যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া [দ্বিতীয় খণ্ড] পর্ব-৪৫ অন্তিম পর্ব (শেষ অংশ)

0
13

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
অন্তিম পর্ব (শেষ অংশ)
[দ্বিতীয় খণ্ড]

সকালবেলা ইথানকে তৈরি করিয়ে দিচ্ছে মোহ। স্কুল ড্রেসের টাই ঠিকঠাক করে লাগিয়ে দিতে দিতে মোহ বলে উঠল,
“আজকে তোমার নানাভাই তোমায় নিতে আসবে। নানাভাইয়ের সাথে ওই বাড়িতে চলে যাবে ঠিক আছে?”

“তুমি ওখানে কখন যাবে মাম্মা?”

“যাব তবে একটু দেরি হতে পারে।”

ইথান মাথা নাড়ায়। তার চুল ঠিক করে বিছানার উপর থেকে নিচে নামিয়ে দিতেই মোহ ঘুরে দেখে স্বচ্ছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্বচ্ছের হাতে তার পোশাকের টাই। মোহ চোখ ছোটো করে তাকাতেই স্বচ্ছ তার হাতে টাই ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“বৈষম্য করলে তো চলবে না। আমারও টাই ঠিক করে দিতে হবে।”

ইথান সোফা থেকে ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে উঠল,
“তুমি তো বড়ো হয়ে গেছো বাবা। তোমার কেন হেল্প লাগবে?”

স্বচ্ছও জবাবে হাসি দিয়ে ইথানের গালে হাত রেখে বলে উঠল,
“তোমার মাম্মার হাতে জাদু আছে তো তাই!”

মোহ স্বচ্ছের টাই নিয়ে ধমকে উঠে বলে,
“কচু আছে।”

মোহ স্বচ্ছের টাই বেঁধে দেয়। স্বচ্ছ তাকিয়ে থাকে একনাগাড়ে। মেয়েটা এখনো স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। আজকাল একটু বেশি ঘুমাচ্ছে সে। সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে পারছে না। স্বচ্ছকেই ডেকে দিতে হচ্ছে। স্বচ্ছের ভাবনার অন্ত ঘটে মোহের কথায়।
“এভাবে তাকাবেন না। আমার মন এখনো আপনার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। ঝড় তোলে।”

“তোমার মনের ঝড়েই বোধহয় তোমার প্রেমে পড়ে গেছি।”

ফিসফিসিয়ে বলে স্বচ্ছ যেন ইথান শুনতে না পায়। মৃদু হাসে মোহ। হাত দিয়ে স্বচ্ছের চুল নেড়ে ঠিক করে দেয়। অতঃপর নিজে তৈরি হতে ওয়ারড্রব হাতড়ায় মোহ। প্রথমে শাড়িতে হাত দেয়। খুবই হালকা সবুজ রং। স্কুলের জন্য মানানসই। স্কুলে সবসময় হালকা রঙের পোশাক পরতে হয়। স্বচ্ছ বিছানার ধপ করে বসে গা এলিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“না, না শাড়ি নয় প্লিজ। শাড়িতে মোহ ম্যাডামকে চমৎকার লাগে। মোহের মোহে আটকে যাওয়া খুব সহজ হয়ে যায়। শাড়ি একদম চলবে না।”

মোহ চাপা হাসি দিয়ে শাড়ি রেখে হালকা মিষ্টি রঙের কামিজ বের করে তার সাথে সাদা ওড়না। ড্রেস বদলিয়ে আয়নার কাছে এসে চুলে হাত দিয়ে দেখে চুল এখনো কিছুটা ভেজা। মোহ চুল না বাঁধার সিদ্ধান্ত নেয়। হালকা আঁচড়ে চুল ছেড়ে রাখতেই স্বচ্ছ হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“চুল খোলা? তুমি কি চাও অফিসে থেকে আমি কাজের বদলে তোমার চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক করে ম/রে যাই?”

মোহ স্বচ্ছের পানে ঘুরে কপাল কুঁচকে উঁচু গলায় বলে উঠল,
“কীসব আজগুবি কথা!”

“হ্যাঁ। আমার কথা আজগুবি তো লাগবেই। আমি নিজের চোখে দেখেছি। তোমার ওই কলিগ না কী যেন নাম সায়েম মনে হয়। তোমার দিকে বারবার আঁড়চোখে তাকায়। কত সুন্দর হেসে কথা বলে। আমি যেকোনো সময় ওই শালার চোখে মে/রে দিয়ে কানা করে দিতে পারি কিন্তু। এসবের কোনো গ্যারান্টি নেই। তোমার জবের কথা ভেবে চুপ আছি আমি।”

একনাগাড়ে কথাগুলো শেষ করে থামে স্বচ্ছ। তার ফর্সা মুখশ্রীর রং পাল্টাচ্ছে ক্রোধে। মোহের হাসি পেলেও হাসেনা। এখন হাসলে সেটা আগুনে ঘি ঢালার মতো হবে। বড়ো শ্বাস নিয়ে সে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি এখনি চুল বেঁধে নিচ্ছি। আর ওই সায়েম জানে তো আমি বিবাহিত। আপনাকেও দেখেছে। তাই খুব একটা বেশি কথা বলেনা দরকার ছাড়া। এবার শান্তি?”

“একটু একটু!”

ইথান রুমের বাহিরে গিয়েছিল। ফের সে দৌড়ে ফিরে আসে। ড্রেসিংটেবিল থেকে তার আইডি কার্ড নেয়। মোহ তাকে ডেকে খানিকটা ঝুঁকে তার গালে চুমু খায়। এটা তার প্রতিদিনের বিদায় জানানোর নিয়ম। মোহ সোজা হয়ে দাঁড়াতেই একটু চমকায়। স্বচ্ছও সামান্য হেলে গাল এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মোহ চোখ রাঙায় এবং সাথে সাথে স্বচ্ছের গাল ধরে সরিয়ে দেয়। ইথান আবারও মিসেস জেবার দৌড়ে যায় নিচে সকালের খাবার খেতে। স্বচ্ছ নারাজ হয়। মুখ ভার করে সেও ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। মোহ ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে গিয়ে স্বচ্ছের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তার টাই টেনে ধরে গালে ঠোঁটের নিবিড় স্পর্শ ছোঁয়ায়। পরক্ষণেই স্বচ্ছের ঠোঁটেও একই পরশ ছুঁইয়ে তড়িৎ গতিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় মোহ। এহেন কাণ্ডে স্বচ্ছ তাজ্জব বনে যায়। কিয়ৎক্ষণ সময় নেয় সেই স্পর্শ অনুভব করতে।

সকালের খাবার খেতে বসেছে সবাই। মোহ রুটি বানিয়ে মিসেস জেবাকে সাহায্য করলেও বাকি কাজ উনি নিজ হাতেই করেছেন। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে উনি ভালোবাসেন। মিসেস জেবার মন আজকে একটু ভার। উনার স্বামীর জন্মদিন আজ। অথচ মানুষটাকে পাশে পাচ্ছেন না। উনাকে একটু শুভেচ্ছা জানাতে কতই না কাঠখড় পোড়াতে হয়! দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মিসেস জেবা মোহকে ডিম ভাজির বাটি এগিয়ে দিলেন। মোহ একবার ডিম ভাজি দেখে সাথে সাথে বাটিটা একটু দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,
“ডিম খেতে ইচ্ছে করছে না। গন্ধটা ভালো লাগছে না আজ।”

উপস্থিত সকলেই হতবাক হয়। মিসেস জেবা চোখ বড়ো বড়ো করে শুধালেন,
“ডিম তো তোমার প্রিয় বলেই তোমার জন্য ভেজে নিয়েছিলাম। গন্ধ তো ঠিকই আছে। হঠাৎ কী হলো?”

সৌমিত্রও বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেসা করল,
“ভাবির শরীর ঠিক আছে?”

মোহ উত্তরে বলল,
“আমি ঠিকই আছি। শুধু আজকে খাওয়ার রুচি নেই।”

স্বচ্ছকে চিন্তিত দেখালো। ইশারায় জানতে চাইল মোহের কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। মোহও ইশারায় জানায় সে একদম ঠিক আছে। সামান্য স্বস্তি পেলেও মনে উঁকি দেয় চিন্তা।

আজ মোহের দুটো ক্লাস করানোর ছিল। তাই সে তাড়াতাড়ি নিজের ছুটি নিয়ে নিলো। উদ্দেশ্য সরোয়ার সাহেবের সাথে দেখা করার। তার নিজেরও জানা নেই সেই ব্যক্তিটি তার প্রতি কীরূপ আচরণ করবে। খানিকটা অস্বস্তি কাজ করে মোহের অন্তরে।

ভিজিটর রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো সরোয়ার সাহেবকে। হতবিহ্বল হয়ে বড়ো আইরন গ্রিলের ওপাশে দেখলেন তিনি। এতগুলো দিন পর এই মেয়েটিও যে উনার সাথে দেখা করতে আসতে পারে সেটা উনার কল্পনাতীত ছিল। সরোয়ার সাহেব চেয়ারে বসেন। মোহও বিপরীতে বসা ছিল। সে অবাক নয়নে দেখছিল সেই কয়েক বছর আগের দাম্ভিক মানুষটিকে। মানুষটির চোখেমুখে আর অহংবোধ ফুটে ওঠে না। সেই ক্ষমতার তেজে জ্বলে ওঠেন না। সারা মুখে সরলতা ধরা দিয়েছে। বড়ো বড়ো দাড়ি রেখেছেন তিনি। মাথার টুপি আর কপালের কালো দাগ দেখে বোঝা যায় নিশ্চিত লোকটি সারাদিন ইবাদতে মগ্ন থাকেন। অভিভূত হয় মোহ। সরোয়ার সাহেব কিছু বলার আগেই সালাম দিয়ে বসে মোহ। তারপর জানায়,
“আপনাকে শুভ জন্মদিন। কেমন আছেন?”

সরোয়ার সাহেব মাথা ঝাঁকিয়ে সালাম গ্রহণ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ শুভেচ্ছা জানানোর জন্য।”

“আমাকে দেখে অবাক হোন নি?”

“হয়েছি। তবে আমার একটা ইচ্ছা ছিল। সেটা পূরণ হয়েছে।”

মোহ আগ্রহের সহিত বলল,
“কী ইচ্ছা জানতে পারি?”

“তোমার সাথে দেখা করার। একবার আমার ছেলের সাথে তোমাকে দেখার। বাবা হয়ে বিয়েতে তো থাকতে পারিনি। কিন্তু স্বচ্ছ আসেনি?”

“এসেছে। ও বাহিরে আছে। আমি চেয়েছি প্রথমে একা আপনার সাথে দেখা করার জন্য।”

সরোয়ার সাহেব চকিতে বলে ওঠেন,
“কেন?”

“জানি না। হয়ত ভেবেছিলাম আমার প্রতি আপনার অভিব্যক্তি অন্যরকম হবে। হয়ত মসৃণ নাও হতে পারে আমাদের কথোপকথন।”

সরোয়ার সাহেব তপ্ত নিশ্বাস ফেলে জানতে চান,
“তুমি কি আমার প্রতি এখনো রাগ পোষণ করে রেখেছ?”

“না। অনেকদিন তো হলো। একটা মানুষ যখন নিজের ভুল বুঝে অনুতপ্ত হয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে মাথা নুইয়ে ক্ষমা চায় সেই মানুষকে যদি অন্য মানুষ ক্ষমা না করে রাগ পুষে রাখে তাহলে সেটাই অপরাধ। সেই অপরাধ আমি করতে চাইছি না আর।”

সরোয়ার সাহেব নীরব রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর কাতর গলায় বললেন,
“পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার সাথে যে অন্যায় করেছি সেকারণে আমি মন থেকে অনুতপ্ত। আর তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

মোহ আশ্চর্য হয়ে জানতে চায়,
“ধন্যবাদ কেন?”

সরোয়ার সাহেব সরল হাসি দিয়ে বলেন,
“আমার ছেলের জীবনে আসার জন্য। তাকে জীবনের সঠিক রাস্তা চেনানোর জন্য। অতীতের আমিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। এই নতুন আমিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আমি শান্তি পাই। আগে এই শান্তিটা কখনো অনুভব করিনি।”

“মানুষ নিজের জীবনের রাস্তা নিজে নির্বাচন করে। আপনার ছেলেও তাই করেছে। আমি শুধু পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আপনিও নিজে নিজেই অনুতপ্ত হয়েছেন। অনেক মানুষ আরো জঘন্য অন্যায় করেও শাস্তি পেয়েও তার মাঝে কোনো অনুতাপ আসেনা। কিন্তু আপনি তাদের মাঝে নন।”

সরোয়ার সাহেব আর প্রত্যুত্তর করলেন না। মোহ নিজে থেকে বলে উঠল,
“মা আপনার কথা সবসময় মনে করেন।”

“কেন আমার মতো মানুষের কথা মনে করে সেটা ভেবেই তো আমি অবাক হই।”

“শুধু উনি নন। মনে মনে পুরো পরিবার আপনাকে চায়। আমি আশা করি জীবনের কোনো এক পর্যায়ে আপনি আবারও ফিরবেন তাদের মাঝে। আপনার পরিবার আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে।”

সরোয়ার সাহেবের বুক কাঁপে। ভাবেন আদেও কি সেই পরিবারে তিনি ফিরতে পারবেন?

দরজা খোলার শব্দে পিছু ফিরে তাকায় মোহ। স্বচ্ছ এবং একজন দারোগা রয়েছে। স্বচ্ছ শান্ত গলায় বলল,
“আর বেশি সময় পাব না হাতে তাই ভেতরে এলাম।”

মোহ নির্লিপ্তে জানালো,
“ভালো করেছেন। আমাদের সব কথা শেষ।”

স্বচ্ছ এগিয়ে এসে কৌতূহলী নয়নে বাবা আর স্ত্রীর দিকে একবার চেয়ে প্রশ্ন করল,
“কী কথা হলো এতটা সময়?”

“সব কথা আপনার জানার দরকার নেই। যা বলেছি বলেছি।”

“আমায় বলবে না? কী আশ্চর্য! বাবা তো আমার নাকি!”

মোহ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“উনার থেকেই জেনে নিন তবে।”

স্বচ্ছ বাবার কাছে ধাবিত হলো। বাবাকে সালাম জানিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে অপলক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনটা খুব চায় তাদের মাঝের বাঁধা ভেঙে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কতদিন সে বাবার ছোঁয়া পায় না। সেই শাসন ধমক পায়না। স্বচ্ছ নিজেকে ধাতস্থ করে। সরোয়ার সাহেব নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেসা করলেন,
“তোর মা কেমন আছে? আর সৌমিত্র?”

“মা যেমন ছিল তেমনই আছে। এখন আগের চেয়ে ভালো আছেন ইথানকে নিয়ে। আর সৌমিত্র আগের মতোই আছে। ভাঙাচোরা ছেলে কিন্তু নিজেকে জুড়ে রেখেছে মা আর আমাদের জন্য।”

সরোয়ার সাহেব দীর্ঘশ্বাস নিলেন। নিচু স্বরে বললেন,
“বাবার পাপ ছেলেকেও ধরে। আমি তোমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছি।”

স্বচ্ছ কিছু বলে না। মোহের ফোনে কল আসে। সে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“স্কুল থেকে ফোন এসেছে। আমি তাহলে আজকে আসি।”

মোহ বেরিয়ে যায়। থেকে যায় সেখানে একজন দারোগা এবং স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেব আরো জানালেন,
“সকালে ফারাহর সাথে কথা হয়েছে। মেয়েটা তার অপরাধী বাবার জন্য এখনো বাচ্চাদের মতো কাঁদে। অনেক কষ্টে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি আমি ভালো আছি। তবেই থেমেছে সে।”

স্বচ্ছ উৎসুক হয়ে শুধায়,
“আসলেই ভালো আছো?”

“আছি তো।”

শব্দহীন হাসেন সরোয়ার সাহেব। স্বচ্ছ সব প্রসঙ্গ ছেড়ে তার হাতের ব্যাগটা দেখিয়ে বলে,
“তোমার জন্য কিছু জিনিস ছিল। তোমার জন্মদিন উপলক্ষে। তোমার পছন্দ হবে। এখানে তো বেশি জিনিস দেওয়া যাবে না তাই আমরা দুই ভাই মিলে একটাই জিনিস কিনেছি।”

“কী কিনতে গেলে আবার? এই বয়সে আর কিছু চাইনা। শুধু মন থেকে তোমাদের ভালো চাই। এই খারাপ বাবা এখনো আর ক্ষমতার পেছনে ছোটে না। তার কিছু চাইনা।”

“তোমার জন্য জায়নামাজ কিনেছি। নিবে না? আর মা তোমার জন্য বিরিয়ানি আর কেক যত্ন করে বানিয়ে পাঠিয়েছে। আর হাদিসের বইটা নিয়েছে মোহ।”

বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সরোয়ার সাহেব। উনার কথা হারিয়ে গেল যেন। কণ্ঠস্বরে চাপ দিয়ে কেঁপে কেঁপে বললেন,
“মোহ দিয়েছে?”

“অবাক হলে? ও যে তোমার জন্য এটা কিনে রেখেছে আমি নিজেও জানতাম না। মায়ের মুখে শুনেছে তুমি এখন হাদিসের বই পড়তে ভালোবাসো। তাই তোমার জন্য এই উপহার নিয়েছে। গ্রহণ করবে না?”

সরোয়ার সাহেব ভালো করে ব্যাগের দিকে লক্ষ্য করলেন। নিজের মনের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলেন। অস্থির কণ্ঠে বললেন,
“নেব তো উপহার।”

স্বচ্ছ বাবার দিকে উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,
“মোহ তোমার পরিবর্তনে অনেক খুশি হয়েছে।”

“আমিও খুশি তোমাদের জন্য। তোমার মাকে আর তোমার স্ত্রীকে আমার বদলে ধন্যবাদ দিও।”

স্বচ্ছ মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতির জানায়। কথা শেষে বিদায় নেয় স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেবের বুকের ভার যেন গায়েব হয়। প্রার্থনা করেন জীবনটা যেন এভাবেই কেটে যায়।

স্বচ্ছের বাইক এসে থামে মোহের বাড়ির গলির সামনে। মোহ বাইক থেকে নামতেই স্বচ্ছ সোজাসাপটা প্রশ্ন করে,
“বাবাকে তো তুমি নিজেও উপহার দিতে পারতে। কেন দিলে না বা জানালে না?”

মোহ স্বচ্ছের উৎসুক দৃষ্টির পানে চেয়ে মুচকি হেসে জানায়,
“আমার মনে হয়েছে উনি আমার চেয়ে উনার ছেলের হাত থেকে উপহার নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন তাই।”

“তুমি আমার জন্য নিজের মনের সব রাগ ঝেড়ে বাবার সাথে দেখা করতে গেছো তাই না?”

স্বচ্ছের আরেকটা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েও নিজেকে সামলে মোহ স্বাভাবিকভাবে বলে,
“মোটেই না। সবসময় নিজেকে এত স্পেশাল ভাবেন কেন বলুন তো?”

স্বচ্ছ মোহের নাক টেনে দিয়ে বলল,
“কারণ আমি তোমার চোখ পড়তে পারি।”

“আপনি বাড়িতে আসবেন না? মা-বাবা হয়ত আপনার জন্যেও অপেক্ষা করছে।”

“আসব তো। কিছু কাজ আছে ব্যবসার। সেদিকের কাজ সেরে এদিকে এসে তোমাদের নিয়ে যাব। তৈরি থেকো কিন্তু।”

মোহকে বিদায় জানিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় স্বচ্ছ। বাইকের গতির কারণে বাতাসে বিগড়ে যাওয়ার স্বচ্ছের চুল মোহ একহাতে ঠিক করে দিতেই স্বচ্ছ রওনা হয়।

চা নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে রান্নাঘর থেকে বের হলো মোহ। বসার ঘরে যাওয়ার পথে একবার মা-বাবার ঘরে উঁকি দিলো সে। বিছানায় তার বাবা আর ইথান ঘুমাচ্ছে। ইথানের মাথার উপর আজহার সাহেবের হাত দেখে মোহ বুঝল তিনি ইথানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছেন। হালকা হেসে বসার ঘরে মায়ের পাশে সোফায় বসে মোহ। মিসেস সুফিয়া মোহের শ্বশুরবাড়ির কথা জানতে চাইলেন। কথায় কথায় তিনি বলে উঠলেন,
“কাল তোর দাদিমা কল করেছিল। তারপর কী বলছেন জানিস? সবাই এখন ইথানকে তোর আর স্বচ্ছের ছেলে বলে ভাবছে। স্বচ্ছের কথা অনুযায়ী তো তোর দাদিমা আশেপাশে সবার প্রশ্নের এই উত্তরই দিয়েছিল যে তোর আর স্বচ্ছের অনেক আগে বিয়ে হয়েছিল যখন তুই শহরে পড়তে আসিস তখন। সেই বিয়ের পরের বাচ্চা ইথান। স্বচ্ছ ছিল মন্ত্রী সাহেবের ছেলে তাই আমরা লুকিয়ে গিয়েছিলাম তোদের বিয়ের কথা। এসব মিথ্যা কাহিনী এখন গ্রামের সবাই জানে। স্বচ্ছের বুদ্ধি কাজে লেগেছে। ইথানকে কেউ আর অবৈধ বলে পরিচয় দেবে না। ইথানও বড়ো হয়ে এটাই জানবে। কখনো সত্যি জানবে না।”

মোহ মনে বিষাদ নিয়ে বলল,
“ইথান কখনো অবৈধ ছিল না মা। ও তো নিজের মর্জি মতো পৃথিবীতে আসেনি। ওর কোনো হাত ছিল না এসবে। ও কেন নিষিদ্ধ ট্যাগ পাবে? ও আমাদের সন্তান। ওর অতীত নিয়ে যেন আর কোনোদিন কোনো কথা না ওঠে। আমি স্বচ্ছ নামক মানুষটার প্রতি চির কৃতজ্ঞ। সে ইথানের সত্যিকারের বাবা হয়ে উঠেছে। তাই ওর অতীতও মুছে গেছে।”

“আমরাও নিশ্চয় অনেক ভাগ্যবান সেকারণেই তোমাকে স্বচ্ছের মতো একজন পুরুষের করে দিতে পেরেছি।”

ভারি পুরুষালি কণ্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মোহ। আজহার সাহেবকে দেখে তার মনে বাচ্চাদের মতো আহ্লাদ জেগে ওঠে। হুড়মুড়িয়ে গিয়ে বাবার বুকে পড়ে শুধায়,
“কেমন আছো বাবা? তোমার ব্লাড প্রেশার কন্ট্রোলে আছে? ঔষধ ঠিকঠাক খাও?”

মেয়ের আহ্লাদে বাবাও আদুরে স্বরে উত্তর দেন,
“তুমি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকি মোহ মা।’

“আমার ভালো না থেকে উপায় কী বলো তো? আমার প্রতিটা খুশি তোমরা আমাকে দিয়েছ। অপূর্ণ কিছু আছে কী? কোনোকিছু না ভেবে আমি যাকে জীবনে চেয়েছি তাকেও এনে দিয়েছ।”

মিসেস সুফিয়া পাশ থেকে মোহকে নির্দেশ দিয়ে বলে ওঠেন,
“তার যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব তোর। ছেলেটাকে একটুও কষ্ট দিস না যেন মোহ।”

আজহার সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার মেয়ে জানে তার প্রিয় জনের কদর করতে।”

বাবার প্রশংসায় মোহের মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এরপর বলে,
“ইথান উঠেছে ঘুম থেকে?”

আজহার সাহেব জবাবে বললেন,
“না। এখানে আসার পর খাওয়াদাওয়া করেই ঘুম দিলো ও। শরীর কি খারাপ নাকি ওর?”

“না, তেমন কিছু নয়। কাল রাতে একটু জেগে পড়াশোনা করেছিল তাই একটু বেশি ঘুমাচ্ছে। ওর শরীর খারাপ হলে শাশুড়ি মা কি ওকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন? সারাদিন ওর কাছে বসে থাকতেন আর সেবা করতেন। আর ছেলেটাও এটা সেটা বায়না করত দাদিমার কাছে।”

মিসেস সুফিয়া কোমল কণ্ঠে বললেন,
“ইথানকে তোর শাশুড়ি খুব ভালোবাসে তাই না?”

মোহ আনমনা হয়ে বলল,
“ইথানকে একদম চোখে হারান উনি। যখন আমাদের বিয়েটা হলো তখন চিত্রটা এমন ছিল না। আমি বুঝতে পারতাম ইথানকে তিনি এড়িতে চলতেন। পাত্তা দিতে চাইতেন না। আমি বুঝতাম যে ইথানকে উনি অপছন্দ করছেন। আর সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ইথানের মাঝে যে মায়ার মোহনজাল আছে সেটা আমার শাশুড়িকে কাবু করে ফেলল। এখন তো ইথানকে ছাড়া উনার ঘুমই হয়না। ইথানও হয়েছে তেমনই। সেও দাদিমার নেওটা হয়েছে। সারাদিন দাদিমার আঁচল ধরে ঘোরে।”

মিসেস সুফিয়া শান্তির শ্বাস নিয়ে বলে ওঠেন,
“যাক উনার মন তো গলেছে। ছেলেটা দাদির ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হয়নি। ওর আসল দাদি তো স্বচ্ছেরই আত্মীয়। তিনি কখনো ইথানের খোঁজ নেন নি?”

“নিতে চেয়েছেন। এসেছেন বাড়িতে কয়েকবার। কিন্তু বারবার ওই জানোয়ারের প্রসঙ্গ তুলতেন বাড়িতে এসে। কান্নাকাটি করতেন। ওই শয়তানের কথা শুনলে আমিও হাইপার হয়ে যেতাম। তাই মা উনাকে মানা করে দিয়েছেন শক্তভাবে।”

মিসেস সুফিয়া ফের একবার আশ্বস্ত হোন। নিজের আদরের মেয়েটার জীবনে সঠিক মানুষগুলো এসেছে ভেবে উনার মন প্রশান্ত হয়। নিজের সন্তানের সুখ দেখার চেয়ে বড়ো আনন্দ বোধহয় আর কোনোকিছুতে নেই।

রাতে শ্বশুর বাড়িতে ফিরেছে মোহ। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে তখন প্রায় দশটা বাজলো। ঘরে এসে মোহের নজর পড়ল ফোনের দিকে। তার ফোন বাজছে। এত রাতে ফোন কল দেখে অবাকই হয় সে। ফোন হাতে নিতেই যেন আরেক দফা চমকায়। অবিলম্বে কল রিসিভ করে বলল,
“হ্যালো। কেমন আছিস তুই?”

ওপাশ থেকে ভেসে আসে তানিয়ার শুকনো কণ্ঠ।
“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

“ভালো। কিন্তু এতদিন পর কেন কল করিস তুই? মাঝে মাঝেই তো কথা বলতে পারিস আমার সাথে।”

তানিয়ার বুকের ভেতর এক চাপা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আচ্ছা, তুই ফ্রী আছিস? তাহলে কাল তোর সাথে দেখা করতাম।”

“আছি তো। বিকালে দেখা করতে পারবি?”

“পারব। কালকেই সব জমানো কথা হবে।”

ফোনটা কাটে তানিয়া। মোহের অন্তরে এক চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তিনটা বছর হয়ে গেছে। মোহ ও তানিয়ার সামনাসামনি আর দেখা হয়নি এই বছরগুলোতে। মোহ বারবার দেখা করতে চেয়েছে। কিন্তু তানিয়া করেনি। হয়ত সংশয়ে। মোহ কালকে তানিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য একপ্রকার অস্থির হয়ে উঠল। গুনতে থাকল প্রহর।

পরদিন বিকালে মোহ অটো ধরে রেস্টুরেন্টে আসে। আজকে ইথান স্কুল শেষে বাড়ি চলে গেছে ফারাহর সাথে। ফারাহর আজকে তার বাড়ি যাওয়ার কথা। তাই ইথানকে নিয়ে ফিরেছে সে। মোহ দুরুদুরু মনে রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে ভেতরে আসে। চারিদিকে চোখ বুলায়। শেষ মাথায় কোণার দিকে চেয়ে সাদা কামিজ পরা শুকনো মেয়েটিকে দেখে চিনে নেয় সে। মোহ এগোতেই তানিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মোহের নিকট এসে কোনো কথা না বলে প্রথমে আলিঙ্গন করে। এতদিন পর নিজের প্রিয় বান্ধবীকে দেখার পর এর চেয়ে উত্তম অভিব্যক্তি আর হতে পারে না। মোহও চোখ বুঁজে তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে শুধায়,
“কেমন আছিস তুই? তোকে চেনা যায় না। এতটা শুকিয়ে গেছিস! ভালো আছিস তো? কেন দেখা করিস নি এতদিন?”

তানিয়া মোহকে ছেড়ে বসে চেয়ারে। মোহও তার বিপরীতে বসে। তানিয়া উত্তরে নিস্তেজ হাসি দিয়ে বলল,
“তোর সাথে কোন মুখে দেখা করতাম আমি? আমার সাথে ভালো শব্দটা যায় নাকি? তবুও ভালো থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি তোর খবর জানতে চাই। তোর গল্প শুনতে চাই। আমার গল্প জানিয়ে আমাদের এতটুকু মুহূর্ত বিষাদ বানাতে চাইনা। অবশ্য তুই কতটা ভালো আছিস সেটা তোর সুন্দর চেহারার দিকে তাকালে বোঝা যায়। ঝলমলে মুখটা সব জবাব দেয়। কিছু খাবি তো নাকি? আমি কোল্ড কফি অর্ডার করেছি দুজনের জন্য।”

মোহ চুপ করে তানিয়ার রুগ্ন লোচন দুটোর দিকে চেয়ে থাকে। সে উপলব্ধি করে তানিয়ার মনে সুখ নেই। তানিয়ার টেবিলে রাখা হাতটার উপর হাত রেখে মোহ দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আমি আজ কথা শুনতে এসেছি এখানে। তুই কেমন আছিস? কেমন সংসার করছিস? তোর স্বামী তোকে কতটা ভালো রেখেছে? জানতে চাই আমি। অতীতের জন্য নয়। একজন বান্ধবী হিসেবে। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল। তুই ফোনে একবারের জন্যও তোর জীবন, সংসারের আলাপ করিস নি। আমি জানতে চাইলে এড়িয়ে গেছিস। কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিয়েছিস। কেন?”

তানিয়া ফের প্রসঙ্গ পাল্টায়। গ্লাসে থাকা পানি পান করে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল,
“সৌমিত্র কেমন আছেন? আজকাল কী করছেন? নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন?”

“এতদিন পর জানতে চাইছিস? তিনটা বছর তো হয়ে গেল। সে এখন সেই পাগলাটে সৌমিত্র নেই। প্রচণ্ড বুঝদার মানুষ সে। পরিবারের প্রতি সব দায়িত্ব পালন করা এক সুপুরুষ সে। এখন সে বাইরে বাইরে আড্ডা দেয়না, বাড়িতে হৈচৈ করে না, বেফাঁস কথা বলেনা। সে আর অগোছালো নেই। তার ঘর সবসময় পরিষ্কার থাকে। সে নিজেও খুব গোছালো হয়েছে। ফর্মাল ড্রেসআপে জবে যায়, স্যুট বুট পরে কখনো কখনো। ওর চাকরি করা কোম্পানিতেও ওর বেশ সুনাম আছে। কোনো খামতি নেই। কিন্তু ওর অন্তরটা খালি। তুই জানতে চাসনি ওর ব্যাপারে কখনো। আমিও বলিনি। কারণ তোর তো বিয়ে হয়েই গেছিল। স্বামী তো স্বামীই হয় তাই না?”

তানিয়া বিস্মিত হলো বোধহয়। হয়ত সৌমিত্রের এঔ পরিবর্তন শুনে। একইভাবে বসে রইল। একটু সময় পর অস্ফুটস্বরে বলল,
“উনি জব পারসন হয়ে গেছেন?”

তানিয়ার চোখে ঝলক বলে দিলো সে সৌমিত্রের জন্য খুশি। অতঃপর মোহের পানে চেয়ে বলে ওঠে,
“আমিও ঠিক একই কারণে সৌমিত্রের খবর জানতে চাইনি এতদিন। স্বামীকে মনে বসানোর চেষ্টা চালিয়েছি। সৌমিত্রকে মন থেকে দূরে রাখার ভান ধরে গেছি। সবসময় সংসার নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু ভাবনাগুলো বেশিদিন টিকল না। মুক্ত বিহঙ্গিনী হয়ে গেছি এখন। তাই উনার কথা জিজ্ঞেস করতে খুব মন চাইল।”

মোহের কপালে ভাঁজ পড়ে তানিয়ার কথা শুনে। সময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেও তা না বুঝে জানতে চেয়ে বসে,
“মানে? তোর শেষ কথা আমি বুঝিনি।”

“ডিভোর্স হয়ে গেছে আমার। আমার মধ্যে মা হওয়ার ক্ষীণ সম্ভবনা দেখে আমার স্বামী আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। সে বাবা হতে চায়।”

তানিয়ার কণ্ঠ শীতল। তবে মোহের এসব কথা কুর্ণকুহরে পৌঁছানোর পর মনে হলো যেন তার পায়ের তলায় আর জমিন নেই। মাথা দুলে উঠল তার। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কী বলছিস তুই? ডিভোর্স হয়েছে? তোর মা হওয়াতে কমপ্লিকেশনস্ আছে?”

“এন্ডোমেট্রিওসিস। এর মানে জরায়ুর বাহিরে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু বেড়ে যাওয়া। যার কারণে গর্ভাধারণ করতে বাধাগ্রস্ত হই আমি।”

বাকহীন হয়ে বসে রয় মোহ। গলায় জোর দিয়ে থেমে থেমে বলে ওঠে,
“এর জন্য লোকটা তোকে ছেড়ে দিলো?”

“হ্যাঁ, দিলো। তার পরিবারের মন্তব্য, তাদের ছেলেদের কী দোষ? কেন বংশের আলো দেখতে পাবেন না তারা আমার জন্য? আমি তাদের বারবার বলেছিলাম যে আমার সমস্যাটা পারমানেন্ট নয়। ডাক্তার বলেছে প্রপার ট্রিটমেন্টে সব ঠিক হতে পারে। কিন্তু সময় দিতে হবে। আমি শতভাগ অক্ষম নই। ত্রিশ ভাগ সম্ভবনা এখনো আছে মা হওয়ার। কিন্তু ওরা নির্দয়ের মতো আমাকে দূরে ঠেলে দিলো।”

“তোর হাজবেন্ড একবারের জন্যও তোর পাশে থাকেনি?”

“না, কেন থাকবে আমার মতো একটা অক্ষম স্ত্রীর পাশে? প্রতি রাতে রাগারাগি করত। বিশ্বাস কর আমি বিয়ের পর নিজেকে অতীত থেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। যাকে ঠকিয়েছি তাকে মন থেকে সরানোর চেষ্টা করেছি। কতটা পেরেছি জানি না। কিন্তু আমি সংসারে মন দেওয়ার চেষ্টা করেছি। মিরাজকে নিজের মাঝে জায়গা দিয়েছিলাম। নিজের ভাগ্যের মাধ্যমে নিজেকে ভালো রাখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের কয়েকদিন পরপরই শাশুড়ি শুধু বাচ্চার কথা বললেন আমায়। যেকোনোভাবে বোঝাতে চাইলেন তিনি নাতিনাতনি চান। তার ছেলে দেশে থাকেনা। সামান্য সময়ের জন্য দেশে আসে তাই দ্রুতই বাচ্চা নিতে হবে। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলাম না। নতুন পরিবেশ তার উপর শ্বশুরবাড়ির এমন চাপ। সবার কথা রাখতে বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করে পারিনি। ভাবলাম, ভাগ্যে থাকলে বাবু আসবেই। এরপর মিরাজ দেশে ফিরল। বিদেশের কোম্পানির ব্রাঞ্চ দেশে থাকাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মিরাজ দেশেই থাকবে। এরপর সবার পক্ষ থেকে আরো বেশি চাপ এলো। বলল, আমার বয়স নাকি এমনিতেই বেশি। আরো দেরিতে বাচ্চা নিলে বাচ্চাই হবেনা। সেসব কথা মেনে বাবু নিতে চেয়েও যখন হলো না তখন মিরাজ জানায় ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। কারণ প্রায় আড়াই বছরেও কোনো লাভ হচ্ছিল না। আমি বাধ্যমতো তার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানলাম আমার মধ্যে সত্যি সমস্যা আছে। মাথায় বাজ পড়ল সেদিন। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় মিরাজের হাত ধরে কান্না করতে করতে বারবার জানতে চেয়েছিলাম সে আমাকে ছেড়ে দেবে না তো? কিন্তু ও একবারও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেনি এবং জবাবও দেয়নি।”

কথাগুলোর মাঝে আঁটকে যায় তানিয়া। কণ্ঠস্বর কান্নায় রোধ হয়ে আসে। আঁখির অশ্রু গড়িয়ে পড়তে চায়। মোহ নির্বাক হয়ে রয়। ঢক গিলে তানিয়ার দিকে টিস্যু এগিয়ে দেয়। তানিয়া টিস্যু নিয়ে চোখের কাছে ধরে হালকা হাসার চেষ্টা করে। সেই হাসি কোনো আনন্দের না। যাতনায় পরিপূর্ণ এক ম্লান হাসি। তানিয়া আবার বলতে আরম্ভ করে,
“তারপর থেকে আমার জীবনে নতুন ঝড় নেমে আসে। প্রতিদিন শাশুড়ি বন্ধ্যা বলে ডাকতে লাগলেন। আমি মিরাজকে অনুরোধ করলাম যেন আমার পাশে থাকে। আমি চিকিৎসা করাব। আমি নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাব। মিরাজ উত্তরে বলেছিল, বাচ্চা হওয়ার হলে এতদিন হয়ে যেতো। আমায় দিয়ে কিছুই হবে না। আমি নাকি ব্যর্থ স্ত্রী! এতসব অপবাদ নিয়ে আমার আর ওখানে ঠাঁই হয়নি। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কী জানিস? আমাদের তখনও ডিভোর্স ফাইনাল হয়নি। সেসময় থেকেই আমার ননদ আর শাশুড়ি মিলে মিরাজের জন্য নতুন পাত্রী দেখা শুরু করেন। আমি তো সেদিনই হার মেনে নিয়েছি।”

দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে মোহ। দম বন্ধ অনুভূত হয় তার। গুমোট লাগে পরিবেশ। শুকনো ঢক গিলে বলে,
“তোর মা-বাবা আর ভাইয়ের কী মতামত এখন?”

তানিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে এবং বলে,
“মা কেঁদেই মরে যাচ্ছে। চিন্তায় বারবার বাবার প্রেশার ফল হচ্ছে। আর আমার ভাই? সে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তার কিছু বলারই নেই। আমার সব ধ্বংস করে দিয়ে সে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে আছে। তাদেরকেও মিরাজের বাড়ির লোকজন যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছে। আমি প্রতিবাদ করিনি। ইচ্ছে জাগেনি। তারা তো অপমানগুলো নিজেই টেনেছে।”

“তোর যেই ভাই গলায় ছুরি ধরে তোকে বিয়ে করিয়েছিল এখন সেই ভাই নিস্তব্ধ? ছি!”

ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে আসে মোহের। তানিয়া মন্তব্য করে,
“নিস্তব্ধ তো হবেই। তার ধারণা ছিল সে আমার জন্য বেস্ট মানুষ এনেছে। কিন্তু সে ফেল করে গেল। তাই ইগো হার্ট হয়েছে তার। তাই লজ্জা পাচ্ছে, অপমানবোধ করছে। আমার মা এখন তোর কথা বারবার বলে। তুই সেদিন মাকে বলেছিলি তারা নাকি জাহিল। তুই নাকি ঠিকই বলেছিলি। আমার মা এখন আমার সুখের জন্য হাহাকার করেন। অথচ উনারাই বহু আগে আমার জীবনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন।”

মোহের সান্ত্বনার বাণী ফুরিয়ে আসে। তানিয়ার বসে যাওয়া মুখ দেখে ভেতরে কেঁপে ওঠে। মৃদু স্বরে জানতে চায়,
“এখন তুই তোর বাড়িতে থাকছিস? কী করবি ভবিষ্যতে কিছু ভেবেছিস?”

তানিয়া ফের হাসল। বলল,
“আমার বাড়ি? কোনটা আমার বাড়ি? আমার কোনো বাড়ি নেই মোহ। আমি একা। হোস্টেলে থাকছি এখন। বাড়ি থেকে বারবার কল আসে। কিন্তু আমার আর যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করেনা। ক্লান্ত আমি। একা বাঁচতে চাই। তোর সঙ্গে আজ দেখা করার একটা উদ্দেশ্য। হয়ত আর কখনো আমাদের সেভাবে দেখা করা হয়ে উঠবে না। আমি শুধু জমানো কথা বলতে আর তোদের খবর নিতে চেয়েছিলাম।”

মোহ নড়েচড়ে বসে। চোখ বড়ো বড়ো করে আতঙ্কিত হয়ে বলে ওঠে,
“দেখা হবে না কেন?”

“আমি চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছি। সেখানে আমার ছোটোখাটো চাকরি হয়েছে। আমার দূর সম্পর্কের এক কাজিন আমায় সাহায্য করেছে এসবে। আমি সবার থেকে দূরে চলে যেতে চাই মোহ। একা শান্তির সন্ধান করতে চাই। তোর থেকে বিদায় নিতে এসেছি। কারণ আমাকে বোঝার মতো একমাত্র তুই আছিস।”

বাম চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ার আগেই অশ্রু মুছে ফেলে মোহ। দুর্বল হয় কণ্ঠস্বর। কাতর হয়ে বলে,
“যোগাযোগ রাখিস প্লিজ!”

“রাখব। সব তো শুধু নিজের গল্প করে গেলাম। তুই কেমন আছিস তোর প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে? ইথান কেমন আছে?”

তানিয়া এবার দুঃখের গল্প এড়িয়ে যেতে চায়। মোহ নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,
“জীবনে যা চেয়েছি তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। সবাই ভালো আছে।”

তানিয়ার মুখেও মিষ্টি হাসির রেখা দেখা যায়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“অনেকদিনই তো হলো। তোর সুখবর কবে শুনব? কোনো প্ল্যানিং করেছিস?”

মোহ মিইয়ে যায়। হালকা কেশে বলে,
“আজ ডাক্তার দেখাব।”

তানিয়া হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রত্যুত্তরে বলল,
“মানে? তাহলে ধরে নেওয়াই যায় বিষয়টা কনফার্ম?”

“আই থিংক সো।”

খুশির যেন অন্ত থাকেনা তানিয়ার। দুহাতে মুখ চেপে ধরে হাসতে থাকে সে। নিজের দুঃখ একপাশে সরিয়ে রাখে। মোহের হাত ধরে খুশিতে আটখানা হয়ে কৌতূহলী হয়ে বলে,
“স্বচ্ছ ভাই জানে?”

“না এখনো জানাই নি। নিশ্চিত হয়ে জানাব।”

তানিয়া মোহের গাল টেনে বলল,
“তোর জীবন এভাবেই পরিপূর্ণ হয়ে থাক। কোনো অসুখ তোকে যেন না ছুঁতে পারে। আমি প্রার্থনা করি।”

মোহ তানিয়ার হাতে হাত রেখে উত্তর করে,
“আমিও চাই তুই নিজের সুখের সন্ধান পেয়ে যায়। সেই হাস্যোজ্জ্বল তানিয়া ফিরে আসুক। তোর অপূর্ণতা সব মুছে যাক।”

একে অন্যকে আবারও আলিঙ্গন করে বিদায় জানায় তারা। তানিয়া ছুটতে থাকে নিজের শান্তির সন্ধানে। আর মোহ নিজের পূর্ণতার পথে।

হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকে মোহ। টলমল করছে সে। হয়ত খুশিতেই এই দশা। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে এই মুহূর্তে। হাতে থাকা ফাইলটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। মনে হয় যেন স্বপ্ন দেখছে। পরিবেশটা অন্যরকম মধুর লাগে। অস্বাভাবিক আনন্দ তাকে ঘিরে ধরে। আবার পরক্ষণেই সব নিভে যায় প্রিয় বান্ধবীর কথা স্মরণ হতেই। সব মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করে তার গহীনে। এলোমেলো পায়ের ধাপ ফেলে হাঁটতে থাকে। এরই মাঝে আচানক তার ঠিক সামনে এসে এক গাড়ি দাঁড়ায়। চকিতে গাড়ির পানে তাকায় মোহ। গাড়ির গ্লাস ভেদ করে শৌভিক নামক মানুষটাকে চিনতে ভুল হয়না তার। শৌভিক মাথা বের করে মোহকে ডেকে বলে,
“কী করছিস এখানে এই সময়? বাড়ি যাবি তো? আমিও ওদিকে যাচ্ছি তোর ননদকে নিতে। জলদি গাড়িতে উঠে আয়।”

মোহ তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসে। শৌভিক গাড়ি স্টার্ট করে। এরই মাঝে মোহের হাতে ফাইল লক্ষ্য করে খানিকটা বিচলিত হয়ে জানতে চেয়ে বসে,
“কার কী হয়েছে? কার ফাইল এটা? তোর কী হয়েছে? আমাকে জানাস নি তো।”

মোহ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আমি কখন বললাম আমার কিছু হয়েছে? তেমন কিছু হয়নি।”

“তো কেমন কিছু হয়েছে বল।”

“উঁহু, কিছুই নয়। তুমি দিনদিন এত একগুঁয়ে হচ্ছো কেন?”

“কী আশ্চর্য! তোর কিছু হলে জানতে চাইব না?”

মোহ একগাল হেসে একচোখ টিপে বলে উঠল,
“কিছু না তো। সময় মতো জেনে যাবে।”

শৌভিক গাড়ি ব্রেক করে। মোহের দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলে,
“আমি কিছু আন্দাজ করছি!”

মোহ উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। শৌভিক আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে।
“মোহ! এটা আমাকে কী জানাইলি! আনন্দ যে ধরেনা!”

মোহ হেসে ওঠে। তৎক্ষনাৎ শৌভিকের দিকে তাকিয়ে কড়া কণ্ঠে নির্দেশ দেয়,
“এখনো এটা কেউ জানে না। তুমি জেনে গেলে ঠিক আছে। বাড়িতে গিয়ে মুখ ফসকে কাউকে কিছু বলবে না আমি না বলা অবধি।”

শৌভিকের চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায়। একটু ভেবে বলে,
“আমার একটা শর্ত আছে।”

“কী সেটা?”

“বাবু সবার আগে আমার কোলে আসবে। এটা আমাকে কথা দিলে আমি এখন কাউকে কিছু বলব না। ডিল?”

মোহ হাফ ছেড়ে বলল,
“ওকে ডিল!”

“তোর জামাইকে বুঝিয়ে দিবি এটা নিয়ে আমার সাথে লাগতে না যেন আসে। তাহলে কিন্তু ভালো হবে না।”

কথা শেষে গাড়ি স্টার্ট দেয় শৌভিক। মোহ তাকে শান্ত করে বলে ওঠে,
“ঠিক আছে। কেউ লাগতে আসবে না।”

সন্ধ্যার আগমুহূর্ত। সূর্য ঢলে পড়েছে। দিনের আলোর তেজ কমে এসেছে। নদীর পানি বেড়েছে অনেকটা। নিয়মিত বর্ষণের ফলে স্রোতের ধারাও তীব্র। তটিনীর পাশে কিছুটা দূরত্বে ঘাসের উপর বসে আছে সৌমিত্র। লোকসমাগম কমে এসেছে সেখানে বিকাল পেরোতেই। সৌমিত্রের কোনো হেলদোল নেই। নদীর বহমান স্রোতে তার ভাবনা হারিয়ে গেছে। আজ তার কাজ দ্রুত শেষ হওয়ায় অফিস থেকে চলে এসেছে সে। খুব ইচ্ছে করছিল নদীর পাড়ে আসতে যেখানে তার আর তার প্রিয় রমনীর আগমন ছিল একটা সময়। আজ সৌমিত্রের পাশের বসার জায়গা ফাঁকা। বড়ো নিশ্বাস ফেলে নিজের বুকের ভার ফাঁকা করার চেষ্টা করে সৌমিত্র। মাথা ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই চোখ আঁটকায় তার। মিস গোলাপি তার পাশে বসে হাসছে মিটমিটিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে। সৌমিত্র স্থির হয়ে বসে। নিজের হাঁটু উঁচিয়ে তাতে মাথা ঠেকিয়ে তার মিস গোলাপিকে দেখতে অপলক। সে খুব ভালোমতো জানে এই রমনী তার চোখের ধাঁধা। একটি মরীচিকা, কল্পনা।তবুও সৌমিত্র তাতেই সন্তুষ্ট। অনেকক্ষণ তাকানোর পর চোখ বুঁজে নেয় সে। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“একটাবার যদি সত্যিকারের মুখোমুখি হতেন! আমি কোনো অভিযোগ করতাম না আপনার প্রতি। সত্যিই যদি দেখা দিতেন তাহলে আর কোনো আফসোস থাকত না। শুধু এক ঝলক দেখতাম।”

কথা সম্পূর্ণ করে চোখ মেলে তাকায় সৌমিত্র। কাল্পনিক মিস গোলাপি মিলিয়ে যায় হাওয়ায়৷ নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায় বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য।

গভীর রাত্রি নিস্তব্ধতাকে আঁকড়ে ধরেছে। ইথানকে একহাতে জড়িয়ে শুয়ে আছে স্বচ্ছ। আজ ইথান তাদের ঘরেই মা-বাবার সাথে ঘুমিয়েছে দাদিমাকে বলে। স্বচ্ছ তানিয়া সম্পর্কে পুরোটা মোহের কাছ থেকে শুনে কিছুটা ব্যথিত হয়। আফসোসের সহিত বলে,
“না সে জীবনের অর্থ খুঁজে পেল আর না আমার ভাই! দুজনের জীবনটা ছারখার হয়ে গেল।”

মোহের মুখটা ফ্যাকাশে হয়। তানিয়ার কথা ভেবে কিছুই ভালো লাগছে না তার। ভারাক্রান্ত গলায় জানায়,
“অনুপমের গানে একটা লাইন শুনেছিলাম। লাইনটা হচ্ছে, সব পেলে নষ্ট জীবন। তাই বলে একটা মানুষ কিছুই পেল না? এটা মানতে কষ্ট হয়।”

“ভাগ্য মোহ। যে পায়না সে কিছুই পায়না। আর যে পায় সে সবকিছু পায়। আমি শুধু এটাই চাই ওদের দুজনের জীবনের সৌন্দর্য ফিরে আসুক। এটা চাওয়া ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারব না।”

মোহ নীরবে স্বচ্ছের বাহুতে ঢলে পড়ে। জীবনের সুঁতোয় কেন এত বিচিত্রতা?

সকালবেলা ঘুম ভেঙে ইথানকে পাশে পেলেও হাতড়ে অন্যপাশে হাত রেখেও মোহকে পাশে পায়না স্বচ্ছ। ইথান ঘরে থাকলে স্বচ্ছ সবসময় মাঝখানে ঘুমায়। দুই হাত দিয়ে তার পুরো ভুবনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। সেদিন স্বচ্ছের ঘুম বেশিই হয়। পিটপিট করে চোখ খোলে সে। ঘরের আশেপাশে তাকায়। মোহকে খুঁজে না পেয়ে ঘড়ি দেখে সে। প্রায় নয়টা বেজে যাচ্ছে। আজকে ছুটির দিন হওয়ায় কারোরই নিজের কাজের জায়গায় যাওয়ার তাড়া নেই। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে গা মোচড় দেয় স্বচ্ছ। ইথানের দিকে একবার দেখে তার গায়ে ভালো করে চাদর তুলে দেয়। বিছানা থেমে নেমে সবার আগে আলমারি খোলে স্বচ্ছ। ফ্রেশ হয়ে নতুন পোশাক পরবে বলে। আলমারির দরজা খুলতেই সেখান থেকে পড়ে গেল মোহের হসপিটালের ফাইল। কপাল কুঁচকে ফাইলটা হাতে তুলে নিলো স্বচ্ছ। বুঝতে দেরি হলো না এটা হসপিটালের রিপোর্টের ফাইল। মনে চিন্তার দানা বেঁধে গেল। মোহকে ডাকার আগেই মোহ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। সবে গোসল সেরেছে সে। চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে বাঁধা। স্বচ্ছের হাতে ফাইল দেখে অবাক হলেও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো সে। স্বচ্ছের সংশয়ে ভর্তি দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখল। আচানক স্বচ্ছ তার বাহু চেপে বলল,
“এই মেয়ে কী হয়েছে তোমার? আমাকে না জানিয়ে হসপিটালে গেছিলে কেন? কী সমস্যা হয়েছে আমাকে বলো।”

স্বচ্ছের বিচলিত কণ্ঠে মুখ ভারি হয় মোহের। দৃষ্টি নামিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিন করে বলে,
“একটা ঘটনা ঘটে গেছে।”

স্বচ্ছের উত্তেজনা বেড়ে গেল। শুধাল,
“কী ঘটনা? কোনো অসুখ হয়েছে তোমার?”

মোহ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“একটা অপারেশন করতে হতে পারে।”

স্বচ্ছের মুখ চুপসে গেল। কেঁপে উঠে বলল,
“কী হয়েছে তোমার যে অপারেশন করতে হবে? আমাকে বলোনি কেন? কী সমস্যা হয়েছে মোহ?”

“ফাইল খুলে দেখুন।”

স্বচ্ছ ঢক গিলে ফাইল খুলতেই মোহের গম্ভীর মুখে চাপা হাসি দেখা যায়। স্বচ্ছের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“তবে অপারেশনটা করতে দেরি হবে নয়-দশ মাসের মতো। আগে তাকে বড়ো হতে হবে তো।”

স্বচ্ছের বুঝে এলো বিষয়টা। ফাইল হাত থেকে ফেলে দিয়ে মোহকে জড়িয়ে ধরতে এক মুহূর্ত সময় নিলো না সে। তার গহীনে যে ভয়টা ছড়িয়ে গিয়েছিল সেটাকে সে প্রকাশ করার মতো অবস্থাতেও নেই। মোহ স্বচ্ছের পিঠে হাত রেখে বলে ওঠে,
“ভয় পেয়েছেন বুঝি?”

স্বচ্ছ সে প্রসঙ্গে কিছু বলে না। মোহকে আলগা করে দিয়ে তার দিকে চেয়ে জানতে চায়,
“তুমি সত্যি বলছ? আমি আবার বাবা হবো?”

মোহ মাথা ঝাঁকাতেই মোহের গালে ফট করে চুমু খেয়ে চিৎকার দিয়ে বসে সে। দিশাহারা লাগে স্বচ্ছের। কাঁপতে থাকে পুরো শরীর। মোহের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাঁপা স্বরে জানায়,
“আমাকে ধরে থাকো প্লিজ। আমি যখন তখন মাথা ঘুরে পড়ে যাব।”

স্বচ্ছের এমন প্রতিক্রিয়ায় মোহ কী করবে বুঝেই উঠতে পারল না। শুধু ঘনঘন শ্বাস ফেলে নিজের ভেতরের উত্তেজনাকে কমানোর চেষ্টা করল। চিৎকারে ইথানের ঘুম ভাঙল। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাবা, কী হয়েছে? চিৎকার করলে কেন? তেলাপোকা দেখতে পেয়েছ?”

স্বচ্ছ মোহকে ছেড়ে ইথানের কাছে ছুটে এলো। তার উচ্চস্বর পুরো বাড়ির লোকজন শুনে নিয়েছে। তাই সৌমিত্র এবং মিসেস জেবাও ভয়ে ভয়ে চলে এলেন ঘরে দেখতে। স্বচ্ছ ইথানকে বিছানার উপর দাঁড় করিয়ে তার ছোট্ট হাত দুটো ধরে নাচতে নাচতে সুর করে বলল,
“একদিন আবার বাবা হবো,
আমার বাচ্চাদের নিয়ে অনেক দূরে যাব!
নীল আকাশে, সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাবো।”

মোহ ফিক করে হেসে দিলো। মিসেস জেবা আর সৌমিত্রও স্বচ্ছের কথাতে প্রথমে বিস্মিত হলেও বুঝতে পেরে মোহের দিকে তাকালো। মিসেস জেবা এগিয়ে এসে মোহের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“এটা সত্যি? আবার দাদিমা হচ্ছি?”

সবার সামনে খানিকটা লজ্জায় চোখ নামায় মোহ। মিসেস জেবার আর উত্তরের দরকার হয় না। তিনি মোহের চোখমুখে হাত বুলিয়ে সেই হাতে চুমু খান। সৌমিত্রের মনেও অনেকদিন পর হুট করে আনন্দের আগমন ঘটে। হেসে উঠে বলে,
“এবার থেকে তাহলে দুটো চকলেট আনতে হবে! হায় হায়! বাজেট তো বেড়ে গেল।”

ইথানের সরল মস্তিষ্ক বোঝার প্রচেষ্টা করল সবার কথাগুলো। কিন্তু না বুঝে স্বচ্ছের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বায়না করল,
“তোমরা কী বলছ? আমাকেও বলো!”

কেউই উত্তর দিলো না। ইথানের অবুঝ মুখটার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসতে থাকল।

সেদিন রাতে একা একা ঘরে আধশোয়া হয়ে মুচকি হাসছিল ফারাহ। শৌভিক ঘরে এসেছে সেটা তার খেয়ালে আসেনি। স্ত্রীর এমন হাসি দেখে আগ্রহ নিয়ে আকস্মিক তার বাহু চেপে ধরতেই হকচকিয়ে ওঠে সে। শৌভিকের বুকে থাবা দিয়ে বলে,
“এমন ভয় দেখান কেন? বুক ধক করে উঠেছে।”

“আমারও সেম কেইস।”

ফারাহ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
“মানে?”

“মানে আপনার মুচকি হাসিতে আমারও বুক ধক করে উঠেছে।”

ফারাহর মুখের প্রফুল্লতা গভীর হলো। শৌভিকের পাশ ঘেঁষে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর গলায় বলে ওঠে,
“বাড়িতে বাবু থাকলে কিন্তু অনেক ভালো লাগে। যেমনটা ওই বাড়িতে ভাবির কথাটা জেনে সবাই মেতে উঠেছে!”

“তা ঠিক বলেছ। ইথান তো ছিলোই। এখন আরেকজন আসবে। আমিও আবার আঙ্কেল হবো।”

“সেই সাথে এই বাড়িতেও বাবু থাকলে কিন্তু মন্দ হয়না।”

শৌভিক প্রথমে মাথা নেড়ে সায় দেয়। হুট করে তার হুঁশ হয়। চমকে গিয়ে ফারাহর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এক মিনিট! তুমি কি আমায় কিছু ইঙ্গিত দিতে চাইছ ফারাহ জান?”

ফারাহর লজ্জায় কান গরম হয়। অস্থির হয়ে তিড়িংবিড়িং করে বিছানা থেকে নামতে চায়। শৌভিক তার হাতটা টেনে বলল,
“দুজন দুজনের ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে এই প্ল্যানিং এর সময়ই হয়নি। শত্রুর মেয়ে যখন ইঙ্গিত দিয়েছে তখন সেটাকে পূর্ণতা প্রদান করার দায়িত্ব আমার।”

ফারাহকে কাছে টানে শৌভিক। ফারাহ লুটিয়ে পড়ে শৌভিকের বুকে। শৌভিক চুম্বন আঁকে ফারাহর কপালে। ফারাহ লুকিয়ে মৃদু হাসে।

এক সপ্তাহ কেটেছে। সৌমিত্র চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রের পাড় ধরে অগোছালোভাবে হাঁটছে। আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখন সবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মনে হচ্ছে রাত নেমে এসেছে। অন্যদিনের চেয়ে বেশিই উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢেউগুলো। উপচে চলে আসছে তারা সৌমিত্রের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। অফিসের ডিলের কাজে চট্টগ্রাম আসতে হয়েছে তাকে তিনদিনের জন্য। আজ শেষদিন কাজ শেষ করে ফেলেছে সে। যাওয়ার আগে সমুদ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করলে ব্যাপারটা জমে না। আশেপাশে লোকালয়, জনগণ থেকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে এসেছে সে। আগে কোলাহল যতটা ভালো লাগত এখন একাকিত্ব ততটাই ভালো লাগে। একটু জিরিয়ে নিতে মন চাইল সৌমিত্রের। অদূরের বালির উপরে রাখা কয়েকটা সিমেন্টের ব্লক দেখে এগিয়ে গিয়ে সানগ্লাস খুলে বসল সে। একদিকে পা রাখতেই পায়ের কাছে ঠেকল নরম কাপড়ের মতো কিছু। মাথা নিচু করে দেখল একটা হালকা গোলাপি রুমাল পড়ে আছে। সৌমিত্র সেটাকে হাতে উঠিয়ে নিলো। মনোযোগ দিয়ে দেখল হালকা গোলাপি রুমালের মধ্যে গাঢ় গোলাপি রঙের সুঁতা দিয়ে গোলাপ ফুল সেলাই করা। সৌমিত্রের ধ্যান ভাঙে কারোর হাঁপানোর শব্দ কানে আসায়। সৌমিত্র তাকানোর আগেই একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর তার কান থেকে মস্তিষ্ক অবধি বেজে ওঠে।
“এক্সকিউজ মি! আপনার হাতের রুমালটা হয়ত আমার।”

সৌমিত্র তড়িৎ গতিতে ঘুরে তাকায়। তার চোখজোড়া আঁটকে যায়। পুরো দুনিয়া একটা মরীচিকা মনে হতে শুরু করে। তার সামনে মিস গোলাপি দাঁড়িয়ে। হালকা গোলাপি কামিজ সাথে সাদা ওড়না। ওড়না সমেত চুলগুলো উড়ে যাচ্ছে উন্মাদ হাওয়ায়। সৌমিত্রের মনে হয় সে বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। ভুল দেখছে। পরক্ষণেই মনে হয় এতদিনের কল্পনায় সে মিস গোলাপিকে কখনো কথা বলতে দেখেনি। তার এই রুমালও তো মিথ্যা নয়। তবে তার সামনে স্বয়ং তার চিরদিনের প্রিয় রমনী হাজির হয়েছে অবশেষে? সৌমিত্র চোখ বুঁজে আবার খোলে। কিন্তু মিস গোলাপি ঠাঁই দাঁড়িয়ে যেন সেও অবাক হয়েছে। সৌমিত্র নিশ্চিত হয় এটা তার কল্পনা নয়। এক ভয়ানক সুন্দর সত্যি। কথা ছিল সে এক ঝলক দেখে নজর সরিয়ে নেবে। কিন্তু সেটা কেন করতে পারছে না? দৃষ্টি একভাবে কেন আঁটকে গেছে? সৌমিত্র অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“মিস গোলাপি!”

তমসার বর্ষণে প্রকৃতি ছারখার হয়ে যাচ্ছে। প্রবল হাওয়ায় মোহ ও স্বচ্ছের ঘরের দুপাশের জানালার পর্দা এলোমেলো হয়ে উড়ছে। শীতল বাতাসে ঠাণ্ডা হয়েছে ঘর৷ মোহ জানালার কাছের একটা টেবিলের চেয়ারে বসে ডায়েরি লিখছিল। আজকাল ডায়েরি লেখার নেশা চেপে ধরেছে তাকে। হঠাৎ বাবা ছেলের আগমন ঘটে ঘরে। ইথান ছুটে এসে মোহের কোলের কাছে দাঁড়ায়। ইথান মোহের দিকে তাকিয়ে উৎসুক হয়ে বলে ওঠে,
“আমার ভাইবোন কখন আসবে?”

মোহ দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে হেসে ইথানের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে ওঠে,
“তার যখন আসার সময় হবে তখনই আসবে। এত অধৈর্য হলে তো হবেনা।”

স্বচ্ছও তাদের কাছে এসে মোহের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে ইথানের হাতটা নিয়ে মোহের পেটের কাছে হাত রাখে। স্বচ্ছ আদুরে স্বরে বলে,
“হ্যালো, ছোট্ট তুমি!”

ইথান আরেক দফা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে যেন সে তার ছোটো ভাইবোনের সাথে কথা বলতে পেরেছে। দ্রুত সেই খবর বলতে দাদিমার কাছে ছুটল সে। স্বচ্ছ মোহকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিজে চেয়ারে বসে। অতঃপর নিজের কোলে মোহকে বসায়। মোহের হাতটা নিয়ে সেটা স্বচ্ছ নিজের বুকে ঠেকিয়ে জানায়,
“দেখো, এখনো আমার বুক কাঁপছে।”

মোহ বরাবরের মতো তার স্বামীর চুলে হাত রেখে তা ঠিক করে দেয়। এই কাজটা মোহের বড়োই পছন্দের নরম সুরে বলে,
“এত দুর্বল হৃদয় হলে দুটো বাচ্চাকে সামলাবেন কী করে?”

স্বচ্ছ মোহের কানের লতিতে চুমু খেয়ে প্রেয়সীর গলায় মুখ গুঁজে শীতল গলায় উত্তর দেয়,
“আমার ছোট্ট নিজস্ব ভুবনটাকে স্বপ্নের চেয়েও সুখের করে তোলার জন্য তোমায় ধন্যবাদ আমার ভুবনমোহিনী! তোমার ছোঁয়ায় আমার পৃথিবীটা আজ এত রঙিন।”

“আপনি ভালোবাসেন বলেই তো আমার ভালোবাসাও এভাবে রং ছড়ায়!”

স্বচ্ছের উত্তর পাওয়া যায়না। সে মোহের কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে থেকে নিজের প্রশান্তি উপভোগ করে। মোহ আঁড়চোখে স্বচ্ছকে দেখার পর কলমটা ধরে ডায়েরিতে লিখে,
“যতবার বর্ষণ লণ্ডভণ্ড করবে এই ত্রিধারা,
ততবার আগমন ঘটবে সেই বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া।”

সমাপ্ত….