যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
7

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৫ [দ্বিতীয় খণ্ড]

প্রকৃতির শিরশিরে হাওয়া বইলেও তা ছাড়িয়ে গেল স্বচ্ছের চারিদিকে ভাসতে থাকা প্রেমের উষ্ণ হাওয়া। ঝিরিঝিরি ছোটো ফোঁটার বৃষ্টি পড়ে স্বচ্ছের গাড়িটাতে ফোঁটা নকশা তৈরি হচ্ছে ক্রমাগত। স্বচ্ছের কানে ক্রমাগত বেজেই চলছে রিনরিনে কণ্ঠে স্বীকার করা ভালোবাসার স্বীকারোক্তি। বর্ষণ যেন তাতে সায় জানাতেই হাজির হয়েছে। এই বর্ষণেই হয়ত লেগে রয়েছে প্রেমের ছোঁয়া! স্বচ্ছ চোখ বুঁজে অনুভব করছে তার নিজেরই টগবগিয়ে বেড়ে যাওয়া হৃৎস্পন্দন। তৎক্ষনাৎ তার প্রিয় নারী আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,
“এই নারী আপনাকে ভরসা করে আপনার সঙ্গে নির্ভয়ে রয়েছে। এই বিশ্বাসটা কেন আপনার প্রতি জানেন? কারণ সে আপনাকে ভালোবাসে, বোকা পুরুষ!”

বুকে যেন আরেকবার ধাক্কা লাগল স্বচ্ছের। মেয়েটার মৃদু হাসি দিয়ে থেমে গেল। সেই সুন্দর ধাক্কা সামাল দিতে বেশ সময় লাগল। আসলেই তো! এই স্বীকারোক্তি মধুর! আচানক তার কানে আসে দরজা বন্ধ করার শব্দ। চোখ মেলে তাকায় স্বচ্ছ। দেখে পাশে তার প্রিয় নারীটি নেই। বাইরে চোখ দিতেই মোহকে গলির ভেতরে ঢুকতে দেখে সে দ্রুত জানালা খুলে মাথা বের করে চিল্লিয়ে পিছু ডাকল,
“মিস মোহ!”

মোহ শুধু হাস্যোজ্জ্বল মুখে একবার পেছন দিকে স্বচ্ছের পানে নজর দিলো। অতঃপর গলিতে ঢুকে গেল সে। তবে সেই নজর স্বচ্ছের নয়নে আঁটকে গেল। সরাতে পারল না সেই সুন্দরতম চাহনি! এমন মুহূর্ত সে আবার কবে পাবে? ধৈর্যহারা স্বচ্ছ।

ক্লান্ত সৌমিত্র ফ্রেশ হয়ে ঘরের জামাকাপড় পরে ওয়াশরুম থেকে বের হলো সবে। ঘরে এসে বাজতে দেখল তার ফোন। হাতে ফোন নিলো সে। তানিয়ার নম্বর থেকে এতগুলো কল দেখেই বুক ধড়ফড়িয়ে উঠল তার। সে কি স্বপ্ন দেখছে? তার স্বপ্ন এত সুন্দর কবে থেকে হলো? প্রতিনিয়ত তো সাপ, বা/ঘ, ভাল্লু/ক দেখে বেড়ায়। আজ স্বপ্নের এত সুন্দর উন্নতি? এত ভাবনার ছেদ ঘটল যখন ষষ্ঠবারের মতো ফোনের রিংটোন বাজে। তড়িঘড়ি করে ফোনটা রিসিভ করে সৌমিত্র বিচলিত হয়ে বলে,
“হ্যালো, হ্যালো! আপনি কি আমার স্বপ্ন?”

“আবোলতাবোল কী বকছেন? আমি স্বপ্ন হতে যাব কেন? আমি বাস্তব।”

সৌমিত্রের মনটা যেন ফুরফুরে হয়ে যায় মুহূর্তেই। ভীষণ মোলায়েম সুরে বলে,
“এত সুন্দর বাস্তবও হয়?”

“আমি জানি আপনি অনেক দারুণ ফ্লার্ট করতে পারেন। সেটা আমাকে বোঝানোর দরকার নেই। একটা জরুরি দরকারে কল করেছি আপনাকে।”

তানিয়ার কথায় রাগের আঁচ পাওয়া গেল। সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“বিশ্বাস করুন আমি সেই কবে ফ্লার্ট বাদ দিয়ে দিয়েছি শুধু আপনার জন্য। আর যেকোনো দরকারে আমি আপনার জন্য হাজির।”

তানিয়া কোনো ভণিতা ছাড়া বলে ওঠে,
“তাহলে এখন দেখা করতে পারবেন?”

সৌমিত্র বেশ চমকায়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে সেখানে প্রায় নয়টা বেজেছে। আর পাঁচটা মিনিট বাকি। শেষবার যখন তানিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন সে নিজেই মানা করেছিল যেন তার সামনে আর সৌমিত্র না যায়। আজ নিজে থেকে ডাকছে? তাও এই রাতে? হিসাব মেলাতে পারে না সৌমিত্র। অপরদিকে তার জবাব না পেয়ে তানিয়া ঝাঁজালো সুরে বলে,
“কী হলো? কিছু বললেন না যে? দেখা করতে পারবেন না? না পারলে থাক।”

সৌমিত্র তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে বসল,
“এই না, না। আমি এখনি যাচ্ছি। কোথায় দেখা করতে হবে বলুন মিস গোলাপি!”

“আমার বাড়ির ছাঁদে।”

চোখ যেন উল্টে ওঠে সৌমিত্রের। এ কী বলছে মেয়ে? তার কি মাথার ঠিক আছে? সৌমিত্র একরাশ আতঙ্ক নিয়ে বলে,
“মিস গোলাপি সত্যি করে বলুন তো আমাকে কি জনগণের ধো/লাই খাওয়ানোর জন্য মনে মনে পরিকল্পনা করেছেন?”

তানিয়ার রাগ হলো এবার। তবুও রাগটা দমিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“হঠাৎ আপনার কেন মনে হচ্ছে?”

“মনে না হওয়ার কী আছে সেটা বলুন। এত রাতে একটা মেয়ের বাড়ির ছাঁদে উঠব। ধরা পড়লে আমার ছয় মাসের জন্য হসপিটালের বেডে কাতরানো নিশ্চিত। আমি আপনাকে নিয়ে কয়েকদিন রাস্তায় গান গেয়ে গেয়ে জ্বালিয়েছি বলে আপনি আমাকে নিয়ে এত ভয়াবহ প্ল্যান করে ফেলেছেন মিস গোলাপি?”

তানিয়া এবার রাগ দমাতে সক্ষম হলো না। মাথা গরম করে বলল,
“আপনার না আসতে না হলে না আসুন। আপনাকে আসতে বলাই আমার ভুল হয়েছে। আমি রাখছি।”

সৌমিত্র এবার কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিলো তানিয়া। সৌমিত্র বুঝল সে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। মেয়েটার মেজাজ খারাপ করে ফেলেছে। এবার কী করা যায় তা নিয়ে ভাবনায় পড়ল সে।

টিপটিপ হালকা বৃষ্টি বন্ধ হয়নি। সম্ভবত সারারাত এমনটা চলবে। এর মাঝে তানিয়া ছাঁদে রাখা এক দোলনায় বসে আছে মেজাজ খারাপ করে। একমনে কীসব যেন বিড়বিড় করে নিজের রাগ বের করছে সে। হঠাৎ তার ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে সৌমিত্র নামটা দেখেই চোখমুখ জড়িয়ে যায় রাগে।সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করে একপ্রকার বাঘিনীর মতো গর্জন ছেড়ে বলে,
“কী সমস্যা আপনার? কল করছেন কেন আবার?”

“আমি আপনার বাড়ির সামনে এসে পড়েছি মিস গোলাপি।”

তানিয়ার সমস্ত ক্রোধ কোথাও উবে যায়। বিস্মিত হয়ে ছুটে যায় ছাঁদের অন্য প্রান্তে যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। সেখানে একটা বাইক আর বাইকের উপরে বসে থাকা মানুষের অবয়ব দেখতে পাচ্ছে সে। বাইকে জ্বলছে লাইট। তানিয়ার চিনতে কষ্ট হলো না। সে হতবিহ্বল হয়ে শুধায়,
“আপনি আমার বাড়ি চিনলেন কী করে?”

সৌমিত্র একগাল হেসে বলে,
“ইটস সিক্রেট, মিস গোলাপি। এখন বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?”

“আচ্ছা, মেইন গেট আমি খোলা রেখেছি দেখুন। বাইকটা আরো দূরে কোথাও রেখে ভেতরে আসুন। তারপর বাড়ির গেটের বাম দিকে দেখবেন সিঁড়ি আছে। উঠে আসুন। আমি উপরেই আছি।”

নিজের কথা শেষ করে কল কাটে তানিয়া। সৌমিত্র তার কথা অনুযায়ী একটু ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢোকে। না জানি কী এমন প্রয়োজনে মিস গোলাপি তাকে এত বিপদের মাঝে ডাকল! ভয়ে তার গায়ের কাটা শিউরে উঠছে। বামপাশে তাকাতে সিঁড়ি দেখল সে। বাইরের দিকেই সিঁড়ি দেখে হাফ ছেড়ে পা টিপে টিপে উপরে গেল সে। ছাঁদটা তার দৃষ্টিগোচর হতেই সে দেখল দোলনায় বসে থাকা রমনীর অবয়ব। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে। রমনীটি তার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। হালকা আলোয় অস্পষ্ট তার মুখ। আলগোছে বাঁধা তার হাতখোঁপা। মেয়েটি গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“বসুন।”

সৌমিত্র দোলনার অন্যপাশে তানিয়ার থেকে বেশ দূরত্ব রেখে বসে। দোলনা হালকা ভেজা হয়ে আছে। ঝেড়ে কেশে জানতে চায়,
“কী কারণে এত জরুরি তলব? যে এত ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় এই সাধাসিধে ছেলেটাকে ডাকতে হলো?”

তানিয়া মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর করে,
“কেন? আপনার তো প্রেম করার অনেক শখ। প্রেম করলে তো মাঝে মাঝে ঝুঁকি নিতে হবেই। এতগুলো প্রেম করেও অভিজ্ঞতা নেই?”

“একদমই না। অবশ্য যেতে বলেছিল এক প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ড। আমি কি পাগল নাকি যে ওর বাড়িতে গিয়ে ধোলা;ই খেয়ে আসব! না করে দিয়েছিলাম মুখের উপর। তা নিয়ে কী ঝগড়া করছিল মেয়েটা! সেটার কারণে ব্রেকআপ করে দিয়েছি।”

তানিয়া উৎসুক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“তাহলে আমার ডাকে এলেন যে?”

সৌমিত্র সোজাসাপটা জানায়,
“জানি না কেন এসেছি। ভয় তো করছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি ইচ্ছে করছিল আপনার সঙ্গে কথা বলতে। সেদিন আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ নিজে আপনি আমাকে ডেকেছেন। না আসলে মন মানতো না। আর নিজের সঙ্গে আমার ওইসব গার্লফ্রেন্ডদের তুলনা করতে যাবেন না। ওরা আমার অনুভূতিতে ছিল না। আপনি আছেন।”

“আমি আছি তার গ্যারান্টি কী? আমি যে তাদের মতোই একজন নই তার নিশ্চয়তা কী?”

“কী নিশ্চয়তা চান বলুন?”

তানিয়া এবার কিছুটা সময় নীরব রইল। বৃষ্টির আলতো শব্দ শুধু কানে আসছে। হালকা ভিজে গেছে তাদের পোশাক, চুল, দেহ। সেটাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। তানিয়া হঠাৎ বলে ওঠে,
“মা এবার সত্যি আমার বিয়ে নিয়ে বেশি ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।”

তানিয়ার এক কথায় যেন সৌমিত্রের ভেতরটা কাঁপতে আরম্ভ করে। মস্তিস্ক ফাঁকা হতে শুরু করে। তানিয়া আরো বলতে থাকে,
“এতদিন শুধু মা ছিল। এখন বাবা, বড়ো ভাই, মামা সবাই বিষয়টাতে জোর দিচ্ছে। অবশ্য জোর দেবে না-ই বা কেন? বিয়ের বয়স তো হয়েই গিয়েছে আগে। তাদের কোনো দোষ নেই। দোষটা শুধু আমার যে কিনা নিজের জীবনের এতগুলো বছর ভুল মানুষের পেছনে সময় নষ্ট করেছি।”

সৌমিত্রের বুকটা দুরুদুরু করছে। গলা শুঁকিয়ে গেছে। অনুভব করছে তার মনকে চেপে ধরেছে এক আতঙ্ক। সে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কি বিয়ে করতে চান?”

“হ্যাঁ, চাই। কোন মেয়ে অবিবাহিত থেকে পরিবারের বোঝা হতে চাইবে বলুন তো? তাই বিয়ে করতে চাই। তবে এক বছর পর।”

সৌমিত্র থমকায়। চোখমুখ শুকিয়ে উঠেছে তার। ঢক গিলে বলে উঠল,
“কেন?”

“কেন আবার? আপনি ভালো করে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট নিয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবেন। অনেক ফেল করেছেন। এবার আপনাকে সবটা সিরিয়াসলি নিতে হবে।”

সৌমিত্র ফের বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলে,
“কিন্তু কেন?”

তানিয়া এবার বিরক্ত হয়ে ধৈর্যহারা হয়ে বলে,
“কেন আবার? আমার জন্য! বিয়ে করতে চান তো আমাকে? নাকি আমিও টাইমপাস?”

চকিতে তাকায় সৌমিত্র। কানে ভুল শুনেছে নাকি ঠিক শুনেছে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় মনে মনে। অনুভূতিগুলো দলা পাকিয়ে যায়। উত্তেজনায় পাথর হয়ে গিয়েছে যেন সে। খুশিরা বুক ফেটে বেরিয়ে পড়তে চাইছে! কী টানটান সেই অস্থিরতা! সৌমিত্র কাঁপা সুরে শুধালো,
“আপনি সত্যি আমাকে বিয়ে করতে চান?”

তানিয়া দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। নিজের বিয়ের কথা তুলতে তার একটু সংকোচ হচ্ছে বটে। নিচু স্বরে বলে,
“অনেক ভেবে দেখেছি, যে আমাকে নিয়ে অনুভব করে তার দোষ নেই। তার অনুভূতি আমি বাকিদের দিয়ে বিচার করতে চাইছিলাম। সেটা আমার অন্যায়। বিয়ে তো করতেই হবে। তাহলে যে আমাকে নিয়ে অনুভব করে তাকে কেন নয়?”

সৌমিত্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
“আমি রাজি।”

কপাল কিঞ্চিৎ ভাঁজ হয়ে আসে তানিয়ার। সেও দাঁড়িয়ে পড়ে। জানতে চায়,
“কীসে রাজি?”

“আপনাকে আপন করতে।”

লজ্জায় যেন ফুলের ন্যায় নেতিয়ে পড়ে তানিয়া। সৌমিত্রের কাছে তা আহামরি মধুর লাগে। তানিয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
“কিন্তু তার আগে আপনাকে ভালো করে পড়তে হবে। পাশ করতে হবে। আপনার যা রেজাল্ট! প্রতিটা পরিবার চায় তার মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত ছেলের হাতে তুলে দিতে। আমার পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়।”

সৌমিত্র বড়ো শ্বাস ছাড়ে। বলে,
“আমাকে এত বড়ো একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, মিস গোলাপি। এই সুযোগ সৌমিত্র কখনো হাতছাড়া করবে না। সে আপনাকে পেয়ে দেখাবে। মিলিয়ে নেবেন।”

তানিয়া এবার গম্ভীর সুরে বলল,
“তবে একটা শর্ত আছে। আমাদের মাঝে কোনো প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হবে না। আমি এতে আর বিশ্বাস করি না। বিয়ের আগ অবধি আমি বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। যেমনটা এখন আছি।”

সৌমিত্র নিজের বুকের বা বাশে হাত রেখে হাসিমুখে স্বীকার করল,
“এই শর্তও মঞ্জুর করা হলো মিস গোলাপি। আপনাকে যদি শেষ অবধি নিজের স্ত্রী রূপেই পেয়ে যাই তবে প্রেমের সম্পর্ক সেখানেই বেঁধে ফেলব। এমন প্রেমের বাঁধন বাঁধব ছাড়া পাবেন না।”

তানিয়া মুখ ঘুরিয়ে নিলো। প্রচণ্ড লজ্জা লাগছে তার৷ দ্রুত বলল,
“মাকে বলেছি, আমি একজনকে পছন্দ করি তার পড়াশোনা শেষ করতে একটা বছর সময় লাগবে। মা সায় দিয়েছে। মাথায় রাখবেন, বেশি সময় নেই কিন্তু।”

সৌমিত্র হতবিহ্বল হয়ে বলে,
“আপনি আমাকে তবে পছন্দ করেন?”

চমকে ওঠে তানিয়া। চুপসে যায় মুখশ্রী। আমতা আমতা করে বলে,
“জানি না। আপনি যান তো এখন এখান থেকে। তাড়াতাড়ি যান।”

সৌমিত্র অসহায় পানে চেয়ে বলল,
“নিজেই ডেকে আবার নিজেই এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছেন মিস গোলাপি? ঠিক আছে। চলেই যাচ্ছি।”

সৌমিত্র হাঁটা ধরে। সিঁড়ির কাছে চলে আসে। তৎক্ষনাৎ পিছু ডাকে তানিয়া।
“শুনুন!”

সৌমিত্র ফিরে তাকায়। তানিয়া তার নিকটে আসে। একপলক চেয়ে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে,
“আপনিও বদলে যাবেন না তো?”

সৌমিত্র স্নিগ্ধ হাসে। তার কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি তানিয়ার কনিষ্ঠা আঙ্গুলের সঙ্গে মিলিয়ে সামনে তুলে ধরে বলে,
“কথা দিলাম, এমনই থেকে যাব আজীবন।”

বিছানায় একা বসে আছে স্বচ্ছ। রাত তখন এগারোটা। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে আকাশটা থমথমে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে হিম শীতল হাওয়া। ঘরটা অন্ধকার করে রেখেছে সে। মোহের সঙ্গে থাকাকালীন সবটা সুন্দর ছিল। এখন একা থাকতে থাকতে মনে পড়ছে অতীতের কথা। সরোয়ার সাহেবের সঙ্গে কাটানো তার মুহূর্ত মনে পড়তেই দম বন্ধ লাগছে তার। কেমন করে যেন বুকের উপর পাথর রেখে নিজের বাবাকে পু/লিশের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করল সে। এই বাবাই তাকে প্রথম হাঁটতে শিখিয়েছিল। স্বচ্ছের পাশে তার ছোটোবেলার এলবাম। ছবিতে স্বচ্ছ মাত্র দশ মাসের বাচ্চা ছেলে। সরোয়ার সাহেব তাকে কাঁধে নিয়ে চওড়া হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এলবামের পাতা উল্টাতে থাকে স্বচ্ছ। দেখতে পায় নিজের একটু বড়ো বয়সের ছবি। হয়ত দশ বছর হবে! তার জন্মদিন ছিল। একপাশে মা অন্যপাশে বাবা। মাঝখানে বার্থডে বয় স্বচ্ছ। অবশ্য মিসেস জেবার কোলে ছোট্ট ফারাহ এবং সরোয়ার সাহেবের কোলে চঞ্চল সৌমিত্র রয়েছে। সুখি একটা পরিবার ছিল তার। এক পা/পের কারণে সবটা নষ্ট হয়ে গেল। ঢোক গিলে এলবামটা বন্ধ করে স্বচ্ছ। আর দেখার সাহস হচ্ছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় সে। রুমের বাহিরে চলে যায় দ্রুত৷

না ঘুমিয়ে একা একা বিষণ্ণ মনে বসে রয়েছেন মিসেস জেবা। মুখটা ফ্যাকাশে, মলিন। বারবার তাকাচ্ছেন রকিং চেয়ারের দিকে নয়ত বিছানার অন্যপাশে। সরোয়ার সাহেব থাকলে এই দুটো জায়গাতে কোথাও থাকতেন নিশ্চয়৷ স্বামী ছাড়া ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে উনার। কাঁদতে গিয়েও থেমে যাচ্ছেন উনি। আচানক ছেলের গলা পেয়ে হকচকিয়ে ওঠেন।
“মা, ঘুমাও নি?”

মিসেস জেবা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন,
“এইতো ঘুমাচ্ছিলাম। তুমি এত রাতে? কিছু দরকার?”

“আমি জানি তোমার স্বামীকে মিস করছ।”

এই কথা বলে সোজা এসে মায়ের কোলে মাথা শুয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল স্বচ্ছ। মিসেস জেবা হতাশা নিয়ে বলেন,
“এতগুলো বছর একসাথে কাটিয়েছি। মনে তো পড়বেই। কখনো ভাবতে পারিনি উনার করা এসব ভুলের পরিণতি এমন হবে।”

“আমিও ভাবতে পারিনি যেই মানুষটাকে আমি আদর্শ মানতাম সে এতটা নিচে নেমে যাবে।”

“তোমারও নিশ্চয় মন খারাপ করছে বাবার জন্য?”

স্বচ্ছ উত্তর করে না। তবে মিসেস জেবা বুঝে নেন ছেলের মনের কথা। উনিও কিছু না বলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। কিছু সময় পর জিজ্ঞেস করে,
“মোহের সঙ্গে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটেছে?”

“হুমম। তোমার হবু বউমা প্রচণ্ড একগুঁয়ে। রগে রগে তার জেদ। নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে আমাকে।”

মিসেস জেবা সামান্য শব্দ করে হেসে বলেন,
“হুঁ, এমন মেয়েই তো দরকার তোমার জন্য। নয়ত সোজা থাকবে কী করে!”

“হ্যাঁ, তুমি তো সেটাই চাও।”

এরপর মিসেস জেবার মুখ ভার করে বললেন,
“নিজেকে নিয়ে কী ভেবেছ? বোনকে তো বিয়ে দিলে। বিয়ে তো তোমারও করা প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে তোমাকে তো কিছু করতে হবে। তুমি কি বাবার মতোই রাজনীতি…”

স্বচ্ছ সঙ্গে সঙ্গে তিক্ত হয়ে বলে ওঠে,
“না, কখনোই না। এই রাজনীতি এখন আমার চোখের বিষ। এটা নিয়ে আমি ভাবতেই চাইনা। আমি সাধারণ হয়ে বাঁচতে চাই এবার। শান্তি চাই। নিজে কিছু করতে চাই। কিছু জায়গায় চাকরির এপ্লাই করেছি। ইন্টারভিউ আছে কিছুদিন পর।”

মিসেস জেবা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন। উনি নিজেও চান না তার কোনো ছেলে আর রাজনীতির বিষয় নিয়ে ভাবুক। স্বচ্ছ আরো বলে,
“এই বাড়ি, টাকাপয়সা, বিলাসিতা সব আমি ত্যাগ করতে চাই, মা। একদিন মন্ত্রী মশাইকে কথা দিয়েছিলাম এসব বিলাসিতা আমার দরকার নেই। আবার ফিরে এসেছি। কিন্তু শুধুই সেটা আমার পরিকল্পনার অংশ ছিল। আমি আমার কথা রাখতে চাই। এসব কিছু আবার ত্যাগ করতে চাই। যা করব, নিজে করব।”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬ [দ্বিতীয় খণ্ড]

গোলাপ ও রজনীগন্ধার সম্মিলিত সাজানো সুন্দর বিছানা ছেড়ে খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফারাহ। পরিবেশ ভীষণ শান্ত। বাহিরের ঠাণ্ডা বাতাসে তার শীত অনুভূত হলেও সে অন্যমনা। বাবার কথা মনে পড়ছে খুব। ন্যায় বা অন্যায় যাই করুক লোকটা দিনশেষে বাবা মানুষটার প্রতি অনুভূতি কারোরই কম নয়। এতটা অন্যায় না করলেও পারত মানুষটা। আনমনে ফারাহ দুই বাহুতে স্পর্শ উপলব্ধি করে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তার চোখ বড়ো বড়ো করা দেখে শৌভিক স্মিত হেসে শুধাল,
“ভয় পেয়েছেন, ম্যাডাম?”

“এভাবে হঠাৎ করে এলে ভয় পাব না?”

শৌভিকের হাসি প্রগাঢ় হয়।
“আর ভয় পাবার দরকার নেই। বুঝে নিন, এই হঠাৎ হঠাৎ স্পর্শ করার অধিকার একজনই পেয়েছে। সে হচ্ছে শৌভিক মীর।”

ফারাহ শৌভিকের পানে ফিরল। শৌভিকের ফে;টে র/ক্তাক্ত হয়ে যাওয়া ঠোঁটের কোণ, ফোলা গালে হাত আলতো করে বুলিয়ে ব্যথিত সুরে বলল,
“খুব লেগেছে না? আমার ভাইটা একদম পা/গল।”

“হুমম আমার বোনটাকে পা/গলের মতো ভালোবাসে। তবে মুখে এতদিন তালা দিয়ে ছিল। আজকে তো পারে না সে আমাকে মে/রে ফেলে। মনে হচ্ছিল যেন ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছি জানো? কিন্তু বোঝেই না। শেষে উল্টো আ;ঘাত করতে হলো তাকে।”

ফারাহ দীর্ঘশ্বাস নিলো। শান্ত সুরে বলল,
“এখন দুজনের বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে শান্তি পাই।”

ফারাহকে এবার অন্যদিকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে তাকে আলগা করে জড়িয়ে ধরল শৌভিক। কম্পন খেলে গেল ফারাহর শরীরে। প্রথম কোনো পুুরুষ তার এত সংলগ্নে। পুরুষটির শরীরের উষ্ণতা তার মস্তিষ্ক ফাঁকা করে ফেলছে। পুরুষদের ব্যবহৃত পারফিউম তার নাকে বাড়ি খাচ্ছে। শৌভিকের হালকা দাড়ির খোঁচা লাগছে ফারাহর উন্মুক্ত গলায়। ফারাহ ভারি গলার গয়না বিরক্তিতে খুলে রেখে দিয়েছিল তারই সুবিধা যেন লুফে নিচ্ছে শৌভিক। ফারাহ দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো। পাথরটার বাইরে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও ভেতরটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। শৌভিক শীতল কণ্ঠে জানতে চাইল,
“কী নিয়ে এত অন্যমনস্ক ছিলেন ম্যাডাম?”

ফারাহর উত্তর দিতে দেরি হয়। কণ্ঠ যেন কেউ রোধ করে রেখেছে। নিচু স্বরে বলে,
“বাবাকে নিয়ে চিন্তা করছিলাম।”

“মন খারাপ হচ্ছে উনার জন্য?”

ফারাহর কণ্ঠ দিয়ে আর সুরই বের হলো না। হাঁসফাঁশ করছে শুধু। শৌভিক আচানক তাকে ছেড়ে দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠল। তার দিকে ফিরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ফারাহ। শৌভিক বলল,
“আমার এতটুকু স্পর্শতেই দেখি ডিজাইনার ম্যাডাম বোবা হয়ে গেছে। অথচ এখনো কত কিছু বাকি!”

ফারাহর মুখটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেল। চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জা পেল বোধহয়। শৌভিক তা দেখে তার চিবুক ধরে বলল,
“লাফিয়ে, লাফিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার আগে মনে ছিল না যে এই শৌভিকের ছোঁয়া লাগলে তার সাইড ইফেক্ট কী কী হতে পারে?”

ফারাহর চোখমুখ লাল হলো। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে তেজ নিয়ে বলল,
“জীবনে প্রথমবার এভাবে কোনো পুরুষের কাছাকাছি হয়েছি বলে কেমন যেন লাগছে। এতে নিজে ক্রেডিট নিয়ে নিজেকে বাহবা দেওয়ার কিছু নেই।”

শৌভিকের ফা/টা ঠোঁটের হাসির রেখা আরো বাড়ল। মেয়েটা ভাঙবে তবে মচকাবে না। পাশে টেবিলে রাখা দুটো কফির কাপ নিয়ে কথা একটা কাপ হুট করে ফারাহর সামনে ধরে বলল,
“নেন ধরেন। সারাদিন অনেক ধকল গেল। কফি খেলে ভালো লাগবে। আমার হাতের কফি কিন্তু! বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর বানানো কফি খেতে পারছেন। ইশশ…কী ভাগ্য আপনার!”

ফারাহ খপ করে কাপটা নিয়ে কফির কাপে চুমুক দিলো। দারুণ হয়েছে স্বাদটা। প্রশংসা না করলেই নয়। তবে শৌভিকের স্পর্শের রেশটা সে কাটাতে পারছে না। মস্তিস্ক এখনো সেই ব্যাপারে ভাবছে। তার অস্বস্তি লাগছিল বটেই। তবে অস্বস্তির ধরণটা ছিল ভিন্ন। সেই অস্বস্তি বারবার পেতে চাইবে মন। গলা খাঁকারি দিয়ে ফারাহ শুধাল,
“সত্যি আপনার বানানো?”

“জি। কোনো সন্দেহ?”

“না। তবে কফিটা দারুণ বানান আপনি।”

শৌভিক কিছু একটা ভেবে বলল,
“চাইলে তোমায় রোজ বানিয়ে দেব মিসেস। তবে একটা কন্ডিশন আছে।”

ভ্রু কুঁচকায় ফারাহ। একটু আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,
“কী সেটা?”

মুহূর্তের মধ্যে ফারাহর ডান গালে এক উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো ব্যাপারটা ঘটিয়ে অমায়িক হাসি দিলো শৌভিক। ফারাহর হাত চলে গেল তার গালে। শৌভিক বলল,
“প্রতিটা দিন যদি এমন তুলতুলে গালে চুম্বনের সুযোগ পাওয়া যদি যায় তো… ”

কী প্রতিক্রিয়া জানাবে জানা নেই ফারাহর। ঢক গিলে নিজের অসম্পূর্ণ কফিটা রেখে দিলো কাঁপা হাতে৷ তার আর কফি পান করার মতো শক্তি বা সামর্থ্য নেই। অন্তর উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। শৌভিক থামল না। ফারাহর থুঁতনি ধরে মুখ উঁচু করল। ঘামতে আরম্ভ করল ফারাহ। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। শুধু অনুভব করল তার কপালে কেউ তার ঠোঁটের পরশ আঁকছে। ফারাহর এমন নাজেহাল, লাজুক অবস্থা দেখতে বেশ লাগছে শৌভিকের। তবে সে রুখতে চায় না। সে নিজের ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে যেতেই আচানক উচ্চ শব্দে বেজে ওঠে শৌভিকের ফোনের রিংটোন। ফারাহকে ছেড়ে দাঁড়ায় শৌভিক। টেবিলে ফোনটাকে বাজতে দেখে ইচ্ছে করল যে কল করেছে তার গলা টি/পে দিতে। শৌভিক গটগট করে গিয়ে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে নীলয়ের নামটা৷ দাঁতে দাঁত চেপে কলটা রিসিভ করে সে। ফারাহ দ্রুত বিছানায় বসে হাঁপাতে থাকে। সে শুনতে পায় শৌভিক রেগে বলছে,
“সবে তো ভালো করে বউকে চুমুটা খাচ্ছিলাম। মাঝখানে তুই নাক গলিয়েছিস কেন?”

ফারাহ যেন এবার মাটির সাথে মিশে যায়। শৌভিক ফের বলে,
“এইরাতে যদি আর একটা কল আসে তোদের কারোর বাসর রাত সফল দিতে দিব না বলে দিলাম। রাখ শা/লা।”

কল কাটে শৌভিক। ফারাহ মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে,
“কী বলছে ওরা?”

শৌভিক গিয়ে ফারাহর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কাজের কিছু কথা বলতে আমাকে এইরাতে কল দিয়েছিল।”

ফারাহ প্রত্যুত্তর করল না। শৌভিক তার সামনে নিচু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তার কোলে হাত রেখে বলল,
“আজ রাতটাই কিন্তু আপনার সময় ম্যাডাম। যা খুশি তাই করতে পারেন। এরপর কিন্তু চাইলেও আপনার বর আপনাকে সময় দিতে পারবে না।”

মুখ ফিরিয়ে নিলো ফারাহ। সে শৌভিকের সঙ্গে চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। কী বিড়ম্বনা!

সকাল হয়েছে। চড়া রোদে পরিবেশ উত্তপ্ত। ঝলমলে রোদ্দুরের চোটে বাহিরের দিকে চোখ রাখায় দায়। যেন বহু সময় পর সূর্য মেঘের বন্দিদশা কাটিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিজের কিরণ ছড়াচ্ছে। সেই কিরণ দেখার সুযোগ পান না সরোয়ার সাহেব। উনাকে একটা একটি ছোটো কা/স্টারিতে রাখা হয়েছে। যেখানে অন্ধকার। সামান্য কৃত্রিম আলো দিয়ে উনার কিছুই হচ্ছে না। সকালের খাবার দেওয়া হয়েছে অনেক আগে তবে সেটা তেমনভাবেই পড়ে আছে। এখনো উনার চোখের সামনে ভাসছে উনার সুখের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। তবে এবার উপলব্ধ করতে পারছেন এসবের জন্য শেষমেশ উনি নিজেই দায়ি। হঠাৎ গেইট খোলার শব্দ। উনি মাথা তুলে তাকালেন। একজন দারোগা বললেন,
“আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে। সামনাসামনি দেখা করতে পারেন। আমার সাথে চলুন।”

সরোয়ার সাহেব জানেন কে এসেছে। শক্ত চৌকির তক্তা ছেড়ে উনি উঠে গেলেন ওয়েটিং রুমে। দরজা খুলতেই সেখানকার বেঞ্চে বসে থাকতে দেখলেন উনার স্ত্রীকে। মিসেস জেবা উনার দিকে একমনে চেয়ে রয়েছেন। পাশে রাখা টিফিন বক্স। ধীর পায়ে মিসেস জেবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন সরোয়ার সাহেব। স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সৎ সাহসটাও উনি পাচ্ছেন না। আচমকা মিসেস জেবা জানতে চাইলেন,
“কেমন আছেন মন্ত্রী সাহেব?”

সরোয়ার সাহেব নীরব। মুখে কোনো কথা নেই। জবাবে কী বলবেন তা নিয়ে দিশাহারা। মিসেস জেবা তৎক্ষনাৎ হালকা হেসে বললেন,
“ভালোই আছেন নিশ্চয়! ভালো থাকারই কথা। আমার সুন্দর সাজানো-গোছানো সংসার সব নষ্ট করে দিয়ে নিশ্চয় অনেক ভালো আছেন আপনি!”

এত অভিমান, এত ঘৃণা নিয়ে কথা বলতে মিসেস জেবাকে কখনোই দেখেননি সরোয়ার সাহেব। তিনি বিচলিত হয়ে বলেন,
“না, জেবা। আমি…”

“কোনো কথা আপনি বলবেন না আজকে। আমি বলতে এসেছি। আমি জানতে চাই, এতকিছু করে আপনি কী পেলেন?”

সরোয়ার সাহেবের মাথা নত হলো। একরাশ যাতনা নিয়ে বললেন,
“আমি জানি না। নিজের উদ্ধতকে আমি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম যে এভাবেই হয়ত আমার পতন হওয়ার ছিল।”

মিসেস জেবার চোখের কোণে সামান্য পানি জমা হয়েছে। তা দেখতে দিলেন না তিনি সরোয়ার সাহেবকে। নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনার এই উদ্ধত আমার সংসার, আমার এত বছরের স্নেহ ও মায়া আগলে রাখা স্বামী আর সন্তান নিয়ে তৈরিকৃত ছোট্ট পৃথিবীকে ভেঙে দিলো। শেষ করে দিলো। আপনি আমাকে সর্বস্বান্ত করে দিলেন মন্ত্রী সাহেব।”

সরোয়ার সাহেব মিসেস জেবার পাশে বসলেন। চোখ বুঁজে বললেন,
“আমি এসব চাইনি জেবা।”

“এখন তো এটা বলে লাভ নেই। যা করার আপনি করে ফেলেছেন। আপনি আমাকে কখনো ভালোও বাসেন নি তাই না?”

সরোয়ার সাহেবের ভিত নড়ে উঠল যেন। বাকহারা হয়ে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। কী বলবেন তিনি? মিসেস জেবা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাচ্ছেন। নিজেকে ধাতস্থ করে তিনি বললেন,
“আসলেই ভালো বাসেন নি। বিয়ে করেছিলেন রাজ/নৈতিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার জন্য। যেমনটা স্বচ্ছের বিয়ে দিতে চাইছিলেন অন্য একটা মেয়ের সাথে! ঠিক তেমনভাবে আপনিও হিসেব-নিকেশ করে আমাকে বিয়ে করেছিলেন।”

সরোয়ার সাহেবের সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল যেন। শুকনো মুখে অনুরোধ করলেন,
“এসব বলো না, প্লিজ!”

মিসেস জেবা নিজেকে সামলে নিলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“ঠিক আছে। জানো ফারাহর বিয়ে হয়েছে? তাও শৌভিকের সঙ্গে ওর বিয়ে আমি নিজে দিয়েছি। ওর মতো ছেলে পাওয়া মুশকিল। ইচ্ছে ছিল, ধুমধাম করে মেয়েটার বিয়ে দেব। সেটাও অপূর্ণ রয়ে গেল। কী হতো যদি সব মেনে নিয়ে ছেলেমেয়েদের অনুভূতির মর্ম বুঝে তাদের মেনে নিতে?”

সরোয়ার সাহেব এবার নিশ্চুপ। মিসেস জেবা জানেনই যে আজ উনার স্বামী একটা জবাবও দিয়ে উঠতে পারবে না। তিনি আবার বলেন,
“যদি মেনে নিতে তাহলে কাল আমরা সবাই বড়ো করে মেয়ের বিয়ে দিতাম৷ স্বচ্ছকেও আমি নিজে বিয়ে দেব। আমার খুশি লাগছে যে ছেলেটা তোমার মতো রাজ/নীতি বেছে নিবে না। ও নিজে কিছু করবে। সৌমিত্রও পরীক্ষায় পাশ করে গেলে নিজে থেকে কিছু করতে পারলে ওর পছন্দমতো বিয়ে দেব। আফসোস, যে পরিপূর্ণ পরিবার আমরা হতে পারব না।”

মুখ খুললেন সরোয়ার সাহেব। প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে বললেন,
“আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি জেবা৷ আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবে?”

মিসেস জেবা দম ফেলে বলেন,
“জানি না।”

“ঠিক আছে।”

সরোয়ার সাহেবের ভাঙা কণ্ঠে হতাশা। মিসেস জেবা আরো বলেন,
“আমি চলে যাচ্ছি। এই শহরটা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাবার বাড়ি যাব। এই ভাঙাচোরা সংসারে আর থাকতে মন চাইছে না।”

“কেন এই সিদ্ধান্ত নিলে জেবা?”

মিসেস জেবা বিষণ্ণ মুখে উত্তর দিলেন,
“কারণটা তো প্রথমেই বললাম। ওই বাড়িতে থাকলে এখন শুধু ভেতর থেকে বারবার ভেঙে পড়ব। তা আমি চাইনা। বাবার বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে মা-বাবা মা/রা যাবার পর থেকে। সৌমিত্রকে নিয়ে সেখানেই চলে যাব ঠিক করেছি।”

সরোয়ার সাহেব কৌতূহলী হয়ে শুধালেন,
“আর স্বচ্ছ?”

“ওইযে বললাম ও নিজে কিছু করবে। তবুও চেষ্টা করব আমার সাথে ছেলেটাকে রাখতে। ছেলেটা তোমার বিরুদ্ধে গেল ঠিকই কিন্তু তোমার আদর্শ বাবার চরিত্র সে ভুলতে পারেনি। কাল স্মৃতিচারণ করছিল। যদি ওমনই থাকতে তাহলে আমাদের পৃথিবীতে সুখের অভাব হতো না।”

নিজের কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস জেবা। সময় শেষ হয়েছে। সরোয়ার সাহেব নিজের উদ্ধতের আগুনে নিজে ছাই হয়ে গিয়েছেন আজ। মুখ দিয়ে বলার মতো কোনো শব্দ বেঁচে নেই। মিসেস জেবা হাফ ছেড়ে বলে ওঠেন,
“গেলাম আমি। আর নিজহাতে খাবার তৈরি করে নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। মন চাইলে খেয়ে নিও।”

মিসেস জেবা যাওয়ার জন্য উদ্যত হোন। অতঃপর পিছু ফিরে ফের স্বামীর মুখটির দিকে চেয়ে ভীষণ আশা নিয়ে বলেন,
“তোমার শা;স্তি তো কেউ আটকাতে পারবে না। যতই বড়ো আইনজীবী ঠিক করো। তোমার বিপক্ষের প্রমাণগুলো অনেক জোরালো। শা/স্তিটা হবেই। তবে এই আশা করছি যে আমি কখনো আমার সেই আগের মানুষটিকে ফিরে পাব। স্বপ্ন দেখতে তো ক্ষতি নেই।”

থম মে/রে বসে রইলেন সরোয়ার সাহেব। নিজের স্ত্রীর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন। হাতে টিফিন বক্স নিয়ে সেটা খুলে একটুখানি খাবার মুখে দিলেন। ঠিক করলেন নিজের পক্ষে কোনো আইনজীবী রাখবেন না।

বিকেলে নিজের কিছু পোশাক ভাঁজ করে নিজের লাগেজে তুলছিল স্বচ্ছ। মায়ের অনেক বোঝানোর পর সে অবশেষে নিজের নানুভাইয়ের বাড়িতে যেতে রাজি হয়েছে সে। আর যাই হোক সে এই বাড়িতে থাকতে চায় না। মিসেস জেবা তার সামনেই বসে আছেন। তিনি খানিকটা চিন্তিত হয়েই জিজ্ঞেসা করলেন,
“তুমি নিশ্চিত যে তোমার একাউন্টের টাকাগুলো সব বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে দেবে?”

স্বচ্ছ কোনোকিছু না ভেবেই উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, মা। এছাড়াও কিছু গরীবদের জন্য করা ফাউন্ডেশন, অবলা প্রাণীর ফাউন্ডেশনে সব ভাগ করে দিয়ে দেব।”

মিসেস জেবার মন মানতে চাইছে না। তিনি স্বচ্ছকে বোঝাতে চাইলেন।
“কিন্তু তুমি তো এখনো কিছু করছ না। প্রয়োজনীয় টাকা কোথায় পাবে? আর সত্যি তো এটা তুমি যেই বিলাসিতা দিয়ে বড়ো হয়েছ সেসব টাকা ছাড়া সম্ভবই নয়। অন্তত তোমার কোনো চাকরি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওসব রাখো।”

“না, মা। না জানি কত কারোর পাওনা আর অধিকারের টাকা আমার একাউন্টে পড়ে আছে। এতগুলো টাকা বৈধ নয় মা। এসব টাকা খরচ করার অধিকারও আমি রাখি না। আর বিলাসিতা? সেসব কবেই বাদ দিয়ে দিয়েছি। এসব বিলাসিতা আমার কাছে অ/ভিশাপ লাগে। তুমি আর মানা করো না আমাকে।”

স্বচ্ছ সাফ নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। শুধু সে নয় একই সৌমিত্র নিজেও একই জেদ ধরে বসেছে। তবে স্বচ্ছের কথাতে এবার মিসেস জেবা নিজেও ভাবতে লাগলেন বিষয়টা নিয়ে। এদিক থেকে তারা দুই ভাই ঠিক আছে। কিন্তু তাদের যাবতীয় খরচ বলেও তো একটা বিষয় রয়েছে। এসব চিন্তার মাঝে হঠাৎ মিসেস জেবার মনে পড়ল উনার বাবার দেওয়া কিছু টাকার কথা। বৃদ্ধ মানুষটি মেয়ের বিয়ের সময় মেয়েকে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু টাকা দিয়েছিলেন অন্য একটি একাউন্টে। সেসব টাকা আজও একই পরিমাণে একাউন্টে রয়েছে। তিনি চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ছেলেকে উৎসাহ দিয়ে বললেন,
“তোমাদের সিদ্ধান্তকে আমি সমর্থন করি আর গর্বও করি। তোমাদের মাঝে অন্যের অধিকার কেঁড়ে নেওয়ার মতো আকাঙ্ক্ষা নেই সেটার জন্য আমার শান্তি।”

মা ছেলের কথা মাঝে স্বচ্ছের ফোনে কল এলো। মোহের নম্বরটা কিছু না ভেবেই মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে কিছুটা জানালার কাছে গিয়ে কল রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো, মিস।”

“আপনি আমার বাড়িতে আসতে পারবেন?”

অন্য কোনোরকম কথাবার্তা ছাড়াই সরাসরি মোহের এমন জিজ্ঞাসা স্বচ্ছকে ব্যস্ত করে তুলল৷ সে উৎসুক হয়ে বলে উঠল,
“কবে?”

“আজই আসতে হবে আর এখনি আসতে হবে। পারবেন?”

কথা বলতেও কেমন যেন আতঙ্ক কাজ করছে মোহের মনে। তবে সে তা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। স্বচ্ছ হতবিহ্বল হয়ে ফের জানতে চায়,
“যেতে তো পারব কিন্তু কেন? আচ্ছা কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? কিছু তো বলো। কোনো বিপদ হয়েছে?”

মোহ থেমে থেমে জবাবে বলে,
“ধরে নিন তাই। আপনি দেরি করবেন না। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”

স্বচ্ছকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কলটা কেটে দিলো মোহ। ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় সে। মিসেস সুফিয়া একভাবে তার দিকে চেয়ে আছেন এবং তার কথাগুলো শুনছিলেন। মিসেস সুফিয়া গম্ভীর স্বরে বললেন,
“কী বললো? আসবে?”

মোহ শুধু মাথা নাড়ালো। এর আগে নিজের মাকে এতটা রেগে যেতে দেখেনি সে। একপ্রকার চলন্ত বো/ম হয়ে ঘুরছে যেন। যখন তখন ফে/টে যেতে পারে এমন অবস্থা। আজহার সাহেব স্ত্রীকে শান্ত গলায় বলে ওঠেন,
“সুফিয়া এসব কী করছ? আগে এসব নিয়ে তো ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন। কিন্তু তুমি…”

মিসেস সুফিয়া গর্জে উঠলেন।
“তুমি চুপই থাকো। আজ তোমার কোনো কথা আমি শুনব না। বাবা-মেয়ে মিলে অনেক জ্বালিয়েছ। নিজের ইচ্ছে মতো তোমরা যা ইচ্ছে করে গেছো আমি কিন্তু কিছু বলিনি। তবে সবসময় আমি কি চুপ থাকব নাকি? আজ আমি যা চাইব তাই হবে।”

স্ত্রীর এমন অগ্নি রূপ দেখেই নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন আজহার সাহেব। বাবা-মেয়ে চোখাচোখি করল। দুজনেই কিছু বুঝতে পারছে না। আজকে মিসেস সুফিয়া কোথা থেকে যেন সম্বন্ধ এনেছিলেন মোহের জন্য। ছেলে ব্যাংকের ম্যানেজার। তবে মোহ বিষয়টিতে রাজি হয় না। মিসেস সুফিয়া ভালো করেই মোহকে বোঝাতে চান। মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ে তো করতেই হবে। তবুও মোহ নাকচ করলে তা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে বেশ রাগারাগি করেন মিসেস সুফিয়া। এরপর হুট করে মুখ ফসকে মোহ স্বচ্ছের নামটা বলে ফেলে। তারপর থেকেই মায়ের এমন ক্রোধান্বিত ভাবমূর্তি দেখে চলেছে সে। যা আগে মোহ কখনোই দেখেনি। তার জানা নেই আজ কার উপর শনি রয়েছে!

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭ [দ্বিতীয় খণ্ড]

মোহের বাড়িতে অবস্থান করছেন মিসেস জেবা। সোফায় বসে রয়েছেন তিনি। পাশে রয়েছে স্বচ্ছ। তার চোখেমুখে অস্থিরতা। মিসেস সুফিয়া তাদের সামনে ছোটো কাঠের টেবিলে চায়ের ট্রে রাখলেন এবং মিসেস জেবাকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
“আপনিও এসেছেন! ভালো হয়েছে। আলাপটা আরো বেশি ভালো হবে। আমি মোহকে বলেছিলাম আপনার ছেলেকে ডাকতে। ও নিজে থেকে ডাকেনি।”

মিসেস জেবা গলা খাঁকারি দিয়ে জানতে চাইলেন,
“হঠাৎ এত জরুরি তলবের ব্যাপারটা আসলে বুঝতে পারছি না। যদিও ব্যাপারটা ভালো হয়েছে। আমিও আজ না কাল আপনাদের বাড়িতে আসতাম। কিন্তু আমার ছেলে কি কোনো অপরাধ করেছে?”

অনেক ভাবনাচিন্তা শেষ করে এবার আজহার সাহেব মুখ খুললেন।
“আসলে আমি দুঃখিত আমার স্ত্রীর এমন আচরণের জন্য। ও হয়তো আমাদের মেয়েকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তা করছে আজকাল তাই…”

আজহার সাহেব নিজের মুখের কথা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। গম্ভীর গলায় মিসেস সুফিয়া উনার কথার মাঝপথে বললেন,
“আমি ডেকেছি কারণ শুধু আমি কথা বলব। আজ দয়া করে তুমি কোনো কথা বলো না। মা হিসেবে আমি কথা বলব। বাবা হিসেবে তো তুমিই মেয়েকে নিয়ে সব কথা বলেছ, সব সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছ। এবার আমাকেও সুযোগ দাও।”

এবার মিসেস সুফিয়া কিছুটা দম ফেলে মিসেস জেবাকে বললেন,
“আপনার ছেলে অপরাধ করবে কেন? সবসময় নেগেটিভ ভাববেন না। আমি শুধু কিছু জানতে চাই।”

স্বচ্ছ কিছু না ভেবেই নির্দ্বিধায় বলল,
“জি বলুন!”

“তুমি আমার মেয়েকে পছন্দ করো?”

কথা আটকে গেল স্বচ্ছের। খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে তাকাল। আচানক তার চোখে ধরা পড়ল ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারীর অর্ধেক অংশ। তার হাত আর উঁকি দিয়ে দেখা দুটো চোখ দেখা যাচ্ছে। এই টানা চোখজোড়া চিনে স্বচ্ছ। কিন্তু মেয়েটা লুকিয়েছে কেন? হয়ত মায়ের এমন রূপ কখনো দেখেনি তাই। স্বচ্ছ এবার অকপটে বলে বসল,
“না। আমার অনুভূতির সাথে পছন্দ করি এই বিষয়টা ঠিক যাচ্ছে না। আমি তাকে ভালোবাসি।”

কথা শেষ করে সেই নয়ন দুটির দিকে অধীর হয়ে চাইল স্বচ্ছ। আড়ালে থাকা মোহ লজ্জা পেয়েছে। চোখ বড়ো বড়ো করে সম্পূর্ণ আড়ালে চলে গিয়েছে। শুধু দেখা যাচ্ছে তার ওড়নার কিছু অংশ। মিসেস সুফিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে বললেন,
“আজকালকার ছেলেমেয়েদের ভালোবাসার উপরে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আমি ছেলে মেয়ে উভয়ের কথা বলছি। আজকাল তোমরা বিয়ে নামক জিনিসটাকে হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলেছ। কেন যেন ভালোবাসা দুই দিন পরপরই হারিয়ে যায়।”

মিসেস জেবা এবার বিষয়টি নিয়ে বলে উঠলেন,
“কিন্তু আমার ছেলে কখনো এসব বিষয় নিয়ে… ”

মাকে পুরো কথা বলতে না দিয়ে থামিয়ে দিলো স্বচ্ছ। মাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“আমার কথা আমাকে শেষ করতে দাও।”

স্বচ্ছ মিসেস সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
“এটা আমি অস্বীকার করব না যে আজকাল ভালো লাগাকে ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করে বিয়ে করার পর সেই সম্পর্ক আর স্থায়ী হচ্ছে না। কিন্তু সবাইকে কি এক আঙ্গুলে গুনলে চলে আন্টি? তাই বলে কি আপনি আপনার মেয়েকে বিয়ে দেবেন না? আচ্ছা, সমস্যা নেই তাকে যদি আপনি বিয়ে না দিয়ে রাখতে চান আমি তাতেও রাজি। তবে বিয়ে দিতে চাইলে শুধুমাত্র আমার সঙ্গেই বিয়ে দিতে হবে।”

মিসেস সুফিয়া চোখ যেন কপালে উঠল। এ ছেলে কি তবে হু/মকি দিচ্ছে? অবশ্য হু;মকি দেওয়াটা তার স্বভাবেই থাকা উচিত। কার ছেলে দেখতে হবে তো। কিন্তু ছেলেটার সামনে দমে গেলে চলবে না। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“তুমি আমাদের হু;মকি দিচ্ছো?”

“মোটেই না। আমার কি সেই ক্ষমতা আছে? আমি প্রকৃত সত্যিটা আগেই বলে দিচ্ছি। আপনার মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে চাইলে আমার মোটেই সহ্য হবে না। আমি প্রচণ্ড হিংসুটে ছেলে।”

স্বচ্ছের লাগামহীন কথাবার্তায় মিসেস জেবা অপ্রস্তুত হয়ে ছেলের হাত চেপে ধরে বললেন,
“স্বচ্ছের কথাতে কিছু মনে করবেন না। ও একটু বেশি সোজা কথা বলে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলে না। আমি বরং মূল কথায় আসি।”

মায়ের কথাতে মোটেও গুরুত্ব দিলো না স্বচ্ছ। মুখের হাসি বজায় রেখে মিসেস সুফিয়াকে বলে ওঠে,
“ঠিক আছে তবুও যদি আপনি আমাকে ভরসা না করতে পারেন তাহলে একটা কাজ করতে পারেন।”

মিসেস সুফিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকান। স্বচ্ছ আজহার সাহেবের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“আঙ্কেল! আপনাদের লাভ নাকি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিল?”

আজহার সাহেব চমকে গিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলেন,
“অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। আমাদের তো একে অপরকে বিয়ের আগে চেনাজানার সুযোগও ছিল না। যেদিন দেখে গিয়েছি তার পরের দিনই বিয়ে। বিয়ের পরেই প্রথম কথা আর চেনাজানা।”

“বিয়ের আগে আপনারা একবার নিজেদের মাঝে কথাও বলেন নি। তাই বলে কি বিয়ের পর আপনাদের মাঝে ভালোবাসা, মায়া জন্মায়নি? অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছিল সেই সুন্দর অনুভূতি। আন্টি, আপনি তো না কথা বলেই আঙ্কেলের প্রতি এক বিশ্বাসে চোখ বন্ধ করে বিয়ে করে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন। তাহলে আমরা কেন পারব না? কেন আমি বিশ্বাসযোগ্য নই?”

দমে না গিয়ে আর পারলেন না মিসেস সুফিয়া। এই ছেলের সঙ্গে পারা মুশকিল। স্বচ্ছ আঁড়চোখে দেখল তার প্রিয়তমা আড়ালে দরজার চাদর ধরে মুখ বের করে হাসছে নিঃশব্দে। আজহার সাহেব এবার আরেকটি বিষয় ভেবে চিন্তিত হলেন। সেই চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়ল উনার মুহূর্তেই। অস্ফুটস্বরে বললেন,
“কিন্তু ইথান…? সবশেষে এই একটা বিষয়বস্তু থেকেই যায়। সেটা হচ্ছে ইথান। স্বচ্ছ, মোহ কখনো ইথানকে ছাড়া থাকতে চাইবে না।”

মোহের টনক নড়ে। সত্যিই তো! স্বচ্ছ তাকে যতটা চায়, ইথানকেও কি ততটা চায়? এ বিষয়ে কখনো তার সঙ্গে কথা হয়নি মোহের। সে উদগ্রীব হয়ে স্বচ্ছের পানে চেয়ে থাকে। স্বচ্ছ নির্বিঘ্নে প্রত্যুত্তর করল,
“আমি কখনোই ওমন মা থেকে তার বাচ্চাকে আলাদা করব না। ইথানকে নিজের মানতে আমার আপত্তি নেই।”

মোহ থাকতে পারে না আর সেখানে। চলে আসে নিজের ঘরে। ইথান বসে চকলেট খাচ্ছিল বিছানায়। কিছুটা মুখের চারপাশে আর বিছানার চাদরে লাগিয়ে ফেলেছে চকলেট। তা দেখে হাতে টিস্যু নিয়ে সে ইথান সামান্য ধমক দিয়ে বলল,
“কী করেছ এটা? তোমাকে পাগল পাগল লাগছে তা জানো?”

মোহ সযত্নে প্রথমে ইথানের হাত আর মুখ মুছিয়ে দেয়। ইথান মোহের ধমকে দাঁত বের করে হাসে। তা দেখে চোখ বড়ো করে তাকায় মোহ।
“সুন্দর পোকা যুক্ত দাঁতের চেহারা আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। বেশি চকলেট খাওয়া বেড়েছে তোমার।”

ইথান মুখ ফুলিয়ে বলল,
“কোথায়? আগে একদিনে একটা করে খেতাম। এখন তো দুইদিনে একটা করে খাই।”

“আরো কমাতে হবে খাওয়া। নাহলে পোকা তোমার দাঁত খেয়ে ফেলবে।”

ইথান যেন মোহের কথা শুনেও শুনল না। সে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে কৌতূহলী হয়ে বলল,
“বাহিরে কে এসেছে? আমি গিয়ে দেখি ওরা চকলেট নিয়ে এসেছে কিনা!”

ইথান সবে যেতে নিলেই মোহ তার ছোটো হাতটা ধরে বিছানায় বসায়। মুখ গোমড়া করে বলে,
“চকলেট আনেনি ওরা। এখন বাহিরে যাওয়ার দরকার নেই। চুপ করে আমার কোলে বসো।”

ইথান কথা না বাড়িয়ে মোহের কোলে বসে। মোহের দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি হেসে তার গাল টেনে দেয়। তাতে বেশ হাসিই পেয়ে যায় মোহের। ছোট্ট ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের সব যাতনা ভুলে যায়। এই ছেলেটাও একদিন বড়ো হবে। তারপর? আর ভাবতে পারে না মোহ। তার মস্তিষ্ক জুড়ে স্বচ্ছ। এই লোকটার তো কোনো দায়বদ্ধতা নেই অন্যের সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার। কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। একটা সন্তানকে ছোটো থেকে বড়ো করে তোলা কোনো মুখের কথা নয়। স্বচ্ছের নিজের স্বাধীন জীবন রয়েছে। সে কেন মোহের জন্য ইথানের দায়িত্ব নেবে? এটা তো তার উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয়? চিন্তায় বিলীন হয়ে যায় মোহের মন।

“যদি সবকিছু মেনেও নিই তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়৷ তোমার নিজের ভবিষ্যৎ কী?”

মিসেস সুফিয়ার এমন প্রশ্নে অবশেষে থমকায় স্বচ্ছ। নিজেকে মনে মনে দোষারোপ করতে থাকে যে সে কেন এতদিনে নিজে কিছু করেনি? মিসেস সুফিয়া স্বচ্ছের কোনো উত্তর না পেয়ে আবার শুধালেন,
“বাবার মতো রাজনীতিতে নাম লেখাতে চাও? বাবার মতো হতে চাও।”

স্বচ্ছ সঙ্গে সঙ্গে কঠিন স্বরে বলল,
“কখনোই না। নিজেকে বাবার জায়গায় আমি কখনো দেখতে চাই না। আমি সবকিছু ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক আর সাধারণ একটা জীবনে নিজেকে দেখতে চাই। সেখানে আমি আপনার মেয়ের উপস্থিতি চাই নিজের স্ত্রী হিসেবে। এটা বলতে আমার কোনো লজ্জা বা দ্বিধা নেই। কিন্তু আমাকে কিছু সময় দেওয়া যাবে? কারণ আমি এখন কিছুই করি না। আমি জানি কোনো পরিবার নিজের মেয়েকে কোনো শিক্ষিত বেকারের হাতে তুলে দেবে না। দেওয়া উচিতও নয়। আমারও বোন আছে। আমি বুঝি। তাই আমি সময় চাই।”

আজহার সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
“আমরা তোমাকে সময় দিতে রাজি। এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। একটা কথা ভেবে খুবই ভালো লাগছে যে তুমি তোমার বাবার মতো হওনি। তোমার মতো সৎ আর সাহসী ছেলে আমি অনেক কম দেখেছি। আর যেখানে ছেলে-মেয়ে দুজনের অনুভূতি দুজনের প্রতি বিদ্যমান। আমরা সময় দিতে বাধ্য। কী বলো মোহের মা?”

নিজের কথা শেষ করে মিসেস সুফিয়ার দিকে চাইলেন আজহার সাহেব। মিসেস সুফিয়া সম্মতি না দিয়ে পারলেন না।

ইথানকে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকা মোহের ফোনে একটি মেসেজ এলো। মোহ মেসেজটি ওপেন করে দেখল স্বচ্ছ লিখেছে,
“আপনার মা-বাবার থেকে সময় চেয়ে নিলাম। এখন শুধু একটা চাকরি আর সময়ের অপেক্ষা। আপনি কিন্তু আমারই হবেন। সেটা আপনার মা-বাবাকেও বুঝিয়ে দিয়েছি। যাওয়ার আগে একটিবার দেখা দিলেন না যে মিস মোহ? আপনার ঝাঁজালো চাহনি মিস করতে চাইনা।”

দোটানায় পড়ে মোহের ছোট্ট মন। সে যেতে চেয়েও যায় না। অনেকটা সময় পর মোহ বসার ঘরে পা রাখল। কিন্তু তখন স্বচ্ছ ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে। দৌড়ে দৌড়ে ইথানও এলো। টেবিলের উপর পড়ে থাকা দুটো চকলেটের বড়ো প্যাকেট ছোঁ মে/রে নিয়ে নিলো মোহ বোঝার আগেই। সেখানে বসে থাকা আজহার সাহেব হেসে উঠলেন। মোহ কিছুটা রেগে বলল,
“একি! ওকে চকলেট কে দিলো? বাবা তোমার কাজ এটা?”

“না, রে মা। আমার কি তোমার বারণ করার পরেও সেই সাধ্য আছে? এটা স্বচ্ছের কাজ। ও ইথানের জন্য রেখে গিয়েছিল।”

ইথান প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে বসল,
“সেটা কে নানুভাই?”

আজহার সাহেব ইথানকে কোলে তুলে বললেন,
“খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবে।”

পার্কের ফাঁকা বেঞ্চের উপর বসে আছে তানিয়া। চোখেমুখে বিরক্তি। কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। প্রকৃতি নিজের হাওয়া দিলেও তানিয়ার শান্তি হচ্ছে না। বারংবার নিজের কোনোমতে বেণি করে আসা চুলের ফাঁকে ছোটো চুল গোঁজার চেষ্টা করছে। মূলত সে অপেক্ষা করছে সৌমিত্রের জন্য। বিকেল হলেও রোদ পুরোপুরি গায়েব হয়ে যায়নি। সে খেয়ালই করেনি তার পেছনে থাকা একজন পুরুষকে। আচমকা পেছন থেকে পুরুষটি প্রশ্ন করে ওঠে,
“কেমন আছো?”

হকচকিয়ে পেছন ফিরে তাকায় তানিয়া। বহুদিন পর নিজের প্রাক্তন রাফাতকে স্বচক্ষে দেখল তানিয়া। সে বিস্মিত রাফাতকে দেখে। নিজেকে সামলে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলো,
“ভালোই আছি। তুমি হঠাৎ এখানে?”

“কেন? আসতে পারিনা? নাকি এই পার্কে শুধু তুমি আসতে পারবে।”

গা যেন জ্বলে যায় তানিয়ার। ভীষণ মেজাজ খারাপ হয় তার। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
“তেমনটা নয়। তুমি পার্কের যেখানে ইচ্ছে যেতে পারতে। কিন্তু তুমি আমার কাছে এসেছ। কেন? কারণ কী?”

রাফাত নরম সুরেই বলল,
“আমি একটু তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম।”

“কথা? কী এমন কথা? আমার মনে হয় তোমার আর আমার মধ্যে যত প্রকার কথা ছিল সব আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে রাফাত। তোমার অহেতুক কথা শোনার সময় নেই আমার। আর তোমার উপস্থিতিও আমার নিকটে ঠিক না। পারলে অন্য কোথাও যাও।”

“আচ্ছা, তোমার মনে আছে আগে আমরা এখানেই আসতাম? গল্প করেছি এখানে বসে তোমার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সময় কীভাবে চলে যেত বুঝতেই পারতাম না।”

তানিয়ার অসহ্য লাগে৷ ক্রোধের সঙ্গে বলে ওঠে,
“আমার ওসব কিছু মনে নেই আর মনে করতেও চাইনা। তুমি কী চাইছ আসলে? তুমি বিবাহিত। তোমার এখন আর অতীত নিয়ে ওসব ভাবা মানায় না।”

রাফাত দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি বিবাহিত জীবনে ভালো নেই তানিয়া। প্রতিনিয়ত যেন আগুনে জ্ব/লছি।”

তানিয়া ভ্রু কুঁচকায়। রাফাতের কথার মানে খুঁজে বের করতে পারে না। রাফাত আরো বলে,
“রিফা আমার জীবনটা অশান্তিতে ভরিয়ে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত এত, এত আবদার ওর! ওর চাহিদা না মেটাতে পারলেই ঝগড়া করে। আর এসব কিছু করে ওর মায়ের কথা শুনে। ওর মা প্রতিদিন ওকে ফোন কলে কুবুদ্ধি দেয়। সেটা শুনে ও বাড়িতে অশান্তি করে, রানির হালে সবার উপর হুকুম চালায়। আমি আর এসব নিতে পারছি না।”

তানিয়া না চাইতেও খানিকটা হেসে ফেলে। রাফাত এই ভেবে অবাক হয় যে আজ আর তার জন্য তানিয়ার কষ্ট হয় না। তানিয়া বলে,
“এসব তোমার আর তোমার স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি বাহিরের মানুষ। আমার সঙ্গে এসব শেয়ার করে কোনো লাভ নেই। তুমি একান্ত অশান্তিতে থাকলে যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভালো হবে সেই ব্যবস্থা করো। আমি তোমার এসব সাংসারিক ঝামেলা শুনতে আগ্রহী নই।”

রাফাত আবেগপ্রবণ হয়ে আরো কিছু বলতে চায়। তবে তানিয়া তার আগেই বলে ওঠে,
“আমার নিজের জীবন আছে। আমার পছন্দের মানুষ আছে।”

রাফাতের কাছে যেন বিষয়টা অবিশ্বাস্য লাগে। এটা সেই তানিয়া তার মানতে কষ্ট হয়। সে ঢোক গিলে বলল,
“তোমার জীবনে অন্যকেউ এসেছে?”

“হ্যাঁ। ও তোমার মতো নয়৷ সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষ। আমাকে পাওয়ার জন্য যেই জিনিসটা ওর একেবারে অপছন্দ সেটার প্রতি ফোকাস করছে। সে পড়াশোনা করছে, চাকরি করবে। নিজের সেই বাউণ্ডুলে জীবন বাদ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে। তোমার মতো একটা ঠক পুরুষের পর আমি ভালোবাসা অনুভূতির প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছিলাম। কিন্তু তাকে দেখার পর সেটা ফিরে পেয়েছি।”

রাফাতের চোখেমুখে যেন অন্ধকার নেমে আসে। তানিয়াকে দেখে যেন মনে হচ্ছে সে তার ভালো লাগার পুরুষটাকে অনুভব করতে করতে কথাগুলো বলছে। হঠাৎ তানিয়ার কানে এলো তার পছন্দের এক ডাকনাম।
“মিস গোলাপি!”

পিছু ফিরে দেখল তানিয়া। সৌমিত্র খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরে। তানিয়া রাফাতের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে সৌমিত্রের পানে ছুটে যায়। অতঃপর বলে,
“এত দেরি করলেন কেন? এই গরমে কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে জানেন?”

সৌমিত্র স্মিত হেসে বলে,
“ভাগ্যিস দেরি করে এসেছিলাম। নাহলে যেসব আপনি নিজের মুখে আমাকে বলতে চান না সেসব শুনতে তো পেলাম।”

তানিয়া হকচকিয়ে বলল,
“সব শুনে ফেলেছেন?”

“ইয়েস ম্যাডাম! প্রথমে ওই ইডিয়টকে আপনার সঙ্গে দেখে খুব রাগ হয়েছিল। ইচ্ছে করছিল চলে যাই এখান থেকে। কিন্তু আপনার কথা শুনে মনটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।”

তানিয়া না চাইতেও হেসে ফেলল ঠোঁট টিপে। সৌমিত্র ফের রাগের সহিত বলল,
“ওর ব্যবস্থা আমি এখনি করব। ওয়েট! আমার বন্ধুদের কল করি।”

সৌমিত্র ফোন বের করতে চাইলে তানিয়া তার হাত ধরে বলে,
“ওভার রিয়্যাক্ট করবেন না। এটা আমার পছন্দ নয়।”

সৌমিত্র তখন তানিয়ার কথা মেনে বলল,
“ঠিক আছে। আপনি যা বলছেন! কিন্তু এরপরে যদি আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে তবে…”

তানিয়া তাকে সেখানেই থামিয়ে দেয়। কপাল কুঁচকে শুধায়,
“আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল?”

“কী কথা?”

“আমাদের মাঝে যেই সম্পর্ক থাকবে তা বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্যকিছু নয়।”

সৌমিত্র এবার সোজা বলে ফেলল,
“ঠিক আছে হবু বউ!”

তানিয়া আবার মুখ ফুলিয়ে ঝাঁজালো স্বরে বলে,
“আবার!”

“আপনাকে রাগাতে কী যে ভালো লাগে! মিস গোলাপির পূর্ণাঙ্গ রূপ ফুটে ওঠে। নামটা সার্থক, সার্থক লাগে।”

তানিয়া আর কিছু বলে না। সৌমিত্রের পাশাপাশি মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে থাকে। এরপর সে জানতে চায়,
“এখন বলুন কেন ডাকলেন?”

সৌমিত্র সরল মনে বলল,
“পড়াশোনা করব তাই।”

চোখ রাঙিয়ে তাকাল তানিয়া। যেন পারে না সৌমিত্রকে ভস্ম করে দেয়। তেজ নিয়ে বলে ওঠে,
“ফাইজলামি পেয়েছেন?”

“আরে না, শুনুন তো। আপনি আর আমি তো এক ডিপার্টমেন্ট। আপনি এত ট্যালেন্টেড! ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাশ করা স্টুডেন্ট। এই বয়সে কি আমার মতো বুড়ো দামড়াকে পড়াতে চাইবে বলুন? পড়াতে চাইলেও একটা লাজলজ্জার ব্যাপার আছে তো। আপনার কাছে বরাবরই আমার লজ্জা কম। হবু বউয়ের কাছে আগেই সব ক্লিয়ার হয়ে থাকা ভালো। তাই তো আপনার কাছে এলাম।”

কিছু না বলে বেশ কিছুটা সময় সৌমিত্রের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তানিয়া। অতঃপর একটা বেঞ্চে বসে সৌমিত্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“খাতাটা দেখি! কী কী টপিক আছে?”

সৌমিত্র বাধ্য ছেলের মতো তানিয়াকে খাতা এগিয়ে দেয়। নিজেও গিয়ে তানিয়া থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে মেয়েটির দিকে এক ধ্যানে চেয়ে থাকে। তার মূল উদ্দেশ্য যে তানিয়াকে দেখা এবং তার সঙ্গে একটু কথা বলা সেটা ঠিকই ধরে নিতে পেরেছিল তানিয়া। এই নারীটার দিকে সৌমিত্র কেন জানে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে থাকতে পারে! এটা কি জাদু?

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]