যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব-১৯+২০

0
13

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৯

গাড়িতে খানিকটা চিন্তিত মুখেই বসে আছে সৌমিত্র। পাশে বসে থাকা স্বচ্ছের গম্ভীর মুখভঙ্গির কারণ কিছুতেই বুঝে উঠছে না সে। একটা সময় সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
“ভাই, আজকেই কি এই স্কুলে যাওয়া খুব দরকার? তোমার পায়ে লাগা আছে। তুমি এখনো ঠিক করে সেরে উঠতে পারো নি। কয়দিন করে এখানে আসলে হতো না? ডক্টর কতবার করে মানা করল বাহিরে না আসতে এই কন্ডিশনে।”

স্বচ্ছ দেরি না করে চট করেই ভার মুখে উত্তর দিয়ে বসল,
“আমার কাজ আমি ভালো করে বুঝব সেটা কখন করতে হবে আর কখন করতে হবে না। তোকে ব্যস এখানে নিয়ে আসতে বলেছি তুই নিয়ে এসেছিস। বাড়তি কোনো প্রশ্ন আমি শুনতে চাইছি না।”

“সে তো ঠিক আছে ভাই। কিন্তু বাবা যদি জানতে পারে তোমার সাথে আমাকেও হসপিটালের বেডে শুইয়ে দিতে পারে।”

স্বচ্ছ তপ্ত শ্বাস ফেলে সৌমিত্রকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“বাবাকে আমি সামলে নেব। তুই আমাকে নামতে সাহায্য কর।”

সৌমিত্র আর বাড়তি কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হাতে স্টিক নিয়ে স্বচ্ছের দিকে গাড়ির দরজা খুলে দিলো। স্বচ্ছ একহাতে স্টিক ধরে অন্যহাতটা সৌমিত্রের ঘাড়ে রেখে অনেকটা কষ্ট করে গাড়ি থেকে নামল। তারপর সৌমিত্রের ঘাড় ছেড়ে একা একা স্টিক ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা ধরল সে। তার পানে কৌতূহলী নয়নে তাকিয়ে থেকে সৌমিত্র আপনাআপনি আওড়ায়,
“কী অদ্ভুত একটা ছেলে জন্ম দিয়েছে আমার মা। মাথায় যখন যা আসে সেটা না করতেই হবে।”

স্কুলের প্রিন্সিপাল শফিকুল ইসলাম বেশ আরাম করেই পত্রিকা পড়ছিলেন। সেই মুহূর্তে দরজায় পিয়নের গলা পাওয়ায় বেশ বিরক্ত হলেন উনি। জবাব দিলেন,
“কী হয়েছে?”

পিয়ন কিছুটা আতঙ্কের সহিত বলল,
“স্যার, আসলে আপনার সাথে একজন দেখা করতে আসছে। লোকটা মন্ত্রী সারোয়ার সাহেরের ছেলে স্যার।”

প্রথমে ভালো করে কথাগুলোতে মনোযোগ না দিলেও শেষ কথায় হৃদকম্পন বেড়ে গেল প্রিন্সিপালের। হম্বিতম্বি করে বলে উঠলেন,
“হায় আল্লাহ! এবার যে কী হয় কে জানে। এখন কেন আসলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আর তুমি দাঁড়িয়ে থেকো না। দ্রুত যাও গিয়ে উনাকে এনে এখানে বসাও।”

পিয়ন শফিকুল ইসলামের কথা মতো তড়িঘড়ি করে চলে গেল। কিছু সময় পর স্বচ্ছ এবং সৌমিত্রকে নিয়ে এলো সাথে করে। দুজনকেই বেশ সম্মানের সহিত বসতে দেওয়া হলো। শফিকুল সাহেবও তার সামনাসামনি চেয়ারে বসে খানিকটা ইতস্ততবোধ করে বললেন,
“আমি তো জানতাম না আপনারা আসবেন। তাই কিছু আয়োজন করা হয়নি স্যার। ক্ষমা করবেন।”

স্বচ্ছ বিলম্ব না করে সোজা উত্তর করল,
“কেন? আমি কি বিয়ে করতে আসছি নাকি কোনো অনুষ্ঠানে আসছি যে আয়োজন করতে হবে?”

শফিকুল ইসলাম থতমত খেলেন স্বচ্ছের কথায়। নিজেকে ধাতস্থ করে আমতা আমতা করে শুধালেন,
“কোনো বিশেষ কারণে আমার এখানে আসা স্যার?”

“ফার্স্ট ওফ অল, আমাকে স্যার ডাকা বন্ধ করুন। স্যার আপনি। আমি নই। তাই আমি আপনাকে স্যার ডাকব। আর হ্যাঁ, জরুরি কারণেই এখানে আসা।”

শফিকুল ইসলাম অতি আগ্রহের সাথে জানতে চাইলেন,
“কী কারণ?”

স্বচ্ছ এবার খানিকটা দম নিয়ে কণ্ঠস্বর নরম করে বলতে শুরু করল,
“কারণটা মি. আজহার আহমেদকে নিয়ে। আপনার হয়ত অজানা নয় যে উনাকে পুলিশ কাস্টারিতে রাখা হয়েছিল পুরো এক রাত। সেইদিনের পর থেকে উনার নামে বদনাম রটে গিয়েছে।”

“জি। আসলে লোকটা কাজই এমন করেছে যে জেলে থাকতে হয়েছে। আমরা তো জানতাম না উনি এমন। এত বছর ধরে এই স্কুলে পড়ান। বিশ্বাস করুন কখনোই উনাকে এমন মনে হয়নি। উনাকে স্কুলে রাখাটা কী পছন্দ করছেন না আপনি?”

স্বচ্ছের দৃষ্টির মাঝে ক্ষোভ দেখা গেল খানিকটা। প্রিন্সিপালের কথা শুনে কপাল জড়িয়ে গেল তার। টেবিলে থাবা দিয়ে বলল,
“না। এমনটা কখনোই আমি চাইনি। আমি চাই উনি আগে যেমন মাথা উঁচু করে সবার সামনে চলাফেরা করতেন আজও তাই করুক। যেভাবে সকলের ভালোবাসা পেতেন আজও তাই পাক। কিন্তু আমার এই চাওয়ার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বদনাম। উনি যা নয় সেটাই উনাকে বানানো হয়েছে। উনি অপরাধী নন। পুরোটাই সাজানো ছিল।”

শফিকুল ইসলাম এবার আঁখি দুটো গোলগোল করে তাকিয়ে রইলেন স্বচ্ছের দিকে। মন্ত্রীর ছেলে নিজেই এসে যে আজহার সাহেবের নিরপরাধ হওয়া সম্পর্কে বলবেন সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কোনোমতে নিজের বিস্ময় তিনি কাটিয়ে উঠে প্রশ্ন করেন,
“তাহলে জেলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টা…”

“ভুলটা আমার। আমার জন্য উনার সাথে এমনটা হয়েছে। তাই আমি সংশোধন করতে চাই। আমি সবাইকে জানাতে চাই ওই লোকটা কিছু করেননি। উনি পরিস্থিতির স্বীকার। আর আমায় জানাতে আশা করি আপনি সাহায্য করবেন?”

শফিকুল ইসলাম অপ্রস্তুত হয়ে বলে ওঠেন,
“জি, জি। অবশ্যই। বলুন কী করতে হবে?”

স্বচ্ছ সোজাসাপ্টা বলে দিলো,
“আমি কিছু সময়ের জন্য সবাইকে অডিটোরিয়ামে উপস্থিত দেখতে চাই। টিচার, স্টুডেন্টস্, স্কুলে অবস্থান করা সকল অভিভাবক সবাইকে ওখানে দেখতে চাই। বিশেষ করে মি. আজহার আহমেদ যদি স্কুলে থাকেন তবে উনাকেও আসতে বলবেন। শুধুমাত্র কিছুটা সময়ের জন্য। আমি জানি স্কুলের কার্যক্রমে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু আমি অনুরোধ করছি। প্লিজ স্যার!”

“এভাবে বলবেন না। আমি এখনি সবাইকে অডিটোরিয়ামে উপস্থিত থাকতে বলছি। আমাকে কিছু সময় দিন।”

শফিকুল ইসলাম বিদ্যুতের গতিতে নিজের কক্ষ প্রস্থান করলেন। এতক্ষণ নীরব দর্শকের ন্যায় সবটা শুনলেও এখন চুপ থাকতে পারল না সৌমিত্র। প্রচণ্ড ব্যগ্রতা নিয়ে ভাইকে প্রশ্ন করল,
“ভাই, আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কেন এখানে এসেছ। মোহের বাবাকে যেন একটু হলেও সাহায্য করতে পারো এটাই উদ্দেশ্য ছিল তোমার। কিন্তু এখন সবাইকে ডেকে তুমি কী করতে চাইছ? আমায় বলবে? আমি এত কৌতূহল নিয়ে থাকতে পারছি না আর।”

“ধৈর্য ধর সৌমিত্র। আপনাআপনি সব জানবি।”

সৌমিত্র স্মিত হাসল। উপহার করে বলল,
“যেই মানুষ নিজে কখনো ধৈর্য ধারণ করতে পারেনি সেই মানুষ আমাকে ধৈর্য ধরতে বলছে! হাউ স্ট্রেঞ্জ!”

প্রতিত্তোর আর করল না স্বচ্ছ। সে এখন অন্য চিন্তার জগতে প্রবেশ করেছে। তার ভাবনায় এখন শুধুমাত্র একটি বিষয়ই ঘুরছে।

অডিটোরিয়ামে উপস্থিত সকলে কৌতূহল, বিস্ময়ের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন। বিশেষ করে শিক্ষক এবং অভিভাবকরা। স্বচ্ছ স্টেজে বসে আছে চেয়ারে। দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না এই অবস্থায়। পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন আজহার সাহেব। মুখটা শুঁকিয়ে গিয়েছে উনার। কিছুতেই বুঝতে পারছেন না স্বচ্ছের এমন সিদ্ধান্তের কারণ। এভাবে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আলোচনার পাত্র হতে লজ্জা করছে উনার। স্বচ্ছকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, যা সম্মান ছিল বাকিটুকুও কেঁড়ে নিতে এসেছ? কিন্তু সকলের সামনে এই প্রশ্নটা কিছুতেই করতে পারছেন না তিনি। এবার বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে সৌমিত্রের হাত থেকে মাইক্রোফোন হাতে নিলো স্বচ্ছ। দেরি না করে সালাম দিয়ে একনাগাড়ে বলতে শুরু করল,
“আমি জানি আমার এই আচরণের কারণে আপনাদের কিছুটা হেনস্তা হতে হয়েছে। আপনারা কিছুটা বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু আমি যেই বিষয় নিয়ে কথা বলব সেটাও সকলের জানা খুবই জরুরি। আমি আহিয়ান স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেরের বড়ো ছেলে এবং আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এই স্কুলের একজন সম্মানিত শিক্ষক মি. আজহার স্যার। আমরা সবাই জানি বিগত দিন আগে উনাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। না চাইতেও বদনাম হয়ে যান। মাত্র এক রাতের ব্যবধানে উনাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেললেন আপনারা। অথচ এতদিন উনাকে সৎ বলেই জেনে এসেছেন। আপনাদের দোষ দেব না আমি। আসলে মানুষ ভালোটা নয় খারাপটাই মনে রাখতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমি নিজে আজকে বলছি, উনি খারাপ নন। উনি বা উনার মেয়ে অথবা উনার পরিবারের কেউই কোনো অন্যায় করেনি যার কারণে উনাকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুরোটাই ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি। আপনারা আজহার স্যারকে ঠিক যেমনটা চিনেছিলেন উনি ঠিক তেমনটাই সৎ এবং সরল আর আমি এটাও নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, উনার মেয়েকে নিয়ে রটানো ঘটনাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ঘটনা সেসব আমায় নিয়ে ঘটেছে তাই আমি নিজে বলছি সব মিথ্যে ছিল। উনার মেয়ের গায়ে সামান্যতম কলঙ্কও নেই। আর না উনার গায়ে রয়েছে।”

পুরো অডিটোরিয়াম নিস্তব্ধ। কেউ কথা বলা বা সমালোচনা করার আর কোনো সাহস পাচ্ছে না। সকলের ভাবমূর্তি পর্যবেক্ষণ করল স্বচ্ছ। অতঃপর কোনোরকমে হাতে স্টিক ধরে উঠে আজহার সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়াল সে। আজহার সাহেবের চোখে বিস্ময় স্পষ্ট। সেই উচাটনের মাঝে মুখে আসছে বা একটা শব্দও। সবরকম লজ্জা ত্যাগ করে সকলের সামনে আজহার সাহেবের কাছে মাথা নত করে স্বচ্ছ। জোর গলায় বলে,
“আমি আহিয়ার স্বচ্ছ নিজে ক্ষমা চাইছি আজহার স্যারের কাছে। উনি একেবারেই নির্দোষ ছিলেন। উনি আগের মতোই সম্মানিত এবং সম্মানের যোগ্য।”

একটু থেমে আবারও আজহার সাহেবের উদ্দেশ্যে স্বচ্ছ বলে,
“আমার বাবার জন্য অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে আপনাকে। হয়ত আমার জন্যও তাই। একারণে আমি সত্যিই আপনার কাছে অনুতপ্ত। আপনি যদি আমায় কোনো শাস্তি দিতে চান তবে নির্দ্বিধায় জানান।”

অনেক সময় পর নিজের কণ্ঠে শক্তি জুগিয়ে মুখ খুললেন আজহার সাহেব।
“দেখো বাবা, আমি জানি না তুমি এসব কেন করছ! তুমি আমার ছেলের মতো। আর তোমায় ক্ষমা না করে আমার কোনো উপায় নেই। আর কোনো রাস্তা তুমি বাকি রাখো নি। তুমি যা করলে তার জন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। আর কিছু চাই না। আমার মতো সাধারণ মানুষ সামান্যতেই সন্তুষ্ট, বাবা। তুমি তো অনেক বেশি করে ফেলেছ। আর কিছু করো না। আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি।”

স্বচ্ছ মৃদু হেসে বলল,
“ধন্যবাদ।”

অতঃপর স্বচ্ছ প্রিন্সিপাল শফিকুল ইসলামের উদ্দেশ্যে বলে,
“আমার কাজ শেষ। আমি আসছি। দুঃখিত এত সময় নেওয়ার জন্য।”

সময় নষ্ট না করে ধীর পায়ে হাতে স্টিক ধরে সিঁড়ি বেয়ে সৌমিত্রের সাহায্যে নিচে নেমে যায় স্বচ্ছ। তার জানা নেই সে কতটুকু করতে পেরেছে মোহের বাবার জন্য। তবে এরচেয়ে বেশিকিছু সে করতে পারবে না। যদি পারত। হয়ত আরো করত মানুষটির জন্য।

গাড়ির সামনে এনে সৌমিত্র দাঁড় করায় স্বচ্ছকে। হঠাৎ থেমে যাওয়ায় খানিকটা বিরক্ত হয় স্বচ্ছ। চোখ ছোটো করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোর আবার কী সমস্যা?”

সৌমিত্র কিছু না বলে স্বচ্ছকে আচানক জড়িয়ে ধরে। আত্মহারা হয়ে বলে,
“আই এম প্রাউড ওফ ইউ, ভাই!”

চলবে….

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২০

ঘরের মাঝে থাকা প্রিয় জানালার পাশ ঘেঁষে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে মোহ। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে জট পাকানো মস্তিষ্ক স্বাভাবিক করার পরিচালনা করছে সে। এখনো মাথা থেকে সকালে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয়টি সরতে চাইছে না। আঁটকে আছে সেই রাস্তার মোড়েই, সেই ফলের দোকানেই। সেই পরিচিত এবং নি/কৃষ্ট মুখ ভেসে উঠছে বারংবার। মাথা ঘুরিয়ে বিছানায় বসে আপনমনে খেলতে থাকা ইথানের দিকে দৃষ্টিপাত করল মোহ। ইথানের ছোট্ট মুখটার সাথে সেই মুখটার বিস্তর মিল আছে বলতে হবে। তবে সেই সঙ্গে রয়েছে আকাশপাতাল পার্থক্যও। সেই চেহারায় মোহ খুঁজে পায় নিকৃ/ষ্টতা এবং ভয়া/বহতা এবং ইথানের ছোট্ট চেহারায় খুঁজে পাওয়া যায় সুবিশাল মায়া।

সকল ভাবনার অন্ত ঘটলো আজহার সাহেবের ডাকে। বাবার এমন অস্থির হাক পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল মোহ। বিচলিত মনে বাহিরে এসে আজহার সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে বাবা? কোনো সমস্যা হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”

আজহার সাহেব মৃদু হেসে শান্ত গলায় বললেন,
“না, না। কে আবার নতুন করে কী বলবে!”

মিসেস সুফিয়াও রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসেছেন বসার ঘরে। আজহার সাহেবের কথা শুনে তিনি ক্ষোভ ঝেড়ে বললেন,
“তো এভাবে ডাক দাও কেন? ভালো করে ডাকা যায় না? যেভাবে মেয়েটাকে ডাকছিলে আমারই তো অন্তর কেঁপে উঠেছিল।”

“এখনই তোমার এই অবস্থা! আমি এখন যা বলব তা শুনে তারপর কী হবে বলো?”

মিসেস সুফিয়া এবং মোহ দুজনেই খানিকটা বিস্মিত হলো আজহার সাহেবের এমন হেয়ালিতে। মোহ উৎসুক হয়ে শুধাল,
“কী হয়েছে বাবা?”

“স্বচ্ছ এসেছিল আমার স্কুলে।”

স্বচ্ছের নাম শুনেই ভেতর থেকে বাহির অবধি এক আতঙ্কের শিহরণ বইলো মোহের। মানুষটাই এমন যার নাম শুনে মাথায় ঝামেলা শব্দটি ছাড়া অন্য কিছু আসে না। মোহ কম্পিত গলায় আবারও জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”

“স্কুলে এসে ও যা কাণ্ড করল! আমাদের ভাবনার বাহিরে এসব। সকলের সামনে অডিটোরিয়ামে আমাকে নির্দোষ বলেছে সে। শুধু তাই নয় নিজে থেকে বাবার হয়ে ক্ষমা চেয়েছে ছেলেটা। ছেলেটার কাণ্ডে আমি হতভম্ব।”

“উনি ওই হাতেপায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে তোমার স্কুলে গিয়ে এই কাণ্ড করে এসেছে?”

মোহের মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথায় চকিতে তাকালেন মিসেস সুফিয়া। মোহের দেরিতে বোধগম্য হলো তার একথা বলা উচিত হয়নি। মিসেস সুফিয়া দেরি না করে কঠোর গলায় প্রশ্ন করলেন,
“তুই কীভাবে জানলি ওই ছেলের হাতেপায়ে ব্যান্ডেজ?”

মোহ প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইল।
“আসলে মা…”

“কথা ঘুরাবি না। সত্যি বল।”

“আহ! মেয়েটাকে সবসময় এমন জেরা করো কেন সুফিয়া?”

আজহার সাহেবের কথায় মিসেস সুফিয়া চোখ গরম করে তাকালেও মোহ এবার বাধ্য মেয়ের ন্যায় সত্যি বলার সিদ্ধান্ত নিলো।
“মা, সেদিন যে ইথানের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে মার্কেটে যেতে চেয়েছিলাম আর বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন আমি ওদিকে যেতেই পারিনি। স্বচ্ছ এক্সি/ডেন্ট করেছিলেন। আর সাহায্য করার কেউ ছিল না। আমি উপায় না পেয়ে উনাকে হাসপাতাল অবধি নিয়ে যাই। তুমি যদি রাগ করো তাই বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিলাম। সরি, মা।”

আজহার সাহেবও নিজের স্ত্রীকে কিছু বলতে না দিয়ে তালে তাল মিলিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ ঠিকই আছে। আমার মা যা করেছে ঠিকই তো করেছে, মোহের মা। কেন শুধু শুধু রাগছ!”

“হ্যাঁ আমি তো শুধু শুধুই রাগি। তোমরাই সব ঠিক কাজ করো। আমি যা করি সব ভুল।”

ক্রোধ ঝেড়ে কথাটা বলে গটগট করে রান্নাঘরে চলে গেলেন মিসেস সুফিয়া। উনার কাণ্ডে বাবা-মেয়ে চোখাচোখি করল। তারপর মিটমিটিয়ে হাসল।
“তোমার মা রাগারাগি করলেও আমি তোমার উপর রাগটা দেখাতে পারছি না। স্বচ্ছ আজ যে কাণ্ড করল সে কাণ্ডে আমার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত আমি বুঝতে পারছি না। তবে আজকে ওর যা করেছে তা দেখে মনে হয়েছে ও মন থেকে আমাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছে। ক্ষমা চেয়েছে মন থেকে তাও ওর বাবার হয়ে। অন্যায়টা আদেও ও করেনি। অনুতপ্ত হয়েছে বাবার তরফ থেকে। আমার সম্মান খানিকটা ফেরানোর চেষ্টা করেছে। আমি তাতে অস্বস্তিতে পড়লেও পরবর্তীতে মনে হয়েছে সে একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য। যেটা আমি তখন লজ্জায় পড়ে দিতে পারিনি।”

মোহাবিষ্ট হয়ে কথাগুলো শুনছিল মোহ। স্বচ্ছ নামক পুরুষটির কথা এই মুহূর্তে মুগ্ধ হয়েই শুনতে ইচ্ছে করছে তার। মানুষটা এত কিছু কেন করল জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। তার জায়গায় অন্যকেউ হলেও বুঝি কাজটা তিনি করতেন? যদি করত তাহলে খুশি হবে মোহ। কেননা, সে চায় অনুতপ্ত বোধ সকলের প্রতি একই থাকুক। আজহার সাহেব আরো বলেন,
“হয়ত সে আমার সম্পূর্ণ সম্মান ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবেনা। তবে তার এ কাজের পর আমার নামে আর একটাও কটু কথা কানে আসেনি।”

“তাই উনি তোমার কাছ থেকে ধন্যবাদ পান। তাই না বাবা?”

“ঠিক তাই।”

“কাল যাবে আমার সাথে হসপিটালে উনাকে দেখতে?”

মোহের কথায় আজহার সাহেব তৎক্ষনাৎ বারণ করে দিলেন,
“না, না। আমার সময় হবে না। স্কুলে যেতে হয় ওই সময়। তাছাড়া সবথেকে বড়ো কথা অস্বস্তির ব্যাপার আছে একটা। তাই বলছিলাম যে মোহ মা তুমি এই কাজটা আমার হয়ে করে দিলে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতাম।”

মোহ তার বাবার কথায় অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“বাবা তুমি কী বলছ বলো তো! আমি কাল যাব উনাকে ধন্যবাদ দিতে তুমি না বললেও। এভাবে বলো না।”

আজহার সাহেব একটা মৃদু হাসি দিলেন। তারপর চললেন রান্নাঘরের দিকে। উদ্দেশ্য, স্ত্রীর রাগ ভাঙানো।

মোহ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ছুটে এলো। বড়ো বড়ো শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ-ত্যাগ করে ফোন হাতে নিলো তড়িঘড়ি করে। কললিস্ট থেকে খুঁজে বের করল, ‘স্টোরহাউস ওফ ইগো” নামটি। নিঃসন্দেহে এই নামের ব্যক্তিটি স্বচ্ছ। তবে এই নামটি মোহের কাছে আজ বেমানান লাগল। দ্রুত মানুষটিকে কল দিতে গিয়ে মনে পড়ল সে সেদিনই এক্সি/ডেন্ট করেছিল। তার ফোন হয়ত তার কাছেই নেই। খানিকটা নিরাশ হয়ে ফোনটা আগের স্থানে রাখল মোহ। ইথান দৌড়ে এসে বসল তার কোলে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অধৈর্য হয়ে উঠল সে। কখন সে পরদিন হবে! কখন সামনাসামনি হবে স্বচ্ছের।

পায়ে অতিরিক্ত চাপ পড়াতে সেখানে টনটনে অসহ্যকর ব্যথা উঠেছে স্বচ্ছের। বালিশে ঠেস দিয়ে চোখ বুঁজে হাতের বাহু কপালে ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে রয়েছে সে। দরজা খোলার শব্দ পেয়েও খুলল না তার চোখ দুটো। দেখা গেল না ঘোলাটে মণি দুটো। একসময় নিজের লাগা পায়ে হঠাৎ জ্বলে অতিরিক্ত ব্যথা করে উঠল স্বচ্ছের। ছটফটিয়ে উঠে বসল স্বচ্ছ। বুঝতে পারল কেউ তার পায়ে হাত দিয়ে চাপ দিয়েছে। সামনের মানুষটিকে হাসতে দেখে আরো ক্ষেপে গেল সে।
“হোয়াট দ্যা হেল ইয়ার! এমনি আধম/রা হয়ে পড়ে আছি। দেশে ফিরেই আমাকে পুরো মা/রার ট্রাই করছিস?”

আরিদ্র এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। রাগে গজগজ করতে করতে অন্যদিকে তাকাল স্বচ্ছ। আরিদ্র হাসতে হাসতে স্বচ্ছের পাশে বসে তাকে আলিঙ্গন করে বলল,
“আমার জানের প্রাণের ভাইকে মা/রতে পারি বল? আমি শুধু পরীক্ষা করছিলাম এক্সি/ডেন্টের পর তুই কতটা মজবুত আছিস।”

“পরীক্ষা করতে গিয়ে আমার একটা নড়ে যাওয়া হাড়টা ভেঙে ফেলেছিস মনে হচ্ছে।”

এই কথা বলার পর স্বচ্ছ নিজেও হেসে উঠল এবার। আরিদ্র হোসাইন স্বচ্ছের একমাত্র মামাতো ভাই। যার জীবনের বিগত পাঁচ বছর কেটেছে লন্ডন শহরে। আজ হঠাৎ তার আগমনে খানিকটা অবাক হয়েছে স্বচ্ছ। আরিদ্র স্বচ্ছের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করল আরেকবার। তারপর প্রশ্ন করল,
“তারপর বল! এমন আধম/রা অবস্থা কী করে হলো তোর?”

“বাইক এক্সি/ডেন্ট! আর কী? যাই হোক, হঠাৎ তোর দেশের কথা মনে পড়ল কী করে?”

আরিদ্র মাথা নাড়ায়। কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে,
“দেশ না রে, দেশ না। ব্যাপারটা হচ্ছে বিয়ের। মায়ের ডাক পড়ল বিয়ের জন্য। তাই চলে এলাম।”

“ওহ তাই বল। তাও ভালো। আমি তো ভেবেছিলাম তুই বিদেশী মেয়েকে বিয়ে করে সেটেল হয়ে যাবি।”

স্বচ্ছের কথায় আরিদ্র রসিকতা করে বলল,
“আরে ধুর। দেশী মেয়ের মাঝে যা আছে সেটা পুরো পৃথিবীর মেয়ের মাঝেও পাওয়া যাবে নাকি!”

স্বচ্ছ হালকা মাথা দুলিয়ে বলল,
“আমি ওসব বুঝিনা। তুই-ই ভালো জানিস।”

“তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। তুই তো কখনো টেস্ট করিস নি। আমি তো করেছি নাকি! সব জেনেই বলছি কথাটা।”

স্বচ্ছ আরিদ্রের হাতে চাপড় মে;রে বলল,
“তুই এখনো ভালো হলি না।”

চলবে…