যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
||০৫||
ঘর ভাঙা প্রতিটা মানুষের জন্য এক দুঃস্বপ্ন! এটা কারোর কারোর ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যায়; আবার কারোর জীবনে ভয়ঙ্কর বাস্তবাতা’র সাথে গভীর দাগ কেটে যায়। পুরোনো বিশ্রী এক অভিজ্ঞতা, এখন শাহেদ চৌধুরীকে যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে শতবার ভাবায়। হুটহাট জেঁকের বসে কোন কাজ করতে সে রাজি নয়। সে জলদগম্ভীর গলায় বলল,
–“এতো তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার তো কোন মানে দেখছি না শ্রেয়ান! তোমার কারোর প্রতি দয়া হচ্ছে তুমি বড়ো জোর তার প্রতি সমবেদনা দেখাতে পারো কিংবা অন্যভাবে সাহায্য করতে পারো। কিন্তু তাই বলে তুমি অচেনা একজনকে বিয়ে করার মতো এতো বড় সিদ্ধান্ত এভাবে নিতে পারো না। পরে যদি তোমার মনে হয় তোমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, তখন?”
–“পাপা, আমি একবারো বলিনি আমার ইরা’র প্রতি আমার কোনরূপ দয়া হচ্ছে। আমি শুধু বলেছি আমি ইরাকে বিয়ে করতে চাই, ব্যস্। কোন কারণ ছাড়া!”, শ্রেয়ানের শক্ত কণ্ঠ। শাহেদ চৌধুরী গম্ভীর গলায় বললেন,
–“তোমার বাবা আমি। তোমার আগাগোড়া চিনি। তোমার এই সিদ্ধান্তের কারণ যে ইরার অসহায়ত্ব সেটা তো আমায় বলে বোঝাতে হবে না।”
–“তবে তুমি ভুল। আমি তাকে বিয়ে করতে চাইছি মন থেকে এখানে দয়ার কোন জায়গা নেই। তুমি মোর্শেদ চাচা’র কাছে প্রস্তাব পাঠাও। চেষ্টা করবে যেকোন মূল্যে রাজি করানোর।”
শাহেদ চৌধুরী বিরক্ত হলেন ছেলের এমন গোয়ার আচরণে। সে বিরক্তি নিয়ে বলল,
–“কি অদ্ভুত! সুমনা তোমার ছেলেকে বোঝাও। হুটহাট এমন সিদ্ধান্ত না নিতে; পেছনের অভিজ্ঞতা কি সে ভুলে গিয়েছে?”
–“ভুলিনি বলেই এবার আর মানুষ চিনতে আমি ভুল করছি না। আমি সঠিক মানুষকে বাছাই করছি। আমি আমার জীবনের সবটা ভুল মানুষের পেছনে বিলিয়ে দিয়েছি যেটার যোগ্য সে নয়। তেত্রিশ বছরের এই জীবনে হুটহাট সিদ্ধান্ত তুমি এখনো আশা করছো আমার থেকে? ”
সুমনা স্বামীর দিকে আকাঙ্ক্ষা ভরা চাহনিতে তাকায়। ছেলের সিদ্ধান্ত শোনামাত্র সে খুশিতে আপ্লুত হয়ে গিয়েছে। তার থেকেও বেশি আনন্দ ইরা আর ইরার মেয়েকে সম্পূর্ণ ভাবে আপন করে পাওয়ার খুশিতে। ইরাকে তার খুব ভালোলেগেছে, ভালো মেয়ে মনে হয়েছে। তার থেকেও বড়ো কথা ইরা একজন শক্তিশালী এবং চমৎকার মা! তার সংসারটা এমনি একটা মানুষের অপেক্ষায় আছে যে সন্তান, ঘর সংসারের মায়ায় জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে। ইরা নিঃসন্দেহে এমনি মেয়ে! স্বামীর হাত ধরে সুমনা অনুনয় করে বলে,
–“ওগো, তুমি তো সামনাসামনি দেখোনি মেয়েটিকে। রাজ্যের মায়া মা, মেয়ের মুখ জুড়ে। একদম শান্তশিষ্ট। বাচ্চা মেয়েটা কি মিষ্টি! তুমি যদি কোলে নাও, কোল থেকে নামাতে ইচ্ছে করবে না। ওরা আমার সংসারে আসলে আমার সংসারটার সব খুঁত নিখুঁতভাবে পূর্ণ হয়ে উঠবে। আমি তো সাহস করে বলতে পারিনি কিন্তু আমির ইচ্ছা করে ইরার মেয়েটাকে এনে শোকেসে সাজিয়ে রাখি! জীবন্ত এক পুতুল! আর আমার দাদুভাই একটু মায়ের দুধ খেতে পারতো। আমারো তো ইচ্ছা করে আমার দাদুভাইটাকে একটু পেটভরে খেতে দেখতে। একটু সুস্বাস্থ্য হবে, খেলাধুলা করবে। কিন্তু ওকে দেখো এখনো মনে হয় সেই এক মাসের একটা নবজাতক। তুমি রাজি হয়ে যাও না?”
শাহেদ চৌধুরী কিছুক্ষণ থম মেরে বসলেন। স্ত্রীর কথা, নাতির কথা, ছেলের কথা বিবেচনা করলেন। সুস্মিতা বাবার ভাবুক মুখটির দিকে তাকিয়ে বলল,
–“পাপা আমি তাকে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখেছি। যথেষ্ট ধৈর্য্য, সহনশীলতা আর মায়া’র অধিকারী এক নম্র সত্ত্বা সে! সে যে অবস্থানে রয়েছে সেটার থেকে ভালো কিছু সে ডিজার্ভ করে! আর তুমি শ্রবণের কথা চিন্তা করো, তার দুধ মা থেকে মা হয়ে ওঠার যোগ্যতা তার রয়েছে।”
শাহেদ চৌধুরী ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল,
–“আমি কথা বলছি মোর্শেদের সাথে। চেষ্টা করবো রাজি করানোর। কিন্তু ইরা’র ব্যপারে আমি কিছু জানি না। সে যদি রাজি না হয় তবে আমাকে এখানে টানবে না।”
সুমনা গর্জে উঠলেন। কতোবড় বদ লোক! এমন খুশির কথার শেষে অমন ত্যাড়া কথা বলতে পারলো? এই লোকের সাথে সে কিভাবে আজ ছয়ত্রিশটা বছর সংসার করলো? ভাবতেই তার নিজেকে কোন কিংবদন্তি মনে হলো! তেতে উঠে বলে,
–“তুমি একদম অতিরিক্ত করো শ্রেয়ানের বাবা। তুমি এমন কথা বলবে কেনো? বলবে, না রাজি হলে তুমি নিজে গিয়ে রাজি করাবে। তা না! আমি এই সুমনা বলেই তোমার সাথে এখনো আমি সংসার করছি, নয়তো তোমার মতো খচ্চর মানুষের সাথে কেউ সংসার করতো না।”
শাহেদ চৌধুরী পাল্টা গর্জে উঠলেন,
–“সুমনা? কথায় কথায় ব্যক্তিগত জীবন টানাটানি করা তোমার একটা বদ অভ্যাস।”
–“বদ অভ্যাস ই তো লাগবে! আমার সব কথা তো তোমার কাছে তেঁতো লাগে।”, বলেই সুমনা দুম করে সোফা ছেড়ে উঠলেন। ভাবুক শ্রেয়ান ভাবনা থেকে বেরিয়ে থমথমে মুখে বলল,
–“ইরাকে রাজি করানোর বিষয়টা আমি দেখে নেবো। তুমি আগে তার পরিবারের দিক থেকে সুনিশ্চিত হও।”
বরাবর সন্তানের খুশির সামনে বাবারা নুব্জ্য হওয়ায়, শাহেদ চৌধুরী নিরুত্তর প্রস্থান করলেন।
দুই হাতে ভেজা গামছা জড়িয়ে ইরা নিথর দেহ নিয়ে শুয়ে আছে। চার হাত পায়ে মাকে জাপ্টে ধরে তখন ইরাম দুধ খাচ্ছে। ইরা’র চোখ জড়িয়ে আছে ঘুমে। কিন্তু শরীরের জ্বলন, মেয়ের চিন্তা আর মায়ের নিত্যনতুন ঝামেলায় চোখ বুজতে পারছে না। গত এক মাস যাবৎ ইরামের বাবা কোন টাকা পাঠায়নি ইরামের জন্য। তার কাছে জমানো টাকা দিয়ে এতোদিন চলেছে। এর মধ্যে যাতায়াতের খরচ হয়েছে। তারপর যেটুকু ছিল তা মাকে সব দিয়ে দিয়েছে। ইরামের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শেষ। ডায়পার, সেরেলাক , ওয়াইপস সহ লোশন সব শেষ। এর জন্যই আজ বিছানা মেখেছে ইরাম। আবারো যদি এমন হয় তবে মা অনেক ঝামেলা করবে। দেখাযাবে তাদের এখানে থাকতেই দেবে না। কি করবে? ইরামের বাবার কাছে টাকা চাইবে? না চাইলে ইরামের সব প্রয়োজনীয় জিনিস আনবে কি করে? ইরামের বাবা আর যাই হোক মেয়ের বেলায় কখনো কোন কমতি রাখে না। অথচ সবচেয়ে বড়ো কমতিটাই তো অপূর্ণ। তার মেয়েটার কি ইচ্ছে হয় না একটু বাবার স্নেহ পেতে? আর পাঁচটা সন্তানের মতো বাবার কোলে ঘুমাতে, ঘুরতে যেতে আদর খেতে! ইরা মাঝেমধ্যে ই ভুলে যায় তারা মা মেয়ে আর পাঁচটা মানুষের থেকে আলাদা।
নিরূপায় ইরা। মেয়ের অযত্ন হচ্ছে শুনলেও ইরামের বাবা রাগারাগী করবে তার সাথে। সে স্মার্ট ফোনটি হাতে নেয়। এটাও ইরামের বাবার দেয়া, যেনো যেকোন সময় মেয়েকে দেখতে পারে। কাঙ্খিত নাম্বারটিতে মেসেজ পাঠালো।
–“বাবুর ডায়পার শেষ। প্রয়োজনীয় অনেককিছুই শেষ।”
ফিরতি বার্তা আসলো সাথে সাথে।
–“ডায়পার শেষ সেটা আগে বলবে না? আর কি কি শেষ? খাবারো কি শেষ? এতো দিন কিভাবে ছিল আমার মেয়েটা? তোমার কি কোন কান্ড জ্ঞান নেই? সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর বলো কেনো? কতোদিন হলো টাকা দেইনি। আমারি ভুল, আমি দেশে নেই; মালদ্বীপে আছি, ব্যস্ততায় ভুলে গিয়েছি। আমি এখনি টাকা পাঠাচ্ছি।”
ইরা মলিন হাসলো একজন আশ্চর্য রকমের দায়িত্ববান বাবার কথায়। কতো ভালোবাসা তার মেয়ের জন্য—অথচ সেই মেয়ে আর তার মাই স্থান পেলোনা বাবার কাছে। মালদ্বীপে গিয়েছে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে। অনেক সুন্দর মুহুর্ত কাটাচ্ছে হয়তো! তার গায়ে বোধহয় হাত তোলেনা! অনেক ভালোবাসে, মাথায় করে রাখে নিশ্চয়ই। কারণ সে তো পরিপূর্ণ আর সুন্দরী। আজ সে যদি পরিপূর্ণ হতো তবে সেও আর পাঁচটা মেয়ের মতো সুখী হতো! তার মেয়ে বাবা পেতো। ফোনের আলো জ্বলে উঠতেই ইরা সেদিকে তাকায়। দশ হাজার টাকা এসেছে। সাথে একটা বার্তা,
–“ডেট দেখে কিনবে সব জিনিস। দুই টাকার ফকিন্নিদের মতো জিনিসপত্র কিনবে না। ব্রান্ডের জিনিস কিনবে সব। যা যা লাগবে সব বেশি বেশি কিনে রাখবে ঐ টাকা দিয়ে। নিজের কাজে যেনো এক টাকাও ব্যবহার না হয়। আমার মেয়ের যেনো কোনকিছুতে কমতি না হয়!”
সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে অবলা, তুচ্ছ সৃষ্টি বোধহয় ইরা। নিজের পরিণতিতে হাসি ছাড়া আর কিছুই আসলো না ইরা’র। চোখের পানি ইদানিং শুকিয়ে গিয়েছে, শরীর থেকে চামড়া তুলে ফেলার যন্ত্রণাও কেমন ফিকে লাগে।
*****
বিকল সাড়ে তিনটা। হঠাৎ করেই মিষ্টি আর কিছু উপঢৌকন হাতে শাহেদ চৌধুরী আর তার স্ত্রীকে নিজের ঘরে দেখে মোর্শেদ অবাক হয় বেশ। মোর্শেদ আপ্যায়নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লে শাহেদ চৌধুরী তাকে না করলো। সে জরুরি কিছু কথা বলতে এসেছে। সালমা, মিমি সোফা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চকচকে দৃষ্টি উপঢৌকনের উপর। মোর্শেদ, শাহেদ চৌধুরী আর সুমনার সামনে বসা। মোর্শেদ বিগলিত কণ্ঠে শুধায়,
–“স্যার কি বলবেন বলুন!”
শাহেদ চৌধুরী সোজাসাপ্টা গম্ভীর গলায় প্রস্তাব রাখলেন।
–“মোর্শেদ, আমি তোমার কাছে একটা আবদার নিয়ে এসেছি। আশা করছি আমায় নিরাশা করবে না।”
মালিকের বিরাগভাজন এর মতো অপরাধ শাস্তিযোগ্য, নিমোকহারামি— এটা মোর্শেদ মেনে চলে। সে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
–“এ কেমন কথা স্যার? আপনি আবদার করবেন আর আমি আপনাকে নিরাশা করবো? এটা কখনো হতে পারে? আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন।”
শাহেদ গম্ভীর গলায় বলতে লাগলো,
–“তোমাকে পরিস্থিতি কিংবা দুই পক্ষের জীবনের গতিবিধি খুলে বলার প্রয়োজন নেই তুমি নিজের লোক, সবটাই জানো। আমি ইরাকে আমার শ্রেয়ানের জন্য বউ করে নিতে চাই আর ইরামকে আমার নাতনি।”
সালমা আর মিমি চমকে উঠলো শাহেদের কথায়। সালমা চোখ বড়বড় করে তাকায় মেয়ের দিকে। পরপরই তাকায় নিজের মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল দালানটির দিকে। এই ছয়তলা বিশাল দালানটির মালকিন হবে ঐ ফকিন্নি? আহাজারি জুড়লো সালমার বক্ষজুড়ে। মোর্শেদের চোখমুখ চকচক করে উঠলো এহেন প্রস্তাবে। ঠোঁট ঠিকরে খুশির হাসি বেরিয়ে আসে। সে হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,
–“এ তো খুশির সংবাদ স্যার। আপনাকে মালিক থেকে কুটুম হিসেবে পাওয়া আমার জন্য ভাগ্যের ব্যপার হবে। আজ না হোক কাল ইরাকে নিয়ে আমায় ভাবতেই হতো। যুবতী মেয়ে! জীবনের কি বা দেখলো এর মধ্যেই ভাগ্যের টানাপোড়েনে আজ এই অবস্থা হয়েছে মেয়েটার। বোবা, বধির একটা মেয়ে, কতো শান্তশিষ্ট আপনি না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আপনার মনে হয়, ঘর ভাঙবে এমন কাজ ও করতে পারে? এ তো ভাগ্যের পরিহাস!”
মোর্শেদ সংলাপে আরেকটু রসকষ ঢেলে বললেন। সুমনা বিরক্তি নিয়ে বলল,
–“ইরা’র ব্যপারে সব জেনেই আমরা এসেছি ভাইজান। বাড়তি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমি জানি ও কতো লক্ষ্মী আর ওর জীবনে থাকা মানুষগুলো কতোটা নিকৃষ্ট। আপনি ইরার সাথে কথা বলুন। ওর সাথে আলোচনা করে তাহলে আমাদের জানান। ও রাজি থাকলে আমরা এক মুহুর্ত ও দেরী করবো না।”
মোর্শেদ থতমত খাওয়া দৃষ্টিতে তাকায়। ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো। স্যারেরা স্বল্পভাষী! অল্পের মধ্যে কথা গুছিয়ে বলা মানুষ। সে মেয়ের সাথে আলোচনা না করেই এক প্রকার ওয়াদা দিয়ে দেয়, অতিরঞ্জিত কণ্ঠে আত্মীয় বানিয়ে ফেলে। এদিকে সালমা হা-হুতাশ করে উঠলো স্বামীর কাজে। তারা বেরিয়ে যেতেই গর্জে উঠলো স্বামীর উপর,
–“তুমি এটা কি করলে? তোমার ঐ বোবা কানা মেয়ের সাথে অমন সুন্দর, রাজকুমারের মত ছেলের বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলে? তুমি কি ভুলে যাচ্ছো এই সব সম্পত্তি র একমাত্র মালিক শ্রেয়ান। তারমানে তোমার মেয়ে আমাদের উপর রাজ করবে? আয়হায় এ কি দিন দেখতে হচ্ছে? তুমি কি বোকা মিমির বাপ? নিজের এই বিয়ের লায়েক মেয়েটাকে রেখে তুমি ডিভোর্সী মেয়ের বিয়ে ঠিক করছো তাও আবার সমাজের এমন উচ্চ শ্রেণীর মানুষের সাথে?”
মোর্শেদ রাগান্বিত চোখে তাকায় স্ত্রীর দিকে। বলে,
–“পাগল হয়ে গিয়েছো সালমা? বুঝেশুনে কথা বলো! মিমিকে আমি এক বাচ্চার বাপের সাথে বিয়ে দেবো? ওর কোন দিক থেকে কমতি আছে? চুপচাপ আমি যা করছি তাতে সায় দাও। এমন ঘরের সাথে আত্মীয় করতে পারলে তোমার এই রোজকার ঝামেলাও কমবে আর আমাদের ও একটা গতি হবে। সমাজে কতো নামধাম হবে আমাদের বুঝতে পারছো? তখন আমাদের মিমি’র জন্য আরো উঁচু জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসবে দেখো! আমাদের অর্ধেক দেখাশোনা তখন স্যার ই করবে!”
সালমার মাথার বুদ্ধি খুললো। সে চকচকে দৃষ্টিতে তাকায় স্বামীর দিকে। বলে,
–“তুমি তো ঠিক ই বলছো মিমির বাবা। আমি তো এতো কিছু ভেবে দেখিনি।”
–“এর জন্যই বলি কথা কম বলো।”, বলেই মোর্শেদ ইরার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মিমি মায়ের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় বলে,
–“আমি একটা ডিভোর্সি, বাচ্চার বাপকে বিয়ে করবো মা? লোভে পড়ে তোমার বুদ্ধি সুদ্ধি গিয়েছে।”
বলেই মিমি উপঢৌকন গুলো খুলতে বসলো।
বাবা ছেলে ঘরময় অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলো সম্মতির অপেক্ষা করতে করতে। হয়তো এখন থেকে রোজ শ্রবণ নামক ছেলেটি পেট ভরে খাবার খাবে, গায়ে অনেক শক্তি পাবে, সেও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে উঠবে। আর শ্রেয়ান নামক দুঃখী বাবা’টি চোখ ভরে দেখবে নিজের হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটিকে। তবে তাদের সকল অপেক্ষা ফিকে পড়লো এক ঘন্টার মাঝেই। যখন জানলো ইরা সাফসাফ নাকোচ করেছে তাদের প্রস্তাব। বাবা-ছেলে’র অস্থিরতা মিইয়ে গেলো। শাহেদ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে গেলেন। কাউকে জোরজবরদস্তি করে তো আর বিয়েতে রাজী করানো যাবে না। সুমনা ব্যথিত মন নিয়ে সোফায় ঘাপটি মেরে বসলেন। বাবা ছেলেকে দ্রুত নিরাশার রেশ কাটাতে হয়। এমন নিরাশা তো আর নতুন নয়—যেখানে তারা সবচেয়ে বড়ো আঘাতটা পেয়েছিল নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটির থেকে; সেখানে দূরের মানুষের থেকে পাওয়া কষ্ট তো নিতান্তই স্বাভাবিক!
স্টাডি রুমের সিসিটিভি ফুটেজের সামনে অলস বদনে বসে আছে শ্রেয়ান। বাবার অফিসের সিসিটিভি আর বিল্ডিং এর সিসিটিভি একসাথে দুটোই পর্যবেক্ষণ করছে। সবসময় কেউ না কেউ থাকেই এটা পর্যবেক্ষণে। তার পাশেই পোর্টাবেল দোলনাটিতে তখন দোদুল্যমান শ্রবণের ছোট্ট দেহটি। ঝুলন্ত চাঁদ তারার সাথে চার হাত পা দিয়ে খেলছে। তখন প্রায় বিকাল পাঁচটা। হঠাৎ করেই শ্রেয়ানের দৃষ্টি থেকে উদাসীনতা মিলিয়ে গেলো। গ্রাউন্ড ফ্লোরে গ্যারেজ পেরিয়ে ইরামকে কোলে নিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছে ইরা। শ্রেয়ান চকিতে হেলান ছাড়ে। অতিদ্রুত ফোন লাগায় দারোয়ানের কাছে। হড়বড়িয়ে বলে,
–“আঙ্কেল গেট আঁটকান তাড়াতাড়ি।”
দারোয়ান ভয় পেয়ে গেলো শ্রেয়ানের কণ্ঠে। সে ভয়ের তোপে কিছু না বুঝেই দ্রুত গেট লাগালো। ধুকপুক করা অন্তঃস্থল সামলে, চারিপাশ অবলোকন করে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করে,
–“শ্রেয়ান বাবা কিছু কি হইছে? তুমি দরজা আটকাতে বললা কেনো? কিছু তো নেই, চারপাশ তো ঠিক আছে।”
ছেলেকে কোলে নিয়ে শ্রেয়ান স্টাডি রুম থেকে বের হয় অতিদ্রুত। হাঁটতে হাঁটতে কাঁধ দিয়ে কানে ফোন চেপে বলল,
–“আঙ্কেল, একটা মেয়ে দেখছেন না ওকে কোনমতেও বের হতে দেবেন না; যতক্ষণ না আমি আসছি। বুঝেছেন?”
–“আচ্ছা বাবা!”
ইরা গেটের কাছে গেলে দারোয়ান চাচাকে আ উ শব্দ করে ইশারা করে বলে, গেট খুলতে।
দারোয়ান চাচা তাকে হাত দিয়ে দেখালো দশ মিনিট অপেক্ষা করতে। ইরা মাথা নেড়ে সায় জানায়। ইরামের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যাবে আর নিজের জন্য বার্নার কিনবে একটা।
লাইট ব্লু? না না এটা বেশি ফর্মাল! সাদা? স্কুলে যাচ্ছে নাকি? না না এটাও হবে না। তবে পিংক? শুনেছে মেয়েদের পিংক পছন্দ? নাহ্, পিংক পড়লে তো তাকে আর ছেলে দুইজনকেই ছ্যাঁচড়া দেখতে লাগবে। তবে কি লাল? ছিঃ তাদের দেখতে ঠিক দু’টো লেডিস বাগে’র মতো লাগবে। দেনামোনা করে বাবা ছেলে ডার্ক ব্লু দু’টো শার্ট ই চুজ করলো। ইন করে সেটা পড়ে নিলো শ্রেয়ান। ছোলের ছোট্ট কোমড়ে ইন করার জায়গা নেই বিধায় করলো না। বাবা ছেলে সেইম সেইম পোশাক পড়ে মিনিটের মাঝে তৈরি হয়ে নেয়। শ্রবণকে স্লিং বেবি ক্যারিয়ারে নিজের সাথে বেঁধে নিয়ে শ্রেয়ান ক্ষিপ্ত গতিতে ঘর থেকে বের হলো। পেছন থেকে সুমনা চেঁচিয়ে উঠলো,
–“এই ছেলে ওকে নিয়ে এভাবে ছুটছিস কোথায়?”
শ্রেয়ান যেতে যেতে চঞ্চল কণ্ঠে বলে,
–“আমাদের বাবা ছেলের ভালোথাকা খুঁজতে মামনি।”
হঠাৎ করেই কারোর মাঝে ভালোথাকার কারণ খুঁজতে মড়িয়া হয়ে উঠলো দুঃখী বাবা ছেলে। কালো একটি গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের হয়ে গেট পর্যন্ত আসতেই দারোয়ান চাচা গেট খুলে দিল। ইরা বের হতে যাবে তার আগেই শ্রেয়ান দরজা খুলে ছেলেকে নিয়ে বের হলো। ইরা ভ্রু কুঁচকে তাকালো শ্রেয়ানের দিকে। তবে এখনকার দৃষ্টিতে স্বভাবসুলভ সেই স্বাভাবিকতা নেই। কেমন গম্ভীর, থমথমে ইরা’র মুখ্ এটা প্রস্তাবের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, শ্রেয়ান জানে। সে নির্বিকার হাতের মুঠোয় থাকা কাগজটি বাড়িয়ে দেয় ইরা’র দিকে। ইরা নিলোনা। শ্রেয়ান পুনরায় হাতটা নাড়িয়ে বলল,
–“ইরা নিন।”
ইরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই কাগজটি নিলো। প্রথম লাইনটি পড়েই ললাট জড়সড় হয়ে গেলো।
–“ইরা আপনার সাথে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলবো। প্লিজ না করবেন না। আমায় আমার কথা আপনার সামনে রাখার একটা সুযোগ দিন। আমার কথা শোনার পর আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন আমি তা সম্মানের সাথে মেনে নেবো।”
শ্রেয়ান এতদিনে বুঝলো গম্ভীর মেয়েটি কেনো সর্বদা কপাল জড়োসড়ো করে একাকার করে রাখে। এখনো ইরাম তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আর বরাবরের মতোই শ্রেয়ান মেয়েটির নাক ছুঁয়ে চরম বিরক্তির কারণ হয়। ইরাম থমথমে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মায়ের কাঁধে শুয়ে রইলো। শ্রেয়ান গা দুলিয়ে হাসলো। তবে সেই হাসি মিলিয়ে যায় কাগজ আঁকড়ে ধরা কালচে ফুলে টইটম্বুর হয়ে থাকা হাতটি দেখে। ফোস্কার ভেতর পানি টলটল করছে। ইরা চোখ তুলে তাকায় বাবা ছেলের দিকে। ছোট্ট শ্রবণ টুকটুক করে দেখছে তাকে। শ্রেয়ান ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দেখে সেই নিটোল দৃষ্টি। ইশারায় অনুনয় করলো। ইরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নিরব সম্মতিতে শ্রেয়ান
গাড়ির দরজা খুলে দেয়। ইরা আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে উঠে বসলো।
শুনশান, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় মৃদুমন্দ সুরের তালে দুলছে মানব মন। তবে ইরার নিস্তব্ধ এই পৃথিবীতে এগুলোর আধিপত্য নেই। সে কৌতুহলী নয়নে তাকিয়ে শ্রেয়ানের পানে। যে কি-না অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনে কিছু করছে। কিয়ৎকাল বাদ ফোনটা এগিয়ে দিতেই ইরা ইতস্ততার সাথে ফোনটি হাতে নেয়।
সুন্দরী, আধুনিকতা আর আভিজাত্যের ছোঁয়ায় মোড়া এক নারীর ছবি সহ নিচে কিছু লেখা সেখানে। সে আরেকবার শ্রেয়ানের দিকে তাকায়। শ্রেয়ান ইশারায় পড়তে বললো লেখাগুলো। ছবিটার একদম নিচের লাইনটা পড়তেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়।
–“আমার প্রাক্তন স্ত্রী মাহি। পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়ে হলেও আমরা আগে থেকে পরিচিত ছিলাম। দু’জনের সম্মতিতে বিয়ে হয় আমাদের। তিন বছরের সংসার ছিল আমাদের। কিন্তু ঐ তিন বছর খুব একটা নরমাল বৈবাহিক জীবন ছিল না আমাদের। ভালোবাসা যত্ন কোনদিক থেকে কমতি না রাখলেও মাহি’র ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের স্বীকার হতে হতো আমায় আর আমার পরিবারকে। পেশায় একজন পাইলট হওয়ায় আমায় বেশিরভাগ সময় ট্রাভেলিং এর উপর থাকতে হতো। কিন্তু এটা মাহির পছন্দ ছিল না। সে আমায় ফুলটাইম হাজব্যান্ড হিসেবে চাইতো। তার প্রতিদিনের আবদার ছিল আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে যেনো তাকে সময় দেই, দেশ বিদেশে ঘোরাফেরা করি। পুরুষ মানুষের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয় তার কর্মজীবন! পুরুষ মানুষের সৌন্দর্য হয় তার কর্মঠ ব্যক্তিত্ব। আমার জব আমার প্যাশন ছিল। ছোটবেলা থেকে গড়া স্বপ্ন বহুকষ্টে আমি বাস্তবায়ন করি। যেটা ছাড়তে আমি নারাজ ছিলাম। তো এমন দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। দুই বছর এভাবে কাটলেও, তিনবছরের মাথায় মাহি আমায় হুমকি দেয় হয় চাকরি ছাড়বো নয়তো তাকে। সে আমার পরিবারের সকলের সাথে খারাপ আচরণ করতে লাগলো। একটাসময় বাবার বাড়িতে চলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিলো, তখন আমি তিন মাসের ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসি সম্পর্কটাকে ঠিক করার জন্য। সম্পর্কটা ঠিক ও হয়— যখন মাহি জানতে পারে ও গর্ভবতী। হঠাৎ করেই কেমন যেনো চুপ হয়ে যায় সে। আমি ভাবলাম হয়তো আমাদের সম্পর্কটা শিথিল হচ্ছে। ততদিনে আমার ছুটি শেষ। ওকে ওভাবে রেখেই আবার কাজে ফিরি। কিন্তু মাস পেরুতেই মাহি একদম বদলে গেলো। আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না সে, আমার বাড়ি থেকে আবার চলে যায় বাবার বাড়িতে। আমার পরিবার দ্বন্দ্ব পছন্দ করতো না। তাই তারা কোন অভিযোগ রাখতো না তার প্রতি। আমি প্রায়শই বাড়িতে আসতাম তখন ওর বাড়িতে গিয়ে থাকতাম। কিন্তু ও আমায় সহ্য ই করতে পারতো না। তখন গর্ভাবস্থার আটমাস। আমি আর নিতে পারছিলাম না এই দ্বন্দ্ব। বাড়িতে আসি পনেরো দিনের ছুটিতে। তখন মাহি বলে সে এই বাচ্চা মেরে ফেলতে চায়, আমার সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ি। রাগ সামলাতে না পেরে হাত তুলে বসি তার উপর। কিন্তু মাহি যেনো নাছোড়বান্দা, সে আমার পরিপূর্ণ বাচ্চাটিকে পৃথিবীতে আনবেই না। আর এতে তার পরিবার ও একদম নিশ্চুপ ছিল। আমি নিরূপায় হয়ে পড়ি। তখন তার হাতে পায়ে ধরে অনুনয় করি বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আসতে দেয়ার জন্য। তারপর সে যা চায় আমি তাই করতে রাজি। আমি চাকরি ছাড়তেও রাজি হই। তবে মাহি কোনকিছুতেই আর মানলো না। তার চাওয়া বদলে যায়। সে আমার সাথে থাকবেই না, এটাই তার শেষ সিদ্ধান্ত। আমি তাকে কোনমতে শান্ত করলাম বললাম ঠিক আছে সে যা চায় তাই হবে। কথা মোতাবেক তার একমাস দশ দিন বাদ শ্রবণ পৃথিবীতে আসলো। আমি ভেবেছিলাম বাচ্চার মুখ দেখে অন্তত মাহির জেদ বদলাবে। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে, এক সপ্তাহ পর হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আর শ্রবণ মাহিকে পেলাম না। সেদিন দুপুরেই মাহির বাড়ি থেকে আমার জন্য পার্সেল হিসেবে একটা পেপার আসলো। ডিভোর্স পেপার! আমি ধরে রাখার কারণ পেলাম না। আমাদের পথ আলাদা হয়। তার এক মাসের মাথায় জানতে পারলাম মাহি আবার বিয়ে করছে তার দেড় বছরের প্রেমিককে। আমি তখন বাকরুদ্ধ! দেড় বছরের প্রেমিক শুনে। মাহি বিবাহিত অবস্থাতেই তার বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। যে কি-না বিদেশে থাকতো। কিন্তু মাঝে সমস্যা হয়ে যায় মাহির প্রেগন্যান্সি! এবং তখন বুঝতে পারলাম এতো এতো অযুহাত, সমস্যা, আমার সাথে না থাকতে চাওয়ার আসল কারণ।”
–“তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কাছে আমার নবজাতক ছেলেটার খিদের আর্তনাদ হেরে গেলো। মায়ের দুধের স্বাদ পাওয়া ছোট্ট ছেলেটা কৃত্রিম দুধের অভ্যাস গড়তে নারাজ। সারাটাদিন মায়ের দুধের জন্য ছটফট করতো। এক ফোঁটা দুধ মুখে তুলতো না, জেদ দেখাতো। কিন্ত দিনশেষে সেই সকল জেদ খিদের কাছে হার মেনে যেতো। তখন হাত পা ছেড়ে দেওয়া দূর্বল দেহে আমার ছেলেটা কৃত্রিম দুধ খেতে বাধ্য হতো। এভাবে না খেতে খেতে ছেলেটা একদম দূর্বল, নরকঙ্কালের ন্যায় হয়ে যায়। এন আই সি ইউতে রাখতে হয় একমাস। এরপর অজশ্র ডট ডট ডট…….. এক মাস পর হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার পর ডাক্তার বলে পরিবেশ বদলাতে। বদলালাম। এবং সেই বদলে আমার ছেলেটা কৃত্রিম দুধের অভ্যাস গড়ে নিলো। কিন্তু তার অভ্যাসে হঠাৎ ই বিঘ্ন ঘটলো হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পেয়ে যাওয়া মায়ের দুধের স্বাদে! কেউ একজন আমার অভুক্ত ছেলেটাকে পেট ভরে নয়, মন ভরে দুধ খাওয়ালো। যতো ইচ্ছে ততো! বিগত তিনমাসে আমি আমার ছেলেটাকে এমনভাবে পেট ভরে খেতে কখনো দেখিনি। আমার খুব ইচ্ছে হয় আমার ছেলেটাকে পেট বরে খেতে দেখতে। ও যখন পেট ভরে খায় তখন অনেক শক্তি পায়, হাত পা নাড়াচাড়া করে। নয়তো এমনি সময় এতো শক্তি পায় না; দূর্বল দেহে শুধু শুয়ে থাকে।”
দীর্ঘ সেই সংলাপদ্বয় পড়ে ইরা চোখ তুলে তাকায়। শ্রেয়ার নির্নিমেষ তাকিয়ে তার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শ্রেয়ান আবারো ইশারা করে পড়ার জন্য।
–“বিগত তিন সপ্তাহে আমার ছেলেটার অভ্যাস আবার ভেঙে যায় ইরা। আর তার এই অভ্যাস ভাঙার কারণ আপনি। সে লোভী হয়ে উঠেছে। সে শুধু আপনার থেকেই খাবার চায়। সারাদিন জেদ দেখায় আমার সাথে। এক ফোঁটা দুধও মুখে তোলেনা, যখন খিদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে দূর্বল হয়ে পড়ে— তখন বাধ্য হয়ে খেয়ে নেয় তার অপছন্দের দুধগুলোই। ইরা আপনি যদি আমার ছেলেটার প্রতি একটু সদয় হতেন— তবে ও তিনবেলা হয়তো পেট ভরে খাবার পেতো। আপনার মেয়ের মতো আমার ছেলেটার ও হয়তো এমন স্বাস্থ্য হতো, ও আর পাঁচটা বাচ্চার মতো খেলাধুলা করার শক্তি পেতো। ওর দৈহিক গ্রোথ সেই এক দুমাসের বাচ্চা থেকে একটু বাড়তো। হয়তো আমায় আর কখনো ওকে হাসপাতালের ঐ কাঁচের ঘরে বন্দী দেখতে হবে না।”
–“আপনি নিশ্চয়ই আমায় স্বার্থপর ভাবছেন তাই না? আমি একমাত্র, আমার ছেলের জন্য আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি। কিন্তু এখানে আরো কয়েকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো আমার মেয়ে বাবু খুব পছন্দ। আর আপনার গম্ভীর মেয়েটা একটু বেশিই পছন্দ। ও অনেক সুন্দর! এমন সুন্দর, গম্ভীর মেয়ের বাবা হতে পারলে দাম্ভিকতায় আমার মাটিতে পা পড়বে না। আর আমি খুব করে চাই এই দাম্ভিকতা! ও যখন নাকমুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকায় এটা আমার খুব পছন্দ। আপনি যদি এই বিয়েতে রাজি হন তবে আমি রোজ ওকে বিরক্ত করতে পারবো। ওর ফুলকো ফুলকো গাল দুটোতে বিনা দ্বিধায় আদর করতে পারবো। আড়ং এ যখন বেবি গার্ল কালেকশন গুলো দেখি তখন আমার খুব আফসোস হয় কেনো আমার একটা মেয়ে নেই। মেয়েদের সব জিনিস অনেক আকর্ষণীয়। ওকে যদি আমি আমার করে নিতে পারতাম তবে আড়ং এর সব বেবি গার্ল কলেকশন গুলো আমার হতো। আর আপনি ভাবুন আপনার একটা ছেলে থাকলে আপনি তাকে দিয়ে বাজার করাতে পারবেন, ভারী কিছু যখন জাগাতে পারবেন না তখন আপনার ছেলে আপনাকে সাহায্য করবে। আপনি যখন বুড়ি হয়ে যাবেন তখন আপনার একটা ঢালের প্রয়োজন পড়বে না? আপনার শ্রবণের মতো একটা ছেলে থাকলে সে আপনার ঢাল হতে পারবে।”
শেষের কথাগুলো বেশ হাস্যরসাত্মক শোনালেও ইরা’র মুখে একটুও হাসি দেখাগেলো না। তার মুখশ্রী একদম গম্ভীর। সম্মুখের বাবা ছেলে তখন পিটপিট করে তাকিয়ে। দৃষ্টিতে তাদের সতর্ক! বাবা ছেলে সতর্ক দৃষ্টিতে মা মেয়ের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছে। দু’টো কড়া, গম্ভীর দৃষ্টি দেখে শ্রেয়ান গলা খাঁকারি দিলো। ছেলের পিঠে চাপড় দিতে দিতে উৎসুক নজরে তাকিয়ে ইশারায় কিছু প্রত্যুত্তর চাইলো।
ইরা থমথমে মুখে হাতের ফোনটি এগিয়ে দিলো। শ্রেয়ান অবহেলায় ফোনটির দিকে এক পলক তাকিয়ে পকেটে ঢুকাতে গেলেও থমকালো। সে তড়িৎ গতিতে ফোনটি আবার চোখের সামনে ধরলো। গোটা গোটা শব্দের বুননে মুহুর্তেই অন্তঃস্থল উল্লাসে মেতে উঠলো।
–“বাবুর খিদে পেয়েছে তাকে আমার কাছে দিন।”
চলবে…