রঙ বেরঙে প্রণয় পর্ব-০৫

0
82

#রঙ_বেরঙে_প্রণয়
#পর্ব_৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

একদিন বাড়ির দেয়াল টপকে আগন্তুক বাড়ির পেছনে এসে পাইপের সাহায্যে দোতলায় উঠে দু’টো চিঠি ফাইজার রুমের বেলকনিতে রেখে গিয়েছিল। বিষয়টা জানার পর ফাইজা অবশ্য ভয়ই পেয়েছিল। কারণ বেলকনিতে আসা তো মুখের কথা নয়! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এতদিনেও লোকটার পরিচয় জানতে পারেনি ফাইজা। ফোনের রিংটোনের আওয়াজে ভাবনার ছেদ ঘটল ফাইজার। সেই অপরিচিত নম্বরটা! অর্থাৎ আগন্তুক কল দিয়েছে। ফাইজার অস্থির লাগছে ভীষণ, হার্টবিট স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেড়েও গেছে হয়তো। কেমন সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। ইতস্ততভাবে শেষমেশ কলটা রিসিভ করলো। সাথে সাথে ওপাশ থেকে শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেলো।
” এতো আনমনে কী ভাবছেন? ”
লোকটা কখনো কল দিয়ে ফর্মালিটি করে না। যেটুকু বলার শুধু সেটুকুই বলে। তবে ফাইজা এখন কীভাবে বলবে উনাকে,তাকে নিয়েই তো ভাবনায় মশগুল ছিলো। কিছু একটা তো বলা উচিত! ফাইজা ল্যাম্পপোস্টের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। আবছা আলোতে লোকটাকে পায়চারি করতে দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর দিকে তাকিয়েই লোকটা হাঁটছে।
” না মানে আসলে আপনি কে সেটাই ভাবছিলাম! ”
কথা বলতে গিয়ে ফাইজার কণ্ঠস্বর বারবার কেঁপে কেঁপে উঠল। আগন্তুক নিঃশব্দে মুচকি হাসলো। একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,
” আমি আগন্তুক! ”
” মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে আপনার সাথে আর কথা বলবো না। আর বেলকনিতেও দাঁড়াব না। কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ”
” আজীবন অভ্যাস হয়ে থাকতে চাইলে রাখবেন? ”
একটু নড়েচড়ে উঠলো ফাইজা। এলোমেলো দৃষ্টিতে বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না এখন।
” আপনি কোথায়?”
” আমার যা দেখার ছিলো দেখা হয়ে গেছে। উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। আজকের মতো শুভ রাত্রি। ”
ফাইজা জানে এখন ও চাইলেও অতিরিক্ত এক সেকেন্ডও কলে কথা বলবে না আগন্তুক। এরমধ্যেই অপরপ্রান্ত থেকে কল কেটে দিয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফাইজা। তারপর নিজের বিছানায় গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো। এই পৃথিবীতে ভালোবাসার বিশ্লেষণ আলাদা আলাদা করে দেওয়া হয়। তেমনই কিছু কিছু ভালোবাসার ধরণও আলাদা হয়। কেউ প্রকাশ্যে ভালোবাসে কেউবা গোপনে, কেউ পাগলামি করে কেউবা নীরবে নিভৃতে!

বর্ষার সকাল, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। সাথে একটু-আধটু ঝরো হাওয়া। টিং টিং আওয়াজ করে এলাকার সবচেয়ে বড়ো ভার্সিটির দিকে এগোচ্ছে পায়ে চালিত রিকশা, তাতে বসে আছে তাহমি, পরনে টপস আর স্কার্ট, হাতে পার্পল রঙের ছাতা। বাসে চলাচল করতে ভালো লাগে না ওর। অনেক লোকজন থাকে বাসে। বিশেষ করে বাসের মধ্যে হ্যারাসমেন্টের আশংকা থাকে। সেদিন লোকাল বাসে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, পাশে দু’টো মাঝবয়েসী লোক! তাহমি আগেভাগে বাসে উঠেছিল বলে সিট পেয়ে গেছিলো অবশ্য। বাস চলাকালীন হঠাৎ মেয়েটির দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আঁতকে উঠে। মাঝবয়েসী লোক দু’টোর মধ্যে একজন মেয়েটিকে পেছন থেকে বাজেভাবে স্পর্শ করছিল। অন্যজন তেমন কিছু না করলেও বিষয়টা দেখে বেশ মজা নিচ্ছিল। মেয়েটি হয়তো দূর্বল চিত্তের, সেজন্য প্রতিবাদ করার বদলে বারবার চেষ্টা করছিল একটু সামনে এগিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু লোকটা এতো অসভ্য মেয়েটার পেছন পেছন সেও সামনে এগিয়ে দাঁড়ায়। তাহমি সেদিন লোকটাকে সবার সামনে এক্সপোজ করে ঠিকই, কিন্তু এরকম ঘটনা তো অহরহ ঘটে।

” আফা আইসা পড়ছি তো। ”
রিকশাওয়ালা মামার কথায় সংবিৎ ফিরে পেলো তাহমি। ব্যাগ থেকে ভাড়ার টাকা হাতে নিয়ে রিকশা থেকে নামলো।
” ওহ হ্যাঁ। এই নিন ভাড়া। ”
লোকটা ভাড়া নিয়ে আবারও রিকশা নিয়ে যাত্রীর আশায় অন্য দিকে গেলো। তাহমি ক্যাম্পাসে ঢুকতেই সালমা, আফিয়া ও সানজিদা এগিয়ে এলো। বৃষ্টির মধ্যেও ওদের হাঁটাচলা করতে হবে।

” কী অবস্থা তোর? ”
আফিয়া তাহমির চুলগুলো হাত দিয়ে মুছে দেওয়ার ভঙ্গি করে শুধালো। ছাতা থাকা স্বত্বেও একটু-আধটু পানির ছিটে লেগেছে।
” বিন্দাস। তোদের কী খবর? শুনলাম সালমা আপার বিয়ে? ”
তাহমির কথায় সালমা লাজুক ভঙ্গিতে মুচকি হাসলো। মেয়েটা ভীষণ শান্ত, লাজুক স্বভাবের। সানজিদা তাতে আরো পেয়ে বসলো ওকে।
” আরে ঠিক শুনেছিস তুই। পেত্নীটা ওর কাজিনকেই বিয়ে করবে শেষপর্যন্ত। ”
” কাজিনকে! ”
সানজিদার কথায় হেঁচকি উঠে গেছে। সাথে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সালমার দিকে। তাহমির হেঁচকি দেখে নিজের ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিলো আফিয়া। ও আবার সব সময় সাথে পানি রাখে। তাহমি বোতল থেকে দুই ঢোক পানি পান করে একটু ধাতস্থ হয়ে নিলো। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সানজিদা এখন উত্তর দিলো,
” হ্যাঁ, ওর চাচাতো ভাইকেই বিয়ে করছে ও। কিন্তু তাতে তুই এমন থতমত খেয়ে গেলি কেন? তোরও কি এমন কোন ব্যাপারস্যাপার আছে না-কি? হে হে…..”
” হুঁশ! ছোটোবেলা থেকে ভাই ডাকলাম যাকে তাকে বিয়ে! চুপ বেয়াদব মেয়ে।”
সানজিদার মাথায় গাট্টা মারলো তাহমি। তাতে সবাই হেসে উঠলো একসাথে।
” ভাই ভার্সিটির ভেতরে চল! বৃষ্টির তোপ বাড়ছে, ছাতা দিয়ে কাজ হচ্ছে না কিন্তু। ”
আফিয়ার কথায় সবাই একমত হলো। চারজন একসাথে ভার্সিটির ভেতরে যাবে বলে এগোতে লাগলো।

” তাহমি! কী করছিস এটা? এভাবে পেছন থেকে দু-হাত ধরে রেখেছিস কেনো? ”
” হাত না ধরে রাখলে তোমাকে মনমতো আদর করতে পারবোনা। নড়াচড়া করো না, ঘাড়ে আস্তে করে একটা কামড় দিবো শুধু। ”
সহন কিছু বলার আগেই তাহমি দাঁত বসিয়ে দিলো ওর ঘাড়ে। মৃদু গোঙানির মতো শব্দ শুনে তাহমি ছেড়ে দিলো সহনকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে মেয়েটা। সহন বেশ রেগে গেছে।
” তোর এই কুত্তা মার্কা স্বভাব যদি না বদলাতে পারিস তবে তোর দাঁত ভেঙে দিবো আমি। আর হ্যাঁ এতো নির্লজ্জ কেমনে হয় কেউ? আমি তোর ভাই হই! আমাকে আদর…”

সহনের কথা শেষ হওয়ার আগেই তাহমি চোখের পলকে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো ওর ঠোঁটে। সহন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখগুলো এতো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি কোটর থেকে বেরিয়ে যাবে। তাহমির তাতে কিচ্ছু যায় আসছে না। সে সহনের বক্ষে হাত রেখে গভীরভাবে চুম্বনে লিপ্ত।

” উফ! আরেকটু সময় করতে দাও। সরো, সরো। উফ….”

নিজের শরীরে কেউ অবিরত ঠেলাঠেলি করায় ঘুম থেকে হকচকিয়ে উঠে বসলো তাহমি। ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকাতেই দেখলো তার একমাত্র মা কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। তাহলে মা এতক্ষণ ঠেলে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছিলেন?

” কী করতে দিবো? আজ শুক্রবার! তোর না আমার সাথে শপিংমলে যাওয়ার কথা? সাড়ে দশটা বেজেছে। ”

ঘুমের রেশ কাটতেই সবকিছু মনে পড়লো তাহমির। আরে! সত্যি তো বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো আজ। সালমার বিয়ের জন্য গিফটও তো কিনতে হবে? বসা থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো তাহমি। খোলা চুলগুলো মেসি বান করতে করতে ওয়াশরুমের দিকে এগোতে এগোতে বললো,
” তুমি যাও মা। আমি পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলে আসছি৷ ”
জাহানারা খান মেয়ের কথায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ওয়াশরুমের দরজা আঁটকে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছে ও। একটু আগে কী স্বপ্ন দেখলো ভেবে অবাক হচ্ছে। সহনকে নিয়ে এমন ভাবনা তো কখনো মনেই আসেনি! তাহলে এসব আজাইরা স্বপ্ন কেন দেখলো? সালমা তার কাজিনকে বিয়ে করবে সেইজন্য কি এসব ভাবনা? আনমনে আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই লিপ কিসের কথা মনে পড়লো। যদিও স্বপ ছিলো কিন্তু অনুভূতিটা বড্ড জীবন্ত মনে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে নিজের ঠোঁটে আঙুল রেখে একটু হাসলো তাহমি। পরক্ষণেই সহনের কথা মনে পড়াতে জোরসে একটা থাপ্পড় বসালো নিজের গালেই। এমন স্বপ্ন আর কখনো দেখলে খবর আছে বলে কিছুক্ষণ নিজেকে শাসিয়েও নিলো।

” তাহমি! ছয় মিনিট হতে চললো… ওয়াশরুমের ভেতর আবার ঘুমিয়ে যাসনা। ”

মায়ের ডাকে সব চিন্তাভাবনা সাইডে রেখে তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করতে লাগলো মেয়েটা।

শুক্রবার অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা। ছুটির দিন হওয়ার সুবাদে কোনো প্যারা থাকে না সহনের। কিন্তু বিকেলবেলা শায়লার মায়ের ফোনে সেই ভাবনা বদলে গেলো ওর। শনিবার এক আত্মীয়ের বাসায় যাবে বলে শুক্রবার পড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন ভদ্রমহিলা। যদিও বিষয়টা বিরক্তিকর কিন্তু সহন উনার মুখের উপর না করতে পারেনি। ভেবেছিলো রাতে ছাদে পিকনিক করবে তিনজনে মিলে। ফাইজাকে বললেও তাহমিকে বলা হয়নি যদিও। তবে প্ল্যান করেছিল! জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বুকের ভেতর আফসোসের নিঃশ্বাসটা বের করে দিলো সহন। কালকে পিকনিক করলেও বা সমস্যা কী! রাতে তো সবাই ফ্রি থাকে।

চলবে,