যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
||০৩||
ভাগ্যের পরিহাস! এই দু’টো শব্দের যোগ সন্ধি শুনতে সাধারণ শোনালেও এর সাথে জুড়ে থাকে প্রত্যেকের গোটা এক জীবন বৃত্তান্ত। এমনটাই ধারণা ইরা’র। মা মরে গিয়েছে তার আগমন অভিশপ্ত। মা নেই ঐ মেয়ে ভালো না, সংসার হবে না তাকে দিয়ে। স্বামী মারধর করে, নিশ্চয়ই কোন দোষ আছে মেয়েটার। স্বামী ডিভোর্স দিয়েছে ঐ মেয়ে সমাজের যোগ্য নয়, খারাপ।অল্প দুঃখে তো আর কেউ তালাক দেবে না! এতো কিছুর পরে খালার বাড়িতে জায়গা পেয়েছিল। কিন্তু খালাতো ভাইদের বউদের গলার কাঁটা হয়ে গিয়েছিলো। হয় তারা থাকবে নয়তো থাকবে ইরা নামক পরগাছা! খালার স্নেহ থাকলেও সেখানে থাকতে পারলো না ইরা। বেরিয়ে আসে মেয়েটাকে নিয়ে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে।
দানবাকৃতির একটা বালতি নিয়ে সর্বশেষ তলায় উঠতেই লিফটের দরজা খুলে গেলো। উর্দ্ধশ্বাস সামলে ইরা এক গাল হেসে তাকায় কোলে থাকা মেয়ের দিকে।
পৃথিবীতে যতদিন আছে সে বাঁচবে আনন্দের সাথে শুধু মাত্র এই ছোট্ট জানটির জন্য। তার জন্য মায়া রয়েছে পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না শুধুমাত্র নিজের এই অংশটি ব্যতীত। এই ছোট্ট মনটিতে তার জন্য ভরপুর ভালোবাসা আছে থাকবে। সে জানে। তাই ওর জন্য বাঁচবে সে! প্রতিটা দিন উপভোগ করবে।
ইরাম চুপচাপ বসে আঙুল চুসছে। সে মেয়ের হাতটা টেনে নামিয়ে দিলো। মাথা নেড়ে আ উ শব্দ করে ওটা খেতে নিষেধ করে। বাচ্চা মেয়েটি আর আঙুল মুখে তোলার প্রবণতা দেখালো না। ইরা হাসলো বাধ্যগত মেয়ের আচরণে। আহ্লাদে ঠোঁট দুটো ছুঁইয়ে দেয় মেয়ের দুই গালে। মায়ের আদরে মেয়েটি স্মিত হাসলো। ইরা ডানে বামে মাথা নাড়লো। মেয়ে তার খুব কম হাসে। কিছুটা গম্ভীর! খিলখিলিয়ে হেসেছে এমন দৃশ্য খুবই বিরল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। রোদের তেজ কমে যাবে ভেবেই সে দ্রুত বালতি হাতে লিফট থেকে নামলো। নেমে আরেকটু জিরিয়ে নেয়। বিশাল বালতি একহাতে নিয়ে এখনো দশ সিঁড়ি পর ছাদ। মেয়েকে নিয়ে কষ্ট হবে বেশ! কিন্তু মেয়ে কোল ছাড়তে চাইছে না।
বহু কষ্টে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো ইরা। ততক্ষণে দেহ ভেঙে এসেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলো। ছাদের দরজা পেরিয়ে তখনি কেউ ঢুকলে হকচকায় ইরা। শ্রেয়ান সৌজন্য হাসলো ইরা আর ইরামকে দেখে। জিজ্ঞাসা করে,
–“ভালো আছেন?”
ইরা বুঝলো। হাসিমুখে চোখ বড় বড় করে মাথা নাড়লো সে। শ্রেয়ান তাদের ছাদের পথ দেখিয়ে বলল,
–” যান।”
বলেই শ্রেয়ান তাকায় ইরামের দিকে। যে কি-না ডাগর ডাগর চোখে কেমন করে যেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণের রেশ! সে হেসে আঙুল বাড়িয়ে মেয়েটির নাক ছুঁয়ে দিলে সমান্তরাল সেই ললাট সহ নাক চোখ কুঁচকে একাকার হয়ে গেলো। শ্রেয়ানের প্রচুর হাসি পেলো গম্ভীর মেয়েটিকে বিরক্ত করে। সে তাদের পাশ কাটিয়ে নিচে চলে যায়। ইরা বালতি নিয়ে ছাদে ঢুকতেই দেখতে পেলো যুবতী এক মেয়ের কোলে শ্রবণ। সে তার কাজ করতে লাগলো।
মিলা শ্রবণকে নিয়ে খেলতে খেলতে ইরাকে দেখে গতিরোধ হলো। সে চঞ্চল পায়ে এগিয়ে আসে। চপলতার সাথে জিজ্ঞাসা করে,
–“আফা, আফনে কেডা?”
ইরা বৃহৎ নেত্রে আগুন্তক মেয়েটির কথা বোঝার চেষ্টা করলো। বুঝতে পেরে আ উ শব্দ করে কিছু বলল। কিন্তু মেয়েটি বুঝতে পারলো না। মিলা আবার জিজ্ঞেস করে,
–“আফনে কতা কইতে পারেন না? আফনে কোন তলায় থাকেন? আগে তো দেখিনাই।”
মেয়েটি ইরার কথা বুঝতে পারছে না। ইরা তাই একটা মাটির টুকরো নিয়ে মেঝেতে লিখলো, তার নাম ইরা। গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকে। মিলা বুঝতে পেরে হৈ হৈ করে শুধায়,
–“ওওও, আফনে ড্রাইভার কাক্কুর মাইয়া? যেই আফায় শ্রবণরে দুধ খাওয়াইছিল? কি সুন্দর আফনে? কি সুন্দর আফনার মাইয়া! আরে এ দেহি চাঁন্দের লাহান।”
ইরা বুঝলো না মিলার কথা। সে কাজ করতে লাগলো নিজের। মিলা গল্প জুড়ে দেয় তার সাথে। তাদের ঘরে তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। তার অনেক প্রশংসা শুনেছে সে! অবুঝ ইরা শুধু সৌজন্য হেসে ঘাড় দুলাতে লাগলো।
ততক্ষণে শ্রেয়ান গরম ফিডার হাতে ছাদে ঢুকলো। মিলাকে পকর পকর করতে দেখে বলল,
–“সে কথা বলতে পারে না আর শুনতেও পারে না তুই কি বলছিস? সে তো কিছু শুনতে পারছে না।”
–“আফনে কানেও হোনেন না, আফা?”, মিলার বিস্মিত কণ্ঠ। ইরা এটা বুঝলো বলে সে ঘাড় নাড়লো। সে শুনতে পারে না। তার সাথে কথা বলতে হলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে ছোট সংলাপে কথা বলতে হবে। মিলা আর কথা বললো না। মিলা শ্রেয়ানদের বাসার কাজের মেয়ে। বয়স উনিশ! খুব চঞ্চল, প্রাণবন্ত। শ্রবণ বেতের চেয়ারে বসে মিলাকে বলে,
–“বাবুকে নিয়ে আয় মিলা।”
মিলা লাফাতে লাফাতে গেলো। শ্রেয়ান ধমকে উঠলো,
–“লাফাস না, ও বমি করে দেবে। কতো কষ্ট করে সকালে এক ফোঁটা খাইয়েছি।”
–“হেয়া কি এহনো আছে? কবে হজম হইয়া গেছে।”, মিলি ব্যঙ্গ করে বলল। শ্রেয়ান চোখ রাঙায়। ছেলেকে বেতের সোফাটিতে পাতা গদিতে বালিশের উপর শুইয়ে দিয়ে বলে,
–“ওনাকে গিয়ে একটু সাহায্য কর। ওনার মেয়েটাকে তুই কোলে নে, আর তাকে কাজ করতে দে।”
মিলি ইরা’র দিকে একবার তাকায়। একহাতে মেয়েকে নিয়ে আরেকহাতে বহুকষ্টে কাপড় মেলছে। সে মাথা নেড়ে বলল,
–“আচ্ছা যাইতেছি।”
সে ছুটে গিয়ে ইরা’কে বলল,
–“দেন আফা বাবুরে আমার কাছে দেন। আফনে কাজ করেন।”
ইরামকে নিয়ে নিলো মিলা। ইরা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলো। মিলা ইরামকে নিয়ে আকাশ দেখালো, পাখি দেখালো, ছাদের পাশে লাগানো ফল আর সব্জির গাছগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখালো। সে খেলতে খেলতে জিজ্ঞাসা করে,
–“আফা ওর নাম কি?”
ছেলেকে চেপে ধরে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টায় মগ্ন শ্রেয়ান বলল,
–“ইরাম।”
–“সুন্দর নাম , তাই না ভাইজান?”
–“হুঁ।”
রাজ্যের কাপড় মেলতে মেলতে ইরা তাকায় অদক্ষ হাতে বাচ্চা ছেলেটিকে জোর করে দুধ খাওয়ানো। পুরুষ মানুষের এতো ধৈর্য্য শক্তি আছে নাকি! বাচ্চাটি মুখ খুলছেই না আর লোকটা ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কি যেনো বলছে, হাসছে আর চেষ্টা করছে। পরপরই মনে কৌতুহল জাগলো বাচ্চাটির মা কোথায়। মিলা হাঁটতে হাঁটতে ছাদের ওমাথায় গেলে , ইরা শ্রবণকে দেখিয়ে অস্ফুট স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করে,
–“ম….মা।”
মিলা বুঝে গেলো খুব সহজে।
–“শ্রবণের মায়ের কতা জিগাইতেছেন?”
ইরা মাথা নাড়লো। মিলা মেজাজ নিয়ে বলল,
–“আল্লাহর গজব, আল্লাহ উঠাইয়া নিয়া গেছে।”
ইরা অবুঝপানে আকাশের দিকে তাকায়। মিলা খুব দ্রুত কথা বলে সে বোঝে না। মিলা শুধায়,
–“কি বোঝেন নাই?”
ইরা না বোধক মাথা নাড়লো। মিলা আবার আকাশ দেখিয়ে বলল,
–“আল্লাহ নিয়া গেছে।”
এবার বুঝতে পেরে ইরা’র বক্ষস্থল খামচে ধরলো। সে আহত দৃষ্টিতে তাকায় শ্রবণের পানে। কি ছোট্ট দুধের শিশু। বয়স মাস দুই হবে আন্দাজা করলে। স্বাস্থ্য একদম নেই। পেটের হাড়গোড় সব দেখা যায়। এর জন্যই সেদিন দুধের জন্য অমন হা-হুতাশ করছিল। ব্যথিত মন নিয়ে ইরা চুপসে গেলো। নিজের কাজ করে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসলো। রান্না চুলায়। এসেছে পর থেকে এই এক সপ্তাহ থেকে ঘরের সব দায়িত্ব তার উপরেই ন্যস্ত।
*****
বিকাল তিনটা। অজশ্রবারের মতো ছেলেকে ফিডার চোষাতে ব্যর্থ শ্রেয়ান , লালচে আঁখি তুলে তাকায় ছেলের দিকে। একাধারে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদছে শ্রবণ। শ্রেয়ান রাগে হাতের বেবি টাওয়ালটা ছুঁড়ে মেরে উঠে দাঁড়ায়। ধমকে উঠে বলে,
–“খিদে পেয়েছে তো খাচ্ছো না কেনো, ফাজিল ছেলে?”
কক্ষে অবস্থানরত মিলা লাফিয়ে উঠলো শ্রেয়ানের ধমকে। ছোট্ট শ্রবণ ও আরো জোরে কেঁদে উঠলো। ছেলের চিৎকারে সুমনা ছুটতে ছুটতে আসলো। ধমকে উঠে বলল,
–“কি হচ্ছে কি শ্রেয়ান? অতোটুকু বাচ্চার উপর রাগ দেখাচ্ছো কেনো?”
সুমনা দ্রুত শ্রবণকে বুকে জড়িয়ে নেয়। আদর করে কান্না কমানোর চেষ্টা করে। কাঁদতে কাঁদতে কাঁশতে শুরু করেছে। ছেলের ক্রন্দনরত মুখের দিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে শ্রেয়ান ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে,
–“ধমকাবো না তো কি করবো? সে আমার সাথে জেদ দেখাচ্ছে। ভাবছে জেদ দেখালেই সে মায়ের দুধ খেতে পারবে। লোভী ছেলে একটা! ওর ভাগ্যে ঐদিন দুধ জোটা টাই ভুল ছিল। যার জন্য এই একটা সপ্তাহ যাবৎ এমন করছে। রোজ রোজ ওকে দুধ কে দেবে? সকাল থেকে এক চুমুক দুধ ও মুখে তোলেনি মামনি। কদিন আগে হাসপাতাল থেকে এসেছে। এখন যদি এমন করে ও তো মরে যাবে।”,
বলতে বলতেই শ্রেয়ানের চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সুমনা আহত চোখে তাকায় বিক্ষিপ্ত মেজাজের ছেলের দিকে। এতোটা অধৈর্য্য শ্রেয়ান কখনো ছিল না। কিন্তু যখন থেকে বাবা হয়েছে অধৈর্য্যতা যেনো তাকে গ্রাস করছে। তার থেকেও বেশি অধৈর্য্যতা ছেলেটার কিছু না হয়ে যায়! সে আহত সুরে বলে,
–” সাতানব্বই দিনে একটা দুধের শিশু শ্রেয়ান। ও মায়ের দুধের জন্য কাঁদবে না তো কে কাঁদবে?”
শ্রেয়ান অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় মায়ের দিকে। বলে,
–“ওর জন্য তো ওর মায়ের দুধ কলঙ্কিত। ও কেনো বুঝতে চায় না ও, আর পাঁচটা বাচ্চার মতো ওর ভাগ্য এক নয়। ওর ভাগ্যে মায়ের দুধ নেই।”
সুমনা ছেলেকে বোঝাতে যায় না। সে ফিডারের দুধ বাটিতে ঢেলে চামচ দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বহু চেষ্টার পরেও সে খাওয়াতে পারলো না। চামচ মুখেই ঢোকাবে না। সুমনা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের পানে। শ্রেয়ান অশ্রুসিক্ত নয়নে মলিন হাসলো।
বলল,
–“ওকে পৃথিবীতে না আনলেই ভালো হতো তাই না, মামনি?”
সুমনা টলমলে চোখে ধমকে উঠলো,
–“সব কিছুর একটা সীমা থাকা দরকার শ্রেয়ান। চুপ কর! ও ধীরে ধীরে আবার ভুলে যাবে তখন খাবে। আর এইসব কথা মুখে আনবি না।”
শ্রেয়ান ঘর্মাক্ত গেঞ্জি বদলে আরেকটা পরে নেয়। মাকে বলে,
–“সরো, আমি খাওয়াচ্ছি।”
শ্রেয়ান বিছানায় বসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কান্নারত মুখটি মুছিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
–“পাপা স্যরি, আব্বু। আর কখনো বকবো না। তুমি না খেলে পাপার তো কষ্ট লাগে বলো! এই দেখো তোমার হাড়গোড় সব দেখা যাচ্ছে। না খেলে তুমি আবারো হাসপাতালের ঐ কাঁচের ঘরে বন্দি হয়ে যাবে। পাপার একটুও ভালো লাগবে না, তোমাকে ওখানে দেখতে।”
বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে দূর্বল হয়ে পড়ে রইলো বাবার বুকে। শ্রেয়ান বুকে নিয়েই দূর্বল হয়ে পড়া মুখটিতে চামচ তুলে দিলো। বলহীন দেহে ছেলেটি আর জেদ দেখাতে পারলো না, চুপচাপ খেতে লাগলো। সুমনার চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এই বাচ্চাটা আর তার ছেলের কি দোষ ছিল? সৃষ্টিকর্তার কাছে তার কোন প্রার্থনাই কি পৌঁছায় না?
শ্রেয়ান মলিন হাসলো শরীরের সাথে ছেলের জেদকে হারতে দেখে। একদিন এভাবেই তো শ্রবণ নামক ছেলেটির থেকে মাতৃত্ব হেরে গিয়েছিল। সেই থেকে ছেলেটি এক বেলা কখনো শান্তিমতো খেলাধুলা করতে পারেনি, হাসতে পারেনি। জন্মের পর, সে যেদিন থেকে ছেলেটাকে দেখেছে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কখনো সুস্থ সবল বাঁচতে দেখেনি। এতো এতো অর্থবিত্ত কোন কাজের না! ছেলেকে খাওয়াতে সফল হয় শ্রেয়ান। ছেলেটা তখন কেমন নির্জীব ঢুলুঢুলু চোখে তাকায় বাবার দিকে। শ্রেয়ান তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলে,
–“এখন দাদুর বুকে একটু ঘুমাও। পাপা তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনতে বাইরে যাবো।”
শ্রবণকে মিলার কাছে দিয়ে শ্রেয়ান বলল,
–“মামনির কাছে নিয়ে যা, মিলা। ঘুম পাড়িয়ে দিতে বল। আমি ওর ওষুধ আর ওয়াইপস কিনে আনি।”
মিলা নির্জীব কণ্ঠে বলল,
–“আচ্ছা।”
–“তোর কিছু লাগবে? লাগলে বল, এখনি নিয়ে আসি। বারবার বের হতে পারবো না আমি।”
মিলা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মাথা নেড়ে বলে,
–“না ভাইজান, কিছু লাগবে না।”
–“তোর চানাচুর এখনো আছে? চানাচুর লাগবে না?”
মিলা মলিন হাসলো। বলল,
–“এহনো অর্ধেক বৈয়োম আছে।”
শ্রেয়ান হেসে বলল,
–“ঠিক আছে যা।”
মেয়েটার চানাচুরের পোকা। চানাচুর নাহলে তার দিন চলে না। মিলা মলিন চোখে তাকায় শ্রবণের দিকে। বাচ্চাটা আর ভাইজানের দিকে তাকাইলে মায়ার থেকেও বেশি দয়া হয়। অথচ…. সে কিছু একটা ভাবলো। শ্রবণকে সুমনার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,
–“ভাইজান ঘুম পাড়াইতে মানা করছে। খেলতে কইছে।”
সুমনা বলল,
–“আচ্ছা তুই যা।”
শ্রেয়ান ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই মিলা ছুটে গেলো রান্নাঘরে। প্যান উঠিয়ে উঠিয়ে দেখলো খাবারের আইটেম গুলো। চাচি সবসময় প্রয়োজনের অধিক রান্না করে। সে একটা টিফিন বাটিতে আস্তে আস্তে করে গরুর মাংস ঢেলে নেয়, তিন পিস ইলিশ মাছ নেয়, আর একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ফলের ঝুড়ি থেকে কিছু আপেল, আঙুর, কমলা আর একটা বেদানা নিলো। আর একটা টিফিন বাটিতে ফ্রিজ থেকে কিছু সরপুড়িয়ার নিলো। সেগুলো সব একটা প্লাস্টিক ব্যাগে ঢুকিয়ে গিট দিয়ে খাবার টেবিলে রাখলো। তারপর ছুটে গেলো সুমনার ঘরে। পায়ে দোল দিতে দিতে ঢুলছে চাচি। সে গিয়ে বলল,
–“চাচি আমি ওরে নিয়া খেলি, আফনে ঘুমান।”
সুমনা জড়ানো চোখে বলল,
–“ঠিক আছে, ভালোকরে দেখে রাখিস কিন্তু। ওকে নিয়ে কোন কাজে হাত দিবি না কিন্তু। অন্যকোনদিকে খেয়াল ও দিবি না। শুধু ওর সাথে খেলবি।”
–“আচ্ছা, আচ্ছা। দেন আমারে।”
মিলা শ্রবণকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে সে খাবার টেবিলের উপর থেকে প্যাকেটটা নিয়ে নিঃশব্দে সদর দরজা খুলে বের হলো। বের হতেই তার পায়ের গতি বেড়ে গেলো। সে ছুটে গিয়ে লিফটে ঢুকলো। নামলো একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়ে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে গ্যারেজের সাথে একটা ইউনিট রয়েছে। যেটা ভাড়া দেয়া। সেটার ভাড়া খুবই অল্প। ড্রাইভার চাচা থাকে সেখানে। সে সোজা গিয়ে তাদের ঘরের বেল বাজায়। সালমা ঘুমু ঘুমু চোখে দরজা খুললো। মিলাকে দেখে সৌজন্য হেসে শুধায়,
–“আরে মিলা, তুমি এই সময়?”
মিলা চঞ্চলতার সাথে হাতের ব্যাগটা সালমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। চটপটে কণ্ঠে বলল,
–“চাচি আফনাদের জন্য কিছু খাবার পাঠাইছে। কতোদিন হলো আফনাগো বাসায় কিছু পাঠায়নাই। এই নেন।”
সালমার চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেলো। চোখ চকচক করে উঠেছে। খুশিতে আটখানা হয়ে সে এক গাল হেসে বলল,
–“আরে এগুলো পাঠানো কেনো লাগবে। রোজ রোজ কি মানুষ এসব পাঠায় নাকি! আইসো ভিতরে আসবা না?”
সালমা ব্যাগটা নিয়ে তারপর বলল। মিলা মনে মনে কয়েকটা কটুক্তি করলো। মহিলা বড্ডো লোভী। সে আগে থেকেই জানে। তাদের ঘরে গিয়ে শুধু বলবে,
–“ভাবিজান আপনার হাতের রান্না কি সুস্বাদু!”
আর চাচি ভোলাভালা মানুষ খুশিতে সব দিয়ে দেয়। সে কৃত্রিম হেসে বলল,
–“হুঁ, একটু বসতেই আসছি। বাবু কাঁদতে ছিল। ওরে নিয়া একটু হাঁটতে বাইর হইছি। ইরা আফায় আছে? তার সাথে একটু গল্প করি। ইরামকে দেখলে শ্রবণ খুশি হইয়া যাইবো।”
মহাজনরে খুব মান্য করে চলে মোর্শেদ
সেই দরুন সেও মেনে চলে। সে বলল,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ যাও। ভেতরেই আছে। মিমির ঘরে।”
মিলা হাসিমুখে দ্রুত ইরার কাছে গেলো। অফিসে বসা শাহেদ চৌধুরী সিসি ক্যামেরায় দেখলো মিলির কর্মকাণ্ড। তার কাছে মোটেও ভালো ঠেকলো না। মিলি ঘর থেকে ব্যাগে কি নিলো? আর শ্রবণকে সুমনা ওর হাতে ছেঁড়ে দিলো কি করে? সন্তান নাতি নিয়ে তার বড্ডো চিন্তা। দিনকাল ভালো নয়। সে তাড়াতাড়ি সুমনাকে ফোন লাগায়। সুমনা ঘুমঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করলে ভেসে আসে স্বামীর ধমক।
–“দাদুভাইকে মিলার কাছে একা ছেড়ে দিয়ে তুমি কি করছো সুমনা? মিলা কোথায় একটু দেখো তো!”
সুমনার ঘুম ছুটে গেলো। বলল,
–“মিলা তো দাদুভাইকে নিয়ে বসার ঘরে খেলছে।”
–“তোমার বুদ্ধিসুদ্ধি দিন দিন কমে যাচ্ছে সুমনা। মিলা ঘরে নেই। শ্রবণকে নিয়ে সে মোর্শেদদের বাসায় কি করছে? দেখো গিয়ে! এর জন্য বলি আমি ঘরের সিকিউরিটি আরেকটু বাড়াতে।”, শাহেদ চৌধুরীর ক্ষিপ্ত কণ্ঠে সুমনা চিন্তিত হয়ে পড়লো। সে দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হতে হতে বিড়বিড় করে,
–“মিলারে তুই আবার কি ঝামেলা পাকাচ্ছিস? আমার দাদুভাই! ধুর! কি জন্য ওর কাছে একা ছাড়লাম।”
সুমনা ছুটে বের হয় সদর দরজা আঁটকে। মোর্শেদদের ঘরে গিয়ে দরজা নক করতেই, সালমা দরজা খুললো।খুলেই একগাল হাসলো। বলল,
–“ভাবিজান, আপনি এই দুপুর বেলা এতোকিছু কেনো পাঠালেন বলেন? গরুর মাংস দিয়েছেন আবার ইলিশ মাছ কেনো দিতে হবে? আপনাদের যদি কম পড়ে? আপনার মতো অমায়িক লোক আমি খুব কমই দেখেছি। নিজে না খেয়ে অন্যের জন্য ভাবেন। আসুন ,ভেতরে আসুন।”
সুমনাকে অবুঝ দেখালো। অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“কি পাঠিয়েছি ভাবি? গরুর মাংস?”
সালমা হেসে বলল,
–“আপনিও পারেন ভাবিজান। কতো বড় মনের মানুষ! আসুন , আপনার নাতি ঐ ঘরে। আমার নাতনির সাথে খেলছে।”
সুমনা হতবুদ্ধি হয়ে পা বাড়ায় ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকতেই তার চিত্ত থমকায়, নাতির রুগ্ন পা দুটিকে ওড়নার আড়াল থেকে দুলতে দেখে। সে পা দুলাচ্ছে আর মনের সুখে দুধ খাচ্ছে। মুখ দিয়ে উহ, আহ্ তৃপ্তিদায়ক শব্দ করছে। আর এক হাত দিয়ে মায়াবী দেখতে একটা মেয়ের জামার গলা আঁকড়ে ধরে আছে।
সুমনা টলমলে চাহনিতে তাকায় কাঁচুমাচু করতে থাকা মিলার দিকে। ইরা চোখ তুলে তাকায়। অপরিচিত কাউকে দেখে অস্ফুট স্বরে মাথা নাড়িয়ে কিছু বলল,
সুমনা বুঝতে পারলো তাকে সালাম দিয়েছে। সে মৃদু হেসে বলল,
–“ওয়ালাইকুমুস সালাম, আম্মা। তুমি কি ইরা? তোমার কথা শুনেছি।”
–“সে কতা কইতে পারে না, কিছু শোনেও না চাচি।”, মিলা চঞ্চল কণ্ঠে বলল। সুমনা স্নেহভরা চাহনিতে তাকায়। তাকাতেই চোখ পড়ে বিছানায় বালিশের সাথে ঠেস দিয়ে বসে থাকা একটা পুতুলের দিকে। শ্রেয়ান ঠিক বলেছিল, আস্ত এক জীবন্ত পুতুল। সে কি অনবদ্য সৌন্দর্যের অধিকারী বাচ্চাটি! সে ইরাকে ইশারায় বলল,
–“একটু কোলে নেই?”
ইরা দ্রুত মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
–“এহ্! এহ্!”
মানে নাও। সুমনা দ্রুত কোলে তুললো ইরামকে। স্বাস্থ্যবান মেয়েটাকে বুকে জড়াতেই বুকটা একদম ভরে গেলো। চোখ দুটো আরো ছলছল করে উঠলো। তার নাতিটাকেও আল্লাহ এমন বানাতো যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে মায়ের দুধ পেতো! সে আদর করলো ইরামকে। খুশিমনে জিজ্ঞাসা করে,
–“ওর বাবা কি করে?”
ইরা তাকিয়ে রইল। বুঝতে পেরে মলিন হেসে হাত জাগিয়ে দেখায় বড় চাকরি করে। সুমনা আবার জিজ্ঞেস করে,
–“তোমার শশুর বাড়ি কোথায়?”
সেই জবাবটা ইরার দিতে হয় না। ঘরে সদ্য ঢোকা সালমা বলতে লাগলো,
–“আর শশুর বাড়ি। শশুর বাড়ি আর আছে নাকি। ও তো ডিভোর্সী। চট্টগ্রামে বিয়ে হইছিলো ভাবিজান। জামাইটা খুব ভালো ছিল। কি সংসার কইরা খাইতে পারলো না। যোগ্যতা থাকা লাগে। জীবনে কোন জায়গায় শান্তি করতে পারে নাই। যেখানে গেছে সেখানেই ঝামেলা হইছে। জন্মের পর মা মরছে, খালার বাড়ি থাইকা বিয়ে হইছে। স্বামী রাতের অন্ধকারে তালাকের পেপার ধরাইরা দিয়া, মেয়ে সহ বাসে উঠাইয়া দেছে। আর সেই জামাই এহন কি সুন্দর বউ পাইছে। কোন ঝামেলা নাই সেই সংসারে। খালার বাড়ি এতোদিন ছিল। সেই জায়গায় ও ঠাই হয়নাই। খালাতো ভাইয়ের বউরা রাখতেই চায় না। তাহলে বোঝেন কি জিনিস। অল্প দুঃখে তো আর আমি এগুলা কইনা। আমার ঘরে যেদিন পা দিছিলো সেইদিন ই আমার শখের একটা কাঁচের বাটি ভাঙছে, আমার কোমড়ের ব্যথা বাড়ছে, আমার ছোট ছেলেটা পরীক্ষায় খারাপ করছে। ঘরের অবস্থা দেখেন, কি করছে! কিছু বলিনা কেনো! ঐ কিছু বললেই মানুষ আমায় বলবে আমি সৎ মা। এর জন্য আমি টু শব্দটি করি না।”
সুমনার চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো সালমার কথায়। সে নাকি কিছু বলেনা। ইরা এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল মায়ের ঠোঁটের দিকে কিছু তীক্ত কথা বুঝতে পেরেই চোখ সরিয়ে নেয়। উঁচু শির নত হয়ে গেলো অনতিবিলম্বে।
–“আপনি ঐ চেয়ারে বসেন ভাবিজান। আমি একটু চা বানিয়ে আনি আপনার জন্য।”
সালমা চলে যাওয়ার জন্য উদ্বত হলেই তার চোখ যায় ইরার দিকে। ওড়নার নিচে শ্রবণকে দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কতোবড় অসোভ্য মেয়ে! নিজের মেয়ের হক অন্যের বাচ্চাকে দিচ্ছে। সে কিছু বলতে পারলো না তৎক্ষণাৎ। চলে যায়। সালমা যেতেই সুমনা এগিয়ে আসে ইরার কাছে। থুতনি ধরে মাথাটা জাগিয়ে দেয়। মৃদু হেসে ইশারায় বলে মাথা নত না করতে। ইরা মলিন হাসলো। সুমনা তাকায় চুপটি করে বুকে লেগে থাকা বাচ্চাটির দিকে। একদম লেগে বসে আছে। এতো সুন্দর বাচ্চাটির কপালে এতো দুঃখ! আল্লাহ কি করে দেখছে এগুলো? হাহাকার জুড়লো সুমনার বুক জুড়ে।
সুমনার আর একটুও বসতে ইচ্ছা করলো না ওখানে। কিন্তু ঐ বাচ্চাটা রেখে আসতেও ইচ্ছে করছে না। তারপর আবার তার নাতি। সে রীতিমতো আনন্দের গান গাইছে আর দুধ খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আবার ওড়নার আড়াল থেকে মুখ বের করে সকলের দিক টুকটুক করে তাকাচ্ছে। সুমনা তখন আনন্দে হেসে ফেললো। নাতির মাঝে সতেজতা দেখে। ছেলেটাকে আজ পর্যন্ত সে দুষ্টুমি করতে দেখেনি যে! কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো, এক ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে প্রায়, শ্রবণ দুধ ছাড়বে না। ছাড়ালেই হেঁচকি তুলে কাঁদছে। অন্যদিকে ইরা’র ও ইচ্ছে করলো না ছাড়াতে। বাচ্চাটির যে দুধের বড্ডো তৃষ্ণা! সে ইশারায় বলল,
–“আরেকটু থাক।”
সুমনা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায় ইরা আর মিলার দিকে। ছোট্ট মেয়েটির মাঝে যে এতো উদারতা আর এতো বুদ্ধি কে জানতো! তার বুড়ো স্বামীর আজ খবর আছে!
ছোট্ট শ্রবণ দুধ খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়লো। সুমনা নাতির ফুলে টেবু হয়ে থাকা পেটের দিকে তাকিয়ে বুক ভরা নিঃশ্বাস নিলো। ইরা’র দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আল্লাহ তোমায় আরো ভরপুর দিক মা। পৃথিবীর সব সুখ তোমার হোক।”
ইরা ইরামকে নেয়ার জন্য হাত পাতলো। সুমনার মোটেও ইচ্ছে করলো না পুতুলটিকে হাতছাড়া করতে
তবে সে নিরূপায়। ইরামকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–“ওকে নিয়ে উপড়ে যেও মা। আমি তো ওর জন্য কিচ্ছুটি আনলাম না।”
ইরা বুঝতে পেরে মাথা দোলায়। কোন এক সময় যাবে।
সুমনা আর মিলা শ্রবণকে নিয়ে চলে যায়। সুমনা বাড়িতে এসেই নিজের ঘরে গিয়ে ফোন লাগায় স্বামীকে। ফোন দিয়েই দিলো এক ঝারি।
–“শোন শ্রেয়ানের বাবা! তোমার ঐ সন্দেহ বাতিক মনকে তুমি সামাল দাও। নয়তো তোমার সাথে আমার কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে।”
শাহেদ চৌধুরী থতমত খাওয়া কণ্ঠে বলল,
–“কি হয়েছে সুমনা?”
–“কি হয়নি বলো। অমন একটা লক্ষ্মী মেয়ের ওপর তুমি সন্দেহ কি করে করতে পারো?”
সুমনা সব খুলে বলল। শাহেদ চৌধুরী মিইয়ে গিয়ে বলল,
–“আমার তো চিন্তা হয় তোমাদের জন্য। দিনকালের যা পরিস্থিতি!”
–“রাখো তোমার দিনকাল! আজ তিন বছর যাবৎ মিলা এখানে করছে কখনো আমি অভিযোগ করতে পারিনি। আর তুমি শুধু ওর ওপর সন্দেহ করো।”
–“পেপারে রোজ রোজ কতো নিউজ ছাপা হয় তুমি দেখোনা? আমার মনে তো তাই সর্বদা কুচিন্তা এঁটে থাকে।”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ সব দোষ ঐ পেপারের ই। এরপর যদি তোমায় আমি পেপার পড়তে দেখেছি তো তোমায় আমি দেখে নেবো। তোমার সাথে যদি আমার পথ ভিন্ন হয় তবে এই পেপারের কারণেই হবে। বিয়ের প্রথম প্রথম তুমি এই পেপার পড়েই আমার উপর সন্দেহ করতে!”, সুমনা রাগ ঝেড়ে বলল। শাহেদ চৌধুরী বিরক্ত হয়ে বলল,
–“আহ্ সুমনা বাদ দাও। দুঃখিত বলেছি তো আমি।”
–“এই দুঃখিত শব্দটার কারণেই আমি তোমার নাতির দাদি বুঝেছো? নয়তো তোমার মতো সন্দেহ বাতিক মানুষের সাথে আমার ঘর করা হতো না।”
বলেই সুমনা ফোন কেটে দিলো। মিলাকে গিয়ে মন ভরে দোয়া করে দিলো।
শ্রেয়ান আসলো মাগরিবের আজানের আগেই। ছেলে তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে নামাজ পড়ে ছেলের পাশে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। কাত ফিরে তাকায় ছেলের ঘুমন্ত মুখপানে। একটা পরিচিত আদল ভেসে উঠলো ছেলের মুখে। যেই আদলে সে কখনো প্রাণ হারাতো আজ সেই আদলে বিতৃষ্ণা কাজ করে। যন্ত্রণা অনুভব হয় তার ছেলেটা এমন কারোর অংশ— যে কিনা নিজের সুখের জন্য তার সন্তানের ভাগ্য থেকে মায়ের দুধটুকু ছিনিয়ে নিয়েছে। ছেলের পেটের উপর হাত রাখলে কিছুটা অবাক হয় শ্রেয়ান একদম টসটসে হয়ে আছে। এতো পেট ভরে খাওয়া’য়নি সে। মা কি আবার খাইয়েছে? তার মিনিট পাঁচেক পরেই শ্রবণের ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলেই সে ফোকলা হাসলো। আ, উ শব্দ করে হাসিমুখে নড়াচড়া করতে লাগলো। শ্রেয়ান আশ্চর্য হয় ছেলের মাঝে চঞ্চলতা আর সতেজতা দেখে। সে স্নেহের হাসি নিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। আদুরে গলায় শুধায়,
–“আমার আব্বু এতো খুশি কেনো? সে দেখছি কথা ও বলে, হাত পা ধরে খেলা করে? দাদু পেট ভরে খাইয়েছে তোমায়? তুমি অনেক শক্তি পাচ্ছো গায়ে?”
ছোট্ট শ্রবণ বাবার কথার প্রেক্ষিতে আরো আ উ শব্দ করতে লাগলো। শ্রেয়ানের খুশি দেখে কে! সে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে মাকে হাক ছেড়ে ডাকতে ডাকতে বের হয়।
–“মামনি? মামনি, দেখো তোমার নাতি কতো দুষ্টু করে। সে খেলছে আমার কথার উত্তর দিচ্ছে আ উ করে।”
সুমনা সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছিলো, ছেলের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে সে ছলছলে নয়নে তাকায় বলে,
–“এর জন্য মিলাকে গিয়ে একটা ধন্যবাদ দে। আর ওর জন্য কাল গিয়ে লাল টুকটুকে দেখে একটা জামা আনিস। কি যেনো ও বলে—আনারকলি? ওগুলো!”
–“কেনো, মিলা কি করেছে?”, শ্রেয়ান রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুধায়।
সুমনা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
–“ওর জন্য তোর ছেলের ভাগ্যে আজ আবারো সুস্বাদু সেই খাবার জুটেছে। তোর ছেলে তৃষ্ণা মিটিয়ে খেয়ে এসেছে। তারপর আরামে ঘুমিয়েছে।”
শ্রেয়ান অপলক তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। অবর্ণনীয় আনন্দ লুকিয়ে শুধায়,
–“আজো দুধ খেয়েছে মামনি?”
সুমনা মাথা নেড়ে সায় জানায়। শ্রেয়ান তাকায় ছেলের সতেজ মুখটির দিকে। আল্লাহ’র রহমত আজ আবারো তার ছেলেটার ভাগ্যে জুটেছে?
চলবে…