যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
||০৬||
জীবন থেকে কতোটুকু আশাহত হলে ভালোথাকার নাম শুনলেও কারোর মাঝে ভয় কাজ করে? যেখানে মানুষ বাঁচেই ভালোথাকার জন্য, সেখানে ইরা ভয় পায় ভালো থাকতে। আজ পর্যন্ত নিজের জীবনের কোন সিদ্ধান্ত ইরা নেয়নি। নিজের ভালোথাকার কথা চিন্তা করে তো কখনো না। জীবন যখন সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তখন নিজের সন্তানটিকে জীবন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে। কিন্তু এই চব্বিশ পেরিয়ে পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম ইরা নিজে থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে; এতেও নিজের ভালোথাকার কথা একবারো চিন্তা করেনি। পুরুষ মানুষের প্রতি তার অদ্ভুত ভীতি কাজ করে। তারা নারী মন বোঝে না। তারা শুধু নারী দেহ আর মনের উপর শোচনীয় আধিপত্য বিস্তার করতেই পটু! এই ধারণা ইরার অন্তঃস্থল যখন কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো; তখন ভেবে নিয়েছিল এই জীবনে আর পুরুষ মানুষের সান্নিধ্যে যাবে না। কিন্তু? জীবনে সবসময় কি আমাদের মর্জি চলে? মর্জি তো ঐ উপর ওয়ালার চলে। ঐ তিন মাসের বাচ্চাটার দুধের জন্য হাহাকার ইরা সহ্য করতে পারে না। তাই তো জীবনে প্রথমবার কোনদিক না ভেবে সে রাজি হয়ে যায় দ্বিতীবার কারোর সাথে ঘর বাঁধতে। আজীবন তো অন্যের জন্য ই বেঁচে আসছে; এখন নাহয় বাঁচবে ঐ ছোট্ট দুটি প্রাণের জন্য। তাতে জীবনে যদি আরেকবার সেই শাসনপ্রিয় পুরুষ মানুষের সান্নিধ্যে যেতে হয়, তবে তাই হোক।
লাল যেনো নববধূর সৌন্দর্য! সিঁদুর রঙা শাড়িটির স্বর্নালী রঙের পাথর খচিত আঁচিলটি কাঁধে রাখলে, কৃষ্ণচূড়ার ন্যায় চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ফুটে উঠলো পোড়া দেহটিতে। মলিন মুখটি থেকে মলিনতারা কেনো হুড়মুড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে? মলিনতা যে ইরার নিত্যদিনের সঙ্গী। ভারী আভিজাত্যে মোড়া শাড়িটি যখন পুরোপুরি লেপ্টেগেলো ইরার দেহজুড়ে; তখন নিজের ঐ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয় ইরা। এগুলো তার চোখে সয় না; তার চোখে সয় নিজের বিধ্বস্ত, ফ্যাকাশে মলিন মুখটি। গতরে শাড়ি ব্যতীত আর কোন প্রসাধনীর দেখা মিলছে না। খুবই অযত্নে মাঝ বরাবর সিঁথি কেটে একটা হাত খোঁপা করে ইরা তাকায় নিজের পাশে। মায়ের মতো লাল টুকটুকে ঘাগড়া পরিহিতা ইরাম শীতল পাটিতে বসে অদ্ভুত নয়নে মাকে দেখছে। সাত মাসের ঐ গলুমুলু বদনে আজ অন্যকারোর দেয়া পোশাক শোভা পাচ্ছে। পোশাক সহ মেয়ের দেহ জুড়ে অদ্ভুত শখ, আহ্লাদের দেখা মিলছে। আবদার ছিল, এগুলো খুব শখ করে কেনা হয়েছে; ইরামকে যেনো এগুলো পড়ানো হয়। ছোট্ট গতরে ঝুলতে থাকা দোপাট্টায় যেনো রাজ্যের সৌন্দর্য! কারোর ছোট ছোট শখগুলো এতো সুন্দর কেনো?
সে বিছানায় রাখা জুতাটা মেয়েকে পড়াতে নিলে কেউ ছুটে এসে সেটা খপ করে নিয়ে নিলো। ইরা চোখ তুলে তাকায়। মিলা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
–“আফনে তাড়াতাড়ি তৈরি হন ভাবিজান আমি জুতা ওরে পড়াইতেছি। ঐদিকে সময় হইয়া গেছে তো!”
বেশ আকার ইঙ্গিতে কথাগুলো বললো মিলা। ইরা খুব সহজেই বুঝে ফেললো। মৃদু হেসে আ উ শব্দ করলো বোঝালো, সে তৈরি। মিলা অবাক হয়ে শুধায়,
–“একটু সাজবেন না? একটু লিপস্টিক লাগান, লাল লাল। নয়তো আফনারে বউ বউ লাগবে না তো!”
ইরা স্মিত হেসে আরশির সামনে দাঁড়ায়। মুখে কোন প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। দেহ উত্তপ্ত! পোড়া ঘা এর যন্ত্রনা সে সহ্য করে নিলেও তার দেহ সহ্য করতে পারেনি। রাত পেরুতেই কাঁপিয়ে জ্বর আসে।
সে ঘাড় কাত করে পাঠানো লাগেজের দিকে তাকায়। কতোশত প্রসাধনী আর সাজ সরঞ্জামের জিনিস। সে সেগুলোকে আঁটকে রেখে মেয়ের বেবি ময়েশ্চারাইজার মুখে লাগায় আর একটু মেরিল ভ্যাসলিন। দিয়ে মিলার দিকে তাকায় ইশারায় বোঝায় সে তৈরি। মিলা হতাশার দৃষ্টি নামিয়ে ইরামকে জুতা পড়াতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলে,
–“আজকালকার মানুষ মরা বাড়ি গেলেও একটু চ্যাপিস্টিক লাগায় আর আফনে বিয়ের দিন লাগান ভ্যসলিন।”
দরজা’র কাছে সদ্য দাঁড়ানো সালমা আর মিমি মুখ বাঁকালো ইরাকে দেখে। ফিসফিসিয়ে বলল,
–“দেখেছিস তুই শুধু বলতি ওর সাথে যেনো আমি খ্যাচর খ্যাচর না করি! এখন দেখলি কতো চালাক মেয়ে? বড়ো লোক মানুষ পেয়েছে ওমনি বিয়ের জন্য নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গিয়েছে। কালকে বাইরে নিয়ে মনে হয় হাতিঘোড়া কিছু দেখাইছে তাই তো বাড়িতে আইসাই বিয়ের জন্য রাজি হইয়া গেছে।”
মিমি কপাল কুঁচকে হাসিমুখে বলল,
–“বড়োলোক হলে কি হবে আম্মা? ও যেই লোভে পড়ে রাজি হয়েছে তা তো আর পূরণ হলো না। দেখো না বড়োলোক হলেও তাদের রুচিবোধ নেই। একটা সোনার জিনিস দেয়নি। একটা দামী বেনারসী দিয়েছে শুধু। একদম ঠিক আছে।”
–“সে যা বলেছিস। আমিও তো তাই ভাবছি। একটা কিছু দিলো না। ভালো হয়েছে, একটা ডিভোর্সি বাচ্চাওয়ালা মেয়ে। তাকে আবার গহনা দিয়ে বউয়ের মতো সাজিয়ে নেবে! মানুষের তো বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, হুহ!”
ততক্ষণে মোর্শেদ হাঁক ছাড়লো।
–“সালমা, ওদের দেখো হয়েছে নাকি! ওদিকে সব তৈরি।”
সালমা দ্রুতমাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ইরার ঘরে ঢুকলো তাড়া দিয়ে বলল,
–“করবি তো সেই দ্বিতীয় বিয়ে তোকে কেউ হাক ডাক পিটিয়ে নিচ্ছে না। ফকিন্নিকে ফকিন্নির বেশেই নেবে, এখন তাড়াতাড়ি আয়। এতো সাজগোজের প্রয়োজন নেই।”
মিলা দাঁতে দাঁত চেপে ইরামকে কোলে নিয়ে দাঁড়ায়। বাঁকা চাহনিতে সালমার দিকে তাকালে সে একদম নির্বিকার দাঁড়িয়ে। মিলি রাগে গজগজ করতে লাগলো কিছু বলতে না পেরে। কিন্তু তার সব রাগ মিলিয়ে গেলো দরজায় সদ্য দাঁড়ানো দুটি মুখ দেখ। এতক্ষণ এদের ই অপেক্ষা করছিল। সে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“সুস্মি আফা আইছে? আন তাড়াতাড়ি আন, একটু দেখাইয়া দেন কেডায় ফকিন্নি।”
সালমা হকচকায় সুস্মিতার কথা শুনে। সে আলাভোলা হেসে বলল,
–“তুমি, এসেছো? আমি ই তো ওদের নিয়ে আসতাম।”
সুস্মিতা সৌজন্য হেসে বলল,
–“আমি না আসলে আমাদের মেয়ে বউ তো অপূর্ণই থেকে যেতো!”
সুস্মিতা ছোট্ট একটা স্যুটকেস হাতে ঘরে ঢুকলো। তার কিয়ৎকাল বাদ সুমনাও তড়িঘড়ি করে ঢুকলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
–“উপড়ে অনেক মেহমান ছিল তাই আসতে পারিনি। নে সুস্মিতা তাড়াতাড়ি ওকে পড়া সব গহনা। ছাদে ডাকছে সবাইকে।”
বলতে বলতেই সুমনার চোখ যায় ইরা আর ইরামের দিকে। চোখদুটো তার টলমলে হয়ে উঠলো। হাসিমুখে মেয়েকে দেখিয়ে বলল,
–“সুস্মি রে দেখ দু’জনকে কি মিষ্টি লাগছে! এ তো গহনার প্রয়োজন ই নেই এদের। গহনা ছাড়াই তাদের কতো সুন্দর লাগছে।”
সুস্মিতা হাসলো মায়ের কথায়। বিছানার উপর স্যুটকেসটা রেখে ইরাকে টেনে কছে আনে। সালমা আর মিমিও দ্রুত তাদের কাছে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলো। সুস্মিতা স্যুটকেস খুললে তারা হতভম্ব হয়ে গেল স্যুটকেস ভরতি গহনা দেখে। তারা বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় একে অপরের পানে। সুস্মিতা একে একে গহনা বের করতে করতে বলল,
–“গহনাগুলো আগে দেইনি করণ এই জায়গাটা হয়তো সেইফ না গহনাগুলোর জন্য। কখন আবার চুরি, ডাকতি হয়ে যা !”
বলেই সুস্মিতা এক গাল হাসলো। কথাখানা বেশ গায়ে লাগে সালমার। সে চোখা স্বরে বলে,
–“কেনো তোমাদের দালানের দারোয়ানের উপর তোমাদের বিশ্বাস নেই?”
–“দারোয়ানের উপর বিশ্বাস করে কি হবে চাচি? দুস্কৃতিকারী যদি দালানের ভেতরেই থাকে।”
সুস্মিতা একে একে ইরাকে সব গহনা পড়াতে লাগলো। ইরার ইতস্ততা ততোটাই বাড়তে লাগলো গা ভরতি গহনা দেখে। সে সুমনা আর সুস্মিতার দিকে তাকিয়ে আ উ শব্দ করে বোঝাতে লাগলো তর এতো গহনা লাগবে না। সুস্মিতা কড়া চোখে তাকায়। বলে,
–“লাগবে না বললে কিভাবে হবে? এটা তোমার হক তোমায় পড়তে হবে। আমাদের সামার্থ্য রয়েছে আমাদের বউকে রাজারানী করে ঘরে তোলার, তবে কেনো করবো না? চুপচাপ বসো।”
ইরা ঠিক বুঝলো না। সুস্মিতা তাকে চেপে ধরে সব পড়ালো। গহনাগুলো নিজ নিজ জায়গায় সেজে যেতেই ইরার আর কোন বাহ্যিক সৌন্দর্যবর্ধনের প্রয়োজন পড়লো না। সুস্মিতা মুগ্ধ নয়নে তাকায় ইরার পানে। অতঃপর দোপাট্টাটা ইরার মাথায় তুলে দেয়। ঠিক বুক পর্যন্ত ঢেকে দেয়। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“মাশাআল্লাহ!”
সুমনা তাকে তাড়া দিলো। বলল,
–“হয়েছে হয়েছে পরের মেয়েকে তো সাজিয়েছিস এখন আমার বাড়ির মেয়েটাকে সাজা। সে মায়ের দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে! দাদুমনি আমার! তোমাকেও সাজাবো। তোমাকে মায়ের থেকে আরো বেশি সুন্দর লাগবে। মন খারাপ করে না!”
সুস্মিতা হেসে ঘাড় কত করে তাকায় ইরামের দিকে। হত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“আসেন আম্মাজান! ফুপি এখন আপনাকেও সাজাবো।”
সুস্মিতা ইরামকে নিজের কোলে নিয়ে একটা লকেটসহ চেইন পড়ালো, ছোট ছোট হাতে দুটো ব্যাঙ্গেল পড়ালো আর পায়ে একজোড়া রূপালী নুপুর। মুহুর্তেই রিনিঝিনি শব্দে মেতে উঠলো ঘরটি। ইরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে। মেয়ের পুরো গতর জুড়ে কেমন যত্ন, ভালোবাসা, শখ আহ্লাদের ছোঁয়া। সুমনা হৈ হৈ করে উঠলো,
–“দেখ দেখ সুস্মি, কি সুন্দর লাগছে আমার দাদুমনিকে! এ আস্ত এক পরী! কালো টিকা ছাড়া আমি বের করবো না। আসো, দাদুমনির কাছে আসো। দাদুর চোখে কাজল আছে।
সুমনা নাতনিকে কোলে নিয়ে অজশ্র আদর করলো। আর কপালে একটা কালো দাগ কাটলো। ইরাম নিরবে টুকটাক করে দেখছে সকলকে। তাকে নিয়ে কেনো এতো উল্লাস? কেনো এতো পরিবর্তন? মেয়েটি কেমন নিশ্চুপ হয়ে পড়েছে।
ছয়তলা বাড়িটি সোনালী আলোয় জ্বলজ্বল করছে। খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে ইরা আর শ্রেয়ানের। গতকাল রাতে যখন হঠাৎ করে ছেলে এসে জানালো সে কালকের মধ্যে বিয়ে করছে—তখন এক রাত ও একদিনের মধ্যে শাহেদ চৌধুরী সব ব্যবস্থা করলেন। যতোটুকু পারলো। সোসাইটিতে তার একটা সম্মান রয়েছে। হুটহাট কোন কাজ করলেও কিছু ব্যাক্তিবর্গ বর্জন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ছাদেই ছোট পরিসরে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে সাথে ত্রিশ চল্লিশ জন মানুষ!
অফ হোয়াইট রঙের সাদাসিধে পাঞ্জাবি পরিহিত বাবা ছেলে নিজেদের আরেকবার দেখে নিলো। ছেলের পানে ছলছল নয়নে তাকায় শ্রেয়ান। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
–“আজ থেকে আমার আব্বু সবসবময় পেট ভরে খাবার খাবে। অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠবে। প্রচুর খেলাধুলা করার শক্তি পাবে। আর তোমাকে ঐ কাঁচের ঘরে বন্দি হতে হবে না।”
একটু থেমে আবার বলে,
–“আজ তোমার আপা আসছে। হ্যাঁ, তোমার আপা! তাকে সবসময় ভালোবাসবে, সাদরে মেনে চলবে; আর বড়ো হয়ে মায়ের ঢাল হবে, বুঝেছো?”
বাবা কথা বলছে শ্রবণ ও তার সাথে উ আ করে প্রত্যুত্তর করছে।
সময়টা জলদি অতিবাহিত হয়। হুট করেই বাসের সেই ঝঞ্ঝাটময় , উষ্ণ পরিবেশে—বাবা ছেলের একাকী জীবনের রাজ্যের চিন্তা, ক্লেশ, খিদের যন্ত্রণাকে নিরসনে আগমন ঘটে এক দৃঢ় মাতৃত্বের অধিকারিণী’র। আজ আরো একবার বাবার ছেলের জীবনে রাজ্যের সুখ নিয়ে হাজির হয় তারা। কিন্তু প্রেক্ষাপটে আকাশ পাতাল পার্থক্য!
মুক্তো পাথর আর সাদা ফুলের পর্দার দোদুল্যমান ফাঁক ফোকর দিয়ে, একটু আধটু দেখা মিলছে লাল দোপাট্টার আড়ালে থাকা দুই মানবীর মুখ। ছেলেকে কোলের মাঝে নিয়ে আসন পেতে বসে থাকা শ্রেয়ানের ধ্যান ভাঙলো হঠাৎ কর্নকুহর চিরে প্রবেশ করা অস্ফুট স্বরে। অনতিবিলম্বে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সমস্বরে সকলের আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো। সুস্মিতা ফুলের পর্দা সরিয়ে তখন শ্রেয়ানকে পর্দার ওপাশে যেতে বলল। ছেলেকে কোলে নিয়ে শ্রেয়ান উঠে দাঁড়ায় , সরায় ফুলের পর্দাটি। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। লাল দোপাট্টা দিয়ে ঢাকা মানবীর সামনে। তবে তার ঠোঁটের কোনা ঠিকরে স্নিগ্ধ এক হাসি ফুটে উঠলো—দোপাট্টার আড়াল থেকে দু’টো ছোট্ট গোলুমুলু নুপুর পড়া পা বেরিয়ে আসতেই। গতকাল রাতে ছুটে গিয়েছিল জুয়েলার্সের দোকানে। মা সবসময় বলতো মেয়েদের সাজিয়ে গুছিয়ে পুতুলের মতো রাখতে হয়। তারা হয় আদুরে। তাই আদুরে গম্ভীর মেয়েটিকে তো এখন থেকে তাকেই পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখতে হবে। এখন যে সেও একজন মেয়ের বাবা। মেয়ের জন্য দেখে দেখে সবচেয়ে সুন্দর কিছু গহনা কেনে। তন্মধ্যে এই নুপুর জোড়া অন্যতম। কিন্তু ভাবতে পারেনি ঠুনকো এই নুপুর এতো সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে তার মেয়ের পা দুটোর। সে হাসিমুখে দোপাট্টা তুললো। সাথে সাথে ভেসে ওঠে চোখমুখ কুঁচকানো একটি গম্ভীর মুখ। মায়ের বুকে ঠেস দিয়ে বসে আছে। শ্রেয়ান চোখ তুলে তাকায় গম্ভীর মুখটির ঠিক উপরে আরেকটি মুখের দিকে। মা মেয়ে যে অপার সৌন্দর্য নিয়ে আজ হাজির হয়েছে। শ্রেয়ান অস্ফুট স্বরে মাশাআল্লাহ বলে উঠলো মা মেয়েকে দেখে।
শ্রেয়ান গম্ভীর মেয়েটির দিকে দৃষ্টিপাত করে। তার ছোট ছোট পা দু’টো একহাতে আঁকড়ে ধরে পায়ের পাতায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। আদুরে গলায় বলে,
–“গম্ভীর বাচ্চা! আজ থেকে তুমি আমার। আজ থেকে আমি তোমায় অনেক অনেক আদর করতে পারবো। কোন বাঁধা থাকবে না। তোমায় অনেক বিরক্ত করতে পারবো। কিন্তু শত বিরক্তির পরেও তোমায় দিনশেষে আমার বুকেই ঘুমাতেই হবে। কোথাও পালাতে পারবে না।”
উপস্থিত সকলে হো হো করে হেসে উঠলো শ্রেয়ানের কথায়। শ্রেয়ান প্রচন্ড অধিকারবোধের সাথে ইরামকেও কোলে তুলে নিলো। ছেলেকে দেখিয়ে ইরামের উদ্দেশ্যে বলে,
–“এটা তোমার ছোট ভাইয়া, শ্রবণ। তাকে সবসময় দেখে রাখবে।”
ইরাম তখনো অটল তার বিরক্তিতে। সে কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে তাকায় শ্রেয়ান আর শ্রবণের দিকে। শ্রেয়ান হেসে তার গালে শব্দ করে চুমু খেলে সে বিরক্তিকর শব্দ করে উঠলো।
*****
বৈবাহিক জীবন ইরার কাছে যুদ্ধের ন্যায়। আজ দ্বিতীয় বারের মতো তেমনি যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিয়ে জড়সড় হয়ে বসেছিল সে। কিন্তু! ইদানিং তার জীবনে অজশ্র কিন্তু’দের দেখা মিলছে।
জ্বরে কাবু ইরা কটনের একটি শাড়ি পড়ে বসে আছে বিছানায়। আঁচলের নিচে তখন একজন মনের সুখে চুক চুক শব্দ করে দুধ খাচ্ছে। ইরামকে সন্ধ্যার পর থেকে ইরা হাতে পায়নি। তবে তার একটুও চিন্তা হচ্ছে না মেয়ের জন্য।
ইরা মলিন হেসে ছোট্ট বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে শ্রবণ আঁচলের নিচ থেকে মুখ বের করে তাকায় ইরার দিকে। ইরা হেসে দিলে সেও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আবার মুখ লুকায় আঁচলের নিচে।
কিন্তু তার এই পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম আশ্চর্যজনক ঘটনা হয়ে আবির্ভাব ঘটলো সুমনার। খাবারের প্লেট হাতে সুমনা ব্যস্ত পায়ে ঘরে ঢুকলো। বলতে লাগলো,
–“আরে আম্মা, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তোকে খাইয়ে দেয়ার কথা। ওদিকে অতিথিদের বিদায় দিতে হয়েছে যে!”
ইরা শুধু মুখ নড়তেই দেখলো। সে অবুঝপানে সুমনার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সুমনা এসে বসে ইরার সামনে। মুহুর্তেই হতবুদ্ধি হয়ে গেল মুখের সামনে এক লোকমা বিরিয়ানি তুলে ধরতেই। ইরা অবাক, অপ্রস্তুত, ইতস্ততায় গুটিয়ে গেলো, পঁচিশ বছরের এই জীবনে মুখের সামনে কেউ খাবার তুলে ধরাতে। সে হতবুদ্ধি’র ন্যায় মাথা নেড়ে না করলো! সুমনা কপাল কুঁচকে শুধায়,
–“কি?”
ইরা খেতে চাইলো না। সে কি বাচ্চা নাকি! সুমনা কড়া দৃষ্টিতে তাকায়। ব্যান্ডেজ করা হাত দেখিয়ে বলে,
–“এই হাত দিয়ে খাবি কি করে? হা কর বোকা মেয়ে!”
সুমনা ধমকে লোকমাটা ঢুকিয়ে দিলো ইরার মুখে। ইরা অবাকের রেশ ধরেই খেতে লাগলো, কিছু বলার সাহস পায় না। কিন্তু অজানা সুখ আঁছড়ে পড়লো তার বক্ষজুড়ে। জীবনে কারোর থেকে সে এতোটুকু আদর পায় নি। অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও সকলের মুখে খাবার তোলার দায়িত্ব তার ই থাকতো সেখানে কেউ তার খোঁজ নিত না। কেউ খাইয়ে দিলেও যে নিজেকে এতোটা বিশেষ লাগে তা জানতো না ইরা। সুমনা তাকে খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে ইশারায় বলল,
–“আমি হাত ধুয়ে প্লেট রেখে আসছি। তারপর ঔষধ খাইয়ে দেবো।”
ইরা মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। সুমনা বের হয়ে যেতেই হুট করেই আগমন ঘটে ইরাম সহ শ্রেয়ানের। ইরা তাকে দেখতেই দ্রুত উল্টোদিকে ঘুরে বসলো। পুরো আঁচল দিয়ে দেহ ঢাকা থাকলেও আরো সতর্ক হলো। বিছানার এক কিনারায় গুটিয়ে বসে রইল। শ্রেয়ান তার হম্বিতম্বি দেখলো। তবুও নির্বিকার তার কাছে গিয়েই দাঁড়ায়, ইরামকে ঠিক তার পাশে বিছানায় রাখলো। চরম বিরক্তিকর মানুষটির থেকে ছাড়া পেতেই হুড়মুড়িয়ে মায়ের বুকে ঢুকে গেলো। কি এক নাছোড়বান্দা! তাকে ছাড়তেই চায় না। ইরামের কড়া দৃষ্টি দেখে শ্রেয়ান ঠোঁট চেপে হাসি আটকায়।
কিন্তু মায়ের কোলে যে কারোর দুর্ধর্ষ রাজত্ব চলছে। ইরামের দৃষ্টি টলমলে হয়ে উঠলো, একটু পরেই কেঁদে দেবে। ইরা হাসলো মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে। মেয়েকে একহাতে বুকে জড়িয়ে নেয়। ইশারায় মেয়েকে দেখিয়ে দেখাতে লাগলো শ্রবণকে। মেয়ের হাত দিয়ে শ্রবণের গায়ে আদর করে দিলো। ইরাম মায়ের বাধ্যগত মেয়ে ছোট থেকেই। মা যা করে সেও তাই করে। সে মায়ের দেখাদেখি অবুঝের মতো শ্রবণের গায়ে হাত ঘঁষে আদর করতে লাগলো। মেয়ের কাজে মুগ্ধ ইরা গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বুকে চেপে ধরলো।
তখনি তার দৃষ্টি আটকায় একজোড়া নিষ্পলক দৃষ্টির দিকে। শ্রেয়ানকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইরা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেলো। আঁচলটা আরেকটু টেনেটুনে নিলো। শ্রেয়ান স্মিত হাসলো তিন মা মেয়ে আর ছেলেকে দেখে। বিড়বিড় করে বলে,
–“আমার টুকি-টাকির মা।”
ইরা শুনলো না সেই আহ্লাদভরা “আমার” শব্দটি। শ্রেয়ান এগিয়ে গিয়ে কাবার্ডের ড্রয়ার থেকে দু’টো খাম বের করে ইরার হাতে দিলো। ইরা অবুঝ পানে তাকায় শ্রেয়ানের দিকে। শ্রেয়ান ইশারায় খুলে দেখতে বললো। ইরা একটি খাম খুললে একটি চিঠি বেরিয়ে আসলো। ইরা ভ্রু কুঞ্চিত তাকায় অদ্ভুত সম্বোধন দিয়ে শুরু সেই চিঠির দিকে।
“মিসেস ইরা শ্রেয়াংশু চৌধুরী! আমার জীবনে আমার স্ত্রী হিসেবে আপনাকে স্বাগতম। আমার মনে হয়, স্ত্রী হিসেবে আপনার সবটা জানার অধিকার রয়েছে। এটা জানার ও অধিকার রয়েছে আমি আপনাকে কেনো বিয়ে করেছি। যেই কারণ বিয়ের আগে আমি আপনাকে বর্ণণা করেছিলাম, সেই কারণে কিছু মিথ্যা জড়িয়ে ছিল ইরা। আজ আমি আপনাকে পরিপূর্ণ সত্যটা জানাতে চাই।
আর সেই সত্য হলো, আমি একবারের জন্য ও আমার সন্তানের সুখের কথা চিন্তা করে আপনাকে নিজের সাথে জড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করিনি। কখনো না। আমার সন্তানের হাজার দুঃখ দেখেও আমার মনে এই কখনো চিন্তা আসেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার একদিন মনে হয়, ইরা নামক সুন্দর এবং দৃঢ় মাতৃত্বের অধিকারী মেয়েটি একটু সুখ ডিজার্ভ করে। কেনো জানি না আপনার কষ্ট দেখলে আমার অস্থির লাগে, কেনো জানি আপনার দুঃখগুলোর উপশম নিজেকে মনে হয়। খুব ইচ্ছে করে আপনার পোড়া ঘা এর প্রতিষেধক হতে, ইচ্ছে হয় আপনার অশ্রু গুলো শুষে নিতে , ইচ্ছে হয় আপনার মুখে হাসি দেখতে, ইচ্ছে হয় আপনার অস্পষ্ট কথাগুলোকে সময় নিয়ে বুঝতে, ইচ্ছে হয় আপনার গম্ভীর মেয়েটার রাজ্যের বিরক্তির কারণ হতে, খুব ইচ্ছে হয় আপনার সুখ হতে। আমি নিজেকে দমাতে পারিনি আর না চেয়েছি। আমি জানতাম আপনি বিয়েতে রাজি হবেন না। তাই সন্তানের দোহাই দিয়ে আপনাকে অনুভূতিতে কাবু করে, আমি আপনাকে নিজের করে নিয়েছি। আমায় ভুল বুঝলে আমি দুঃখিত ইরা। কিন্তু আমার হঠাৎ করেই জেদ চাপে আপনাকে নিজের করতেই হবে। তারপর আপনার পুরো পৃথিবী জুড়ে দুঃখগুলোকে সুখে পরিণত হবে। কেনো জানি মনে হচ্ছিল এটা একমাত্র আমার’ই দায়িত্ব! আমি জানি না কেনো এমনটা হচ্ছিলো। তবে যে কারণেই হোক না কেনো আমি সেই অজানা কারণকে প্রশ্রয় দিতে চাই। প্রচুর পরিমাণে আস্কারা দিতে চাই। আমার টুকি-টাকির মাকে ফুরসৎ এর সাথে জানতে চাই। টুকি-টাকির বাবার সাথে পরিচিত হবেন তো, ইরা?”
ইরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল চিঠিটির দিকে। চোখ তুলে ঐ দৃষ্টিদ্বয়ের দিকে তাকানোর সাহস আর হয় না। হঠাৎ করেই লাজ আঁছড়ে পড়লো কেনো? জীবনে প্রথম কেউ ইরার সুখ হতে চেয়েছে বলে? এটা কি আদৌও সত্যি নাকি ভ্রম? অপর হাতের খামটি মন্থর গতিতে খুললে বেরিয়ে আসে দু’টো এক হাজার নোটের বান্ডিল। যেটা তার দেনমোহর!
ভাবুক ইরার গালে হঠাৎ করেই ঠান্ডা একটি হাত ঠেকলে হকচকায় ইরা। চমকে তাকায় শ্রেয়ানের পানে। শ্রেয়ান নির্বিকার ললাট সহ গলায় ও হাতের উল্টো পিঠ ছুঁইয়ে দেয়। হাত সরিয়ে বেডসাইড মিনি কাবার্ড থেকে ওষুধ বের করলো। পানির গ্লাস সহ একটা ওষুধ ইরার মুখের কাছে ধরলো। খাইয়ে দেয়া, ওষুধ এগিয়ে দেয়া এগুলো কেনো জানি অভাগী ইরা সহ্য সাদরে গ্রহন করতে পারছে না। তার জীবনে এতো সুখ একদম বেমানান! তবে নিশ্চয়ই এটা ক্ষনস্থায়ী! ইরা জানে এই ক্ষনস্থায়ী সুখ যদি সে সাদরে গ্রহণ করে তবে তাকে ভবিষ্যতে বাজেভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে।
ইরার ভাবুক, অপ্রস্তুত চাহনি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে পুরুষালী হাতটি জোরপূর্বক তার মুখে দু’টো ওষুধ ঢুকিয়ে দিলো। ইরার কপাল কুঁচকে একাকার হয়ে গেলো। শ্রেয়ান পানি তুলে দেয় তার মুখে। ইরাকে বাধ্য হয়েই পানি মুখে নিতে হয়।
দরজায় কেউ টোকা দিতেই শ্রেয়ান দরজার কাছে যায়। সুস্মিতা হাসিমুখে একটা ছোট্ট বাটি আর ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে। ভাইকে দেখে আদুরে গলায় শুধায়,
–“ছানা দুটো কি করছে ভাইয়া?”
শ্রেয়ান হেসে বলল,
–“একজন তার পছন্দের খাবার পেয়ে সেটি খেয়েই যাচ্ছে। আরেকজন মায়ের কোলে বসে আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে বারবার তাকাচ্ছে। আমি যেনো তাকে না ছুঁই, দূর থেকে শাসাচ্ছে আমায়।”
বলেই শ্রেয়ান হেসে ফেললো। সুস্মিতাও হেসে উঠলো। সে দেখছে ইরাম ভাইকে দেখলেই চোখমুখ কুঁচকে নেয়। সুস্মিতা হাতের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“ইরামের কাস্টার্ড ব্লেন্ড করে এনেছি। খাওয়াও ওর খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।”
শ্রেয়ান সেটি নিয়ে ঘরে আসে। সুস্মিতা আর ঢুকলো না। শ্রেয়ানকে আবার কাছে আসতে দেখেই ইরাম আবার কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। শ্রেয়ান মিটিমিটি হেসে একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে আসে ইরামকে। ইরাম রাগে চেঁচিয়ে উঠবে তার আগেই শ্রেয়ান তার ঘাগড়া ভেদ করে বের হয়ে থাকা পেটে মুখ ঘঁষে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো। কাঁদতে যাওয়া ইরাম কাঁদতে আর পারলো না বিরক্তিও লোকটির কারণে বরং খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। শ্রেয়ান মেয়েকে শূন্যে কয় পাক ঘুরিয়ে আনলো। ইরাম আনন্দে আর ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। শ্রেয়ান বুকে জড়িয়ে নেয় তাকে। ইরাম তৎক্ষণাৎ শ্রেয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মেয়েকে খানিক বশ করতে পেরে শ্রেয়ান দ্রুত কাবার্ডের কাছে যায়। কাবার্ড খুলতেই একঝাঁক মেয়েদের পোশাক সহ প্রয়োজনীয় সবকিছু বেরিয়ে আসলো। ইরা এতক্ষণ দেখছিল দুজনকে কিন্তু কাবার্ড খুলতেই সে অবাক হয়। ছোট মেয়ে বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় কোনকিছু বাদ নেই যা ওখানে নেই। বলাবাহুল্য ইরা আর ইরামের কোনকিছু আনতে দেয়নি শ্রেয়ান। তার মেয়ে স্ত্রীর সবকিছু তার দায়িত্ব যে!
শ্রেয়ান কাবার্ড ঘেঁটে একটা পাতলা ফ্রক, প্যান্ট ডায়পার বের করলো। ইরামকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ভারী ঘাগড়াটি খুলে ফেললো। ওয়াইপস দিয়ে ইরামের হাত পা মুখ মুছিয়ে, পুরো দেহে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে ডায়পার পড়ায় আর পোশাক পড়ায়। এই পুরোটা সময় ইরাম একদম নিশ্চুপ ছিল না। সে তো সুযোগ পেলেই ছুটে যায় মায়ের কাছে। শ্রেয়ান কতোশত গান , পোয়েম শুনিয়ে শুনিয়ে তাকে ধরে বেঁধে রাখে। অতঃপর ইরামকে নিয়ে খাবার প্লেট হাতে বারান্দায় নিয়ে যায়। লাইটিং দেখায়, গাড়ি দেখায় কতোশত মন ভোলানো কথা বলে কাস্টার্ডটা খাওয়ালো। দীর্ঘ আধা ঘন্টার যুদ্ধে সফল হয়ে শ্রেয়ান হাসিমুখে রুমে ঢুকলো। ইরার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আমাদের খাওয়া শেষ। এখন ঘুমানোর পালা।”
ইরা বুঝলো ছোট্ট সংলাপটি। বুঝতে পেরে মৃদু হাসলো।
তবুও আজীবন দাঁড়ে দাঁড়ে মাথা ঠুকে আসা অন্তঃস্থল থেকে ভয় যায় না। কখন এগুলো স্বপ্ন হিসেবে ধরা দেয়! ইরা শ্রেয়ানের দিকে হাত বাড়ায় বলে, ইরামকে দিতে। সে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। শ্রেয়ান নাকোচ করে বলল,
–“আপনি ঐ দুষ্টুকে ঘুম পাড়ান, আমি এই গম্ভীর বাচ্চাকে দেখে নেবো।”
ইরা বুঝতে পেরে আঁচলটা খানিকটা সরিয়ে দিলো। ছোট্ট শ্রবণ মায়ের আঁচলের নিচে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। শ্রেয়ানের বদন স্থবির হয়ে গেলো ছেলেকে আরাম করে মায়ের উষ্ণতায় ঘুমাতে দেখে। আর তার ছেলেটাকে খিদে পেটে ঘুমাতে হবে না। সে মৃদু হেসে লাইট নিভিয়ে ইরামকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। ইরাম কাঁধে মাথা তো রাখেই না বরং মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। শ্রেয়ান তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
“টগবগ টগবগ ঘোড়ায় চড়ে রাজার কুমার এলো!
রাজকুমারী তোমার মাথায় এতো চুল কে দিলো?
বলো বলো কে দিলো?”
শ্রেয়ানা আঙ্গিভঙ্গি করে বলল। ইরাম পছন্দের ছন্দটি শুনতেই মোচড়ানো থামিয়ে শান্ত হলো। শ্রেয়ান হেসে তাকে নিয়ে ঘরের এ মাথা থেকে ওমাথা হাঁটতে লাগলো। সাথে রয়েছে অজশ্র ছড়া আর গান। নাছোড়বান্দা সেই বিরক্তিকর লোক ইরামকে ছাড়বে না। এটা খুব জলদিই ইরাম মেনে নেয়। তাই সে নিরবে কাঁধে মাথা রেখে ছড়া শুনতে লাগলো। সেগুলো শুনতে শুনতে পনেরো মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো ইরাম। বিছানার দুই পাশে দু’টো দোলনা রাখা। একদিনের মধ্যে ঘরের অনেক কিছু বদলে ফেলেছে শ্রেয়ান। এখন তো আর এই রুম তাদের একার নয়। শ্রেয়ান একটা দোলনায় ইরামকে শুইয়ে দিলো। অতঃপর এগিয়ে আসে ইরার দিকে। শ্রবণকে বুকে নিয়ে ইরা চুপটি করে বসে ছিল। অন্তঃস্থলে গেঁথে বসা ভয় কাটিয়ে উঠার প্রয়াসে মত্ত সে। ইরার ভয়কে আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়ে শ্রবণকে নিয়ে নিলো শ্রেয়ান। ইরা আঁচল আঁকড়ে ধরে কাঠ হয়ে বসে রইল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পূর্ব সেই অতি স্বাভাবিক অস্বস্তিকর এক অভিজ্ঞতা। আজো তবে সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বিয়ের এই প্রথম রাতে ইরার জায়গা স্বামীর বক্ষতলে নয় বক্ষমাঝে হলো। বিছানার এক পাশে গুটিয়ে শুয়ে ছিল ইরা। কিন্তু অন্ধকারের মাঝে তার পিঠ ঠেকে গেলো প্রশস্ত এক বক্ষ। মাথাটি কেউ স্ব উদ্যোগে নিজের বাহুর উপর রাখতেই ইরা হকচকিয়ে তাকায় শ্রেয়ানের পানে। জড়িয়ে আসা দু’টো হাত আর নৈকট্যে ইরা অতিদ্রুত মুখ ফেরাতে বাধ্য হয়। মুখ ফেরাতেই একটি ফোনের স্ক্রিন ভেসে উঠলো। শ্রেয়ান ফোনটি তার মুখের সামনে ধরলে গোটা গোটা অক্ষর গুলো তার চোখে পড়লো। ইরার মাথায় গাল দাবিয়ে শ্রেয়ান ধীরস্থির লিখলো,
–“আগেই বলেছি টুকি-টাকির মাকে শুধুমাত্র বাচ্চাদের জন্য বিয়ে করিনি। এটা যতো জলদি মেনে নিবেন ততো বেশি ভালো হবে। তাই টুকি-টাকির বাবাকে অবহেলা করার চিন্তাও মাথায় আনবেন না। প্রতিদিন এতো টুকু স্পর্শের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিন ইরা। অস্বস্তি হলে দ্রুত তা কাটিয়ে উঠুন।”
পুরুষালী স্পর্শে অভ্যস্ত ইরা হঠাৎ করেই এই ভিন্ন পুরুষালী সংস্পর্শে হাঁসফাঁস করে উঠলো। পুরুষালী স্পর্শে এতো নম্রতা, ধীরস্থিরতা থাকে? তারা তো বৈধ স্ত্রীর উপর ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো হামলে পড়ে। ঠিক যেমনটা বিশ বছরের ইরার উপর প্রথম রাতে হামলে পড়েছিল, তার তথাকথিত প্রাক্তন স্বামী। তবে এই মানুষটার স্পর্শ এতো অনুভূতির জোগান কেনো দিচ্ছে? কেনো ঐ ঘাড়ে আঁছড়ে পড়া উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মাঝে লাজের আহরণ করছে? আলতো হাতে জড়িয়ে ধরায় ও রাজ্যের আহ্লাদ, নম্রতা। শাসনপ্রিয় এই পুরুষ গুলো স্ত্রীদের কখনো বাহুতে নিয়ে ঘুমায়? তবে এই লোক কেনো তাকে নিজের বাহুতে নিয়ে ঘুমাচ্ছে? তবে কি পুরুষে পুরুষে ভেদ রয়েছে? এটা কি সত্যি?
রাজ্যের প্রশ্ন, কৌতুহল নিয়ে নতুন অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ ইরা’র দিন শেষ হলো ঐ বক্ষমাঝে।
চলবে…