রঙ বেরঙে প্রণয় পর্ব-০৮

0
77

#রঙ_বেরঙে_প্রণয়
#পর্ব_৮
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” তাহমি! এখান থেকে চলে যা বলছি। বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো। ”

রুদ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই তাহমি হাতে থাকা গ্লাসের সবটুকু ড্রিংকস রুদ্রর মুখে ছুড়ে ফেললো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে সবাই। রুদ্র নিজেও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সবাই বিস্ময়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্রর বিস্ময় কাটার আগেই তাহমি পরপর দুই গালে দু’টো থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ওর। সুনয়না ভয়ে একটু কেঁপে উঠল। রুদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাহমির চোখে যে কষ্ট, রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা জ্বলজ্বল করছে সেটা এতক্ষণে দৃষ্টিগোচর হয়েছে ওর।
” তোর কি মনে হয় আমি এখনো তোকে ভিক্ষা চাইতে এসেছি এখানে? এতটা ভিখারি নই আমি মি. রুদ্র। আজ আমি বেহায়া, নির্লজ্জ আরো কতকিছুই! অথচ সম্পর্কের শুরুতে আমার এসব দিকেই আকৃষ্ট হতিস। নতুন নতুন সবকিছু খুব টেস্ট বাট পুরনো হলেই সেই টেস্ট মিষ্টির বদলে তেঁতো হয়ে যায় তাই না? ”
তাহমি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিলো একটু। এরমধ্যে রুদ্রর বাবা এগিয়ে আসতে গেলে রুদ্র ইশারায় বারণ করলো। তাহমি ফের বলতে লাগল,
” যদি সম্পর্কটা জাস্ট টাইম পাস থাকে সেটা প্রথম থেকেই পার্টনারকে বলতে হয়। আর আমি টক্সিক? হ্যাঁ আমি তো এমনই ছিলাম রুদ্র! আমি তো একটুও বদলাইনি। বরং তুই পাল্টে গেছিস। এই যে হুট করে ব্রেকআপ করে দিয়ে বিয়ে করে নিলি একটিবারের মতোও কি ভেবেছিস আমার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে ? হ্যাঁ মানছি আমিও তোকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি না। নিজেকে ভালোবেসে তারপরই তোর কথা ভাবি। কিন্তু আমি যদি আরো সিরিয়াস হতাম! জাস্ট চিন্তা কর একবার, একটা মানুষের সাথে তোর দীর্ঘ দিন কথা হয়, একসাথে টাইম স্পেন্ড করিস, হাত ধরে চলিস, কতশত স্মৃতি! ওই যে ফোন নম্বর থেকে কল আসা, হুটহাট ভিডিয়ো কল, টেক্সট এগুলো সব, সব যখন ধুম করে নাই হয়ে যায় কীভাবে সহ্য করে বিপরীত দিকের মানুষটা? সহ্য করতে কষ্ট হয় রে। দম বন্ধ হয়ে আসে। রাতে ঘুম আসে না, খেতে গেলে গলা দিয়ে ভাত নামে না, মাঝরাতে হুট করে ঘুম ভেঙে গেলে মস্তিষ্কে এটাই প্রথম আসে মানুষটা আর আমার নাই। রুদ্র তুই বুঝতে পারছিস? জাস্ট নাই সেই মানুষটা! তখন সেই মাঝরাতে যখন স্মৃতিগুলো হৃদয়ে কীটপতঙ্গের মতো কিলবিল করে বুকটা কেমন করে জানিস? উঁহু সেটা তুই জানবি না। কারণ তোর সাথে এমন হয়নি। এসবকিছু বাদ দিয়ে যখন মনে হয় যে মানুষটার হাতের স্পর্শ থেকে শুরু করে গভীর আলিঙ্গনে শুধু আমার থাকার কথা ছিলো সেই মানুষটাকে অন্য কেউ ছুঁয়ে দিবে। আহ! ”

রুদ্র হুট করে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। তাহমির রাগ-ক্ষোভ এখন দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে। দু-চোখ ছলছল করছে মেয়েটার। সুনয়নার চোখ থেকে এরমধ্যেই একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। তাহমির প্রতি কোনো হিংসা কাজ করছে না ওর। কথাগুলো যেনো বুকে বিঁধছে। সহন কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছুই দেখছে। ভেবেছিল ঝামেলা বাড়লে তাহমিকে জোর করে নিয়ে যাবে৷ কিন্তু এখন যা হচ্ছে সেটাতে আর ঢুকতে চাচ্ছে না ও। কথাগুলো বললে মনটা হালকা হবে তাহমির।

” তাহমি আমি… ”
” চুপ! আমি বলি তুই শোন রুদ্র। একটা সম্পর্কে থাকতে গেলে কিছু বিষয় দু’জনকেই মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়। মানুষ তো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, কিছু না কিছু ত্রুটি থাকেই। কিন্তু ভালোবাসা থাকলে সব কিছু ব্যালেন্স করে চলা যায়। আমাদের হয়তো সেই ভালোবাসা ছিলো না। যদিও তোর প্রতি রাগ থেকেই এসেছিলাম কিন্তু ওই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেছি আমি। তোর বউ খুব ভালো মনের মেয়ে। দেখ না আমার কষ্টে কেমন কাঁদছে! কখনো শুনেছিস কোনো মেয়ে স্বামীর এক্স গার্লফ্রেন্ডের দুঃখবিলাস দেখে অশ্রুপাত করে! ”

রুদ্র তাহমির দুহাত আঁকড়ে ধরে। তাহমি হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সবাই চুপ করে আছে। বিষয়টা বড্ড সেনসেটিভ।

” আমাকে ক্ষমা করে দে তাহমি। আমার দিক থেকে কিছু খামতি ছিলো। আমার উচিত ছিলো আরেকটু এডজাস্ট করা। কিন্তু সম্ভব হয়নি সেটা। সবকিছুর উপর তকদির বলতে একটা বিষয় আছে। আমরা কেউ চাইলেও তা পরিবর্তন করতে পারি না। ”

” হ্যাঁ। বাদ দে, চল। ”
তাহমি দীর্ঘশ্বাস আঁটকে শুকনো ঢোক গিলে বললো।
” কোথায়!”
” আয় না।”

তাহমি রুদ্রর হাত ধরে সুনয়নার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সুনয়না নিজেকে সামলে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পরিবারের পীড়াপীড়ি সহ্য করতে না পেরেই রুদ্রকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে সুনয়না। তবে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ঘটে যাওয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগত সময়কে নষ্ট করতে চায় না ও।

” এই যে ভালো মেয়ে, এই নাও তোমার বর। ক্ষমা করে দিও আমাকে। আজকের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে তোমাদের বিরক্ত করলাম। ”
তাহমি রুদ্রর হাতটা সুনয়নার হাতে দিয়ে মৃদু হেসে বললো। সুনয়না মিষ্টি করে হাসলো।
” বাদ দাও এসব। আমি সবকিছু ভুলে গেছি। চলো কিছু খাবে বরং। ”
” নাহ গো। এখন চলে যাবো। হয়তো কখনো দেখা হবে না কিন্তু তোমাদের জন্য সব সময় প্রার্থনা করবো।”
রুদ্র কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা। কোনো অধিকার নেই তাহমিকে আঁটকে রাখার। এখানে থাকা ওর পক্ষে মোটেও সুখকর না।
” ঠিক আছে। ভালো থেকো তাহমি। ”
” তুমিও সুনয়না। আসি। ”

তাহমি আর এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় না করে দ্রুত পা চালিয়ে রুদ্রদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। সহনও ওর পেছন পেছন যাচ্ছে। গেটের বাইরে বেরোতে পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করায় দাঁড়িয়ে গেলো তাহমি।

” তাহমি তোর কি উচিত ছিলো না রুদ্রকে জেলে পাঠানো? ”
সহনের কথায় চমকাল তাহমি। এখানে কোনোভাবেই আশা করেনি ওকে।
” তুমি এখানে? ”
” হ্যাঁ। ”
তাহমি হাঁটছে রাস্তার পাশ ধরে, সাথে সহনও। তাহমি আরকিছু বলেনি শুধু চুপচাপ হাঁটছে। সারাদিন ফুটতে থাকা গরম পানির মতো মেজাজওয়ালা মেয়েটা এভাবে শান্ত হয়ে হাঁটছে বিষয়টা মোটেও হজম হচ্ছে না সহনের।

” আচ্ছা তাহমি বললি না তো! ”
” কী বলবো?”
” জেলে দিবি? তুই জাস্ট বল। ওকে জন্মের প্রতারণা করিয়ে দিবো আমি। ”
” না ভাইয়া। যে মানুষটা আমার কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে অন্য কাউকে আপন করে নিলো তাকে আর কী শাস্তি দিবো? ”
তাহমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সহনের দিকে। সহনের বুকের ভেতর কেমন মুচড়ে উঠছে। তাহমিকে কখনো এরকম কষ্ট পেতে দেখেনি ও। তাহমির ডান হাতটা নিজের ডানহাতে আলতো করে ধরে আবারো হাঁটতে লাগলো সহন।
” ঠিক বলেছিস। ফুচকা খাবি তাহমি? না-কি আবার ঝালে হাসফাস করবি? ”
” আমি ঝালে হাসফাস করি না-কি তুমি করো? ”
” এহহহ! আমি ঝাল খেতে পারি। ”
তাহমি মুচকি হাসলো।
” বেশ চলো। দেখি আজ কে কতো ঝাল খেতে পারে। ”
” ওকে, ডান।”

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের ফুচকাওয়ালা মামার কাছে গেলো৷ রাত আনুমানিক দশটা ছুঁইছুঁই এখন৷ দোকানে আরো কয়েকজন কাস্টমার আছে। তাহমি ও সহন দোকানের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

” মামা আমাদের দুই প্লেট ঝাল দিয়ে ফুচকা দাও তো৷ ”
সহন তাহমির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো। সত্যি বলতে সহন তেমন ঝাল খেতে পারে না। তাহমি তারচে একটু বেশি পারে।
” একটু দাঁড়ান ভাইজান, দিতাছি। ”
ফুচকাওয়ালা মামা কয়েক মিনিটের মধ্যে চটপট দুই প্লেট ফুচকা রেডি করে দিলো। তাহমি ও সহন দু’জনেই ফুচকা খেতে শুরু করেছে। মোটামুটি ঝাল থাকায় সহন নিজেকে সংযত রেখে এক প্লেট ফুচকা শেষ করে ফেললো। তাহমির ঝাল লাগেনি। সে আরো উৎসাহ নিয়ে ফুচকাওয়ালা মামাকে বলে,
” মামা ঝাল হয়নি তো! আরেকটু ঝাল দাও। ”

” ঠিক আছে আফা। ”

আবারো দুই প্লেট ঝাল ঝাল ফুচকা দিলো ফুচকাওয়ালা মামা। তাহমি ও সহন যথারীতি এই প্লেটও শেষ করে ফেললো। সহন ঝালে একটু-আধটু
হাসফাস করতে শুরু করেছে। ঝালে ভেতর ভেতর শেষ হয়ে যাচ্ছে ও। তাহমির বেশ মজা লাগছে। একটু ঝাল লাগলেও বিষয়টা খুব মজার।

” মামা ঝাল হয়নি তো! আরো ঝাল দাও, আরো। ”

চলবে,