাটাচ্ছে বাইরে গাড়িতে মোহের বাড়ির গলির সামনে।গাড়ির জানালার বাইরে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে স্বচ্ছ। এই কয়দিন রাতে ঘুম হয়নি, মনে শান্তি পায়নি। যেন বুকে কেউ পাথর তুলে রেখেছে। এখন রাত বেজেছে প্রায় একটা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মেতে আছে পৃথিবী। আবহাওয়া অফিসের মতে কালকেও বৃষ্টি হতে পারে। মোহ কি ঘুমিয়ে পড়েছে? চারদিন আগে শপিংমলে দেখা সেই দৃশ্যগুলো স্বচ্ছের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে। মনে এবং মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। মোহ কি সত্যি বিয়ে করছে? মাথা বিগড়ে যায় স্বচ্ছের। কোনো কিছু না ভেবে গাড়ির দরজা খুলে ধুম করে নেমে পড়ল স্বচ্ছ। সঙ্গে সঙ্গে বর্ষণের ছোঁয়া লাগল তার শরীরে। ভিজতে লাগল শরীর। সেসবের তোয়াক্কা না করে গলির ভেতরে ঢুকে মোহের বাড়ির সামনে দাঁড়ায় স্বচ্ছ। মেইন দরজা লক করা। চিকন রাস্তায় এই গভীর রাতের বৃষ্টিতে দেখা মিলছে না কোনো মানবের। স্বচ্ছ তিন থেকে চারবারের চেষ্টায় মোহের বাড়ির পাঁচিল টপকে ফেলল। লাফ দেওয়ায় শব্দ হলো উদ্ভট। আশেপাশে দেখার প্রয়োজনবোধ করল না সে। দ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ির পেছনের দিকে এলো। সে জানে মোহের ঘর পেছনের ঘরটাই। একবার এসেছিল সে যখন ইথানের এক্সি/ডেন্ট হয়েছিল। মোহের ঘরের জানালা খোলা দেখতে পেয়ে ধৈর্যহারা হয়ে বিভ্রান্তের মতো ছুটল জানালার সামনে। স্থির হয়ে জানালা বরাবর থামতেই থমকে গেল তার দুটো নয়ন। জানালার একদম কাছে মোহ টেবিল ও চেয়ার পেতে বসেছে। তবে চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মোহ। ক্লান্ত মেয়েটার চেহারা। ঘরে জ্বলছে হালকা আলোর লাইট। মেয়েটার কাছে একটি কাগজ এবং হাতের কাছে একটি কলম অযত্নে পড়ে রয়েছে। বৃষ্টির হালকা ঝাপটা এসে টেবিল এবং কাগজের কিছু অংশ ভিজিয়ে দিয়েছে। কী অপূর্ব দৃশ্য! কী প্রশান্তির মুহূর্ত! এ যেন এক মধু বিহীন মৌচাকে এক ফোঁটা সুমিষ্ট মধু। স্বচ্ছের ধাঁধিয়ে যাওয়া দৃষ্টি হঠাৎ খেয়াল করল কাগজের উপর দুটো লাইন লেখা। প্রথমে পড়তে সফল না হলেও একটু চেষ্টা করতেই পড়তে পারল মোহের ছোটো অগোছালো লেখা গুলো। দুটো লাইনে যেন আবেগ দিয়ে লেখা,
“সে হয়েছিল আমার বর্ষণ, আমি হয়েছিলাম তার প্রেম।
এই সেই বর্ষণ যেই বর্ষণে লেগেছিল প্রেমের ছোঁয়া!”

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২ [দ্বিতীয় খণ্ড]

মোহের ছোটো লেখা একটি ছন্দ স্বচ্ছের বুকের ভার কমবে নাকি বাড়বে সেটা নিয়ে বিভ্রান্তিতে বলল। মন বারবার জানতে চাইল, মোহ কি সেই প্রেমের বর্ষণের কথা লিখেছে? স্বচ্ছের ক্লান্ত, ভবঘুরে, নির্ঘুম দুটি লোচন মোহের দিকে অপলক চেয়ে রইল। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটাও ছিল নির্ঘুম এবং অশান্তিতে। নয়ত এমন জায়গা যেখানে বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে তার ঘন চুল সহ গালের সামান্য অংশ সেখানে সে ঘুমে এত নিমগ্ন কী করে? যেখানে স্বচ্ছ এত সুন্দর দৃশ্যের সাক্ষী হচ্ছিল সেখানে একরাশ বিরক্ত স্বরূপ ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। চোরের মতোই চমকে উঠল স্বচ্ছ। বুঝে উঠতেই চলে গেল জানালার আড়ালে। ঘুমন্ত মোহ নড়েচড়ে উঠল। এবার অনুভব করতে পারল তার গাল ভিজে। কানে ভাসছে অসহ্যকর রিংটোন। চোখ ডলে সোজা হয়ে বসল মোহ। আশেপাশে তাকাতেই ড্রেসিংটেবিলের কাছে ফোন পেয়ে হাতিয়ে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখেই রিসিভ করল ফোনটা। অপরপাশ থেকে শৌভিকের তরতাজা কণ্ঠ শোনা গেল।
“কী রে! জেগে আছিস?”

শৌভিকের কণ্ঠে ঘুম কাটলো মোহের কিছুটা। ভার কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ বলো।”

“গলা শুনে তো মনে হচ্ছে না।”

“তোমার মনে হতে হবে না। তুমি বলো তো! আমি শুনছি।”

“রাগ দেখাস কেন কথায় কথায়? ভুলে যাস না আমি তোর বড়ো হই।”

শৌভিকের কণ্ঠে তীব্র দাম্ভিকতা ছাপ। মোহের সামান্য হাসি পেল এক মুহূর্তের জন্যই। শৌভিক তৎক্ষনাৎ আবার বলল,
“আচ্ছা শোন যা বলার জন্য কল করেছি। কালকে কিন্তু বিকেলে তোকে সবার আগে কাজী অফিসে পৌঁছাতে হবে। কেউ আসুক না আসুক তোকে যেন সবার আগে দেখতে পাই।”

মোহ ঠেস মে/রে বলল,
“আগে আগে গিয়ে কি ঘাস কাটব যদি তোমাকে দেখতে না পাই? তোমার যে ব্যস্ততা!”

“পাবি, পাবি। আমার বউকে বরণ করে নিতে আমিই সবার আগে উপস্থিত থাকব। কালকের দিনটা ফাঁকা আছে জন্যই ডেট কালকেই ফাইনাল করা হয়েছে বুঝলি? এরপর আর একটা দিনও ফাঁকা নেই ইলেকশনের আগ অবধি।”

মোহ মাথা নেড়ে বলল,
“কাল কয়টার মধ্যে কাজী অফিসে উপস্থিত থাকতে হবে বলো?”

শৌভিক একটু ভাবনাচিন্তা করে উত্তর দেয়,
“এই চারটা বা সাড়ে চারটার মধ্যে এখানে পৌঁছাতে হবে! আর অবশ্যই তোকে যেসব কিনে দিয়েছি সেসব পরে সুন্দর মতো সেজেগুজে আসবি। সারাদিন এক বয়স্ক বুড়ির মতো সেজে থাকিস।”

মোহ সামান্য তেজ দেখিয়ে বলে,
“সেরা সুন্দরী সেজে যাব তোমার দেওয়া শাড়ি আর গয়না পরে। আর হ্যাঁ আমাকে যে চারটার মধ্যে থাকতে বলছ তোমাকে যেন আমি চারটার সময় গিয়ে পাই। নইলে খবর আছে!”

শৌভিক মোহের কথাতে সামান্যতমও পাত্তা না দিয়ে বলল,
“যা, যা। আমাকে হু/মকি দিচ্ছে। এসব খালি কলসি না বাজিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

মোহ দুয়েকটা কথা বলে কল কেটে দিলো। কালকেই শৌভিক আর ফারাহর বিয়ে। মোহ তাদের পরিপূর্ণতায় বেজায় খুশি। কারোর তো ভালোবাসা পূর্ণতা লাভ করবে! সেটা না হোক তার। তবুও সে খুশি। আজকাল মোহ বোধ করে সে প্রচণ্ড পাষাণ এক হৃদয়কে ভালোবাসতে গিয়েছিল। যেই হৃদয়ে তার কোনো প্রবেশদ্বার নেই। বিধায় সে প্রবেশ করতে পারেনি। প্রণয়ের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়নি। সেই হৃদয় অন্য কারোর জন্য খোলা ছিল। এত ভাবনার ভিড়ে যখন মস্তিষ্ক অচল তখন তার দুটো সুন্দর চোখের কোণে সামান্য অশ্রু। সেই অশ্রু মোহ আঁটকে ফেলল। মাথা নিচু করে তার লেখা সাদা পাতায় দুটো লাইনের দিকে তাকাল। খোলা চিঠি লিখতে বসেছিল সে। তানিয়া বলেছে, মনের কথা লিখলে নাকি মন হালকা হয়। তবে এই দুটো লাইন ব্যতীত আর কিছুই মাথাতে আসেই নি। এই দুটো লাইনও এখন ফিকে। মোহ জানালার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে কাগজটা ফেলে দিলো। অযত্নে ভিজে মাটিতে পড়ে কাগজ ভিজে গেল মূহুর্তেই। মোহ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নিজের মাথার ভার কমানোর বৃথা চেষ্টা করে বিছানায় গিয়ে ঘুমন্ত ইথানকে একহাতে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল।

নিচু হয়ে কাঁপা হাতে নেতিয়ে পড়ে থাকা কাগজ খানা তুলে নিলো স্বচ্ছ। তার পুরো শরীরে কম্পন ধরেছে। এই কম্পনের কারণটা কি ঠাণ্ডা নাকি মোহের মুখে শুনতে পাওয়া খবর সেটা সে বুঝতে পারছে না। কাল কি মোহ বিয়ে করে ফেলছে? নয়ত কাজী অফিসে কাজ কী? শপিংমলে তার ধারণা কী তবে সঠিক ছিল? ব্যস…আর কিছু ভাবার মতো অবস্থাতে নেই সে। মাথা ঘুরছে চড়কির মতো। এতদিন যেই দুঃশ্চিন্তা তাকে শেষ করে ফেলল সেই চিন্তাই তবে সঠিক? মোহ সামান্য অপেক্ষা করতে পারল না? তার অনুভূতিগুলো এতই ফিকে? নাকি তার জেদের বশে বিয়ের সিদ্ধান্ত? যেকারণেই হোক! স্বচ্ছের বুক ধড়ফড় করছে এখন। সে ভালো মতো হাঁটতে সক্ষম হচ্ছে না। পিছলে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে হেলেদুলে নিজের গাড়ির সামনে এসে গাড়ি ঘেঁষে রাস্তাতেই এক দিশাহারার ন্যায় বসে পড়ল সে। কতক্ষণ সেখানে সে বসে রইল সেটা তার জানা নেই।

নিজের এঙ্গেজমেন্টের জন্য পছন্দ করা তিনটে পোশাক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে অন্বেষা। ইভেন্ট একটাই তবে পোশাক কিনে ফেলেছে তিনটা৷ তবে কাল কী পরবে সেটা বুঝতে পারছে না। আয়নার সামনে বারবার একেকটা পোশাক নিজের গায়ের সাথে ধরে দাঁড়িয়ে দেখছে। তিনটে পোশাকে তিন রকমভাবে সুন্দর লাগছে অন্বেষাকে। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী সে। তবে সম্ভবত সাদা গাউনেই তাকে বেশি ভালো দেখাচ্ছে। কিন্তু স্বচ্ছের পছন্দ কী? আয়নায় নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তার ড্রেসিংরুমে এলো নাহিয়ানের স্ত্রী রাজিয়া। তার হাতে গ্রীণ টি। রাতে ঘুমানোর আগে অন্বেষার বরাবরের অভ্যেস গ্রীণ টি পান করা। রাজিয়া খুব যত্নের সাথে অন্বেষার প্রতিটা বিষয়ে ভূমিকা রাখে। রাজিয়া আর নাহিয়ানের বিয়ের প্রায় নয় বছর হলেও সন্তানের মুখ দেখা হয়নি। যার কারণে অন্বেষাকেই তারা দুজন সন্তানের নজরে দেখে।

“এজন্য বলেছিলাম যেকোনো একটা ড্রেস নাও। তাহলে এত কনফিউশানে পড়তে হতো না।”

ভাবির এমন কথায় হাতে দুটো ড্রেস নিলো অন্বেষা। রাজিয়ার দিকে ঘুরে বলল,
“তুমিই বলো এখন কোনটা পরলে আমাকে ভালো লাগবে?”

“এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? যাও তোমার হবু বরকে জিজ্ঞেস করো।”

অন্বেষা খানিকটা কপাল কুঁচকে বলে,
“কল করেছিলাম। ধরছে না।”

রাজিয়া চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে গম্ভীর সুরে বলতে লাগল,
“ছেলেটা ভীষণ অদ্ভুত। কেন যেন মনে হয় বিয়েতে তার আগ্রহ নেই। সেদিন কেমন করে শপিংমল থেকে হারিয়ে গেল দুই ভাই। একবার আমাদের জানালোও না। একারণে তোমার ভাই মানা করছিল এই সম্বন্ধে।”

অন্বেষা বরাবরের মতো আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলে উঠল,
“আগ্রহ না থাকলে রাজি কেন হবে? হি ইজ নট অ্যা লিটল বয়। ছেলেটা ভীষণ ভাব দেখায় বুঝলে? আমার দিকে ভালো করে চোখ তুলে তাকায় না। আমি ওর এটিটিউড ওয়াল ভেঙে ফেলতে চাই।”

রাজিয়া বুঝল মেয়েটা বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জের মতো নিচ্ছে। বিয়ে তো কোনো চ্যালেঞ্জের বিষয় না। এটাতে হারলে সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে। রাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“এই বিষয় নিয়েও জেদ করলে চলে?”

“নোপ! জেদ নয়। ওর যেই রেয়ার আইস আছে না? আমি চাই সারাজীবন ওই দুটো চোখের দৃষ্টি আমার দিকে থাকুক। আমাকে চোখে হারাক।”

কথাটি শেষ করে দারুণ হাসি দিলো অন্বেষা। রাজিয়ার বিষয়টা ভালো ঠেকছে না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।

স্বচ্ছের সকালের কাঁচা ঘুমটা ভাঙল কোনো এক ফোন কলে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছিল সে। ঘুমটা সামান্য ভাঙতেই মনে পড়ল গত রাতের কথা৷ সে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় বসে ছিল এক অসহায় মানবের মতো। প্রায় আধঘণ্টা পর সৌমিত্র এসে তাকে নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসতেই ঘড়িটা দেখে নেয় সে। সকাল প্রায় সাড়ে নয়টা। আর সাত ঘণ্টার ব্যবধানে তার জীবন থেকে সব রং হারাতে পারে নিমিষে। রিংটোনে ধ্যান ভাঙলে সে দ্রুত ফোনটা নিয়ে দেখল সৌমিত্র কল করেছে। রিসিভ করা মাত্র কানে ধরতেই সৌমিত্র কোনো বিরতি ব্যতীত বলতে লাগল,
“ভাইয়া, তাড়াতাড়ি হসপিটালে এসো৷ আরিদ্র ভাইকে পুলিশ ধরতে এসেছে। আরিদ্র ভাইয়ের অপ/রাধের লিস্ট শুনে আমার মাথা ভনভন করছে৷ এর তলে তলে এত? সত্যি কিনা মিথ্যা কিছুই বুঝতে পারছি না৷”

“দেরিতে হলেও যে পুলিশ অবশেষে সব জেনেবুঝে ওই শা/লাকে ধরতে গেছে জেনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এত সুন্দর দৃশ্য মিস করা যায় না। আমি আসছি।”

সৌমিত্রের মাথা দ্বিতীয় বারের মতো চক্কর দিলো যেন। এ কী বলছে তার ভাই? সে কথার প্রত্যুত্তর করার আগেই কেটে দিলো কল স্বচ্ছ। কল কাটতে না কাটতে হাঁচি দিলো সে কয়েকবার। যথেষ্ট ঠাণ্ডা লেগেছে। তবে মস্তিষ্ক এবং প্রতিটা রগ গরম হয়ে রয়েছে। বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথার উদয় হয়েছে গত রাত থেকেই। কেউ যেন সূক্ষ্ম ভাবে বুকের মাঝে একটা একটা করে সুঁই গেঁথে দিয়ে যাচ্ছে। মোহের মোহ থেকে সে বের হতে পারছে না। সে জানে, বের হতেও পারবে না।

“সবকিছু মিথ্যে ইন্সপেক্টর। আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নেই৷ আমি শুধু শুধু ফেঁসে যাচ্ছি।”

আরিদ্রের এমন কথাতে মোটেও ভোলানো গেল না পুলিশ ইন্সপেক্টরকে৷ তিনি ধমকে বলে উঠলেন,
“ইনফরমেশন আমরা নিজে খুঁজে বের করেছি। কোন যুক্তিতে আমাদের তথ্যকে আপনি মিথ্যে বলেন? আপনার সঙ্গে পতি/তি পল্লীর সরদারনীর যোগাযোগের প্রমাণ আপনার ফোন এবং সরদারনী হেনা নিজেই। সে বয়ান দিয়েছে আপনার কৃতকর্মের। আপনি তার হাতে মাঝে মাঝেই ভালো মেয়েদের জোরপূর্বক তুলে দেন হ্যাঁ কি না?”

আরিদ্র কার উপরে রাগটা ঠিক প্রকাশ করবে বুঝে উঠতে পারল না। নিজের উপরে নাকি হেনার উপরে? অসাবধানতার দরুণ আজ তাকে ফাঁ/সতে হলো। সে জে/ল খাটতে চায় না। কোনোমতেই না। ঠিক একারণে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল সে। তা আর হলো কোথায়? মা/র খেয়ে এখনো হসপিটালে পড়ে আছে। ঠিক মতো দাঁড়াতে পারে না আজও। আরিদ্রের মা মিসেস জামিলার যেন দুঃখের শেষ নেই। একেই ছেলের এই হাল তার মধ্যে পুলিশের দেওয়া এত বড়ো এলিগেশন! উনি নিজের ছেলে বড্ড ভালো ছেলে হিসেবেই জানেন। তাই প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন,
“আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার ছেলে এতদিন তো দেশেই ছিল না। ও এত জঘ/ন্য অপরাধ করবে না। হয়ত ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে। আপনারা একটু সঠিন তদন্ত করুন দয়া করে।”

“আমরা একদম সঠিক লোককেই ধরেছি ম্যাডাম। তাও প্রমাণ সমেত। আপনার এই ভালো ছেলের অপ/রাধের লিস্ট সবেমাত্র বলা শুরু করেছি। এর থেকে বড়ো ধরণের অপ/রাধের সাথে সে সংযুক্ত। এমনকি সরাসরি খু/নের সঙ্গে সে যুক্ত। নিজ হাতে খু/ন করেছে একটা মেয়েকে। ওকে আমরা এমনি এমনি ছাড়তে পারব না।”

থরথর করে কাঁপন ধরে আরিদ্রের শরীরে। তার জীবন যেন যাচ্ছে আর আসছে। এসব খবর কী করে ফাঁ/স হলো? নিশ্চিত মোহ বেফাঁস করেছে। কেন মেয়েটা সেদিনই ঈশানীর সঙ্গে ম/রে গেল না? দরদর করে ঘামছে আরিদ্র। অস্থির অস্থির লাগছে। কী করে বাঁচবে সে? তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল সরোয়ার সাহেবের কথা। গতবার তিনি সাহায্য করতে প্রত্যাখান করেছিলেন কিন্তু এবার যে করেই হোক ম্যানেজ করতে হবে। দরকার হলে আরিদ্র উনার পায়েও ধরতে রাজি। কিন্তু সে জে/লের অন্ধকারে পচতে চায় না। সে জানে, যতগুলো অপ/রাধে সে শামিল রয়েছে তার জন্য যাবজ্জীবন কা/রাদণ্ড তার নিশ্চিত। তড়িঘড়ি করে কেবিনের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা সৌমিত্রকে আরিদ্র ডেকে বলল,
“সৌমিত্র তোর ফোনটা থেকে একটু সরোয়ার আঙ্কেলকে কল কর। আমি কথা বলব। প্লিজ!”

এতকিছুর মাঝে স্বচ্ছের প্রবেশ ঘটে অবশেষে। আরিদ্রের মুখটা দেখে সে মৃদু হেসে বলে,
“বাবাকে কল করে কী করবি? তোর পাপ তো ঢাকবে না।”

আঁতকে ওঠে আরিদ্র। মিসেস জামিলা স্বচ্ছের নিকট এসে কেঁদে দিয়ে বলেন,
“এসব কী বলছ তুমি? আরিদ্রকে তুমি চেনো তো স্বচ্ছ বাবা। আমার ছেলেটাকে যা-তা বলা হচ্ছে। তুমি কিছু একটা করো নাহলে ওকে তো ধরে নিয়ে যাবে।”

স্বচ্ছ বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“সরি, মামি। আমার বলতে খারাপ লাগছে তবে এটা সত্যি যে জন্ম দিয়েও আপনার ছেলেকে আপনি চিনতে পারেন নি। আপনি মানুষ রূপি জা/নোয়ার জন্ম দিয়েছেন। আপনি ওর মা। একজন মেয়ে মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ওর মাঝে মেয়েদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা বোধ ছিল না লালসার দৃষ্টি ছাড়া।”

মিসেস জামিলা তবুও বিশ্বাস করতে পারলেন না। উনার ছেলে এমন হতে পারেন উনি কল্পনাও করতে পারেন না। ধমকে উঠলেন তিনি।
“স্বচ্ছ! তুমিও এসব বলে আমার ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টা করো না। ও তোমাদের কী করেছে?”

“তাকে ফাঁসানোর মতো কিছুই নেই। শুনুন, আপনাকে শুরু থেকে বলি। আপনার ছেলে বিদেশ যাওয়ার আগে একটা মেয়ের সঙ্গে অন্যায় করে গেছে। প্রেমের সম্পর্ক গড়েছিল। মেয়েটা ঈশানী। প্রেমের সম্পর্কের নাম করে আপনার ছেলে যা করেছে আপনার মতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে আমি মুখে বলতে পারব না। আপনি প্লিজ ইন্সপেক্টরের কাছে শুনুন।”

স্বচ্ছের কথা শেষ হলে ইন্সপেক্টর বলতে শুরু করে,
“আপনার ছেলে ঈশানী নামক মেয়েটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে। এরপর তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার ফলে মেয়েটির গর্ভে একটা সন্তান আসে। আপনার ছেলে তাকে অস্বীকার করেছিল। তবুও মেয়েটা সন্তানের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সেটা জেনে আপনার ছেলে মেয়েটাকে পতি/তালয়ে বিক্রি করে দিয়েছিল। এরপর মেয়েটা এতবছর পালিয়ে এলে তাকে মে/রে ফেলে নদীতে ফেলে দেয়। আরেকটা মেয়ের সম্মানহানি করার চেষ্টা করে ভাগ্যক্রমে মেয়েটা বেঁচে আছে। আর আপনার ছেলের অস্বীকার করা সেই ছোটো বাচ্চাটিও বেঁচে আছে বলে আমরা ডিএনএ টেস্ট করি। যা ঈশানী এবং আপনার ছেলে উভয়ের সঙ্গে মিলে যায়। এসব কিছু কোর্টে পেশ করা হবে। আশা করছি আর আপনাকে কিছু বলতে হবে না।”

পুরো জগত যেন দুলে উঠল মিসেস জামিলার। সঠিক শিক্ষা তবে পেল না ছেলে? এই ভেবে শ্বাসকষ্ট উঠে গেল উনার। মাতৃত্ব লাভ করাটা বৃথা মনে হলো। আরিদ্রের মতো সন্তান জন্ম দেওয়াটা পাপ বলে মনে হলো। দুচোখ দিয়ে ঝরছে কষ্টের অশ্রু। উনার শ্বাসকষ্ট দেখে স্বচ্ছ সৌমিত্রকে ইশারা করল নার্স ডাকতে। নার্স এসে উনাকে গিয়ে যেতে চাইলেন এমন পরিস্থিতি থেকে। মিসেস জামিলা যেতে চাইলেন না। জোর করে আরিদ্রের কাছে এগিয়ে গেলেন। আরিদ্র কূল না পেয়ে মায়ের হাত ধরে কাঁপা গলায় বলল,
“মা, আমাকে বাঁচাও। আমি জে/লে যাব না। কিছু একটা করো।”

মিসেস জামিলা ছেলের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলেন। একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে উনি কিছু বলতে চাইলেন তবে শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বাড়ার ফলে কিছুই বলতে পারলেন না। দুজন নার্স মিলে উনাকে নিয়ে গেলেন।

আরিদ্রের মাথায় হাত৷ দিকবিদিকশুন্য তার। ইন্সপেক্টর সরাসরি বলে দিলেন,
“আপনি যেহেতু এই মুহূর্তে অসুস্থ সেহেতু আপনাকে হসপিটালেই পুলিশের নজরে থাকতে হবে। সুস্থ হলে আপনাকে আমাদের হেফাজতে নেওয়া হবে। আশা করি পালানোর চেষ্টা করবেন না।”

আরিদ্র আর তর্ক করার মতো কিছু পেল না। তার তর্ক করা বৃথা। শুধু তার মাথায় কিছু বিষয় ঘুরছে। সে উত্তর খুঁজছে। ইন্সপেক্টর সহ পুলিশের টিম চলে গেলেও খুব শীঘ্রই আরিদ্রের উপর নজরদারি করতে কনস্টেবল পাঠানো হবে। আরিদ্র হতাশার নিশ্বাস ছাড়ল। স্বচ্ছ আরিদ্রের নিকট এগিয়ে গিয়ে মৃদু হেসে বলল,
“অনেক প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিস না তাই না? চল তোকে সব ক্লিয়ার করে বলি৷ তোর বাড়ি গিয়েছিলাম মনে আছে? কেন গিয়েছিলাম বল তো? তোর সঙ্গে ঠাট্টা করতে? নোপ! তোর ডিএনএ স্যাম্পলের খুব প্রয়োজন ছিল আমার৷”

আরিদ্র হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল। অস্ফুটস্বরে বলল,
“তুই!”

স্বচ্ছ জোর দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ। পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। তোকে কী করে ছাড়বে? জানিস, তোকে মে/রে ফেলার তীব্র বাসনা জন্মেছিল। কিন্তু খু;নের দায়ে জে/ল খেটে নিজের বাকি জীবন আর নষ্ট করতে চাইনি। তাই কায়দা করে তোকে আধম;রা করে ফেললাম। খুব আনন্দ লুটেছি তোকে এই হসপিটালের বেডে কাতরাতে দেখে। তোকে সারাজীবন জে/ল খাটতে দিয়েই আমি ক্ষান্ত হতে পারতাম না। তাই তোকে ইচ্ছেমতো আ/ঘাত করেছি। নিশ্চয় সেই আ;ঘাতের প্রতিটা যন্ত্রণায় নিজের সব জঘন্য কর্ম স্মরণ করছিলি?”

হাতের ক্ষ/ত এখনো সম্পূর্ণভাবে সাড়ে নি আরিদ্রের। তবুও নিজের ক্রোধ উপচে পড়া থামাতে পারল না সে। রাগের বশে হালকা হাতে চেপে ধরল স্বচ্ছের শার্টের কলার। ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
“তোকে আমি ছাড়ব না শালা।”

সদ্য সেরে ওঠা হাতখানা মুচড়ে ধরল স্বচ্ছ। ব্যথায় ককিয়ে উঠল আরিদ্র। শান্ত কণ্ঠে স্বচ্ছ জবাব দিলো,
“তুই আমার একটা চুলও ছেঁড়ার ক্ষমতা রাখিস না। কিন্তু আহিয়ান স্বচ্ছ তোকে খু/ন করার ক্ষমতা রাখে। বেঁচে আছিস আমার দয়ায়। তোকে খু;ন করলে কারোর বাপের সামর্থ্য নেই আমাকে দোষী হিসেবে প্রমাণ করার। কিন্তু আপাতত তুই পুলিশের হেফাজতেই থাক। আর গলা নিচু কর।”

আরিদ্রের হাত ঝাড়ি দিয়ে ফেলে দিয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে গেল স্বচ্ছ। আগপাছ না ভেবে ভাইয়ের এমন ক্রোধ দেখে পিছু পিছু দৌড়াল সৌমিত্র।

সৌমিত্র বাইক চালাচ্ছে। পাশাপাশি যাচ্ছে স্বচ্ছ গাড়ি ড্রাইভ করে। বারংবার গাড়ির ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। এইটুকু সময়ে এক ঘণ্টা চলে গেল! সে হাতে ফোন নিলো। তবে কাঙ্ক্ষিত কিছুই পেল না। তখন বাইক থেকে সৌমিত্র চেঁচিয়ে বলল,
“ভাই, তুমি আরিদ্রকে মা/রবে সেটা আমাকেও জানাতে পারতে।”

আড়চোখে একবার সৌমিত্রের দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনের দিকে নজর দিলো স্বচ্ছ। সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“না, মানে আমিও তোমার সঙ্গে সামিল হতাম। পশুটাকে পি/টাতে পারতাম আমিও।”

“তার প্রয়োজনবোধ করিনি। আমি একাই যথেষ্ট ছিলাম।”

সৌমিত্র চুপ রইল। ফের আবার কিছু একটা ভেবে বলল,
“আরেকটা কথা ছিল!”

“বলে ফেল।”

সৌমিত্র এবার আমতা আমতা করল। তবুও সাহস জুগিয়ে বলে ফেলল,
“কালকে তো তোমাকে মিস মোহের বাড়ির সামনে পেলাম। তুমি কি তাকে ভুলতে পারছ না? যদি না-ই পারো কেন অন্য বিয়ের জন্য রাজি হলে? কাল তোমার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তুমি হুঁশে ছিলে না। নিজের পরিস্থিতি জটিল নিজেই কেন করছ ভাইয়া?”

স্বচ্ছ এ পর্যায়ে নির্বিঘ্ন রইল। তার চোখেমুখে নেই কোনো অবকাশ। তবে তার চোয়াল ফুটে উঠছে ক্রমশ। সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
‘প্রিয় কারোর জীবন সহজ করার জন্য নিজের জীবন জটিলতায় ফেলতে হয়।”

সৌমিত্র দূরে বাইক নিয়ে কিছুই শুনতে পেল না। চিল্লিয়ে শুধাল,
“কী বললে?”

স্বচ্ছ একবার তার দিকে তাকিয়ে এক দগ্ধ নিশ্বাস ফেলে জোর গলায় বলল,
“আজকে হয় আমার জীবনের সবথেকে আনন্দের দিন হবে নয়ত আজকেই জীবনের আনন্দের অধ্যায় শেষ হবে। বাকিটা সময়ের হাতে।”

কথার মাঝে রহস্য রেখে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে সৌমিত্রের সামনে চলে গেল স্বচ্ছ। সৌমিত্র তার ভাইয়ের কথার রহস্যের কূল-কিনারা ভেদ করতে পারল না।

দুপুর তখন ঠিক দুটো বেজে ত্রিশ মিনিট। সরোয়ার সাহেবের বাড়িতে আগমন ঘটেছে নাহিয়ান রায়হানের। সঙ্গে রয়েছে তার পরিবার। বলা বাহুল্য অন্বেষা নিজেকে নিখুঁত করে সাজিয়েছে বটে। মেরুন রঙের পোশাকে ফুটিয়ে তুলেছে নিজেকে। সাজগোজে কোথাও কমতি নেই। আজ সে স্বচ্ছের আকর্ষণ হাসিল করে তবেই ছাড়বে। তারা সকলে দুপুরের খাবার খেতে বসেছে। এমনটাই কথা ছিল। একসঙ্গে দুপুরের আহার সেরে ফেলার পর আংটি পরানো হবে। আরিদ্রের জন্য বাগদান অনুষ্ঠান আঁটকে যায়নি মোটেই। সরোয়ার সাহেবের এক কথা, ‘যেই ছেলে জঘন্য ক্রি/মিনাল তার জন্য শোক পালন করার কোনো মানে নেই।’

সরোয়ার সাহেবের মন আজকে বেজায় ফুরফুরে। তবে খাওয়ার মাঝে ফারাহকে দেখতে পেলেন না তিনি। মিসেস জেবাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ফারাহ কোথায়, জেবা? খাওয়ার টেবিলে অনুপস্থিত কেন?”

খাওয়ার মাঝে চমকালেন মিসেস জেবা। উনার মন মেজাজ আজ ভালো নেই। কেমন যেন অস্বস্তিতে কাটাচ্ছেন প্রতিটা মুহূর্ত। এমতাবস্থায় ফারাহর কথা জানতে চাইলে অপ্রস্তুত হোন তিনি। পরক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দেন,
“ওর নাকি কাজ আছে। এই বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল কথা না শুনে।”

“এটা কেমন কথা? আজকে তার বড়ো ভাইয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। সে থাকবে না? ওকে কল করো। আমি ওকে সঠিক সময়ে এখানে দেখতে চাই।”

মিসেস জেবা কিছুটা থতমত খেয়ে বললেন,
“আচ্ছা। চিন্তা করো না। খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ হলেই কল করব।”

মিসেস জেবা মিছে শান্তনা দিয়ে বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। উনিও জানেন আজকে ফারাহকে পাওয়া সম্ভব নয়। নাহিয়ান বলে উঠল,
“আপনার মেয়ে তো মনে হয় কাজের প্রতি খুব মনোযোগী!”

সরোয়ার সাহেব মুখে হাসি বজায় রেখে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ। এজন্যই তো এমন দিনেও তার খোঁজ নেই।”

“স্বচ্ছ কোথায়? খাবার টেবিলে নেই যে?”

ফের জেরা করেন সরোয়ার সাহেব। এবার সৌমিত্র তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয়,
“রেডি হচ্ছে বাবা।”

সরোয়ার সাহেব আর কিছু বললেন না। উনি জানেন স্বচ্ছ ইচ্ছে করে খাবার টেবিলে আসছে না। ছেলেটার বিয়েতেই আগ্রহ নেই। এতদিনেও আগ্রহ সৃষ্টি করাতে পারলেন না তিনি। তবুও বিয়েটা হওয়া দরকার। রাজনৈতিক দিকে উপরে উঠতে হলেও বিয়েটা হতে হবে। স্বচ্ছের ইচ্ছে থাকুক কিংবা না থাকুক উনার আর যায় আসে না।

সাদা শার্ট পরিধান করে এসির নিচেও রীতিমতো ঘামছে স্বচ্ছ। বিছানায় অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে ব্লেজার, ঘড়ি আর টাই। তার সেদিকে মনোযোগ নেই। সে ঘড়ি দেখছে। ঘড়িতে তিনটা ছুঁইছুঁই। বুক সত্যি সত্যি জ্বলছে ওর। চোখের সামনে উল্টাপাল্টা দৃশ্য ভাসছে। সে সেসব দৃশ্য দেখতে চায়না। বধূরূপে অন্য কারোর হাত ধরে মোহ এই বিষয়টা ভাবতেই তার ভেতরটা উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা মুহূর্ত যাচ্ছে আর শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হচ্ছে। কাঁপা হাতে শক্তি দিয়ে ফোনটা হাতে ধরল স্বচ্ছ। মোহকে কল করবে? মোহের নম্বর অবধি গিয়ে থামল সে। তারপর ফোন ফেলে দিয়ে নিজের মাথার চুল নিজ হাতে এলোমেলো করল উন্মাদের মতো। বারবার কারোর সঙ্গে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করল। বুঝল আরো সময় লাগবে। ইতিমধ্যে বাহিরে থেকে ডাক এলো। তাকে নিচে যেতে হবে। স্বচ্ছ রুমে পায়চারি করা আরম্ভ করল। মিনিট পাঁচেক গেল এভাবেই। আচানক বেজে ওঠে তার ফোনের নোটিফিকেশনের টোন। হুড়মুড়িয়ে সেদিকে ছুটে যায় স্বচ্ছ। ফোন দেখে অবশেষে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে। সে জানে এবার কী হবে! অস্ফুটস্বরে বলে,
“মিশন ডান!”

নিচ থেকে শোনা যায় তর্কবির্তক। কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছে। কিছু অচেনা কণ্ঠস্বর শুনে স্বচ্ছের বুঝতে বাকি রইল না তার পরিকল্পনা সত্যিই সফল। দেরি না করে ফোনট পকেটে ঢুকিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বের হলো সে।

“আপনাকে এবার আমাদের সঙ্গে যেতে হবে মন্ত্রী সাহেব। গতবার পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে আপনি আমাদের হাত থেকে পিছলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এবার আপনার ডান হাত কামালের বয়ান এবং প্রমাণের ভিত্তিতে আপনাকে এ;রেস্ট করতে এসেছি।”

“মানে কী? ওই কামালের বয়ান যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ কী? ও বলল আর এরেস্ট করতে চলে এলেন? আমি একজন উচ্চ পদস্থ মানুষ। আমাকে আপনারা রীতিমতো হ্যারাস/মেন্ট করছেন। আমি এসব মেনে নেব না।”

পুলিশ অফিসার বেশ শান্ত গলায় উত্তেজিত সরোয়ার সাহেবকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন,
“আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে সমস্ত কাগজপত্র উপস্থিত আছে। বলা বাহুল্য, আপনার উপর এবার আবার অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয় অভিযোগ করা মানুষটির কাছ থেকে শক্তপোক্ত প্রমাণ পেয়ে আমরা এসেছি। আপনাকে আমরা সম্মান দিয়েই বলছি, ভালোই ভালোই আমার সঙ্গে চলুন। আপনার পক্ষে কিছু বলার থাকলে আপনি কোর্টে আপনার উকিল দিয়ে বলাবেন।”

সরোয়ার সাহেব দাঁত কিড়মিড় করে জানতে চাইলেন,
“কে করেছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ?”

“এবার অভিযোগটা তোমার ছেলে নিজে করেছে বাবা।”

উপরের করিডোর থেকে স্বচ্ছের কণ্ঠে হতবাক হয় উপস্থিত সকলে। অন্বেষার কৌতূহলী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যায় স্বচ্ছের পানে। সে শুধু অবাকই হয়নি। চমকেছে ভীষণ! ছেলেটা নিজের বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বসল? তাও প্রমাণ সমেত? কারণ কী? স্বচ্ছ আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো। সরোয়ার সাহেব বরাবর দাঁড়িয়ে বলল,
“গেমের স্টার্টিং তুমি করেছিলে বাবা। ব্ল্যাকমেইল, মিথ্যে, অভিনয় সবকিছু দিয়ে নিজের অন্যায় চেপে রাখার চেষ্টা করছিলে। শেষটা তোমার ছেলে করল। সরি বাবা। বাট তুমি এটার যোগ্য ছিলে।”

সরোয়ার সাহেব হতবিহ্বল চোখে একমনে তাকিয়ে রইলেন। স্বচ্ছ এভাবে বাজিমাত দেবে জানা ছিল না উনার। মিসেস জেবা আজ টু শব্দ করছেব না। উনি সবটা জানতেন। স্বচ্ছের থেকে সবটা শুনেছিলেন। এই আশঙ্কাতেই অস্থির হয়ে ছিলেন। তবে আজ নিজের স্বামীর পাশে দাঁড়াতে উনি নারাজ। এবার থেকে ছেলেমেয়েকেই প্রাধান্য দেবেন এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নিজের কাছে। সরোয়ার সাহেব বিভ্রান্ত হয়ে শুধালেন,
“এমনটা কেন করলে স্বচ্ছ? আমি তোমার বাবা। তুমি তোমার বাবার বিরুদ্ধে যাচ্ছো?”

স্বচ্ছ আজ নির্বিকার। তার মনে আর বাবার প্রতি রাগ নেই। সেসব রাগ ঝেড়ে ফেলেছে অভিযোগ করার পরই। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“সমস্যা তো এখানেই। তুমি আমার বাবা। সঠিক পথে থাকলে আমরা সুন্দর পরিবার পেতাম বাবা৷ কেন তুমি বিপথে গেলে বলো তো? আমাকে বাধ্য করলে তুমি।”

সরোয়ার সাহেব বলার কিছু পেলেন না। উনি উপলব্ধি করতে পারছেন এতদিনে উনার তৈরি করা রাজনীতির এক বড়ো সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ তার পায়ের তলে পিষছে। সরোয়ার সাহেব মানতে পারছেন না। তিনি ক্ষিপ্র হয়ে বললেন,
“আমি কোথাও যাব না। জে;লে যাব না আমি।”

মিসেস জেবা নিজের দুর্বলতা লুকাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সবের মাঝে উনার চোখে পানি চলে আসছে। সৌমিত্র মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে শুধায়,
“মা, ঠিক আছো?”

মিসেস জেবা শুধু মাথা নাড়ান। নাহিয়ান সহ তার পরিবার নিতান্তই দর্শক। এসবের মাঝে হয়ত উনাদের চুপ থাকাই উচিত। স্বচ্ছ বলল,
“তোমার মতো স্বার্থপর, অপ/রাধী এবং অন্যের হক মে;রে খাওয়া মানুষের জন্য ওই জে/লই যোগ্য স্থান। আশা করি নিজেকে শোধরাবে।”

সরোয়ার সাহেব তবুও মানলেন না। নিজেকে নির্দোষ বলে জাহির করতে থাকলেন। পুলিশের সঙ্গে তর্ক হতে থাকল। তবে স্বচ্ছ কথা বাড়াল না। সে একবার অন্বেষার দিকে তাকাল। অন্বেষা তার দিকেই চেয়ে ছিল। স্বচ্ছ তার চোখে চোখ করে স্পষ্ট বলে ফেলল,
“আই এম সরি মিস অন্বেষা। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। যেখানে আপনাকে বিয়েই করতে পারব না সেখানে এই আংটি বদলের কোনো মানে নেই।”

অন্বেষার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। স্বচ্ছ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে আংটির বাক্স সহ অন্বেষার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার প্রতি আমার কখনো কোনো আগ্রহ ছিল না। এটা তৈরিও হবে না কখনো। নিজের সমস্ত আগ্রহতে, আকাঙ্ক্ষায়, মুগ্ধতায় অন্য রমণীর বাস। সেখানে অন্য কেউ স্থান পাবে না।”

হাত থেকে আংটির বাক্স পড়ে গেল অন্বেষার৷ মাথা ভার ভার লাগল তার। তবুও তার চোখ স্বচ্ছের দিকে আটকে রয়েছে। স্বচ্ছ ফের বলল,
“আমি একপ্রকার আপনাকে ঠকিয়েছি বলা চলে। আপনাকে ঠকানোর অধিকার আমি রাখিনা। তাই আমি শাস্তির যোগ্য। কিন্তু তবুও আমি আপনাকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারব না। এই বিয়ের সম্পর্কে সম্মান, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভরসা, মায়া, টানের প্রয়োজন হয়। যেমন রংধনুতে সাতটা রঙয়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু একজন নারী হিসেবে আপনার প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধা ব্যতীত আর কোনোটাই আমার মনে ছিল না। আমি শুধু বাধ্য হয়েছিলাম। এইযে আমার বাবা যিনি স্বার্থের খাতিরে আমাকে বাধ্য করেছিল। আজ আমার মুক্তি।”

কথাগুলো শেষ করে থামে স্বচ্ছ। সবশেষে বলে,
“আই এম সরি মিস অন্বেষা। পৃথিবী উল্টে গেলেও আমি ওই একজনকেই ভালোবাসব। কোটি কোটি রমনীর মাঝে আমি তাকেই খুঁজে যাব। আমি তার কাছেই ফিরে যাচ্ছি।”

চলবে….

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]