যে শ্রাবণে প্রেম আসে পর্ব-০৪

0
255

যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
||০৪||

সন্তানের খিদে মেটা, এটা আরেক স্বস্তিদায়ক দৃশ্য একজন বাবার জন্য। কিন্তু কারোর স্বস্তি বিনষ্ট করে নিজের সন্তানের স্বস্তি নিশ্চিত করা তো অন্যায়! শ্রেয়ান এর আনন্দরা ফিকে পড়লো। সে দু্ঃসহ এক ঢোক গিললো। কতো সুন্দর হতো যদি তার সন্তানটির সুখ সর্বদা অটল থাকতো! সে মাকে বলল,
–“মামনি, মিলা ছোট! ও শুধু শ্রবণের কষ্ট দেখে এমন কাজ করেছে। কিন্তু এরপর থেকে আর কখনো ওকে প্রশ্রয় দেবে না এই কাজ করতে। ইরামের বাবা আর পরিবার এটা নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না। আমাদের জন্য কারোর পরিবারের ঝামেলা হোক এটা আমি কদাপি মেনে নিতে পারবো না, মামনি!”

–“কিসের পরিবার? কিসের বাবা? ইরামের বাবা আছে নাকি? মা-মেয়ে কতো কষ্টে জীবনযাপন করছে তুই জানিস?”,সুমনা কপাল কুঁচকে বলল। শ্রেয়ান অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“মানে?”

–“ইরা ডিভোর্সি! তার স্বামী, ঐ পরীর মতো মেয়েটাকে সহ একদিন রাতে তালাকের পেপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এক বাচ্চা হওয়ার পর তার মনে হয়েছে বোবা, বধির এই মেয়ের সাথে সংসার হবে না। সে আরো ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। স্বামী নাকি বড়ো চাকরি করে। নতুন স্ত্রী নিয়ে সুখে সংসার করছে সে। মা নেই ইরা’র, এতোদিন খালা বাড়িতে থাকতো। সেখানেও কেউ রাখতে চায় না। তারপর এখানে এসে উঠেছে। সে তোর মোর্শেদ চাচার বউকে তো চিনিস না! আস্ত এক জল্লাদ, লোভী মহিলা! অতোটুকু সাত মাসের বাচ্চা মেয়েটা নাকি তার সব ঘর এলোমেলো করে, ভাঙচুর করে। তারা তার ঘরের সবকিছু খেয়ে ফেলে, তার ছেলে মেয়ের পড়াশুনা হচ্ছে না, ঘরের যতো সমস্যা সব ইরা আর ইরার মেয়ের। যতক্ষণ ছিলাম শুধু ইরা আর ইরার মেয়ের দোষ। অথচ মেয়েটা বোবা, বধির সাথে ঐ মাস কয়েকের বাচ্চা। কতো নিচু মনের মহিলা!”

সুমনার কণ্ঠে ভরপুর তেজ, দিদৃক্ষা! অবাক পানে তাকিয়ে থাকা শ্রেয়ানের চোখেমুখে বিরক্তির প্রলেপ পড়লো।
–“আহ্ মামনি! কে কি করলো তা দিয়ে আমাদের কি? তুমি তাদের নিয়ে বাজে কথা কেনো বলছো?”

–“বাজে কথা না, এগুলো তাদের আসল পরিচয়! তবে আমি বলবো না কেনো? আগে চুপ থাকতাম বলেই সবাই পার পেয়ে গিয়েছিল! কিন্তু এখন আর আমি চুপ থাকবো না। ভালোমানুষীর দিন শেষ! ভালোমানুষী দেখিয়ে দেখিয়েই আজ আমার নাতিটার এই অবস্থা!”

শ্রেয়ান হতাশ হয়। নিরুদ্বেগ শান্ত স্বরে বলে,
–“কোত্থেকে কোথায় চলে গেলে তুমি?”

সুমনা টলমলে চোখে তাকিয়ে কণ্ঠে ক্ষোভ নিয়ে বলে,
–“যাবো না তো কি করবো? কোথায় কি কমতি ছিল? তার সাথে আজ পর্যন্ত কেউ একটা উঁচু স্বরে কথা বলেনি, তুই মাথায় তুলে রাখতি, আমি মাথায় তুলে রাখতাম কিন্তু এতোকিছুর পরেও দিনশেষে কেনো আমার দাদুভাইটাকে পুষ্টিহীনতার কারণে হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয়েছে? একটা নারীর আর কি প্রয়োজন? আল্লাহ তো তাকে সব ভরপুর দিয়েছিল! আর ওদিকে ঐ বোবা মেয়েটিকে দেখ! ওর মাতৃত্ব কতোটা দৃঢ়! বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে দাঁত কামড়ি দিয়ে সকলের অবজ্ঞা সহ্য করে থাকছে। কেনো? শুধুমাত্র ঐ বাচ্চাটার জন্য! সেও মা আর তোর…”

শ্রেয়ান নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। অসহনীয় অস্থিরতা নিয়ে বলে,
–“অনেক হয়েছে মামনি! কথায় কথায় এগুলো টানা কি খুব জরুরী? যে যেভাবে সুখে থাকতে পারে। আমি তাকে সুখে রাখতে পারিনি। যার ফলস্বরূপ আজ আমি আর আমার ছেলে একা। আমাদের ও এভাবেই সুখ খুঁজে নিতে হবে। কেনো পেছনের কথা টেনে দুঃখ বাড়াও?”
সুমনা আর কথা বাড়ালো না। টলমলে চোখে রান্নায় মনোযোগ দেয়। শ্রেয়ান উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো। জীবনের এই বিদঘুটে টানাহেঁচড়ায় মা ইদানিং বড্ডো বিক্ষিপ্ত মেজাজের হয়ে গিয়েছে। সে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। অন্তঃকরণে নম্রতার অনুভব হয়, চোখের সামনে ভেসে ওঠে অসম্ভব সুন্দর একটি গম্ভীর মুখ আর অস্ফুট কিছু শব্দ। বেদনায় অন্তঃস্থল কেমন শক্ত হয়ে আসে। অমন সুন্দর মেয়েটাকে রেখে তার বাবা জৈবিক সুখ খোঁজে কি করে? ওর মুখটি দেখলেই তো মনে হয় পুরো পৃথিবী জিতে যাওয়া এক শক্তিশালী বাবা সে! ছেলেকে আঁকড়ে ধরা হাতটি আরো দৃঢ় হয়ে আসে ঘৃণ্য এক পিতৃত্বের বর্ণনায়। সে ছেলেকে বুকে চেপে মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে,
–“পাপা সবসময় তোমার ঢাল হয়ে থাকবো আব্বু। আমাদের কাউকে লাগবে না। আমরা আমাদের মতো ভালো থাকবো।”
হাসিমুখে বলতে বলতেই শ্রেয়ান নিজের ঘরে ঢুকলো। কাবার্ড থেকে ছেলের একটা টিশার্ট আর প্যান্ট বের করে পড়ালো। বাইরে হাঁটতে যাবে। বাইরে গেলে ছেলে খানিক আনন্দ পায়!

ছেলেকে নিয়ে শ্রেয়ান তৈরি হয়ে বের হতেই মিলার সাথে দেখা হলো। শ্রেয়ান স্মিত হেসে তাকে ডাকলো।
–“মিলা এদিক আয়।”

মিলা হেলতে দুলতে আসে। আজকের কর্মের জন্য তার
মাঝে কোনোরূপ ভয় দেখাগেলো না। শ্রেয়ান তার মাথায় হাত রেখে স্নেহের কণ্ঠে বলে,
–“এতো ভালোবাসিস শ্রবণকে?”

মিলা কপাল কুঁচকে বলে,
–“তো? ভালোবাসুম না?”

শ্রেয়ান হাসলো। বলল,
–“বাসবি, কিন্তু তাই বলে এমন কাজ আর করবি না। তারা বিরক্ত হবে। আর এটা ঠিক না। এখন যা রেডি হয়ে আয়।”

–“ক্যান, কোতায় যাইবো?”, মিলা কপাল কুঁচকে শুধায়। শ্রেয়ান হাঁটতে হাঁটতে বলে,
–“তোর আনারকলি কিনতে!”

মিলার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। সে চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়,
–“লাল টুকটুকে?”

–“যে টুকটুকে তুই চাস!”, শ্রেয়ান হেসে বলল।

–“আমি আইতাছি ভাইজান!”, মিলা চিৎকার করে এক ছুট লাগায় নিজের ঘরে। শ্রেয়ান হো হো করে হেসে উঠলো তার দৌড় দেখে।

দিনগুলো এভাবেই কাটতে লাগলো। কেটে যায় আরো কয়েকটা দিন। মাতৃদুগ্ধের কথা ভুলে যাওয়া শ্রবণের জীবনে হঠাৎ করেই দমকা হাওয়ার মতো আঁছড়ে পড়া মাতৃদুগ্ধের ছোঁয়ায় শ্রবণ নামক অবুঝ শিশুটি কাতর হয়ে পড়েছে। সে কোনক্রমেই কৃত্রিম দুধের সংস্পর্শে এসে ভুলতে চায় না মাতৃদুগ্ধের অতুলনীয় সেই স্বাদ এবং মায়ের মতো নরম সেই দেহ জড়িয়ে ধরে দুধ খাওয়ার আরাম। মায়ের কোলে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে দুধ খাওয়ার থেকে আরামদায়ক কোন কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে? নেই তো! মায়ের দেহের সেই মিষ্টি সুবাস সাথে অমৃতের নেয় সেই সুস্বাদু দুধ অতুলনীয়।

ছোটবেলায় ইরা বই’তে পড়েছিল পাখিরা‌ কিচিরমিচির ডাকে। বসন্তে নাকি কোকিল কুহু কুহু ডাকে। কাক নাকি কা কা ডাকে, কবুতর বাক বাকুম ডাকে। বই’তে আরো পড়েছিল বর্ষাকালে নাকি আকাশে মেঘ গুড়ুম গুড়ুম করে; বজ্রপাত পড়ে, বৃষ্টি ঝপঝপিয়ে পড়ে তো কখনো ঝিরিঝিরি শব্দ করে! জন্মগতভাবে বাক প্রতিবন্ধী, বধির ইরা আজ পর্যন্ত কখনো পাখির ডাক শোনেনি; তার খুব ইচ্ছে হয় পাখির ডাক শুনতে, ঝড়ের দিনে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে, পানির কলকল শব্দ শুনতে, পৃথিবীর নিজস্ব আর্তনাদ সহ উল্লাসের আওয়াজ শুনতে, দৈনন্দিন কর্মজীবনের সবকিছুর আওয়াজ শুনতে। খুব ইচ্ছে হয় ইরামের মুখে মা ডাক শুনতে। কিন্তু এই ইচ্ছা গুলো ইরা সবসময় জ্বরের ঘোরেই করে। কারণ যতক্ষন সে ঘোরের মাঝে থাকে ততক্ষণ সে নিজেকে আর পাঁচটা মেয়ের মতো ভাগ্যবতী, পরিপূর্ণ মনে করে। ঘোর ব্যতীত কল্পনাতেও সে এই ইচ্ছা গুলো পোষন করে না। কারণ সে তো জানে সৃষ্টিকর্তা তাকে অপূর্ণ, অবলা হিসেবে পাঠিয়েছে। তার জন্য এগুলো নিষিদ্ধ!

আজো ইরার জ্বর এসেছে। তাই তো সে এতো এতো রঙিন স্বপ্ন দেখছে। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত মিমি সহ ঘরের সোফা, পর্দা, বিছানার চাদর এগুলো ধোঁয়া ফালা করেছে। আজ সপ্তাহের রবিবার। মঙ্গলবার মিমিকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, এটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার করণ!
চুলায় ডাল বসানো। রান্নাঘর থেকে ব্যস্ত শহর দেখতে দেখতে ইরা‌ রঙিন স্বপ্নগুলো দেখছিল। ডাল হয়ে গেলে সে ডালটা চুলোর উপর থেকে নামাতে যায়। অন্যদিকে পেছন থেকে ধেয়ে আসা তীক্ত কথাগুলো থেকে সে অজ্ঞই রয়ে গেলো। বধির ইরা বুঝতে পারলো না পেছন থেকে ধেয়ে আসা বিপদের পূর্বাভাস।

–“আরে এই মুখ পুরী দেখ তোর মেয়ে কি করেছে?”

ধেয়ে আসা এক নারী হাতে আরেক নারীর জন্য এতো ক্রুরতা? পৃথিবী এমন বৈচিত্র্যময় কেনো? কর্মরত বধির ইরার কাঁধ ধরে কেউ ক্ষিপ্র বেগে ধাক্কা মারতেই ফুটন্ত ডাল গুলো সব ঝলসে গেলো ইরার হাত সহ দুই পা এবং পেটের কিছু অংশ। কণ্ঠনালী তো সৃষ্টিকর্তা আগেই বন্ধ করে দিয়েছে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকা ইরা যন্ত্রনায় ব্যথাতুর আওয়াজ পর্যন্ত করতে পারলো না। হাত পা ছিটিয়ে ছিটিয়ে শুধু অস্ফুট স্বরে এহ্ এহ্ শব্দ করছে। লালচে চোখ বেয়ে ব্যথারা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল। হ্যাংলা পাতলা মেয়েটির শ্বাসরোধ হয়ে আসলো অসহনীয় সেই জ্বলনের কারণে। সম্মুখের মা রূপি মহিলার দিকে একটু সহানুভূতির আশায় তাকায় কিন্তু সেখানেও তাকে আশাহত হয়। সালমা চেঁচিয়ে উঠলো রান্নাঘরের সেই বেগতিক অবস্থা দেখে।

–“আরে এই মিমি দেখে যা মুখপুরী কি করেছে? নিজেও পুড়েছে আমার রান্নাঘরের সব শেষ করেছে। আর একটা ফাজিলের বাচ্চা আমার তোশকটা প্রসাব করে ভিজিয়ে দিয়েছে। আমার সংসারের সব জিনিস নষ্ট করতে এসেছে এই রাক্ষুসী দুই মা মেয়ে। এরপরেও তোর বাপ আহ্লাদ দেখাবে? আসুক আজ! ওদের ঘর থেকে না বের করলে আমি এই ঘর থেকে বেরিয়েই যাব।”

ব্যাথায় নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকা ইরা নিজের পা টা নাড়াতে গেলেও মরন যন্ত্রনা অনুভব হলো। সে আবার পড়ে রইলো সেই গরম ডাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঝেতেই। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসছে একদম অনিচ্ছাকৃত। কারণ এই ব্যথাদের উপর ইরার নিয়ন্ত্রণ থাকলে সে এতটুকু ও প্রকাশ পেতে দিতো না। কিন্তু আফসোস ইরা হেরে যাচ্ছে শরীরের জ্বলনের কাছে। হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত খিটিমিটি দিয়ে ইরা সহ্য করার চেষ্টা করে সেই জ্বলন। একটাসময় দুঃখতে দুঃখতে ইরা’র ব্যথারা হার মানলো তার নিষ্ঠুর জীবনের কাছে। এই জীবনে ইরার ব্যথাদের কেউ সহানুভূতি দেখাবে না। তাই তো ব্যথারা নিজেরাই নিজেদের মাত্রা কমিয়ে নিলো। শরীরের একটু জ্বলন কমতেই ইরা’র আড়িয়ে যাওয়া চোখগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। দুই মিনিট বদ্ধ নেত্রে ইরা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। সময় নিয়ে উঠে দাঁড়ালে জ্বলন্ত জায়গাগুলোতে সুতোর স্পর্শে মেয়েটির কণ্ঠ থেকে আপনাআপনি অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে। চোখ তখন উন্মুক্ত। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ধীরপায়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়। বসার ঘরে বসে চিৎকার চেঁচামেচি করা সালমা তাকে দেখতেই চেঁচিয়ে উঠলো,
–“দেখ দেখ সব ঘর মাখছে। এই মুখপুরী তুই থাকতি ওখানে পড়ে! বের হলি কেনো?” পরিষ্কার করে বের হয়েছিস? ডাল ছাড়া তোর বাপ ভাত খেতে পারে না, সে একটু পরে ই খেতে আসবে। কি দিয়ে ভাত দেবো? তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাল রান্না কর।”

ইরা দূর্বল আঁখি তুলে তাকায় সালমার দিকে। যে কি-না মুখ নেড়ে লাগাতার কিছু বলে যাচ্ছে। কিছু শুনতে না পাওয়ায় ইরা ব্যথাতুর হাসলো! টাইলসের উপর বসে থাকা মেয়েকে এক পলক দেখে সে সোজা বাথরুমে চলে গেলো। ঝরনার নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই জ্বলন্ত শরীর যেনো একটু স্বস্তি পেলো। ইরা বুক ভরা শ্বাস নেয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। কিয়ৎকাল বাদ ই বাথরুমের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো অস্ফুট আর্তনাদে ভরা কান্নায়। দশ মিনিটের বেশি জ্বলন্ত শরীরকে স্বস্তি দিতে পারলো না ইরা। মেয়ে একা মেঝেতে বসা। সে পুরোপুরি বসতে পারলেও হঠাৎ হঠাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যায়। বাথরুম থেকে বের হতেই দেখলো দুই হাতের লাল চামড়া কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। পায়ে একটু কম পুড়েছে। কিন্তু যেটুকু পুড়েছে সেটুকুতে এখন ফোস্কা পড়ে গিয়ে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছে। মেয়ের কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই সালমা আর মিমি বিশালাকৃতির এক তোশক এনে দুম করে রাখলো সদর দরজা বরাবর। ইরাকে ইশারা করে সালমা বলল,
–“এই বেজন্মা কোথাকার! নাটক শেষ হলে এটা গিয়ে সোজা ছাদে দিয়ে আয়। তোর মেয়ে প্রসাব করে মাখিয়ে দিয়েছে। আমার এই দামী তোশক থেকে যদি একটু গন্ধ আসে না তুই বানিয়ে দিবি। খর আজকের মধ্যে ঘর থেকে বের হবি তোর ঐ মেয়েকে নিয়ে। ওর কান্নার কারণে মিমির কালকের পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, ছেলেটার মাথা তো আগেই খেয়েছিস। সারাক্ষণ এদের পেছনে পড়ে থাকে।”

–“কি হলো বুঝতে পারছিস না? এটা এই তোশক গিয়ে ছাদে দিয়ে আয়।”, সালমা ইরাকে ভালোকরে ইশারায় বোঝাতে লাগলো। দরজায় সদ্য দাঁড়ানো সুস্মিতা আর শ্রেয়ান থমকায় অশ্রাব্য গালি সহ তীক্ত কথা শুনে। সুস্মিতা সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিয়ে ভাইয়ের কনুইয়ে নাড়া দিয়ে বলল,
–“কি কাজ আছে ভাইয়া? তাড়াতাড়ি করো। আমি উপড়ে যাবো।”

শ্রেয়ান ধ্যানচ্যূত হয়। দৃষ্টি সরায় মেঝেতে বসা ইরা আর ইরামের থেকে। চোয়াল শক্ত করে নত মস্তকে গলা খাঁকারি দিলো। সালমা আর মিমি চমকে দরজার দিকে তাকায়। শ্রেয়ান থমথমে মুখে হাতের খামটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“চাচা কোথায় চাচি? এই খামটা তাকে দিন আর বলুন পাপা তাকে এখনি এটা নিয়ে অফিসে যেতে বলেছে।”

সালমা অপ্রস্তুত সৌজন্য হেসে বলল,
–“তোমার চাচা তো বাড়িতে নেই বাবা, বাজারে গিয়েছে। তুমি আমায় দাও। সে আসলেই আমি দ্রুত পাঠিয়ে দেবো।”

–“হুঁ।”, ছোট্ট একটা জবাব দিলো শ্রেয়ান। মেঝেতে বসা কেমন অদ্ভুত আচরণ করা ইরার দিকে এক পলক দৃষ্টি ফেলে সে বোনের হাত ধরে চলে যায়। শ্রেয়ান চলে যেতেই সালমা ইরার মাথায় একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,
–“ওটা ছাদে দিয়ে আয় শিগগিরি, প্রসাব শুকিয়ে গন্ধ হয়ে গেলে তোর খবর আছে।”

ইরা মেয়ের পেছনে একটা কুশন রেখে দূর্বল পায়ে উঠে দাঁড়ায়।
লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সুস্মিতা আর‌ শ্রেয়ান। সুস্মিতা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অসন্তোষের সাথে বলে,
–“এসব কি ভাইয়া? কি ধরণের ভাষা ব্যবহার করে চাচি? পাপাকে বলো এদের এখানে না রাখতে। পরে আমাদের মানসম্মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এমন মানুষ বিল্ডিং এ রাখে কেউ? ওই মেয়েটা কে, কাজের মেয়ে? ওকেই বলছিল মনে হয়েছে।”

–“সৎ মেয়ে! চাচার আগের ঘরের মেয়ে ওটা।”, ক্রোধ নিয়ন্ত্রনে ব্যস্ত শ্রেয়ান ধিমি কণ্ঠে জবাব দেয়। সুস্মিতা ঘৃণায় নাক সিঁটকায়, বলে,
–“কি খারাপ আচরণ করে! খারাপ মহিলা।”

ততক্ষণে লিফট খুলে গেলো। সুস্মিতা আর শ্রেয়ান লিফটে উঠে তিন নাম্বার বাটন প্রেস করলো। তবে দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই একটা তোশকের এক কোনা আটকালো দুই দরজায় মাঝে। দরজাটি আবার খুলে গেলে ইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কোনদিকে না তাকিয়ে তোশকটিকে টেনেহিঁচড়ে লিফটের ভেতর ঢোকাতে লাগলো। বিশাল তোশক! পোড়া হাতের নরম চামড়ায় লাগাতার ঘর্ষণে মেয়েটি বারবার থেমে থেমে শ্বাস নেয়। আবার চেষ্টা করে। শেষবারের‌ চেষ্টার অধৈর্য্যের প্রকাশ! নিজের সকল ব্যথা, অসম্ভব কে তুচ্ছ করে ইরা তোশকটি নিয়ে লিফটের ভেতর ঢুকতে সফল হয়। কিন্তু তার বিভিষীকাময় পরিণাম দেখলো সুস্মিতা আর শ্রেয়ান। দোদুল্যমান দেহটিকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো সুস্মিতা! চিন্তিত গলায় শুধায়,
–“আপনি ঠিক আছেন? এতো বড়ো একটা তোশক আপনি একা নিচ্ছেন কেনো?”

বলতে বলতেই ইরার অস্ফুট আর্তনাদ শুনতে পেলো সুস্মিতা। সে হকচকালো নিজের আঁকড়ে ধরা হাতটির দিকে তাকিয়ে। ইরার হাতটি ছেড়ে দিতেই সুস্মিতা ভাইয়া বলে আর্তনাদ করে উঠলো। শ্রেয়ানের চোখের কার্নিশ লাল হয়ে উঠলো বোনের হাতের তালুতে উঠে আসা পোড়া চামড়া দেখে। ইরা হাত আঁকড়ে ধরে নিচে বসে পড়লো। বদ্ধ নেত্রে হাঁপড়ের মতো ব্যথাতুর শব্দ করছে সে। সুস্মিতা দ্রুত হাত ঝাড়া দিয়ে বসে পড়লো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
–“আমি দুঃখিত! আমি বুঝতে পারিনি আপনার হাত পোড়া। দেখি, আমি একজন ডাক্তার। আমায় দেখতে দিন।”

বলেই সুস্মিতা ইরার দুই হাত আলতোভাবে ধরে তুললো। দু’টো হাতের ই বাজে অবস্থা। তবে ডান হাতের অবস্থা একদম কাহিল! সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
–“ভাইয়া তাকে বাসায় নিয়ে চলো। সেখানে চিকিৎসার সরঞ্জাম কিছু আছে। নাহলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”

ততক্ষণে তিন তলায় লিফট থামলো। ইরা ব্যথা সামলে উঠলো দ্রুত। সম্মুখে অপরিচিত মুখ দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। সুস্মিতা তাকে বলল,
–“ধীরে ধীরে উঠুন। আপনি আমাদের সাথে বাসায় চলুন। আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন।”

শ্রেয়ান ধিমি কণ্ঠে বোনকে জানায়,
–“সে বাক প্রতিবন্ধী আর বধির।”

বলে সে এগিয়ে আসে এক পা। ইরাকে ইশারায় বলল,
–“আপনি আমাদের সাথে বাসায় চলুন। আপনার হাতে চিকিৎসার প্রয়োজন!”

ইরা বুঝতে পারলো শ্রেয়ানের কথা। সে তৎক্ষণাৎ না বোধক মাথা নেড়ে জোরপূর্বক হাসলো। নিজের মতো করো আ উ করে কিছু বলতে লাগলো। সুস্মিতা অবুঝপানে তাকায় ভাইয়ের দিকে।
–“উনি কি বলছে ভাইয়া?”

ইরার ব্যথা ঢাকার প্রয়াসরত মুখটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা শ্রেয়ান শক্ত কণ্ঠে বলল,
–” তার কাছে ওষুধ রয়েছে। সে একটু পরে ডাক্তারের কাছেও যাবে। আমরা যেনো চিন্তা না করি।”

সুস্মিতা দ্বিরুক্ত করলো, ইরা শুনলো না সে ছয় তলার বাটনে প্রেস করে দিলো। ফলস্বরূপ সুস্মিতা আর শ্রেয়ানকে বের হতে হবে। শ্রেয়ান থমথমে মুখে বোনকে বলল,
–“তুই যা, আমি আসছি।”

সুস্মিতা নিরবে মাথা নেড়ে চলে গেলো। ইরা এক পলক শ্রেয়ানের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের হাতটিকে ওড়ানা দিয়ে ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শ্রেয়ান ঐ সময়টুকু একটা কিছু বললো না চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। লিফট খুলে যেতেই সে নিরুত্তর, নির্বিকার তোশকটি কাঁধে তুলে হাঁটা শুরু করলো। ইরা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রেয়ান সেটিকে ছাদে শুকাতে দিয়ে ইরার দিকে কোনোরূপ ভ্রুক্ষেপ না দেখিয়ে নিচে নেমে গেলো। ইরা হতবাক চোখে তার গমনের পানে তাকিয়ে থাকে।
*****
শ্রবণ উদাসীন, নির্জীব, দূর্বল দেহে পড়ে রয়েছে বাবার কোলে। তার কৌতুহলী দৃষ্টি বাবার শার্টের বোতামের দিকে। অলসহাতে বাবার শার্টের বোতাম নিয়ে খোটাখুটি করছে সে। ছেলের পাতলা চুলে হাত বুলাতে থাকা শ্রেয়ানের চেহারা ভাবুক। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে! একাধারে কোন ধূসর কিছুকে দেখে চলেছে। সুস্মিতা কফি হাতে ভাইয়ের ঘরের বারান্দায় ঢুকলো। বেতের টেবিলে কফি দুই কাপ রেখে ভাইয়ের পাশে বসে। ভাবুক ভাইয়ের থেকে শ্রবণকে নিজের কোলে নিয়ে শুধায়,
–“কি ভাবছো?”

শ্রেয়ান অনড় অবস্থাতেই ভাবুক কণ্ঠে শুধায়,
–“আমরা সবদিক থেকে সবসময় সুখী কেনো হইনা?”

–“আমরা সবদিক থেকে সুখী হলে সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যাবো, তাই।”, সুস্মিতা বড্ডো স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো। শ্রেয়ানকে আবার ভাবুক হতে দেখাগেলো। অক্ষিপটে ভেসে চলেছে পুড়ে যাওয়া হাতের সেই উঠে আসা এক পত্তন চামড়ার দৃশ্য! সে কি বিভীষিকাময় দৃশ্য! শ্রেয়ানের কেনো এতো ব্যথা অনুভব হচ্ছে? মনে হচ্ছে কেউ তার শরীর থেকে চামড়া ছিলে নিয়ে গিয়েছে। এক অসহ্য অনুভূতি সামলাতে না পেরে বলে,
–“আমার কেমন অস্থির লাগছে?”

–“কোন বিষয়ে?”

–“আমি কারোর কষ্ট দেখতে পারি না কেনো? যেখানে আমি নিজেই এক দুঃখী মানুষ!”, শ্রেয়ানের অসন্তোষ মাখা কণ্ঠে সুস্মিতা মৃদু হেসে বলল,
–“তুমি সবার নয়! তুমি এমন কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারো না যার কষ্ট নিরসন করার সামার্থ্য তোমার রয়েছে। আর সামার্থ্য থাকা সত্বেও তুমি তার কষ্ট নিরসন করতে পারছো না—এই অনুভূতি তোমায় তাড়া করে বেড়ায়, অস্থির করে তোলে।”

শ্রেয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বোনের দিকে। শুধায়,
–“আমার কি সত্যিই সামার্থ্য আছে তার কষ্ট দূর করার?”

–“তার? মানে, কার? বলতে না চাইলে বলো না। তবে সামার্থ্য আছে কি নেই— সেটা তুমি নিজেকে প্রশ্ন করো! তার পরিস্থিতি বিবেচনা করো, তারপর ভাবো তোমার সামার্থ্য আছে কি-না। ভাবো তুমি কিছু করলে তার পরিণতি মোকাবেলা করতে পারবে কি-না। যদি মনে হয় তুমি যথেষ্ট সামার্থ্যবান তবে নিজের এই ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করো।”, শ্রবণকে আদর করতে করতে বলল সুস্মিতা। ছেলের মুখপানে তাকিয়ে শ্রেয়ান গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। মুহুর্তেই অন্তঃকরণে এক চমৎকার ফ্রেম ভেসে উঠলো যেখানে চারটি স্নিগ্ধ মুখ একদম ঠিকঠাক ভাবে এঁটে গিয়েছে। সুস্মিতা আবার জিজ্ঞেস করে,
–“ঐ মেয়েটা অমন করলো কেনো? আমাদের সাহায্য নিলো না কেনো?”

–“আত্মসম্মান বোধ!”, শ্রেয়ান ছোট্ট করে জবাব দেয়। সুস্মিতা কপাল কুঁচকে শুধায়,
–“ব্যথা সহ্য করে আত্মসম্মান রক্ষা করায়, কেমন লজিক? আমার তো মনে হয় না তার ডাক্তার দেখানোর মতো এবিলিটি আছে।”

–“কারোর কারোর জন্য হয়তো ঐটুকুই বেঁচে যাওয়া একমাত্র সম্বল। আমাদের উচিৎ তাদের আত্মসম্মানবোধে আঘাত না দেয়া।”, শ্রেয়ান শান্ত স্বরে বলল। সুস্মিতা আর কথা বাড়ায় না।

মধ্যাহ্নের ভোজন চলছে তখন। সুস্মিতা মায়ের হাতে হাতে কাজ করছে। পেশায় একজন কার্ডিওলজিস্ট! এখনো পুরোপুরি এস্টাব্লিশড নয়। তবে হয়ে যাবে শিঘ্রই! সে এমনি হুটহাট চলে আসে বাবার বাড়িতে। কখনো এক বেলা থাকে, তো কখনো একদিন। তার শশুর বাড়ি আর স্বামী অমায়িক!
সকলে তখন আলাপ আলোচনা করতে করতে খাওয়া-দাওয়া করছিলো। তাদের আলোচনায় হঠাৎ বিঘ্ন ঘটলো শ্রেয়ানের অপ্রত্যাশিত কথায়।

–“আমি বিয়ে করতে চাই।”

উপস্থিত সকলে চমকে উঠলো। শাহেদ চৌধুরী বিব্রত বোধ করলো হঠাৎ এমন কথায়। সে গম্ভীর গলায় শুধায়,
–“কি বলছো? হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেনো?”

শ্রেয়ান গভীর এক শ্বাস নিলো। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
–“হুঁ, আমি অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।”

সুমনার দৃষ্টি চকচক করে উঠলো। সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
–“ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস! আমরা তাহলে মেয়ে দেখা শুরু করবো।”

–“মেয়ে দেখতে হবে না।”, শ্রেয়ান নত মস্তকে গম্ভীর গলায় বলল। ভাইকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকা সুস্মিতা সন্দিগ্ধ গলায় বলে ওঠে,
–“মেয়ে না দেখলে বিয়ে করবে কি করে?”

সুমনা শাহেদ চৌধুরী উৎসুক নজরে তাকিয়ে ছেলের দিকে। শ্রেয়ান চোখ তুলে তাকায় বাবা মায়ের পানে। বলে,
–“আমি ইরাকে বিয়ে করতে চাই।”

–“ইরা?”, সুমনা’র হতভম্ব কণ্ঠ।

–“ইরা মানে ঐ লিফটের মেয়েটা?” সুস্মিতার চঞ্চল কণ্ঠে শ্রেয়ান মাথা নাড়লো। সুস্মিতার ঠোঁটের কোনে থেকে ঠিকরে হাসি বেরিয়ে আসলো। সে দেখেছিলো ভাইয়ের চোখে মেয়েটির জন্য অজানা নম্রতা, ক্লেশ!

চলবে..