যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
সূচনা পর্ব।
প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে জনজীবন সহ ধরিত্রীর কোনা কোনা। শুধুই কি প্রকৃতির উষ্ণতা, নাকি জীবনে বয়ে চলা এক একটা বিদঘুটে পরিস্থিতিও বিরূপ উষ্ণতা ছড়াচ্ছে? পালাক্রমে পরিবর্তিত মৌসুম তখন শ্রাবণের দোরগোড়ায় হলেও, শ্রাবণ যে ব্যর্থ হচ্ছে দূর্দমনীয় তাপকে বশ্যতা স্বীকার করাতে! হুটহাট আঁছড়ে পড়া বারিধারা’র চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে তেজি সেই ময়ূখ দ্যুতির এক নজর দেখলেই। এ কেমন শ্রাবণ?
ক্ষিদের যন্ত্রনায় সন্তানের চোখ থেকে অশ্রু গড়ায়; এটা হয়তো পৃথিবীর অন্যতম এক যন্ত্রণাদ্বায়ক কঠিন শাস্তি বাবা-মায়েদের জন্য।
লোকাল বাস! মানবজীবনের অত্যাবশ্যকীয় এক বিরক্তিকর যানবাহন! এতো অত্যাবশ্যকীয় একটি যানবাহনের আরেকটু উন্নতি ঘটালে মালিক সমিতি কি নিলামে উঠবে? ব্যবসা বোঝা দ্বায়! মৃদু কোলাহল, গুঞ্জনে লোকাল বাসের মধ্যকার পরিবেশ নিস্তব্ধহীন, ঝঞ্ঝাট পূর্ণ এবং ভারী। সাঁড়ি সাঁড়ি সবুজ গাছগুলোকে দৃষ্টিসীমায় ঝাঁপসা করে পিছু ফেলে, পিচ ঢালা রাস্তা পিষে দূর্বার গতিতে ছুটে চলছে বাস। চলন্ত সেই ভাঙারি বাসের মধ্যে ভাঙচুর শব্দ আর হুটহাট ঝাঁকি বড্ডো সাধারণ আর সহজলভ্য! ভ্যাপসা গরমে বাসে অবস্থানরত যাত্রীর প্রান ওষ্ঠাগত। ঘর্মাক্ত চিন্তিত নয়নে হাতের বেবি এক্সেসরিজ ব্যগটার দিকে তাকালে অসহায়ত্ব অনুভব হয়। হাত বাড়িয়ে দুটো ফিডার মুখের সামনে তুললে, ভরশূন্য খালি ফিডারটি দেখে বুকের ভেতরের অসহনীয় ব্যাথায় চৌচির হয়ে ওঠে।চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো খানিক। গলদেশ সহ জিহ্বা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে গেলেও পানি মুখে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। বুকের মাঝে কান্নারত ছোট্ট দুধের শিশুটিকে অনবরত দোল দিতে দিতে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো, এক অসহায় বাবা। ক্ষুধায় আর গরমে কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে উঠেছে ছোট্ট শিশুটি। যেখানে এক ফোঁটা দুধের জন্য ছেলে এতোক্ষণ যাবৎ কেঁদে চলেছে সেখানে সে বাবা হয়ে নিজের তৃষ্ণা মেটায় কি করে! জানালার দিকে একপলক তাকিয়ে, পাশের যাত্রীকে টপকে জানালাটা ভালো করে খুলে দিলো শ্রেয়ান। ভালো করে জানালা খুলে দিতেই সমীরনের ঝাপটায় কোলে থাকা কান্নারত ছেলে কান্নার বেগ কমিয়ে, একটু শ্বাস নেয়। তবে পেটের ক্ষুধার জ্বালা কান্না কমানোর সুযোগ দেয় না। অবুঝ শিশুটি আবারো গলা ফাটিয়ে কান্না করা শুরু করে। চিৎকার করে বোঝানোর চেষ্টা করছে তার খিদে পেয়েছে। তবুও বাবা কেনো তাকে খাবার দিচ্ছে না!
শ্রেয়ান অদক্ষ হাতে আরো দোল দিতে শুরু করলো। প্রায়াস বলতে ছেলেকে একটু আরাম দেয়া,ক্ষিদের কথা ভুলিয়ে রাখা।
লোকাল বাসের সিটের স্বল্প পরিব্যপ্তির জায়গায় লাগাতার গায়ে গায়ে ধাক্কা স্বাভাবিক হলেও, সেই ধাক্কার পরিমাণ তখন মাত্রারিক্ত বাড়তে লাগলো। শ্রেয়ান বিমর্ষ নয়নে খানিক বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাশের সিটের যাত্রীর দিকে। বলে,
–“এতো নড়াচড়া করলে বাচ্চা নিয়ে বসতে অসুবিধা…”
শ্রেয়ানের কথারা গতি হারায় অচেনা দুটো অশ্রুসিক্ত, ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে। তার কোলেও ছোট্ট একটা বাচ্চা। নারীটি কেমন মোচড়ামুচড়ি করছে। বারবার পায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর তার দিকে তাকাচ্ছে। শ্রেয়ান ভ্রু কুঁচকে সোজা দৃষ্টি তাক করে নারীটির পায়ের দিকে।
চোখ থেকে নম্রতা, বিরক্তিভাব মিলিয়ে যায়। মেয়েলি পা দুটো পুরুষালী দুই পায়ের মাঝে আঁটকে আছে। পুরুষালী পা টি মেয়েটির গোড়ালির সেলোয়ার কিছুটা জাগিয়ে অশালীন ছুঁয়ে যাচ্ছে, খুঁচিয়ে যাচ্ছে। এবং ফর্সা পায়ে একটি সরু লালচে নখের আঁচড়ের দাগ স্পষ্ট! বিনা শব্দ ব্যায়ে ছেলেকে বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে নিজের সিট থেকে উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়ান। বাসের ঝাঁকুনি সামলে ছেলেকে একহাতে আঁকড়ে ভারসাম্য রক্ষা করে। পেছনের সিটে জানালার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করছে ত্রিশ বা বত্রিশের দোরগোড়ায় থাকা এক লোক! ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিত হাসির রেখা। শ্রেয়ান তার কাঁধে হাত রেখে ডাক দিতেই, লোকটি কৌতুহলী নয়নে তাকায়। লোকটির কৌতুহলী দৃষ্টি অবহেলিত থেকে গেলো, স্বশব্দে রুক্ষ হাতের এক প্রকাণ্ড চড় তার ডান গাল ছুঁয়ে গেলো।লোকটি বিমূঢ়, তব্দা খেয়ে যায় হঠাৎ অচেনা কারোর থেকে এমন আঘাতে। বিষয়টি পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষিত হঠকারিতা মনে হলো তার কাছে। বাসটিও গতি হারালো। বাসের মধ্যকার পরিবেশ ও তখন উৎসুক হয়ে উঠলো। থাপ্পড় খাওয়া লোকটি সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো,,
–“এই আপনি গায়ে হাত তুললেন কোন সাহসে?…”বাক্যটি শেষ করার আগেই আরো একটি থাপ্পড় পড়লো বা গালে।
তৎক্ষণাৎ শ্রেয়ানের পাশে বসা এক বয়স্ক লোক মুখ খুললো,
–“আরে কি হচ্ছে কি ভাই?”
সকলে উৎসুক তাকিয়ে আছে শ্রেয়ানের দিকে। কন্ডাক্টর এগিয়ে আসলো দ্রুত। শ্রেয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,,
–“কি হইছে ভাই কোন সমস্যা?”
শ্রেয়ানকে কোনপ্রকার সুযোগ না দিয়ে লোকটি ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,,
–“সমস্যা মানে! এই লোক শুধু শুধু আমাকে এসে থাপ্পড় মেরেছে। আমি একে চিনিনা পর্যন্ত!”
কন্ডাক্টরটি শ্রেয়ানের উদ্দেশ্যে কিছুটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে শুধায়,
–“কি ভাই শুধু শুধু মারলেন ক্যান তারে?”
শ্রেয়ান কন্ডাক্টর লোকটির প্রশ্নের জবাব দিলো না। শান্ত স্বরে থাপ্পড় মারা লোকটিকে বললো,,
–“ঐ মেয়েটির কাছে ক্ষমা চান!মেয়ে মানুষ দেখলে নিয়ত ঠিক থাকে না তাই না? শরীর চুলকায়?”
সকলের উৎসুক দৃষ্টি এবার গিয়ে পড়লো, ছোট্ট একটি বাচ্চা কোলে সিটে গুটিয়ে বসে থাকা কান্নারত এক নারীর দিকে। চেহারার আদল অবলা’র ন্যায় মলিন, বেরঙ! এবার ঘটনা আন্দাজা করতে পারলো সবাই। ততক্ষণে সকলের মুখশ্রী থেকে অপরাধী লোকটির জন্য সহানুভূতি মিলিয়ে গিয়েছে। সকলের দৃষ্টি লোকটির উপর পড়তেই লোকটি অপ্রস্তুত দৃষ্টি চুরি করতে শুরু করলো। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য উল্টো চেঁচিয়ে বললো,,
–“কি সব যা তা বলছেন, হ্যাঁ? তার কাছে কেনো ক্ষমা চাইবো আমি? আমি কি করেছি? আর আপনারা তাকিয়ে কি দেখছেন? আপনাদের বাসে এভাবে যেকেউ এসে একজন যাত্রীর গায়ে হাত তুলবে আর আপনারা তাকিয়ে তাকিয়ে নাটক দেখবেন?”
বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবারো একটি থাপ্পড় পড়লো লোকটির গালে। কন্ডাক্টর নিজেও বুঝলো ঘটনা। শ্রেয়ানকে থামিয়ে বললো,,
–“থামেন ভাই। আমরা দেখতেছি। বাসের মধ্যে ঝামেলা কইরেন না।”
পরপরই লোকটির ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বললো,,
–“শা”লা”র লুচ্চা! ঘরে মা বোইন নাই? বাসে আইসা লুচ্চামি করো? তগো মতো কয়টার জন্য বাসের নাম খারাপ হয়। মানুষ ওঠতে চায়না। গনধোলাই না খাইতে চাইলে চুপচাপ আফার কাছে মাফ চা।”
ততক্ষণে বাসের সকলে চড়াও হয়ে উঠলো লোকটির উপরে। পরিস্থিতি আরো খারাপ পর্যায়ে যাচ্ছে দেখে, লোকটি সময় নষ্ট না করে নত মস্তকে মাফ চাইলো, সিটের কোনায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটি নিরুত্তর চঞ্চল চোখে একবার তাকিয়ে আবার নিজের সিটে নত মস্তকে সেঁটে বসে রইল। সেখানেই মাঝ পথে কন্ডাক্টর সহ বাসের চালক ঘাড় ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে নামিয়ে দিলো বাস থেকে।
শ্রেয়ান নিজের সিটে বসে তাকায় পাশের যাত্রীর দিকে। কণ্ঠে কিছুটা রাগ নিয়ে বলে,
–“বাসে চড়তে পারেন না তবে একা একা ওঠেন কেনো? কেউ জখম করে দিচ্ছে আর সে বসে বসে কাঁদছে। রিডিকিউলাস!”
শ্রেয়ানের রাগান্বিত কথার প্রেক্ষিতে মেয়েটি কেমন অবুঝপানে তাকিয়ে রইল। শ্রেয়ানের প্রচুর রাগ হলো পুনশ্চঃ সেই অসহায় দৃষ্টি দেখে। সে আবার ছেলের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে দোল দিতে লাগলো। সাথে কতোশত মন ভুলানো পিতৃসুলভ আদুরে স্নেহমাখা কথা! যেনো ছেলে খিদে ভুলে থাকতে পারে।
তখন দুপুর বারোটা আটচল্লিশ। সিরাজগঞ্জ টু ঢাকা প্রায় ঘন্টা চারেকের পথ। আর সেটা যদি হয় লোকাল বাস! তবে পাঁচ ঘন্টা স্বান্তনা বানী, এর অধিক সময় ধরে নিয়ে নিরবে বসতে পারলে অভ্যন্তরীণ শান্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। বাবা’র গ্রামের বাড়ি জমিজমা সংক্রান্ত আলোচনার শেষ বৈঠক সহ অসুস্থ পর দাদির সাথে দেখা করে ফিরছিলো আজ। কিন্তু পথিমধ্যে ব্যাক্তিগত গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ড্রাইভার রেখে ছেলে সমেত মধ্য পথে একটা লোকাল বাসে ওঠে শ্রেয়ান। যার ফলস্বরূপ এখন সে আর তার ননীর পুতুল প্রায় ছেলে ঝাঁকুনি খাচ্ছে। উঠেছে থেকে ঝাঁকুনির কারণে ছেলেটা দুই তিনবার বমি করেছে। মূলত এর জন্যই ক্ষুধাও বেশি লাগছে আর খেয়েছে বেশি।
তার ঠিক দশ মিনিটের মাথাতেই ছোট্ট শ্রবণের অবস্থা বেগতিক হয়ে পড়লো। সে কেমন হেঁচকি তুলছে আর হাত পা ছেঁড়ে দিয়ে দূর্বল গলায় কাঁদছে। শ্রেয়ান অস্থির হয়ে পড়লো। চোখ ততক্ষণে ভরে উঠেছে। এটা কোন বাবার পক্ষে দেখা সম্ভব? গত মাসেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে ছেলেটা। জন্মের পরপরই মাতৃদুগ্ধের অভাবে রুগ্ন রোগে আক্রান্ত হয়। হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করায় পুরো একমাস। ডাক্তার বলেছে না খাইয়ে রাখা যাবে না। ছেলে ক্ষিদের যন্ত্রণায় আধ ঘন্টা যাবৎ কাঁদছে একটা বাবার জন্য এর চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কিছু হতে পারে না। নির্দিধায় নিজের পিতৃত্বের উপর প্রশ্ন তুলে ফেললো শ্রেয়ান। কি করবে? দূর্বল হয়ে পড়া ছেলের চোখেমুখে অজশ্র আদর করে দিলো শ্রেয়ান। মিহি স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“এই তো আব্বু আরেকটু! আরেকটু সহ্য করে নাও। আমরা পৌঁছে যাচ্ছি।”
নিরুপায়ন্তর শ্রেয়ান, অস্থির হয়ে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করতে নিলে কোলের উপর একটা কাগজ পড়লো। শ্রেয়ান অশ্রুসিক্ত নয়ন তুলে তাকায় পাশের নারীটির দিকে। যে কি-না তাকে আঙুল দিয়ে বারবার ইশারায় কাগজটি দেখাচ্ছে। সে পানির বোতলটা কোলে রেখে একহাতে কাজটা হাতে নিলো। গোটা গোটা এবড়োখেবড়ো অক্ষরে লেখা,
–“আপনার বাচ্চার খিদে পেয়েছে, ওকে খাবার দিন।”
শ্রেয়ান বেশ বিরক্ত হলো। নিজের ছেলের খিদে পেয়েছে সে কি তা বোঝে না? উপায় থাকলে এতক্ষণে খিদে নিবারণ করতো সে। কিন্তু তিনমাসের দুধের শিশুকে, দুধ ব্যতীত এই রাস্তা ঘাঁটে কি খাওয়াবে সে? ঢাকায় পৌঁছাতে এখনো দুই ঘন্টা! ছেলেটা যে মরে যাবে। সে কোনমতে নিজেকে সামলে থমথমে মুখে বলল,
–“ওর খাবার শেষ হয়ে গিয়েছে।”
বলেই সে ছেলেকে পানি খাওয়াতে লাগলো। একটু পানির ফোঁটা জিহ্বায় পেতেই, ছেলেটা কেমন ছটফটিয়ে উঠে খেতে লাগলো। অসহায়ত্ব আর ঘৃণায় বিষিয়ে আসলো শ্রেয়ানের অন্তঃস্থল! এ কেমন শাস্তি?
কি অপরাধ ছিল তার যার জন্য ছোট্ট এই শিশুটিকে দুধের জন্য তরপাতে হয়?
পাশে বসা নারীটি তখনো তাকিয়ে আছে শ্রেয়ানের ঠোঁটের দিকে। বড়বড় নিগুঢ় তার দৃষ্টি। যেনো কিছু বোঝার চেষ্টা করছে!
কিয়ৎকাল বাদ আবার শ্রেয়ানের কোলে একটা কাগজ পড়তেই শ্রেয়ান নিস্প্রভ বিবর্ণ চোখে তাকায় পাশের নারীটির দিকে। শুধায়,
–“কি সমস্যা আপনার?”
নারীটি আবার ইশারায় কাগজটিকে দেখায়। সে কাগজটি চোখের সামনে তুললে খানিক আড়ম্বরতা কাজ করলো অন্তঃস্থলে। একটু আকাঙ্ক্ষা’র উদ্ভাবন ঘটে। সৃষ্টিকর্তা বুঝি কোন পথ খুলে দিলো। আগের মতোই এবড়োখেবড়ো অক্ষরে লেখা,
–“আমার কাছে খাবার আছে। আপনি চাইলে আমি ওকে খাওয়াতে পারি।”
শ্রেয়ান দ্বিরুক্তি করার কোন পথ পেলোনা। বিলম্ব হীন ঘাড় নেড়ে সায় জানায়। নিভু স্বরে বলে,
–“ধন্যবাদ!”
মেয়েটির দৃষ্টি সেই ঠোঁটের দিকেই আঁটকে আছে। কিছু বুঝতেই সে মৃদু হাসলো। আর নিজ উদ্যোগে নিজের কোলে থাকা মেয়েকে শ্রেয়ানের কোলে বাড়িয়ে দিলো।
শ্রেয়ান অপ্রস্তুত হলেও, তা দ্রুত কাটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। নারীটি নিজের মেয়েকে তার কোলে দিয়ে শ্রবণকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। শ্রেয়ান গোলগোল বিবর্ণ চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টার করছে নারীটি কি করতে চাইছে? হঠাৎ করেই নারীটি একটু ঘুরে গেলো জানালার দিকে। সুতির ওড়নার আড়ালে শ্রবণকে নিয়ে নিতেই শ্রেয়ান হকচকালো। নারীটির উদ্দেশ্য বুঝতেই অতিদ্রুত অন্যদিকে ঘুরে গেলো। সিট থেকে বাইরে পা বের করে সম্পূর্ণটা অন্যদিকে ঘুরে বসলো। মিনিট এক বাদেই শ্রেয়ান অদ্ভুত সুন্দর মোহনীয়, প্রশান্তিদায়ক এক আওয়াজ শুনলো। উত্তপ্ত, অস্থির অন্তঃস্থল ক্রমশই শীতল হয়ে আসলো, বাসের সেই কান জ্বালাময়ী ঝঞ্ঝাট ভেদ করে ছেলের চুক চুক করে দুধ খাওয়ার শব্দ শুনতেই। পৃথিবীর সব আওয়াজ হয়তো এই স্নেহভরা আওয়াজটিকে টেক্কা দিতে ব্যর্থ হবে। বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই প্রশান্তিদায়ক মুহুর্তটি এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পেয়ে যাবে তা কখনো ভাবতে পারেনি শ্রেয়ান। কৃতজ্ঞতায় নুব্জ্য দেহ সাড়ম্বর, সতেজ হয়ে উঠলো। সে নিশ্চিন্তের এক নিঃশ্বাস ফেলতে গেলে হঠাৎ সে অবাক হলো। কোলে থাকা মেয়ে বাচ্চাটি পেছনে ঘাড় হেলিয়ে আশ্চর্য, ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বোঁচা নাক, বড় বড় চোখ, ছোট্ট একটু কপাল কুঁচকে সে এক জড়োসড়ো অবস্থা! সে কি কান্ড! শ্রেয়ান হেসে ফেললো মেয়েটির রাগি গম্ভীর চাহনি দেখে। বয়স কতো হবে পাঁচ কি ছয়মাস—অথচ দেখো কেমন বড়দের মতো নিজের বিরক্তি প্রকাশ করছে। সে হেসে মেয়েটির কুঁচকানো নাক চেপে দিলো দুই আঙুলে। ফলস্বরূপ মেয়েটি নড়চড়ে উঠে বিরক্তিকর শব্দ করে কেঁদে উঠলো। শ্রেয়ান দ্রুত আদুরে হাতে বুকে জড়িয়ে নেয়। মিহি স্বরে বলে,
–“স্যরি স্যরি গম্ভীর মেয়ে! এতো রেগে যায় না। আঙ্কেল দুষ্টু করেছি তোমার সাথে।”
আশ্চর্য ভাবে মেয়েটি থেমে গেলো। আর মুখ তুলে তাকায় না সেভাবেই শ্রেয়ানের বুকে গাল দাবিয়ে আঙুল মুখে ঢুকিয়ে বসে রইল। আর মনের সুখে উ আ , আব, বা-বা শব্দ করতে লাগলো। তার দুই পা শ্রেয়ানের দুই কোমড়ের পাশে ঝুলছে আর সে দোলাচ্ছে।
শ্রেয়ান স্নেহমাখা হাস নিয়ে তাকায় নিজের কোলে থাকা অত্যাধিক পরিমাণে ফুটফুটে সুন্দর আর স্বাস্থ্যবান বাচ্চা মেয়েটির দিকে। বাচ্চাটির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য এতক্ষণ নজরে না আসলেও চিন্তামুক্ত মস্তিষ্কে, এখন ঠিক ই নজরে এসেছে। গাল দুটো যেনো ঝুলে পড়বে! সে এক আঙুলে গালটা ছুঁয়ে দিলে গালটা থলথল করে উঠলো। বাচ্চাটি তড়াক চোখ তুলে তাকায় শ্রেয়ানের দিকে। দৃষ্টিতে রাগ তার গাল ধরেছে কেনো? শ্রেয়ান ফিক করে হেসে ফেললো। দ্রুত সেই হাসি মিলিয়ে গেলো গাম্ভীর্যের আড়ালে। খুব ইচ্ছে হলো আদুরে গাল দুটোতে একটু ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে। সে মেয়েটির গাল চেপে আদর করার ইচ্ছা পোষণ করলেও বাধাপ্রাপ্ত হলো! অন্যের সন্তানকে ছুঁয়ে দিলে যদি রাগ করে। তাই আর আদর করলো না। খুব কষ্টে নিজের ইচ্ছেকে সংবরন করলো।
সে বাচ্চাটির সাথে খেলতে লাগলো। দেখতে দেখতেই আধা ঘন্টা পার হয়ে গেলেও ছেলের দুধ খাওয়া শেষ হলো না। তখন শ্রেয়ান নড়েচড়ে উঠলো। পিছু না ফিরেই শুধায়,
–“এক্সকিউজমি! বাবুর খাওয়া কি হয়েছে? এতক্ষণে তো হয়ে যাওয়ার কথা!”
তবে নারীটির কোন আওয়াজ আসলো না। সে ইতস্ততা নিয়ে আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করলো। কিন্তু তখনো কোন সাড়াশব্দ আসছে না দেখে সে আবার ডাকলো,
–“শুনছেন?”
তৎক্ষণাৎ তার কোলে একটি কাগজ পড়লো। শ্রেয়ান কাগজটি তুললো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
–“বাবু তো ছাড়তে চাইছে না। ওর খিদে মেটেনি বোধহয়!”
শ্রেয়ান বেশ লজ্জিত হলো ছেলের কর্মে। নারীটি নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছে! সে বলল,
–“সমস্যা নেই, আপনি ওকে দিন। ওর পেট ভরেছে এতক্ষণে।”
ইরা নিগুঢ় চোখে দেখে পুরুষালী ঠোঁটের আঙ্গিভঙ্গি। বুঝতে পেরে শ্রবণকে ওড়নার নিচ থেকে বের করতে চায়। ওমনি শান্তশিষ্ট ছেলেটা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো। শ্রেয়ান আশ্চর্য হয়ে তাকায় ছেলের দিকে। ইরা’র থেকে কিছুটা জোরপূর্বক নিয়ে যায় শ্রবণকে। ছেলেটি রীতিমতো হাত পা ছড়াছড়ি করতে করতে কান্নাকাটি করতে লাগলো। নিজের কোলে থাকা বাচ্চাটিকে নারীটির কোলে দিয়ে শ্রেয়ান মলিন হাসলো কান্নারত ছেলেকে কোলে নিয়ে। কতো স্বাদের জিনিস আজ ভাগ্য করে পেলো ছেলেটা তাই ছাড়তে নারাজ। ছেলের আকুতি বোঝে সে! কিন্তু কারোর বিরক্তির কারণ হতে চায় না সে। ছেলের খিদে মিটেছে এটাই যথেষ্ট। ফুলে টেবুস হয়ে গিয়েছে শ্রবণের পেট। তবুও বদ ছেলে একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে!
ইরা’র অন্তঃস্থল অস্থির হয়ে পড়লো আবারো বাচ্চাটিকে কাঁদতে দেখে। এই যে মাতৃত্ব ভরা অন্তঃস্থল কোন শিশুর আহাজারি দেখতে পারে না। এখনো পারছে না। সে মেয়েকে বুকে চাপলো। মেয়েটা তার একদম চুপচাপ, শান্ত খুব বেশি চঞ্চল নয়। সে ব্যথিত চোখে তাকায় শ্রবণের পানে। সৃষ্টিকর্তা তাকে ভরপুর রহমত দিয়েছে। তার মেয়ের দুধের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়, ঝরে পড়েও যায়। তার জন্য যদি কোন বাচ্চার কান্না থামে, তৃষ্ণা নিবারণ হয় তবে দোষের কি! সে দ্রুত ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করলো আর কলম। এগুলো তার নিত্যদিনের সঙ্গী। এগুলো না হলে মানুষের কাছে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবে কি করে! সে যে বাক প্রতিবন্ধী।
পুনরায় একটি কাগজ হাতে নিয়ে শ্রেয়ান তাকায় পাশের নারীটির দিকে। যে কি-না আবারো নিজের মেয়েকে বাড়িয়ে দিয়েছে তার কাছে। কৃতজ্ঞতায় টলমলে আঁখি শ্রেয়ানের। সে দ্বিরুক্তি না করে ছেলেকে নারীটির কোলে দিয়ে তার মেয়েকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলে,
–“আপনার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না।”
নারীটি বুঝলো কি বুঝলো না এটা বোধগম্য হয় না শ্রেয়ানের। কারণ তার ইতিমধ্যেই মনে হলো নারীটি বাক প্রতিবন্ধী। নয়তো প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকা ধরণীতে চিরকুট কে ব্যবহার করে মনের ভাব প্রকাশ করতে! পুরোটা জার্নিতে ইরা ঠিক দেড় ঘন্টার মতো শ্রবণকে দুধ ই খাওয়ালো। এতে একটুও বিরক্ত হয়নি ইরা বরং প্রশ্ন জাগে বাচ্চা ছেলেটির পেট ভরে গেলেও কেনো সে দুধ ছাড়তে চায় না? কেনো দুধের এতো তৃষ্ণা?
গাড়িটি নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল তিনটা! পথে পথে বহুবার থামিয়েছে, যাত্রী উঠিয়েছে।
বাস থেকে নেমে শ্রেয়ান ইরা’র সামনে এসে দাঁড়ায়। কৃতজ্ঞতার সাথে মৃদু হেসে বলে,
–“আপনার এই উপকার আমি কখনো ভুলবো না। ধন্যবাদ বলে ছোট করবো না। মাতৃদুগ্ধের কোন মূল্য হয় না। এটা আপনার বাবুর জন্য, ওকে কিছু কিনে দেবেন। আমি খুশি হয়ে দিয়েছি। নিতে অস্বীকার করবেন না।”
বাচ্চা মেয়েটির হাতে হাজার টাকার দু’টো নোট দিয়ে বলল শ্রেয়ান।
–“আর হ্যাঁ , এরপর থেকে একা একা জার্নি করবেন না। হাজব্যান্ড কে সাথে রাখবেন।”
পরপর আবার বলে শ্রেয়ান পা বাড়ায়। ইরা তাকিয়ে রইল পিটপিট করে!
চলবে…