যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
7

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮ [দ্বিতীয় খণ্ড]

আজ স্বচ্ছের চাকরির ভাইবা। কয়দিন আগেই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে গেছিল স্বচ্ছ। চাকরিটা বেশ বড়োসড়ো কোম্পানির। চাকরির পদ হিসেবে স্যালারিটাও অনেক। স্বচ্ছ বরাবর নিজের মন থেকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল বরাবরই। জীবনে খুব কম রিজেকশন খেতে হয়েছে। যেটুকুও রিজেকশন খেতে হতো সেটাও হয়ত কেউ কেউ তার বাবার ক্ষমতা দেখে পার করে দিয়েছে বরাবর। নিজেকে বেশ ভদ্রভাবে তৈরি করেছে স্বচ্ছ। সাদা শার্ট পড়েছে, ইন করেছে, সুন্দর করে টাই বেঁধেছে। চুলগুলো হালকা ট্রিম করেছে। কয়দিন আগের এলোমেলো স্বচ্ছ এখন নিজেকে গুছিয়েছে বেশ। ওয়েটিং রুমে সে সহ আরো বেশ কিছু পরীক্ষার্থী অপেক্ষা করছিল যারা পাশ করেছে। বেশ কিছু সময় ধরে ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল সে। প্রতীক্ষা করছিল মোহের একখানা ফোন অথবা মেসেজের। মেয়েটা জানত আজ তার জীবনের প্রথম চাকরির ভাইবা। তবুও কেন সে দেরি করছে স্বচ্ছকে সামান্য উইশের মাধ্যমে সাহস জোগাতে? স্বচ্ছ খেয়াল করেছে মোহ আজকাল বেশ উদাসীন হয়ে থাকে। তার কারণ স্বচ্ছের জানা নেই। আচানক তার ফোনে মেসেজ আসে। চাতক পাখির ন্যায় প্রতীক্ষামান স্বচ্ছ ফোনের মোহ নামটা দেখেই উৎসুক হয়ে পড়ে। মেয়েটা লিখেছে,
“মাথা ঠাণ্ডা রাখবেন। আপনার তো হুটহাট মাথা গরম হয়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে। এসব থেকে বিরত থাকবেন। আপনি হারুন বা জিতুন তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এই আমি সবসময় আপনার পাশে আছি। বেস্ট অফ লাক!”

স্বচ্ছের বিষাদ মুখ পরিবর্তিত হয়ে উজ্জ্বলতার রেশ দেখা গেল। শুষ্ক ঠোঁটের কোণে দেখা গেল মন ভুলানো হাসি। মেয়েটা যে মনে স্বস্তির ঝর্ণা বইয়ে দেয় সেটা সে জানে?

ওয়েটিং রুমের স্পিকারে ‘আহিয়ান স্বচ্ছ’ নামটি উচ্চারিত হয়। ধ্যান ভাঙে স্বচ্ছের। ফোন সাইলেন্ট করে এগিয়ে যায় অফিস রুমের দিকে। কাঁচের দরজা খুলতেই সামনে তিনজন কালো কোট পরিহিত ভদ্রলোক দেখা যায়। স্বচ্ছ গলা ঝেড়ে তাদের সালাম দিতেই তাদের মাঝে একজন স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“প্লিজ সিট।”

স্বচ্ছ সোজা হয়ে বসে। একজন স্বচ্ছের সব যাবতীয় সার্টিফিকেট ও ডকুমেন্ট চায়। স্বচ্ছ তা বাড়িয়ে দেয়। অন্য ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন,
“আপনার নাম?”

“আহিয়ান স্বচ্ছ।”

“ডু ইউ নো ইংলিশ?”

“অফ কোর্স।”

“প্লিজ, ইন্ট্রডিউস ইউরসেল্ফ…”

বাকিটা বলার আগেই হঠাৎই তার পাশে স্বচ্ছের ডকুমেন্ট দেখতে থাকা লোকটি প্রশ্ন করা লোকটিকে থামিয়ে দেয়। তিনি কানে কানে কিছু একটা বলেন যা স্বচ্ছ শুনতে পায় না। তারা তিনজনই বেশ গভীর আলোচনা করে স্বচ্ছের দিকে আঁড়চোখে তাকায়। ডকুমেন্ট চেক করা লোকটি সরাসরি স্বচ্ছকে বলে বসেন,
“আপনি তো মি. সরোয়ার সাহেরের ছেলে। তাই না?”

স্বচ্ছ সামান্য ভ্রু কুঁচকায়৷ উত্তর না দিতেই আরেকজন জিজ্ঞেস করেন,
“আপনি একজন এতবড়ো রাজনীতিবিদের ছেলের হয়ে আমাদের এখানে চাকরি করবেন?”

সবার শেষের জনও বলেন,
“আপনার বাবা যা করেছেন তা নিয়ে তো আপনাদের পরিবারকে নিয়ে প্রচণ্ড কন্ট্রোভার্সি চলছে।”

স্বচ্ছের পা থেকে মাথা অবধি কাঁপতে আরম্ভ করে। অপমানবোধে রি রি করে ওঠে শরীর। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে সে থেমে থেমে জবাব দেয়,
“আমি এখানে কাজের জন্যই ভাইবা দিতে এসেছি। যোগ্য মনে হলে আপনারা আমাকে নির্বাচন করবেন। নইলে করবেন না। আমি এখানে আমার ফ্যামিলি বা পার্সোনাল লাইফের ইন্টারভিউ দিতে আসিনি।”

স্বচ্ছের বলা কথাগুলো ঠিকভাবে নিতেই পারেন না ভদ্রলোকেরা। একজন ক্ষেপে গিয়ে বলে ওঠেন,
“আপনার মাঝে বিন্দুমাত্র ভদ্রতা নেই। আপনার এখানে কেন কোথাও চাকরি হবে না এমন অভদ্রতা নিয়ে।”

আরেকজনও সায় দিয়ে বললেন,
“বাবা যেমন সন্তান তেমনই ধাঁচের হবে। আমাদের আগেই নোটিশ করা উচিৎ ছিল।”

স্বচ্ছ উঠে দাঁড়াল। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে বর্তমানে। হিংস্র বা;ঘের ন্যায় টেবিলে থাবা দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলে উঠল,
“দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস, ম্যান। হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকেও লা/থি মা/রে। আমার এমন কোম্পানিতে চাকরির দরকার নেই যেখানে আপনাদের মতো লোক আছে।”

তীব্র ক্রোধের বশে ভদ্রলোকের হাতে থাকা নিজের ফাইল ছিনিয়ে নিয়ে ঘাড় এদিক ওদিক বাঁকাতে বাঁকাতে রুম ছেড়েই বেরিয়ে যায় স্বচ্ছ।

বাইকের উপর বসে বসে গরম গরম চা পান করছে স্বচ্ছ। রোদের তীব্র তেজে ঘাম ছুটছে। সেই জ্বলন্ত রোদে দাঁড়িয়ে নিজের ত্বক পোড়াচ্ছে স্বচ্ছ। নিজের রাগ সে এখনো কমাতে পারছে না। চা পানেও মন বসছে না। বেজে ওঠে তার ফোন কল। পকেট থেকে ফোন বের করে কল কেটে দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মোহের নম্বর দেখে থমকায় সে। রিসিভ করতেই মোহ প্রথমেই যেই প্রশ্নটা করে,
“ভাইবা শেষ?”

“হুমম।”

“এখন কোথায় আপনি?”

স্বচ্ছ গম্ভীর সুরে প্রত্যুত্তর করল,
“আছি আশেপাশে কোথাও!”

“সবসময় পেঁচিয়ে কথা না বললে চলে না আপনার?”

মোহের কথাতে রাগের ধাঁচ বোঝে স্বচ্ছ। মেয়েটা একেবারে ক্ষ্যাপা বিড়ালের মতো। যখনতখন তেড়ে আসে, কথায় কথায় তেজ দেখায়, চোখ রাঙায়। স্বচ্ছের কাছে এসব অতিব প্রিয়। সে কিছু বলতে উদ্যত হতেই মোহ ফের বলল,
“পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকুন আর দশ মিনিটের মধ্যে ইথানের স্কুলের পর যেই পার্ক রোড আছে সেখানে চলে আসুন। দশ মিনিটের এক মিনিটও দেরি হলে বাড়ি চলে যাব।”

মোহ কল কাটে। বিরক্তিতেও সামান্য হাসি আসে স্বচ্ছের। এই নারী বড্ড জেদি! সেও কি কম যায়? একবার বাড়ি গিয়ে দেখুক মেয়েটা সেও ওর বাড়িতেই চলে যাবে। চা শেষ না করেই তার বিল মিটিয়ে মোহের নিকট আসতে বারো মিনিটের কিছু সময় বেশি লেগে গেল। আনমনে মোহের সামনে স্পিডের বাইকটা দ্রুত ব্রেক কষতেই হকচকিয়ে উঠল সে। নেত্রপল্লব দুটি বড়ো করে তাকাল স্বচ্ছের পানে। দেরি করাতে মেয়েটা রাগে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। স্বচ্ছ শুধাল,
“আসতে তো দশ মিনিটের বেশি সময় লেগেছে। চলে গেলে না যে!”

মোহ তৎক্ষনাৎ যেন আগুনের শিখার ন্যায় জ্বলে উঠে উত্তাপ ছড়িয়ে বলল,
“চলে গিয়ে শান্তি আছে? আমি চলে গেলে আপনি কী কাণ্ড বাঁধাতেন আমি জানি না?”

স্বচ্ছ স্মিত হেসে ফের শুধায়,
“এত অশান্তি ভোগ করেও আমার পাশে থেকে যাচ্ছো কেন?”

মোহের ক্রোধের মাত্রা বাড়ল। অনেকটা ধমকে উঠে বলল,
“আপনাকে ছেড়েও শান্তি নেই। আপনি হচ্ছেন আমার শান্তি নামক অশান্তি।”

স্বচ্ছের অকারণেই হাসি পেয়ে যাচ্ছে। তবে মোহ একটু বিরক্ত তো হয়েই এই গরমে। ভ্যাপসা গরমে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখমুখ ঘেমে উঠেছে তার। নাকের ডগায় ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘাম স্বচ্ছের কাছে বেশ আকর্ষণীয় দৃশ্যের মতো লাগছে। তবে মোহ নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট রুমাল বের করে অবিলম্বে স্বচ্ছের কাছে এসে তার কপাল থেকে গালে এবং থুঁতনিতে যত্নের সহিত ঘাম মুছিয়ে দেয়। গরমে সাদা শার্ট ভিজে উঠেছে স্বচ্ছের। মোহ তার গলার কাছের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে আগের থেকে খানিকটা নরম হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন হলো ইন্টারভিউ?”

নিভে যাওয়া স্বচ্ছের ভেতরের আগুন যেন তেতে উঠল। আগের কথা মনে হতেই চোখমুখের রঙ পাল্টালো। মোহ আগ্রহী হয়ে চেয়ে আছে উত্তর জানতে। স্বচ্ছ একটু সময় নিয়ে সরাসরি বলে দিলো,
“মাথা গরম হয়ে গেছিল। রাগ উঠে গিয়েছিল। কিছু কথা বলে চলে এসেছি। মেইন কোয়েশ্চনই করা হয়নি আমাকে।”

মোহ বড়ো নিশ্বাস ছাড়ল। শান্ত সুরে বলল,
“আপনাকে বলেছিলাম যে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে। সবসময় এত রেগে যান কেন?”

“কী করে সামলাতাম? যেখানে আমার ব্যক্তিগত জীবনের দিকে আঙ্গুল তোলা হচ্ছিল। আমার বাবা কী করেছে না করেছে সেসব দিয়ে আমাকে বিচার করা হচ্ছিল! কী করে চুপ থাকতাম?”

মোহের বোধ হলো এবার বিষয়টা। স্বচ্ছের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে শান্তনা দিয়ে বলে উঠল,
“ঠিক আছে। ওটার কথা বাদ দিন। ওরা ব্যক্তিত্বহীন! আপনি নন। আরো অনেক ইন্টারভিউ বাকি। ওটার কথা ভুলে যান।”

স্বচ্ছ কিছু সময় নীরব রইল। অতঃপর ঠাণ্ডা হয়ে জানতে চাইল,
“বাড়ি যাবে তো?”

মোহ আমতা আমতা করে বলল,
“যাব। তবে কিছু কথা ছিল আপনার সঙ্গে।”

“যেতে যেতে কথা হবে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনি ঘামতেই থাকবেন। উঠে পড়ুন, ম্যাডাম।”

স্বচ্ছ মোহের হাতটা ধরে নিজের বাইকের পেছনে বসতে বলে। মোহ উপায়ন্তর না পেয়ে বসে পড়ে স্বচ্ছের পেছনে। তার কাঁধে একহাত রাখতেই বাইক জোরে টান দেয় স্বচ্ছ। অন্যহাতে ঘর্মাক্ত শার্টের পিঠের অংশ চেপে ধরে সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“কী হচ্ছে? ম/রে গিয়ে ভূত হয়ে দুজন সংসার করি সেটা চান? নাকি জীবিত অবস্থায় সংসার করারও ইচ্ছে আছে?”

“চাই তো দুটোই। আপাতত জীবিত অবস্থাতে চাইছি। তাই সাহস রাখো।”

মোহ পরবর্তী জবাব দিলো না। চেয়ে রইল সামনে। ওড়না এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বাতাসে। একহাতে ওড়না চেপে ধরে অন্যহাতে শক্ত করে স্বচ্ছকে ধরল সে। এখনো মনে পড়ে স্বচ্ছের বাইকে যেদিন সে প্রথম বসেছিল সেদিন ছিল বৃষ্টি। ইথানের মাথা ফে/টে গিয়েছিল। প্রচণ্ড বিপদে পড়ে তার বাইকে বসা। সেই বিপদ এবং সাহায্যগুলো প্রণয় বয়ে নিয়ে আসবে কে জানত? হঠাৎ স্বচ্ছ জানতে চায়,
“কী যেন কথা আছে বলছিলে?”

ভাবনায় বিমোহিত মোহের ধ্যান ভাঙে। স্বচ্ছের প্রশ্নে ভেতরটা কিছুটা এলোমেলো হয়। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে উৎসুক হয়ে বলে ওঠে,
“শুনলাম, আপনি নিজের বাবার দেওয়া সব ব্যাংক ব্যালেন্স, সম্পত্তি অস্বীকার করেছেন?”

“হুঁ, করেছি তো। এ কথা কে বলল তোমায়?”

স্বচ্ছ কোনো ভণিতা না করেই উত্তর দিলেও পাল্টা প্রশ্ন করাতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয় মোহ। স্বচ্ছ ফের নিজেই উত্তর দেয়,
“সৌমিত্র বলেছে?”

“হ্যাঁ, বলেছে তো। ভুল কিছু তো বলেনি। আপনি যা করছেন ভেবেচিন্তে করছেন? এইযে এখন চাকরি খুঁজছেন! এসব চাকরি করতে গেলে কষ্ট কতখানি করতে হবে ধারণা আছে?”

“এসব কোনো ব্যাপার না। আমি সজ্ঞানে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওসব আয়েশের জীবন এখন মূল্যহীন হয়েছে আর বিতৃষ্ণা উঠে গিয়েছে।”

মোহ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জানান দিলো,
“আপনি কেন নিজের বিলাসিতা ছাড়বেন? কেন এত কষ্ট করে সাধারণ জীবনযাপন করতে চাচ্ছেন?”

স্বচ্ছ হেসে দেয়। মোহ অবাক হয়।
“কে বলেছে আমি নিজের বিলাসিতা ছেড়ে দিচ্ছি? আমি নিজের সবচেয়ে বড়ো বিলাসিতা ছাড়িনি। ছাড়তে পারব না।”

“কী সেটা?”

“তুমি।”

থমকায় মোহের দুটো নেত্রপল্লব। দ্বিগুণ বেগে টগবগিয়ে ওঠে তার হৃদপিণ্ড। স্বচ্ছ বলতে থাকে,
“ভেবো না মজা করছি। আমি তোমার মাঝে নিজের এমন বিলাসিতা খুঁজে পেয়েছি সেটা বাকি সবকিছুকে হার মানিয়েছে। ওসব কিছু আমার কাছে ফিকে। তুমি আমার বিলাসিতা হয়ে থেকে যাও। প্লিজ!”

মোহের মনে আরেক আশঙ্কা জন্মে মুহূর্তেই। অস্ফুটে বলে ওঠে,
“ইথান…”

স্বচ্ছ থামে। অপেক্ষা করে মোহের পুরো কথা শোনার। তবে মোহ বলে না। স্বচ্ছ জিজ্ঞেস করে,
“কী বলবে? বলো?”

মোহ নিজের অস্থিরতা কাটিয়ে বলতে লাগল,
“ইথানকে আমি ছোটো থেকে নিজের কাছে রেখে বড়ো করছি। সেটা তো আপনি জানেন।”

স্বচ্ছ চুপ থাকে। সে আন্দাজ করতে পারে মোহ কী বলতে চায়। তবে সে আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না। মোহ নিজ থেকে বলে,
“যেই সময় ওর মায়ের দরকার ছিল সেসময় আমি ওর মা হয়ে ওর কাছে রয়ে গিয়েছি। যার নাড়ি ছেঁ/ড়া সন্তান সেও যে চলে গেল। ইথান আমার জীবনের এমন একটা অংশ যে ওকে আমি এক চুল পরিমাণ অবহেলা করতে পারব না। কিন্তু বিয়ের বয়স হওয়ার পর থেকে একটা কথা মাথাতে আসত যে আমার সঙ্গে ওকে কে নিতে চাইবে? মানেও নি কেউ৷ ও আমাকে নিজের মা মানে। ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।”

স্বচ্ছ কিছু না বলে বাইক এক সাইড করে থামায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে স্বচ্ছের উত্তর খোঁজে মোহ। স্বচ্ছ বাইক থেকে নেমে মোহের চোখে চোখ রেখে বলল,
“কী বলতে চাও?”

“বলতে চাইছি যে আপনি আমাকে ভালোবেসে ইথানকে মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু এটা আমার কাছে আপনার প্রতি অন্যায় করছি সেটাই মনে হচ্ছে।”

স্বচ্ছ কোনো জবাব দিলো না পরক্ষণে। ভ্রু কুঁচকে চুপই থাকে। মোহ বুঝে উঠতে পারে না লোকটা রেগে যাবে, নাকি মন খারাপ করবে! হঠাৎ স্বচ্ছ মলিন কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“অনেক তো মায়ের দায়িত্ব পালন করলে। আমি কি বাবার দায়িত্ব পালন করার যোগ্য হতে পারছি না?”

মোহ স্বচ্ছের পানে তাকিয়ে রইল। তার বলার আর কোনো শব্দ নেই৷ স্বচ্ছ আবারও বলে,
“মানুষ যাকে ভালোবাসে তার সবটাকে ভালোবাসে। ইথান তোমার অংশ তাই আমি তাকেও ভালোবাসি। বিয়ের পর সবার তো বাচ্চা হয় মোহ। আমাদের বাচ্চা না হয় বিয়ের আগেই হলো। সমস্যা কোথায়? আমি মেনে নিই নি ইথানকে। আমি ওকেও ভালোবেসেছি। আমি চাইনা ওর বাবা হওয়ার অধিকার থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত করো।”

মোহের আর তখন কথা বলার সাহস জুগিয়ে ওঠা হলো না। স্বচ্ছ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বাইকে বসো।”

ব্যস…সারা রাস্তা আর কোনো কথা বলল না স্বচ্ছ। যেন রাগই করে ফেলল লোকটা।

বিয়ের কারণে দুয়েকদিন ছুটিতেই ছিল ফারাহ। আজ অফিস আসার পর থেকে সকলে তার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। ফারাহ লজ্জায় কেবিনে কাউকে আসতে দিচ্ছে না। আজ প্রচণ্ড কাজের প্রেশারে মাথাব্যথা ধরেছে তার। এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের বেশ কয়টা ডিজাইন দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সে। হঠাৎ এক মেয়েলি কণ্ঠ মিনমিন করে উঠল।
“ম্যাম, আপনার সঙ্গে দেখা করতে একজন এসেছে।”

বিরক্ত হয় ফারাহ। চেঁচিয়ে বলে,
“বলে দাও আমি দেখা করতে পারব না ব্যস্ত আছি।”

“কিন্তু উনি বলছেন তাও দেখা করবেন।”

ফারাহ এবার রাগে। কড়া কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“কার এত সাহস?”

আচমকাই ফারাহর কর্ণকুহরে ভেসে আসে মোটা পুরুষালি কণ্ঠস্বর।
“হ্যালো মিসেস ফারাহ ম্যাডাম। মে আই কাম ইন?”

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯ [দ্বিতীয় খণ্ড]

ফারাহ কিছু সময় নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইল দরজার পানে। হৃদয়ের দুয়ারে শীতল বাতাস ধা/ক্কা দিলো যেন। এতদিন ‘মিস ফারাহ’ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হওয়া মেয়েটার মিসেস শুনলে তো একটু ধা/ক্কা তো লাগবেই। তাও যদি সেই সম্বোধনটা প্রিয় মানুষটা করে তাহলে সেই সংঘাত যেন দ্বিগুন হয়ে যায়৷ ফারাহ বিস্ময়ের সহিত বলল,
“আপনি?”

কেবিনে উপস্থিত থাকা মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে বলে,
“আমি তাহলে আমার কাজে যাচ্ছি।”

মেয়েটি চলে গেলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল শৌভিক। তার বোধ হলো সে বেশ কয়েকদিন পর তার প্রেয়সীকে জাগ্রত অবস্থায় দেখছে। ফারাহ তার নিকট এসে চোখ ছোটো করে বলে উঠল,
“বাবাহ্! বিজি ম্যান হঠাৎ এখানে? কী ব্যাপার?”

“নিজে বউয়ের ভাইয়ের হাতে জাতের মাইর খেয়ে বউকে লিগ্যালি বিয়ে করেছি। ঘা এখনো তাজা আছে। এত কষ্ট করে বিয়ে করার পর কোনো ব্যাপার ঘটলে তবেই বউয়ের কাছে আসা যাবে? তার আগে নয়?”

ফারাহ এবার সহসা জানতে চাইল,
“আগামী কত বছর আপনি আমার ভাইয়ের করা ভুল কাজটার কথা মনে করাতে থাকবেন বলুন তো?”

শৌভিক হেসে ফারাহর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়,
“ইচ্ছে তো আছে আজীবন দৃশ্যটা বাঁধিয়ে রাখার। বউয়ের বড়ো ভাইয়ের বেস্ট গিফট। গিনিজবুকে লেখা থাকা উচিত।”

ফারাহ চোখ রাঙিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“লেখিয়ে আসুন তবে যান।”

শৌভিক ফারাহর গাল চেপে ধরে হঠাৎ। তার দিকে ফারাহকে ফিরিয়ে বায়না করে বলে,
“আপনার চোখ রাঙানি খুব মিস করেছি ম্যাডাম। আর আপনি অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাচ্ছেন? ঠিক হচ্ছে না।”

ফারাহর রাগ গলে যেতে সময় লাগল না। ঠোঁটে দৃশ্যমান হলো হাসির রেশ। শান্ত কণ্ঠে শুধাল,
“আপনার সব ব্যস্ততা শেষ?”

শৌভিক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দুচোখে ক্লান্তি নিয়ে বলে ওঠে,
“শেষ আর কোথায় হলো বলো! হাতে আর ৮ দিন মতো সময় আছে। এরপর ইলেকশন। অনেক টেনশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাবা। ওদিকে তোমার বাবার দলের লোকজন ক্ষে/পে রয়েছে। ওরা ইলেকশনের আগেই এভাবে হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না। জানি না কী হবে!”

ফারাহ মৃদু হেসে শৌভিকের চোখে চোখ রেখে আশ্বাস দিলো,
“এবার আপনারাই জিতবেন।”

শৌভিক প্রচণ্ড অবাক হওয়ার ভান ধরে গর্বের সহিত বলতে লাগল,
“শত্রুর কন্যা কিনা আমাদের জিতে যাওয়ার কামনা করছে! ইশশ…! কী ভাগ্য আমার! চমকের উপর চমক পাচ্ছি। একদিনে তো এত চমক দিতে নেই।”

“আজকাল মানুষের ভালোও চাইতে নেই। এই জ্বালাতন করার জন্য এসেছেন এখানে?”

আচানক জ্বলে উঠল ফারাহ। তাকে বুঝতে পারা দায়। মেয়ে মানুষ কি-না! তবে তার এমন অগ্নি কন্যার রূপ দেখতে ভালোই লাগে শৌভিকের। এটাই সে প্রচণ্ড মিস করছিল। সামনে ইলেকশনের কারণে ফারাহকে একদমই সময় দেওয়া হচ্ছে না তার। সকালে ফারাহ ঘুম থেকে ওঠার আগেই কাজে বের হয় শৌভিক। আর বাড়ি ফিরে আসে রাতে ফারাহ ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। তবে আজ একটু সময় পেতেই ফারাহর কাছে এসেছে সে। শৌভিক ফারাহর হাতে সুন্দর মতো দুটো চকলেট ধরিয়ে দিলো আর বলল,
“চকলেট খাও আর মাথা ঠাণ্ডা করো।”

ফারাহ হতভম্ব হয়ে চকলেটের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“আমি চকলেট খেলে মাথা ঠাণ্ডা হয় কে বলল আপনাকে?”

শৌভিক এক গাল হেসে প্রত্যুত্তর করল,
“আমার ছোটো শ্যালক আছে যে!”

ফারাহ আর কিছু বলে না। চকলেটের প্যাকেট খুলে এক কামড় বসিয়ে একটা কথা মাথায় আসতেই বলে বসে,
“মা, আমাদেরকে একসঙ্গে ডেকেছে। বলেছে কয়দিন ওখানে থাকার জন্য।”

শৌভিক কিছুটা সময় ভেবে বলে,
“উনি এখন বোধহয় উনার বাবার বাড়িতে আছেন?”

ফারাহ মাথা ঝাঁকায়। শৌভিক এক রাশ চিন্তা নিয়ে বলল,
“জায়গাটা বেশ দূর হয়ে যায়। আর ওখানে গেলেও তো আমি সময় দিতে পারব না খুব একটা৷ আমারই খারাপ লাগবে।”

ফারাহর চকলেট খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মাধুর্যে ভরা মুখখানায় অন্ধকার নামে। সে চায় কয়েকদিন মায়ের কাছে থাকতে। আবার ভাইদের সঙ্গে ঝগড়া, কথা কাটাকাটি করতে। হঠাৎ শৌভিক জানায়,
“তুমি বরং কয়দিন গিয়ে থেকে এসো মায়ের কাছে। এমনিতেও শ্বশুরবাড়িতে তোমার তো কাজ নেই। তুমি যাওয়ার পর আমি এক বেলার জন্য হলেও সেখানে উপস্থিত থাকব। ঠিক আছে?”

মুহূর্তে যেন ফারাহর সুন্দর চেহারায় ফিরে আসে তার আগের রঙ। ঝলমলে দেখায় তাকে। প্রচণ্ড আনন্দ নিয়ে বলে,
“সত্যি? থ্যাংক ইউ।”

নাক সিটকায় শৌভিক। চোখমুখ জড়িয়ে বলে,
“এসব রসকষহীন থ্যাংক ইউ আমার লাগবে না।”

“তো?”

শৌভিক ঝড়ের গতিতে তাকে সুন্দর মতো আলিঙ্গন করে ডান গালে চুম্বন এঁকে সরেও যায় কিছুটা দূরে। ফারাহ সেই আগের মতো দাঁড়িয়ে। চোখ নামিয়ে নিলো সে। শৌভিক ফিসফিসিয়ে বলে চলে গেল,
“থ্যাংক ইউ এভাবে দিতে হয়। শিখে রাখো। কাজে লাগবে।”

দুদিন পর আজ ইথানের স্কুলে স্পর্টস ডে ছিল। তাই স্কুল ছুটি হয়েছে দেরিতে। বিকেল প্রায় সাড়ে চারটা ছুঁইছুঁই। মোহ ইথানকে কোলে করে নিয়ে স্কুল থেকে বের হলো। ইথান প্রচণ্ড আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল,
“আমি দৌড়ে সেকেন্ড হয়েছি মাম্মা। দেখেছিলে কত জোরে দৌড়েছিলাম?”

মোহ হেসে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ দেখলাম তো। আমার চোখ তো আমার ইথান ছাড়া অন্য কারোর দিকে সরছিলই না।”

ইথান এবার বিষণ্ণ মুখে বলল,
“খুব চেষ্টা করলাম ওই তিহানকে হারাতে। পারলামই না। প্রথম হয়ে গেল ও।”

“তাই বলে মন খারাপ করতে নেই। এটা ঠিক মানুষ সবসময় প্রথমে থাকতে চায়। কিন্তু সবাই প্রথম হয় না। চেষ্টার পরেও যখন তুমি পারলে না তখন তোমাকে তোমার স্থান নিয়ে খুশি থাকতে হবে। নয়ত সৃষ্টিকর্তা বেজার হবে। বুঝলে?”

ইথান কী বুঝল মোহের জানা নেই তবে সে বাধ্য ছেলের মতো বলল,
“তাহলে থাক আমি সেকেন্ডই ঠিক আছি।”

তার সরলতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারে না মোহ। বাচ্চাদের সরলতা এত সুন্দর কেন হয়? মায়াভরা সুন্দর মুখ দেখেই বোঝা যায় তারা কত নিষ্পাপ! মোহ ইথানকে নামিয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়াল। হঠাৎ বেশ কয়েকবার বাইকের হর্ণ বাজলে বিরক্তি নিয়ে বাম পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মোহ। সেই ক্লান্তি চোখমুখ, এলোমেলো চুল, খোলা শার্টের বোতাম, শার্টের হাতা গুটানো এবং শুকিয়ে যাওয়ার চোখমুখ দেখে সে আবিষ্কার করল লোকটা স্বচ্ছ। মোহের আঁখি দুটো বড়ো হয়ে গেল। হতবাক হয়ে সে ইথানের হাত ধরে স্বচ্ছের দিকে এগিয়ে গেল।
“আপনি এসময় এখানে?”

স্বচ্ছ বাইক থেকে নামে। তার চোখমুখ ফ্যাকাসে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে জবাব দেয়,
“কল করে যে বলেছিলে আজ ইথানের স্পর্টস আছে। বাড়ি ফিরতে সাড়ে চারটার মতো বাজবে। আমার ইন্টারভিউ শেষ হয়ে গেল। তাই ভাবলাম তোমাদের সঙ্গে দেখা করি।”

মোহ কিছুটা সংশয় নিয়েই প্রশ্ন করে ফেলল,
“কেমন হলো ইন্টারভিউ?”

“আগেরবার যেমন হয়েছে। সেভাবেই চলছে সব। আজকেও সিনক্রিয়েট করে এসেছি।”

স্বচ্ছের প্রতিটা শব্দ হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ। মোহ মানুষটার দিকে ভালো মতো তাকাতেও পারছে না। স্বচ্ছ আরো বলে,
“প্রথমে যার কাছে গেলাম তিনি আমার সম্পর্কে জেনেই বললেন একজন ম/ন্ত্রীর ছেলেকে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতাই নাকি উনাদের নেই৷ দ্বিতীয়বার যার কাছে গেলাম উনারা বললেন আমার মতো একজন ধুরন্ধর ম/ন্ত্রী সাহেবের ছেলেকে চাকরি দিলে শেষে বাবার মতোই ঝামেলা বাঁধাব। সব জেনেশুনে উনি চাকরি দিবেন না৷ আরো অনেক কথা বলছিল। খারাপ লাগছি, রাগ উঠছিল তাই টেবিলে থাকা গ্লাসের পানি লোকটার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছি। অবশ্য এর কারণে মা/র খেতে পারতাম। কিন্তু ওইযে পাওয়াফুল লোকের ছেলে তাই…”

মোহ কথার মাঝপথে বলে উঠল,
“থাক আর বলতে হবে না। বুঝেছি।”

স্বচ্ছ কিছুটা সময় চুপ থেকে নিজের ভেতরে থাকা কিছুক্ষণ আগের রাগ হজম করে অবসাদের সাথে বলল,
“আমার ভেতরের আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি ম/রে যাচ্ছে। হাঁপিয়ে উঠেছি। চোখ বুঁজলে শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা দেখতে পাই, মোহ।”

“সাধারণ মানুষদের এভাবেই প্রতিনিয়ত কতশত স্ট্রাগল করে চলতে হয়। আশেপাশে তাকালেই দেখবেন চাকরির জন্য একেকটা ছেলে কতগুলো পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে অথচ কোথাও ভাগ্য সহায় হয়নি। তবুও তারা ভাঙেনি।”

স্বচ্ছ অধৈর্য হয়ে প্রত্যুত্তর করে,
“আমার যোগ্যতা বিচার করে যদি আমাকে প্রত্যাখান করত তবে আমার এতটা কষ্ট হতো না। তারা তো আমার যোগ্যতা পরীক্ষা করার কথা একবারও ভাবছে না যখন আমায় চিনতে পারছে। কেউ কেউ আমাকে বিদ্রুপ করে বলছে, এত বড়ো মন্ত্রীর ছেলে চাকরি করবে? অসম্ভব! হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছে। আমি সত্যি আর পারছি না।”

মোহের চোখেমুখেও মলিনতা ধরা দেয়। তার ইচ্ছে করে না মানুষটাকে এত ভেঙ্গে পড়তে দেখতে। এই স্বচ্ছকে সবসময় প্রবল আত্মবিশ্বাসী, অযাচিত জেদ আর কঠিন রাগেই মানায়। যার মুখটা দেখেই যে কেউ দুই ধাপ আরো পিছিয়ে যাবে। মোহ সেই স্বচ্ছকে ফিরে পেতে চায়। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“সেটা তাদের ব্যর্থতা যারা আপনার যোগ্যতাকে দুচোখ মেলে দেখতেই চাইছে না। আপনার সময় যখন আসবে তখন আপনি সফলতা পাবেন। কিন্তু যা ইচ্ছে হয়ে যাক মোহ মোহের জায়গায় থাকবে। একটুও নড়বে না।”

স্বচ্ছের অন্তর থেকে স্বস্তি আসে। মোহের প্রতিটা শব্দ তার ভেতর অবধি ভরসা জাগায়। স্বচ্ছ চুপ রয়। মোহ বলে,
“চলুন।”

স্বচ্ছ কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধায়,
“কোথায়?”

“আমি যেখানে বলব সেখানে। আপত্তি আছে? থেকেও লাভ নেই। আপনাকে যেতেই হবে।”

“বাহ্! না গেলে কী করবে?”

মোহ চোখ গরম করল। বলল,
“কী করব দেখবেন? বাড়ি যেতে পারবেন না। আপনার বাইকের টায়ারের হাওয়া বের করে দেব। এখানেই পড়ে থাকবেন তারপর।”

স্বচ্ছ চকিতে ওঠার ভান ধরে বলে,
“থাক, আপনার এত কষ্ট করতে হবে না মহারানি৷ উঠে আসুন।”

মোহের হাত আচানক টেনে ধরে ইথান। স্বচ্ছকে চোখ ছোটো ছোটো করে পর্যবেক্ষণ করে সে। একটু ভেবে বলে ওঠে,
“আপনি কে? আপনাকে তো ওইদিন আমাদের বাসায় দেখেছিলাম। মাম্মার সঙ্গে কথাবার্তা শুনে অন্যরকম মনে হচ্ছে। কে আপনি বলুন তো?”

ইথানের পুরো পৃথিবী জুড়ে বিস্ময়। সে স্বচ্ছকে খুব বেশি একটা চেনে না। দুয়েকবার দেখেছে। তার মাম্মা কেন এতসব কথা বলছে তার জানতে খুব ইচ্ছে করছে। স্বচ্ছ ইথানের গাল হালকা করে টেনে ধরে বলল,
“আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে তোমার?”

“টিভিতে মুভি দেখেছিলাম। গার্লফ্রেন্ড আর বয়ফ্রেন্ড এভাবে কথা বলে। মাম্মা এটা তোমার বয়ফ্রেন্ড?”

ছোটো ছেলের মুখে এত পাকা কথা শুনে চোখ বড়ো হলো মোহের। ইথানকে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“ইথান, তুমি এসব কোথায় দেখেছ? টিভিতে এসব দেখো বসে বসে?”

স্বচ্ছ এবার ইথানকে হাতে তুলে বাইকের সামনে বসিয়ে নিয়ে তাকে প্রশ্রয় দিয়ে বলল,
“ডিজিটাল বাচ্চা! এসব না শিখলে পারফেক্টলি প্রেম করতে পারবে না। আমার মতো বুড়ো বয়সে কি ও বিয়ে করবে? ও বিয়ে করবে চনমনে বয়সে। আগেকার বাবা-চাচারা যেমন যৌবন পড়তেই বিয়েশাদি করত। ঠিক সেই জেনারেশন ফিরিয়ে আনবে আমাদের বাচ্চারা। তাই না ইথান?”

ইথান এত কথা বোঝে না। ফ্যালফ্যাল করে স্বচ্ছকে দেখে নিয়ে বাইকের সামনের অংশগুলো দেখতে মনোযোগ দেয়। মাঝে মোহ স্বচ্ছের হাতে চিমটি কেটে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“বাচ্চাদের সামনে কী বলেন এসব? লাজলজ্জা নেই? অসভ্য!”

“লাজলজ্জার কী আছে? আমি তো সব লজিক্যালি কথা বলছিলাম। আজকে যেয়ে তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করবে তিনি কত বছরে বিয়ে করেছিলেন? সেই বছরে আমি বিয়ে করলে আরো তিন চারটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিতো বাড়ির মেঝেতে।”

মোহ হতবিহ্বল। মুখের কথা হারিয়েছে। মুখে কুলুপ এঁটে মুখ ফুলিয়ে স্বচ্ছকে যেন চোখ দিয়ে ভস্ম করতে চাইছে। স্বচ্ছ ফের বলে,
“অবশ্য একটা ভালো কাজ হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করলে তো মিস বিছুটির দেখা পেতাম না। জীবনের সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি সেখানেই হতো। এজন্য বলে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। যাই হোক, কোথায় যেন নিয়ে যাবে বললে। তা যাবে নাকি দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে অগ্নিকন্যার মতো জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে?”

মোহ বাইকের পেছনে উঠে বসে। স্বচ্ছের দুই কাঁধে হাত রেখে রাগে জোরে চাপ দিয়ে ধরে কাঁধ। স্বচ্ছ বলে ওঠে,
“তোমার পাতানো ভাই একবার মে/রে রেখেছে। আর এখন তুমিও যদি বাকিটা মে/রে ভেঙে রেখে দাও বাকি জীবন কিন্তু তোমাকেই জ্বালা সইতে হবে। আমি নির্দোষ।”

মোহ তৎক্ষনাৎ কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। চোখেমুখে নেমে আসে অনুশোচনা। স্বচ্ছের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“সরি।”

স্বচ্ছ মৃদু হেসে বলে উঠল,
“মজা করছিলাম অগ্নিকন্যা।”

ইথান তখনি প্রচণ্ড কৌতূহল না চেপে জানতে চাইল,
“আপনি আমার কে হোন?”

স্বচ্ছ একটু ভেবে উত্তর দিলো,
“আমি তোমার অনেক কিছু হতে পারি। যেমন তোমার ফ্রেন্ড হতে পারি। বেস্টফ্রেন্ডও হতে পারি। আরো কিছু হতে পারি। কিন্তু তুমি আমায় কী বানাতে চাও তা নাহয় তুমিই বলে দিও। ঠিক আছে?”

ইথান বাধ্য ছেলের মতো সম্মতি জানায়। স্বচ্ছ বাইক স্টার্ট দেয়।

জ্যামে আটকায় অন্বেষার গাড়িটা। ফোন ঘাঁটতে ব্যতিব্যস্ত অন্বেষা খানিকটা বিরক্ত হয়। তাড়াহুড়োর সময় জ্যামে পড়া কি খুব জরুরি? কপাল কুঁচকে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে কপালের চুল সরিয়ে আনমনে বাহিরে তাকায় সে। আচানক দেখে ফেলে সেই পুরুষকে। যার সঙ্গে এ জীবনে সে মুখোমুখি হতে চায় না। সোজা হয়ে বসে অন্বেষা। ভালো করেই দেখার চেষ্টা করে বাইকে বসে থাকা স্বচ্ছকে। বাইকের সামনে থাকা ছোটো বাচ্চা এবং পেছনের সিটে বসে থাকা রমনীকে দেখে উৎসুক হয় সে। মেয়েটা অন্বেষার উল্টো হয়ে বসেছে ফলে মুখ দেখতে সফল হচ্ছে না। এটা নিশ্চয় ফারাহ নয়। কারণ ফারাহর পোশাক পরনের ধরণই অন্যরকম। তবে কি এটা সেই রমনী যার জন্য সে প্রত্যাখান হয়েছিল? একথা ভাবতেই যেন মনের গহীনে কোথাও দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে দাবানল। যার ফ্যাশন সেন্স এত সাধারণ তার মুখশ্রী কতটা সুন্দর হতে পারে ভাবতে থাকে সে। মেয়েটির মুখ দেখতে যেন মরিয়া হয়ে ওঠে অন্বেষার প্রাণ। মেয়েটির মাঝে নিশ্চয় কিছু আছে নয়ত কেন স্বচ্ছ বারংবার তার বাইকের আয়না ঘুরিয়ে মেয়েটার দিকে তাক করে রেখে তাকে দেখছে আর মাঝে মাঝে হাসছে? অথচ কতশত চেষ্টার পর সে স্বচ্ছের দৃষ্টি জুড়ে একবারও থাকতে পারেনি। অন্বেষা স্বচ্ছের প্রিয়তমার মুখশ্রী দেখার আগেই জ্যাম ছেড়ে গেল। গাড়ি চলতে লাগলে অন্বেষা বিচলিত হয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমাকে অফিসে নয় অন্য কোথাও যেতে হবে। বাইকটার পিছু করুন।”

ড্রাইভার আমতা আমতা করল। তবে অন্বেষার আদেশে পিছু করা আরম্ভ করল।

একেবারে নদীর তীরে থামে স্বচ্ছের বাইক। বর্ষায় নদী ভরভর। নদীর স্রোত যেন উতলা হয়ে রয়েছে। এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত খেলা করছে। তীব্র হাওয়া এসে লাগছে গায়ে। স্বচ্ছ নিজের হাত দিয়ে মোহকে ধরে বাইক থেকে নামিয়ে দিলো। অতঃপর ইথানকে একহাতে কোলে নিয়ে নিজে নেমে মোহের কাছে জানতে চাইল,
“হঠাৎ এখানে কেন এলাম?”

মোহের সহজ উত্তর এলো,
“কারণ আমি বিশ্বাস করি, স্রোতের নদী আপনার হতাশাকে দূরে নিয়ে যাবে। দমকা হাওয়া আপনার ভেতরে সতেজতা জাগাবে।”

স্বচ্ছ বোকার ন্যায় হাসে। মেয়েটা যদি জানত তার চোখের এক ঝলক, ঠোঁটের মৃদু হাসি, কণ্ঠের তেজ তাকে সতেজ রাখে তাহলে কি নদীর পাড়ে আসত? নাকি সারাদিন তার সামনে বসে থাকত? মোহ এবার আবদার করল,
“আমরা ঘাসের উপর গিয়ে বসি? দেখবেন অনেক ভালো লাগবে। দেখুন অনেকে বসে আছে।”

স্বচ্ছ বিরোধিতা করে না৷ মেয়েটা খুশি মনে রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে বসে পড়ে। স্বচ্ছ কোলে থাকা ইথানকে জোরে জড়িয়ে বলে,
“তুমি নদী পছন্দ করো?”

ইথান সরল মনে উত্তর করে,
“একটু একটু।”

স্বচ্ছ হেসে গিয়ে মোহের পাশে বসে।

এই প্রথম কাঁচের আড়াল থেকে নিজ গাড়িতে বসে স্বচ্ছের প্রিয় রমনীকে দেখার সুযোগ পেল অন্বেষা। সেই রমনীকে দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল সে। দ্রুত নিজের ফোনের স্ক্রিনে নিজেকেও পরখ করে নিলো। আচ্ছা, কী করে তার থেকে সেই সাদামাটা মেয়েটাকে স্বচ্ছের চোখে সুন্দর লাগল? কী করে ওই সাধারণ কমদামি কামিজ, ওড়না পরা, সাধারণভাবে চুল বিনুনি করা ও সামান্য হলদে ফর্সা তার চেয়ে অত্যাধিক কম সুন্দর মেয়েটার প্রেমে স্বচ্ছ উন্মাদ হলো? কেন নিজেকে যতটা সম্ভব নিখুঁত ভাবে সামলে নিজেকে সুন্দরী করে গড়ে তোলার পরেও ওই মেয়েটা তাকে হারিয়ে দিলো? ওই নারীর কপালে আর গালে দুয়েকটা ব্রণের দাগও দেখা যায়, কখনো নিজের স্বাস্থ্য সামলে নিখুঁত হওয়ার চিন্তাও হয়ত করেনি সে। তবুও মেয়েটা কেন সেই পুরুষটির চোখে বিশ্বসুন্দরী? কেন? ভাবনায় জগতে ভবঘুরে হয়ে ঘুরেও অন্বেষা নিজের উত্তরগুলো খুঁজে পেল না। পলকহীন তাকিয়ে থাকল হাস্যোজ্জ্বল মোহের দিকে। খুঁজতে থাকল সেই সৌন্দর্য যা মেয়েটা লুকিয়ে রেখে স্বচ্ছকে দেখিয়ে তাকে মুগ্ধ করছে। তবুও অন্বেষা ব্যর্থ হলো। এবার মনে এলো, ভালোবাসলে নিশ্চয় এমনই হয়! হঠাৎ সেই কাঙ্ক্ষিত নারী সেই পুরুষের কাছে হয়ে যায় বিশ্বসুন্দরী। সেই মাধুর্যের কাছে বাকি সব লাবণ্য শুধুই চিকচিকে বালির মতো। যা ফুঁ দিয়েই উড়িয়ে দেওয়া যায়!

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০ [দ্বিতীয় খণ্ড]

নদীর পাড়ে প্রবল হাওয়ায় উথাল-পাতাল করছে ছোটো ছোটো ঢেউ। আকাশ নিভু নিভু। সূর্যের তেজ নেই। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে বিদায় দিচ্ছে আজকের মতো। দমকা বাতাসে নিজের ওড়না সামলে সামনে তাকায় মোহ। সে ঘাসে বসে ইথান ও স্বচ্ছের কাণ্ড দেখছে। ইথান জোরে জোরে দৌড়াচ্ছে স্বচ্ছ তার পেছনে ছুটছে। মূলত ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে তারা। মোহ অবাক পানে চেয়ে তাদের নিয়ে ভেবেই যাচ্ছে। তবে ভেবে পাচ্ছে না যেই ইথান সহজে কারোর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না সে কী করে স্বচ্ছের সঙ্গে কয়েক মিনিটে মিশে গেল? মোহ খুঁজে নিলো অথবা তৈরি করল উত্তর। স্বচ্ছ একবার ইথান পড়ে গিয়ে মাথা ফা;টিয়ে ফেলার পর তাকে সাহায্য করেছিল। সেই থেকে এখন অবধি তাদের পরিচয়। নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে কোনো সুন্দর বন্ধন গঠিত হয়েছে। মোহ এই সম্পর্কটাই দেখতে চায় তাদের মাঝে। আচানক স্বচ্ছ ইথানকে তার কাঁধে তুলে নিলো। খিলখিলিয়ে ইথানের হাসি শুনতে পেল মোহ। মোহের ওষ্ঠদ্বয়ও বিস্তৃত হলো খুশিতে। কথায় বলে, ছোটোদের সাথে মিশলে বড়োদের মনটাও ছোটোদের মতো হয়ে যায়। স্বচ্ছের বোধহয় সেই দশা হয়েছে। একটা চাকরি না পাওয়ায় ভেঙে যাওয়া ভেতরের আত্মবিশ্বাস এবং হতাশা কর্পূরের মতো গায়েব হয়ে ধরা দিয়েছে খুশি। মোহ তো এটাই চেয়েছিল।

ইথানকে কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত স্বচ্ছ তাকে নামাতে গেলে হঠাৎ কিছুটা দূরে জোড়া নয়ন থামে। হালকা আকাশী টিশার্ট পরিহিত ছেলেটার দিকে কিছুটা সময় চেয়ে থেকে চিনতে পারে স্বচ্ছ। ওটা সৌমিত্র ছাড়া কেউ না। তবে সে একা নয়। তার সঙ্গে একজন নারী রয়েছে। স্বচ্ছের মনে আছে সকালে সে বলেছিল আজ বিকালে নাকি পড়াশোনার জন্য কোনো বন্ধুর কাছে যাবে। এই হচ্ছে তার পড়াশোনার নমুনা! স্বচ্ছ আরো ভালো করে দেখল সৌমিত্রের কাছে বসা মেয়েটি তারও চেনা। কিছুটা সময় নিয়ে বুঝতে পারল এটা মোহের বান্ধবী। স্বচ্ছ জানত এদের মধ্যেকার কিছু কিছু অনুভূতির কথা। আজ যেন নিশ্চিত হলো। ইথানের হাত ধরে মোহের দিকে এগোয় স্বচ্ছ।

তানিয়া পড়াশোনার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বললেও যেন তা কর্ণকুহর অবধি পৌঁছায় না সৌমিত্রের। তানিয়া ভ্রু কুঁচকে নিজের পাঞ্চ ক্লিপে ফের বাঁধন ছাড়া চুলগুলো আঁটকে বলল,
“এই আপনি শুনছেন?”

সৌমিত্র কিছুটা চকিতে বলল,
“হ্যাঁ, মিস। শুনছি তো। কানে সব এসেছে। মাথায় সেটও হয়ে গেছে।”

“আমার ডাউট আছে।”

সৌমিত্র হাফ ছেড়ে প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে বলে উঠল,
“আপনাদের নারী জাতির তো সবেতেই ডাউট থাকে। আপনাদের পুরুষ জাতির ভালোবাসায় ডাউট রয়েছে। এরপর আসে বিশ্বাসে, কথায়, কাজকর্মে সবেতে সন্দেহ। বড়ো মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পুরুষ জাতি তবুও নারী জাতির পেছনে ছুটতে থাকে। কী কা/লো জা/দু করেন তা আপনারাই ভালো জানেন!”

তানিয়া সৌমিত্রের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ঝাঁজালো স্বরে বলে,
“মেয়েদের নিয়ে এত গবেষণা করার চেয়ে যদি একটু পড়াশোনা করতেন তাহলে এভাবে ভার্সিটিতে ঝুলে থাকতে হতো না। একে তো প্রাইভেট ভার্সিটি তার উপর আবার আপনি ক্লাসও করেন না। মনে রাখবেন এই তানিয়া শুধু আপনাকে একটা বছরই সময় দিতে পারবে।”

“ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু তো করেছি মিস। যেই সময় ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ছাড়া যেন জীবন চলত না সেসব বাদ দিয়ে একটু হলেও পড়াশোনায় মনোযোগ এনেছি। আপনার জন্য এই মহান ত্যাগ করেছি।”

“ওহ হো, আমার ত্যাগী মানুষ! একটা কথা বলুন তো?”

“কী?”

তানিয়া এবার প্রচণ্ড উৎসুক হয়ে শুধাল,
“আপনি পড়ার বিষয় বুঝতে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন নি তাই তো?”

সৌমিত্র সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না দিয়ে শুধু তানিয়ার হাত থেকে খাতাটা নিলো। স্মিত হেসে বলল,
“হুমম, ঠিক ধরেছেন। এইযে পড়া পড়া করে আপনার মাথা খাচ্ছিলাম, এটা শুধুই আমার বাহানা।”

“তবে এসব বাহানার মানে কী?”

“আপনি আমার সাথে একটি কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। কোনো দরকার ছাড়া আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব না আমি। চেষ্টা তো করি নিজের মনকে প্রতিহত করতে। কিন্তু তার মনের মধ্যখানে যখন অনুভূতিগুলো ঝর্ণার পানির মতো উপচে পড়তে শুরু করে তখন তা কী করে সামলায়?”

তানিয়া নিশ্চুপ। এক নিষ্ক্রিয় হয়ে জড়োসড়ো হয়ে রইল। সে কি বেশি পাষাণ হয়ে যাচ্ছে। আরো একবার যে পুরুষের পরিপূরক হতে চেয়েছে তার প্রতি কি এই অন্যায় আচরণ ঠিক হচ্ছে? সৌমিত্র আচানক বলে ওঠে,
“আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে মিস গোলাপি!”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল তানিয়া। পরক্ষণেই খানিকটা লজ্জা ঝেঁকে ধরলে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সৌমিত্র ফের বলল,
“আমি সুন্দর করে লাইন সাজিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না। মুখে যা আসে তাই বলে দিলাম।”

“ওহ আচ্ছা! তো এই হচ্ছে আপনার ক্লাস।”

হঠাৎ সৌমিত্রের কানে আসে পুরুষালি মোটা কণ্ঠস্বর। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই তার কান চেপে ধরে টান দেয় কেউ। হালকা আর্তনাদ করে উঠে ঘুরে দাঁড়ায় সৌমিত্র। বড়ো ভাইকে দেখে শুকনো ঢল গিলে আকুতি করে বলে,
“ভাইয়া তুমি! কান ছাড়ো। ছিঁড়ে যাবে তো।”

“এইযে তুই আমাকে সকালে বললি পড়াশোনার জন্য বিকালে বাড়িতেই থাকবি না৷ আমার চোখ তো কপালেই উঠে গিয়েছিল। এইযে এই পড়াশোনার জন্য যে বাড়িতে থাকবি না সেটা দেখার পর নিশ্চয় তোকে ফুলের মালা পরাব না?”

নিজের কথা শেষ করে সৌমিত্রের কান ছেড়ে দিলো স্বচ্ছ। তানিয়া পারে না প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সঙ্গে আবার মোহকে দেখে আরো কারোর সঙ্গে চোখে চোখ মেলাতে পারে না সে। সৌমিত্র কান ডলতে ডলতে মুখ ফুলিয়ে বলল,
“ফুলের মালা না-ই দিলে। কিন্তু গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার নেই। বাড়িতে তুলোধোনা করো ঠিক আছে। তবে বাইরে গায়ে হাত দিতে পারো না। আমারও তো মান সম্মান আছে নাকি!”

স্বচ্ছ আক্রো;শ ঝেড়ে বলল,
“এইযে তুই দিনরাত পড়াশোনা নিয়ে ভাবিস জন্য মা খুশি হয়ে দুই তিন দফা করে তোর জন্য পছন্দের সব খাবার রান্না করে। মা যদি জানে তার গুণধর ছেলে এই পড়াশোনা করছে তাহলে বাড়িতে তোর জায়গা হবে কিনা গ্যারান্টি দিতে পারিস?”

সৌমিত্র এবার মোহের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তুমি নিশ্চয় এখানে ইন্টারভিউ দিতে আসো নি! দেখো, তুমিও প্রেম করতে এসেছ আর আমিও তাই। হিসাব বরাবর! তাই ব্যাপারটা এখানেই শেষ।”

চোখ রাঙিয়ে যেন সৌমিত্রকে শাসায় স্বচ্ছ। অতঃপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সহিত জানায়,
“আমি প্রেমের লাইসেন্স পেয়েছি। একদম পিওর লাইসেন্স দিয়েছে মা। তোকে দিয়েছে? তোর বয়স হয়েছে?”

সৌমিত্রের যেন প্রেস্টিজে বেঁধে গেল কথাটা। গায়ে বিঁধে গেল ভাইয়ের এমন অপমান। তীব্র তেজ নিয়ে বলল,
“আজকেই বাড়ি গিয়ে আগে মায়ের কাছে লাইসেন্স চাইব। তারপর তোমাকে দেখে নেব।”

“এরপর মায়ের হাতে কয়টা জুতার বা/ড়ি খাস সেটাও ভিডিও করে রাখব।”

দুই ভাইয়ের এমন প্রেম বিষয়ক তর্কাতর্কিতে তানিয়া গিয়ে মোহের পাশে দাঁড়াল। তারা এই মুহূর্তে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা না বুঝে সম্পূর্ণ বেআক্কলের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সৌমিত্র এবার ভাইয়ের কথার উত্তরই না দিয়ে মোহের সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা সালাম জুড়ে দিলো।
“আসসালামু আলাইকুম ভাবি!”

মোহ বোকার মতো চেয়ে থেকে সালামের উত্তর নিতেই সৌমিত্র সরাসরি অভিযোগ করে বসল,
“দেখেন ভাবি, আপনার প্রেমিক পুরুষকে সামলান। যখন তখন আমার সম্মান নিয়ে টানাটানি করে। এটা তো ঠিক না। আমি আপনার ভবিষ্যৎ দেবর৷ সেই হিসেবে আমার পাশে থেকে আমার পক্ষে বিচার দেওয়া আপনার দায়িত্ব।”

মোহ কিছু না বুঝে পাল্টা জিজ্ঞেসা করল,
“কী বিচার করব!”

“এইযে আপনি আমার এই ভাইটার সঙ্গে প্রেম করছেন। আমি কি কিছু বলেছি বলুন? তাহলে আমি প্রেম করলে তার কেন সমস্যা হবে?”

অসহায়ের ন্যায় কথাগুলো প্রকাশ করতেই মাঝখান থেকে তানিয়া হতবাক হয়ে বলল,
“আমরা প্রেম করছি? কবে, কখন? আমি তো করছি না। এই মোহ, তুই প্রেম করছিস?”

মোহও সম্পূর্ণভাবে কথা ঘুরিয়ে না জানার ভান করে বলল,
“একদমই না। আমি কি প্রেম করার পাত্রী নাকি? আমরা তো শুধু দেখা করেছিলাম।”

তানিয়াও সায় দিয়ে বলল,
“আমিও শুধু দেখাই করেছিলাম। প্রেম তো করিনি।”

হঠাৎ নীরব ইথান স্বচ্ছকে দেখিয়ে বলল,
“আমরা তো খেলছিলাম।”

ফিক করে হেসে উঠল মোহ। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দুই ভাই। স্বচ্ছ কঠিন সুরে মোহকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মানে কী? আমরা প্রেম করছি না?”

মোহ একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“জি, না।”

“এটা কেমন কথা? এতদিন যা যা হলো সেগুলো…”

মোহ স্বচ্ছকে কথার মাঝে থামিয়ে বলল,
“অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়ি ফেরা দরকার। মা কল করছে। আমি আর তানিয়া একসঙ্গে বাড়ির দিকে গেলাম তবে।”

স্বচ্ছের চোখমুখ চুপসে গেল। মনে মনে যেন হাসিতে ফেটে পড়ল মোহ। দুই ভাইকে জব্দ করতে পেরে একটা জয়ের অনুভূতি কাজ করছে। ভালোই লাগছে। স্বচ্ছ শুকনো গলায় বলল,
“আমি দিয়ে আসি তোমায়!”

“কোনো প্রয়োজন নেই। আপনারা বরং দুই ভাই প্রেমের লাইসেন্স নিয়ে তর্ক করতে থাকুন। আমরা আসি।”

ইথানের হাত ধরে তানিয়ার সঙ্গে হাঁটা ধরল মোহ। স্বচ্ছ চোখ গরম করে সৌমিত্রের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পারে না এই দৃষ্টি দিয়েই ছেলেটাকে বেহাল করে ফেলবে। সৌমিত্র দাঁত কেলিয়ে বলল,
“আমার কোনোই দোষ নেই। প্রেম করবা না? যাও করো প্রেম!”

স্বচ্ছ সৌমিত্রের গাল ধরে জোরে চাপ দিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“বাড়ি চল আজকে। তোর সাথে WWE খেলব। বাড়ি যেতে যেতে হসপিটালে কল করব এডভান্স বুকিং করে রাখব তোর জন্য।”

কথা শেষ করে হনহনিয়ে নদীর পাড় থেকে উঠে পড়ল স্বচ্ছ। বাইকে বসল। সৌমিত্র পিছু ছুটতে ছুটতে স্বচ্ছ বাইক স্টার্ট দিয়ে চালাতে আরম্ভ করল। সৌমিত্র চিল্লিয়ে ওঠে।
“ভাইয়া আমাকে তো অন্তত নিয়ে যাও।”

“পারব না। পেছনের সিট একজনের জন্য বুকিং করা।”

সাফ জবাবে আর কোনো উত্তর পেল না সৌমিত্র। বিড়বিড়িয়ে ভাইয়ের উপর রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে গাড়ির খোঁজ করতে লাগল।

পাশাপাশি হাঁটছে তানিয়া ও মোহ। মোহের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে চলছে ইথান। মোহ হালকা কেশে বলল,
“ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস বলিস নি তো!”

তানিয়া যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় নয়ত আকাশে উড়ে যায়। হাতের আঙ্গুল কামড়ে বলে,
“আরে তেমন কিছু না তো!”

“তবে কেমন কিছু?”

তানিয়া এবার আস্তে আস্তে মোহকে তার পুরো সিদ্ধান্ত জানালো। মোহ এবার ভ্রু উঁচিয়ে উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইল,
“কেন তুই বিষয়টাতে সৌমিত্রকেই চয়েস করলি? কেন তুই অন্য কাউকে ভরসা করলি না?”

তানিয়া নিরুত্তর। সে তার অজান্তে সৌমিত্রকে সীমাহীন ভরসা করে ফেলেছে সেটা সে বুঝেও উঠতে পারেনি। মোহ মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
“কারণ তুই জানিস ছেলেটা তোকে সত্যিকার অর্থে চাইছে। তুই তাকে বিশ্বাস করিস, ভরসা করিস। হয়ত পছন্দও করিস।”

তানিয়ার মুখ ফ্যাকাসে হয়। বিষণ্ণ মুখে জানালো,
“কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। ভয় হয়। যদি আগেট বারের মতো কিছু হয় তবে দুনিয়া, সম্পর্ক সবকিছুর প্রতি অবিশ্বাস চলে আসবে।”

“তুই একটা মানুষকে দিয়ে বাকিদের বিচার করতে পারিস না। সৌমিত্র খারাপ ছেলে নয়। কলেজ লাইফে সবারই উদ্ভট কিছু আবেগ থাকে সেসবে জড়িয়ে সবার অতীত থাকতেই পারে। তোর নিজেরও অতীত আছে। সেসব দিয়ে ওকে বিচার করতে যাস না। তুই ছেলেটার চোখে তার সত্যি দেখতে পাবি।”

তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“সেকারণেই তো ভরসা করেছি উনাকে।”

এরপর সব নীরব থাকে। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়ায় গাড়ির জন্য। তানিয়া এবার নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“এই তোর মনে আছে আমি আগে বলতাম যে আমরা যদি একই বাড়িতে বিয়ে হই তবে কতটা মজার হবে! তুই কী বলতি যেন? তোর আদেও বিয়েই হবে কিনা তুই জানিস না। আজ আমার ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে তো?”

মোহ হেসে ওঠে। অতঃপর বলে,
“ছোটো জা হচ্ছিস। বড়ো জা কে সম্মান দিয়ে চলবি।”

তানিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বয়েই গেছে।”

দুই বান্ধবীর এসব আলাপ চলতে চলতে গাড়ি পেয়ে গাড়িতে উঠে যায় তারা।

ইলেকশন শেষ। ফলাফল বেরিয়েছে। চারিদিকে শৌভিকের বাবা মীর সাহেবের প্রশংসার ছড়াছড়ি। উনার নামে কতশত মিছিল। তবে শৌভিক ব্যস্ততা থেকে ছুটি পায় না। তার কাছ থেকে ছেলেপেলে সরে না। ভিড় লেগেই আছে। সকলে শৌভিকের কাছে জম্পেশ খাওয়াদাওয়ার আবদার করেছে। তাদের আবদার পূরণ না হলে তাকে এখান থেকে যেতে দেবে না তারা। অগত্যা শৌভিক এখনো তার ক্লাবে বসে রয়েছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত তখন আটটা। শৌভিক সকলের মাঝেই নিজের ফোনটা বের করে বলল,
“আমারে যখন ছাড়বিই না তো এখন সবাই মুখ বন্ধ কর। একটা শব্দও যেন না বাহির হয়। এখন তোদের ভাবির সাথে কথা বলব। সিঙ্গেল পোলাপাইনদের কষ্ট হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। দোষ কিন্তু তোদেরই।”

সেখানে উপস্থিত থাকা আলিফ নামের ছেলে বলে উঠল,
“কোনো সমস্যা নাই। আমরা না হয় সিঙ্গেলরা বিবাহিত ভাইয়ের কথপোকথন শুনে একটু অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।”

শৌভিক কথা না বাড়িয়ে ফারাহর নম্বরে কল করল। কল বেজে গেল তবে রিসিভ হলো না। শৌভিক বেশ বুঝল মেয়েটা হয়ত রাগ করেছে। দ্বিতীয়বার কল করল শৌভিক। এভাবে একে একে চারবার কল করার পরেও যখন ওপাশ থেকে কেউ কল তুলল না তখন শৌভিক সবার উদ্দেশ্যে হতাশা নিয়ে বলল,
“দেখ, যেই ভাইকে তোরা মাথায় তুলে নাচিস তাকে তার বউ পাত্তায় দিচ্ছে না। তোদের আবদারে এখনো এখান থেকে বের হতে পারছি না ওদিকে আমাট শাশুড়ি সেই কবে বলেছে আমাকে যেতে। বউয়ের রাগ না ভাঙলে তোদের সব কয়টাকে নিয়ে গিয়ে একসঙ্গে কান ধরে নিজেও স্যরি বলব, তোদের দিয়েও বলাব।”

শৌভিক আবারও কল দিলো। এবার কলটা রিসিভ হলেও ওপাশ থেকে ভেসে এলো সৌমিত্রের মোটা গলার স্বর। সালাম দিয়ে বলল,
“শৌভিক ভাই আপনার বউ তো মুখ বেলুনের মতো ফুলিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।”

“তোমার বোন কি আমার সাথে কথাই বলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করল নাকি?”

সৌমিত্র সহসা জানায়,
“যা ত্যাঁড়া বউ পেয়েছেন আপনি! বলা যায় না প্রতিজ্ঞা করতেও পারে। তাও ভালো যে আমি ওর ঘরের এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই কল রিসিভ করলাম আপনার।”

কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে কাঁথা থেকে বেরিয়ে বালিশ ছুঁড়ে মা/রল ফারাহ৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এই সৌমিত্রের বাচ্চা তোর নিজের ফোন নেই? বোনের ফোন তার অনুমতি না নিয়ে ধরিস লজ্জা করে না? যা, না তোর প্রেমিকার সঙ্গে ফোনআলাপ কর। আমার নামে দুর্নাম করবি না।”

সৌমিত্র প্রচণ্ড দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
“শুনলেন ভাইজান আপনার বউয়ের কথাবার্তার ছিঁড়ি? বড়ো ভাইকে তুইতোকারি করছে। আপনি এসে একটু বিচার করুন।”

শৌভিক বুঝল কোনোমতেই এখন আর ফারাহকে কোনোমতেই ফোন কলে মানানো যাবে না। ফারাহর সামনাসামনি যেতে হবে তাকে। তাই দেরি না করে বলল,
“আচ্ছা, আমি একটু পরেই তোমাদের বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছি। তোমার বোনকে জানাতে হবে না সেটা।”

সৌমিত্র সম্মতি দিয়ে কল কাটল। এরপর আধঘণ্টার মধ্যে দ্রুত সবার জন্য খাবারদাবারের ব্যবস্থা করে নিজে না খেয়ে বেরিয়ে পড়ে শৌভিক। এরই মাঝে তার মনে পড়ে মোহের কথা। মেয়েটাকে একটা কল না করলেই নয়। তার সঙ্গেও ব্যস্ততার চাপে মাঝে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। তাই গাড়িতে বসে কল করে তাকে। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে মোহ প্রচণ্ড আনন্দের জোরে চিল্লিয়ে ওঠে,
“কংগ্রাচুলেশনস!”

“থ্যাংক ইউ ডিয়ার। বহুদিন পরে বোধহয় কোনো ন্যায্য লোক নিজের স্থান পেল জানিস তো! এটা সত্যি আমার বাবা কখনোই নিজেকে এতটা নিচে নামবে না যতটা সরোয়ার সাহের নেমেছিলেন। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেও শুরু থেকে শুধু হার দেখে গেলেন আমার বাবা। আর অযোগ্য লোকটা সেই আসন পেতেই থাকলেন।”

“পুরোনো ওসব কথা এখন ভুলে যাও। সামনে তোমাদের উপর বিশাল দায়িত্ব। জনগণ তোমাদের ভরসা করে। সেটার মান রাখবে আশা করি।”

শৌভিক মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর করে,
“অবশ্যই ম্যাডাম। তা আমি না হয় ব্যস্ততায় কল দিতে পারি না। তোর কল দিতে কি গায়ে লাগে? নাকি প্রেমিক নিয়ে ফোন আলাপ করার পর আর সময়ই পাস না?”

“তেমন কিছুই না। তুমি ব্যস্ত ভেবেই কল দিইনি এতদিন। ভাবছিলাম আজ কল দেব। ভাবতে ভাবতে তুমিই দিলে।”

“থাক আর বাহানা দেখাতে হবে না। এগুলা আমার কাছে অচল। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি বুঝলি? বউ রাগ করেছে।”

মোহ ফিক করে হেসে দিয়ে জানায়,
“তবে সাথে গোলাপ নিয়ে যেও। রাগ ভাঙাতে সুবিধা হবে।”

“ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস তো! থ্যাংকস মাই গ্রেট সিস্টার।”

আর দুয়েকটা কথা বলে ফোন কাটল মোহ। এরপর কিছু সময় নিয়ে স্বচ্ছকে কল দিলো। তবে স্বচ্ছ কল ধরল না। এই দিয়ে ছয়বার স্বচ্ছকে কল করল সে। তবে ফলাফল শূন্য। মোহের এবার টনক নড়ে। শৌভিককে বিষয়টা জানাতে চেয়েও জানাল না সে। তবে স্বচ্ছ তো কখনো এমন করে না!

পরদিন বিকেল গড়িয়েছে। সূর্যের পাত্তা নেই আজ। আকাশ মেঘ মেঘ করছে। আজ বহুদিন পর ক্লাবে বসেছিল স্বচ্ছ। বন্ধুরা রয়েছে সাথে। তারা প্রায় সবাই সিগারেট নিয়ে মেতেছে৷ এই বয়সে যেই জিনিসের নেশা সবচেয়ে বেশি কাজ করে তা হচ্ছে সিগারেট। স্বচ্ছের বন্ধু শুধাল,
“কীরে ভাই, তোর চোখমুখের এই অবস্থা কেন? চেনাই যায়না আজকাল।”

স্বচ্ছ জবাব দেয় না। চোখ বন্ধ করে বসে আছে চেয়ারে মাথা উপুড় করে। সিগারেটের গন্ধ নাকে আসলে চোখ মেলে তাকায় সে। রাতে ঘুম হয়নি। চোখ লাল হয়ে গেছে অনেকটা। হঠাৎ সে প্রশ্ন করল,
“তোরা দাবি করিস সিগারেটে টান দিলে নাকি সমস্ত টেনশন ছেড়ে যায়। কতটা কতটুকু যৌক্তিক?”

তার এক সিগারটখোর বন্ধু সিগারেটে টান দিয়েই প্রচণ্ড কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
“একশো পার্সেন্ট সত্যি ব্রাদার।”

স্বচ্ছ হাত বাড়ায়। সিগারেট নিতেই তাদের মাঝে অন্যজন বলে,
“কী ব্যাপার ভাই? যেই তোকে আমরা বলে বলে সিগারেট ধরাতে পারলাম না এতদিন সেই তুই কাল থেকে সিগারেট খাচ্ছিস! অবিশ্বাস্য ব্যাপার!”

স্বচ্ছ কিছু বলে না। ঠোঁটে সিগারেট লাগায়। ধোঁয়া টেনে নেয় নিজের ভেতরে। গতকাল প্রথম প্রথম অনেক কাশি উঠলেন আজকে কিছুটা সয়ে গেছে। ধোঁয়া ছেড়ে আরেক টান দিতে যাবে তৎক্ষনাৎ দরজার পাশ থেকে কেউ বলে,
“সিগারেট খাওয়া শেষ হলে কি আপনার একটু সময় হবে আমার সঙ্গে কথা বলার?”

চেনা কণ্ঠে অনেকটা চমকে তাকাল স্বচ্ছ। মোহ দাঁড়িয়ে আছে। হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিবে কিনা ভাবতে ভাবতেই মোহ বলল,
“সিগারেট খেতে পারেন। আমি বাহিরে ওয়েট করছি।”

স্বচ্ছ সিগারেট ফেলে দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে এলো। তারা দুজন গিয়ে বাহিরে দাঁড়াল। মোহ বলল,
“ফেলে দিলেন কেন? বললাম তো ওয়েট করছি।”

স্বচ্ছ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তুমি হঠাৎ এখানে?”

“বাধ্য হয়ে এসেছি। আপনার খোঁজ পাচ্ছিলাম না তাই। সৌমিত্র বলল আজকে ইন্টারভিউ দেওয়ার পর থেকে আপনি বাড়ি ফিরেন নি। তাই ভাবলাম ক্লাবে এসে দেখে যাই। ধারণা সত্যি হলো। যা দেখলাম সেটাও অনবদ্য!”

স্বচ্ছ নীরব। মোহ ফের বলে,
“কবে থেকে শুরু হয়েছে সিগারেট খাওয়া?”

“গতকাল থেকে।”

স্বচ্ছের সহজ স্বীকারোক্তি। মোহ এবার নরম হলো। নিজের ভেতরের ব্যাকুলতা লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে আপনার? কাল থেকে কেন ফোন ধরছেন না।”

স্বচ্ছ একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
“আই এম অ্যা লুজার। এই লুজারের সাথে তোমার কথা বলাই উচিত নয়। আমার দ্বারা কিছুই সম্ভব না।”

মোহ আন্দাজ করতে পারে এবার। স্বচ্ছের হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“শুধুমাত্র এই কারণে আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে ছিলেন?”

স্বচ্ছ ফট করে বলে দিলো,
“আমি তোমার যোগ্যই নই মোহ। আমি একটা অযোগ্য।”

স্বচ্ছের কথা শেষ হলে আকস্মিকভাবে একটি শব্দ হলো। স্বচ্ছের গালে থা/প্পড় পড়ার শব্দ! কোনোপ্রকার ভাবনাচিন্তা ছাড়াই মোহ চোখমুখ খিঁচে তাকে চ/ড় মে/রে দিয়েছে।

চলবে….