যে শ্রাবণে প্রেম আসে পর্ব-০৮

0
75

যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
||০৮||

চরম বিরক্তি থেকেই ভালোবাসা বোধহয় আরো তীব্রতর হয়। বদলে যাওয়া এই জীবনে, মা ব্যতীত ইরাম কারোর সাথে যদি একদম বন্ধুর মতো মিশে যায় সেটা হলো শ্রেয়ান। সুঠামদেহী ঐ পুরুষটিকে ছোট্ট মেয়েটির রাগ, কান্না, বিরক্তি সবকিছুর তোপে পড়তে হয়। আর শ্রেয়ান হাসিমুখে সেই রাগ বিরক্তির সামনা করে। কিন্তু মেয়েটিকে বিরক্ত করতে করতে কখন যে শ্রেয়ান তার ভরসা আর কম্ফোর্ট জোনে পরিণত হয়েছে তা বুঝতে পারলো না।

কর্মচারী ভরতি অফিসে শ্রেয়ান, ইরাম আর ছেলেকে নিয়ে ঢুকছিলো। তখন কিছু কর্মচারী ছুটে আসে অত্যাধিক সৌন্দর্যের মেয়েটিকে দেখতে। বরাবরের মতো মাথার বা পাশে একটা কালো টিপ দিয়ে রেখেছে শ্রেয়ান। কিন্তু যখনি ঐ মানুষগুলো বেবি ট্রলির দিকে ঝুঁকে গেলো ইরাম ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। রীতিমতো দাঁত খিটিমিটি করছে ভয়ে। শ্রেয়ান নিজেও ভয় পেয়ে গেলো। সে অতিদ্রুত মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। আদর করে বলে,
–“মা, ভয় নেই পাপা আছি তো।”

কান্না করতে করতে পরিচিত বিশ্বস্ত মুখটি দেখতেই ইরাম আরো ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে উঠলো। আহ্লাদে, রাগে সবেগে শ্রেয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। বাবার শার্টটা হাতের মুঠোয় কুঁচকে নিলো। বিবর্ণ মুখশ্রী হলেও শ্রেয়ানের বুক জুড়ে প্রশান্তি নেমে আসলো মেয়ের আগ্রাসী আচরণে। এই তো ছোট্ট মনটিতে তার জন্য স্থান তৈরি হচ্ছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে; এ যাত্রায় হয়তো গম্ভীর মেয়েটির বাবা হয়ে ওঠার পথটা খুব বেশি কঠিন নয়। বেল্ট দিয়ে বুকে বাঁধা শ্রবণ তখন টুকটাক করে বোনের কান্না দেখছে। দু’জনকে একসাথে নিতে বেগ পেতে হলেও শ্রেয়ান সামলে নিলো। মেয়ের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
–“আঙ্কেলদের আমি বারন করে দিচ্ছি মা। দেখো, কেউ তোমায় ছুঁয়ে দেবে না।”
বলেই শ্রেয়ান মেকি রাগ দেখিয়ে ইমপ্লয়িদের বলল,
–“পঁচা আঙ্কেলরা! বকা বকা, আমার মা’কে ধরবে না। সে ভয় পাচ্ছে।”

শ্রেয়ান উচ্চস্বরে ধমকে দিতেই ইরাম কাঁধ থেকে মাথা তুলে আড়চোখে তাকায় লোকগুলোর দিকে। সকলে চলে গিয়েছে দেখতেই তার কান্না কমে আসলো। সে টলমলে চোখে বাবার দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে রাগ নেই রয়েছে নম্রতা। শ্রেয়ান তার চোখ মুছিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদর করে দিলো। প্রচন্ড অধিকারবোধের সাথে বলল,
–“এতো ভয়ের কিছু নেই তো মা। পাপা সবসময় তোমার সাথে আছি। কেউ তোমায় আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”
অবুঝ মেয়েটি হয়তো বুঝলো না আশ্বাসের সেই বানী। তবে এতো টুকু বুঝলো এই মানুষটার কাছে সে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ! সে থমথমে মুখে শ্রবণের দিকে তাকায়। শ্রেয়ান তার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বলে,
–“ভাই, তোমায় দেখছে। তাকে আদর করে দাও।”

ইরাম পিটপিট করে তাকায় শ্রবণের দিকে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“ভা ভা!”
শ্রেয়ানের চোখ চকচক করে উঠলো মেয়ের কথায়। সে উজ্জ্বল দৃষ্টি ফেলে বলল,
–“আমার মা দেখি ভাই বলছে। বলতো মা পাপা—পা পা, বলো।”
ইরাম শ্রেয়ানের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
–“পাহ….পা।”

শ্রেয়ান আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলো। মেয়ের গাল চেপে উল্লাসে চুমু দিয়ে বলে,
–“আমার মা পাপা বলতে পারে, ভাই বলতে পারে; কতো বড়ো হয়ে গিয়েছে।”

ইরামের নম্রতা উবে গেলো সে তৎক্ষণাৎ কড়া দৃষ্টিতে তাকায় বাবার দিকে। তাকে চুমু দিয়েছে আবার? শ্রেয়ান ফিক করে হেসে উঠলো মেয়ের কপাল কুঁচকানো কড়া দৃষ্টি দেখে।

দুপুর একটা দশ। শাহেদ চৌধুরীর বুকে ঘুমন্ত ছেলেকে দেখতেই ইরা চঞ্চল পায়ে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। শাহেদ চৌধুরী মৃদু হেসে ইশারায় বলল,
–“পথে ঘুমিয়ে পড়েছে।”

ইরার মুখশ্রী চিন্তিত। ছেলেটা খেয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টা আগে। না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলো? সে দ্রুত ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মুখে দুধ দিলে সে ঘুমের মধ্যেই চুক চুক শব্দ করে খেতে লাগলো। শ্রেয়ান পিছু পিছু মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। শাহেদ চৌধুরী অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকায় নাতনির দিকে। আবদার করে বলে,
–“একটু দাদুভাইয়ের কাছে এসো।”

ইরাম ছোট ছোট আ’ত’ঙ্ক ভরা দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তৎক্ষণাৎ মুখ লুকায় বাবার বুকে। শ্রেয়ান ম্লান হাসলো। তাকে ছাড়া আর কারোর কাছে যেতে চায়না।সে মেয়েকে নিয়ে ঘরে আসে। ইরার মাঝে জড়তা খানিক কমছে। তাই আজ আর তার মধ্যে কোন অস্থিরতা দেখা গেলো না। বরং নিরবেই শ্রবণকে খাওয়াতে মগ্ন হলো। শ্রেয়ান উদাস দেহ টেনে হাতে থাকা প্যাকেটটা ইরার কোলে রাখলো। অতঃপর মেয়েকে বুকের উপর বসিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ইরা দেখলো শ্রান্ত দেহের মানুষটাকে। প্যাকেটটা নেড়েচেড়ে দেখে বুঝলো এটাতে বারবিকিউ মমো’স রয়েছে। ইরা মৃদু হাসলো। একদিন শ্রেয়ানের সাথে বাইরে গিয়েছিল তখন এই খাবারটা সে খুব মজা করে খেয়েছিল। তার পর থেকে শ্রেয়ান যখনি বাইরে যাবে ফিরে আসবে হাতেকরে কিছু মমো’স নিয়ে‌। মানুষটার ভাবনায় ইরা নামক বোবা বধির মেয়েটি কি সবসময় থাকে? তার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই ঘুমন্ত ছেলেকে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে দেয়। রুম থেকে বেরিয়ে যায় দ্রুত কদমে। ফিরে আসে এক কাপ চা হাতে। শ্রেয়ান চা দেখে উঠে বসে, চায়ের কাপটা হাতে নেয়। ইরা মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে অস্ফুট শব্দ করলো। শ্রেয়ান মেয়েটির চোখের দিকে তাকায়। ইরার কাছে বড্ডো উদাসীন ঠেকলো সেই দৃষ্টি। এক পা এগিয়ে যায়। হাত গলিয়ে দেয় শ্রেয়ানের চুলের মাঝে। মাথা নেড়ে ইশারায় শুধায়,
–“কি হয়েছে?”
শ্রেয়ান ম্লান হেসে চায়ের কাপটা রেখে দু’হাতে মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। ইরা হতচকিত হয় উদরে উত্তপ্ত মুখটি ঠেকে যেতেই। তবুও নির্বিকার চুলগুলোতে হাত বুলাতে লাগলো। মায়ের দেখাদেখি ইরাম ও বাবার চুল টানতে লাগলো। ছোট ছোট হাতের স্পর্শে শ্রেয়ান মাথা তুলে তাকায়। হেসে মেয়ের পা দুটো আঁকড়ে তাতে শব্দ করে চুমু খায় বলে,
–“আমার ছোট্ট আদুরে বুড়ি।”

পরপরই পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ইরার সামনে তুলে ধরে। ইরা অবুঝ দৃষ্টিতে তাকায় কাগজটির পানে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা থেকে কোন নোটিশ। শ্রেয়ান ফোন বের করে কিছু লিখে ইরার মুখের সামনে ধরলো।
–“জবের থেকে নোটিশ এসেছে। আগামীকাল মেডিক্যাল চেকআপ সহ কিছু অফিশিয়াল কাজ রয়েছে। সেগুলো যদি নিখুঁত থাকে তবে—পোরশু থেকে জবে জয়েন করতে হবে। আর এই সপ্তাহেই হয়তো ফ্লাইটের শিডিউল ও এসে যাবে। উড়োভাসা শুনেছি শিডিউল টাফ হবে! আমায় লম্বা সময়ের জন্য বাইরে থাকতে হবে।”
ইরার মুখশ্রী চকচক করে উঠলো। ঠোঁট দুটি অনতিবিলম্বে বিস্তৃত হয়ে গেলো। প্রফুল্ল হেসে অস্ফুট স্বরে কিছু বলল। শ্রেয়ান ঠোঁট উল্টালো স্ত্রীর উল্লাস দেখে। আলগোছে পুনরায় জড়িয়ে ধরে। উদরে মুখ গুঁজে জড়ানো উদাসীন কণ্ঠে বলল,
–“আমার থেকে দূরত্ব আপনাকে এতো খুশি কেনো করে বিবিজান? আমার যে ইচ্ছে করে না আপনাদের ছেড়ে থাকতে।”

মোহনীয় সেই কথাগুলো অগোচরেই থেকে গেলো দৈহিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। ইরা’র কণ্ঠনালী রোধ হয়ে আসে উদরে কাঁটা কাঁটা দাঁড়িগুলো উগ্রভাবে স্পর্শ করতেই। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতিগুলো বড্ডো আলাদা। এই মানুষটার স্পর্শ বড্ডো আদুরে; যেখানে চাহিদা নয় ভালোবাসা মিশ্রিত স্পর্শ থাকে। হুটহাট পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়া, কোলের উপর শুয়ে পড়া এগুলো তার কাছে নতুন! একদম নতুন! পূর্ব অভিজ্ঞতা তো ছিল বড্ডো বিদঘুটে বিতৃষ্ণা ময়; যখন সংসারের সকল কাজ শেষ করে সারাদিন পরে বিছানায় পিঠ এলাতো তখন লোকটা রুক্ষ কণ্ঠে অনুভূতিহীন ভাবে বলতো,
–“কাপড় খোল!”
যখন না বুঝতো তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা, তারপর সেই রাগ তার ক্লান্ত দেহের উপর মিটানো। সংসার জীবন থেকে অনুভূতি উঠে গিয়েছিলো; তখন হঠাৎ ই এক শ্রাবণে আগমন ঘটে এক অন্য ব্যক্তিত্বের মানুষের। যে আজ পর্যন্ত তার কাছে পুরুষালী চাহিদা নিয়ে হাজির হয়নি। বরং দু’হাত ভরতি মুগ্ধতা নিয়ে হাজির হয়। বিশ দিনের এই সংসারে আজ সকালেই তার করা প্রথম স্পর্শ ছিল তার ললাট বরাবর। যেই স্পর্শে তার ভঙ্গুর মন হঠাৎ ই মুখ থুবড়ে পড়লো। বড্ডো ইচ্ছে হয় লোকটার কথা শুনতে। যার কর্মকাণ্ড এতো আদুরে, আহ্লাদ মাখা তার কণ্ঠেও নিশ্চয়ই ভরপুর আদর হবে? গলার আওয়াজ কেমন? তাকে কি নামে ডাকে? একটু যদি শুনতে পেতো? তবে কেমন হতো? সে কি খুব লজ্জা পেতো? লজ্জায় পড়ে নিজেকে সপে দিতো তার বাহুডোরে?

উদরে পুনরায় রুক্ষ মুখটি ঘঁষে দিতেই ইরা হকচকায়। লালচে আভাযুক্ত মুখশ্রী লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো! শ্রেয়ান মুখ তুলে তাকায় ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি। ইশারায় ভ্রু নাচায়। ইরা না বোধক মাথা নেড়ে বোঝালো কিছু না। শ্রেয়ান আক্ষেপ ভরা কণ্ঠে আবার শুধায়,
–“আপনি খুব খুশি তাই না?”

ইরা বুঝতে পারলো বলে, মাথা নাড়লো ঘনঘন। শ্রেয়ান নিদারুণ যন্ত্রনা নিয়ে বলল,
–“আপনি বড্ডো নির্দয় ইরা।”

ইরা এটাও বুঝলো। বুঝতে পেরে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো।
শ্রেয়ান ডানে বামে মাথা নাড়ে স্ত্রীর উৎফুল্লতা দেখে।

ঘটনাটা ছিল দুই সপ্তাহ পূর্বের। নতুন ঘরটিতে একটু একটু করে পরিচিত হয়ে ওঠা ইরার হঠাৎ নজরে আসে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা একটি ফটোফ্রেম। ছেলেকে দোল দিতে দিতে সে এগিয়ে যায় নিজের ঘরের বা পাশের দেয়ালটির কাছে। তার চোখে শ্রেয়ান পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন একজন পুরুষ! কারণ তার দৈহিক বরণ, গঠন নজরকাড়া। তার থেকেও ফর্সা! পেশায় একজন পাইলট এর বাহ্যিক সৌন্দর্য বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। সাদা ফুল হাতার শার্টটির কাঁধে কালো অ্যাপোলেটের উপর স্বর্নালী স্ট্রাইপ জ্বলজ্বল করছে। সুঠামদেহী সুশ্রী গড়নের পরিপাটি আভুষনে আবৃত মানুষটা হাস্যোজ্জ্বল মুখটি নিয়ে ককপিটে বসে আছে। ইরা বড়ো বড়ো নয়নে, সম্মুখের সাদা মেঘে মেঘে ঢাকা এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে আবৃত আকাশ দেখছে। মানুষটা আকাশ ছোঁয়? খুব আশ্চর্য হয় ইরা! এই আকাশ ছোঁয়া মানুষটা নাকি তার মতো অভাগী মেয়ের স্বামী?
কাঁধে কেউ অলস গতিতে থুতনি রাখতেই ইরা হকচকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে শ্রেয়ানের মুখটি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ইরামকে কোলে নিয়ে শ্রেয়ান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। হোয়াইট বোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,
–“কি দেখছিলেন?”

ইরা তার ঠোঁটের নড়চড় দেখে আঙুল তাক করলো ফটোফ্রেমটির দিকে। বুড়ো আঙুল আর শাহাদাত আঙুল এক করে হাত দিয়ে বোঝালো ওয়াও! ওয়াও!
শ্রেয়ান নিজের ছবিটি একপলক দেখলো। স্মিত হেসে শুধায়,
–“ওয়াও! ওয়াও?”

ইরা মাথা নেড়ে সায় জানালো। শ্রেয়ান আবার শুধায়,
–“আপনার ভালোলেগেছে?”

ইরা তৎক্ষণাৎ ঘনঘন মাথা নাড়লো। রাজ্যের উৎফুল্লতা নিয়ে চোখ বড়বড় করে অস্ফুট স্বরে আ উ শব্দ করে অনেক কিছু বলল। শ্রেয়ান অসহায়ত্ব অনুভব করলো তেমন কিছু বুঝতে না পেরে। সেই অসহায়ত্বের রেশ ধরেই মার্কার কলমটি এগিয়ে দিলো। ইরা বুঝতে পেরে এক পলক থমকালো। পরমুহূর্তেই হেসে ফেললো। উৎকণ্ঠা নিয়ে বোর্ডে লিখলো,
–“আপনি কি পাখিদের মতো আকাশে উড়েন? খুব আনন্দ হয় নিশ্চয়ই? মেঘ ছুঁতে পারেন? আপনি কি ঐ বিশাল প্লেনটিকে উড়াতে পারেন? আপনি তো খুব শক্তিশালী! আমার না খুব ইচ্ছে আপনাকে আকাশে উড়তে দেখার। আমি সবাইকে বলবো শ্রবণ আর ইরামের বাবা আকাশে উড়ে বেড়ায়! কি সুন্দর হবে বলুন! কিন্তু…আমি তো বলতে পারি না। সমস্যা নেই ইরাম আর শ্রবণ বড়ো হয়ে বলবে তাদের বাবা ঐ দূর আকাশে উড়ে বেড়ায়! সবাই তখন নিশ্চয়ই অনেক অবাক হবে!”

চোখেমুখে শিশু সুলভ আদল স্পষ্ট। কণ্ঠ নিশ্চয়ই অবুঝ শোনাতো? তবে এই অবুঝের ন্যায় নিজের আনন্দ উৎফুল্লতা ব্যক্ত করতে পারা ইরা’র চোখেমুখে রাজ্যের কৌতুহল। শ্রেয়ান মুগ্ধ হয় সেই শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস দেখে। চোখ মুদে নেয় সেই অপার্থিব সৌন্দর্য। মোহিত কণ্ঠে শুধায়,
–“আপনি আকাশে উড়বেন?”

ইরা বুঝলো সহজ এবং ছোট্ট সংলাপটি। সৌজন্য হেসে না বোধক মাথা নাড়লো। শ্রেয়ান কপাল কুঁচকে শুধায়,
–“কেনো!”

ইরা বোর্ডে লিখলো,
–“এতো কপাল আমার আছে নাকি! আমি যেটুকু পেয়েছি তাতেই সন্তুষ্ট। আমার স্বামীকে ঐ দূর আকাশে উড়তে দেখাই আমার স্বার্থকতা!”

লেখাটির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো শ্রেয়ান। দৃষ্টি অম্লান— অথচ দেহাবয়ব ম্লান। জীবনে এমনি একটু সমর্থন চাইতো সবসময়। যে তার প্যাশনকে নিজের প্যাশন মনে করবে। যে তার খুশিতে নিজের খুশি খুঁজে নেবে। মেয়েটির চকচকে দৃষ্টি তখনো শ্রেয়ানের দিকে। শ্রেয়ান ম্লান হেসে আলগোছে ছেলে সহ টেনে নেয় মেয়েটিকে বুকে। ইরার পিঠ ঠেকলো শ্রেয়ানের বুকে। ইরা নিরুদ্বেগ শান্ত চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকলো। পুনরায় বোর্ডে লিখলো,
–“আপনি আর চাকরি করবেন না?”

শ্রেয়ান নিরুদ্বেগ বোর্ডে লিখলো,
–“চাকরি করলে আপনাদের সময় দেবো কি করে? আপনি একা একা দু’জন নিয়ে পেরে উঠবেন না।”

ইরা কপাল কুঁচকে তৎক্ষণাৎ লিখলো,
–“এ কেমন কথা! কাজ হলো পুরুষ মানুষের সৌন্দর্য, মর্যাদা, শিড়ঁদাড়া সোজা করে চলার একমাত্র মাধ্যম। পৃথিবীর সবাই করে। তারা কি পরিবারকে সময় দেয় না? কাজ করে দিনশেষে যখন ক্লান্ত বদনে বাড়িতে ফিরবেন তখন পরিবার আপনার সেই ক্লান্তি দূর করবে। এটাই সৌন্দর্য! আর আমি একা কোথায় মা, বাবা মিলা আছে। আমি পারবো! এর থেকেও বিশাল আর কঠিন দায়িত্ব পালন করে এসেছি।”

মেয়েটির মাথায় ঠেকানো শ্রেয়ান থুতনি। অলস গতিতে বেঁকে যায় শ্রেয়ানের ওষ্ঠদ্বয়। লিখলো,
–“দিনশেষে কেউ যদি তার নরম স্পর্শ মাখা যত্ন দিয়ে ক্লান্তি দূর করে তবে কাজ না করে তো উপায় নেই। টুকি-টাকির মা কি তা পারবে?”

ইরা হেসে উঠলো। চঞ্চল হাতে লিখলো,
–“খুব পারবে!”

–“তবে তো কাল থেকেই কাজে লেগে পড়তে হবে!”, শ্রেয়ান লিখলো। সেখান থেকেই শ্রেয়ানের কর্মক্ষেত্রে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই কর্মক্ষেত্রে বিগত ছয় বছর ধরে শ্রেয়ান কর্মরত। অভিজ্ঞ এবং স্বনামধন্য। দুই সপ্তাহ লেগে গেলেও তার কর্মক্ষেত্র থেকে তার তলব আসে।

রুমের দরজায় কেউ নক করতেই শ্রেয়ান ধ্যানচ্যূত হলো। সুমনা হাঁক ছেড়ে বলল,
–“শ্রেয়ান দেড়টা বেজে গিয়েছে বাবুদের দে আমি গোসল করিয়ে ফেলি।”

শ্রেয়ান গলা উঁচিয়ে বলল,
–“ভেতরে এসো মামনি।”

সুমনা মাথা ঢুকিয়ে বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলল,
–“কতোবার বলি বারোটার মধ্যে ওদের গোসল করাবি। দেড়টা বেজে গিয়েছে, ঠান্ডা লেগে যাবে।”

শ্রেয়ান বিছানা ছেড়ে উঠে বলল,
–“আজ একটু দেরি হয়ে গেল। শ্রবণ ঘুম! ওকে আজ গোসল করানোর প্রয়োজন নেই। তুমি ইরামকে করিয়ে দাও।”

সুমনা নাতনিকে নিয়ে নিজের বাথরুমে ঢুকলো। ইরা গেলো রান্নাঘরে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো, ইরাম পানি দেখতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দিলো। শ্রেয়ান মাত্র ই কাপড় বদলাতে নিয়েছিলো। মেয়ের চিৎকারে সে কোমড়ে গামছা নিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেলো। এক দৌড়ে মায়ের ঘরে যেতেই ইরাম সবেগে ঝুঁকে গেলো তার দিকে। সুমনা হতবাক! সে অবাকের সুরে শুধায়,
–“কি হলো পানি দেখতেই কাঁদলো কেনো?
শ্রেয়ান মেয়েকে কোলে নিতে নিতে বলল,
–“পানি দেখলে ভয় পায় মামনি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম বলতে। তাকে কলাকৌশলে গোসল করাই আমি। দেখবে? আসো!”

শ্রেয়ান হেসে বলল। উদাম গায়ে সে বাথরুমে ঢুকে গেলো। ইরাম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশপাশে অবলোকন করে অতঃপর ঠাঁটিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইল। শ্রেয়ান ধীরে ধীরে উষ্ণ পানি নিজের গায়ে ঢালতে লাগলো। ওমনি বাচ্চা মেয়েটি ছটফটিয়ে উঠলো। তবুও ভয় তাকে গ্রাস করতে পারলো না কারণ সে জানে সে বিশ্বস্ত একটি বুকে আবদ্ধ। সুমনা ডানে বামে মাথা নাড়লো। বলল,
–“বাবার তো চাকরি শুরু হয়ে যাচ্ছে।‌ তখন কিভাবে গোসল করাবো?”

শ্রেয়ান মলিন হেসে মেয়ের ভেজা পল্লবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। বলে,
–“মা দাদুমনিকে বলো, আমাদের দুঃখী করো না। আজকের দিনটা তো আমাদের উপভোগ করতে দাও। কালকের টা কালকে দেখে নেবো।”

সুমনা হেসে উঠলো। বাবা মেয়ের এমন অজশ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত ধীরে ধীরে জীবনের সুখের খাতায় লিপিবদ্ধ হতে লাগলো। তেমনি মাতৃদুগ্ধ হারা ছেলেটির জীবনে যুক্ত হয় মায়ের উষ্ণ কোল, পেট ভরে সুস্বাদু খাবার খাওয়ার আনন্দঘন মুহুর্তগুলো। একে একে সকল ক্লেশ কাটতে লাগলো কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে যাওয়া দুটি মানুষের জীবন থেকে। পরদিন শ্রেয়ান মেডিক্যাল চেকআপ সহ অফিশিয়াল সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে। এবং সেখান থেকে সুনিশ্চিত হয়ে বাড়িতে ফিরলো আগামীকাল থেকে তাকে জবে জয়েন করতে হবে। সেই নিয়মানুযায়ী শ্রেয়ান পরদিন সকালে যথারীতি কর্মক্ষেত্রে ফিরলো। তার এক সপ্তাহের মধ্যেই শ্রেয়ানের ফ্লাইটের শিডিউল ও এসে যায়।

সেদিন বুধবার। এফ.এ.এ (ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনিস্ট্রেশন) এর তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ফ্লাইটটির উড্ডয়নের ভারপ্রাপ্ত শ্রেয়ান। দুপুর তিনটায় শ্রেয়ান ব্যাগপত্র গুছিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজের রুম থেকে বের হয় শ্রেয়ান। মুখটি খানিক মলিন তার। ভরপুর এই সংসারটা ইদানীং তারমাঝে অলসতা সৃষ্টি করছে। ইচ্ছে করে জনমভর তাদের হাসি দেখে দিন কাটাক। শ্রেয়ানের মলিনতা আরেকটু বাড়িয়ে দিলো মায়ের মলিন মুখ আর মেয়ের কড়া দৃষ্টি। সকাল থেকে তার উপর ক্ষেপে আছে মহারানী। বহুবার আহ্লাদ করেছে, জিজ্ঞাসা করেছে কিন্তু মেয়ের থেকে বিন্দুমাত্র পাত্তা পায়নি শ্রেয়ান। তার মন খারাপে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো হাস্যোজ্জ্বল মুখে ইরা ঘর থেকে তার ট্রলিটা টেনে বের হতেই। শ্রেয়ান মুখ বিকৃত করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তার পানে। কতো বড়ো নির্দয় নারী হলে স্বামীর যাত্রাকালে দাঁত কেলিয়ে হাসে! শ্রেয়ানের অমন দৃষ্টি দেখে ইরা খানিক ভড়কালো। ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,
–“কি?”
শ্রেয়ান জবাব দিলো না মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইরা কাঁধ ঝাঁকালো। সুমনা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
–“আয়াতুল কুরসি পড়তে ভুলবি না কিন্তু! নিজের খেয়াল রাখবি। আমায় প্রতি মিনিটের খবর পাঠাবি। দেখ শ্রেয়ান ব্যস্ততার অজুহাত যেনো আমি না শুনি।”

শ্রেয়ান হাসলো। বিগত বহু বছর ধরে এই এক কথা শুনতে শুনতে সে অভ্যস্ত। সে ঘাড় কাত করে মেয়ের দিকে তাকায়। থমথমে মুখ ইরামের। মায়ের বুকে বসে তার দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে আছে। শ্রেয়ান কপাল কুঁচকে শ্রবণকে একটা চুমু দিয়ে তাকে মায়ের কোলে দিয়ে দিলো। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“মায়ের বুকে বসে দাপট দেখানো হচ্ছে? কি ভেবেছো ওখানে থাকলে আমি তোমায় ছুঁতে পারবো না? তবে তুমি ভুল! এই দেখো..”

বলেই শ্রেয়ান ইরার বুক থেকে বাজপাখির মতো ছিনিয়ে আনলো ইরামকে। ইরাম বড়োসড়ো এক চিৎকার জুড়ে দেয়ার আগেই, শ্রেয়ান তাকে সোফায় শুইয়ে দিয়ে অঝোরে চুমু দিতে শুরু করলো। পেটে দাঁড়িযুক্ত মুখটি ঘঁষে দিতেই ইরাম বিরক্তি আর রাগে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু তবুও শ্রেয়ান ছাড়লো না। চুমুর বর্ষন তখন আদর আর বিদায় বেলার
বেদনায় পরিণত হলো। মেয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরে শ্রেয়ান ছলছল নয়নে বলল,
–“পাপার গম্ভীর বাচ্চা! পাপা তোমায় খুব মিস করবো। গোসল করতে গেলে, খেতে গেলে, ঘুমাতে গেলে তোমার কথা খুব মনে পড়বে। তোমার দুষ্টু ভাই তো মাকে পেয়ে আমায় ভুলে গিয়েছে। কিন্তু তুমি আমায় ভুলে যেওনা ঠিক আছে? পাপা এসে আবার তোমার সব কাজ আমি করবো, আচ্ছা?”

শ্রেয়ান মেয়েকে আরো দীর্ঘক্ষণ আদর করে উঠতে গেলে তার কলারটা আঁটকে গেলো ছোট্ট হাতের মুঠোয়। ইরাম অশ্রুসিক্ত নয়নে শ্রেয়ানের কলার চেপে ধরে শুয়ে আছে। শ্রেয়ান ম্লান হেসে মেয়ের ছোট্ট বুকটিতে আলতো মাথা রেখে বলল,
–“পাপাকে যেতে দেবে না? পাপা থাকবো তোমার কাছে?”

–“পাহ…পা….পা…পা।”, হঠাৎ করছি ইরাম সুর টেনে টেনে পাপা বলতে লাগলো‌। শ্রেয়ান খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। মাকে আর ইরাকে দেখিয়ে বলল,
–“দেখেছো আমায় পাপা বলেছে। আমি বলেছিলাম না ও আমায় পাপা বলে।”

ইরা অবুঝপানে তাকিয়ে রইল হাসিমাখা মুখটির দিকে। তবে আনন্দের কারণ যে তার মেয়ে এটা বুঝতে পারলো। মলিন হাসলো সে। অন্তরালে সবসময় একটা প্রার্থনাই এই সুখ যেনো স্থায়ী হয়। সুমনা ছেলের খুশি মনভরে দেখলো। সময় ফুরিয়ে আসে। ছেলের ব্যাগপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শাহেদ চৌধুরী তাড়া দিলো ছেলেকে।
–“ওদিকে তোমার সময় সংকটে পড়তে হবে শ্রেয়ান। তাড়াতাড়ি বের হও।”
ছেলে মেয়েকে আদর করে শ্রেয়ান উঠে দাঁড়ায়। দরজা পর্যন্ত যেতে যেতে কয়েকবার পিছু ফিরে তাকায় ইরার হাস্যোজ্জ্বল মুখটির দিকে। উশখুশ কর অন্তঃস্থল সামলে উঠতে পারলো না শ্রেয়ান। মনটা যে পড়ে থাকতে চায় ঐ মানুষটার আশেপাশে। নিজেকে দমাতে দমাতে লিফট পর্যন্ত গেলেও শ্রেয়ান আর পারলো না। সে ট্রলি ছেড়ে বাবাকে বলল,
–“পাপা, আমি মানিব্যাগ আনিনি আমার সব কার্ড সেখানে। তুমি নিচে যাও আমি আসছি।”

–“সেকি? সবকিছু মনে করে গুছিয়ে নেবে না? কেমন কান্ডজ্ঞানহীন তুমি!”

–“আহ্, যাওয়ার সময় বকছো কেনো?”, শ্রবণকে কোলে নেওয়া সুমনা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল। শ্রেয়ান দ্রুত কদম ঘরের দিকে ফেলতে বলল,
–“তোমরা আগাও আমি মানিব্যাগ খুঁজে নিয়ে আসি‌। ইরা আমার মানিব্যাগটা দিন।”

চেঁচিয়ে বলতে বলতে শ্রেয়ান ছুটে গেলো ঘরে। মিলা ইরামকে নিয়ে সুমনা আর শাহেদের সাথে নেমে গেলো।

শ্রেয়ান হাওয়ার বেগে ঘরে ঢুকলো। ইরার হাতটি মুঠোবন্দী করে টানতে টানতে তাকে নিয়ে ছুটতে লাগলো। ইরা আশ্চর্য হয়। ছুটতে ছুটতে অস্ফুট স্বরে আ উ শব্দ করে কতোকিছু বলছে সে। নিজেদের কক্ষে ঢুকতেই দরজাটি সবেগে বন্ধ হয়ে গেলো। উগ্র হাতে কেউ এক পাক ঘুরিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজায় লেপ্টে গেলো ইরার পৃষ্ঠদেশ। সে কি দূর্যোগ! নিজেকে সামলে ওঠার আগেই বিলম্বহীন এক অকল্পনীয় কান্ড ঘটে যায়। এতোটা অস্থিরতা, অধৈর্য্যতা? ইরা আশ্চর্য, হতভম্ব হওয়ার সুযোগ টুকু পেলোনা গভীর থেকে গভীরতর সেই স্পর্শের টানাপোড়েনে। আগ্রাসী দু’টো ওষ্ঠ ভঙ্গুর মেয়েটির সদ্য প্রেমে পড়া মিঠা মিঠা সেই প্রেমময় সুধা’র আস্বাদনে মত্ত। ঠিক যেনো বুনো ভীমরূল! মধু আস্বাদনে সে নির্দয়! চারম নির্দয়!
আস্তিন আঁকড়ে ধরা মেয়েটির হাত আর শক্ত হওয়ার উপায় খুঁজে পেলোনা। প্রতিটা স্নায়ু সরব নিশ্চল হয়ে পড়ছে। এমন কখনো হয়নি! কখনো না। দু’গাল গড়িয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই নম্র স্পর্শে। দু’গালে পুরুষালী দুই হাত বিগ্রহ লেপ্টে দিলো।
প্রেমের সেই প্রারাম্ভ ঠিক যেনো পশ্চিমা হাওয়ার ন্যায় তীব্র তান্ডব চালালো ইরা’র মাঝে। বাহু গড়িয়ে পুরুষালী দু’হাত ঠেকলো নগ্ন কোমড়ে। ললাটে ললাট ঠেকলো, নাকে নাক। বদ্ধ নেত্রে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে শ্রেয়ান ফিসফিসিয়ে বলল,
–“আই উইল মিস ইউ, ইরা! আমার জীবনের আগত প্রতিটা মুহূর্ত আরো দুঃসহ করে তুলবে আপনার থেকে আর আপনার সন্তানদের থেকে দূরত্ব। ইশ্! আপনি নিদারুণ যন্ত্রনা দিতে জানেন ইরা। এর শোধ আমি নেবো ফিরে এসে। আমার অপেক্ষায় থাকবেন।”

এতো এতো মোহনীয় শব্দ আবেগের সাথে পেরে না উঠেই বেরিয়ে আসে। নয়তো বাস্তবিকতা যে নিষ্ঠুর! এই মোহনীয় শব্দগুলো একটুও আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলো না ইরার মাঝে। সে তো তখনো বদ্ধ নেত্রে সেঁটে আছে। চোখের পাতায় ছুঁয়ে গেলো দুটি ভেজা ঠোঁট। পরপরই নাকের ডগা। দু’টো দেহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেই ইরা তড়াক দৃষ্টি মেললো। সম্মুখে কেউ নেই। ছুটে বের হয় ইরা। সদর দরজায় এসে গতিরোধ হয় তার। লিফট ততক্ষণে বন্ধ হয়ে যায়।

চলবে…