#রঙিন_রোদ
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১২
দিন চলে যায় আপন-গতিতে। দেখতে দেখতে আরও দুইদিন চলে গিয়েছে। আরশির বাবা-মা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরশির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এরপর আরো একদিন কেটে গেল। এর মাঝেই একদিন শোনা গেলো, লুৎফর আহমেদদের মেডিকেলটা অনেক বড়ো অফিসারদের হাতে করতলগত হয়েছে। বাসার সবার মাথায় চিন্তা ভর করলো। পরিবারে একের পর এক এসব কী নেমে আসছে! মেডিকেল বন্ধ হয়ে গেল। মৃত্তিকাদের ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হলো। লুৎফর আহমেদ এটা শুনে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি কোনোমতেই শুয়ে থাকতে চাইছেন না। লুৎফর আহমেদের বিশ্বস্ত কয়েকজনকে মেডিকেলের ওখানে পাঠিয়েও কোনো লাভ হলো না। পুলিশ মেডিকেলটাকে ঘিরে আছে। এসবের কারণে লুৎফর আহমেদ মানসিক-ভাবে আরো বেশি ভেঙে পড়েছেন। বাসার সবার চোখে চিন্তায় ঘুম নেই। রিনি আর মৃত্তিকা কোনোমতে উনাকে সামলে তারা ওখানকার পরিস্তিতিটা অবলোকন করার জন্য মেডিকেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
মেডিকেলের ধারে গিয়ে পৌঁছাতেই তারা দুই’জনেই রিকশা’র ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেল।
রিনি আর মৃত্তিকা একটু এগিয়ে গেল। চারপাশে বিভিন্ন মানুষের ছড়াছড়ি। পুলিশ চারদিকে ঘেরাও করে রেখেছে। স্টুডেন্টরা জিনিসপত্র নামিয়ে মাথার উপর এক-বোঝা পরিমান চিন্তা নিয়ে হল ছেড়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। চারদিকে অনেক পরিমান শ্রমিক। মেডিকেলের এক পাশ ভেঙে ফেলেছে। মৃত্তিকা’র এসব দেখে হঠাৎ করে ভীষণ রকম খারাপ লেগে গেল। এই মেডিকেলে কত স্টুডেন্ট কত দূর থেকে স্বপ্ন দেখে পড়তে এসেছে অথচ আজ তারা অসহায়। আজ সব খালি। তার আর সিয়ার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মেডিকেলে। এই হলটাতে তারা দুইজনে কত হাসি-তামাশা করতো। অথচ তারা মেডিকেলটাকে নিমিষের মধ্যে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে! মৃত্তিকার নিজের জন্য চিন্তা হচ্ছে না। তার বড়ো মামার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। তিনি কত কষ্ট করে স্বপ্ন দেখে তিল তিল করে এই মেডিকেলটা তুলেছে অথচ এই পাষান লোকগুলো এক নিমিষে চুরমার করে দিচ্ছে। রিনি’র চোখ গড়িয়ে অশ্রু নির্গত হচ্ছে। তার বাবা- ভাইয়ের এতো কষ্টের উপার্জনের টাকা!
মৃত্তিকা রিনিকে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখলো, অদূরে মেডিকেলের প্রবেশ পথের ভেতরে কয়েকজন লোক হাতে কিছু একটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তবা ফাইলের মতো কিছু একটা হবে। তারা কয়েকজন একটা লোককে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে লোকটা এদের ইশারা করে কিছু একটা বলছে। হয়ত দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে, হয়ত কোনো বড়ো অফিসার। মৃত্তিকার কেন জানি মনে হচ্ছে এই লোকটার এরূপ পেছন সাইট সে কোথাও দেখেছে কিন্তু ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না। লোকটা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বলে মৃত্তিকা ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু তার মনে হচ্ছে, এই লোকটাকে সে অনেক কাছ থেকে কোথাও দেখেছে কিন্তু যায় হোক, মৃত্তিকাদের যে এই মানুষটার সাথে কথা বলতেই হবে। কেন তারা লুৎফর আহমেদের এতো স্বপ্নের ভবনটা এক নিমিষের মধ্যে ভেঙে ফেলছে! বাইরের মানুষ ওখানে যেতে পারছে না। মৃত্তিকা আর রিনি হাজার চেষ্টা করেও ওখানে যেতে পারলো না। পুলিশ আটকে ধরে ফেলল।
মৃত্তিকা পুলিশকে বুঝিয়ে বলতে লাগলো, যাতে করে ওখানে একটু মৃত্তিকা আর রিমিকে যেন যেতে দেওয়া হয় কিন্তু পুলিশ’রা তা শোনার চেষ্টা করছে না। তাদের এক কথা, তাদের ওই স্যার কাওকে ওখানে যেতে অনুমতি দিবে না। মৃত্তিকা আর রিনি দুইজনেই হতাশ হলো।
মৃত্তিকা আর রিনি নিরাশ হয়ে শেষবারের মতো আবার পুলিশটাকে অনুরোধ করল, শুধুমাত্র একটিবার যেন তারা মানুষটার সাথে দেখা করতে পারে। ওইজায়গার লোকগুলো আস্তে আস্তে সরে গিয়ে ওই অফিসারকে জায়গা দিতেই মৃত্তিকা বুঝতে পারলো হয়ত অফিসারটা চলে যাবে। তার আগেই যেভাবেই হোক, ওই লোকটার সাথে দেখা করতেই হবে। মৃত্তিকা পুলিশকে অনুরোধ করল, একটু করে দেখা হলেই তারা চলে যাবে কিন্তু পুলিশটা তাতেও রাজি না হওয়ায় মৃত্তিকা ওই অফিসারটার উদ্দেশ্যে জোরে ‘স্যার’ বলে চিৎকার দিলো। তার চিৎকার শুনে ওই অফিসারটা হাঁটা থামিয়ে তার দিকে ফিরতেই মৃত্তিকা চমকে স্তব্ধ হয়ে গেল।
এদিকে পুলিশগুলো মৃত্তিকা ঐভাবে এতো জোরে চিৎকার দেওয়ার ফলে তার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আজেবাজে গালি দিয়ে তাকে সরাতে চেষ্টা করেও পারলো না। রিনি পুলিশদের এমন অকত্য ভাষায় গালি শুনে চোখ-মুখ কুঁচকে অপমানে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মৃত্তিকার হাত ধরে টানতে লাগলো কিন্তু মৃত্তিকা শক্ত হয়ে এক দৃষ্টিতে ওই অফিসার’টার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে এক-পাও নাড়াচ্ছে না।
অফিসারটা নিজেই রিনি-মৃত্তিকাদের দিকে এগিয়ে আসতেই পুলিশগুলো মাথা নিচু করে সালাম দিয়ে সরে দাঁড়ালো। এতে মৃত্তিকা আরো বেশি চমকে গেল।
তার মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না। অফিসার’টার গাড়ি এসে দাঁড়াতেই পুলিশ সবাইকে সরিয়ে দিতে লাগলো কিন্তু মৃত্তিকা সরলো না। রিনি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে টানতে টানতে ব্যর্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
অফিসারটা মৃত্তিকাদের পাশ দিয়ে গাড়িতে উঠতে গিয়ে মৃত্তিকার দিকে ফিরে আরেকটু এগিয়ে এলো।
-‘আ… আদিব তুমি?’
-‘আদিব নয়। রিফাত চৌধুরী।’
মৃত্তিকা স্তব্ধ দৃষ্টিতে আদিবের দিকে তাকালো। কী বলছে এসব!
-‘এ.. সব কী!’
আদিব চোখ থেকে চশমা খুলে সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে জবাব দিল,
-‘লুৎফর আহমেদ আই মিন তোমার মামা’র এই মেডিকেলটা তার অবৈধ উপার্জনে গড়ে তোলা। সব প্রমান আমাদের হাতে আছে। খুব শীঘ্রই উনাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’ বলেই চশমা পড়ে দ্রুত পদে হেটে গাড়িতে উঠে গেলো। আদিব গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। পেছন থেকে আরও কিছু পুলিশের গাড়ির হর্ন বাজতেই মৃত্তিকার হুশ ফিরলো। রিনি তাড়াতাড়ি মৃত্তিকাকে সাইট করে নিয়ে এলো। পরপর কয়েকটা পুলিশের গাড়ি আদিবের গাড়ির পেছনে অনুসরণ করে চলল। মৃত্তিকা সব দেখে ঘোরে চলে গেল। এসব কী বলছে! এসব কী আধো তার চোখের ভ্রম না-কি সব সত্যি! আদিব এই জায়গায় কীভাবে পৌছালো! আর তার চেয়ে বড়ো কথা, এসব কী বলল সে! তার মামা’র অবৈধ ব্যাবসা মানে!
মৃত্তিকার পাশে রিনিও এসব শুনে থমকে গেল। এই মাত্র লোকটা কী বলে গেল! এটা কী আধো সত্যি!
.
.
সেদিনের পর মৃত্তিকা আরও চুপচাপ হয়ে গেল। একের পর এক ঘটা সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এসবের কারণে সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে! একের পর এক চমক নিতে পারছে না আর সে! এসব কী হচ্ছে তার সাথে! মৃত্তিকা মাথাটা চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লো।
রিনি এসে লুৎফর আহমেদকে সব বলতেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
এর একদিন পর মেডিকেলটা সম্পূর্ণ ভাঙার কাজ শেষ হলো। এখন সেখানে আর আগের মতো এতো আকর্ষণীয় লাগে না, শুধুমাত্র একটি খালি জমিই। এসব শুনে লুৎফর আহমেদ একেবারে শুয়ে গেলেন, তিনি এখন আর উঠে বসতেও পারেন না।
হঠাৎ একদিন লুৎফর আহমেদ রুমি আহমেদ’কে আলাদাভাবে ডেকে পাঠালো কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে। তিনি রুম থেকে সবাইকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন। শুধুমাত্র রুমি আহমেদকে থাকতে বলেন। অস্পষ্ট সুরে তিনি রুমি আহমেদের উদ্দেশ্যে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলেন,’বোন আজ তোকে সবচেয়ে সত্য কথা যেটা স্বয়ং তোর থেকেও লুকিয়েছি। সেটাই বলবো। হয়ত আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পুরুষ ভাববি। হয়ত এখন তোর পছন্দের মধ্যে আমি শীর্ষ আছি কিন্তু এই কথা শুনার পর তোর ঘৃণার জায়গায় আমাকে বসাবি কিন্তু কিছুই করার নেই। আমি আর কষ্টের বোঝা সহ্য করতে পারছি না।’
রুমি আহমেদ বুঝতে পারলো না কী এমন বলবে তার ভাই যার ফলে ঘৃণা করবে তাকে! রুমি আহমেদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকাতেই লুৎফর আহমেদ শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শোয়া অবস্থায় বলে উঠল,
-‘আমি শফিকে খু’ন করেছিলাম। তোর আজ এই দশা’র জন্য আমি’ই দায়ী। একমাত্র তোর বড়ো ভাই লুৎফর দায়ী।’ বলতে বলতেই তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন কিন্তু এইবার আর রুমি আহমেদ তার ভাইয়ের কান্না দেখে সান্ত্বনা দিতে দৌড়ে আসলো না। সে একজায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।