যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
||২||
ললাটে বিরক্তির ভাঁজ। শহুরে অম্বরে তখন মেঘ নেমেছে। আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে পবন। গর্ভবতী নারীদের কি মুড সুইং হয় তার থেকেও বেশি মুড সুইং হয় শ্রাবণ নামক এই ঢঙ্গি মৌসুমের। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি একে একে পিচের রাস্তা ভিজিয়ে তুললো। রোদ খানিক মুখ লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে। পথচারীরা হঠাৎ প্রকৃতির এই বদলে যাওয়া আচরণে বিরক্ত হয়ে এদিকসেদিক ছুটে নিজেদের সিক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করছে।
কিন্তু এতো এতো বিরক্তির মাঝে একজোড়া চোখে স্নিগ্ধতা এঁটে আছে। অদূরে সাদা সুতির থ্রিপিস আবৃত নারী তখন অর্ধসিক্ত। বেশভূষায় কোন আভিজাত্য নেই। বরং সাধারণের থেকেও সাধারণ। তবুও মার্জিত পরিপাটি চলাফেরায় মোটেও অশালীনতার ছোঁয়া নেই। নয়তো এহেন সাদা পোশাকে বৃষ্টির এই দিনে বিপাকে পড়তে হতো! কিন্তু ভাগ্যবশত নারীটিকে পড়তে হচ্ছে না তার মার্জিত চলাফেরার কারণে। সাদা ওড়না পুরো উপরিভাগে জড়িয়ে আছে। নারীটির কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে থাকা অত্যাধিক সৌন্দর্যের অধিকারী বাচ্চা মেয়েটির সুডৌল মুখ বেরিয়ে আছে সুতির ওড়নার আড়াল থেকে। নিরবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে কিছু আর মুখ নাড়ছে মাঝেমধ্যে। মা তাকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য নিজের ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে নিয়েছে। কিন্তু লাগাতার বৃষ্টির ফোঁটা বাচ্চা মেয়েটির গায়ে পড়লেও, তার চোখেমুখে বাচ্চাসুলভ কোন কান্নাকাটি কিংবা আনকম্ফোর্টেবল এর চিহ্ন নেই। যেখানে তারা বয়স্ক মানুষরাই বৃষ্টির ফোঁটায় অস্বস্তি বোধ করে। বেশ অবাক হয় শ্রেয়ান। বাচ্চাটিকে কেমন প্রাপ্তবয়স্ক মনে হয়! ভাবভঙ্গি এমন যেনো মা সাথে থাকলে পৃথিবীর কোন অস্বস্তি তার মধ্যে অস্বস্তি বোধ সৃষ্টি করতে পারে না। পরিস্থিতি মোতাবেক নিজেকে সামাল দেয়ার ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে ঐ মাত্র মাস কয়েকের একটি বাচ্চার মাঝে।
ব্যাক্তিগত গাড়ি তখনো এসে পৌঁছায় নি। শ্রেয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে ফুটপাতের উপর একটি চায়ের দোকানের ছাউনীর নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আর রাস্তার অপরপাশে ইরা সি এন জির জন্য হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে।
ভাবনার মাঝে শ্রেয়ানের গাড়ি এসে থামলো তার সামনে। শ্রেয়ান গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বললো,
–“ঐ সাদা পোশাক পড়া নারীটির কাছে চলো তো, মঈন।”
ছাব্বিশ সাতাশ বছরের যুবকটি মাথা নেড়ে সায় জানায়। গাড়িটি ঠিক ইরা’র সামনে থামতেই শ্রেয়ান ছেলেকে মঈনের কোলে দিয়ে ছাতা হাতে বেরিয়ে আসে। ইরা বৃষ্টিভেজা ঘন পল্লবদ্বয় মেলে তাকায় শ্রেয়ানের পানে। পরিচিত মুখ দেখে বড় বড় নেত্রে হাসলো সে। শ্রেয়ান খেয়াল করেছে নারীটি কেমন যেনো একটু আচরণ করে। সবসময় বড় বড় চোখ করে তাকায় আর চঞ্চলতা থাকে চোখেমুখ সহ পুরো বদনে। যেনো চোখেমুখে কথা বলে সকলকে বোঝাতে চায় সে কি বলছে! হয়তো এটা বাক প্রতিবন্ধীদের নিজস্ব আচরণ। সে কিছুটা দ্বিধা নিয়েই ছাতাটি ইরার দিকে এগিয়ে দিলো। যতোদূর পারলো ইশারা ইঙ্গিতে, শব্দতে বুঝিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
–“আপনি কোথায় যাবেন?”
বাক প্রতিবন্ধী ইরা’র প্রখর ক্ষমতার একটি অংশ হলো; সে খুব সহজেই ঠোঁটের আঙ্গিভঙ্গি দেখে বুঝতে পারে, সামনের মানুষটা তাকে কি বলছে। কিন্তু সংলাপটি ছোট হতে হবে। ইরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো। প্রশ্ন বুঝতেই হাতের মুঠোয় থাকা একটি কাগজ বাড়িয়ে দিলো শ্রেয়ানের দিকে। ইশারায় অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলল,
–“সে এই জায়গায় যাবে। কিন্তু এই অসময়ে কতো বৃষ্টি!”
শ্রেয়ান কাগজটি খুলে দেখলো একটি অতিপরিচিত ঠিকানা লেখা। ঠিকানার নিচে লেখা শ্রেয়াংশু প্যালেস।। কাকতালীয় ঘটনা মনে হলো তার কাছে। তবে প্রকাশ করলো না। সে মৃদু হেসে বলল,
–“এই জায়গা আমি চিনি। আপনার সমস্যা না থাকলে, আমার সাথে আসুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”
ইরা এবার একবারেই বুঝলো না। বাক প্রতিবন্ধীদের সাথে কথা বলায় অনভ্যস্ত শ্রেয়ান কি করবে ভেবে পেলোনা। গাড়িতে গিয়ে একটা কলম এনে দ্রুত একটা কাগজে কিছু লিখে ইরা’র হাতে দিলো।
ইরা আধো নয়নে পড়লো,
–“আপনি যেই ঠিকানা দিয়েছেন সেটা খুব কাছেই। আমিও ঐ পথেই যাচ্ছি। আপনার সমস্যা না থাকলে আমি পৌঁছে দিচ্ছি আপনাকে।”
ইরা আশেপাশে একবার চোখ বুলালো। বৃষ্টির কারণে কোন সি এনজি দেখতে পাচ্ছে না। সে রাজি হয়ে গেলো। লোকটাকে খারাপ মনে হয়নি তার একবারের জন্যও। খারাপ হলে তো আর বাসে তাকে সাহায্য করতো না। সে নির্ভয়ে উঠলো গাড়িতে। শ্রেয়ান সামনের সিটে বসে ইরা’র দিকে একটা ছোট্ট তোয়ালে এগিয়ে দিলো। ইশারায় বলল,
–“আপনার বাচ্চার গা মুছে দিন। ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ইরা হাসিমুখে তোয়ালেটা নিলো। আ, উ শব্দ করে বড় বড় নেত্রে শ্রেয়ানকে কিছু বলল। খুব একটা না বুঝলেও শ্রেয়ান বোঝার চেষ্টা করলো প্রাণপনে। অতঃপর এতোটুকু বুঝলো সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। শ্রেয়ান অমেঘ নয়নে তাকিয়ে বলল,
–“আপনার ঋণের থেকে আমার ঋণের পরিমাণ অনেক অনেক ভারী। আপনি আমার ছেলেকে এমন একটা উপহার দিয়েছেন; যা তার ভাগ্যে কখনো জোটা’র কথা ছিল না। আমার ছেলেটাকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ এবং অসম্ভব একটা চাওয়া পূরণ করার জন্য আমি আজন্ম আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি ওর ভাগ্যে কখনো এমন কিছু জুটবে।”
বিশাল সংলাপ! ইরা’র কাছে দূর্বোধ্য ঠেকলো। সে বুঝতে পারলো না বলে অস্ফুট শব্দ করতে লাগলো। শ্রেয়ান হেসে বলল,
–“কিছু না।”
গাড়ি চলতে শুরু করে। পথিমধ্যে অনেক প্রশ্ন করার থাকলেও করলো না শ্রেয়ান। শান্তিনগরের মৌচাক মার্কেট থেকে পনেরো মিনিট দূরত্বে অবস্থানরত ছয়তলা বিশিষ্ট একটি বিশাল দালান। যার সামনে লেখা শ্রেয়াংশূ প্যালেস। গাড়িটি বিনা বাঁধায় গেট পেরিয়ে গ্যারেজে ঢুকে গেলো। শ্রেয়ান বেরিয়ে আসতে আসতেই দারোয়ান লোকটা এগিয়ে আসলো। গাড়ি থেকে শ্রেয়ানের ব্যাগগুলো নামাতে লাগলো। ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে শ্রেয়ান বের হয়ে ব্যাক সিটের দরজা খুলে দেয়। ইরা কিছুটা অবাকের রেশ ধরে বাইরে আসলো। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আ উ শব্দ করে কিছু জিজ্ঞেস করে শ্রেয়ানকে । শ্রেয়ান মৃদু হেসে পকেট থেকে নিজের কার্ডটা বের করে ইরা’র সামনে ধরলো। নিজেকে দেখিয়ে বলল,
–” আমি শ্রেয়াংশু চৌধুরী, শাহেদ চৌধুরীর ছেলে। এটা আমার বাড়ি।”
ইরা বুঝলো পরে অবাক হলো। পরপর হেসে ফেললো।
শ্রেয়ান ইশারা আর শব্দের মিশ্রণে আবার শুধায়,
–“আপনি কি এখানে কারোর বাসায় বেড়াতে এসেছেন? আগে কখনো তো দেখিনি।”
তাদের কথার মাঝেই বয়স্ক একটি লোক এগিয়ে আসলো। ইরা’র কাছে এসে দাঁড়ায়। ইরা’র কোল থেকে বাচ্চা মেয়েটিকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়। কণ্ঠে কিছুটা অসন্তোষ নিয়ে বলে,
–“জানিয়ে আসবি না?”
ইরা তাকায় বাবার দিকে। শ্রেয়ান ও তাকায় মোর্শেদ চাচার দিকে। যে কি-না তার বাবার ড্রাইভার। বহু বছরের পুরাতন বিশ্বস্ত ড্রাইভার। তাদের নিচ তলায় ই থাকে পরিবার সমেত। সে অবাক কণ্ঠে শুধায়,
–“চাচা উনি আপনার কি হয়?”
মোর্শেদ তাকায় শ্রেয়ানের দিকে। বিগলিত হেসে শুধায়,
–“আরে শ্রেয়ান আব্বা, তুমি আসছো? আমি দেখিনি তোমায়। ও আমার বড়ো মেয়ে ইরা। আর এটা আমার নাতনি ইরাম।”
শ্রেয়ান অবাক কণ্ঠে বলল,
–“আপনার এতো বড়ো একটা মেয়ে আছে, জানতাম না তো! কোত্থেকে আসলো, শশুর বাড়ি থেকে?”
মোর্শেদ সৌজন্য হেসে বলল,
–“না আব্বা, খালা বাড়ি থেকে আসছে।”
–“ওহ্! আচ্ছা আঙ্কেল, তারা ভিজে গিয়েছে। তাদের নিয়ে ঘরে যান।”
মোর্শেদ সায় জানিয়ে মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে চললেন।
শাহেদ চৌধুরী সিদ্ধেশ্বরী কলেজের একজন প্রাক্তন প্রফেসর। তবে এখনো বেকার বসে নেই। শিক্ষাগতা করাকালীন নিজের এবং ছেলের সাহায্যে একটি গার্মেন্টসে কোম্পানি দাড় করিয়েছেন। বহু মানুষের কর্মসংস্থান। সেটার তত্ত্বাবধায়ক তিনি। তার দুই ছেলে মেয়ে। বড়ো ছেলে শ্রেয়াংশু চৌধুরী আর ছোট মেয়ে সুস্মিতা চৌধুরী। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে বছর এক হলো। শ্রেয়াংশুর ডাক নাম শ্রেয়ান। এটা খানিক সহজ! সে পেশায় একজন প্রাক্তন পাইলট। দুই মাস হলো সেই চাকরি থেকে ইস্তফা নিয়েছে সে। এখন বেকার সময় কাটাচ্ছে ছেলের সাথে। মূলত চাকরি ছাড়ার কারণ ছেলেকে সময় দেয়াই।
ব্যাগপত্র লিফটে উঠিয়ে দিলে, ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে শ্রেয়ান নিজেও লিফটে উঠলো। লিফট চলতে শুরু করলে ছেলের হাতের মুঠো থেকে কিছু পড়ে যেতে দেখে শ্রেয়ান নিচে তাকায়। কিছুটা অবাক হলো টাকা দেখে। সে টাকাটা তুলে খুললে দু’টো আধভেজা হাজার টাকার নোট দেখতে পেলো। এটা সেই টাকা যেটা সে ইরাম’কে দিয়েছিলো। শ্রেয়ানকে চিন্তায় পড়তে হলো, সে কি অজান্তে কারোর আত্মসম্মানে আঘাত দিয়েছে? টাকা দেওয়াটা কি ঠিক হয়নি?
*****
সদর দরজা পেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই ধুম করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। ইরা তো শুনলো না কিন্তু মোর্শেদ শুনলো। সে হাঁক ছেড়ে শুধায়,
–“আবার কি ভাঙলে সালমা?”
রান্নাঘর থেকে শাড়ির আঁচল মুছতে মুছতে সালমা নামের মহিলাটি ছুটতে ছুটতে আসে। বিগলিত হেসে কৈফিয়ত দিয়ে বলে,
–“ও কিছু না গো! রান্না করতে গেলে হাত ফসকে একটু আধটু কাঁচের জিনিস ভাঙবেই। এটা সংসারের নিত্যনতুন একটা অং…” বলতে বলতেই সালমা নামক অর্ধবয়স্ক মহিলার কণ্ঠরোধ হলো। সে আশ্চর্য চোখে তাকায় একবার ইরা আর ইরার হাতের ব্যাগ তো আরেকবার স্বামীর দিকে। যেনো কেউ বড়ো কোন অপরাধ অরে ফেলেছে, এমন তার দৃষ্টি! ইরা মৃদু হেসে আ উ শব্দ করে বলে,
–“মা কেমন আছো?”
মোর্শেদ বুঝলেন মেয়ের কথা। কিন্তু সামনের মানুষটা এই বোঝাবুঝির দায় কখনো নেয়নি আর না নেবে! সে আশ্চর্য চোখে গর্জে উঠলো,
–“একি হুট করে ও কোত্থেকে আসলো মিমির আব্বু? আর ওর হাতে ব্যাগ কেনো? কতোদিন থাকবে? দেখো আমার ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা সামনে। তোমার এসব আলগা আহ্লাদে ঘরে বাড়তি কোন ঝামেলা কর যাবে না। আমার ছেলেমেয়েরা যদি খারাপ রেজাল্ট করে তবে আমি সবকটাকে দেখে নেবো!”
–“আমিও তো বলি কোন অনুক্ষণের আগমন ঘটলো— যে আমার শখের কাঁচের বাটিটা ভেঙে গেলো! নয়তো আমার হাত দিয়া আজ পর্যন্ত একটা কাঁচের জিনিস ভাঙেনি অথচ ঘরে পা দিছে আর সাথে সাথে অনর্থ ঘটিয়ে ছেড়েছে। অলুক্ষুণে নাকি অভিশাপ! আস্ত এক অভিশপ্ত মেয়ে! কারোর জীবনে তো শান্তি আনতে পারে না, পারে শুধু জীবন তছনছ করতে। কি হইলো মিমির আব্বু তুমি কথা বলছো না কেনো? ওকে বেশিদিন এই ঘরে রাখার চিন্তা করছো নাকি? তবে তুমি থাকো তোমার ঘরে। কারণ ও যে ঘরে থাকবে সেই ঘর ধ্বংস হয়ে যাবে। মা জন্ম দিয়াই মরছে, স্বামী অন্ধকার রাত্রে তালাকের কাগজ ধরাইয়া দিয়া, ঘর থিকা বাইর কইরা দিছে, এখন কি খালার বাড়ি থিকাও বাইর কইরা দিছে?”
–“থামো সালমা, এতোমাস পর আসছে। একটু বসতে তো দিবা। তা না কইরা শুরু করে দিছো ক্যাঁচাল। ভালো লাগে না। আর তুই একটু জানাইয়া আসবি না? তাহলে আমি কিছু ব্যবস্থা করতে পারতাম।”
বলেই মোর্শেদ ক্ষিপ্ত মেজাজে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ইরা অনিমেষ তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। অন্তঃস্থলে বলে ওঠে সব বাবা সুপার ম্যান হয় না, সব বাবারা বটবৃক্ষ হয় না, সব বাবারা সন্তানের সুখ হয়না। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মাঝেমধ্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে , তাকে জন্মগত বধির, বাক প্রতিবন্ধী বানানোর জন্য। এই যে কতো কটু কথা তার কর্নগোচর হয়। কি শান্তি! কি শান্তি! সৃষ্টিকর্তা সর্বশ্রেষ্ঠ! যা করেন ভালোর জন্য করেন। এই যে সৎ মা নামক মানুষটার কথায় সে কখনো কষ্ট পায় না। কারণ পর মানুষের থেকে যেটুকু পায় সেটাই অনেক। কিন্তু ঐ যে বাবা নামক মানুষটা! তার একটু মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতেও তার বুকটা ছিঁড়ে যায়।
–“কি হলো কতোদিন থাকবি? এতো ব্যাগপত্র নিয়ে এসেছিস কেনো? দাঁড়া তোর খালার কাছে ফোন দিচ্ছি।”, বলেই সালমা ছুটলো। মুহুর্তেই ঘরের শান্তি বিনষ্ট হলো। ইরা মলিন হেসে চুপটি করে কোলে বসে থাকা মেয়েকে নিয়ে বোনের ঘরের দিকে গেল। চাপিয়ে রাখা দরজা খুলতেই, বিছানায় আধশোয়া একটা একুশ বছরের মেয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলে উঠলো,
–“শুধু শুধু কেনো আসলি? এখন রোজ রোজ ঘরে ঝামেলা করবে আম্মা। ভালোলাগে না।”
বলেই মিমি হাতের ফোনটা ছুঁড়ে মেরে উবু হয়ে শুয়ে পড়লো। বোনের তিরস্কার বুঝতে অসুবিধা হয়নি ইরা’র। তবুও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। দাঁত কামড়ি দিয়ে এখানে পড়ে থাকতে হবে।
জন্মের পর ইরার মা মারা যায়। বাবা বিয়ে করে এক বছরের মাথায়। সেই ঘরে ইরার ঠাই হলো না। ঠাই হয় খালার বাড়িতে। খালা কোনরকমে হাতে পায়ে বড়ো করে বিশ বছর বয়সে, একটা চাকরিজীবী ভালো ছেলের হাতে পাত্রস্থ করলো। কিন্তু পোড়া কপাল সেখানেও সে সুখের দেখা পেলো না। বোবা, বধির, মা বাবাহীন হওয়ার ফলে রোজকার মারধর, তুচ্ছতাচ্ছিল্য অতঃপর রাতের অচেনা সেই স্বামীর ছোঁয়ার সুখ সহ্য করে সংসার করে। তবে সেই সংসারে একদিন স্বামী নিজেই অতিষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে ইরা গর্ভধারণ করলো। ফলে বিচ্ছেদ স্থগিত করা হয়। তারপর? তারপর অবশ্য ইরার ভাগ্যে চমৎকার এক সুখ হয়ে আসে মাত্রারিক্ত সৌন্দর্যের অধিকারী এক কন্যা সন্তান। ইরা’র স্বামীর চোখ ঝলসে গেলো মেয়ের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে। ডাক্তার আবার জানায় তার মেয়ে বোবা হবে না। এই নিয়ে পুরো একমাস তার শ্বশুরবাড়িতে উৎসব চললো। কিন্তু পৌরুষ সুখ, চাহিদার কাছে সন্তান, সংসার সব তুচ্ছ হয়ে পড়লো।মেয়ের জন্মের এক মাসের মাথায় ইরার হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়ে সুন্দরী, বাকপটু পরিপূর্ণ এক তরুণীকে বিয়ে করে আনে তার স্বামী। কিন্তু সমস্যা হয় সেই তরুণী অন্য সংসারের বাচ্চা লালন পালন করবে না। ফলশ্রুতিতে মেয়েটির ভাগ্য ও জুড়ে যায় মায়ের সাথে। কিন্তু এর বাবা’র দায়িত্ব সব যথাযথভাবে পালন করে ইরা’র প্রাক্তন স্বামী। কারণ মেয়ে এখনো তার কাছে বড্ডো আদরের। মাসে দুই বার এসে দেখে যায় মেয়েকে। মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রতিমাসে প্রয়োজনের অধিক টাকা, সরঞ্জাম পাঠায়। এতে ইরা’র নিজের খরচ ও চলে যায়। মাঝেমধ্যে খুব করে চায় টাকা গুলো অস্বীকার করতে। কিন্তু কি হবে? তার মেয়েটাকে না খেয়ে থাকতে হবে। কেননা বোবা বধির হওয়ায় তাকে কেউ কাজ দিতে চায় না। সাত মাস হলো সে ডিভোর্সীর তকমা পেয়েছে। তকমাটা একদম খারাপ নয় ভালোই! দিনশেষে এটা ইরা’র স্বান্তনা বানী।
মিনিট পাঁচের মাঝে গোসল করে বের হয় শ্রেয়ান। কোমড়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে খালি গায়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয় ঘর থেকে। ওমনি নাতিকে কোলে নিয়ে হাঁটতে থাকা সুমনা চেঁচিয়ে উঠলো,
–“এই অভদ্র ছেলে! এতো বড়ো হয়েছিস তবুও ঘরের বাইরে এভাবে আসতে লজ্জা করে না? শ্রেয়ান , ঠিক করে পোশাক পড়ে বের হ বলছি।”
শ্রেয়ান গা দুলিয়ে হাসলো মায়ের কথায়। সেই হাসি দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে শাহেদ চৌধুরী। বলে,
–“এমন গুরুত্বপূর্ণ কথায় হাসাটা বড্ডো বেমানান শ্রেয়ান। এক ছেলের বাবা হয়েও এমন উশৃঙ্খলতা!”
শ্রেয়ান মাথা মোছার তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
–“অভ্যাস পাপা!”
–“বাজে অভ্যাস! ত্যাগ করা অতিব জরুরি।”, শাহেদ চৌধুরী গম্ভীর গলায় বলল। শ্রেয়ান মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় ট্রাভেলিং এর উপর থাকায় হোটেল রুমে থাকা হতো। আর সেখান থেকেই এই অভ্যাসের সৃষ্টি!
সুমনা নাতিকে কোলে নিয়ে দোল দিতে গিয়ে খানিক বিব্রত হয়। এসেছে থেকে শুধু যার তার বুকের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। যেনো দুধ খাওয়ার অভ্যাসের বহিঃপ্রকাশ! সে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেকে শুধায়,
–“দাদুভাই আবার এই অভ্যাস কোত্থেকে গড়লো শ্রেয়ান? অভ্যাসটা তো ভুলে গিয়েছিল।”
শ্রেয়ান চোখ তুলে তাকায়। শ্রবণ দাদির কাছেও দুধ খাওয়ার আবদার জানাচ্ছে। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি নতুন নয়। সেই ছেলের জন্মের সপ্তাহ খানেক পর থেকেই। ছেলের কাজের লজ্জিত না হয়ে শ্রেয়ান মলিন হেসে মাকে বলল,
–“আজ খুব মজাদার, অকল্পনীয় পছন্দের খাবারটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তার ভাগ্যে জুটেছিল মামনি। তাই সে ভাবছে এমন করলে আরো খাবার পাবে।”
সুমনার চোখেমুখে উপচেপড়া আগ্রহ ভীড় জমায়। সে উৎসুক কণ্ঠে শুধায়,
–“মানে?”
–” শ্রবণের খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিল মাঝরাস্তায়। শ্রবণ অনেক কান্নাকাটি করেছিলো তখন একজন নারী তার মেয়ের অধিকার থেকে ওকেও একটু ভাগ দেয়।”
সুমনা দ্রুত ছেলের পাশে বসে। সাগ্রহে শুধায়,
–“সবটা খুলে বল আমায়।”
শ্রেয়ান ছেলেকে নিজের কোলে নিয়ে মাকে সব খুলে বলল। সুমনা অবাক কণ্ঠে শুধায়,
–“মোর্শেদ ভাইয়ের এতো বড়ো মেয়ে আছে? কই জানতাম না তো?”
শাহেদ চৌধুরী মুখ খুলল, বলল,
–“আমিও তো জানতাম না।”
শ্রেয়ান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
–“আমিও জানতাম না। কিন্তু বড্ডো অমায়িক মেয়েটা, মামনি। তার মেয়েটাকে যদি দেখো, তাকিয়েই থাকবে। জীবন্ত পুতুল! এতো সুন্দর বাচ্চা আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু একটু গম্ভীর আর রাগী। ছুঁলেই রাগ করে! আমার কোলে এসে একদম চুপ করে ভদ্র মেয়ের মতো বসেছিল। একটুও জেদ করেনি মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য।”
সুমনা প্রাশান্তিভরা হাসলো। বলল,
–“একদিন গিয়ে দেখে আসবো। কতো ভালো! আমার দাদুভাইকে এতো সুস্বাদু খাবার খাওয়ালো। তার কাছে তো আমরা ঋণী হয়ে গেলাম।”
–“মোর্শেদকে তো আমার নিজে গিয়ে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ, সুমনা।”, শাহেদ চৌধুরী মৃদু হেসে বলল। সুমনা বলে,
–“হ্যাঁ, উচিৎ ই তো। বলবে।”
শ্রেয়ান হাসলো। তার বাবা মায়ের এই নাতি জুড়ে ই সবকিছু। নাতির ভাগ্য থেকে যেদিন মায়ের দুধ ফস্কে যায় সেদিন থেকে শুরু হয় তাদের ভালোথাকার যুদ্ধ।
সুখ খোঁজার যুদ্ধ।
*****
ইরা গোসল করে মেয়েকে খাইয়ে নিজেও দু’টো খেয়ে নিলো। অন্যদিকে সালমা’র জীবন থেকে সুখ হারিয়ে গিয়েছে সে সেই বিকাল থেকে ঘরে ঝামেলা শুরু করেছে। ইরাও বুঝলো ঘরের ঝামেলার কারণ। সে পার্স ঘেঁটে পাঁচ হাজার টাকা বের করলো। টাকাটা নিয়ে একটা কাগজে কিছু লিখলো। অতঃপর সেটা নিয়ে বাবা মায়ের ঘরে গেলো। মোর্শেদ শুয়ে ছিল আর তার পাশে বসা সালমা বিলাপ করছে কিছু। ইরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। আর পাঁচ হাজার টাকা সহ কাগজটা এগিয়ে দেয় মায়ের দিকে। সালমার বিলাপ থেমে গেলো কচকচে কটা নোট দেখে। সে শকুনী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইরা’র দিকে। থমথমে মুখে টাকাটা হাতে নিয়ে কাগজটা খুললো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
–“আমার এই মাসের থাকা খাওয়ার খরচ, আপাতত এটা রাখো। পরে আরো দেবো।”
সালমা’র রাগ কমলো তৎক্ষণাৎ। তবুও গাম্ভীর্যতা নিয়ে বলল,
–“দুর্মূল্যের এই বাজারে পাঁচ হাজার টাকায় ডাল ভাত জোটে যে তুই থাকা খাওয়ার কথা বলছিস? আরো লাগবে?”
ইরা বুঝলো না পরে সালমা ইশারায় বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলল,
–“আরো লাগবে।”
ইরা বিনা দ্বিরুক্তিতে রাজি হয়ে যায়। সালমা ঠান্ডা হলো। যেতে যেতে বলে যায়,
–“রাতের রান্নাটা যেনো করে রাখে। তার কোমড়ে ব্যথা বেড়েছে। আর ঘরটাও যেনো পরিষ্কার করে। এক মাস যাবৎ ঘরটা পরিষ্কার করা হয়নি।”
ইরা ঘাড় দুলিয়ে সায় জানায়। কিন্তু এই পুরো সময়টাতে মোর্শেদ নামক বাবা, একটা টু শব্দটি করেনি। জোরগলায় বলেনি, আমার মেয়ে আমার ঘরে খাবে, থাকবে তাতে টাকা কেনো দেয়া লাগবে?” ইরা অনেক রঙিন রঙিন স্বপ্ন দেখে তার মধ্যে অন্যতম একটা স্বপ্ন হলো, বাবা তার মাথায় হাত রেখে বলবে,
–“এটা আমার মেয়ে ইরা। কেউ ওর সাথে উঁচু গলায়, ছোট করে কথা বলবে না। খারাপ ব্যবহার করবে না। ও আমার ছায়াতলে বাঁচবে।”
কিন্তু এটা স্বপ্ন হয়েই থেকে গেলো। সন্ধ্যা হতেই ইরার ছোট ভাই ঘরে ফিরে। যার নাম মিহাদ, বয়স বারো বছর। তার কাছে একমাত্র প্রিয় মানুষ হলো ইরা। হঠাৎ করেই ঘরে ফিরে ইরাকে দেখে সে আনন্দে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ইরা তাকে আদর করে দিয়ে মেয়েকে তার কাছে রেখে পুরো ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ধোঁয়া মোছা করলো। অতঃপর রাতের রান্না করলো। ইরার হাতের রান্না খুব সুস্বাদু। তার স্বামীর বাড়িতে চার বছর সংসার করার ভাগ্য যদি হয়ে থাকে—তা শুধু মাত্র এই দুটি উৎকৃষ্ট কারণে। এক হলো এই মজাদার রান্নার গুন আর এক হলো স্বামীকে সে কখনো বিছানায় অসন্তুষ্ট করেনি।
চলবে…